অনুবাদ: স্বপন কুমার গায়েন
এ এক বাঘের গল্প। মানুষের মধ্যেই সে বড় হয় এবং লেখাপড়া শেখে। তার নাম হুয়ান দারিয়েন। প্যান্ট-সার্ট পরে চার বছর সে নিয়মিত স্কুলেও গিয়েছে। বনের বাঘ হয়েও ঠিকই তার পড়াশোনা শেষ করেছে। ঠিকই এটা সম্ভব হয়েছিল তার মানবদেহের কারণে। সে গল্পই আজ বয়ান করব।
সেবার শরতের শুরুতে গুটিবসন্তে অনেক লোক মারা যায়। বহু দূরের এক ছোট্ট গাঁয়েও তার প্রকোপ পড়েছিল। ভাই হারায় বোনকে, সবে হাঁটতে শেখা শিশু হয় এতিম। আর মা হারায় সন্তান। এক হতভাগী কম বয়েসী বিধবা নিজেই তার একমাত্র শিশুপুত্রের শব বয়ে নিয়ে যায় কবর দিতে। ঘরে ফিরে সে ছেলের কথা ভাবছিল, আর বিড়বিড় করে বলছিল, ‘ভগবান তুমি একি করলে, আমার কোলের ছেলেকে কেড়ে নিলে। স্বর্গে অনেক দেবতা থাকতে পারে, কিন্তু আমার ছেলে তো তাঁদের চেনে না। হতভাগা বাছা আমার! সে শুধু আমাকেই চিনত।’
বাড়ির পেছনে ছোট একটা ফটকের ধারে সে বসে ছিল। চোখ মেললেই দূরে সে জঙ্গল দেখতে পায়।
সেই জঙ্গলে থাকে অনেক হিংস্র জন্তু। সকালে-সন্ধ্যায় তাদের গর্জন শোনা যেত। হতভাগী পুত্রহারা মা তখনও সেখানে বসে থাকে। অন্ধকারে হঠাৎ সে একটি ক্ষুদে প্রাণীকে দ্বিধাজড়ানো পায়ে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে। দেখতে ছোট বেড়ালের মতো, হাঁটার শক্তিও যেন নেই। ঝুঁকে পড়ে নারীটি সেই ছোট বাঘশিশুকে কোলে তুলে নেয়। একেবারেই শিশু সে। তখনও ভালো করে চোখ ফোটেনি। নিঃস্ব বাঘশাবক তার হাতের স্পর্শ পেয়ে তৃপ্তিতে ঘড়ঘড় শব্দ তোলে, সে আর এখন একা নয়। মানুষের এই ক্ষুদে শত্র“কে সে অনেকক্ষণ হাতে ধরে রাখে। আত্মরক্ষার ক্ষমতাহীন ছোট পশুটিকে সহজেই মেরে ফেলা যেত। কিন্তু পরিবর্তে সে একমনে অসহায় বাঘশাবকের কথাই ভাবে, ভগবান জানেন কোথা থেকে এসেছে, ওর মা নিশ্চয়ই মারা গেছে। কিছু না ভেবেই সে বাঘশাবককে তার বুকে রেখে বড় বড় দুখানি হাতে আঁকড়ে ধরে। আর ক্ষুদে বাঘ উষ্ণতার পরশ পেয়ে নড়েচড়ে আরাম করে শোয়, এক গভীর প্রশান্তিতে ঘড়ঘড় শব্দ তুলে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে।
বিষণœ ও চিন্তামগ্ন নারীটি একসময় ঘরে ঢোকে। বাকি রাত বাঘশাবকের ক্ষুধার কান্না শুনে, তার না-ফোটা চোখে চোখ রেখে কীভাবে সে তার বুকে আশ্রয় খোঁজে লক্ষ করে। তার আর্তহৃদয়ে এক গভীর অনুভূতির জন্ম হয়। মহাবিশ্বের পরম বিধানে সকল জীবই সমান...
আর তাই সে ক্ষুদে বাঘটিকে স্তন্য পান করায়।
বাঘশাবক রক্ষা পায়, আর মা পায় পরম প্রশান্তি। সে প্রশান্তি এতই গভীর যে কখন এই বাঘশাবককে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে, সেই কথা ভেবে সে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। কারণ গ্রামে যদি জানাজানি হয়ে যায় সে বনের পশুকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করছে তবে নির্ঘাৎ তারা ক্ষুদে প্রাণীটিকে মেরে ফেলবে। কী করা উচিত তার? তুলতুলে আদুরে বাঘশাবক তার বুকে খেলা করে, সে যেন তার হারানো ছেলে।
এমনি করেই দিন যাচ্ছিল। এক বর্ষণমুখর রাতে তার বাড়ির পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে একটি লোক চাপা, কর্কশ, বিলাপের শব্দ শোনে, যা সদ্যজাত পশুর গলা থেকে বেরিয়ে এলেও মানুষকে ভীত করে তুলতে পারে। লোকটি হঠাৎ করেই থেমে যায়, তারপর রিভলবার বের করে দরজায় টোকা দেয়। লোকটির পায়ের শব্দ মা ঠিকই শুনেছিল। চিন্তায় আকুল হয়ে সে ক্ষুদে বাঘকে বাগানে লুকিয়ে রাখার জন্য ছোটে। ভাগ্য ভালো তার। পেছনের দরজা খোলার চেষ্টা করতেই সে দেখে এক বিজ্ঞ, বর্ষীয়ান সাপ তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে। ভয়ে, আতঙ্কে হতভাগিনী চিৎকার করতে যাচ্ছিল, তখন সাপ কথা বলে ওঠে, ‘ভয় নেই, মেয়ে। তোমার মাতৃহৃদয় একটি জীবন রক্ষা করতে ব্যগ্র। এই মহাবিশ্বে সব জীবনই তো সমান। কিন্তু মানুষ তোমাকে বুঝবে না, তারা চাইবে তোমার নতুন ছেলেকে হত্যা করতে। ভয় পেয়ো না, নির্ভয়ে যাও। এ মুহূর্ত থেকে তোমার ছেলে মানুষের দেহ পাবে; পশু বলে তাকে চেনা যাবে না। তার হৃদয় গড়ে তোল; তাকে তুমি তোমার মতো ভালো হতে শেখাও, কখনো জানাবে না সে মানুষ নয়। যদি না... যদি না মানুষের মাঝে অন্য কোন মা তাকে অভিযুক্ত করে; যদি না আরেক মা দাবি করে তুমি তাকে যা দিয়েছ নিজের রক্ত দিয়ে সে তা পরিশোধ করুক, তবে তোমার ছেলে সবসময়ই তোমার যোগ্য সন্তান হবে। নির্ভয়ে যাও মা, তাড়াতাড়ি কর, লোকটা তোমার দরজা ভেঙে ফেলছে।’
মেয়েটি সাপের কথা বিশ্বাস করে। কারণ সব ধর্মেই আছে, পৃথিবীতে যারা বসবাস করে তাদের জীবনের রহস্য সাপেদের জানা। তাই সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, আর ক্ষুব্ধ লোকটা রিভলবার হাতে ঢুকে সারা বাড়ি খুঁজে কিছুই পায় না। লোকটা চলে যেতেই মা কাঁপতে কাঁপতে তার রিবোজো খোলে, যেখানে বুকের কাছে যে ক্ষুদে বাঘকে লুকিয়ে রেখেছিল। বাঘশাবকের জায়গায় একটি ছোট ছেলেকে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সে। সুখে বিহ্বল হয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে চুপিসারে কাঁদে, তার বুনো ছেলে হঠাৎ করে মানুষের রূপ পেয়ে গেছে। এই চোখের জলে বারো বছর পর এই ছেলেটিকে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিল মায়ের কবরের ওপর নিজের রক্ত দিয়ে।
দিন যায়। ছেলেটির নামের দরকার হয়। মা তাকে হুয়ান দারিয়েন বলে ডাকে। তার খাবার, জামা, জুতোর দরকার হয়। মা দিন-রাত কাজ করে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু যোগায়। তার বয়স তখনো কম, চাইলেই সে আবার বিয়ে করতে পারত। কিন্তু ছেলের গভীর ভালোবাসাই যথেষ্ট ছিল তার জন্য। আর সেও সমস্ত হৃদয় দিয়ে সে ভালোবাসার প্রতিদান দিত।
হুয়ান দারিয়েন সত্যিই ভালোবাসার যোগ্য ছিল। তার মতো ভালো ও দয়ালু আর কেউ ছিল না। বিশেষ করে মার প্রতি ছিল তার সুগভীর শ্রদ্ধা। সে কখনো মিথ্যা বলত না। (কারণ সম্ভবত মনের গভীরে সে ছিল বন্য। এটা সম্ভব হতে পারে। কারণ তাপসী মায়ের আত্মার পবিত্রতা সদ্যজাত পশুর ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা এখনো জানা যায়নি।)
এই হলো হুয়ান দারিয়েন। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে সে স্কুলে যেত। তার লাজুক স্বভাব ও রুক্ষ চুল নিয়ে তারা তাকে ক্ষ্যাপাত। হুয়ান দারিয়েন অসাধারণ মেধাবী ছিল না; কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তার গভীর অনুরাগ সে ঘাটতি পূরণ করে দিত।
এভাবেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু তার বয়স তখনো দশ বছর হয়নি, যখন তার মা মারা গেল। হুয়ান দারিয়েনের কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত সময় তার ব্যথা কমিয়ে আনল ঠিকই, কিন্তু তখন থেকেই সে পরিণত হলো এক বিষণœ বালকে, যার একমাত্র আকাক্সক্ষা নিজেকে শিক্ষিত করা।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। গ্রামের লোক হুয়ান দারিয়েনকে ভালোবাসত না। সভ্যতাবর্জিত জংলি গ্রামের মানুষ যেসব ছেলে খুব দয়ালু, মন-প্রাণ দিয়ে পড়াশোনা করে তাদের পছন্দ করে না। তাছাড়া সে স্কুলের সেরা ছাত্র। আর এই পরিস্থিতিই আমাদের গল্পকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাবে এমন এক ঘটনার মধ্য দিয়ে যা সেই সাপের ভবিষ্যদ্বাণীকেই সত্য প্রমাণিত করবে।
গোটা গ্রাম তখন প্রস্তুত হচ্ছিল এক বড় উৎসবের জন্য। দূর শহর থেকে আতসবাজি আনার ব্যবস্থা হয়েছিল। একজন ইনসপেক্টর স্কুল পরিদর্শনে আসবেন বলে ছেলেমেয়েদের তৈরি করা হচ্ছিল। ইনসপেক্টর এলে শিক্ষক তাঁকে সেরা ছাত্র হুয়ান দারিয়েনকে প্রশ্ন করতে বললেন। হুয়ান ছিল এমন ছাত্র যে সবসময় ভালো ফল করত। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিহ্বলতায় তার কথা জড়িয়ে আটকে গেল, আর জিহ্বা জড়িয়ে গিয়ে এক উদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে।
ইনসপেক্টর অনেক সময় নিয়ে ছাত্রটিকে পর্যবেক্ষণ করে নিচু স্বরে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেটা কে? কোত্থেকে এসেছে?’
‘ওর নাম হুয়ান দারিয়েন’, শিক্ষক জবাব দিলেন। ‘গ্রামের এক বিধবা ওকে মানুষ করেছে। সে মারা গেছে। ছেলেটি কোথা থেকে এসেছে কেউ জানে না।’
হুয়ান দারিয়েনের রুক্ষ চুল আর চোখের সবুজাভ প্রতিফলন লক্ষ করে ইনসপেক্টর বিড়বিড় করে বললেন, ‘অদ্ভুত, খুব অদ্ভুত।’
ইনসপেক্টর জানতেন মানুষ যা আবিষ্কার করতে পারে তার চেয়ে অদ্ভুত অনেক কিছুই পৃথিবীতে আছে। সেই সাথে এও জানতেন হুয়ান দারিয়েনকে শুধু প্রশ্ন করে কখনো বের করা যাবে না, তিনি যা ভয় করছেন সত্যিই সে কখনো সেই বনের পশু ছিল কি না। কিছু মানুষ আছে যারা বিশেষ অবস্থায় তাদের পূর্বপুরুষের জীবনে কী ঘটেছিল তা স্মরণ করতে পারে। তেমনি সম্মোহিত অবস্থায় হুয়ান দারিয়েন বন্যপশু হিসেবে তার জীবনের কথা মনে করতেও পারে। যেসব ছেলেমেয়ে এ গল্প পড়ছে অথচ মানে বুঝতে পারছে না তারা বড়দের জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারে।
ইনসপেক্টর উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্ল্যাটফরমে উঠে নিজের কথাগুলো বললেন, ‘খোকা-খুকুরা, আমি চাই তোমাদের ভেতর থেকে কেউ জঙ্গলের একটি বর্ণনা দাও। বলতে গেলে জঙ্গলেই তোমরা বড় হয়েছ এবং তাকে তোমরা ভালো করে জান। জঙ্গল কেমন? সেখানে কী ঘটে? এসবই আমি জানতে চাই। এই যে তুমিÑ’ এলোপাতাড়ি এক ছাত্রকে লক্ষ করে তিনি বললেন, ‘প্ল্যাটফরমে উঠে এসো, বল তুমি কী দেখেছ।’
ছাত্রটি প্ল্যাটফরমে গেল। ভয় পেলেও সে কয়েক মিনিট জঙ্গলের বর্ণনা দিল। সে বলল, জঙ্গলে বিশাল সব গাছ আছে, গাছ বেয়ে ওঠা লতাগুলো আর ছোট ছোট ফুল আছে। সে বলা শেষ করলে আরেক ছাত্র প্ল্যাটফরমে উঠল, তারপর আরেকজন, যদিও তারা সবাই জঙ্গলকে ভালোভাবেই জানত, তারা একই রকম বর্ণনা দিল। কারণ শিশুরা এবং অনেক বয়স্ক মানুষও, নিজেরা যা দেখেছে তা বলে না, বলে তারা যা দেখেছে সে সম্বন্ধে যা পড়েছে সেই কথা। সবশেষে ইনসপেক্টর বললেন, ‘এবার হুয়ান দারিয়েনের পালা।’
হুয়ান দারিয়েনও অন্যরা যেমন বলেছিল কম-বেশি সে রকমই বলল। কিন্তু ইনসপেক্টর তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘না, না আমি চাই তুমি ঠিক যেমনটি দেখেছ তা, মনে কর। চোখ বন্ধ কর।’
হুয়ান দারিয়েন চোখ বোজে।
‘ভালো, এবার বল জঙ্গলে তুমি কী দেখ, ‘ইনসপেক্টর প্রশ্ন করেন। হুয়ান দারিয়েনের চোখ তখনো বোজা, খানিক ইতস্তত করে সে শেষ পর্যন্ত বলে, ‘আমি কিছুই দেখছি না।’
‘শিগ্গিরই দেখবে তুমি। মনে কর এখন রাত তিনটে, ভোর হতে কিছু দেরি আছ্ েআমরা সবে খেয়েছি ধর। আমরা জঙ্গলে...অন্ধকারে...আমাদের সামনে একটি ছোট নালা। কী দেখছ তুমি?’
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে হুয়ান দারিয়েন। ক্লাসঘর এবং পাশের জঙ্গলেও অখণ্ড নীরবতা। হঠাৎ হুয়ান দারিয়েন কেঁপে ওঠে, আর ধীর গলায়, যেন স্বপ্ন দেখছে, বলে, ‘আমি দেখছি পাথর গড়িয়ে পড়ছে, ঝুঁকে পড়া গাছের ডাল...মাটি... আরো দেখছি পাথরের ওপর ঝরে পড়া শুকনো পাতার স্তূপ...’
‘এক মিনিট!’, ইনসপেক্টর থামিয়ে দেন ওকে। ‘গড়িয়ে পড়া পাথর, পাতা, এসব কত উঁচুতে?’
‘ইনসপেক্টরের প্রশ্নের উদ্দেশ্য হলো,...
বন্য জন্তু হিসেবে খাবার শেষে জল খেতে গিয়ে সে যা করত তাই যদি হুয়ান দারিয়েন সত্যিই ‘দেখে’, তা হলে বাঘেরা নদীর দিকে যেতে পাথরগুলোকে চোখের সামনে যে উচ্চতায় দেখে হুয়ান দারিয়েনও তেমনি দেখবে। ইনসপেক্টর তাই আবার প্রশ্ন করেন, ‘পাথরগুলো কত উঁচু?’
হুয়ান দারিয়েন চোখ বোজা অবস্থায় জবাব দেয়, ‘পাথরগুলো মাটির ওপরে,...কান ছুঁয়ে যায়...ঝরা পাতারা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে নড়ে ওঠে...আর আমি অনুভব করি আমার...’
হুয়ান দারিয়েনের স্বর থেমে যায়।
‘কোথায়?’ ইনসপেক্টর দৃঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করেন। ‘কোথায় তুমি আর্দ্রতা অনুভব কর?’
‘আমার গোঁফে,’ হুয়ান দারিয়েন চোখ খুলে ভীত খসখসে গলায় জবাব দেয়।
গোধূলি নামছিল। জানলা দিয়ে ইতিমধ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গল দেখা যাচ্ছিল। কী ভয়ঙ্কর সত্য উদ্ঘাটিত হলো ছাত্ররা তা বোঝেনি। কিন্তু উয়ান দারিয়েনের অসাধারণ গোঁফ নিয়ে তারা হাসি-তামাশাও করেনি। হুয়ান দারিয়েনের আদৌ কোন গোঁফ ছিল না। তারা হাসেনি কারণ হুয়ান দারিয়েনের মুখ পাণ্ডুর ও চিন্তাক্লিষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
ক্লাস শেষ হয়। ইনসপেক্টর লোক খারাপ ছিলেন না। কিন্তু যেসব মানুষ জঙ্গলের খুব কাছাকাছি বসবাস করে তাদের সবার মতো তাঁরও বাঘের প্রতি এক অন্ধ ঘৃণা ছিল। আর তাই তিনি নিচু গলায় শিক্ষককে বলেন :
‘ হুয়ান দারিয়েনকে অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে। সে বনের পশু, সম্ভবত বাঘ। ওকে আমাদের মেরে ফেলতেই হবে, না হলে আজ না হোক কাল ও আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। এখনো ওর মধ্যে পশুত্ব জেগে ওঠেনি, কিন্তু একদিন বিস্ফোরণ ঘটবে। তখন ও আমাদের সবাইকে গিলে ফেলবে, যদি আমরা ওকে আমাদের মধ্যে থাকতে দিই। তাই ওকে শেষ করে দিতে হবে। মুশকিল হলো যতক্ষণ ও মানুষের রূপ নিয়ে আছে, ততক্ষণ আমরা ওকে মারতে পারি না, কারণ আমরা প্রমাণ করতে পারব না যে ও বাঘ। ও দেখতে মানুষের মতো, আর মানুষের বেলায় অবশ্যই সাবধানে এগোতে হবে। আমি জানি শহরে এক লোক আছে সে বন্য পশু পোষ মানাতে পারে। আমরা তাকে ডেকে পাঠাই। হুয়ান দারিয়েন যাতে তার বাঘের শরীরে ফিরে যায় তেমন কোন উপায় সে বের করতে পারবে। আর যদি নাও পারে, লোকে আমাদের কথা বিশ্বাস করবে এবং হুয়ান দারিয়েনকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দেবে। আর দেরি না করে উয়ান দারিয়েন পালানোর আগেই সেই পশু গুনিনকে ডেকে পাঠানো দরকার।’
পালানোর কথা হুয়ান দারিয়েনের মনেও হয়নি। কারণ কিছু একটা যে ঘটছে, সে তা আদৌ বুঝতে পারেনি। সে যে মানুষ সে কথা কী করে সন্দেহ করবে যখন মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করেনি সে। শুধু তাই নয় ক্ষতিকর হিংস্র জন্তুদের পর্যন্ত ঘৃণা করেনি কোনদিন।
কিন্তু মুখে মুখে কথাটি প্রচারিত হতে থাকে, আর হুয়ান দারিয়েনের দুর্ভোগও শুরু হয়। লোকে তার কথার জবাব দেয় না; সে কাছাকাছি গেলেই তারা চকিতে সরে যায়, আর রাতে দূর থেকে তাকে অনুসরণ করে।
‘কী হলো আমার? কেন ওরা আমার সাথে এমন ধারা ব্যবহার করছে?’ হুয়ান দারিয়েন প্রশ্ন করে নিজেকে।
শুধু যে তারা তার কাছ থেকে সরে যেতো তাই নয়, ছোট ছেলেরা তাকে লক্ষ করে চিৎকার করত, ‘ভাগো এখান থেকে। যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও! দূর হয়ে যাও!’
শত্র“তায় বয়স্করাও ছোটদের চেয়ে কম যেত না। শেষ পর্যন্ত উৎসবের দিন বিকেলে বহু প্রতীক্ষিত সেই গুনিন এসে না পৌঁছুলে কী হতো কে জানে। হুয়ান দারিয়েন ঘরে বসে রাতে যে সামান্য সুপ খেত তাই তৈরি করছিল। এমন সময় তার কানে আসে লোকজন চিৎকার করতে করতে তার বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। কী হচ্ছে দেখার জন্য বের হতে না হতেই তারা তাকে ধরে টানতে টানতে গুনিনের সামনে হাজির করে।
‘এই যে এখানে!’ তাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ওরা চিৎকার করে ওঠে। ‘এই-ই হচ্ছে সেই! ও একটা বাঘ। আমরা ওর সম্বন্ধে কিছুই জানতে চাই না! ওর মানুষ রূপ কেড়ে নাও, আমরা ওকে মেরে ফেলব।’
ছোট ছেলেরা, যাদের সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত সেই সহপাঠীরা, এমনকি বয়স্করাও চিৎকার করতে থাকে, ‘ও একটা বাঘ! হুয়ান দারিয়েন আমাদের খেয়ে ফেলবে। মার উয়ান দারিয়েনকে।’
কিল, ঘুষি বৃষ্টিধারার মতো ঝরল ওর গায়ে, আর হুয়ান দারিয়েনÑমাত্র বার বছরের বালক সেÑকাঁদল, প্রতিবাদ করল। এক সময়ে ভিড় ফাঁকা হলো, আর লাল জামা গায়ে, উঁচু চামড়ার বুট পায়ে, চাবুক হাতে গুনিন মহাশয় হুয়ান দারিয়েনের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চাবুকটা আঁকড়ে ধরে সজোরে।
‘আহা!’, বিদ্রƒপ করে সে। ‘আমি ঠিকই চিনেছি তোকে! আর সবাইকে বোকা বানাতে পারলেও আমাকে পারবি না। আমি দিব্যি দেখছি তোকে, বাঘের বাচ্চা। তোর জামার নিচে বাঘের ডোরা দাগ আমি দেখতে পাচ্ছি। জামা খোল! শিকারী কুকুরগুলোকে ডাক, আমরা শিগগিরই দেখতে পাব কুকুরগুলো তোকে মানুষ হিসেবে শনাক্ত করে, না বাঘ হিসেবে!’
মুহূর্তের মধ্যে তারা হুয়ান দারিয়েনের গায়ের সব কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং তাকে এক বন্যজন্তুর খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়।
‘কুকুরগুলোকে ছেড়ে দাও। এখনই!’ গুনিন নির্দেশ দেয়। ‘আর তোর জংলি দেবতাদের নাম স্মরণ কর হুয়ান দারিয়েন।’
বাঘ শিকারে পাকা চারটি হিংস্র কুকুরকে লেলিয়ে দেয়া হয়। গুনিন জানে কুকুরেরা সবসময় বাঘের গায়ের গন্ধ টের পায়। সে জানত শিকারী কুকুরের চোখ উয়ান দারিয়েনের মানুষী চামড়ার নিচে লুকিয়ে থাকা বাঘের ডোরাকাটা দাগ ঠিকই দেখতে পাবে। আর মানুষের পোশাকবিহীন হুয়ান দারিয়েনের গায়ের গন্ধ পেলেই তারা ওকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।
কিন্তুহুয়ান দারিয়েনের মধ্যে কুকুরগুলো সেই ভালো ছেলেটিকেই দেখতে পায় যে ক্ষতিকর জন্তুদেরও খুব ভালোবাসে। ওর গায়ের গন্ধ পেয়ে তারা ধীরে ধীরে লেজ নাড়তে থাকে।
‘ওকে গিলে ফেল! ও একটা বাঘ। যা, গিলে ফেল!’, চিৎকার করে কুকুরগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। কাকে আক্রমণ করতে হবে বুঝতে না পেরে কুকুরগুলো পাগলের মতো গর্জন করতে করতে খাঁচার চারপাশে লাফালাফি করতে থাকে।
পরীক্ষায় কোন ফল পাওয়া গেল না।
‘ঠিক আছে।’, গুনিন বলে। ‘কুকুরগুলো বেজন্মা, বাঘের বংশের। তাই ওকে চিনতে পারেনি। কিন্তু আমি তোকে চিনেছি, হুয়ান দারিয়েন। এবার দেখা যাবে।’
একথা বলে সে খাঁচায় ঢোকে এবং চাবুক তোলে। ‘বাঘ!’, চিৎকার করে ওঠে সে। ‘তুই একটা বাঘ, কিন্তু এখন তুই একজন মানুষের মুখোমুখি। মানুষের যে চামড়া তুই চুরি করেছিস তার নিচে বাঘের ডোরাকাটা দাগ আমি দেখতে পাচ্ছি। তোর ডোরাকাটা খুলে দেখা!’ বলে হুয়ান দারিয়েনের শরীরে সে চাবুক দিয়ে নির্মম আঘাত হানে। উলঙ্গ, হতভাগা প্রাণীটি তখন ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। আর মত্ত জনতা প্রতিধ্বনি তোলে, ‘দেখা, তোর বাঘের দাগ দেখা।’
এই নির্মম অত্যাচার চলে কিছুক্ষণ। কিন্তু যেসব ছোট ছেলেমেয়ে আমার গল্প পড়ছে, আমি চাই না তারা কাউকে এভাবে নির্যাতিত হতে দেখুক।
‘দয়া কর! আমি মরে যাচ্ছি,’ হুয়ান দারিয়েন আকুতি জানায়।
‘তোর ডোরাকাটা দাগ দেখা’, তাদের জবাব আসে।
‘না, না’ আমি মানুষ! ও মা!’ হতভাগা শিশু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
‘দাগ দেখা বলছি’, তাদের জবাব।
একসময় নির্যাতন শেষ হয়। খাঁচার পেছন দিকে এক কোণে পড়ে থাকে শিশুর বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত ছোট্ট দেহ, হুয়ান দারিয়েন তার নাম। সে তখনো জীবিত। ওরা যখন তাকে টেনে বের করে আনে তখনো সে হাঁটতে পারছিল। কিন্তু যে কষ্ট সে পাচ্ছিল, তা কখনো জানতে পারবে না কেউ।
খাঁচা থেকে টেনে বের করে রাস্তার মধ্য দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তারা তাকে গ্রামের বাইরে তাড়িয়ে দিতে থাকে। প্রতি পদক্ষেপেই সে পড়ে যাচ্ছিল, আর তার পেছনে তাকে ধাক্কা দিতে দিতে আসছিল ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষের দল।
‘এখান থেকে ভাগ উয়ান দারিয়েন! বাঘের ছা জঙ্গলে ফিরে যা। বাঘের হৃদয়। দূর হয়ে যা হুয়ান দারিয়েন!’
আর যারা দূরে ছিল, আঘাত হানতে পারছিল না, তারা ঢিল ছুঁড়ছিল ওকে লক্ষ্য করে।
শেষ পর্যন্ত হুয়ান দারিয়েন ভেঙে পড়ে, তার করুণ কচি দুহাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে সামনে প্রসারিত হয়। আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই, শিশু কোলে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা উয়ান দারিয়েনের এই বিনীত প্রার্থনার ভঙ্গিকে ভুল বোঝে।
‘ও আমার শিশুকে চুরি করার চেষ্টা করছিল!’ মহিলা চেঁচিয়ে ওঠে। ‘ও হাত বাড়িয়েছিল শিশুকে মারার জন্য। ও একটা বাঘ! এসো ও আমাদের ছেলেমেয়েদের মারার আগে আমরা এখনই ওকে মেরে ফেলি।’
মহিলার কথা শেষ হলো। আর সেই সাথে এভাবেই সত্য হলো নাগরাজের সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে, হুয়ান দারিয়েনের তখুনি মৃত্যু হবে, যখন মানুষেরই এক মা অসঙ্গতভাবে তার জীবন দাবি করবে, যে জীবন তাকে দিয়েছিল আরেক মানুষ মাতা।
আর কোন অভিযোগের দরকার হলো না। উত্তেজিত জনতা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। পাথর ধরা কুড়িটি হাত ওপরে উঠে এলো হুয়ান দারিয়েনকে গুঁড়িয়ে ফেলার জন্য। এসময় পেছন থেকে কর্কশ গলায় গুনিনের নির্দেশ আসে, ‘ওকে আগুনে দাগিয়ে দেয়া যাক! এসো, আজকে আতসবাজি পোড়ানোর সাথে সাথে ওকেও পোড়ানো হোক।’
দেরি হয়ে গিয়েছিল। ওরা যখন নগর-চত্বরে পৌঁছায় তখন আঁধার নেমেছে। চত্বরে চাকা, চুড়ো আর হ্যাজাকবাতি দিয়ে বড় করে আতসবাজি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। হুয়ান দারিয়েনকে সবচেয়ে উঁচুতে বেঁধে দিয়ে তারা এক কোণে আগুন লাগিয়ে দেয়। একটি আগুনের সুতো ওপরে-নিচে ছুটতে ছুটতে পুরো প্রদর্শনীকে আলোকিত করে তোলে। আর উঁচুতে স্থির তারকারাজি আর বহুবর্ণের অতিকায় সব চাকার মাঝে দৃশ্যমান থাকে উয়ান দারিয়েনের করুণ বলিদান।
‘মানুষ হিসেবে আজ তোর শেষ দিন, হুয়ান দারিয়েন’, হল্লা করছিল সবাই।
‘তোর ডোরাকাটা দাগ দেখা।’
আগুনের ঝলক আর ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে যন্ত্রণায় মোচড়াতে মোচড়াতে সে কেঁদে ওঠে, ‘মাপ কর, মাপ কর আমাকে।’ হলুদ, লাল আর সবুজ চাকাগুলো উদভ্রান্তের মতো ঘুরছিল, কিছু ডাইনে, কিছু বাঁয়ে। প্রদর্শনীর সব কিনার ঘেঁষে জ্বলন্ত আগুনের শিখারা তার বিশাল পরিধির জানান দিচ্ছিল। আর কেন্দ্রে উয়ান দারিয়েন ব্যথায় মুচড়ে উঠছিল, তার দেহের সাথে আড়াআড়িভাবে বয়ে যাওয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ধারা তাকে পুড়িয়ে মারছিল।
‘তোর ডোরাকাটা দাগ দেখা,’ নিচ থেকে অবিরত চিৎকার উঠছিল।
‘না! আমাকে ক্ষমা কর! আমি মানুষ!’ দুঃস্থ প্রাণীটির তখনো কেঁদে ওঠার মতো সময় ছিল। আগুনের আরেকটি নতুন তরঙ্গ বয়ে যাবার পর দেখা গেল তার দেহ খিঁচুনি দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে; তার আর্তনাদ গভীর ও কর্কশ হয়ে আসছে, আর একটু একটু করে তার দেহে বদলাচ্ছে রূপ।
বিজয়ের বর্বর চিৎকার তুলে জনতা শেষ পর্যন্ত দেখল মানুষের চামড়ার নিচে বাঘের গায়ের কালো, সমান্তরাল, মারাত্মক ডোরাকাটা দাগ ফুটে উঠছে।
চরম নৃশংস কাজ শেষ হয়। যা তারা চেয়েছিল তা পায়। মাথার ওপরে নিরপরাধ এক প্রাণীর জায়গায় মরণযন্ত্রণায় গর্জনরত এক বাঘের দেহ ঝুলতে থাকে।
বাতিগুলো ম্লান হয়ে আসে। ক্ষয়ে আসা এক চাকা থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আরেক বর্ষণ পৌঁছে যায় হাতের কব্জিতে (না, বাঘের থাবা, কারণ হুয়ান দারিয়েন বলে আর কেউ ছিল না।) বেঁধে রাখা দড়িতে, দেহটা সশব্দে মাটিতে পড়ে। জনতা দেহ টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলের কিনারে, ফেলে রেখে আসে শেয়ালে খাবে বলে।
কিন্তু বাঘ মরেনি। রাতের শীতলতার সাথে সাথে তার চেতনা ফিরে আসে। আর প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেও সে নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যায়। পুরো একমাস জঙ্গলের সবচেয়ে গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশে সে আশ্রয় নেয়, আর পশুর বিষণœ সহিষ্ণুতা নিয়ে সব ক্ষত সেরে ওঠার জন্য অপেক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত সব ক্ষতই ভরাট হয়, শুধু একটি ছাড়া। দেহের একপাশে গভীর পোড়া সে ক্ষত বাঘটি পাতা দিয়ে ঢেকে রাখত।
আগের মানুষ--জীবন থেকে তিনটি জিনিস ধরে রাখে বাঘটি অতীতের সুস্পষ্ট স্মৃতি, হাত ব্যবহার করার কৌশল (যা সে মানুষের মতোই ব্যবহার করত) ও ভাষা। কিন্তু অন্য সব বিচারে সে নিরঙ্কুশ এক পশুতে পরিণত হয়। অন্যান্য বাঘের সাথে তার কোন তফাত থাকে না।
যখন শেষ পর্যন্ত সে পুরোপুরি সুস্থ বোধ করে, বনের অন্য সব বাঘকে একরাতে সে গ্রামবাসীদের আবাদী জমির সীমানায় বড় বাঁশ ঝোপের কাছে জড়ো হতে বলে। রাত নেমে এলে সে নীরবে গ্রামের দিকে এগোয়। গ্রামের কিনারায় পৌঁছে সে একটি গাছে চড়ে বসে এবং অনেক সময় ধরে একটুও নড়াচড়া না করে প্রতীক্ষা করে থাকে। নিচের দিকে না তাকিয়েও সে ঘৃণা ও করুণা উদ্রেক করে এমন সব মেয়েলোক এবং পরিশ্রান্ত শ্রমিকদের চলে যেতে দেখে। শেষ পর্যন্ত সে উঁচু-বুট-পায়ে লাল কোট গায়ে একজন লোককে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে।
সে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়, গাছের একটা শাখাও নড়ে না। গুনিনের ওপর সে লাফিয়ে নামে, থাবার এক চাপড়ে তাকে অচেতন করে ফেলে, তার বেল্ট দাঁতে কামড়ে ধরে অক্ষত অবস্থায় তাকে বাঁশের বড় ঝোপের কাছে বয়ে নিয়ে যায়।
ঝোপের বাঁশ এত লম্বা যে নিচের যে জমি থেকে তা বেড়ে উঠেছে তাকেও আড়াল করে রাখে। সেখানে অন্ধকার বনের বাঘেরা পায়চারি করছিল, তাদের চোখগুলো যেন চলমান উজ্জ্বল আলো। গুনিন তখনো অচেতন। বাঘ বলল, ‘ভাইসব, বারো বছর ধরে আমি মানুষের মধ্যে মানুষের মতো বসবাস করেছি। কিন্তু আমি বাঘ। আমি এখন যা করতে যাচ্ছি তা সম্ভবত তার চিহ্ন মুছে দেব। ভাইসব, আজ রাতে আমি অতীতের সাথে আমার শেষ বাঁধনটি ছিঁড়ে ফেলব।’
একথা বলে, বাঘ তখনো অচেতন লোকটিকে মুখে করে বাঁশ ঝোপের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় ওঠে। সেখানে সে তাকে দুটি বাঁশের মাঝখানে বেঁধে রাখে। তারপর নিচে শুকনো পাতায় আগুন ধরিয়ে দেয়। শিগগিরই চড়চড় শব্দে আগুনের শিখা জ্বলে ওঠে। আগুন দেখে ভীত পশুরা সরে যায়, কিন্তু বাঘ তাদের বলে, ‘ভয় নেই, ভাইসব!’ তারা শান্ত হয়, আর সামনের থাবা দুটি আড়াআড়িভাবে রেখে প্রসারিত দেহ পেটের ওপর ভর করে দেখতে থাকে।
বাঁশ ঝোপ প্রকাণ্ড এক আতসবাজি প্রদর্শনীর মতো হয়ে জ্বলে। বোমার মতো শব্দ করে বাঁশ ফাটে, নির্গত গ্যাস সরু, উজ্জ্বল বর্ণের তীরের মতো চক্রজাল রচনা করে। আগুনের শিখা দ্রুত, নিঃশব্দ ফুৎকারে ওপরে উঠে যায়, নিচে রেখে যায় কালশিরে পড়া ফাঁকা জায়গা, আর শিখার আগুন যেখানে পৌঁছেনি, সেখানে আগুনের তাপে বাঁকা হয়ে দোলে বাঁশ গাছ।
আগুনের শিখার স্পর্শে লোকটির চেতনা ফিরে আসে। নিচে লালচে চোখ তুলে বাঘেরা তার দিকে চেয়ে আছে, সে দেখে এবং বুঝতে পারে কী ঘটেছে।
‘আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে ক্ষমা কর,’ মোচড়াতে মোচড়াতে এপাশ-ওপাশ করতে করতে সে চিৎকার করে। ‘আমি সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি।’
কেউ জবাব দেয় না। লোকটা তখন অনুভব করে ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করেছেন, তখন সে সব আবেগ জড়ো করে কেঁদে ওঠে, ‘আমাকে ক্ষমা কর হুয়ান দারিয়েন।’
একথা শুনে হুয়ান দারিয়েন মাথা তোলে এবং ঠাণ্ডা গলায় বলে, ‘ হুয়ান দারিয়েন নামে এখানে কেউ নেই। আমি হুয়ান দারিকেনকে চিনি না। ওটা মানুষের নাম, আর এখানে আমরা সবাই বাঘ।’
সাথীদের দিকে ফিরে, যেন বুঝতে পারেনি এমন ভাব করে সে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের কারো নাম কি হুয়ান দারিয়েন!’
কিন্তু ততক্ষণে আগুনের শিখারা আকাশ ছুঁয়েছে। আর সেই শিখার দেয়াল ভেদ করে ছুটন্ত তীক্ষè সব বাতির মাঝখানে একটা জ্বলন্ত, ধূমায়িত কালো দেহ দেখা যেতে থাকে।
‘আমি শিগ্গিরই তোমাদের সাথে ফিরে আসব, ভাইসব’, বাঘ বলে। ‘কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি আছে, যা আমাকে করতে হবে।’
আবার একবার সে গ্রামের দিকে রওনা হয়। অলক্ষে বাঘেরা তাকে অনুসরণ করে। এত হতশ্রী, করুণ বাগানের সামনে সে থামে, দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকে এবং অনেক প্রস্তরফলক ও ক্রুশ পেরিয়ে এক টুকরো অসজ্জিত জমির সামনে গিয়ে থামে। আট বছর ধরে সে যাকে মা ডেকেছে সেই নারী সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত। বাঘ জানু পেতে বসেÑমানুষের মতো জানু পেতে এবং মুহূর্তের জন্য নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা বিরাজ করে সেখানে।
এক প্রগাঢ় কোমল স্বরে বাঘ শেষ পর্যন্ত কথা বলে, ‘মা! মানুষের মধ্যে তুমিই শুধু বুঝেছিলে, মহাবিশ্বের সব প্রাণীরই জীবনের ওপর পবিত্র অধিকার আছে। একমাত্র তুমিই স্বীকৃতি দিয়েছিলে যে মানুষ আর বাঘ তাদের হৃদয়ে পৃথক। তুমি আমাকে ভালোবাসতে, বুঝতে, ক্ষমা করতে শিখিয়েছিলে। মা, আমি নিশ্চিত যে তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ। ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন আমি চিরদিনই তোমার ছেলে, কিন্তু শুধু তোমারই। বিদায়, মা!’
বাঘ যখন উঠে দাঁড়ায়, সে দেখে তার সাথীদের লালচে চোখ দেয়ালের বাইরে থেকে তাকে লক্ষ করছে। আবারও সে তাদের সাথে যোগ দেয়।
এসময় রাতের গভীরতা ভেদ করে উষ্ণ বাতাস এক গুলির শব্দ বয়ে আনে।
‘জঙ্গল থেকে আসছে এ শব্দ,’ বাঘ বলে। ‘মানুষের কাজ। ওরা শিকার করছে, খুন করছে, হত্যা করছে।’
জ্বলন্ত জঙ্গলের প্রতিফলনে আলোকিত গ্রামের দিকে ফিরে সে চিৎকার করে ওঠে, ‘হৃদয়হীন, অভিশপ্ত জাত! এবার আমার পালা!’
যে কবরের সামনে সে সবে প্রার্থনা করেছে সেখানে ফিরে বাঘ তার নখরের এক ঝটকায় ক্ষতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে এবং যে ক্রুশের ওপর তার মার নাম খোদাই করা ছিল সেখানে নিজের রক্ত দিয়ে বড় হরফে লেখে
হুয়ান দারিয়েন
‘এবার আমরা নিশ্চিন্ত,’ বলে সাথীদের সঙ্গে ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামের দিকে অগ্রাহ্যের গর্জন তুলে সে বলে, ‘এবার থেকে জঙ্গলে! এবং বাঘ চিরদিনের জন্য।’
(ওরাসিয়ো কিরোগা (১৮৭৮-১৯৩৭): জন্ম উরুগুয়াইয়েতে। শিক্ষা মন্তেবিদেয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে কবিতা লিখতেন এবং জবারংঃধ ফবষ ঝধষৎড় নামে সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৯০০ সালে পারী যান এবং মোহমুক্ত হয়ে ফিরে আসেন অচিরেই। যৌবনে এক দুর্ঘটনায় তাঁর নিজের হাতে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর করুণ মৃত্যুর পর তিনি উরুগুয়াই পরিত্যাগ করে আর্হেন্তিনার এক প্রত্যন্ত প্রদেশ মিসিয়নের গভীর বনা লে বসবাস শুরু করেন। নগরসভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বেছে নেন কৃষকের কঠোর জীবন। আর এই প্রকৃতিঘনিষ্ঠ, দ্বন্দ¡সঙ্কুল জীবনের প্রেক্ষাপটেই গড়ে ওঠে তাঁর পরবর্তী সাহিত্যজীবন। মূলত ছোটগল্পই হয় তাঁর বিচরণভূমি। লাতিন আমেরিকার আধুনিক ছোটগল্পের জনক ওরাসিয়ো কিরোগার প্রভাব পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের মধ্যে নানাভাবে পরিদৃশ্যমান। তাঁর প্রধান গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতমÑ ঝঃড়ৎরবং ড়ভ খড়াব, গধফহবংং ধহফ উবধঃয (১৯১৭), ঝড়ঁঃয অসবৎরপধহ ঔঁহমষব ঞধষবং (১৯১৮), ঞযব ঝধাধমব (১৯২০), ঞযব উবংবৎঃ (১৯২৪) ও ঞযব ঊীরষব (১৯২৬)। ছোটগল্পের শিল্পরীতি ও নির্মাণকৌশল বিষয়ে গধহঁধষ ভড়ৎ ঃযব চবৎভবপঃ ঝযড়ৎঃ ঝঃড়ৎু ডৎরঃবৎ নামে তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থও রয়েছে। ওরাসিয়ো কিরোগার ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত ট্রাজিক। তাঁর বাবা, প্রথমা স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা প্রত্যেকেই আত্মহত্যা করেন। আজীবন মৃত্যুচেতনায় আচ্ছন্ন কিরোগাও অতঃপর ১৯৩৭ সালে আত্মঘাতী হন।)
উৎস : ‘জাদুবাস্তবতার গাথা: লাতনি আমরেকিার গল্প’ আলম খোরশদে সম্পাদতি
2 মন্তব্যসমূহ
গল্পের ইন্সপেক্টর নিপাত যাক্!
উত্তরমুছুনবাহ
উত্তরমুছুন