বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র দন কিহোতে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি প্রথম দন কিহোতে (Don Quixote) পড়ি কিশোর বয়েসে। পুরো উপন্যাসটি নয়, কোনো একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বলাই বাহুল্য, তাতে উপন্যাসটির জটিল আঙ্গিক অনেক সরল করা হয়েছিল। আমি তা নিয়ে মাথাও ঘামাইনি, আমি পড়েছি একটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি হিসেবে। কৈশোর তো অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়ারই বয়েস। কিন্তু আরও অন্যান্য অনেক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়া সত্ত্বেও দন কিহোতে চরিত্রটি আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটে যায়। তখন আমরা রামায়ণ ও মহাভারত পড়ি, সংক্ষিপ্ত আকারে ইলিয়াড এবং ওডিসি-ও পড়া হয়ে যায়, রাজস্থানের বীরপুরুষদের কাহিনি আমাদের মুগ্ধ করে।
তবু বহু গুণান্বিত সব নায়কদের বদলে আমার কাছে রোল মডেল হয়ে ওঠে ওই দন কিহোতে। তার কারণ বোধহয়, রিয়েলিজম-এর চেয়ে ফ্যান্টাসির প্রতি বেশি আকর্ষণ। রিয়েলিজম কিছুদিনের মধ্যেই মলিন হয়ে যায়, আর ফ্যান্টাসি বহুরূপীর মতন অনবরত নিজেকে বদলায়।

সেই বয়েসে আমি নির্জন কোনো জায়গায় কল্পনায় নাইট সাজতাম, হাতে একটা লম্বা লাঠিই বর্শা, আর ঘোড়ার অভাবে মুখ দিয়ে ঘোড়া ছোটানোর শব্দ করলেই হয়। উইন্ডমিল আমাদের এদিকে নেই, কিন্তু কোনো পরিত্যক্ত কারখানা কিংবা মাঠের মধ্যে একগুচ্ছ বড়ো বড়ো গাছকে অনায়াসেই কোনো দুর্গ হিসেবে কল্পনা করে নেওয়া যায়, এমনকি আকাশের মেঘেও দুর্গ দেখা যায় সেই বয়েসে

অল্প বয়েসে যেসব ক্লাসিক গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ পড়েছি, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মূল গ্রন্থগুলো পড়ে নেওয়ার ঝোঁক থাকাই স্বাভাবিক। চার্লস ল্যাম-এর টেলস ফ্রম শেকসপিয়র পড়ার পরই তো শেকসপিয়রের মূল রচনা একে একে পড়তে শুরু করি। কিন্তু দন কিহোতে আমার মনে দাগ কেটে রাখলেও সেরভান্তেস (Cervantes)-এর মূল গ্রন্থটি আমি অনেক দিন সংগ্রহ করতে পারিনি। তা ছাড়া ব্রিটিশ কলোনির মানুষ হিসেবে আমাদের ইংরেজি বই-ই পড়তে হয়েছে বেশি, ইংল্যান্ডের ইতিহাস বা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে। দেশ স্বাধীন হবার পরেও ইংরেজির প্রভাব হয়েছে আরও ব্যাপক। ইউরোপের অন্যান্য প্রধান ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ছিল যৎসামান্য। একসময়ে ইংরেজির প্রভাবকে অস্বীকার করার জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ ফরাসি ভাষার চর্চা শুরু করেন, শিক্ষিত সমাজে ফরাসি জানা অনেকটা ফ্যাশনেব্ল হয়ে দাঁড়ায়। এঁদের লেখালেখির ফলে ফরাসি সাহিত্যের দ্বার আমাদের কাছে কিছুটা কিছুটা উন্মোচিত হয়। এমনকি মূল ফরাসি না জেনেও রাসিন, মলিয়ের, ভিক্তর হুগো, বদলেয়ার, র‌্যাঁবো প্রমুখের নাম কফি হাউসের তরুণ লেখকদের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে, কিন্তু স্প্যানিশ সাহিত্য এদিকে প্রায় কিছুই পৌঁছয়নি। সারা বিশ্বের তৃতীয় প্রধান ভাষা হওয়া সত্তে¡ও স্প্যানিশ সাহিত্যের প্রভাব ভারতে প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। স্প্যানিশ সাহিত্য প্রাচ্যে আসেনি বরং বেশি ছড়িয়েছে আরও পশ্চিমে, ব্রাজিল-বর্জিত সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকায়।

সেরভান্তেসের সম্পূর্ণ উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে আমার হাতে আসে আমার তিরিশ বছর বয়েসে। সেসময় আমি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে বই সংগ্রহ করা যেমন সহজ, পড়াশোনা করার সময়ও যথেষ্ট। সেই অসাধারণ গ্রন্থের উপক্রমণিকা (prologue) এবং কয়েকটি অধ্যায় পড়তে পড়তেই আমার দারুণ আফসোস হয়, কেন এই লেখা আমি আগে পড়িনি! তাহলে হয়তো জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই অন্যরকম হয়ে যেতে পারত।

অবশ্য ততদিনে আধুনিককালের কিছু কিছু স্প্যানিশ কবি আমাদের কাছে পরিচিত। লোরকা এবং নেরুদা সারা বিশ্বেই তরুণ কবিদের কাছে আদর্শ। লোরকার মৃত্যু-স্মরণে আমি একটি কবিতাও লিখে ফেলেছিলাম। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি বা লেখকদের রচনা পাঠের একটা ঝোঁক থাকেই। সেই সুত্রে জেনেছি হিমেনেথকে। হিমেনেথ যখন ওই পুরস্কার পান, তখন একজন সমালোচক লিখেছিলেন যে এই নোবেল পুরস্কার শুধু হিমেনেথের নয়, আসলে এ পুরস্কার মিলিতভাবে তিনজনের, তিমেনেথে, আনতোনিয় মাচাদো এবং লোরকার, কেন না শেষোক্ত দুজন তখন বেঁচে ছিলেন না, নইলে তাদের দু’জনের ওই পুরস্কার অবশ্যই প্রাপ্য ছিল। তখন আমি মাচাদো-র কবিতাও খুঁজে খুঁজে পড়েছি। কিন্তু এর আগের কয়েক শতাব্দীর স্পেনীয় সাহিত্য সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। দন কিহোতে-র অন্যতম অনুবাদক জে.এম. কোহেন তাঁর ভ‚মিকাতেও বলেছেন যে, মধ্যযুগীয় স্প্যানিশ সাহিত্যের অনেক ঐশ্বর্য থাকলেও অন্য ভাষায় অনুবাদ হয়েছে খুবই কম, অনুবাদ করা কঠিন বলেই। একমাত্র সেরভান্তেস-এর বইটিই যেন সমগ্র স্প্যানিশ সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে এই মহাগ্রন্থ সমান জনপ্রিয়।

লেখকের পুরো নাম মিগেল দে সেরভান্তেস সাভেদা (Miguel De Cervantes Saavedra), বইটির নাম দ্য আডভেঞ্চারস অফ দন কিহোতে। বইটি দুটি খণ্ডে ভাগ করা, প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৬০৫ সালে। দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশ পায় লেখকের মৃত্যুর এক বছর আগে, ১৬১৫ সালে। উপক্রমণিকাতে লেখক একটি উক্তি করেছেন, যা একই সঙ্গে মজার এবং রহস্যময়। তিনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তির একটি কুরূপ এবং অবোধ সন্তান আছে, কিন্তু সে পুত্র¯েœহে অন্ধ হয়ে ছেলেটির কোনো দোষই দেখতে পায় না, বরং সে যা-কিছুই করে তা-ই মনে করে প্রতিভা ও সৌন্দর্যের লক্ষণ, আর বন্ধুদের কাছে ছেলের গুণপনা করে বেড়ায়। তেমনই, যদিও সবার মনে হতে পারে যে আমি এই কাহিনির জনক, আসলে আমি এর পালক পিতা, তবু একালের রীতিনীতি মেনে, প্রায় অশ্রুপূর্ণ নয়নে আমার এই সন্তানটির দোষত্রুটি বা অজ্ঞতা ক্ষমা করার অনুরোধ জানাব না। আপনারা, হে পাঠক, স্বাধীনভাবে এর সমালোচনা করতে পারেন। রহস্যটি হচ্ছে, একজন লেখক তার গ্রন্থকাহিনির পালক পিতা হল কী করে? উপন্যাসটির দুটি খণ্ডেই এই রহস্যটি রয়ে গেছে।

উপক্রমণিকায় সেরভান্তেস আরও জানিয়েছেন যে, গ্রন্থটি রচিত হয়েছে এক জেলখানার দুঃসহ পরিবেশের মধ্যে। অবশ্য সত্য। সেরভান্তেসের জীবন বেশ ঘটনাবহুল। তিনি জন্মেছেন মাদ্রিদ থেকে কিছুটা দূরে আলকালা দে এনারেস (Alcala de Henares) নামে একটা ছোট্ট শহরে ১৫৪৭ সালে। তাঁর জীবৎকালটাকে বলা যায় একই সঙ্গে স্পেনের স্বর্ণযুগ এবং সেই স্বর্ণযুগ থেকে পতনের কাল। নতুন এক মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখান থেকে আসছে সোনা আর রুপো, আরও প্রচুর স্বর্ণ-রৌপ্য পাবার সম্ভাবনার নানান কাহিনিতে আকৃষ্ট হয়ে দলে লে স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা হামলা চালাচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকায় আজটেকদের রাজ্যে। শুধু সম্পদ নয়, নতুন মহাদেশ থেকে ইউরোপে আসছে ভুট্টা, টম্যাটো, তামাক এবং চকোলেটের মতন নতুন দ্রব্য। আবার এই সময়েই ইউরোপের অনেকখানি অংশ জুড়ে চলে যুদ্ধবিগ্রহ, তুর্কিরা আক্রমণ করে বারবার, নিজেদের মধ্যে চলেছে ধর্মযুদ্ধ। মার্টিন লুথার এসে ক্রিশ্চিয়ান জগতে এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন, পোপের একাধিপত্য অস্বীকার করে এবং গির্জার সংস্কারের দাবিতে মাথাচাড়া দিল প্রোটেস্টান্টিজম। স্পেন গভীরভাবে ক্যাথলিক, ওদিকে ইংল্যান্ড মেনে নিয়েছে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম। ইংল্যান্ডকে শিক্ষা দেবার জন্য যুদ্ধাভিযানে প্রবৃত্ত হলো স্পেন, তার আর্মাডা নামে নৌবাহিনী তখন অপরাজেয় হিসেবে জগদ্বিখ্যাত, কিন্তু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেই আর্মাডার ভরাডুবি হলো।

যুদ্ধবিগ্রহের ফলে স্পেনের অভ্যন্তরে দরিদ্র মানুষরা হলো দরিদ্রতর, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধি আঘাত হানল মধ্যবিত্তদেরও, জমি হারিয়ে ভ‚মিহীন কৃষকরা এসে ভিড় করতে লাগল শহরে। সমাজিক পরিবেশ অশান্ত ও উদ্বেল।

সেরভান্তেস বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। সম্ভবত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সুযোগও তিনি পাননি, তার বদলে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনিতে। তিনি ঘোর ক্যাথলিক এবং দেশপ্রেমী, তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত পান তাঁর বাঁ হাতে। সেজন্য তিনি সেনাপতি দন হুয়ানের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র পান এবং আবার ফিরে যান যুদ্ধক্ষেত্রে।

একবার দেশে ফেরার সময়ে বন্দি হন জলদুস্যদের হাতে। টানা পাঁচ বছর তাঁকে কাটাতে হয় আলজিরিয়ায় মুসলমানদের গারদে। কয়েকবার পালাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। প্রত্যেকবার ধরা পড়ার পর তাঁকে নির্যাতনও সইতে হয় যথেষ্ট। ১৫৮০ সালে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করা হয় তাঁকে।

এই বন্দিদশায় সেরভান্তেস তাঁর মহাগ্রন্থটি শুরু করতে পারেননি। সম্ভবত সেখানে লেখা-পড়া করার সুযোগও ছিল না। তবে এই কারাবাসের অভিজ্ঞতা তাঁর পরবর্তী রচনায় অবশ্যই কাজে লেগেছিল। এরপর বেশ কয়েক বছর তাঁকে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়। একসময় ট্যাক্স কালেক্টরের চাকরি নিতেও বাধ্য হন, কিছুদিন আন্দালুসিয়া অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীও হয়েছিলেন, কিন্তু সুবিধে করতে পারেননি। স্পেনে তখন সব জিনিসপত্রেরই দাম ঊর্ধ্বমুখী, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সংসার চালানোই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। তখনও স্বপ্নের হাতছানি দিচ্ছে নব-আবিষ্কৃত মহাদেশ, সেখানে সর্বত্রই যন সোনা ছড়িয়ে আছে। সেরভান্তেসেরও খুব ইচ্ছে হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে সেখানেই স্থায়ী হওয়া। তিনি গোয়াতেমালা (Guatemala) রাজ্যে একটি চাকরির জন্য অনেক দরবার করেছিলেন সরকারের কাছে। যদি তাঁর সেই আবেদন গ্রাহ্য হত, যদি তিনি চলে যেতেন দক্ষিণ আমেরিকায়, তাহলে হয়তে তিনি দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতেন, কিন্তু তারপরেও কি তিনি ওই মহাগ্রন্থ রচনা করতেন? তাঁর আর্থিক সাফল্যে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারত বিশ্বসাহিত্যের।

সেরভান্তেস গোয়াতেমালায় চাকরি তো পেলেই না, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি সেভিলের (Sevilla) রাজকীয় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেখানেই শুরু হলো দন কিহোতে-র কাহিনি রচনা। তিনি এর আগেও কিছু নাটক ও কবিতা লিখেছেন, কিন্তু এই রচনার সঙ্গে আর কোনো কিছুই তুলনীয় নয় এবং দন কিহোতে নামে এক দিব্যোন্মাদ নাইটের এই অভিযান-কাহিনি মধ্যযুগের অন্যান্য সব অভিযান-কাহিনিকেই একেবারে নস্যাৎ করে দেয়। এই রচনার স্বাদ একেবারে অভিনব। এই নাইটের চরিত্র একই সঙ্গে কমিক এবং ট্র্যাজিক, বিশ্বসাহিত্যে এর আর কোনো তুলনা নেই।

সেরভান্তেস যখন এই উপন্যাসটি রচনা করেন, তখনও ইংরেজি সাহিত্যে উপন্যাস ঠিকমতন দানা বাঁধেনি। পরবর্তীকালে ইংরেজি উপন্যাস অনেক উচ্চস্তরে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু সেই লেখকরা কেউই ফ্যান্টাসি কিংবা পরাবাস্তবতার (abstraction) দিকে ঝোঁকেননি। ইংরেজি উপন্যাস বড়ো বেশি বাস্তব, যার চ‚ড়ান্ত নিদর্শন চার্লস ডিকেন্সের রচনাগুলো। ফ্যান্টাসি বা অবাস্তব কল্পনা ইংরেজদের চরিত্রেই নেই। তারা সবসময় নিপুণভাবে হিসেব কষে, এবং তাদের সেই হিসেব অঙ্কের মতোন নির্ভুল হয়। এ কথা অনায়াসেই বলা যায় যে কলম্বাস যেমন ভারতের সন্ধানে নৌকো ভাসিয়ে ভুল করে পৌঁছে গেলেন সম্পূর্ণ উলটোদিকের আমেরিকায়, ইংরেজদের পক্ষে সেরকম ভুল করা সম্ভবই নয়। ভারত সন্ধানে বেরিয়ে তারা ঠিক ঠিক ভারতেই পৌঁছেছে।

স্পেনের মধ্য স্বর্ণযুগে এক প্রকার উপন্যাসের খুব প্রসার হয়েছিল, সেই প্রকারকে বলে পিকারেস্ক (চরপধৎবংয়ঁব) নভেল। স্প্যানিশ ভাষায় পিকারোস (Picaros) মানে রাসকেল। অর্থাৎ এই উপন্যাসগুলো ইতরজনের অভিযান-কাহিনি, যার সবকিছুই ঘটে উন্মুক্ত স্থানে এবং অনবরত যাত্রাপথে। সেরভান্তেসের কাহিনিও এই ধারাতেই রচিত, শুরুতেই আমরা দেখতে পাই লা মাঞ্চা (La Mancha) অঞ্চলের এক মধ্যবয়স্ক লোক নিজেকে মনে করে নাইট এবং জীবনের সার্থকতার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে পথে। কিন্তু পিকারেস্ক উপন্যাস বড়ো বেশি বাস্তবসম্মত তাতে নানান সামাজিক দুর্নীতি এবং অবক্ষয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা থাকে। আর সেরভান্তেসের নায়ক কল্পনা আর বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলেন সবসময়, তাই উইন্ডমিলকে মনে করেন দুর্গ, বেশ্যাদের মনে করেন রাজকুমারী, অনেক ধনী, ক্ষমতাশালী মানুষদের মনে করেন দুর্বৃত্ত। কোথাও কোথাও থাকে সূক্ষ্ম বিদ্রুপ, আবার তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে। সব মিলিয়ে মনে হয় এক উদ্ভট পাগলামির জগৎ। আবার এই পাগলটিকে ভালো না বেসেও পারা যায় না।

এই উপন্যাসের আঙ্গিকটিও বিস্ময়কর। এই প্রসঙ্গেই পালক পিতার প্রশ্নটি আসে। লেখক এক এক জায়গায় বলছেন, মূল কাহিনিটি তাঁর নিজস্ব নয়। একজন আরব লেখক, তাঁর নাম সিদি হামিদ বেনেনগালি (Sidi Hamid Benengali), প্রথম দন কিহোতের জীবনী-উপন্যাস রচনা করেন। সেটির অনুবাদ হয় স্প্যানিশ ভাষায়। সেই অনুবাদ পড়েই সেরভান্তেস এই গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হন। সেরভান্তেস এ কথাও জানিয়েছেন, অনুবাদটি সর্বত্র সঠিক হয়নি, আর মূল কাহিনিতেও কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্যভ্রান্তি আছে, তিনি সেগুলো সংশোধন করে দিয়েছেন। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে, তাহলে এই নাটটের চরিত্রটি কি কাল্পনিক নয়, একজন বাস্তব ইতিহাসসম্মত পুরুষ? অনুবাদকের নাম অবশ্য সেরভান্তেস কোথাও জানাননি। তিনি বুঝলেন কী করে যে অনুবাদে ভুল আছে, তিনি কি মূল আরবি গ্রন্থটির সঙ্গে মিলিয়ে পড়েছেন? তিনি আরবি ভাষা জানতেন?

অতি কষ্টে একসময় পাঠক বুঝতে পারে যে এর পুরোটাই সেরভান্তেসের কল্পনা। সিদি হামিদ বেনেনগালি নামে কোনো আরবি লেখক নেই, আরবি ভাষায় দন কিহোতের কোনো জীবনী-উপন্যাস লেখা হয়নি, সুতরাং অনুবাদের প্রশ্নই ওঠে না এবং এই কাহিনির সঙ্গে ইতিহাসের কোনো সং¯্রবই নেই। তবু কেন সেরভান্তেস পাঠকদের এই বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন, তা রহস্যই থেকে গেছে।

এই উপন্যাসটির আঙ্গিককে কোনো সমালোচক বলেছেন Metafictive। গ্রীক ভাষায় Meta শব্দটির অর্থ আবার, অর্থাৎ উপন্যাসের মধ্যে উপন্যাস, তার মধ্যে আবার উপন্যাস, আবার। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেরভান্তেস নামে একজন লেখকের রচনায় সেরভান্তেস নামে একজন কথকের চরিত্র রয়েছে, তার মধ্যে এসে গেছে বেনেনগালি নামে আর-একটি কাল্পনিক লেখকের কথা এবং আর-একজন নামহীন অনুবাদক। অনেকটা যেন আমাদের মহাভারত-এর মতন।

মহাভারত-এর কাহিনি আমরা পাই সৌতি নামে একজন পেশাদার কথকের বর্ণনায়। সেই সৌতি আবার সে-কাহিনি শুনেছে বৈশম্পায়ন নামে এক ঋসির মুখে, আবার মূল যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছেন সঞ্জয়, আবার এই মহাগ্রন্থের লেখকের নাম ব্যাস হলেও তিনি নিজেও একটি চরিত্র এবং স্বনামে তিনি মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ছেন মূল কাহিনির মধ্যে। অনেকটা সেরভান্তেসেরই মতন। তবে সেরভান্তেস নিশ্চয়ই মহাভারত পড়েননি। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যের রত্নসম্ভার পৌঁছয়নি পশ্চিমি জগতে।

১৬০৫ সালে প্রকাশিত হয় দন কিহোতে-র প্রথম খণ্ড। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বইটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়, প্রথম বছরেই ছাপা হয় ছটি সংস্করণ। অনূদিত হতে থাকে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায়। ইংরেজিতে প্রায় সমসময়েই গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন শেলটন (Shelton) তারপর থেকে অন্তত আট-নটি পৃথক অনুবাদভাষ্য বেরিয়েছে ইংরেজিতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উপন্যাসটি সমান জনপ্রিয়। পৃথিবীতে এমন কোনো শিক্ষিত মানুষ নেই, যিনি মূল গ্রন্থটি না পড়লেও দন কিহোতে চরিত্রেটির কথা জানেন না। পৃথিবীর বহু লেখকের রচনায় এই উপন্যাসের প্রভাব আছে। এককভাবে একটি কাল্পনিক চরিত্রের এরকম জনপ্রিয়তা আর কারও নেই। স্যাঁৎ বভ (Saint-Beauve) বলেছেন, এই গ্রন্থ মানবতার বাইবেল। কবি উনামুনো (Unamuno) ঠিকই বলেছেন, আমাদের লর্ড DQ ফ্রান্ৎস কাফকা (Frantz Kafka)-র আগেই একজন কাফকান। কারণ, কাফকা যাকে বলেছেন অবিনশ্বর, এঁর পাগলামি এসেছে এই বিশ্বাস থেকে।

উপন্যাসটির সার্থকতা দেখে প্রলোভিত হয়ে একজন অসৎ লেখক তাড়াতাড়ি এই কাহিনির একটি দ্বিতীয় খণ্ড লিখে বাজারে ছেড়ে দেয়। সে যুগেও এরকম কারবার হত। আমাদের দেশে রামায়ণ-মহাভারত-এ, এমনকি কালিদাসের কাব্যেও অনেক লেখক যুগ যুগ ধরে নিজেদের কিছু কিছু রচনা জুড়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা কেউ নিজেদের নাম জাহির করেননি, খ্যাতির অংশ চাননি বরং তাঁদের নাম জানাই যায় না, শুধু ভাষা ব্যবহারের কিছু কিছু তফাত দেখে আলাদা আলাদা লেখকের স্পর্শ চিহ্নিত করা যায়। সেরভান্তেসের লেখার যিনি নকল করেছেন তার নাম অবশ্য জানা যায়, আলোনসো ফের্নান্দেস দে আভেইয়ান্দা (Alonzo Fernandez de Avellanda)। বলাই বাহুল্য এই লেখকের রচনা খুব দুর্বল, শুধু তাই নয়, এর মধ্যে সেরভান্তেস সম্পর্কে নানা ব্যঙ্গবিদ্রæপ আছে, তাঁকে বলা হয়েছে এক খিটখিটে বুড়ো, বাঁ হাত ভাঙা, তাঁর বন্ধুটন্ধু কেউ নেই!

ক্রোধে, ক্ষোভে জ¦লে উঠে সেরভান্তেস নিজেই আবার লিখতে লাগলেন দ্বিতীয় খণ্ডে নতুন অভিযান-কাহিনি। মজার ব্যাপার এই, বর্ণনায় মধ্যে মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে দন কিহোতে তার জীবনকাহিনি নিয়ে সেভান্তেসের লেখা বইটি পড়েছেন, দ্বিতীয় খণ্ডের নকল জীবনীটিও তার জানা আছে। আরও কিছু কিছু চরিত্র সেরভান্তেস ও আভেইয়ান্দা, দুজনের লেখার কথাই জানে। প্রথম পাঠের সময় একসময় সন্দেহ হয় যে এটাও সেরভান্তেসের নতুন আঙ্গিকের কৌশল নয় তো? আভেইয়ান্দা নামে সত্যিই কি কেউ আছে, নাকি সেও প্রথম ভাগের সেই আরব লেখকের মতন কাল্পনিক? সে সন্দেহ অবশ্য অমূলক, ওই নামের একজন লেখক সত্যিই সেরভান্তেসের খ্যাতির ভাগ নিতে চেয়েছিল, বইও প্রকাশ করেছিল। আভেইয়ান্দার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্ত, তিনি ওই বাজে বইটি লিখে না ছাপালে সেরভান্তেস তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডটি হয়তো লিখতেনই না। দ্বিতীয় খণ্ডটির সাহিত্যগুণ আরও বেশি।


মৃত্যুর এক বছর আগে সেরভান্তেস ১৬১৫ সালে প্রকাশ করেন দ্বিতীয় খণ্ড। আমৃত্যু তাঁর দারিদ্র্য ঘোচেনি।

শেকসপিয়র আর সেরভান্তেসের মৃত্যু হয় একই দিন। এর মধ্যে কোনো তাৎপর্য খোঁজার দরকার নেই, এমনই কাকতালীয় ঘটনা। নিশ্চয়ই এঁরা কেউ কারও রচনা কিংবা অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। কিন্তু আমরা এ যুগে এই দুজনেরই রচনাতে এখনও মুগ্ধ, একই দিনে এই দুই দিকপালের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কথা জানলে এক বিচিত্র অনুভূতি হয়ই!


সূত্র : বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত প্রবন্ধ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ