যোয়াও গিমারায়েস রোয়াসা
অনুবাদ : মুহম্মদ জাফর ইকবাল
খুব ছেলেবেলা থেকেই আমার বাবা ছিলেন দায়িত্বশীল, নীতিবান কাজের মানুষ, প্রাজ্ঞ প্রবীণদের কাছে আমি যখনই বাবার কথা জানতে চেয়েছি সবাই একবাক্যে তা স্বীকার করেছেন। চেনা-জানা মানুষজনের ভেতর আমি একজনের কথাও ভাবতে পাই না যাকে বাবার চেয়ে কম পাগলাটে বা খেয়ালি বলা যায়। কথা বেশি বলতেন না বাবা। সেটা বলতেন আমার মা, চ্যাঁচাতেন আর আমাদের বকতেন—আমার বোনকে, ভাইকে আর আমাকে। ঠিক এরকম সময়ে একদিন আমার বাবা নিজের জন্যে একটা নৌকো তৈরির আয়োজন শুরু করলেন।
ব্যাপারটি বাবা খুব গুরুত্ব দিয়ে নিলেন। ডিঙিটি তৈরি হল তার নকশা অনুযায়ী, সরেস ভিনাটিকো কাঠ দিয়ে; ছোট ডিঙি, গলুইয়ে এক চিলতে জায়গা রাখা হল, যাতে একজনের বেশি মানুষ বৈঠা নিয়ে সেখানে বসতে না পারে। বিশেষ আকারের শক্ত কাঠ থেকে নৌকোটির প্রতিটি অংশ হাত দিয়ে কেটে কেটে বের করা হল যেন তা কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর টিকতে পারে। মা ব্যাপারটি দেখে কেন জানি একেবারে ক্ষেপে গেলেন। যে জীবনে কখনই এ ধরনের কাজ-কারবারে সময় নষ্ট করেনি, সেই এই বয়সে কীভাবে নৌকো করে মাছ ধরতে বা শিকার করতে যেতে পারে? বাবা কিন্তু কিছুই বললেন না। আমাদের বাড়ি নদী থেকে এখন যতদূরে আগে তার চেয়ে অনেক কাছে ছিল, আধ মাইলেরও কম হবে। নদীটি সেখান দিয়ে বয়ে যেতই, বিশাল, সুগভীর, নিঃশব্দ একটি নদী সবসময়েই নিঃশব্দ! সেই নদী এত বড় যে অন্য তীর প্রায় দেখাই যেত না। বাবার ডিঙি নৌকোটি তৈরি হল যেদিন সে দিনটির সে কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না।
খুশি বা উত্তেজনা নয়, মন খারাপও নয়, বাবা টুপিটা মাথায় টেনে বেশ অস্বাভাবিকভাবে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তারপর আর একটি কথাও বললেন না, সাথে কোন খাবার বা অন্য কোন রসদও নিলেন না, এমনকি শেষবারের মত কাউকে কোন উপদেশ দেবারও চেষ্টা করলেন না। আমরা ভেবেছিলাম মা বুঝি একটা কেলেঙ্কারি করবেন, কিন্তু কিছুই করলেন না, শুধু রক্তশূন্য মুখে ঠোঁট কামড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘যাওয়া না যাওয়া সেটা তোমার ইচ্ছে, কিন্তু সত্যি যদি যাও আর কখনো যেন ফিরে না আস।’ বাবা তার উত্তরে কিছু না বলে পুরো ব্যাপারটি রহস্যের মাঝে রেখে দিলেন। আমার দিকে একবার কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার সাথে কয়েক পা হেঁটে যেতে ইঙ্গিত করলেন। মায়ের রাগকে আমি খুব ভয় পাই কিন্তু তবু সাহস করে গেলাম। ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আমি প্রায় মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, আমাকে তোমার নৌকোয় নেবে?’ উত্তরে কোন কথা না বলে বাবা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আশীর্বাদ করে চলে যেতে ইশারা করলেন। আমি চলে যাওয়ার ভান করে কী হয় দেখার জন্যে গাছপালায় আড়াল করে রাখা একটা গর্তের মাঝে গিয়ে লুকিয়ে রইলাম। বাবা নৌকোয় গিয়ে বসলেন, বাঁধন খুলে দিয়ে বৈঠা বাইতে শুরু করলেন। ডিঙি নৌকোটি আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল, সেটিকে দেখতে কুমিরের মত লাগছিল, পিচ্ছিল আর লম্বা।
আমাদের বাবা আর কখনো ফিরে আসেননি। কিন্তু কোথাও চলেও যাননি। নদীর বাঁকটিতে তিনি থেকে গেলেন, মাঝ-নদীতেই নৌকো ভাসমান। বাবা কখনো আর নৌকো থেকে নামেননি, একবারের জন্যেও না! ব্যাপারটি এত অদ্ভুত যে তা আমাদের সবার বুক ভেঙে দিল। আগে কখনো কোথাও ঘটেনি যা তাই কি না ঘটল। আমাদের সব আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শী এবং পরিচিত যারা ছিল সবাই একত্র হয়ে একে অপরকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল।
মা অবশ্যি খুবই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন, তাতে লাভ হল এই সবাই ধরে নিল বাবার আসলে মাথা খারাপ, অবশ্য কথাটি কেউ মুখ ফুটে বলতে সাহস করেনি। অল্প কিছু লোক শুধু বিশ্বাস করত বাবা আসলে একটা মানত রক্ষা করছেন। কেউ ভাবতো কে জানে হয়তো কুষ্ঠ রোগের মত খারাপ কোন অসুখ হয়েছে বলে বাবা আমাদের ছেড়ে অন্য একটা জীবন শুরু করেছেন, আমাদের এত কাছাকাছি থেকেও যোজন যোজন দূরে। যেসব লোক নদীর কাছাকাছি থাকে আর যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের মুখে মুখে বাবার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা বলে বেড়াত বাবা কখনোই নৌকো থেকে তীরে নামেন না, দিন হোক রাত হোক সবসময়েই নদীর ওপরে একাকী, সব মানুষজন থেকে দূরে। মা ও আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা একসময় মনে করল বাবা লুকিয়ে যেটুকু খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেটায় এতদিনে নিশ্চয়ই টান পড়েছে, তারা ভাবল এখন বাবাকে হয় কোথাও নামতে হবে না হয় আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে যেতে হবে, কিংবা কে জানে হয়তো লজ্জার মাথা খেয়ে বাড়িতেই ফিরে আসতে হবে।
সবাই আসলে ভুল ভেবেছিল। আমি তার জন্য প্রতিদিন কিছু খাবার সরিয়ে রাখতাম, বাবা চলে যাবার পর রাত্রিবেলা যখন সবাই নদীর তীরে একটা বড় আগুন জ্বালিয়ে তার আলোতে বসে বসে বাবার জন্যে প্রার্থনা করছিল, বুদ্ধিটা ঠিক তখুনি এসেছিল আমার মাথায়। সেই থেকে প্রতিদিনই আমি এক টুকরো গুড় বা একটা রুটি কিংবা এক কাঁদি কলা নিয়ে নদীর তীরে যেতাম। একবার এক ঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করার পর—মনে হচ্ছিল অনন্তকাল—বাবার দেখা পেয়েছিলাম। বাবা বহুদূরে, বসে ছিলেন নৌকোর খোলে, আয়নার মত স্বচ্ছ নদীতে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ভেসে আছেন। তিনি আমাকে দেখলেন কিন্তু কাছে আসার কোন চেষ্টাই করলেন না। আমি খাবার জিনিসগুলো তুলে দেখালাম তারপর নদীর তীরে একটা পাথরের খোপে রেখে দিলাম, যাতে জন্তু-জানোয়ারেরা খুঁজে না পায়। বৃষ্টি বা কুয়াশাতেও ভিজে নষ্ট হওয়ারও যেখানে কোন আশঙ্কা নেই। দিনের পর দিন আমি একই কর্তব্য করে গেছি। অনেকদিন পর আমি আবিষ্কার করেছিলাম মা আসলে আমার কাজকর্মের কথা জানতেন, কখনো কিছু বলতেন না, ভান করতেন যে কিছুই জানেন না, এমনকি আমার সুবিধের জন্যে সবসময় বাড়তি কিছু খাবার খোলা জায়গায় রেখেও দিতেন যাতে আমার খুঁজে পেতে কোন অসুবিধে না হয়। মা কখনোই তার মনের ভেতর কী আছে বুঝতে দিতেন না।
জমিজমা এবং টাকা-পয়সার ব্যাপার নিয়ে সাহায্য করার জন্য শেষ পর্যন্ত মা তার এক ভাইকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের পড়াশোনার জন্যে একটা মাস্টার রেখে দেয়া হল। মা পাদ্রীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করলেন যেন তিনি প্রার্থনার পোশাক পরে নদীর ধারে এসে বাবাকে অশুভ অপদেবতার প্রভাব মুক্ত করে এই দুঃখজনক পথ থেকে তাকে সরিয়ে আনেন। মা আরেকবার দুজন সেপাইকে দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। বাবা অনেক দূরে থেকে সরে যেতেন। নদীর কুয়াশাতে তাকে ঝাপসা দেখা যেত, তিনি এত দূরে দূরে থাকতেন যে কেউ কখনো তার কাছে যেতে পারত না, তার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা। যে সাংবাদিকেরা কিছুদিন আগে তার ছবি তোলার জন্যে একটা মোটরবোটে করে হাজির হয়েছিলেন তাদের চেষ্টাও বিফলে যায়। বাবা তাদের দেখে নদীর অন্য তীরে গিয়ে ঘন জংলার ভেতরে ঢুকে গেলেন। সেটা মাইলের পর মাইল বিস্তৃত, খানিকটা ঝোপঝাড়, খানিকটা জংলা, শুধু বাবাই ঐ অন্ধকার এলাকাটা হাতের তালুর মত চিনতেন।
চেষ্টা করতে হল আমাদের ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে, সেটা খুবই কঠিন এবং আমরা কখনোই ঠিক অভ্যস্ত হতে পারিনি। আমি অবশ্যি আমার নিজের কথা বলছি। আমি চাই আর নাই চাই, আমার মাথায় ঘুরে-ফিরে শুধু বাবার কথাই আসত। ব্যাপারটির সবচেয়ে দুর্বোধ্য দিক হলো, আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না বাবা কীভাবে টিকে আছেন। দিন কিংবা রাত, কাঠফাটা রোদ কিংবা ঝড়-বাদলার রাত, গুমোট গরম বা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় একটা টুপি ছাড়া কিছু নেই। অথচ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গেল, একসময় কি বছর ঘুরে এল তবু কোন কিছুই তাকে কোনভাবে থামাতে পারল না। বাবা কখনোই নৌকো ভেড়াননি, দুই তীরের কোন তীরেই না। নদীর মাঝখানের ছোট চরেও বাবা কখনো নামেননি। সোজা কথায় বাবা আর কখনোই শক্ত মাটি বা ঘাসে পা রাখেননি। এটা অবশ্যি সত্যি যে ঘুমনোর সময় নৌকোটাকে কোথাও বেঁধে নিতে হত। কিন্তু কখনোই নদীর তীরে আগুন জ্বালাননি, তার কাছে কোন কুপি বা মোমবাতিও ছিল না। তিনি এ জীবনে আর কখনো দেয়াশলাই স্পর্শ করেননি। খাবার চেখে দেখার চেয়ে আর বেশি কিছু করেননি কোনদিন। আমরা নদীর তীরে মাকাল গাছের গুঁড়িতে যে খাবার তার জন্যে রেখে যেতাম তিনি তার থেকে অল্পস্বল্প যেটুকু নিতেন সেটা কোনমতেই তার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। তার কি কখনোই শরীর খারাপ হয়নি? বন্যার পানি যখন গর্জন করে ফুলে-ফেঁপে উঠতো, ভয়ঙ্কর স্রোত যখন মৃত-পশু-পাখি আর গাছপালা নিয়ে তার নৌকোয় আঘাত করতে করতে বয়ে যেত, তখন নৌকোটিকে সোজা করে ধরে রাখতে বাবার দুহাতে না জানি কী অসুরের শক্তি এসে হাজির হত! বাবা আর কখনো কারো সাথে একটি কথাও বলেননি, আমরাও তার কথা বলতাম না, শুধু ভাবতাম। বাবার কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, যদি কখনো মনে হত তার কথা ভুলে গেছি তখন হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটা নতুন করে মনে পড়ে যেত, আর আমরা এর অভাবনীয়তার কথা চিন্তা করে শিউরে শিউরে উঠতাম।
আমার বোনের বিয়ে হল, মা সে জন্যে বিশেষ কোন উৎসবের আয়োজন করলেন না। যখনই আমরা ভাল কিছু খেতাম বাবার কথা মনে পড়ত, যখন আমরা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমোতাম মনে পড়ত বাবা হয়তো বাইরে খোলা জায়গায় ঝড়ের রাতে ঠাণ্ডার ভেতরে কোনমতে একটা লাউয়ের খোল দিয়ে পানি সেচে নৌকো সামলানোর চেষ্টা করছেন। পরিচিত লোকজন মাঝে মাঝে বলত আমি নাকি দেখতে আমার বাবার মত হয়ে উঠছি। আমি অবশ্যি জানতাম এতদিনে নিশ্চয়ই তার মাথায় লম্বা চুল, মুখে-দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল গজিয়েছে। রোদে পুড়ে কালো পশুর মত হয়ে উঠেছে তার রোমশ দেহ এবং হয়তো পশুর মত প্রায় নিরাবরণ, যদিও আমরা বেশ কয়েকবার তার জন্যে কাপড়-জামাও রেখে এসেছি।
বাবার কখনোই আমাদের সম্পর্কে কিছু জানার কৌতূহল হয়নি, তার কি আমাদের জন্যে কোনই মায়া-মমতা নেই? তার জন্যে কিন্তু গভীর মমতা ছিল আমার, মমতা আর শ্রদ্ধা, তাই কেউ যদি আমার কোন কাজের জন্যে প্রশংসা করত আমি সবসময় বলতাম, বাবা আমাকে এটা এভাবে করতে শিখিয়েছিলেন। কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। সত্যির কাছাকাছি একটা মিথ্যের মতো। বাবা যদি আমাদের কথা ভুলে গিয়ে থাকেন, কিংবা আমরা কেমন আছি তা জানার কোন কৌতূহল যদি না থাকে তাহলে আরো দূরে চলে যাচ্ছেন না কেন? দূরে কোথাও নেমে গেলেই হয় যেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন শুধু বাবাই। আমার বোনের যখন একটা ছেলে হল তখন তার মাথায় ঢুকল ছেলেকে দেখাবে বাবাকে। একদিন আমরা তাই সবাই গিয়ে নদীতীরে দাঁড়ালাম। দিনটি ছিল চমৎকার। আমার বোন পরেছিল তার বিয়ের শাদা পোশাক। সে বাচ্চাটিকে দুহাতে ওপরে তুলে ধরলো, আর স্বামী বেচারা একটা ছাতা দুজনের মাথায় মেলে রাখলো। আমরা অনেক ডাকাডাকি করে অপেক্ষা করে রইলাম কিন্তু বাবা এলেনই না। বোনটি আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল, আমরাও আরেকজনকে ধরে একটু কান্নাকাটি করে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।
বোন তার স্বামীর সাথে দূরে চলে যাবার পর আমার ভাই ঠিক করল সে শহরে গিয়ে থাকবে। সময় পাল্টে যায়, কালের অমোঘ নিয়মে। মাও শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন, বয়স হয়ে গিয়েছে তাই বোনের সাথে গিয়ে থাকবেন বলে ঠিক করলেন। শুধু আমি থেকে গেলাম, পুরো পরিবারের মধ্যে একজন মাত্র। আমি কখনো বিয়ের কথা চিন্তা করিনি। যেখানে সারাজীবন ছিলাম জীবনের সব অহেতুক বোঝা নিয়ে সেখানেই থেকে গেলাম। আমি জানি নদীতে ঘুরতে ঘুরতে একদিন আমাকে প্রয়োজন হবে বাবার। কোনদিন কাউকে বললেন না বাবা, কেন এভাবে নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি! আমি শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আমাকে জানতেই হবে ব্যাপারটি কী। সত্যি সত্যি যখন খোঁজ নিতে শুরু করলাম লোকজন আমাকে জানালো নৌকোর কারিগরকে বাবা নাকি কারণটি জানিয়েছিল। এখন সে লোকটিও মারা গেছে, কেউ এখন আর কিছু তার সম্পর্কে জানে না বা মনেও করতে পারে না। শুধু হাস্যকর একটা গল্প শোনা গেল, প্রথম যখন অবিরাম বৃষ্টির ফলে নদীর দুকূল ছাপিয়ে বন্যা আসে লোকজন ভেবেছিল এই বুঝি পৃথিবীর শেষ, শুধু বাবা সম্ভবত নূহ নবীর মত আগে-ভাগে সঙ্কেত পেয়ে তার নৌকো তৈরি করে রেখেছেন! গল্পটি আমি নিজেও আবছা মনে করতে পারি। বাবাকে তার কাজের জন্যে কেন জানি আমি দায়ী করি না। এরকম সময়ে আমি লক্ষ করলাম আমার মাথায় একটা-দুটো চুল পাকতে শুরু করেছে।
আমি এমন একটা মানুষ যার সবটাই দুঃখে ভরা। কেন আমার নিজেকে এত দোষী মনে হয়? কেন? সেটা কি বাবা তার অনুপস্থিতি একরকম জোর করে আমাদের অনুভব করিয়েছেন বলেই? সেই নদীটির জন্যে, যে নাকি বয়ে চলেছে নিরবধি? আমি নিজের মাঝে মাঝ বয়সের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। জীবনের নিশ্চিত অবক্ষয়কে শুধু কোনভাবে আটকে রাখতে চাইছি। প্রায়ই অসুখে ভুগি আমি পেটে ব্যথা, মাথা ঘোরা, কখনো বাতের যন্ত্রণা। আর তিনি? কেন? হায় কেন তিনি এ রকম করলেন! কী কষ্টটাই না তিনি পাচ্ছেন! এত বয়স হয়েছে, এখন কি তার শক্তি কমে আসছে না? আগে হোক পরে হোক একদিন কি তার নৌকোটা উল্টে যাবে না? কিংবা নদী যখন বন্যার পানিতে ফুলে উঠবে, তুমুল বেগে ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে হতে যখন এক সময় প্রবলভাবে আছড়ে পড়বে দুকূল জুড়ে তখন কী অবস্থা হবে তার? আমার বুক কেপে ওঠে, বাবা যেখানে আছেন সেখানে যে আমার এই সহজ নিরাপত্তার কিছুই নেই। ঠিক কী কারণে আমি জানি না, কিন্তু প্রচণ্ড অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। হৃদয়ের গভীরে এক অসহনীয় দুঃখবোধ জেগে ওঠে। হায়, যদি আসল ব্যাপারটা জানতে পারতাম আমি, কিংবা যদি ব্যাপারটি অন্য কোন রকম হতো! তখন, খুব ধীরে ধীরে আমার মাথায় ভাবনাটি এল।
এরপর আমি আর রাত পোহানোর জন্যেও অপেক্ষা করতে পারি না। আমি কি পাগল হয়ে গেছি? না, আমাদের বাড়িতে পাগল শব্দটি ব্যবহার করা হয় না, এই দীর্ঘদিনে এই শব্দটি একবারও উচ্চারিত হয়নি, কাউকেই আর মাথা খারাপ বলে অভিসম্পাত দেয়া হয় না। এই পৃথিবীতে হয় কেউই পাগল নয় অথবা সবাই পাগল। পরদিন আমি গেলাম বাবার সাথে দেখা করতে। সঙ্গে নিলাম একটি চাদর, নাড়ানোর জন্যে। আমি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় কাজকর্ম করছিলাম। নদীতীরে আমি চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকি। অনেকক্ষণ পর বাবাকে দেখা গেল, ধীরে ধীরে তার অস্পষ্ট অবয়ব দৃশ্যমান হল। তিনি গলুইয়ে বসে আছেন, চিৎকার দিলে শুনতে পাবেন এ রকম দূরত্বে। আমি কয়েকবার গলা ফাটিয়ে ডাকলাম তাকে। কথাগুলো যেন আমাকে দিয়ে বলানো হচ্ছিল, উচ্চারিত হচ্ছিল শপথ ঘোষণার মত। জোর করে গলা থেকে শব্দ বের করতে হল, বললাম, ‘বাবা তোমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। তোমার অংশ তুমি করেছ, এখন তুমি ফিরে এস। তোমাকে আর থাকতে হবে না, তুমি ফিরে এস। এখন থেকে আমিই করব। তুমি যদি চাও তাহলে এখনই শুরু করব, না হয় পরে। তুমি আর আমি দুজনেই এটা চাই, নৌকোয় তোমার জায়গায় এখন থেকে আমিই বসতে পারি।’ যখন কথাগুলো বলছিলাম, তখন তার সাথে স্পন্দিত হচ্ছিল আমার হৃদয়। আমার একান্ত আমি, আর সত্যিকারের রূপ আমার ভেতর থেকে বের হয়ে এল।
বাবা আমার কথা শুনতে পেলেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তারপর নৌকোটি ফেরালেন আমার দিকে। তিনি রাজি হয়েছেন। তিনি দুহাত তুলে আমাকে অভিবাদন করলেন, এত বছর পর এই প্রথমবার। হঠাৎ আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। ভয়ে-আতঙ্কে আমার মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল আমার পিছু পিছু বুঝি তিনিও ছুটে আসছেন আর আমি অনুনয় করছি, অনুনয় করে ক্ষমা চাইছি!
ভয়াবহ আতঙ্কের একটা শীতল স্পর্শ আমাকে গ্রাস করে ফেলল এবং তার পরপরই আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। পরে জেনেছি এরপর আর কেউ আমার বাবাকে দেখেনি। আমার কেবলই মনে হত তাকে এভাবে প্রতারণা করার পর আমি কি আর কখনো নিজেকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে পারব? সারাজীবন আমি যা ছিলাম না কখনো এখন কি না তাই হতে হলো, মুখ খোলার সাহস নেই এ রকম একজন মানুষ! আমি জানি আমার ভুল শোধরানোর জন্যে এখন খুব দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু আমি যে পৃথিবীর এক প্রান্তে জীবনটা এভাবে শেষ করে দিতে সাহস পাইনি। কিন্তু আজ বলি, মৃত্যু যখন এসে আমার এই শরীরটাকে স্পর্শ করবে তখন তোমরা সবাই আমার শরীরটাকে একটা ছোট নৌকায় করে ভাসিয়ে দিয়ো। জল স্রোতে ভেসে যাবে অনাদিকাল ধরে। নদীর নিঃসীম উপকূল ছাড়িয়ে আমি যাব, নদীর ভেতরে, নদী থেকে দূরে, নদীতে।
(যোয়াও গিমারায়েস রোয়াসা (১৯০৮-১৯৬৭): জন্ম ব্রাজিলের বিখ্যাত বিশাল পার্বত্যঅঞ্চল সেরতাও-এ। পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি ডাক্তারি ছেড়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন কূটনৈতিক জীবনকে। হামবুর্গ, পারী ও ইউনেস্কোর মতো নানা জায়গায় তিনি পেশাগত দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। Sagarana তাঁর প্রথম গ্রন্থ। প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। তাঁর জন্মভূমি সেরতাও-এর নিস্তরঙ্গ জীবন নিয়ে লেখা নয়টি গল্প সঙ্কলিত করে The Third Bank of the River প্রকাশিত হয় কিছুদিন বাদে। অসাধারণ ভাষা-শিল্পী রোয়াসাকে বলা হয়ে থাকে পর্তুগিজ ভাষার নতুন প্রাণদাতা। অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ, কাব্যিক ও দর্শনের সৌরভমাখা তাঁর ভাষাশৈলী। তিনি তাঁর ছোটগল্পে আশ্চর্য বাকসংযমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, শেষদিকে তিনি দুই পৃষ্ঠার বেশি বড় কোনো গল্পই লিখতেন না। তাঁর শৈশব-কৈশোরের চারণভূমি ‘সেরতাও’ নিয়ে লেখা এপিক উপন্যাস The Devil to Pay in the Backland-কে সমালোচকরা সমগ্র লাতিন আমেরিকার মধ্যে অন্যতম সেরা একটি উপন্যাস বলে মনে করেন। ১৯৬৭ সালে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে ৪০টি অত্যন্ত ক্ষুদ্রকায় গল্প নিয়ে একটি গ্রন্থ এবং মৃত্যৃর পরে ১৯৬৯ সালে Estas Estorias শীর্ষক নয়টি নভেলার একটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়।)
উৎস : ‘জাদুবাস্তবতার গাথা: লাতিন আমেরিকার গল্প’ আলম খোরশেদ সম্পাদিত
0 মন্তব্যসমূহ