
সাক্ষাৎকারকারী : অস্কার হিহুয়েলোস
অনুবাদ : যুবায়ের মাহবুব
[কিউবান সাহিত্যিক লিওনার্দো পাদুরা ফুয়েন্তেস ১৯৫৫ সালে রাজধানী হাভানায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত সৃষ্টি ডিটেকটিভ মারিও কোন্দে, আজ অব্দি আটটি উপন্যাস লিখেছেন এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে। বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছেন, জিতেছেন অসংখ্য পুরস্কার। রুশ বিপ্লবের নেতা লিওন ট্রটস্কি এবং তার আততায়ীকে নিয়ে সম্প্রতি লিখেছেন ঐতিহাসিক উপন্যাস “যে মানুষটি কুকুর ভালোবাসতো”। ২০১২ সালে কিউবার জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন, এবং এই বছর (২০১৫ সালে) জিতেছেন হিস্পানিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরষ্কার “প্রেমিও আস্তুরিয়াস”। আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং গিয়ের্মো কাব্রেরা ইনফান্তে’র যোগ্য উত্তরসুরী পাদুরা আধুনিক কিউবার শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে স্বীকৃত। গুরুত্বপূর্ণ এই লেখকের সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন অনুবাদক যুবায়ের মাহবুব।]

অস্কার হিহুয়েলোস রচিত ভূমিকা —
ফিদেল কাস্ত্রোর কমিউনিস্ট বিপ্লবের পূর্বে রাজধানী হাভানা শহরের জমকালো গোলক-ধাঁধা আর পাপ-পঙ্কিল আতিশয্যের বর্ণনা লিখে গেছেন কিউবার দুই মহান লেখক হোসে লেজামা লিমা এবং গিয়ের্মো কাব্রেরা ইনফান্তে। তাদের অন্তর্ধানের পরে ঐতিহ্যময় এই নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখকের ভূমিকায় অতি সহজেই অবতীর্ণ হয়েছেন লিওনার্দো পাদুরা ফুয়েন্তেস। কিন্তু পাদুরার হাভানা আর তার পূর্বসুরীদের হাভানা দুটি পৃথক শহর। পাদুরার সুবিখ্যাত চরিত্র মারিও কোন্দে একজন পুলিশ ডিটেকটিভ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে নির্মোহ এক চরিত্র। পেশাগত নানান এডভেঞ্চার তাকে নিয়ে যায় নগরীর পুঁতিগন্ধময় জঠরে। সময়কাল নব্বইয়ের দশকের “বিশেষ অবস্থা” (Período especial)—সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবার ফলে কিউবার অর্থনীতিতে নেমেছিল মহামন্দার বিষবাষ্প। হাভানার জনগণ যেমন চতুর তেমনই মরিয়া, বেঁচে থাকার জন্যে হেন কোন ধান্দা নেই যে ওরা চেষ্টা করে দেখবে না। সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক হিসেবে পাদুরা হয়তো হাভানার অন্ধকার দিক সম্পর্কে যা কিছু জানার, তার সবই অবগত আছেন। মারিও কোন্দে সিরিজের চারটি উপন্যাসে তিনি পরম অসংকোচে এঁকেছেন কিউবার আপামর জনসাধারণের অর্থনৈতিক দুর্দশা ও নিরন্তর কৃচ্ছসাধনের চিত্র। হাভানা রেড, হাভানা ব্লু, হাভানা গোল্ড এবং হাভানা ব্ল্যাক শিরোনামের চারটি বই-ই নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত হয়। কাস্ত্রো সরকারের কঠোর সেন্সরশিপ সর্বজনবিদিত, সেই পরিপ্রেক্ষিতে পাদুরার অকপট উচ্চারণ সততই বিস্ময়কর।
তবে বইগুলো মূলত ডিটেকটিভ তদন্তের গল্প, রাজনীতির প্রশ্নে খুব শক্ত অবস্থান সেখানে নেই। পাদুরার চরিত্ররা নির্লিপ্ত-নির্বিকার, ফিদেলের অধীনে দুরূহ জীবনযাপনে তারা নেহায়েত অভ্যস্ত। হয়তো একারণেই সরকারের শ্বাসরোধ করা নজরদারি থেকে রেহাই পেয়ে গেছেন লেখক। ঘটনার সত্যাসত্য যাই হোক, পাদুরার বলিষ্ঠ সুরেলা গদ্য, তার রসবোধ, জ্বলজ্বলে যৌনতা এবং রহস্যময় সব গল্পকাহিনী তাকে দেশে ও বিদেশে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। এমনকি আমার যেসব কিউবান বন্ধু ছোটবেলা থেকে আমেরিকায় বড় হয়েছে, পরিবারের সাথে পালিয়ে এসেছিল বিপ্লবের পরে, তারাও অতি আগ্রহে পাদুরার উপন্যাস পড়ে। এর পেছনে একটি কারন পাদুরা কিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন না, কিন্তু মূল কারন পাদুরার সৃষ্ট কাল্পনিক জগৎ এবং তার চরিত্রসমূহ এতটাই উপভোগ্য, পরতে পরতে এতটাই কিউবান।
পাদুরার বাবা ছিলেন বাস ড্রাইভার। হাভানার দক্ষিণে মান্তিয়া নামের জরাজীর্ণ এক শহরতলিতে পরিবারের বসবাস ছিল, আজও সেই পৈত্রিক বাড়িতেই থাকেন পাদুরা এবং তার স্ত্রী লুসিয়া। ছোটবেলায় বাড়িতে পড়ার মত বই তেমন একটা ছিল না। বেসবল খেলার চরম ভক্ত ছিলেন, স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে ক্রীড়া সাংবাদিক হবেন। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে ইচ্ছা বদলে যায়, আবিষ্কার করেন সাহিত্য নামের নতুন এক ভালোবাসা। বেশ অনেকদিন রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন, অত:পর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। আজ অব্দি প্রকাশ করেছেন প্রায় ত্রিশটির মত বই—ডজনখানেক উপন্যাস, কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলন, চিত্রনাট্য, ইত্যাদি। ২০০৯ সালে ছাপা হয় তার এপিক উপন্যাস El hombre que amaba a los perros (“যে মানুষটি কুকুর ভালবাসতো”)। চল্লিশের দশকের পটভুমিতে লেখা এই বইয়ের প্রধান চরিত্র মেক্সিকোয় নির্বাসিত রুশ বিপ্লবের অন্যতম হোতা লিওন ট্রটস্কি এবং তার স্টালিন-প্রেরিত আততায়ী রামোন মের্কাদের। উপন্যাসটি বোদ্ধামহলে বিপুল সমাদর লাভ করে; ২০১৪ সালের শুরুতে আনা কুশনারের অনুবাদে এর ইংরেজি সংস্করণ বের হয়।
৫৮ বছর বয়েসী পাদুরা খুব সম্ভবত বর্তমান কিউবার সর্বাধিক পরিচিত লেখক। সুখ্যাতির কল্যাণে রাষ্ট্র থেকে বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা মেলে—যার অন্যতম বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা। তথ্যের কঠোর নিয়ন্ত্রনের কারণে কিউবার আমজনতা আজ অব্দি এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তবে হাভানায় আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কয়েক মাস পরে পাদুরা আমাকে লিখে জানিয়েছিলেন—“স্রেফ ধীরগতির ডায়াল-আপ সংযোগ, তাই আমার উত্তর দিতে যদি দিনকয়েক দেরী হয়ে যায়, ক্ষমা করে দিও। কানেকশন পেতে সত্যি অনেক সময় লেগে যায়।” অসাধারণ এই লেখকের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে এই তথ্যটুকু দেয়া দরকার, কারন ইমেইল মারফত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই প্রচুর সময় গিয়েছে, তাই তার ধৈর্য্যের জন্যে লেখককে অশেষ ধন্যবাদ।—অস্কার হিহুয়েলোস
অস্কার হিহুয়েলোস :
বেশ অনেকদিন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার পর আপনি উপন্যাস রচনায় হাত দেন। এই পরিবর্তন কিভাবে সাধন করেছিলেন?
পাদুরা :
সমান্তরাল (এবং প্রায় সম্পুরক) দুটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। যখন ভার্সিটিতে পড়তাম, দু-তিনটে ম্যাগাজিনের জন্যে আমি সাহিত্য সমালোচনা লিখেছিলাম। পাশাপাশি আমার নিজের প্রথম ছোটগল্পগুলোও সে সময়েই লিখতে আরম্ভ করি। গ্র্যাজুয়েশন শেষে ১৯৮০ সালে আমি এল কাইমান বার্বুদো (“শ্মশ্রুধারী কুম্ভীর”) নামে একটি সংস্কৃতি সাময়িকীতে যোগ দেই। আমার মূল কাজ ছিল নতুন বইয়ের রিভিউ করা আর নানা ধরনের প্রবন্ধ লেখা। আমার প্রথম “উদ্ধারযোগ্য” গল্পগুলো সেখানে বসে লিখেছিলাম, আর প্রথম উপন্যাস ফিয়েব্রে দে কাবাইয়োস (“ঘোড়া-জ্বর”) নিয়ে কাজও সেখানেই শুরু করেছিলাম।
১৯৮৩ সালে “শ্মশ্রুধারী কুম্ভীর” থেকে আমাকে পত্রপাঠ বিদায় করা হলো। বলা হলো যে আমার ভেতর নাকি মতাদর্শিক গন্ডগোল আছে। নতুন কাজ জুটলো হুভেন্তুদ রেবেল্দে (” বিদ্রোহী যৌবন”) দৈনিকে। সে আমলে কিউবায় চাকরি দেয়ার একমাত্র মালিক ছিল সরকার বাহাদুর। ওদের যেখানে ইচ্ছা নিয়োগ দিতে পারতো, যেখানে খুশি পাঠাতে পারতো। মোটের উপর দুটো পথ খোলা ছিল—ওদের কথা ভালোয় ভালোয় মেনে নাও, নতুবা যে বিকল্প চাকরি জুটবে তা নিঃসন্দেহে আরো খারাপ। (ট্রটস্কি-কে নিয়ে লেখা উপন্যাসে ইভান চরিত্রের কপালে ঠিক এই ঘটেছিল।)
তো ” বিদ্রোহী যৌবন” পত্রিকাতেই সাংবাদিক হিসেবে আমার প্রকৃত আত্মপ্রকাশ। চাকরি শুরু করার প্রায় সাথে সাথে “ঘোড়া-জ্বর” উপন্যাসের পান্ডুলিপি লিখে শেষ করি, একই সঙ্গে সমাপ্ত করি আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন। ওদিকে পত্রিকায় চাকরির দৈনিক চক্করেও পড়ে গেলাম। আমার অবশ্য কপাল ভাল ছিল—রবিবাসরীয় সংখ্যার জন্যে দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখার দায়িত্বে একটি “স্পেশাল টীম” ছিল, সেখানে জায়গা পেয়ে গেলাম। আমার জীবনের অদ্ভুত এবং অপূর্ব একটি অধ্যায় ছিল সেটি, মনে যা চাইতো তাই নিয়েই লিখতে পারতাম। এমন স্বাধীনতা পত্রিকাজগতে বিরল, কিউবাতে তো আরো বেশি। ফলে যে সব প্রতিবেদন লিখলাম, বেশ উঁচু সাহিত্যমানসম্পন্ন ছিল সেগুলো, ঐতিহাসিক গবেষণার উপর ভালোমত নির্ভরশীল। এতটুকু বলতে পারি যে সেই লেখাগুলো এখন কিউবায় সাংবাদিকতার ক্লাসিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
“বিদ্রোহী যৌবন” পত্রিকায় কাজ করেছিলাম মোট ছয় বছর—১৯৮৪ সালে সমাপ্ত “ঘোড়া-জ্বর” থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, যে বছর মারিও কোন্দে চরিত্রকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাস বেরুলো। ছয় বছরে আমার লেখায় যে বিবর্তন, তা ওই দুটো উপন্যাসের পার্থক্য থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। প্রথম উপন্যাসটি কাঁচা হাতে লিখেছিল এক নবীশ লেখক। আর দ্বিতীয় উপন্যাসের রচয়িতার দখলে ছিল পেশাদারী সাহিত্যিকের প্রয়োজনীয় সকল মাল-মশলা আর কারিগরী দক্ষতা।
অস্কার হিহুয়েলোস :
হাভানার যে পাড়ায় আপনি বড় হয়েছিলেন, এখনো সেই মান্তিয়া-তেই থাকেন। নিশ্চয়ই আপনার কাজের উপর প্রভাব ফেলেছে এটি?
পাদুরা :
তা তো নিশ্চয়ই, সারাজীবন এক জায়গায় কাটিয়ে দিলে আপনার উপর তা প্রভাব ফেলবে বৈকি। আমি আগেও বলেছি, আবারও বলবো—আমার কিউবান বা হাবানেরো পরিচয়ের চেয়েও বড় পরিচয়, আমি একজন মান্তিয়েরো। আমার দেশ কিউবা নয়, বরং মান্তিয়া।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আপনার স্ত্রী লুসিয়া প্রায়ই আপনার সাথে কাজ করেন। সেটা কেমন ভূমিকায়—সম্পাদক নাকি সহ-লেখক?
পাদুরা : লুসিয়া আমার জীবনের অন্যতম আশীর্বাদ—অবশ্য তার মানে এই না যে আমরা সারাক্ষণ ঝগড়া করি না। আটাত্তর সালে আমরা যখন হাভানা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তখন থেকে আমাদের সম্পর্কের শুরু। ওর বয়স ছিল ১৮, আমার ছিল ২২—আর আজ এতদিন পরে আমরা দুজনে একসাথে এখানে। আমার সমগ্র সাহিত্যের পেছনে লুসিয়ার বিশাল প্রভাব আছে, বিভিন্ন কারণে। আমাকে একটা মানসিক স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে ও, আমার সব কটি উপন্যাস পড়েছে, সমালোচনা করেছে—আর এতদিন ধরে আমাকে খাইয়ে-পড়িয়েও রেখেছে লুসিয়া! আমার রচনাবলীর সংকলন প্রকাশ করেছি আমরা দুজনে মিলে, একসাথে সিনেমার স্ক্রিপ্টও লিখেছি। এই মুহুর্তে মারিও কোন্দে-কে কেন্দ্র করে লেখা হাভানা চতুষ্টয়ের প্রথম দুটো বইয়ের চিত্রনাট্য বানাচ্ছি আমরা—জার্মানী আর স্পেনের কয়েকজন প্রযোজক চেষ্টা করছেন একটি সম্ভাব্য টিভি সিরিজ দাঁড় করানো যায় কিনা। কাজটা করে খুবই তৃপ্তি পাচ্ছি, কারণ লুসিয়া এর আগে ফিল্ম জগতে কাজ করতো। বইয়ের পাতা থেকে রূপালি পর্দায় রূপান্তরের সবচেয়ে নিরানন্দ এবং স্বীকৃতিহীন যে কাজটি, সেটিই করে দিচ্ছে লুসিয়া। অর্থাৎ উপন্যাসকে কুপিয়ে কুপিয়ে সিনেমার প্লটের জন্যে খন্ড খন্ড অংশ তুলে আনছে। ফিকশনের ভাষা থেকে ফিল্মের ভাষায় অনুবাদ করা আসলেই ভীষণ কষ্টকর, নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া।
আমার উপন্যাসগুলোর কথায় আসি। আর সবার আগে পান্ডুলিপি পড়ে দেখে লুসিয়া, এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পাই আমি ওর থেকেই। আমি ঠিক কি করতে চাইছি, কি বলতে চাইছি, ওর চেয়ে ভালো কেউ জানে না—তাই যদি কোন কারনে তা বলতে ব্যর্থ হই, আমাকে সঠিক সমাধান ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে ও। এটা ঠিক যে জীবনের কিছু কিছু বিষয়ে ওর ধ্যানধারণা তেমন যুক্তিযুক্ত বা আক্কেলসম্মত নয়। কিন্তু লেখালেখির ব্যাপারে ওর চক্ষু ঈগল পাখির মতই শাণিত—এক ধরনের অমোঘ অজেয় যুক্তি আছে ওর বিচার-বিবেচনায়।
অস্কার হিহুয়েলোস :
এই পত্রিকার পাঠক তালিকায় অনেক লেখক আছেন। তাদের জ্ঞাতার্থে কিউবার প্রকাশনা জগৎ নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলবেন? যেমন ধরুন, কিউবায় বই প্রকাশের প্রক্রিয়াটা কি রকম?
পাদুরা :
খুবই জটিল প্রশ্ন, তবে উত্তর দিতে চেষ্টা করবো। প্রথমেই যেটা বলে নেয়া দরকার, কিউবার সকল প্রকাশনা সংস্থার মালিক হচ্ছে সরকার। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য আছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রভাব হলো রাজনৈতিক। হ্যাঁ, গত কুড়ি বছরে সেন্সরশিপ লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও কি ধরনের লেখা ছাপা হবে বা হবে না, সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ প্রকাশকের এখতিয়ারে। লেখার মান অথবা রাজনৈতিক গুরুত্ব বিচার করে প্রকাশনার জন্যে বই নির্বাচন করা হয়। গোটা প্রকাশনা শিল্পের জন্যে একটি পরিচালনা পর্ষদ আছে, যার নাম কিউবান বুক ইন্সটিটিউট। বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে এরা। তবে ইনস্টিটিউটের বাইরেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন লেখক ইউনিয়ন, যারা আলাদা করে বই ছাপাতে পারে।
হাভানার বাইরে মফস্বল জেলাগুলোয় আপনি মাঝারি বা ছোট আকারের প্রকাশক পাবেন, ওরা মূলত স্থানীয় বা আঞ্চলিক লেখকের লেখা প্রকাশ করে থাকে। লেখকের এডভান্স হিসেবে ওরা আনুমানিক ৩,০০০ থেকে ১০,০০০ পেসো দিতে পারে, ডলার হিসেবে ১২০ থেকে ৪০০ ডলার। বইটি বিক্রি হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। যদি সব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়েও যায়, আবার যে পুনর্মুদ্রণ করা হবে, তেমন কোন গ্যারান্টি নেই। মার্কিন নিষোধাজ্ঞার কারনে দেশে কাগজের ঘাটতি আছে, ওদিকে আরো অন্যান্য লেখক লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের বই ছাপানোর জন্যে। প্রতিটি বইয়ের দাম ধার্য করা হয় এক মার্কিন ডলারের মত, যদিও ছাপার খরচ তার থেকে বেশীই পড়ে—অর্থাৎ পণ্য হিসেবে সরকারী ভর্তুকির সুবিধা পাচ্ছে বইপুস্তক।
এক কথায় যদি বলি—এখানে কোন প্রকাশনা শিল্প নেই, বই বিক্রির উপর কোন লেখকের সাফল্য নির্ভর করে না, আর নতুন বইয়ের জন্যে যে এডভান্স দেয়া হয়, তা লেখকদের জীবনধারণের জন্যে নিতান্তই অপ্রতুল। ৯১ বা ৯২ সালের আগ পর্যন্ত কোন বিদেশী প্রকাশকের সাথে বইয়ের চুক্তি স্বাক্ষর করা রীতিমত অবৈধ ছিল আমাদের জন্যে। কেবলমাত্র নির্দিষ্ট এজেন্সীর মাধ্যমে তা করা যেতো, এবং অবশ্যই রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে। তবে নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক সংকটের সময় এসব নিয়মকানুন আরেকটু শিথিল করা হয়—এখন তো পুরোপুরি হারিয়েই গেছে। আপনি চাইলে নিজের ইচ্ছামত বিদেশী প্রকাশক বা এজেন্টদের সাথে কাজ করতে পারবেন, আমি যেমনটা করি। আমার সব উপন্যাস প্রথমে স্পেন থেকে প্রকাশিত হয়, বার্সেলোনার তুস্কেৎস আমার মূল প্রকাশক। এরপর তুস্কেৎস প্রদত্ত একটি লাইসেন্সের অধীনে কিউবার রাইটার্স ইউনিয়ন একটি স্বদেশী সংস্করণ ছাপায়। এই দেশীয় মুদ্রণটি নিম্ন-মূল্যে বিক্রয় হয়, কেন না কিউবার অধিকাংশ মানুষের গড় আয় অপ্রতুল, মাসপ্রতি বড়জোর ২০-২৫ মার্কিন ডলার। ওদের পক্ষে ২০ ইউরো দিয়ে স্প্যানিশ সংস্করণ কেনা কখনোই সম্ভব নয়। প্রকাশনা পরিস্থিতি বোঝাতে পারলাম কি?
অস্কার হিহুয়েলোস :
আপনি একবার আমাকে বলেছিলেন যে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যিনি বহু বছর ধরে হাভানার অদূরে একটি বাড়ির মালিক, তার সাথে কিউবার লেখকদের যোগাযোগ অতি সামান্যই। তিনি যে পরিমান সময় এই দেশে কাটিয়েছেন, সে বিচারে অন্তত আমার কাছে এটা খুব অদ্ভুত ঠেকেছে। এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করবেন?
পাদুরা : দেখুন, সবার উপরে গার্সিয়া মার্কেসের একজন বন্ধু ছিল কিউবায়—তিনি ফিদেল কাস্ত্রো। আরো কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল তার, মূলত ফিল্মী লাইনের লোক, কারন গার্সিয়া মার্কেস হাভানায় একটি আন্তর্জাতিক ফিল্ম স্কুল আর ল্যাটিন আমেরিকান সিনেমার জন্যে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্থানীয় লেখকদের মধ্যে তার নিকটতম বন্ধু ছিলেন মহাকবি এলিসেও দিয়েগো। তবে হ্যাঁ, এটা খুব কৌতুহলের বিষয় যে তিনি কখনোই অন্যান্য কিউবান লেখকদের ধারে-কাছে ঘেঁষেননি, যেন আমরা তার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নই। আর যে ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তিনি বিচরণ করতেন, সেটা আমাদের মত সাধারণ লেখকদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। হাতেগোণা কয়েকজন শুধু এর ব্যতিক্রম হতে পেরেছেন—ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের, কবি নিকোলাস গিয়েন, আরো দুয়েকজন।
অস্কার হিহুয়েলোস :
পূর্ব প্রজন্মের মহান কিউবান লেখক, যেমন হোসে লেজামা লিমা, আলেহো কার্পেন্তিয়ের বা গিয়ের্মো কাব্রেরা ইনফান্তে, তাদের সাথে কখনো সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন?
পাদুরা :
দুঃখের সাথে বলতে হয় যে পাইনি। লেজামা লিমা আর ভের্হিলিও পিনিয়েরা যেমন অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আমি ভার্সিটিতে থাকাকালীন। সত্তুরের দশকের শেষদিকে সেটা—ওরা দুজনই তখন রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা অচ্ছ্যুত গণ্য হয়েছেন। পুরো দশক ধরে তাদের একঘরে করে রাখা হয়েছিল, মারাও যান একই অবস্থায়। আলেহো কার্পেন্তিয়ের-কে চোখে দেখিনি—তিনি থাকতেন প্যারিসে, ফ্রান্সে কিউবার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখানেই ১৯৮০ সালে তার মৃত্যু হয়। আর কাব্রেরা ইনফান্তের নাগাল পাওয়া তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল—উনি থাকতেন লন্ডনে, আর আমাদের মত যারা কিউবান লেখক, কিউবাতেই যাদের বসবাস, তাদের সাথে সাক্ষাতে তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তার বিচারে আমরা সবাই ছিলাম “কাস্ত্রিস্তা”—বা কাস্ত্রোপন্থী লেখক।
তবে এলিসেও দিয়েগো’র সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। ওর ছেলে এলিসেও আলবের্তো উপন্যাস লিখতো, ওই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বয়োজ্যেষ্ঠ এলিসেও অত্যন্ত চমৎকার মানুষ ছিলেন। আমার সবসময় মনে পড়ে যে লুসিয়াকে তিনি একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন, তাতে লিখেছিলেন “To Lucía, the lucid”। তবে এখানে আমার একটি স্বীকারোক্তি আছে। স্বদেশী হোক বা বিদেশী, আমি কোনদিনও বিখ্যাত লেখকদের বন্ধু হবার জন্যে পেছন পেছন দৌঁড়াইনি। কে যেন একবার বলেছিল না—লেখকের সাথে পরিচয়ের চেয়ে তার বই পড়াই শ্রেয়।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আর রেইনাল্দো আরেনাস? তার বই কি আদৌ বিক্রি হতো কিউবায়?
পাদুরা :
রেইনাল্দো-র সাথেও আমার কোন পরিচয় ছিল না। ১৯৮০ সালে তিনি কিউবা ছেড়ে যান। সে বছর মারিয়েল বন্দর থেকে লক্ষাধিক শরণার্থী খোলা নৌকায় সাগরপাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পৌঁছায়, রেইনাল্দোও ছিলেন তাদের মাঝে। ওর প্রথম উপন্যাসটি কেবল কিউবায় প্রকাশিত হয়েছিল, তারপর একটাও না। আমি ওর প্রচুর লেখা পড়েছি, মুগ্ধ হয়েছি অনেক। আমার মতে কিউবার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখকদের অন্যতম। খুব কষ্টে কেটেছিল ওর জীবন, না হলে হয়তো আমাদের সাহিত্যে আরো অনেক অবদান রেখে যেতে পারতো। অধিকাংশ লেখালেখি করতে হয়েছিল নির্বাসনে বসে। ওর বইগুলোর মধ্যে “বুড়ি রোসা” নামের উপন্যাসিকা আমার সবচেয়ে প্রিয়।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আমাদের পাঠকদের কাছে কিউবার কোন কোন লেখকের লেখা পড়ার পরামর্শ দিবেন?
পাদুরা :
আমি আপনাদের এবিলিও এস্তেভেস-এর লেখা পড়তে বলবো, দুর্দান্ত ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার, বর্তমানে স্পেনে বসবাস করছেন। হাভানা শহরের ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণের জন্যে পেদ্রো হুয়ান গুতিয়েরেস বেশ ভালো। এলিসেও আলবের্তো চমৎকার লেখক ছিলেন—বছর দুই আগে মারা গেছেন মেক্সিকোয়। আর কিউবায় যাদের স্থায়ী বসবাস, তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনের লেখা আমার ভালো লাগে—সেনেল পাস, আর্তুরো আরাঙ্গো, মিগেল মেহিদেস। আরেকজন নবীন লেখিকা আছেন, অবশ্য তিনি পর্তুগালে থাকেন—কার্লা সুয়ারেস, তার লেখাও বেশ উপভোগ করি।
অস্কার হিহুয়েলোস :
প্রাক্তন ডিটেকটিভ মারিও কোন্দে, এবং সমকালীন হাভানায় ওর চমকপ্রদ এডভেঞ্চারের গল্পগুলো আপনাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে যে মারিওর ব্যক্তিত্বে ইন্দ্রিয়বিলাস আর বিষন্নতার যে সংমিশ্রণ, তা একদম নিখাঁদ কিউবান। ভুল বললাম কি?
পাদুরা : না, ভুল বলেননি, তবে আমি আরেকটু খোলাসা করি। মারিও মনে-প্রাণে, অস্থি-মজ্জায় কিউবান। ওর মুখের ভাষা কিউবান, ওর জীবনধারা কিউবান, ওর সকল চিন্তা-চেতনা আর দুঃখ-কষ্টও কিউবান। কিন্তু তবুও ও আপনার গড়পরতা বা টিপিক্যাল কিউবান মানুষ নয়। আর আট-দশজনের তুলনায় ও একটু বেশী চিন্তাশীল, বেশী নস্টালজিক, মোহমুক্ত, বিষাদগ্রস্থ। কিউবার জাতীয় চরিত্রে বরং লঘুরস আরো বিদ্যমান—মানুষজন হাসি-ঠাট্টা ভালোবাসে, ভাবনাহীন নিরুদ্বেগ জীবন কাটিয়ে দিতে পছন্দ করে, ভবিষ্যত নিয়ে অহেতুক টেনশন না করে বর্তমান উপভোগ করতেই বেশী ব্যস্ত থাকে। আমরা একে বলি “সিন কোহের লুচা”।
কিন্তু মারিও এর ব্যতিক্রম। রাস্তার নেড়িকুকুরের মতই কষ্ট পায় ও—অধরা উজ্জল কোন ভবিষ্যতের জন্যে নিষ্ফল অপেক্ষায় থেকে কষ্ট পায়, চারপাশের দুর্নীতি আর মানুষের লোভ-লালসার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা দেখে কষ্ট পায়, বন্ধুদের ব্যর্থতা আর নির্বাসিত আপনজনের পরিণতি দেখে কষ্ট পায়। আর এতসব কষ্টের পেছনে কারন কি জানেন? কারন ওর অস্তিত্বের মূলে মারিও কোন্দে সবসময়ই একজন লেখক—অথচ যে কোনদিন লেখালেখি করতে পারেনি।
সমাজ-সংসার নিয়ে ওর বিবেক যেমন প্রবল, কালের ইতিহাস বা অদৃষ্টের টানাপোড়েন নিয়েও ও তেমন গভীরভাবে সচেতন। যার ফলে পুলিশ বা প্রাক্তন পুলিশ চরিত্রে বসিয়ে ওকে আমি কিউবার বর্তমান বাস্তবতার দর্পণ হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছি। সঙ্গত কারণেই এই বাস্তবতা নিয়ে ও বা আমি কেউই সন্তুষ্ট নই। মারিওর মত চরিত্রের আমার বিশেষ প্রয়োজন ছিল—একাধারে বুদ্ধিদীপ্ত এবং সংবেদনশীল, যত না পুলিশের লোক তার চেয়ে ঢের বেশি একজন ব্যর্থ লেখক। ও না থাকলে আমার লেখার উদ্দেশ্য অর্জন হতো না।
চতুর্থ উপন্যাসে এসে আমরা দেখতে পাই যে মারিও পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পুরনো বইয়ের ব্যবসা ধরেছে। যেমনটা বললাম, ও তো কখনোই সত্যিকারের পুলিশ ছিল না, ছিল সাহিত্যানুগ পুলিশ। আমার মত ওর জন্মও পঞ্চাশের দশকে, বড় হয়েছে কিউবান বিপ্লবের ডামাডোলের ভেতরে। অর্থাৎ আমাদের প্রজন্মেরই প্রতিনিধি। সেই সময়ের ভালো আর মন্দ দুটোই দেখেছে, দেখেছে তার নিষ্ঠুরতাও।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আপনার বইগুলোতে আপনি আধুনিক, অন্ধকার এক হাভানা সৃষ্টি করেছেন, যেখানে মারিও কোন্দে নানা রকম পরিবেশ-পরিস্থিতি খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পায়। যেমন চতুর্থ বইয়ে হাভানার পুরনো বা দুর্লভ বইয়ের বাণিজ্যের খোল-নলচে ওকে জানতে হয়েছে। কিউবার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনি যে ধরনের খোলামেলা উচ্চারণ করেন আপনার বইয়ে, সেটা অবশ্যই নজর কাড়ার মত। ঠোঁট-কাটা লেখার জন্যে কখনো তিরস্কৃত হয়েছেন?
পাদুরা :
ঠোঁট-কাটা বলা যাবে কিনা জানিনা, কিন্তু আপনি ঠিকই ধরেছেন—সাহিত্য সমালোচনা যত না পেয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি জুটেছে রাজনৈতিক সমালোচনা। যদিও পাশাপাশি আমি প্রচুর সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছি। সম্প্রতি কিউবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার—“জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার”—দিয়ে আমাকে সম্মানিত করা হলো। অপরাধজগত নিয়ে আমি যত বই লিখেছি, সব কটিতেই আমি কিউবার বর্তমান অবস্থার সমালোচনা করেছি। “নীল্ হাভানা” থেকে শুরু করে এই বছর স্পেনে প্রকাশিতব্য “ধর্মত্যাগী” উপন্যাসেও সমালোচনা অব্যাহত আছে। নিছক ক্রাইম নভেল নয়, আমি মনে করি আমার বইগুলো আসলে সামাজিক উপন্যাস যেখানে আমি বাস্তবতাকে খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করেছি, পাঠকের কাছে মনোজ্ঞ করে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছি। কট্টরপন্থী কিছু লোক হয়তো আমার তীর্যক দৃষ্টি অপছন্দ করেন, কিন্তু সত্যি কথা হলো যে এই দেশের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্যে আমার লেখাগুলো হলো তাদের যাপিত জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিরূপ। আর তাই আমার উপন্যাস বা আমার সাংবাদিকতার প্রতি পাঠকরা এত বেশী একাত্মতা বোধ করেন। আর শেষ বিচারে পাঠকরাই তো সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, তাই না? ওসব কট্টরপন্থীরা নন।
অস্কার হিহুয়েলোস :
মারিও কোন্দে-র অন্তর্মুখী চরিত্রের সাথে আমি যেন ইভান কার্দেনাসের দূর আত্মীয়তার সম্পর্ক খুঁজে পাই। আপনার নতুন উপন্যাস “যে মানুষটি কুকুর ভালবাসতো”-র অন্যতম চরিত্র এই প্রবীণ লেখক, ১৯৭৭ সালে একদিন হাভানার সমুদ্রতটে হাঁটতে গিয়ে দৈবক্রমে দেখা হয়ে যায় রামোন মের্কাদের-এর সাথে। সেই রামোন মের্কাদের, যে তিন যুগ আগে স্টালিনের আদেশে মেক্সিকো গিয়ে লিওন ট্রটস্কি-র মাথায় কুড়াল মেরে হত্যা করেছিল, আজ দিব্যি সীবীচে হেঁটে বেড়াচ্ছে পোষা কুকুরের পাশে। অসাধারণ লেগেছে আপনার এই কল্পনা। কয়েক দশক জুড়ে উপন্যাসটির ব্যাপ্তি—ত্রিশের স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের কিউবার “বিশেষ অবস্থা” পর্যন্ত। আলাদা সব গল্পগুলোর সংযোগ ঘটাতে আপনি ঘুরেফিরে কুকুরদের ব্যবহার করেছেন। এই বুদ্ধি কোথায় পেলেন? আপনি কি কুকুর খুব ভালোবাসেন?
পাদুরা :
কুকুরদের সাথে নিয়ে সাগরতীরে মের্কাদেরের হেঁটে বেড়ানোর গল্পটা কিন্তু কোন কল্পনা নয়। বিশালাকৃতির দুটো রাশিয়ান গ্রেহাউন্ড পুষতো মের্কাদের, শীতকাল এলে শহরের নির্জন সৈকতে নিয়ে যেতো, যেন কুকুর দুটো অবাধে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। তখন ওর সাথে, ওর কুকুরগুলোর সাথে যে কারোই দেখা হয়ে যেতে পারতো, ইভানের যেমন হয় এই বইতে। ইভান স্রেফ কাল্পনিক চরিত্র বলে ঘটনাটা উদ্ভাবিত মনে হয়েছে। আর আপনি যদি ইভান আর মারিও কোন্দে-র চরিত্রে মিল খুঁজে পান, তাহলে ঠিকই ধরেছেন। একই প্রজন্মের কিউবান পুরুষ ওরা, একই ইতিহাসের স্বাক্ষী, সাহিত্যের প্রতি দুজনেরই প্রবল অনুরাগ, আর দুজনের জীবনেই একই ফ্রাস্ট্রেশন আর হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন।
তবে কুকুর প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কিউবায় ওই কুকুরগুলো পালতেন মের্কাদের, আর ট্রটস্কিও আজীবন কুকুর পুষেছিলেন। যেখানেই নির্বাসনে গেছেন, সেখানেই তার সাথে কুকুর ছিল—কাজাখস্তানে, তুরস্কে, ফ্রান্সে অবশেষে মেক্সিকো সিটিতেও। দুজনের মানসচেতনার বৈপরীত্যকে সংযুক্ত করতে তাদের এই কুকুর-প্রেম আমার সহায়ক হয়েছিল। ট্রটস্কি ছিলেন বুদ্ধিজীবী-বিপ্লবী, অপরদিকে মের্কাদের ছিলেন অনুগত বিপ্লবী, স্রেফ আজ্ঞাবহ দাস। এই দুইয়ের মাঝে যে বিশাল রাজনৈতিক ও মানবিক দূরত্ব, তা অতিক্রম করা আমার পক্ষে সহজতর হয়েছিল।
ট্রটস্কির মনুষ্যত্বকে ফুটিয়ে তুলতে কুকুরগুলো দারুন কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। অপরদিকে মের্কাদেরের মত অজানা অখ্যাত একজন লিওন ট্রটস্কিকে খুন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালো, জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাটাতে হলো মিথ্যা পরিচয়ে, নীরব মৌনতায়, নির্জন কারাবাসে, অথবা পর্দার অন্তরালে। প্রায় অবাস্তব একটি চরিত্র। কুকুর ভালোবেসে মের্কাদের-ও যেন ওর মানবতা প্রকাশের একটি সুযোগ পায়। বৃত্তটি সম্পূর্ণ করতে তাহলে আমার শুধু একটি জিনিসই বাকি থাকে—ইভান কার্দেনাস-ও যদি কুকুরপ্রেমী হয়! ডিটেকটিভ মারিও কোন্দে-ও রাবিশ নামের একটা নেড়ি কুকুর পালে, ওর মতই একদম অগোছালো। আর হ্যাঁ, আমি নিজে কুকুর খুব পছন্দ করি—জন্মের পর থেকেই বাড়িতে কুকুরের সান্নিধ্যে বড় হয়েছি। লুসিয়া আর আমি ১৯৯৭ সালে থেকে একটা কুকুর পালছি, নাম চোরিসো। নেড়ি কুকুর কিন্তু খুবই চমৎকার স্বভাবের, বুড়োর বয়স এখন ষোল হয়েছে।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আপনার উপন্যাসের ব্যাপ্তিতে আমি লেখকের উচ্চাভিলাষের ছাপ দেখি। বিশেষ করে স্টালিনের শাসনামলে রাশিয়াতে যা কিছু ঘটেছিল তার বিশদ বর্ণনায়। শীতল যুদ্ধের ছায়ায় আপনি বড় হয়েছেন, ফলে ছোটবেলায় কিউবায় রুশদের সরব উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আপনার লেখায় কি সেই স্মৃতির প্রভাব পড়েছে? স্কুলে যখন পড়তেন, স্টালিনের দুঃশাসন সম্পর্কে কোন আলোচনা হতো? আমার কাছে মনে হয়েছে যে কিউবান লেখকরা এই প্রসঙ্গটি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। আপনি কি এই ব্যাপারে একমত হবেন?
পাদুরা :
কিউবায় স্টালিনবাদের বিস্তারিত আলোচনা কখনোই হয়নি, অতীতে তো নয়ই, এমনকি এখনো না। স্টালিনের শাসন ঠিক কেমন ছিল, বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবের ইতিহাসে তা কি ভূমিকা রেখেছিল, প্রকৃত সাম্যবাদের বুকের ওপর যে জগদ্দল পাথরে পরিণত হলো, এমনই সেই মড়ার ভার যে গোটা দুনিয়া থেকেই সমাজতন্ত্র উধাও হয়ে গেল—এসব নিয়ে কোথাও কোন আলাপ হয় না।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম, এমনকি হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়েও লিওন ট্রটস্কির নাম নেয়া হতো না। যদিও বা কখনো উল্লেখ হতো, ট্রটস্কির পরিচয় ছিল শুধু মতাদর্শিক সংশোধনবাদী আর রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। আর যতরকম প্রশংসা আর মহিমাকীর্তন আছে দুনিয়ায়, সব অবিরল ধারায় বর্ষিত হতো মহান স্টালিনের উপর। ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত কৃষিখামার যৌথকরণ প্রক্রিয়ার নির্মম বাস্তবতা কখনো উল্লেখ হতো না, ওই প্রক্রিয়ার ফলে কয়েক মিলিয়ন মানুষ যে না খেতে পেয়ে মারা গেল, তাদের কথাও কেউ বলতো না। সাইবেরিয়ার শ্রমশিবির বা গুলাগের নারকীয় বর্বরতা, সেখানে মরে যাওয়া আরো কয়েক মিলিয়ন মানবসন্তান; ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত মস্কোর মিথ্যা মামলাগুলো, যার মাধ্যমে পুরনো বলশেভিক নেতা-কর্মীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রণ-পরিচালনায় বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তি; ইহুদি ডাক্তারদের উপর অকথ্য নিপীড়ন; চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে ভিন্নমতাবলন্বীদের বিরুদ্ধে অন্যায় বিচারপ্রক্রিয়া—আমরা এর কোন কিছুই শুনিনি। এমনকি স্টালিনের শাসনব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করে তার উত্তরসুরী নিকিতা ক্রুশ্চেভ যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, সেটাও প্রায় আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।
একথা সত্য যে নব্বইয়ের দশকে মস্কোর রাষ্ট্রীয় আর্কাইভ উন্মুক্ত করে দেয়ার আগ পর্যন্ত স্টালিনের অপরাধসমূহের মাত্রা বহির্বিশ্বে মোটামুটি অজানাই ছিল। কিন্তু স্টালিনের সর্বগ্রাসী স্বৈরাচার সোভিয়েত রাশিয়াকে কোন পথে নিয়ে যাবে, সে সম্পর্কে অনেকেই অনেক আগে থেকে ওয়াকিফহাল ছিলেন। স্বয়ং ট্রটস্কি ত্রিশের দশকে স্টালিনের কঠোর নিন্দা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃত চেহারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেন। একথা অনস্বীকার্য যে কিউবার ভেতরেও অনেক বিশ্লেষক আছেন যারা বহুদিন ধরে স্টালিনবাদকে ধিক্কার জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আলোচনাটি যেভাবে হওয়া উচিত ছিল—অর্থাৎ স্টালিনীয় রাজনীতির স্বরূপ কি? স্টালিন প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক মডেল কিউবার জন্যে কি পরিণতি বয়ে এনেছে?—এসব গুরুতর প্রশ্ন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা আমরা আজ অব্দি করতে পারিনি। সেই ইতিহাস এখনো এদেশে অজানা। আর ঠিক একারনেই কিউবার পাঠকরা আমার উপন্যাসকে অনেকটা ওহী নাজিলের মত বরণ করে নিয়েছেন, যেন বহুদিন ধরে গুপ্তরহস্যের হঠাৎ উত্তর মিললো। এই উপন্যাস যে কিউবায় ছাপা হতে পেরেছে এবং একাধিক পুরস্কার জিতেছে, তা থেকেই প্রমাণ হয় যে এখানেও এখন আলোচনাটি সম্ভব—সোভিয়েত পরিপ্রেক্ষিতে স্টালিনবাদ, এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এর প্রভাব, যেমন স্পেনের গৃহযুদ্ধে, এবং হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের এই কিউবায়।
আরেকটা ব্যাপার দেখুন। ত্রিশ বছর ধরে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে কিউবার এত দহরম-মহরম ছিল, রাজনৈতিক অঙ্গনে, অর্থনৈতিক লেনদেনে, কিউবার সিনেমা হলগুলোতে কত শত রাশিয়ান চলচ্চিত্র দেখানো হলো, আমাদের টেলিভিশনে অসংখ্য রাশিয়ান কার্টুন সম্প্রচার হলো, কিন্তু তবুও সোভিয়েতরা এই দ্বীপে তাদের সংস্কৃতির লেশমাত্র রেখে যেতে পারলো না। ব্যাপারটা যেমন কৌতুহলোদ্দীপক তেমনই যুক্তিসঙ্গত। আত্মার কোন খোরাক ওরা আমাদের জন্যে রেখে যেতে পারেনি বললেই চলে, যদিও আজ পর্যন্ত রাজনীতি আর অর্থনীতির বড় বড় প্রশ্নে কিউবান সরকার অনুগতভাবে সোভিয়েত মডেলকেই অনুসরণ করে আসছে।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আপনার উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ইভান কার্দেনাস পেশায় লেখক। মারিও ভার্গাস ইয়োসা এবং মার্কিন ডিটেকটিভ উপন্যাসিক রেমন্ড চ্যান্ডলারের প্রতি ওর প্রবল অনুরাগের কথা আমরা জানতে পারি। অথচ রাজনৈতিক মতাদর্শে ভার্গাস ইয়োসা বেশ রক্ষণশীল, তার প্রিয় বন্ধু প্রয়াত লেখক গিয়ের্মো কাব্রেরা ইনফান্তে-ও অনুরূপ রক্ষণশীল ছিলেন। ল্যাটিন আমেরিকার বড় বড় লেখকদের মধ্যে সম্ভবত এই দুজনই শুধু বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। এই বিবেচনায় ইভানের পছন্দের কি ব্যাখ্যা করবেন? প্রশ্নটি উত্থাপন করছি কারন উপন্যাসের অনেক উপাদান আছে যেগুলো ভার্গাস ইয়োসা স্বয়ং তার সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন—জটিল কাহিনী এবং প্যাঁচালো কাঠামো, চরিত্রদের দ্বৈত পরিচয়, ইতিহাস থেকে প্রচুর উপাদানের অবতারনা। লেখার সময় আপনি কি ভার্গাস ইয়োসার কথা ভাবছিলেন?
পাদুরা :
ভার্গাস ইয়োসার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল মাদ্রিদ বিমানবন্দরে। একটা কথা তাকে না বলে পারিনি—যতবারই আমি নতুন কোন উপন্যাস লিখতে বসি, ওর অমর উপন্যাস “ক্যাথেড্রালে কথোপকথন” আরেকবার পড়ে নেই। সাহিত্যিক হিসেবে আমার দায় অনেকের কাছে, প্রভাবের উৎস অনেক, যদিও প্রিয় লেখকের রাজনৈতিক আদর্শ অনেক ক্ষেত্রে আমার সাথে নাও মিলতে পারে। যেমন বিংশ শতকের মার্কিন সাহিত্যিকদের কাছে আমি ভীষণ ঋণী—কিভাবে গল্প বলতে হয়, পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে হয়, তাদের থেকেই শিখেছি। ডিটেকটিভ সাহিত্যিক ড্যাশিয়েল হ্যামেট এবং রেমন্ড চ্যান্ডলার তো অবশ্যই আছেন, আরো উল্লেখ করবো হেমিংওয়ে, জন ডন প্যাসোস, উইলিয়াম ফকনার, জে ডি স্যালিঞ্জার, জন আপডাইক। সবাই ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী কিন্তু প্রত্যেকেই মহান লেখক।
পঞ্চাশ-ষাট দশকের পরবর্তী স্প্যানিশ এবং ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যের প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি—কার্পেন্তিয়ের, হুয়ান রুলফো, গার্সিয়া মার্কেস, মানুয়েল ভাস্কেস মোন্তালবান, হুলিও কর্তাসার, প্রমুখ। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ঋণ নিঃসন্দেহে ভার্গাস ইয়োসা আর কাব্রেরা ইনফান্তে’র প্রতি। ভার্গাস ইয়োসার লেখা আমাকে মুগ্ধ করে—ওর অসাধারন কাহিনীবিন্যাস, পাঠককে নিপুণ হাতে পরিচালনা করার আশ্চর্য ক্ষমতা। একটি দীর্ঘ উপন্যাসের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে যতটুকু সময় দরকার, ভার্গাস ইয়োসা সেই সময়টুকু দেন। আর কাব্রেরা ইনফান্তের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি শিখেছিলাম—কিভাবে কিউবান ভাষায় লিখতে হয়, কিভাবে হাভানার কথ্য ভাষা “হাবানেরো” ব্যবহার করতে হয়। এই শিক্ষাও আমার জন্যে অত্যাবশ্যক ছিল।
তবে দুঃখজনক সত্য হলো যে বহু বছর ধরে এই দুজনের কোন লেখা কিউবায় প্রকাশিত হতো না। ওদের বইয়ের সন্ধান পাওয়া খুব দুষ্কর ছিল, কিন্তু তবুও আমি খুঁজে-পেতে ওদের লেখা পড়ে আসছি সেই সত্তুরের দশক থেকে, যখন থেকে আমার নিজের সাহিত্য পাঠরুচি আরেকটু পরিশীলিত হতে শুরু করে। প্রথমবার ওদের বইগুলো পড়ে পুলকিত-চমতকৃত হয়েছিলাম। তারপর আবার পড়েছি, এইবার বিশ্লেষকের দৃষ্টি দিয়ে, যেন ওদের কলাকুশল থেকে নিজেও কিছু শিখতে পারি। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভালো লিখতে শেখার একটাই পথ—যারা ভালো লিখেন, বিশেষ করে আপনার মাতৃভাষায়, তাদের রচনাবলী নিয়মিত পড়া।
অস্কার হিহুয়েলোস :
উপন্যাসের প্রথম দৃশ্যে আমরা হাভানার একটি কবরস্থানে, কিন্তু শীঘ্রই স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে পাঠক চলে যান সুদূর সাইবেরিয়ায়—লিওন ট্রটস্কি যেখানে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। এরপর সহসা লাফ দিয়ে কাহিনী আবার চলে আসে ভবিষ্যতে। গল্পের এত শত খুঁটি-নাটি কি করে সাজিয়েছেন? মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় হয়নি?
পাদুরা :
এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে সবচেয়ে দুরূহ কাজ ছিল গল্পের কাঠামো দাঁড় করানো। বাকি সবকিছুই নির্ভর করছিলো এই কাঠামোর উপর—কিভাবে তথ্য সাজাবো, ঠিক কোন মুহুর্তে সেই তথ্য পাঠকের কাছে পরিবেশন করবো। শেষে কি হবে প্রথম পাতায়ই বলে দিয়েছি, কারন পাঠক সে ইতিহাস জানেন। মের্কাদের কিভাবে ট্রটস্কিকে খুন করেছিলেন, সেই নৃশংস অপরাধের নেপথ্যে কি ছিল, ইতিহাসে এই হত্যাকান্ডের তাৎপর্যই বা কি—এসব বিষয় নিয়ে আমার উপন্যাস। গল্পের নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স যেহেতু সকলেরই জানা, লেখক হিসেবে আমি কিভাবে তাহলে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখবো? একের পর এক পাতা উল্টাতে প্রলুব্ধ করবো?
উত্তর হলো, গল্পের কাঠামোয় পাঠককে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে হবে, গদ্যের ছন্দে তাকে আকৃষ্ট করতে হবে। কাহিনীর বিন্যাস হওয়া চাই নাটকীয়, বলিষ্ঠ। বলা বাহুল্য, খুবই শক্ত কাজ ছিল! একবার ভাবুন—টানা দুই বছর ধরে ইতিহাস গবেষণা করে ৬০০ পৃষ্ঠার একটি কালপঞ্জি আমাকে তৈরী করতে হয়েছিল। ট্রটস্কি আর মের্কাদেরের জীবনের বিস্তারিত হালখাতা—যে কোন মুহুর্তে ওরা কোথায় ছিল, কার সাথে ছিল, কি করছিল, এই রোজনামচা দেখে আমি ঠিক ঠিক বলে দিতে পারতাম। ফ্রিদা কাহলো, দিয়েগো রিভেরা, আঁদ্রে ব্রেতোঁ, জর্জ অরওয়েল, লাজারো কার্দেনাস এবং আরো অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রও এই উপন্যাসে আবির্ভূত হয়েছেন।
আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল গল্পের কাঠামোকে তিনভাগে বিভক্ত করে ফেলা। এর আগেও আমি এই ত্রিভুজ বিন্যাস ব্যবহার করেছি “আমার জীবনের গল্প” নামে একটি উপন্যাসে। নতুন বই “ধর্মত্যাগী”-তেও একই কাজ করেছি, তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। ত্রিভুজের তিনটি বাহুর মত উপন্যাসের তিনটি পর্ব একে অপরের ভারসাম্য বজায় রাখে—তাই পাঠকের কাছে অতিরিক্ত বলে মনে হয় না। এমন না যে প্রথমে একটি গল্প লেখা শেষ করে পরেরটা শুরু করেছি। বরং এক সাথে সমানতালে তিনটি গল্প লিখে গেছি—একটার পঞ্চাশ পাতা লেখা হয়ে গেলে থেমে যেতাম, আরেকটা ধরতাম। ওটার পঞ্চাশ পাতা হয়ে গেলে আবার আরেকটা। এভাবে করে প্রতিটি গল্প স্বতন্ত্রভাবে লিখেছি, অর্থাৎ প্রত্যেকটির নিজস্ব স্টাইল আছে, নিজস্ব ছন্দ আর ভাষা আছে। “আমার জীবনের গল্প” বইটি এভাবে লিখেছিলাম, ট্রটস্কির উপন্যাসেও একই কায়দা ব্যবহার করে ফল পেলাম। তবে ঐতিহাসিক উপন্যাস বিধায় ট্রটস্কির বইটি অবশ্যই আরো অনেক বেশি জটিল ছিল। ইতিহাসের পাতা থেকে অজস্র তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে, স্থান-কাল বিচারে গল্পের অনেকরকম প্রেক্ষাপট আছে, আছে বাস্তব চরিত্রের সমাহার। এমনকি অজানা অনেক অধ্যায়ও লিখেছি, ইতিহাস-বই ঘেঁটেও যে ঘাটতিগুলো এখন আর পূরণ করা সম্ভব না।
প্রতিটি গল্প যখন লেখা শেষ, তখন আমার আসল মাথাব্যথা শুরু—কিভাবে এগুলো গুছাবো, একটি গল্পের সাথে আরেকটি কোথায় গিয়ে মিশবে। উপন্যাসের প্রারম্ভে তিনটি গল্পেরই মিলন ঘটেছে, প্রধান চরিত্রদের জীবনপথ এই বিন্দুতে এসে মিশেছে। আমি মনে করি যে মোটের উপর গল্পের নকশাটি বেশ ভালোই কাজ করেছে।
অস্কার হিহুয়েলোস :
লেখক হিসেবে আপনি প্রায়ই কিউবার বাইরে ভ্রমণ করার সুযোগ পান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আপনার কি মতামত? আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশে যে কিউবান অভিবাসী জনগোষ্ঠীর দেখা পান, তাদের বিষয়ে আপনার কি অনুভূতি?
পাদুরা :
সব মিলিয়ে আমি দশবারের বেশী আমেরিকায় গিয়েছি। প্রতিবার মায়ামি দিয়ে প্রবেশ করি, আর চুপচাপ নীরবে যাত্রা সেরে ফেলার চেষ্টা করি। আমার পরিবারের সদস্য, আমার বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করি, ওদের সাথে ভালো সময় কাটাতে চেষ্টা করি। রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি, কারণ বাইরে থেকে যারা কিউবাকে দেখেন, দেশ নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা বেশ সরলরৈখিক, সবকিছু দেখেন সাদা-কালো চোখে। আমার আরো অনেক বন্ধু আছেন যারা স্পেনে স্থায়ী নিবাস গেঁড়েছেন, ওদের সাথেও দেখা হয়।
এই দুই গ্রুপের আসল তফাৎটা বলি। মায়ামিতে যারা থাকেন তারা কিউবার অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলী নিয়ে খুব বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন, যেন তারা দেশ ছেড়ে কোনদিন পালিয়ে যাননি। অথচ রূঢ় বাস্তব হলো যে কিউবার ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে, তা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছেন তারা অনেক আগেই। স্পেন দেশটার পরিবেশ আরো অনেক খোলামেলা—যারা সেখানে সেটেল করেছেন, স্বদেশের সাথে তাদের সম্পর্কও অনুরূপ খোলামেলা, নিরুত্তেজ। হ্যাঁ, তারাও দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করেন, কিন্তু তারা থাকেন অনেক দূরদেশে—মায়ামিতে নয়। মায়ামি শহরটা কিউবাও নয়, আবার পুরোপুরি আমেরিকাও নয়। মায়ামি স্রেফ মায়ামি।
অস্কার হিহুয়েলোস :
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত হিস্পানিক বংশোদ্ভূত লেখক যেমন জুনোট ডিয়াজ বা সান্দ্রা সিস্নেরোস, ওদের লেখা কি পড়েন?
পাদুরা :
আমি আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাটিনো লেখকদের কাজের সাথে অতটা পরিচিত নই। কিন্তু তাদের মধ্যে অস্কার হিহুয়েলোস নামে একজন আছেন—আপনাকে বলা ঠিক হচ্ছে কিনা জানিনা—ওনার লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আর হ্যাঁ, অসাধারণ দুজন প্রাবন্ধিকের নামও তো অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়—রবের্তো গন্সালেস এচেভারিয়া এবং গুস্তাভো পেরেস ফির্মাৎ। মুশকিল হলো এই ধারার সাহিত্য সচরাচর আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় না। যদি ভাগ্যক্রমে স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েও থাকে, প্রায় সময়ই সেটা খুব নিম্নমানের অনুবাদ হয়। তার উপর বড় বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো সবসময় এধরনের লেখা প্রকাশে আগ্রহী হয় না—যদিও উপরে যে লেখকদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা এই নিয়মের ব্যতিক্রম। মোদ্দা কথা, মার্কিন ল্যাটিনো সাহিত্য বলে যে একটা সাহিত্য ঘরানা আছে, সেটা কিউবায় বসে অনেক সময় টেরই পাওয়া যায় না।
অস্কার হিহুয়েলোস :
আপনি সিনেমার জন্যে বেশ কিছু চিত্রনাট্য লিখেছেন—এর মধ্যে “সেভেন ডেজ ইন হাভানা” ছবিটি উল্লেখ্য। একাধিক শিল্পী এই ছবির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, হলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা বেনিসিও দেল তোরো তাদের অন্যতম। এই প্রজেক্টের সাথে কিভাবে জড়িত হলেন? চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট ছিলেন?
পাদুরা :
সিনেমার কথা যখন এসেছে, আমি সবচেয়ে বেশি যেটা পছন্দ করি তা হলো সিনেমা দেখতে। লুসিয়া আর আমি, আমরা দুজনই বদ্ধ সিনেমা-পাগল। প্রথম যেদিন একসাথে ডেটে গিয়েছিলাম আমরা, সেই ছাত্র বয়সে, স্প্যানিশ পরিচালক কার্লোস সাউরা’র “এলিসা, আমার জীবন” ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম দুজন মিলে। যখন বাড়িতে থাকি, প্রতি রাতেই কিছু না কিছু দেখি আমরা। হতে পারে কোন সিনেমা, অথবা প্রিয় টিভি সিরিজের কয়েকটি পর্ব—আমরা দুজনই মার্কিন সিরিজ “দ্য ওয়ায়ার”-এর বিশেষ ভক্ত। বাড়িতে প্রচুর ডিভিডি আছে আমাদের, আরও আছে একটা এইচডি প্লেয়ার আর একটা এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ। ওর ভেতর শত শত চলচ্চিত্র মজুদ করে রেখেছি, পুরনো ক্লাসিক, নতুন ছবি, সবকিছুই। এই তো কদিন আগে রোমান পোলানস্কির “চায়নাটাউন” ছবিটি আবার দেখলাম দুজনে।
তবে সিনেমা জগতে কাজ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, বিশেষ করে আপনি যদি লেখক হয়ে থাকেন। যতবারই ওই লাইনে কাজ করেছি আমি, করেছি মূলত দুটি কারণে—প্রথমত টাকার জন্যে, কারন খুব অল্প সময়ে আপনি যে টাকা কামাতে পারবেন সিনেমা লিখে, বই লিখে তা কখনো সম্ভব না। অথচ একটা বই লিখতে দুই তিন এমনকি পাঁচ বছরও লেগে যেতে পারে। দ্বিতীয় কারণটা সেন্টিমেন্টাল—যখন কোন প্রজেক্টের সাথে একাত্মতা অনুভব করি, যখন মনে হয় যে এই ছবিতে আমারও ভাগ আছে। ওই যে সম্ভাব্য একটা টিভি সিরিজের কথা বলেছিলাম, জার্মানি আর স্পেনের কিছু প্রযোজক চাইছেন মারিও কোন্দে-র গল্পগুলোকে মিনি-পর্দায় নিয়ে আসবেন। খুব আপন বলে মনে হচ্ছে এই সিরিজটাকে। এমন আরো একটা প্রজেক্ট আছে—ফরাসী পরিচালক লরোঁ কোঁতে-র জন্যে একটা মৌলিক চিত্রনাট্য লিখছি, হয়তো এবছরই হাভানায় শুটিং হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিত্রনাট্য আমি একা লিখছি না, যৌথভাবে লিখছি আরেকজনের সাথে। যেমন লুসিয়ার সাথে সম্প্রতি বেশ কিছু কাজ করেছি, ছবির পরিচালকের সাথেও মাঝে মাঝে করি।
আর স্ক্রিপ্ট লেখার পেছনে তৃতীয় একটি কারন আছে। যখন কোন উপন্যাস লিখে শেষ করি, সাথে সাথেই পরের উপন্যাসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। একটা বিরতির প্রয়োজন হয়, গভীর চিন্তা করার জন্যে একটু সময় দরকার হয় যেন আগের কাজটা থেকে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারি। কিন্তু আমি তো কাজপাগলা লোক, প্রতিদিনই কিছু না কিছু আমার লেখা চাই। তাই বিরতির সময়টুকু পার করার জন্যে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখা বেশ চমৎকার বিকল্প। “হাভানায় সাত দিন” ছবিটার বেলায় ঠিক এই কাজ করেছিলাম। ট্রটস্কি-মের্কাদেরের উপন্যাসটি তখন সবেমাত্র স্পেনে প্রকাশিত হয়েছে, এমন সময় দুজন প্রযোজক আমাকে খুঁজে বের করলেন। জানতে চাইলেন আমি নতুন একটা প্রজেক্টে যোগ দিতে ইচ্ছুক কি না। ওরা প্রস্তাব দিল যে আলাদা আলাদা কয়েকটি গল্প দাঁড় করাই, সেগুলো বিভিন্ন পরিচালকের হাতে দেয়া হবে।
মোট ১১টা কাহিনী লিখেছিলাম আমরা, তার মধ্যে চারটা বেছে নিলেন চারজন পরিচালক—আমেরিকার বেনিসিও দেল তোরো, স্পেনের হুলিও মেদেম, কিউবার হুয়ান কার্লোস তাবিও, এবং আর্জেন্টিনার পাবলো ত্রাপেরো। চূড়ান্ত চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে সবার সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি আমি আর লুসিয়া। ব্যতিক্রম শুধু ত্রাপেরো, উনি ঠিক করলেন নিজের স্ক্রিপ্ট নিজেই লিখবেন। এই ধরনের অমনিবাস চলচ্চিত্র যেমন হয় আর কি, আমাদের ছবির মানও উঁচু-নীচু, ভালো-মন্দের মিশ্রণ। কিন্তু আমার মনে হয় যে একটা বড় গুণ আছে এই ছবির—নান্দনিক বিচারে তো বটেই, সামাজিক বিশ্লেষণের দিক থেকেও ছবিটি মূল্যবান মনে করি। বর্তমান সময়ে হাভানা শহরে জীবনযাত্রার বহুমুখী চিত্র এখানে পরিবেশন করা হয়েছে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। শহরের এই জীবনটা আর বেশীদিন নেই—খুব শিগগিরই আমূল পাল্টে যাবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা অস্কার হিহুয়েলোস (১৯৫১-২০১৩) পুলিৎসার বিজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক। “The Mambo Kings Play Songs of Love” শীর্ষক উপন্যাসটি তার সবচেয়ে সফল গ্রন্থ। এই বই লিখে ১৯৯০ সালে গদ্য-সাহিত্যে পুলিৎসার পুরস্কার জয় করেন কিউবান বংশোদ্ভূত হিহুয়েলোস। হিস্পানিক লেখক হিসেবে তিনিই সর্বপ্রথম এই বিরল সম্মাননার অধিকারী। বর্তমান প্রজন্মের মার্কিন ল্যাটিনো লেখকদের সাফল্যের পেছনে তিনি অন্যতম প্রেরণা ছিলেন। ২০১৩ সালে ইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন। বম্ব পত্রিকার জন্যে নেয়া লিওনার্দো পাদুরার এই সাক্ষাৎকারটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়।
সূত্র : arts.bdnews24.com
0 মন্তব্যসমূহ