(প্রথম খণ্ড)
অনুবাদক : উৎপল দাশগুপ্ত
মুখবন্ধ
গন উইথ
দ্য উইন্ড আমেরিকান ঔপন্যাসিক মার্গারেট
মিচেলের লেখা একমাত্র সাহিত্যকীর্তি। এই উপন্যাস ১৯৩৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) পটভুমিকায় লেখা এই উপন্যাস একসময় খুবই জনপ্রিয়
হয়। ১৯৩৬ এবং ১৯৩৭ সালে এই উপন্যাস
আমেরিকার ‘বেস্টসেলার’ তালিকায় সর্বোচ্চ আসন লাভ করে। ১৯৩৭ সালে এই উপন্যাস
পুলিৎজ়ার পুরস্কার পায়। ১৯৩৯ সালে এই উপন্যাসের সফল চলচিত্রায়ন হয়। এত বছর পরে এখনও আমেরিকার পাঠকের কাছে গন
উইথ দ্য উইন্ড বাইবেলের পরেই দ্বিতীয়
জনপ্রিয় বই।
মার্গারেট
মিচেলের জন্ম ১৯০০ সালের ৮ই নভেম্বর
জর্জিয়ার অ্যাটলান্টা শহরে। মৃত্যু ১৬ অগাস্ট ১৯৪৯ সালে। তাঁর পরিবারের সকলেই আগ্রহের সঙ্গে আমেরিকার
ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতেন। বাল্যকালে, কৈশোরে আর যৌবনে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ নিয়ে যে
সব ঘটনা উনি শুনেছিলেন, সেগুলোরই ফলশ্রুতি এই উপন্যাস।
উপন্যাসটা আমি প্রথম
পড়ি কলেজে পড়াশোনা করার সময়। আমার মতে উপন্যসটা চিরায়ত বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম
সম্পদ। বইটা নিশ্চয়ই অনেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাভাষায় এর কোন অনুবাদ আজ পর্যন্ত আমার চোখে
পড়েনি। সময় ও সুযোগ পেলে এর বাংলা অনুবাদ করার ইচ্ছে অনেকদিন থেকেই মনের মধ্যে
ছিল। বইটার বিপুলতা দেখে বার বার পিছিয়ে
গেছি। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেটাই জয়ী হল। আমি সাহিত্যের লোক নই। তাই ভাষার অক্ষমতা থেকে
যাবে। যাঁরা কষ্ট করে পড়বেন, তাঁদের কাছে আগেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সব শেষে একটা কথা
বলতে চাই। ইংরেজি আর বাংলার প্রকাশভঙ্গী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাই নিখুঁত আক্ষরিক
অনুবাদ করলে পাঠককে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে।
তবুও যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। আর কৃষ্ণকায় মানুষরা
সে সময় যেভাবে ইংরেজি বলতেন, সেটা আমি বাঙলা করবার চেষ্টা করিনি – স্বাভাবিক
কারণেই। কৃত্রিমতা এসে যেত। তাদের
কথাবার্তা আমি সোজা বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছি। শুধু এই দু ধরণের স্বাধীনতা আমি এই
অনুবাদে নিয়েছি। ইংরেজি নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলায় নাম দিয়েছি যে দিন ভেসে গেছে
(রবীন্দ্রনাথের গানের একটা পঙতি)।
ধন্যবাদান্তে।
উৎপল দাশগুপ্ত
(১)
স্কা
|
রলেট ও’হারা কে সেভাবে সুন্দরী বলা যায় না। তবে সব পুরুষই তার মাধুর্যে এতটাই
আকৃষ্ট হত যে কেউ সেটা ধরতে পারত না; যেমন টার্লটন যমজ ভাইরা।
মায়ের মুখের ফরাসি আভিজাত্যের
ছোঁয়া আর আইরিশ বাবার মুখের দৃঢ়তার এক অপূর্ব মিশেল স্কারলেটের মুখমণ্ডলকে আকর্ষক
করে তুলেছিল। হালকা সবুজের আভা ছিল তার চোখ দুটিতে, চোখের লম্বা পালক আর ভ্রূদ্বয়
ছিল ঘন কালো; ত্বকে ছিল শ্বেতশুভ্র পেলবতা। জর্জিয়ার প্রখর সূর্যালোক থেকে এই
শুভ্রতা রক্ষা করার জন্য মহিলারা শিরাবরণ, অবগুণ্ঠন এবং আরও নানা ধরণের আচ্ছাদন
ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন।
১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসের এক
উজ্জ্বল অপরাহ্ণ। স্কারলেট তার বাবার কার্পাস বাগানের ঘেরা
বারান্দায় স্টুয়ার্ট এবং ব্রেন্ট টার্লটনদের সাথে বসে গল্প করছিল। ওকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। পরনে ছিল বারো গজের প্রাচুর্যময়
সবুজ মসলিনের পোষাক। পায়ে তার বাবার আটলান্টা থেকে নিয়ে আসা মানানসই
সবুজ মরোক্কো চামড়ার স্লিপার। পোষাকটি তার সতেরো ইঞ্চির কোমরটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছিল। তার ষোল বছরের তুলনায় পূর্ণবিকশিত বক্ষদেশকে আড়ালও করে রেখেছিল। তার পোষাক
ছিল অত্যন্ত শালীন। কেশরাশি সুসম্বদ্ধ ভাবে খোঁপা করে নেট দিয়ে
মাথার পেছনে আটকানো। তুষারশুভ্র হাত দুখানি কোলের ওপর জড় করা।
চোখের চাউনি কিন্তু বিপরীত ইঙ্গিত বহন করছিল। সযত্নে লালিত স্নিগ্ধ মুখমণ্ডলে্র
সবুজাভ দৃষ্টিতে প্রাণবন্ত এবং বলিষ্ঠ অবাধ্যতা উঁকি মেরে যাচ্ছিল। মায়ের
মৃদু উপদেশ আর তার ‘ম্যামি’র কঠোর অনুশাসন তার আচ্ছাদনে
অবতীর্ণ হতে পারলেও, তার চোখে নয়; চোখের ভাষা
নিতান্তই তার নিজস্ব।
দুই ভাই, স্কারলেটের দু’পাশে রাখা দুটো চেয়ারে বসে হেসে হেসে গল্প করছিল।
রোদ-চশমা থাকা সত্বেও, রোদের তেজে তাদের দৃষ্টি কিছুটা তির্যক। দুজনেই পায়েই হাটুর নীচে পর্যন্ত ঢাকা জুতো। মৌরসিপাট্টা
মেরে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে। দুজনেরই বয়স ১৯ বছর। ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা।
বলিষ্ঠ ব্যায়ামপুষ্ট চেহারা। রোদে ঝলসে যাওয়া মুখ। গাঢ় বাদামী লাল চুল। অহংকারি কিন্তু
রঙ্গপ্রিয় দৃষ্টি। পরনে একই ধরনের নীল রঙের কোট আর সর্ষে রঙের
ব্রীচ।
মোটকথা এদের দুজনকে একে অন্যের থেকে আলাদা করা কঠিন।
বাইরে পড়ন্ত সূর্যের আলো ডগউড
গাছের শ্বেত পুষ্পপল্লবের আবরণের ওপর বিচ্ছুরিত হয়ে শ্যামল পটভুমিকে ঝলমলে করে
তুলেছে। টার্লটন ভাইদের বড় লাল ঘোড়া দুটো বাইরের উঠোনে বাধা। পোষা
কুকুরদুটো ঘোড়াগুলোর পায়ের কাছে খুনসুটি করছিল।
কুকুরদুটো স্টুয়ার্ট আর ব্রেন্টের সর্বক্ষণের সঙ্গী। এছাড়া ছিল কালো ছোপ
ছোপ একটি পাহারাদার সারমেয়।
খানিক অলস অভিজাত ভঙ্গিতে সে তার মালিকদ্বয়ের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা করছিল, কারণ
সাপারের সময় এগিয়ে আসছিল।
নিত্য সঙ্গী এই প্রাণীকুলের সাথে
ভ্রাতৃদ্বয়ের অন্তরঙ্গতা যতটা দৃশ্যমান আসলে তা ছিল তার থেকেও অনেক বেশী গভীর। এরা
প্রত্যেকেই খুব স্বাস্থ্যবান, সজীব, ছটফটে, হঠকারী আর বিপজ্জনক। অবশ্য এদের মন
জুগিয়ে চলতে পারলে সমস্যা হত না।
কার্পাস বাগানমালিকের সন্তান হওয়ার
সুবাদে, দুই ভাইকে আশৈশব নিজে হাতে কোনোও কাজ করতে হয় নি। তা বলে এদের মুখ দেখে এদের নরম বা ঢিলে মনে করার কোন কারন নেই। লেখাপড়ার আর
বইখাতার মত নীরস বস্তুর সম্পর্কবর্জিত যে কোনোও দেহাতি লোকের মতই এরাও
প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর আর তৎপর। অগাস্টা, স্যাভান্না এবং চার্লস্টনের তুলনায়,
উত্তর জর্জিয়ার এই ক্লেটনের বসতি কিছুটা নতুন এবং খানিক অমার্জিত। দক্ষিণ অঞ্চলের
অপেক্ষাকৃত বনেদী এবং মার্জিত রূচিসম্পন্ন লোকেরা জর্জিয়ার অধিবাসীদের ব্যাপারে
বেশ নাক উঁচু মনোভাব পোষণ করতেন। যদিও এতে জর্জিয়ার মানুষের খুব একটা এসে যেত না।
লেখাপড়া না জানাকে এরা মোটেই সম্মানহানিকর বলে মনে করত না।
বরং তৎপর এবং করিৎকর্মা হওয়াটাকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে
করত। ভাল মানের কার্পাস উৎপাদন, ঘোড়ায় চড়তে জানা, ভাল নিশানাবাজ হওয়া, অভিজাত এবং
রুচিশীল মহিলাদের সাথে পরিচিত হওয়া এবং ভদ্রলোকের মত নিজের পানীয় বহন করা।
উপরোক্ত সবকটি ব্যাপারেই এই যমজ
ভ্রাতৃদ্বয় এক নম্বরে ছিল। শুধু তাই নয়,
বইয়ের দুই মলাটের ভেতর যা কিছু বলা থাকত, সেটা না শিখতে পারার পারদর্শিতাতেও এরা
কারোর থেকে পিছিয়ে ছিল না। এই কাউন্টির অন্য পরিবারের তুলনায়, এদের অর্থবল,
অশ্ববল, আর ক্রীতদাসের সংখ্যা অনেক বেশী ছিল, যদিও এই দুই ভাই স্বাক্ষরতার নিরিখে
তাদের দরিদ্রতর প্রতিবেশীদের থেকে বেশ পিছিয়ে ছিল।
এই বিশেষ কারনেই, এপ্রিল মাসের এই
অপরাহ্ণবেলায়, টারার বারান্দায় এই অলস আসর বসেছিল। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় খুব
সম্প্রতি এই দুই ভাইকে বহিষ্কার করেছে। গত
দু’বছরে, এটা চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয় যারা এদের বহিষ্কার
করল। টম আর বয়েড, এদের বড় দুই ভাইও, ওদের
সাথেই বেরিয়ে এসেছে, কারন যেখানে এই যমজ ভাইরা স্বাগত নয়, সেখানে তারাও থাকতে রাজী
নয়। স্টুয়ার্ট আর ব্রেন্ট নিজেদের এই বহিষ্কারকে একটা বড় ধরনের রসিকতা বলেই মনে
করছে। আর স্কারলেট, গত বছর ফ্যেয়াটভিল
মহিলা একাডেমি ছাড়ার পরে যে নিজের ইচ্ছেয় একটাও বই পড়েনি, সেও এটাকে একটা
মজাদার ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে চায়
না।
“আমার
ধারণা, তোমরা দুভাই, এমন কি টমও এই তাড়িয়ে দেওয়াটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাও না,” সে বলল। “কিন্তু বয়েডের ব্যাপারটা কি? ওর মধ্যে তো আবার
লেখাপড়া শেখার একটা ঝোঁক রয়েছে। আর ওকে তোমরা দুজনে মিলে প্রথমে ভার্জিনিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তারপর অ্যালাবামা, তারপর সাউথ ক্যারোলাইনা আর এখন জর্জিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে আনলে! এভাবে
চললে ও যে আর কোনদিন পড়াশোনা শেষ করে উঠতে
পারবে না।”
“আরে
ও ফ্যেয়াটভিলে জাজ পারমালীর অফিসে গিয়ে আইনও শিখতে পারে,” ব্রেন্ট বেশ অবহেলার সঙ্গে বলল। “তা ছাড়া এমনিতেও টার্ম শেষ হওয়ার আগেই আমাদের বাড়ী ফিরে আসতে হত।”
“কেন?”
“কেন
আবার, যুদ্ধ! যে কোন দিন যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আর তুমি নিশ্চয়ই মনে কর না যে
যুদ্ধের সময় আমরা কলেজে থাকব। তাই না?”
স্কারলেট একটু যেন বিরক্ত হল। “তোমরা ভাল করেই জান, ও সব যুদ্ধ-টুদ্ধ কিছুই হবে না। এ সব নিতান্তই গুজব। এই তো, গত সপ্তাহেই, অ্যাশলে
উইল্কস আর তার বাবা আমার বাপীকে বলছিলেন ওয়াশিংটনে আমাদের কমিশনারদের সাথে মিঃ
লিঙ্কনের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি হতে চলেছে – আমাদের কনফেডারেটের১ সঙ্গে। আর ইয়াঙ্কিদের২ আমাদের
সাথে যুদ্ধ করবার সাহসই নেই। কোন যুদ্ধই হবে না, আর আমি যুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে
ক্লান্ত হয়ে গেছি।” [১ কনফেডারেট – গৃহযুদ্ধের সময় আমেরিকার দক্ষিণের
১১ টি রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করবার পক্ষে ছিল। এদের
সংক্ষেপে কনফেডারেট বলা হত। যারা এই বিচ্ছিন্নতাবাদের বিপক্ষে ছিল অর্থাৎ উত্তরের
রাজ্যগুলো, তাদের বলা হত ইউনিয়নিস্ট] [২ ইয়াঙ্কি – ইউনিয়নিস্টদের পক্ষ নিয়ে যারা লড়াই করেছিল তাদের বলা হত]
“কি বললে, যুদ্ধ হবে না!” দুই ভাই এমন ক্রুদ্ধভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেন মনে হল ওরা খুব ঠকে গেছে।
“যুদ্ধ
নিশ্চয়ই হবে সোনা,” স্টুয়ার্ট বলল। হতে পারে
ইয়াঙ্কিরা আমাদের ভয় পায়; কিন্তু জেনারাল বোরিগার্ড৩ যে ভাবে ওদের
ফোর্ট সামটার৪ থেকে পরশুদিন তাড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে ওদের যুদ্ধ করা কিংবা
সবার সামনে নিজেদের কাপুরুষ প্রমান করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কেন, কনফেডারেসি
_____” [৩ জেনারাল বোরিগার্ড – ১৮৬১ তে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনী
ছেড়ে কনফেডারেটদের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারাল হিসেবে যোগ দেন] [৪ ফোর্ট সামটার – ইউনিয়নিস্ট সৈন্যরা চার্লসটনের
ফোর্ট সামটারে কনফেডারেটদের কাছে হেরে যায়। এই ঘটনাই গৃহযুদ্ধের সূচনা করে]
স্কারলেট বিরক্ত মুখভঙ্গী করল।
“আর
একবারও যদি তোমরা এই ‘যুদ্ধ’ কথাটা উচ্চারণ কর, আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেব। ‘যুদ্ধ’
আর ‘অপসারণ’ এই দুটো কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সকাল থেকে রাত্রি, সারাটা সময়,
বাপী শুধু যুদ্ধের কথাই বলবেন। এমনকি, তাঁর সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে আসেন তাঁরাও
কেবল ফোর্ট সামটার, রাষ্ট্রের অধিকার, অ্যাবে লিঙ্কন এছাড়া আর কথা বলার কিছু পান
না। এত বিরক্তিকর লাগে যে মাঝে মাঝে আমার চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। এমন কি কম বয়সি ছেলেরাও
- আর তাদের ট্রুপ - এছাড়া যেন কিছু বলবার
বিষয়ই পায় না। বসন্তের পার্টিটাই মাটি হয়ে গেল ছেলেদের এই একমুখি আলোচনার জন্য। জর্জিয়া যে অন্তত বড়দিনের পর ইউনিয়ন থেকে আলাদা হবার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতে আমি খুবই খুশী। নইলে বড়দিনের পার্টিটাও মাটি হয়ে যেত! আর
একবারও যদি ‘যুদ্ধ’ কথাটা তোল, তাহলে আমি কিন্তু ঘরে চলে যাব।”
কথাটা স্কারলেট মন থেকেই বলেছিল।
যে সব আলোচনার মূল বিষয়বস্তু সে নয়, সে ধরণের আলোচনা বেশীক্ষণ সহ্য করার মত ধৈর্য
ওর নেই। অবশ্য কথাগুলো বলার সময় সে সচেতন
ভাবে হাসছিল যাতে তার গালের টোল পড়াটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার লম্বা কালো চোখের পালকগুলো প্রজাপতির পাখার
মত আন্দোলিত হচ্ছিল। ছেলেদুটো মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল। স্কারলেটও সেটাই চাইছিল।
ওরাও ওকে বিরক্ত করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিল। ওর যুদ্ধে আগ্রহ না থাকার
ব্যাপারটাকে ওরা মোটেই হেয় করে দেখল না। বরং ওদের মনে হল যুদ্ধ ব্যাপারটা পুরুষ
মানুষের বিষয়, মেয়েদের নয়। এ ব্যাপারে
অনাগ্রহ, ওদের মনে ওর নারীসুলভ কমনীয়তার প্রমাণ বলেই মনে হল।
একটা ক্লান্তিকর বিষয় থেকে আলোচনা
ঘুরিয়ে দিয়ে স্কারলেট ওদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে কথাবার্তায় আবার সচেষ্ট হল।
“তোমাদের
আবার বহিষ্কার হওয়া নিয়ে তোমাদের মা কি বলছেন?”
দুই ভাই একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তিন মাস আগে, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিশেষ
অনুরোধে ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করে মায়ের ব্যবহার ওদের মনে পড়ে গেল।
স্টুয়ার্ট বলল, “এখনও কিছু বলার সুযোগ পান নি। টম আর আমরা -
মা ঘুম থেকে ওঠার আগেই - বেরিয়ে
পড়েছি। টম গেছে ফোনটেনদের ওখানে - আমরা
এখানে তোমার কাছে।”
“কাল
রাতে যখন বাড়ি এলে তখন কিছু বলেন নি?”
“তা
বলতে পারো ভাগ্য সহায় ছিল। আমাদের আসার
ঠিক আগেই, গত মাসে কেনটাকিতে মা যে মদ্দা ঘোড়াটা কিনেছিলেন, সেটা নিয়ে আসা হয়েছিল।
রাস্তাতেই ঘোড়াটা তাঁর বন্য স্বভাবের পরিচয় দিল। জোন্সবোরোতে ট্রেন থেকে যারা ওকে
আনতে গেছিল, তাদের মধ্যে দুটো নিগ্রোকে ঘোড়াটা পায়ের তলায় পিষে ফেলে। ঠিক আমরা ঢোকার আগেই, মায়ের বুড়ো মদ্দা
ঘোড়াটাকে তো লাথি মেরে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।
মা তখন এক বস্তা চিনি নিয়ে ঘোড়াটাকে শান্ত করছিলেন। দারুণ কাজ হয়েছিল। আর
নিগ্রোগুলো ভয়ে কড়িবরগায় ঝুলে গোল গোল চোখ করে একবার মা’কে আর একবার ঘোড়াটাকে দেখছিল। মা ঘোড়াটার সাথে গল্প করতে করতে নিজের হাতে
খাওয়াচ্ছিলেন, যেন ওটা একটা ছোট্ট ছেলে। সত্যিই ঘোড়াকে তোয়াজ করার ব্যাপারে মায়ের ধারেকাছে
কেউই লাগে না। আমাদের দেখে বললেন, “হে ভগবান, তোমরা এখন বাড়িতে কি করছ? খুবই অপদার্থ তো
তোমরা!” ঘোড়াটা আবার অশান্ত হয়ে চিঁহি
চিঁহি করা শুরু করল। তখন মা বললেন, “যাও,
তোমরা এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। দেখতে পাচ্ছ না সোনামনি তোমাদের দেখে ভয়
পাচ্ছে! কাল সকালে আমি তোমাদের ব্যাপারে ফয়সলা করব।” তাই ভোর হতে না হতেই, আমরা তিনজনেই কেটে পড়েছি, মার সামনে যাতে না পড়তে হয়। বয়েড আছে মার সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য।”
“বয়েডের
গায়ে আবার হাত তুলবেন না তো?” যে ভাবে মিসেজ় টার্লটন তাঁর সাবালক ছেলেদের
ওপর তর্জন করেন সেটা কাউন্টির অন্য সবার মত স্কারলেটেরও চোখে লাগে। দরকার বুঝলে, ঘোড়ার চাবুকটাও ছেলেদের পিঠে
চালিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
বিয়াট্রিস টার্লটন একজন অত্যন্ত
ব্যস্ত মহিলা। তিনি একটা বড় কার্পাস বাগানের পরিচালনা করতেন।
একশ জন নিগ্রো আর আটটি ছেলে মেয়ের দায়িত্ব সামলাতেন। এছাড়া এলাকার সর্বোত্তম অশ্ব
প্রজনন কেন্দ্রও তাঁরই তত্বাবধানে ছিল। বেশ বদমেজাজি মানুষ। ছেলেরা মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে
ঝগড়া বাধিয়ে বসত আর তিনি রেগে আগুন হয়ে যেতেন।
তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল যে ঘোড়া কিংবা ক্রীতদাস, কারও ওপরে চাবুক চালানো
যাবে না। তবে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা যে
ছেলেদের পিঠে চাবুক পড়লে ক্ষতির চেয়ে লাভই হবে বেশি।
“না
– নাহ মা
বয়েডকে মারবেন না। ওর গায়ে মা কখনই হাত তোলেন নি। বয়েড আমাদের মধ্যে সব থেকে বড় আবার সব থেকে
ছোটখাটো।”
স্টুয়ার্ট, নিজের ছ ফুট দুই ইঞ্চির কথা ভেবে, বেশ একটু গর্বের সাথেই বলল। “এজন্যই তো মাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলবার জন্য ওকে রেখে
এসেছি। ভগবান করুন, মা যেন আমাদের মারধোর করার অভ্যেসটা ছেড়ে দেন। আমরা উনিশ, টম একুশ; অথচ মা এমন ব্যবহার করেন
যেন আমাদের বয়েস মাত্র ছয়!”
“কাল
উইল্কসদের বারবেকিউ পার্টিতে তোমাদের মা নতুন ঘোড়ায় চেপে আসবেন কি?”
“ইচ্ছে
তো ছিল। কিন্তু বাবা বললেন এখনও ওটা খুবই বিপজ্জনক। আর মেয়েরাই ওঁকে আসতে দেবে না। ওরা বলেছে, অন্তত একটা পার্টিতে
মা যেন লেডির মত যান, ঘোড়ার গাড়ি চেপে।”
“কাল নিশ্চয়ই আর বৃষ্টি হবে না,” স্কারলেট বলল। “এ
সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়েছে। বারবেকিউ যদি শেষ পর্যন্ত ঘরের ভেতরে গিয়ে
মানাতে হয়, তার থেকে খারাপ আর কিছু হতেই পারে না।”
“আরে
না না। কাল আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আর জুন মাসের মত গরম থাকবে,” বলল স্টুয়ার্ট। একবার সূর্যাস্তটা লক্ষ কর।
এতটা লাল আগে কখনও দেখিনি। আবহাওয়া
কেমন থাকবে সূর্যাস্ত দেখেই আন্দাজ করা যায়।”
জেরাল্ড ও’হারার সদ্যকর্ষিত আবাদি বহু দূরে গিয়ে রক্তিম দিকচক্রবালরেখার সাথে মিশে
গিয়েছে। ফ্লিন্ট নদী ছাড়িয়ে টিলার পেছনে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে রক্তিমাভা ছড়িয়ে ঢলে
পড়ছে। এপ্রিল মাসের উষ্ণতা সরে গিয়ে বাতাসে মৃদু শীতল ভাব। ওরা সেদিকে তাকিয়ে রইল।
এ বছর বসন্ত একটু আগেই এসে গিয়েছে।
কখনো কখনো হালকা বৃষ্টি। বাতাস সামান্য উষ্ণ। পীচের গোলাপি মুকুল আর ডগউডের
শ্বেতশুভ্র ফুলে জলা আর দূরবর্তি টিলাগুলো আবৃত। জমির হালচাষ প্রায় শেষের মুখে।
অস্তগামী সূর্যের অরুণাভা, জর্জিয়ার লাল
মাটিতে প্রতিফলিত হয়ে গাঢ়তর লালবর্ণ ধারণ
করেছে। আলের ওপরের মাটিতে গোলাপী আভা। ছায়া ঘেরা নীচের মাটিতে সিঁদুরে লালের ছ্বটা। চুনকাম করা ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা
ইটের বহির্বাটিগুলো লালের সমুদ্রে কতগুলো দ্বীপের মত লাগছে। সমতল মধ্য জর্জিয়ার হলুদ মাটির মত
কিংবা উপকূলবর্তী কালো মাটির আবাদির মত উত্তর জর্জিয়ার আলগুলো সোজা আর লম্বা
নয়। অজস্র আলপথ এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে। নদীর জল যাতে এই উর্বরা জমিকে ধুয়ে না দিতে পারে।
জর্জিয়ার এই লাল মাটিই হল তুলো
উৎপাদনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ। বর্ষাকালে এই মাটি রক্তের মত লাল, খরায় ইটের গুঁড়োর
মত। মমতাময় সাদা গৃহের সারি, শান্ত চষা জমি আর শ্লথগতি হলুদ নদীর দেশ। আবার
বৈপরিত্যেরও সমাহার ঘটেছে এ দেশে। সূর্যের তীব্র রশ্মি। আবার ছায়াঘন সবুজ বন। দিগন্ত
বিস্তৃত কার্পাস আবাদি উষ্ণ সূর্যালোকে প্রশান্ত প্রসন্নতায় হেসে ওঠে। সীমান্ত
জড়িয়ে আছে ঘন অরণ্যে; গ্রীষ্মের দাবদাহে যে অরণ্য শীতল, খানিক রহস্যময়ী, প্রাচীন,
সহিষ্ণু। যেন মৃদুস্বরে বলছে, “সাবধান,
সাবধান! আমরা একবার তোমাদের গ্রাস করেছিলাম। আবারও করতে পারি।”
বাইরে থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ,
লোহার শেকলের ঝিনঝিনি, নীগ্রোদের তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ ভেসে এল। তিনজনেই বুঝতে পারল,
জমি চষা শেষ করে আজকের মত শ্রমিকেরা খচ্চর নিয়ে ফিরে এল। বাড়ির ভেতর থেকে স্কারলেটের মা এলেন ও’হারার মৃদু স্বর ভেসে এল। তাঁর চাবির বাক্সবাহিকা
কালো মেয়েটিকে ডাকলেন। মেয়েটি বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিল, “আজ্ঞে, যাই।” তার পায়ের শব্দ পাকশালার দিকে
মিলিয়ে গেল। এখানেই এলেন মাঠ থেকে ফেরা
শ্রমিকদের প্রাপ্য খাদ্য সামগ্রী ভাগ করে দেবেন। চিনে মাটির বাসন আর রুপোর কাঁটা
ছুরি চামচের আওয়াজ ভেসে আসছে টুংটাং। সাপারের (সান্ধ্য আহারের) জন্য পোর্ক টেবিল সাজাচ্ছে। পোর্ক টারার খানসামা।
শেষ আওয়াজে দুই ভাই বুঝতে পারল যে
এবার তাদের বাড়ি ফেরা উচিত। মায়ের মূখোমুখি হবার একদম ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই সময়
নিচ্ছিল। আর মনে মনে আশা করছিল, স্কারলেট
ওদের সাপারে আহ্বান জানাবে।
“কালকের
কথাটা একটু ভেবে রেখ স্কারলেট,”
ব্রেন্ট বলল। আমরা এখানে ছিলাম না। বারবেকিউ আর বল নাচের কথাও জানা ছিল না। তাই বলে কাল সন্ধ্যায় আমরা যথেষ্ট নাচের সুযোগ
পাব না, সেরকম নিশ্চয়ই হবে না। তুমি
নিশ্চয়ই সবাইকে আবার কথা দিয়ে রাখ নি?”
“সত্যিই
দিয়ে ফেলেছি। কি করে জানব যে তোমরা চলে আসবে?
শুধুই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করলে
একা হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকত যে।”
“তু
-- মি! একা হয়ে যেতে!”
ছেলে দুটো খুব জোরে হেসে উঠল।
“দেখ
ডার্লিং, কথা দাও যে প্রথম ওয়াল্টস তুমি আমার সঙ্গে নাচবে আর একদম শেষেরটা স্টু-এর
সাথে। আর হ্যা, সাপারটা আমরা একসাথেই খাব। সিঁড়ির ল্যানডিঙে বসব, যেমন আগের বার বসেছিলাম আর ম্যামি জিন্সিকে আবার আমাদের ভাগ্য বলে দিতে বলব।”
“আমি
ম্যামি জিন্সির ভাগ্য গণনায় বিশ্বাস করি না।
মনে নেই বলেছিল যে আমার বিয়ে হবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যার চুল হবে ঘন কালো
রঙের আর লম্বা কালো গোঁপ থাকবে! আমি কালো চুলের লোক মোটেই পছন্দ করি না।”
“তুমি
নিশ্চয়ই লাল চুল ভালোবাস, তাই না ডার্লিং?”
ব্রেন্ট এক গাল হাসল। যাই হোক তুমি আমাদের
ওয়াল্টস আর সাপারের জন্য কথা দিলে কিন্তু।”
“কথা
যদি দাও, তাহলে একটা গোপন কথা তোমাকে বলে দেব,” স্টুয়ার্ট বলল।
“কি
গোপন কথা?” স্কারলেট উত্তেজনায় বাচ্চা মেয়ের
মত চেঁচিয়ে উঠল।
“যেটা কাল অ্যাটলান্টায় শুনলাম, সেটা কি স্টু? তাই যদি
হয়, সেটা কাউকে বলব না বলে কথা দিয়েছি যে।”
“হ্যা,
মিস পিটি যেটা বললেন।”
“মিস
কে?”
“অ্যাশলে
উইল্কস কে তো তুমি জান। ওর পিসী –
মিস পিটিপ্যাট হ্যামিলটন –
চার্লস আর মেলানি হ্যামিলটনেরও পিসী। অ্যাটলান্টায় থাকেন।”
“খুব চিনি! আর ওঁর মত বোকার হদ্দ বুড়ি আর একটা দেখিনি।”
“সে
যা হোক, কাল যখন আমরা অ্যাটলান্টায় বাড়ি আসার ট্রেনের অপেক্ষা করছিলাম, ওঁর ঘোড়ার
গাড়ি ডিপোর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। উনি
কিছুক্ষণ আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন। তখনই বললেন যে উইল্কসদের বল পার্টিতে কাল
একটা বাগদানের ঘোষণা করা হবে।”
“ওঃ,
সে তো জানি,” স্কারলেট হতাশ স্বরে বলে উঠল। ওই
যে ওঁর বোকচন্দর ভাইপোটা –
চার্লি হ্যামিলটন আর হানি উইল্কস। সবাই জানে – অনেক বছর ধরেই জানে –
যে ওরা একদিন না একদিন বিয়ে করবে। যদিও
চার্লির এ ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ আছে বলে কোনোদিনই মনে হয় নি।”
“ওকে
বোকা মনে কর তুমি?” ব্রেন্ট জিজ্ঞেস করল। “গত বড়দিনে, তুমি ওকে তোমার পাশে খুব ঘুর ঘুর করতে
দিয়েছিলে।”
“কোন
উপায় ছিল না,” স্কারলেট কাঁধ ঝাঁকাল। “ওকে আমার কেমন যেন ভিতু ভিতু মনে হয়।”
“আর
তা ছাড়া ওদের বাগদানের কথা ওখানে মোটেই ঘোষণা করা হচ্ছে না।” স্টুয়ার্ট কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল। “অ্যাশলের সাথে মেলানির –
মানে চার্লির বোনের বাগদান।”
স্কারলেটের মুখের অভিব্যাক্তি
বদলাল না, কিন্তু ওর ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গেল। কোন পূর্বাভাষ ছাড়াই হঠাৎ ধাক্কা
খেলে যেরকম হয়। প্রথমে বুঝতেই পারল না কি হয়েছে। সে এত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যে যখন
ও স্টুয়ার্টের দিকে তাকাল, সে ধরেই নিল যে স্কারলেট খুবই আশ্চর্য হয়েছে এবং আরো
কিছু জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। স্টুয়ার্টের বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা খুব পাকা
নয়।
“মিস
পিটি বলছিলেন যে এই ঘোষণা হয়ত পরের বছরের জন্যই মুলতুবি থাকত; বিশেষ করে মেলানির
শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু যে ভাবে
চারদিকে শুধু যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, তাতে দুটো পরিবারই চাইছে বিয়েটা তাড়াতাড়ি
মিটে গেলেই ভাল। তাই কাল সন্ধ্যেবেলা খাবার সময় এই বাগদানের ঘোষণা করা হবে। দেখ
স্কারলেট তোমাকে গোপন কথাটা বলেই ফেললাম।
তোমাকে আমাদের সাথে সাপার খাওয়ার
কথা দিতেই হবে।”
“সে
আর বলতে,” স্কারলেট যান্ত্রিকভাবে বলল।
“আর
ওয়াল্টস গুলো?”
“সব।”
“তুমি
খুব মিষ্টি! বাজী ধরতে পারি, অন্য ছেলেরা হিংসেয় নীল হয়ে যাবে!”
“করুক
যত খুশী হিংসে,” ব্রেন্ট বলল। ওদের দেখে নেবার
জন্য আমরা দুজনই যথেষ্ট। কাল সকাল থেকেই বারবেকিউতে বসছি আমরা।”
“কি
বললে?”
স্টুয়ার্ট আবার বলল।
“নিশ্চয়ই।”
দু ভাই একে অন্যের দিকে বিজয়ী
দৃষ্টিতে তাকাল। যদিও একটু অবাক যে হয় নি তা নয়।
ওরা বিশ্বাস করে যে ওরাই স্কারলেটের পছন্দের পাণিপ্রার্থী। কিন্তু এই প্রথম ও এত সহজে রাজী হয়ে গেল। সাধারণত, ও ওদের অনুরোধ উপরোধ করতে বাধ্য করে,
হ্যা কিংবা না কিছুই বলতে চায় না। ওরা
অভিমান করলে হেসে উড়িয়ে দেয়, রেগে গেলে নিরুত্তাপ হয়ে যায়। আর এখন কাল প্রায় সারাদিনের জন্য কথা দিয়ে দিল।
বারবেকিউতে এক সাথে বসবে, সব কটা ওয়াল্টস এক সাথে (আর ওরা চেষ্টা করবে যাতে কাল
শুধু ওয়াল্টস নাচই হয়)আর সাপার।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হওয়া মনে হচ্ছে যেন একটা
আশীর্বাদ।
সাফল্য লাভ করার উত্তেজনায়, দুজনে
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল। বারবেকিউর কথা, বল নাচ, অ্যাশলে উইল্কস,
মেলানি হ্যামিলটন এই সব। একজন অন্যজনের কথার পিঠে কথা বলে, নিজেদের মধ্যে হাসি
ঠাট্টা করে, আর মাঝে মাঝেই সাপারে
নিমন্ত্রণ করার জন্য স্থুল ইঙ্গিত করে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওদের খেয়াল হল স্কারলেট কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
আবহাওয়াটা যেন পালটে গেছে। কিন্তু কিভাবে সেটা ওদের মাথায় ঢুকল না, অপরাহ্ণের সেই দ্যুতি এখন ম্রিয়মাণ। যেন ওরা কি
বলাবলি করছে, স্কারলেট তাতে মন দিচ্ছে না, যদিও প্রয়োজনে তার প্রতিক্রিয়া গুলো
একেবারে ব্যাকরণ মেনে সঠিক। অতএব আরো
কিছুক্ষণ কথা চালাবার চেষ্টা করে, কিছুটা হতবুদ্ধি, কিছুটা বিরক্ত হয়ে অবশেষে দু
ভাই অত্যন্ত অনিচ্ছাসহকারে ঘড়ির দিকে তাকাল।
সূর্য একেবারে পাটে নেমে গেছে।
নদীর অন্য পারে লম্বা গাছগুলোকে কালো ছায়ামূর্তির মত লাগছে। সোয়ালো পাখিরা দ্রুত
পায়ে উঠোন পেরিয়ে আসছে। মুর্গি, হাঁস আর টার্কির দল হেলতে দুলতে মাঠ থেকে ফিরে
আসছে।
স্টুয়ার্ট হাঁক লাগাল “জীমস!” একটু বাদেই, একজন লম্বা কালো ছেলে, দু ভাইয়েরই
সমবয়সিই হবে, ছুটতে ছুটতে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাঁধা ঘোড়ার পাশে দাঁড়াল। জীমস দুই
ভাইয়ের নিজস্ব পরিচারক। ছোটবেলায় একসাথে খেলাধুলো করেছে। ওদের দশম জন্মদিনের উপহার
হিসেবে জীমসকে পেয়েছে। ওকে দেখতে পেয়ে কুকুরগুলো ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়ল। ছেলে দুটো বাও করে স্কারলেটের করমর্দন করল। বলল
কাল ওরা ভোর হতেই উইল্কসদের ডেরায় পৌঁছে যাবে আর স্কারলেটের অপেক্ষা করবে। এরপর
ওরা ঘোড়ায় চেপে রওয়ানা দিল; পেছনে পেছনে জিমস।
রাস্তা ধরে কিছুটা যাবার পরে বাঁক
নিতেই, টারা যখন চোখের আড়াল হল, ব্রেন্ট
একটা ডগউড গাছের তলায় ঘোড়া থামাল। স্টুয়ার্টও। কালো পরিচারকটিও একটু পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাগাম হালকা হতেই ঘোড়া দুটো
জমি থেকে নরম ঘাস খেতে শুরু করল।
কুকুরগুলো আবার লাল মাটিতে শুয়ে পড়ে সতৃষ্ণ চোখে সোয়ালো পাখির আনাগোনা দেখতে
লাগল। ব্রেন্টের চওড়া অকপট মুখে একটা
বিহ্বল ছাপ; হয়ত সামান্য অসন্তুষ্টও।
“দেখ,” সে বলল। “তোর
মনে হয় না যে আমাদের সাপারে ডাকা উচিত ছিল ওর?”
“আমি
তো ভেবেছিলাম ডাকবে,”
স্টুয়ার্ট বলল। “আমি অপেক্ষা করতেই থাকলাম, কিন্তু
কোথায় করল? কি মনে হয় তোর?”
“কিছুই
বুঝতে পারছি না। আমারও তো তাই মনে হয়েছিল। অনেকদিন বাদে দেখা হল। আমাদেরও বলবার
অনেক কিছুই ছিল!”
“মনে
তো হয়েছিল, আমাদের দেখে ও খুব খুশী হয়েছে। যখন আমরা এলাম।”
“আরে
আমিও তো তাই ভেবেছিলাম।”
“তারপর,
শেষের দিকটায় একদম যেন চুপ মেরে গেল। এমন ভাব করল যেন খুব মাথা ধরেছে!”
“হ্যা, আমিও খেয়াল করলাম। তবে ও নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাই নি। কি হয়েছিল বলে মনে হয় তোর?”
“কে জানে! আচ্ছা এমন কিছু কি আমরা বলে ফেলেছি – যাতে করে ও রেগে গেছে?”
“সেরকম কিছু তো মনে আসছে না।
তা ছাড়া স্কারলেট যখন রেগে যায় সবাই জানতে পারে। অন্যান্য মেয়েদের মত চুপচাপ মেনে নেবার পাত্রীই নয় ও।”
“হ্যা
ওর এই ব্যাপারটাই আমি খুব পছন্দ করি। রেগে গেলে অন্যদের মত একটা ঠাণ্ডা অথচ ঘৃণার
মনোভাব নিয়ে বসে থাকে না। সোজাসুজি বলে দেয়। মনে হয় আমরা এমন কিছু একটা করেছি বা
বলে ফেলেছি যেটা ওকে এত চুপচাপ হয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিংবা অসুস্থ বোধ করেছে। জোরের সাথে বলতে পারি, আমাদের দেখে ও খুশীই হয়েছিল আর
আমাদের সাপারে ডাকবার কথাও ভেবেছিল।”
“আমরা
বহিষ্কৃত হয়েছি বলে এরকম করল? তোর কি মনে হয়?”
“বোকার
মত কথা বলিস না। দেখলি না যখন সেটা বললাম, কি রকম প্রাণ খুলে হাসল। আর স্কারলেটও বই, পড়াশুনো এসব ব্যাপারে আমাদের মত
করেই ভাবে।”
ব্রেন্ট ঘোড়াটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে,
নিগ্রো ছেলেটাকে ডাকল।
“জীমস!”
“আজ্ঞে?”
“মিস
স্কারলেটের সাথে আমাদের কি কথাবার্তা হয়েছে শুনেছিস তো?”
“না
না হুজুর – মিষ্টার ব্রেন্ট! আপনি কি করে
ভাবলেন যে আমি আপনাদের কথাবার্তায় আড়ি পাতব?”
“আড়ি
পাতিসনি! গুলি মার! তোরা কালোরা চার পাশে কি কি ঘটছে, সব জানিস। মিথ্যুক কোথাকার! আমি নিজের চোখে দেখেছি, তুই
চন্দ্রমল্লিকার ঝোপের কাছে, আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলি! এখন বল, আমরা মিস
স্কারলেটকে – রেগে যাবার মত কিংবা দুঃখ পাওয়ার
মত কিছু বলেছিলাম কি?”
এভাবে আবেদন করার পর জীমস আর কোন
ভনিতা না করে ভুরু কোঁচ করে একটু ভেবে নিল।
“না
হুজুর, রেগে যাবার বা দুঃখ পাওয়ার মত কিছুই আপনারা বলেছেন বলে আমি তো শুনিনি। বরং
আপনাদের দেখে উনি খুবই খুশী হয়েছিলেন, আর আপনাদের সাথে উনি খুব আনন্দের সঙ্গে গল্প
করছিলেন। তারপর যখন আপনারা মিস্টার অ্যাশলে আর মিস মেলি হ্যামিলটনের ব্যাপারে
বললেন – ওরা বিয়ে করতে যাচ্ছে – তারপর থেকেই উনি চুপ করে গেলেন।”
ভাইরা পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে ঘাড়
নাড়ল, কিন্তু ব্যাপারটা ওদের বোধগম্য হল না।
“জিমস
ঠিকই বলছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন,”
স্টুয়ার্ট বলল। “ওর তো অ্যাশলের ব্যাপারে তেমন কোন
আগ্রহ কখনো দেখি নি। হ্যা ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু ওর ব্যাপারে কোন দূর্বলতা
ছিল বলে জানি না।”
ব্রেন্ট ওর কথায় সায় দিয়ে ঘাড়
নাড়ল। তারপর বলল –
“কিংবা
এটা নয়তো – হয়ত অ্যাশলে বাগদানের ঘোষণার কথা
ওকে নিজের মুখে বলে নি –
একজন পুরোনো বন্ধুকে –
অন্যদের বলার আগে – তাই ও হয়ত দুঃখ পেয়েছে। মেয়েরা
আবার এসব ব্যাপারকে খুবই গুরত্ব দেয়।”
“হতেই
পারে। নাই বা যদি বলে থাকে তো অসুবিধে কোথায়? চমক দেবার জন্য ব্যাপারটা গোপন রাখার
অধিকার তো সবারই আছে; স্বাভাবিক ভাবেই কেউ চাইতে পারে তার বাগদানের খবর নিয়ে বেশী
হইচই না হোক। কি বল? আমরাও তো জানতে পারতাম না। মেলির পিসী যদি না কথাটা আমাদের
কাছে ফাঁস করতেন। কিন্তু স্কারলেটের তো
জানা থাকার কথা যে আজ না হোক কাল অ্যাশলের সাথে মিস মেলির বিয়ে হতই। এ তো কত যুগ
ধরে জানি। উইল্কস আর হ্যামিলটনরা সব সময় নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে। সবাই জানত। যেমন
হানি উইল্কস মিস মেলির ভাই চার্লিকে বিয়ে করবে।”
“যেতে
দে। তবে ভেবেছিলাম ও আমাদের সাপারে ডাকবেই। এখন বাড়ি ফিরে মায়ের মুখোমুখি হতে একদম মন চাইছে না
রে। আমাদের বের করে দেওয়া নিয়ে
অনেকক্ষণ বক বক শুনতে হবে –
যেন আমাদের এই প্রথম বের করে দেওয়া হল!”
“দেখা
যাক। হয়ত বয়েড এতক্ষণে ওঁকে সামলে নিয়েছে। বাঁটকুলিটা মানুষকে কথায় বশ করতে খুব
ওস্তাদ কিন্তু। জানিসই তো মাকে ঠাণ্ডা করতে একমাত্র ও-ই পারে।”
“ঠিকই
বলেছিস। তবে একটু সময় তো ওকে দেওয়াই উচিত। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে মাকে গুলিয়ে
দেবে আর মা হাল ছেড়ে বলবেন যে ওই কথার মারপ্যাঁচ গুলো আইন ব্যবসায় কাজে লাগানোই
বেশী ভাল। কিন্তু এত অল্প সময়ে বেচারা নিশ্চয়ই সব বুঝিয়ে উঠতেই পারেনি! কি মনে হয়
জানিস? মা নতুন ঘোড়াটা নিয়ে এতই উত্তেজিত রয়েছে যে সাপারের টেবিলে বসার আগে খেয়ালই
করবে না যে আমরা ফিরে এসেছি। বয়েডের সঙ্গে কথা বলা তো দুরস্ত! আর সাপারের আগেই
একপ্রস্থ চেঁচামেচি হয়ে যাবে। রাত দশটার আগে বয়েড এটা বলার সুযোগই পাবে না যে
চ্যান্সেলার তোর আর আমার সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তারপরে আমাদের কারোরই কলেজে
থাকাটা সম্মানের হত না। আর মাকে চ্যান্সেলারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট করে তুলতে
মাঝরাত পেরিয়ে যাবে, যখন মা শেষমেশ বয়েডকে বলবে যে ও কেন চ্যান্সেলারকে গুলি করল
না! নাঃ, মাঝরাতের আগে কিছুতেই ঘরে ফেরা যাবে না!”
দু’ভাই বিমর্ষ চোখে একে অন্যের দিকে তাকাল। বুনো ঘোড়ার ব্যাপারে, শিকার করবার
ব্যাপারে, প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলায় এদের মনে কোন ভয়ডর নেই।
কিন্তু ওরা ওদের লাল চুল মায়ের বাক্যবানকে, বিশেষ করে মায়ের চাবুককে অত্যন্ত
ভয় পায়, কারন দরকার পড়লে ওই চাবুক ওদের পিঠে পড়তে দেরি হয় না।
“তার
থেকে চল উইল্কসদের ওখানে যাওয়া যাক,”
ব্রেন্ট বলল। “অ্যাশলে আর মেয়েরা সাপারে আমাদের পেয়ে খুশীই হবে।”
স্টুয়ার্ট একটু অস্বস্তি বোধ করে।
“না
না ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই কালকের বারবেকিউর আয়োজন নিয়ে ওরা ব্যস্ত আছে
আর তা ছাড়া _____”
“ওঃ!
একদম ভুলে গেছিলাম,” ব্রেন্ট তাড়াতাড়ি বলল। “নাঃ ওখানে যাওয়া চলবে না।”
এরপর বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ ওরা
ঘোড়ায় চড়ে পাশাপাশি চলতে লাগল। স্টুয়ার্টের বাদামি গালে অস্বস্তি বোধ থেকে হালকা
লালের ছোঁয়া। গত গ্রীষ্মের আগে পর্যন্ত স্টুয়ার্ট আর ইন্ডিয়া উইল্কসের মধ্যে একটা
পূর্বরাগের সম্ভাবনা ঘোরাফেরা করছিল। দুই পরিবার আর পুরো কাউন্টির প্রকাশ্য
সম্মতিতেই। সকলে মনে করেছিল ধীর স্থির
ইন্ডিয়া উইল্কসের প্রভাবে স্টুয়ার্টও কিছুটা সংযত হয়ে উঠবে। হয়ত স্টুয়ার্ট ইন্ডিয়াকে বিয়ে করতে রাজীও হয়ে
যেত। কিন্তু ব্রেন্ট এটাকে মেনে নিতে পারেনি।
ও ইন্ডিয়াকে পছন্দ যে করত না তা
নয়। কিন্তু মনে করত যে মেয়েটা খুবই সাধারণ আর ভীরু স্বভাবের। আর সেজন্যই ও
কোনোদিনই ইন্ডিয়ার প্রেমে পড়েনি যাতে স্টুয়ার্টকে সঙ্গ দিতে পারে। সেই প্রথম দুই ভাইয়ের পছন্দ আলাদা আলাদা খাতে বইছিল।
একজন অতি সাধারণ মেয়ের প্রতি অনুরক্ত হওয়ায় ও স্টুয়ার্টের ওপর মনে মনে একটু
ক্ষুব্ধই হয়েছিল।
তারপর গত গ্রীষ্মে, জোন্সবোরোর
ওকগাছ পরিবেষ্টিত পার্কে ওরা দুজনেই একসাথে আবিষ্কার করল স্কারলেটকে। অনেক বছর ধরেই চেনে ওকে। এক
সময় খেলাধুলোও করেছে একসাথে –
বলা যেতে পারে ওদের খুবই পছন্দের খেলার সাথী।
কারন স্কারলেট ওদের
মতই, গাছে আর ঘোড়ায় চড়তে, দুটোতেই সমান পারদর্শী ছিল।
ওরা অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করল যে সেই স্কারলেট এক জন অত্যন্ত
আকর্ষণীয় নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
জীবনে প্রথম লক্ষ্য করল যে ওর ডাগর
সবুজ চোখ দুটো কেমন কথায় কথায় নেচে ওঠে। যখন হাসে, গাল দুটোতে কি গভীরভাবে টোল
পড়ে। কি সুন্দর ছোট ছোট ওর হাত দুটো। কি সরু কটি! ওদের মন্তব্য শুনে স্কারলেট
উচ্ছল হাসিতে একেবারে গড়িয়ে পড়ল। ওদের দুজনকে ও যে অসাধারণ জোড়ি বলে মনে করে সে
কথা বলাতে ওরা একটু বেশী রকম গলে গেল।
সেটা ছিল ওদের জীবনের একটা স্মরণীয়
দিন। মাঝে মাঝে যখন ওরা এ নিয়ে কথা বলত তখন দুজনেই এই ভেবে আশ্চর্য হত যে ওরা
স্কারলেটকে আগে কেন লক্ষ্য করেনি! আসল কারনটা ওরা অবশ্য ধরতেই পারে নি, যেটা হল
সেদিন স্কারলেটই চেয়েছিল ওরা ওকে লক্ষ্য করুক। কোন পুরুষ মানুষ তাকে ছাড়া আর কারও
প্রেমে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া স্কারলেটের পক্ষে অসম্ভব ছিল। স্টুয়ার্ট আর ইন্ডিয়া
উইল্কসকে হেসে গল্প করতে দেখায় ওর শিকারীসত্বা জেগে উঠেছিল। শুধু স্টুয়ার্টের
শিকারেই তার মন ভরে নি, ব্রেন্টকেও তার মোহজালে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আবদ্ধ
করেছিল। ওরা দুজনেই অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সঙ্গে এই ফাঁদে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বর্তমানে দুজনেই স্কারলেটের প্রেমে
হাবুডুবু খাচ্ছে। ইন্ডিয়া উইল্কস আর লাভজয়ের লেটি মুনরো – যার সাথে ব্রেন্টের একটা শিথিল প্রেমের ব্যাপার চলছিল, এখন ওদের মনোজগত থেকে
বহু দূরে চলে গেছে। যদি স্কারলেট ওদের দুজনের কোন একজনকে বেছে নেয়, তাহলে অন্য জন
কি করবে এ প্রশ্ন কখনও ভেবে দেখে নি। যখন ব্যাপারটা দানা বাঁধবে তখন দেখা যাবে। এই
মুহুর্তে অবশ্য একটি মেয়েতেই দুজনের মধ্যে কোন মনান্তর তৈরি করতে পারে নি। এরা একে
অপরকে হিংসে করত না। এমন একটা পরিস্থিতি, যেটা তাদের প্রতিবেশীদের কাছে কৌতুহলের
কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর তাদের মায়ের কাছে বিরক্তির কারন। মা স্কারলেটকে একেবারেই পছন্দ করতেন না।
“ওই
সেয়ানা মেয়েটা তোমাদের কোন একজনকে যদি বিয়ে করতে রাজী হয়, সেটাই হবে তোমাদের
যথযোগ্য শাস্তি। এও হতে পারে যে ও তোমাদের দুজনকেই বিয়ে করতে চাইবে। তখন তোমাদের
জর্জিয়া ছেড়ে উটায়৫ থাকতে হবে। অবশ্য মর্মনরা৬ যদি থাকতে
দেয়! যেটা সব থেকে চিন্তার ব্যাপার সেটা হল ওই দুমুখো, সবুজচোখো ডাইনিটা তোমাদের
মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেবে আর তোমরা একে অন্যকে গুলি করে মারবে। সেটা হলে অবশ্য খারাপ
হয় না।” [৫ উটা – আমেরিকার পশ্চিম উপকূলেরে একটা
রাজ্য। ১৮৪৮ সালে মেক্সিকো থেকে কেটে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। মর্মনরা এখানে
প্রথম বসতি স্থাপন করে। ওরা বহুবিবাহ করত। উটা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ৪
জানুয়ারি ১৮৯৬তে যখন মর্মনরা বহুবিবাহ প্রথা তুলে দিতে রাজী হয়।] [৬ – মর্মন – উটার প্রথম অধিবাসী যাদের মধ্যে
বহুবিবাহপ্রথার চল ছিল ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত]
সেদিনের পর থেকে স্টুয়ার্ট
ইন্ডিয়ার উপস্থিতিতে বেশ অস্বস্তি বোধ করে। অবশ্য ইন্ডিয়া এ নিয়ে ওকে কখনই কোন কটূ
কথা বলেনি। হাবে ভাবে বুঝতেও দেয়নি যে স্টুয়ার্টের আকস্মিক আনুগত্য পরিবর্তনের কথা
সম্বন্ধে সে অবহিত। স্টুয়ার্ট জানে যে ইন্ডিয়া মনে মনে এখনও ওকেই ভালবাসে; আর
নিজের আচরণ যে ভদ্রলোকসুলভ হয় নি, সেটাও ভেতরে ভেতরে অনুভব করে। ওকে ও এখনও খুবই
পছন্দ করে; সম্মানও করে ওর বংশমর্যাদার জন্য, ওর মিষ্টি স্বভাব আর শিক্ষাদীক্ষার
জন্য এবং আরো অনেক সুন্দর গুণের জন্য। কিন্তু মেয়েটা কেমন যেন ফ্যাকাসে আর
নিরস। আর স্কারলেট কত প্রাণবন্ত; ওর মধ্যে
রয়েছে এক সদা পরিবর্তনশীল আকর্ষণ।
ইন্ডিয়ার সঙ্গে তোমার অবস্থান তুমি সবসময়ই উপলব্ধি করতে পারবে, কিন্তু
স্কারলেট সম্বন্ধে সেটা আন্দাজ করা খুব শক্ত। এটা একটু অসুবিধেজনক হলেও এর একটা
আলাদা আকর্ষণ আছে।
“চল,
তাহলে কেড ক্যাল্ভার্টের কাছেই যাওয়া যাক;
সাপার ওখানেই সারা যাবে। স্কারলেট বলছিল ক্যাথলীন চার্লস্টন থেকে বাড়ি
ফিরেছে। হয়ত ওর কাছে ফোর্ট সামটারের নতুন খবর কিছু পাওয়া যাবে।”
“ক্যাথলীন!
না রে। আমি বাজী ধরে বলতে পারি ফোর্ট যে ওখানে আছে সেটাই ও জানে না। ওটা যে
ইয়াঙ্কি সৈন্যের দখলে চলে গেছিল, এখন আবার আমরা ফিরে পেয়েছি, এটা জানে আশা করাটা
বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! ওখানে ও কটা বল নাচে গেছে আর কতগুলো ফুলবাবুকে পাকড়াও করতে
পেরেছে সেটুকুই বলতে পারবে।”
“সে
ওর আবোল তাবোল শুনতে মজাই লাগবে। আর মায়ের ঘুমোতে যাওয়া অব্দি কোথাও তো লুকোতে
হবে!”
“সে
আমিও ক্যাথলীনকে পছন্দই করি আর ওর বকবকানিতে মজাই পাই। ক্যারো রেট আর চার্লস্টনের অন্যদের
সম্বন্ধেও জানা যাবে। কিন্তু
ওর ওই ইয়াঙ্কি সৎ মায়ের সাথে আবার এক টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করাটা একটু অসহ্য
লাগবে।”
“অত
রাগ করিস না স্টুয়ার্ট। উনি মানুষ খারাপ নন।”
“না
রাগ করি নি। ওঁর জন্য আমার দুঃখই হয়। কিন্তু যাদের জন্য দুঃখ হয় সেরকম মানুষ আমার
ভাল লাগে না। উনি সারাক্ষণ হই চই করবেন, চেষ্টা করবেন ঠিক ঠিক কথা বলার যাতে তুই
অস্বস্তিতে না পড়িস, কিন্তু শেষমেশ ঠিক ভুল কথাটাই বলে ফেলবেন! মাথাটা আমার গরম
হয়ে যায়। আর ওনার মতে তো আমরা দক্ষিণের লোকেরা সবাই বর্বর! মাকে পর্যন্ত একথা বলে
দিয়েছেন। দক্ষিণের লোকজনদের সম্পর্কে ওনার একটা ভয় কাজ করে। যতক্ষণ আমরা থাকি, উনি যেন মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে
থাকেন। ওনাকে আমার একটা রুগ্ন মুর্গীর মত
লাগে, জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে সিঁটিয়ে বসে থাকেন। যেন কেউ এদিক ওদিক করলেই লাফ মেরে
চম্পট দেবেন!”
“তুই
ওঁকে দোষ দিতে পারিস না। তুই তো কেডের পায়ে
গুলি মেরেছিলি!”
“ঠিক
কথা। কিন্তু আমাকে জ্বালাতনের একশেষ করেছিল। নইলে আমি কখনওই করতাম না,” স্টুয়ার্ট বলল। তবে কেড সে কথা মনে রাখে নি।
ক্যাথলীন, কিংবা রেফোর্ড কিংবা মিঃ ক্যাল্ভার্টও ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে
নিয়েছেন।একমাত্র ওই ইয়াঙ্কি সৎমাই চেঁচামেচি করেছিলেন। আমাকে বর্বর বলে গাল পেড়েছিলেন।
আর বলেছিলেন যে অসভ্য দক্ষিণের লোকের কাছে কোনও সভ্য মানুষই নিরাপদ নয়!”
“বেশ।
কিন্তু তুই ওঁকে দোষ দিতে পারিস না। প্রথমত উনি ইয়াঙ্কি, তাই আমাদের মত ভদ্র
ব্যবহার ওঁর কাছ থেকে আশা করা ঠিক হবে না। সব থেকে বড় কথা তুই সত্যিই গুলি
চালিয়েছিলি, আর ও ওঁর সৎছেলে।”
“গুলি
মারো! কিন্তু তাই বলে এটা আমাকে অপমান করার যথেষ্ট কারণ হতে পারে না! তুই তো মায়ের
নিজের ছেলে। তোকে যখন টোনি ফোনটেন পায়ে গুলি করল, তখন মা কি এরকম কিছু করেছিলেন?
শুধু ডঃ ফোনটেনকে ব্যান্ডেজ করে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। আর বলেছিলেন নেশা করার জন্য
হয়ত টোনির হাতের নিশানা ঠিক ছিল না। মনে আছে এ কথায় টোনি কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল?”
দুজনেই জোরে হেসে উঠল।
“মায়ের
কোন তুলনাই হয় না!” কিছুটা আবেগের সাথে বলে উঠল
ব্রেন্ট। “যেখানে যেমন করা উচিত, মা সব সময়
ঠিক সেটাই করেন। আর অন্যদের সামনে তুই
কখনও অস্বস্তিতে পড়বি না।”
“কিন্তু
বাবার আর বোনদের সামনে মা সাংঘাতিক অস্বস্তিকর কিছু বলে ফেলতে পারেন, যখন রাতে ঘরে
ঢুকব,” খুব হতাশ ভাবে বলল স্টুয়ার্ট। “তার মানে আমরা ইউরোপে বেড়াতে যেতে পারব না। মা
বলেছিলেন যদি আবার কোন কলেজ আমাদের বের করে দেয় তাহলে আমরা এই লোভনীয় সফরে যেতে
পারব না।”
“আমাদের
কিছু যায় আসে না। কি বলিস? কি আছে ইউরোপে?
ওখানে কি এমন কিছু দেখার আছে, যা আমাদের জর্জিয়াতে নেই। বাজী রেখে বলতে পারি ওদের
ঘোড়াও এত জোরে ছুটতে পারে না, আর ওদের মেয়েরাও এত সুন্দরী নয়। আর বাবা যে রাই হুইস্কি খায় তেমন জিনিসও ওখানে
মিলবে না।”
“অ্যাশলে
উইল্কস বলছিল, ওদের দেশে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর আর ওখানকার সঙ্গীত স্বর্গীয়।
ইউরোপ অ্যাশলেকে খুব মুগ্ধ করেছে। ও সব সময় ওখানকার কথা বলে।”
“তুই
তো ভাল করেই জানিস উইল্কসরা গান আর বইয়ের ব্যাপারে বেশ পাগল; আর প্রাকৃতিক দৃশ্য।
মা বলেন এর কারন হল ওদের ঠাকুরদা ভার্জিনিয়া থেকে এসেছিলেন। ভার্জিনিয়ার লোকেরা আবার এসব জিনিসকে খুব
গুরুত্ব দেয়।”
“থাকতে
দাও ওদের ওসব নিয়ে। আমাকে শুধু ভাল একটা ঘোড়া দাও চড়বার জন্য, ভাল মদ দাও পান করার
জন্য, ভাল মেয়ে দাও প্রেম করার জন্য, আর মন্দ মেয়ে দাও ফষ্টিনষ্টি করার জন্য
......... যে ইচ্ছে ইউরোপে যাক ………. আমি কোন পরোয়া করি না। ধরে নে,
সামনেই যুদ্ধ, আর আমরা ইউরোপে! তাড়াতাড়ি ফিরতেও পারব না। আমি বরং
যুদ্ধে যেতেই বেশী রাজী ইউরোপ যাওয়ার চেয়ে।”
“আমিও
তাই। ব্রেন্ট আমি বুঝতে পেরে গেছি কোথায় আমরা সাপারের জন্য যেতে পারি! চল, আমরা
অ্যাবেল ওয়াইন্ডারের কাছে যাই আর বলি যে চারজনে আবার বাড়ি চলে এসেছি। বাড়ী ফিরলেই
নানারকম জবাবদিহি করতে হবে।”
“এটা
একটা ভাল আইডিয়া!” ব্রেন্ট সজোরে বলে উঠল। “ওর কাছে সৈন্যদলের সম্বন্ধে জানা
যাবে আর ইউনিফর্মের জন্য কোন রঙ বেছে নেওয়া হল সেটাও।”
“যদি
জ়ুয়েভ৭ সৈন্য হয়, আমি সৈন্যদলে যোগ দেবার ব্যাপারে আবার নতুন করে
ভাবব। ওই সব ঢোলা লাল প্যান্টে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। ওগুলো ঠিক মেয়েদের লাল
রঙের পাজামার মত”।
[৭ জ়ুয়েভ -
ফরাসী সেনাবাহিনীর অ্যালজেরিয়ান পদাতিক বাহিনী। এদের
ইউনিফর্মে অনেকদিন পর্যন্ত লাল রঙ ব্যবহার হত]
“আপনারা
কি মিঃ ওয়াইন্ডারের বাড়িতে যাবার কথা ভাবছেন? ওখানে গেলে কিন্তু সাপার পাওয়া যাবে না,” জিমস বলল। ওদের রাঁধুনি মরে গেছে আর এখনও নতুন কোন রাঁধুনি আসে নি। একজন মাঠে
কাজ করার লোককে দিয়ে রান্না করাচ্ছে। নিগ্রোরা বলছে ও হচ্ছে এখানকার সব থেকে খারাপ
রাঁধুনি।”
“হে
ভগবান! একটা নতুন রাঁধুনি কিনে নিলেই তো পারে।”
“কোথা
থেকে কিনবে? ওরা এত গরীব, ওদের চার জনের বেশী ক্রীতদাস কখনই ছিল না।”
জিমসের কথায় স্পষ্ট শ্লেষ। টার্লটনদের
একশজন ক্রীতদাস, তাই জিমসের সামাজিক অবস্থান খুব সুরক্ষিত। অন্যান্য বড়
প্ল্যান্টারদের ক্রীতদাসদের মত সেও ছোট প্ল্যান্টারদের, যাদের ক্রীতদাসের সংখ্যা
কম, তাদের একটু হেয় করে দেখত।
“মেরে
তোর চামড়া আমি ছাড়িয়ে নেব,”
স্টুয়ার্ট খুব হিংস্রভাবে বলল। “কি
সাহস তুই অ্যাবেল ওয়াইন্ডারকে ‘গরীব’ বলে অপমান করছিস! গরীব হতে পারে, কিন্তু ও বেজন্মা
নয়। সাদা অথবা কালো কেউ যদি ওঁকে অপমান করে তাহলে তাকে আমি দেখে নেব! এই কাউন্টিতে
ওর থেকে কাবিল লোক নেই। শুধু শুধু ওকে
সৈন্যদলের লেফটেনান্ট করেনি!”
“আমার
জানা ছিল না,” বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে জিমস
বলল। আমার ধারণা ছিল সেনাদলের অফিসার শুধু ধনী সাদা মানুষদের থেকেই নেওয়া হবে;
ছোটলোকদের থেকে নয়।”
“কি
বললি, ও ছোটলোক? তুই ওর সঙ্গে স্ল্যাটারিদের তুলনা করবি, যারা হল সত্যিকারের সাদা
ছোটলোক? অ্যাবেল হয়ত গরীব। বড় চাষী কিংবা
প্ল্যান্টার নয়। তা সত্ত্বেও যদি ওকে লেফটেনান্ট করে থাকে, তাহলে কোন কালো লোকের
সে নিয়ে বলার অধিকার নেই। সৈন্যদল জানে ওরা কি চায়।”
তিন মাস আগে, যেদিন জর্জিয়া ইউনিয়ন
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সেদিনই অশ্বারোহী সৈন্যদল তৈরি করা হয়। আর সেদিন থেকেই
যুদ্ধের গুজব জোরদার হতে শুরু করে। এখনও এটার কোন নাম দেওয়া হয় নি। নামের অভাব ছিল
বলে নয়। আসলে সবারই নিজস্ব কিছু ভাবনা ছিল আর কেউই নিজের ভাবনাটাকে ছেড়ে দিতে
চাইছিল না। “ক্লেটনের বুনো বেড়াল”, “অগ্নিভুক”, “উত্তর
জর্জিয়ার অশ্ববাহিনী’,
“জ়ুয়েভ”,
“ইনল্যাণ্ড রাইফেল” (যদিও রাইফেলের ব্যবহারই হবে না, পিস্তল, তরবারি আর ছুরি দেওয়া হবে), এই রকম।
যতক্ষণ না ফয়সালা হয় ততক্ষণ সবাই এটাকে “ট্রুপ” এই নামেই ডাকছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই টিঁকে গেল।
অফিসার নির্বাচন সদস্যরাই করেছিল। কাউন্টিতে
এমন একজনও ছিল না যার সামরিক অভিজ্ঞতা ছিল, দু একজন মেক্সিকো আর সেমিনোলের যুদ্ধের
অভিজ্ঞ সৈন্য ছাড়া, যারা আবার ট্রুপের সদস্যদের পছন্দের নয়। ওরা টার্লটনদের চার
ছেলে আর ফোনটেনদের তিন ছেলেদের যথেষ্ট পছন্দ করত, বিশ্বাসও করত। কিন্তু দুঃখের
বিষয় ওরা ওদের বাছতে অনীহা জানাল।টার্লটনদের মধ্যে ছিল সংযমের অভাব আর ফোনটেনদের
মেজাজ ছিল তিরিক্ষে। অ্যাশলে উইল্কসকে ক্যাপটেন করা হল, কারন সে খুব ভাল ঘোড়সওয়ার।
মাথা খুব ঠাণ্ডা আর শৃঙ্খলাপরায়ণ। রেফোর্ড ক্যাল্ভার্টকে করা হল ফার্ষ্ট
লেফটেনান্ট, কারন রেফকে সবাই ভালবাসত আর অ্যাবেল ওয়াইন্ডারকে করা হল সেকেণ্ড
লেফটেনান্ট।
অ্যাবেল ছিল খুব বিচক্ষণ,
বিশালদেহী, নিরক্ষর, কিন্তু সহৃদয় ব্যক্তি। বয়সেও অন্যদের থেকে বড় ছিল। মহিলাদের
সম্মান করত। ট্রুপে খুব একটা উন্নাসিকতা ছিলনা। অনেকেরই বাবা, ঠাকুরদা ছোট চাষী
থেকে বড় হয়েছেন। অ্যাবেল এ তল্লাটের সব থেকে ভাল নিশানাবাজ। বলা হত, পঁচাত্তর গজ দূর থেকেও কাঠবেড়ালির চোখে
গুলি করে লক্ষ্যভেদ করতে পারত। ঘরের বাইরে থাকবার অভ্যেস ছিল।
ওকে যে সম্মান দেখান হত তার জন্য সে কোনরকম দম্ভ প্রকাশ করত
না। কিন্তু প্ল্যান্টারদের মহিলারা আর
ক্রীতদাসরা কখনো ভুলতে পারত না যে ও জন্মসূত্রে বনেদী ছিল না।
প্রথম প্রথম ট্রূপে শুধুই
প্ল্যান্টারদের পরিবারের ছেলেদেরই নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রত্যেকেই নিজেদের ঘোড়া,
অস্ত্রশস্ত্র, ইউনিফর্ম আর চাপরাশি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। ক্লেটন কাউন্টিতে ধনী
প্ল্যান্টারদের সংখ্যা কমই ছিল। তাই ট্রুপের
লোকবল বাড়ানোর জন্য ছোট ছোট চাষীদের পরিবারের ছেলেদেরও নিয়োগ করতে হয়েছিল। এছাড়া
যারা শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত, কিংবা জেলে, এমনকি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল গরীব
সাদা মানুষদেরও দলে নেওয়া হয়েছিল।
তূলনামূলক ভাবে গরীবশ্রেণীর
লোকেরাও স্বচ্ছল লোকদের মতই, যুদ্ধ হলে, ইয়াঙ্কিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে
পিছু পা হবে না। কিন্তু এদের কোন বাড়তি সম্পদ ছিল না যা দিয়ে এরা ট্রুপকে অর্থকরী সাহায্য করতে
পারে। অনেক ক্ষুদ্র চাষীরই ঘোড়া ছিল না, ওরা খচ্চর দিয়েই চাষের কাজ চালিয়ে নিত।
যুদ্ধের জন্য সেটাও দিয়ে দিলে রোজগারের পথটাও বন্ধ হয়ে যাবে। কোন কোন গরীব সাদা মানূষের কাছে অন্তত একটা
খচ্চর থাকাটাই অনেক। শিকারি আর জেলেদের
কাছে আবার সেটুকুও ছিল না। ওদের ছিল দিন আনি দিন খাই অবস্থা। বছরে পাঁচ ডলারও একসাথে দেখার সুযোগ
হয় না এদের। তবে নিজেদের দারিদ্র নিয়ে এদের
যথেষ্ট গর্ব ছিল যেমন ধনী প্ল্যান্টারদের ছিল ঐশ্বর্য নিয়ে। দান হিসেবে কোন কিছু
নেওয়াটাকে এরা অপমান বলে মনে করত। তাই
প্রত্যেকের অনুভুতিকে সম্মান জানিয়ে এবং ট্রুপকে শক্তিশালী করার জন্য, স্কারলেটের
বাবা, জন উইল্কস, বাক মুনরো, জিম টার্লটন, অর্থাৎ সব বড় প্ল্যান্টাররাই, একমাত্র
অ্যাঙ্গাস ম্যাকিন্টশ বাদে, সবাই ট্রুপকে অর্থ, ঘোড়া আর লোকবল দিয়ে প্রভূত সাহায্য
করেছিলেন। প্রত্যেক প্ল্যান্টার ঠিক করে নিয়েছিলেন যে তাঁরা নিজেদের ছেলেদের ছাড়াও
নির্দিষ্ট সংখ্যক অন্য সদস্যদেরও সাজ সরঞ্জাম দেবার বন্দোবস্ত করবেন। ব্যাপারটা এমন ভাবে করা হবে যাতে কেউই এঁদের
ঘোড়া বা অন্যান্য সরঞ্জাম গ্রহণ করে অসম্মানিত বোধ না করেন।
ট্রুপ সপ্তাহে দুবার অনুশীলন করবার
জন্য জোন্সবোরোতে মিলিত হত। প্রার্থণা করত যেন যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যায়। তখনও
অবশ্য সকলের জন্য ঘোড়ার আয়োজন করা যায় নি।
কিন্তু যাদের ছিল তাঁরা নিজেদের মত করে
অনেক ধুলো উড়িয়ে, আদালতের পেছনের জমিতে অশ্বারোহীবাহিনীর রণকৌশল অনুশীলন
করে চলত। মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে তরবারি আস্ফালন করত। যাদের ঘোড়া ছিলনা, তাঁরা
বুলার্ডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তামাক চিবোতে চিবোতে আর আড্ডা দিতে দিতে মহড়া
দেখত। অথবা তারা গুলি ছোঁড়া অভ্যাস করত।
কেউ শেখাবার ছিল না। কিন্তু এরা
ছিল জন্মাবধি তুখোড় নিশানাবাজ।
নানা ধরণের অস্ত্রশস্ত্র মজুদ
থাকত। কোন কোন অস্ত্র ছিল পুরোনো। নতুন বসতি গড়বার সময় অ্যালঘেনি পর্বত পেরিয়ে
আসার সময় যেসব অস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছিল সেসব যেমন ছিল তেমনি ইংল্যান্ডে তৈরি আধুনিক
রাইফেলও ছিল।
অনুশীলন শেষ হলে জোন্সবোরোর একটা
প্রদর্শণীকক্ষে সবাই জমায়েত হত। অফিসারদের চেষ্টা থাকা সত্বেও ট্রুপে নিজেদের
মধ্যে ছোট খাট লড়াই এড়াতে পারতেন না। তাই ইয়াঙ্কি আক্রমণের আগেই নিজেদের মধ্যে
ঝাগড়াতেই, বেশ কিছু সদস্যের গুরুতর আঘাত লাগত। এরকমই একটা ঝগড়ার সময় স্টুয়ার্ট
টার্লটন কেড কাল্ভার্টকে আর টনি ফোনটেন ব্রেন্টকে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল। যে সময় ট্রুপের গঠন হয়, সেই সময় যমজ ভাই দুজন
সবে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে এসেছে। ওরা খুব আগ্রহ সহকারেই দলে নাম লেখাল। কিন্তু
এই গুলি চালানোর ঘটনার পর ওদের মা আবার ওদের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি
করিয়ে দেন। এই দু’মাস ওরা এই অনুশীলনের আড্ডার অভাব
বোধ করেছে আর লেখাপড়া করা যে শুধুই সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়, সেটা হাড়ে হাড়ে
বুঝেছে।
“আমাদের
এত ঘুরে অ্যাবেলের বাড়ি যাবার দরকার নেই,”
ব্রেন্ট পরামর্শ দিল। “মিঃ
ও’হারার পুকুরের ধার দিয়ে গিয়ে ফোনটেনদের ক্ষেতের পাশ
দিয়ে গেলে এক্ষুণি পৌঁছে যাব।”
“ওখানে
গেলে শুধু অল্প মাংস আর সব্জী ছাড়া কিছুই খেতে পাবেন না,” জীমস শেষ চেষ্টা করল।
“তুই
কিছুই পাবি না,” স্টুয়ার্ট হাসল। “তার কারন, তুই এখন বাড়ি গিয়ে মাকে বলবি যে আমরা খেতে
আসতে পারছি না।”
“না না সে আমি পারব না,” জিমস ভয়ে কঁকিয়ে উঠল। “মিস বিয়াট্রিসকে আমি আপনাদের থেকে কম ভয় পাই না। প্রথমেই উনি কলেজ থেকে আপনাদের বের করে দেওয়ার জন্য
আমাকেই দায়ী করবেন! আর আপনাদের ফেরত না
নিয়ে গেলে আপনাদের বদলে আমাকেই উত্তম মধ্যম
দেবেন, কারন ওনার মনে হবে এই সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী! যদি আপনারা আমাকে মিঃ ওয়াইন্ডারে ওখানে নিয়ে না
যান, তাহলে সারা রাত আমি জঙ্গলে বসে থাকব। হয়ত পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস ভে্বে
সেপাইরা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তবু
মিস বিয়াট্রিসের কবলে পড়ার থেকে সেটা ভাল।”
দু’ভাই কালো ছেলেটার দৃঢ় সংকল্প দেখে একটু ঘাবড়ে গেল আবার ভেতরে ভেতরে রেগেও
যাচ্ছিল।
“সেপাইদের
হাতে ধরা পড়াটা খুবই বোকার মত কাজ হবে। মা’ও এক সপ্তাহ ধরে চেঁচামেচি করার মত আরো একটা বিষয় পেয়ে যাবে। এই কালোগুলো মাঝে মাঝে সত্যিই সমস্যার কারন হয়ে
দাঁড়ায়। কখন কখন মনে হয় যারা এই
ব্যবস্থাটা তুলে দিতে চাইছে, তারা ঠিকই করছে।”
“দেখ
আমার মনে হয় আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইছি না, জিমসেরও সেটার মুখোমুখি
হওয়া উচিত নয়। ওকে সাথে নিয়ে যাওয়াই ভাল।
আর শোন গাধা, তুই খবরদার ওদের ক্রীতদাসদের কাছে আমরা এই খাই – সেই খাই আর তোরা এই খাস –
এসব বলে কোন রকম বাতেলা মারবি না! তাহলে
মা কে বলে দেব আর তোর যুদ্ধে যাওয়া বন্ধ করে দেব।”
“বাতেলা?
না হুজুর। আমি বাতেলা মারি না। মিস
বিয়াট্রিস যেমন তোমাদের আদব কায়দা শিখিয়েছেন, তেমনি আমাকেও শিখিয়েছেন।”
“খুব
একটা লাভ হয় নি। তিনজনেরই,”
স্টুয়ার্ট বলল। “চল, তবে যাওয়া যাক।”
তিনজনে রওয়ানা দিল। খানিকটা যাবার পরে ব্রেন্ট চেঁচিয়ে ভাইকে বলল, “আচ্ছা স্টু, তোর কি মনে হয় না স্কারলেটের আমাদেরকে
খেতে বলা উচিত ছিল?”
অনুবাদক পরিচিতি
উৎপল দাশগুপ্ত
ফটোগ্রাফার। অনুবাদক।
উৎপল দাশগুপ্ত
ফটোগ্রাফার। অনুবাদক।
0 মন্তব্যসমূহ