আফ্রিকার গল্প : এক মুঠো খেজুর

মূল: তায়েব সালিহ
অনুবাদ: ফজল হাসান

[আধুনিক সুদানি কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ এবং আরব বিশ্বের পাঠকের কাছে আলোচিত লেখক তায়েব সালিহর জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুলাই, সুদানের উত্তরাঞ্চলের আল দাববাহ গ্রামের এক কৃষক পরিবারে । শৈশবে গ্রামের মক্তবে পড়াশনা করে অদূরবর্তী এক স্কুলে ভর্তি হন । খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যায় লেখাপড়া সমাপ্ত করে গ্রামের স্কুলে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য শিক্ষকতা করেন । পরবর্তীতে তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য বিলাত গমন করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ে ডিগ্রী অর্জণ করেন ।
স্বদেশে ফিরে এসে তিনি বিবিসির আরবী প্রোগ্রাম এবং সুদান বেতারে কর্মজীবন শুরু করেন । একসময় তিনি কাতারের তথ্য মন্ত্রনালয়ে মহাপরিচালক ছিলেন । কর্মজীবনের শেষ দশ বছর তিনি ইউনেস্কোর কর্মকর্তা হিসাবে প্যারিস এবং ইউনেস্কোর বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে গালফ দেশসমূহে কর্মরত ছিলেন । 

কর্মজীবনের শেষ দিকে এসে তায়েব সালিহ সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন । তাঁর লেখায় উঠে এসেছে গ্রামীন জীবনের অভিজ্ঞতা । তবে বলা হয়, তাঁর লেখায় ধর্মীয় পরিবেশ এবং আধুনিক আফ্রিকার প্রাক- এবং উত্তর-উপনিবেশ সময়ের অভিজ্ঞতাও ফুটে উঠেছে । তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা খুবই সীমিত । আরব বিশ্বের পাঠকের কাছে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘সিজন অফ মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ’ (ইংরেজিতে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত)-এর জন্য সুপরিচিত এবং ব্যাপক আলোচিত । উল্লেখ্য, যৌনতা এবং রাজনীতি নির্ভর কাহিনী নিয়ে রচিত এই উপন্যাস তাঁর মাতৃভূমি সুদানে বেশ অনেক বছর বাজেয়াপ্ত ছিল । কিন্তু আলোড়িত এই উপন্যাসই তাঁকে আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি এনে দিয়েছে । সত্তর দশকের শুরুতে তাঁর ‘বন্দরশাহ্’ (প্রথম এবং দ্বিতীয় খন্ড) উপন্যাস প্রকাশিত হয় । ‘এ হ্যান্ডফুল অফ ডেটস্’ তাঁর একমাত্র ছোটগল্প সংকলন । এছাড়া লন্ডন ভিত্তিক আরবী ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিকে নিয়মিত সাহিত্য বিষয়ক কলাম লিখেছেন । তিনি আশি বছর বয়সে ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে ইন্তেকাল করেন ।

‘এক মুঠো খেজুর’ গল্পটি শোষক আর শোষিতের মধ্যে শ্রেনী বিভাজনের উজ্জ্বল উদাহরণ । অনন্য এই গল্পটিতে শোষকের ভুমিকায় অধিবক্তা বালকের দাদু এবং শোষিতের ভূমিকার প্রতিবেশি মাসুদ । যদিও বড় হয়ে আদর্শ পুরুষের প্রতীক দাদুর মতো হওয়ার বাসনা ছিল অধিবক্তার, কিন্তু ঋণগ্রস্থ মাসুদের উপর জুলুম দেখে একসময় দাদুর প্রতি তার ঘৃণা জমে । এছাড়া গাছপালার প্রতি মানুষের যে সহজাত মমতা, সেই বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে ।]

নিশ্চয়ই সেই সময় আমি খুব ছোট ছিলাম । যদিও আমার সঠিক বয়স মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে লোকজন যখন আমাকে দাদুর সঙ্গে দেখতো, তখন তারা আমার মাথায় আলতো করে চাঁটি দিতো এবং গালে মৃদু চিমটি কাটতো । অথচ তারা আমার দাদুকে এসব কিছুই করতো না । অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, আমি কখনই বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতাম না । বরং যেখানেই দাদু বেড়াতে যেতেন, আমি তাঁর সঙ্গী হতাম । কিন্তু সকালে বেড়াতে যাওয়ার সময় দাদু আমাকে সঙ্গে নিতেন না । কেননা সেই সময় আমি মসজিদে কোরান শরীফ পড়া শিখতে যেতাম । মসজিদ, নদী এবং খোলা মাঠ – এগুলো ছিল আমাদের জীবনের অংশ । আমার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে মসজিদে না-যাওয়ার জন্য নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির খুঁজতো । অথচ মসজিদে যেতে আমার খুব ভালো লাগতো । নিঃসন্দেহে তার কারণ ছিল । আসলে আমার মুখস্ত করার ক্ষমতা ছিল দারুণ । এ জন্যই মসজিদে যখন কোন গণ্যমান্য অতিথির সমাগম হতো, তখন মৌলভী সাহেব আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে ‘দ্য চ্যাপ্টার অফ দ্য মারসিফুল’ (অর্থাৎ সূরা আর-রাহমান) তেলওয়াত করতে বলতেন । তেলওয়াত শুনে অতিথিরা আমার মাথায় চাপড় কাটতেন এবং আদর করার ভঙ্গিতে গাল টিপে দিতেন । দাদুর সঙ্গে আমাকে দেখলে লোকজন যেমন করতো, অতিথিরাও ঠিক তেমনই করতেন । 

হ্যাঁ, আমি মসজিদ খুব ভালোবাসতাম এবং ভালোবাসতাম নদীকেও । সকালবেলা কোরান পড়া শেষ করেই আমি আমার কাঠের শ্লেট রেখে রীতিমত জ্বিনের গতিতে ছুটে যেতাম মায়ের কাছে । তারপর গপগপ করে সকালের নাস্তা খেয়ে দৌঁড় দিতাম নদীতে গোসল করার জন্য । সাঁতার কেটে যখন ক্লান্ত হতাম, তখন আমি পানি থেকে উঠে এসে নদীর ধারে বসতাম । সেই সময় আমি পূর্ব দিকে বয়ে যাওয়া নদীর স্রোতের দিকে, যা ঘন অ্যাকাশিয়া গাছের আড়ালে হারিয়ে গেছে, আনমনে তাকিয়ে থাকতাম । তখন গভীর ভাবে ভাবতে আমার দারুণ ভালো লাগতো । চিন্তার সঙ্গে কল্পনার রঙ মিশিয়ে আমি গহীন অরণ্যের মাঝে বাস করা দানব সম্প্রদায়ের দলনেতা হিসাবে নিজেকে ভাবতাম । তখন নিজেকে একজন ঋজু এবং হালকা-পাতলা দেহের মানুষ, যার মুখে শুভ্র দাড়ি এবং সুতীক্ষ্ণ নাসিকা, হিসাবে কল্পনা করতাম – আমার দাদু দেখতে যেমন, ঠিক তেমনই চেহারার একজন । আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দাদু তর্জনী দিয়ে তাঁর নাকের ডগা ঘষতেন । তাঁর দাড়ি ছিল নরম, ঘন এবং তুলার মতো সফেদ । দাদুর সেই শুভ্র এবং অত্যন্ত সুশ্রী দাড়ির মতো আমি সারা জীবনে এমন সুন্দর কোন জিনিস দেখিনি । নিশ্চয়ই দাদুর দেহের গড়ন ছিল দীর্ঘ । তার কারণ আমাদের পাড়ায় এমন কেউ আমার নজরে পড়েনি যিনি মাথা উপরের দিকে না তুলে দাদুর সঙ্গে কথা বলেছে । আমি দেখেছি অন্য কোন বাড়িতে ঢোকার সময় দাদু এমন করে মাথা নোয়াতেন যে, তখন আমার মনে পড়তো অ্যাকাশিয়া গাছের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া নদীর বাঁকের কথা । আমি দাদুকে ভীষণ ভালোবাসতাম এবং নিজেকে তাঁর মতো কল্পনা করতাম । অবচেতন মনে ভাবতাম, আমি যখন তাঁর মতো বড় হবো, তখন আমার দেহের গড়ন হবে দীর্ঘ এবং হালকা-পাতলা । আমি লম্বা কদম ফেলে হাঁটবো । 

আমার বিশ্বাস, দাদুর নাতি-নাতনিদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে প্রিয় । এতে অবাক হওয়ার মতো কোন ফুরসৎ নেই । আমার কাজিনরা সবাই ছিল বোকার হদ্দ এবং আত্মীয়-স্বজন সবাই বলতো অন্যদের তুলনায় আমি ছিলাম বু্দ্ধিমান । আমি জানতাম, একসময় দাদু চাইতেন আমি হাসি-খুশি থাকি, আবার অন্য সময় চাইতেন আমি যেন চুপ করে গম্ভীর থাকি । এছাড়া আমাকে বলার আগেই আমি তাঁর জন্য জায়নানাজ নিয়ে আসতাম এবং অজু করার জন্য পানি এগিয়ে দিতাম । দাদুর যখন কোন কিছু করার থাকতো না, তখন তিনি আমার মধুর সুরে কোরান তেলওয়াত শুনে ভীষণ আনন্দ পেতেন । অনায়াসে আমি তাঁর মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারতাম । 

একদিন আমি দাদুর কাছে আমাদের প্রতিবেশী মাসুদ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম । ‘আমাদের পড়শী মাসুদকে তুমি বুঝি দেখতে পারো না ?’ 

আমার কথার জবাবে দাদু স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে নাকের ডগা ঘষতে ঘষতে বলেছিলেন, ‘লোকটা অলসের ঢিবি এবং আমি অই ধরনের লোক পছন্দ করি না ।’ 

আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অলসের ঢিবি মানে কি ?’ 

দাদু এক মুহূর্তের জন্য মাথা আনত করেন । তারপর বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি কী মরুভূমির প্রান্ত থেকে শুরু করে নীল নদের তীর পর্য্যন্ত বিশাল জায়গাটা দেখেছো ? এক শ’ ফেদানের মতো জায়গা । অই খেজুর গাছগুলোও কী দেখেছো ? এবং অন্য গাছপালা – সান্ট, অ্যাকাশিয়া এবং সায়াল গাছ ? সব গাছই মাসুদের এবং সে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে । 

দাদুর চুপ করে থাকার ফাঁকে আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিই এবং দাদুর বর্ণনা মতো বিশাল এলাকার চারপাশে চোখ বুলিয়ে আনি । আপনমনে বললাম, জমিনের খেজুর গাছ, অন্যান্য গাছপালা এবং কৃষ্ণবর্ণের ফাটা জমি যারই হোক না কেন, আমি থোড়াই কেয়ার করি । আমি শুধু জানি, পুরো এলাকা আমার স্বপ্নপুরী, আমার খেলার মাঠ । 

দাদু আবার বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ দাদুভাই, চল্লিশ বছর আগে সম্পত্তির পুরোটাই মাসুদের ছিল । কিন্তু এখন সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ আমার ।’ 

এটা আসলেই আমার কাছে রীতিমত একটা নতুন খবর । কেননা আমার ধারনা ছিল সৃষ্টির শুরু থেকে দাদুই পুরো সম্পত্তির মালিক । 

দাদু পুরনো দিনের গল্প শুরু করেন, ‘আমি প্রথম যখন এই গ্রামে আসি, তখন আমার এক ফেদানও জমি ছিল না । মাসুদ ছিল সব জমির মালিক । এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে । আমার ধারনা, আল্লাহপাক তাঁর কাছে ডেকে নেওয়ার আগেই আমি বাকি এক-তৃতীয়াংশ জমির মালিক হতে পারবো ।’ 

আমি জানি না, দাদুর কথা শোনার পর কেন আমাকে ভয় গ্রাস করেছে এবং আমাদের প্রতিবেশী মাসুদের জন্য আমার দুঃখ জমা হয় । আমি আপনমনে চাইলাম দাদু যা বলেছেন, তা যে কখনই সত্যি না হয় । সেই মুহূর্তে মাসুদের গানের কথা আমার মনে পড়ে । আরো মনে পড়ে তার সুন্দর গলার স্বর এবং উচ্ছ্বল হাসি, যা পানির কূলকূল ধারার মতো উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত । আমার দাদু কখনই হাসতেন না । 

মাসুদ কেন তার সম্পত্তি বিক্রি করেছে, তা আমি দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম । 

‘মেয়ে মানুষ !’ দাদু এমন ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন, আমি ভাবলাম ‘মেয়ে মানুষ’ একধরনের সাংঘাতিক ভয়ংকর জীব । যাহোক, কথার রেশ ধরে দাদু আরো বললেন, ‘মাসুদ ছিল বিয়ে-পাগলা লোক । প্রতিবার বিয়ে করার সময় সে আমার কাছে এক বা দুই ফেদান জমি বিক্রি করেছে ।’ আমি চটজলদি হিসাব করি । আমার হিসাব অনুযায়ী মাসুদ নিশ্চয়ই আনুমানিক নব্বইটি শাদী করেছে । তারপরই আমার মনে পড়লো তার তিন বিবির কথা, তার জীর্ণ চেহারা, খোড়া গাধা ও ভাঙাচোরা জোয়াল এবং তার ছেঁড়া আস্তিনের মলিন আলখেল্লার কথা । কিন্তু আমার মনের মধ্যে যেসব চিন্তাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল, লোকটিকে আমাদের দিকে আসতে দেখে আমি সেগুলো দূরে সরিয়ে দিয়ে দাদুর সঙ্গে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করি । 

‘আজ আমরা বাগান থেকে খেজুর তুলবো,’ মাসুদ বললো, ‘আপনি কী উপস্থিত থাকবেন না ?’

আমার মনে হলো, মাসুদ আসলে চায় না দাদু সেখানে থাকুক । অথচ আমার দাদু অতি উৎসাহে রীতিমত লাফিয়ে উঠলেন এবং আমি দেখলাম পলকের জন্য তাঁর চোখের মণি দু’টি এক প্রচন্ড উজ্জ্বল দ্যুতিতে ঝলমলিয়ে উঠলো । দাদু আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলেন এবং আমরা মাসুদের খেজুর বাগানের দিকে রওনা হলাম ।

দাদুর বসার জন্য কেউ একজন বলদের চামড়ায় মোড়া একটা টুল নিয়ে আসে । আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে অসংখ্য মানুষের ভীড় ছিল, কিন্তু আমি সবাইকে চিনতাম । হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, বিশেষ কোন কারণে আমি শুধু মাসুদকেই লক্ষ্য করছি । লোকজনের ভীড়ের মাঝে সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন খেজুর তোলার বিষয়টি তার কাছে রীতিমত গূরুত্বহীন । অথচ যে খেজুরগুলো তোলা হবে, সেগুলো তার নিজের সম্পদ । অনেক উঁচু থেকে খেজুরের থোকা মাটিতে পড়ার শব্দে কদাচিৎ তার সম্বিত ফিরে আসে । একটা খেজুর গাছের সবচেয়ে উঁচুতে বসে একসময় একটি ছেলে দীর্ঘ শাণিত দা দিয়ে খেজুরের থোকায় কোপ দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে সে চিৎকার করে বললো, ‘সাবধান, তুই আবার খেজুর গাছের হৃদপিন্ডটা কেটে ফেলিস না যেন ।’

মাসুদের কথায় কেউ আমল দেয়নি । উঁচুতে বসে থাকা ছেলেটি তার কাজে নিমগ্ন । বরং উৎসাহী হয়ে সে খেজুরের থোকা কাটতে থাকে, যতক্ষণ না পর্য্যন্ত আকাশ থেকে খসে পড়া কোন কিছুর মতো গাছ থেকে আলাদা হয়ে খেজুরের থোকা মাটির দিকে পড়তে শুরু করে । 

ততক্ষণে আমি অবশ্য মাসুদের কথাটা ‘গাছের হৃদপিন্ড’ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি । কল্পনায় আমি একটা ছবি এঁকে নিয়েছি, গাছ এমন একটা কিছু যার অনুভূতি আছে এবং হৃদয় আছে যেখানে সারাক্ষণ ধুকপুকানির শব্দ হয় । আমার মনে পড়ে, একবার আমি যখন একটা কচি খেজুর গাছের গুঁড়ি নিয়ে খেলছিলাম, তখন মাসুদ বলেছিল, ‘এই ছেলে, জানো, খেজুর গাছ কিন্তু মানুষের মতোই । ওদের আনন্দ-ফূর্তি, এমনকি দুঃখবোধ আছে ।’ তখন আমি আমার ভেতর একধরনের অযৌক্তিক অস্বস্তি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম । 

পুনরায় আমি যখন আমার সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পেলাম যে আমার সমবয়সী বন্ধুরা খেজুর গাছগুলোর চতুর্দিকে পিঁপড়ার মতো পিলপিল করছে । ওরা মাটি থেকে খেজুর কুড়াচ্ছে এবং কুড়ানো খেজুরের বেশির ভাগই পেটের মধ্যে চালান করে দিচ্ছে । উঁচু ঢিবির মতো খেজুর জড়ো করে রাখা হয়েছে । দেখলাম লোকজন আসছে এবং তারা মাপার পাত্রে খেজুর রেখে ওজন করে ছালার বস্তায় ভরছে । আমি গুণে দেখেছি তিরিশ বস্তা । একসময় জনতার ভীড় ভেঙে যায়, শুধু থেকে যায় ব্যবসায়ী হুসেইন, আমাদের জমির পূর্ব দিকের ক্ষেতের মালিক মূসা এবং দু’জন অপরিচিত লোক । আমি আগে কখনই এই দু’জনকে দেখিনি । 

আমি একটা মৃদু শিসের মতো আওয়াজ শুনতে পেয়ে তাকিয়ে দেখি দাদু গভীর ঘুমের অতলে নিমজ্জিত । তারপর লক্ষ্য করি মাসুদ আদৌ তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি বলায়নি । তবে সে মুখের ভেতর একটা ডাঁটি নিয়ে চিবুচ্ছে । ভাবটা এমন যেন সে ডাঁটির চিবানো অংশ মুখের ভেতর নিয়ে কী করবে, তা বুঝতে পারছে না । 

আচমকা দাদু ঘুম থেকে জেগে রীতিমত লাফিয়ে উঠলেন এবং খেজুর ভর্তি বস্তাগুলোর দিকে এগিয়ে যান । ব্যবসায়ী হুসেইন, আমাদের জমির পূর্ব দিকের ক্ষেতের মালিক মূসা এবং আমার অপরিচিত দু’জন দাদুকে অনুসরণ করে । আমি মাসুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখি সে ধীর পদক্ষেপে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে । তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে যেন অন্য কোথাও পালাতে চাইছে, কিন্তু পা দু’টি তাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করছে । সবাই খেজুরের বস্তাগুলোর চারপাশে জড়ো হয় এবং বস্তাগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করে । খাওয়ার জন্য কয়েকজন খেজুর তুলে নেয় । দাদু আমাকে এক মুঠো খেজুর দিয়েছেন । আমি খেতে শুরু করি । একসময় তাকিয়ে দেখি মাসুদ দুই হাতের তালুর মধ্যে খেজুর নিয়ে নাকের কাছে এনে পুনরায় সেগুলো রেখে দিলো । 

তারপর আমি দেখলাম, খেজুরের বস্তাগুলো তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে । ব্যবসায়ী হুসেইন নিয়েছে দশ বস্তা এবং আগুন্তুক দু’জন নিয়েছে প্রত্যেকে পাঁচ বস্তা করে । মূসা, আমাদের জমির পূর্ব দিকের ক্ষেতের মালিক, পাঁচ বস্তা নিয়েছে এবং আমার দাদু নিয়েছেন পাঁচ বস্তা । কোন কিছু না বুঝেই আমি মাসুদের দিকে তাকাই । দেখি তার চোখের মণি দু’টি বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলা নেংটি ইঁদুরের মতো একবার বাম দিকে এবং আরেকবার ডান দিকে অসহায়ের মতো ছুটাছুটি করছে । 

‘এখনো আমার কাছে তোমার পঞ্চাশ পাউন্ড দেনা রইলো,’ দাদু মাসুদকে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলবো ।’

হুসেইন তার সহকারীদের ডাকে এবং তারা তাদের গাধাগুলোকে নিয়ে আসে । আগুন্তুক দু’জনের সঙ্গে ছিল উট । খেজুর ভর্তি বস্তাগুলো জন্তুদের পিঠের উপর চাপানো হয় । একটা গাধা চিৎকার করে উঠে এবং তা শুনে উটেরা মুখ ভর্তি ফেনা নিয়ে সশব্দে অভিযোগ জানায় । মাসুদের কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল এবং চাচ্ছিলাম তার পরিধানের বস্ত্র ছুঁয়ে দেখতে । শুনতে পেলাম তার গলা দিয়ে জবাই করা ভেড়ার গোঙানির মতো ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরিয়ে আসছে । কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমি আমার বুকের ভেতর একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করি । 

আমি এক দৌঁড়ে দূরে ছুটে যাই । পেছনে দাদুর কন্ঠস্বর শুনে সামান্য ইতস্তত করি, কিন্তু পুনরায় সামনের দিকে এগুতে থাকি । সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো আমি দাদুকে ঘৃণা করি । আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিই । মনে হলো আমি যেন বুকের মধ্যে একটা গোপন কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছি এবং তা থেকে নিস্কৃতি চাই । অ্যাকাশিয়া বৃক্ষের আড়ালে যেখানে নদী বাঁক নিয়েছে, সেখানে এসে আমি থমকে দাঁড়াই । তারপর কারণ না জেনেই আমি গলার ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ আগে খাওয়া সব খেজুর উগরে দিই । 



গল্পসূত্র: ‘এক মুঠো খেজুর’ গল্পটি তায়েব সালিহর ইংরেজিতে ‘এ হ্যান্ডফুল অফ ডেটস্’ ছোটগল্পের অনুবাদ । আরবীতে গল্পটি ১৯৬৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে গল্পটি লেখকের ইংরেজিতে ‘দ্য ওয়েডিং অফ জেইন’ গল্পসংকলনে প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে । পরবর্তীতে বহুল পঠিত এবং পাঠকমহলে সমাদৃত এই গল্পটি একাধিক আফ্রিকার ছোটগল্প সংকলনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে ।



অনুবাদক
ফজল হাসান





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ