চিনের গল্প : অভ্যেস

মূল গল্প : চিয়া চিয়া লিন
অনুবাদক : রোখসানা চৌধুরী

এটা ছিল তার প্রিয় ঋতু। এ সময় গাছের পাতাগুলো আলোছায়ায় নকশা কেটে যেত। সুগন্ধী হাওয়া জীবনী শক্তিতে ভরপুর থাকত। কিন্তু গত সপ্তাহটি ছিল অন্যরকম। টাই চলে গিয়েছিল, বাড়িটা ছিল ফাঁকা, কেবল তাদের বাবা বসেছিল অন্ধকারে, একা। লুমি একটা তাঁবু বানাচ্ছিল। চিকন চিকন লাকড়ি দিয়ে, যার মুখটা থাকবে তিন কোনাচে খোলা যাতে সে সহজেই হামাগুড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যতবারই সে ঢুকে আবার বের হতে যাচ্ছিল তার ধাক্কায় কিছু কিছু কাঠি পড়ে যাচ্ছিল। সে যখন এটাকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল তখন এক পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো, 

‘এটা কোনো অবস্থাতেই কাজে দেবে না।’

দুটো খুঁটির মাঝখানের বাঁকা জায়গা দিয়ে কেবল একজোড়া বড় বড় বুটজুতা এবং ধূসর হালকা শীত বস্ত্র তার নজরে এলো। 

একবার কিছু ছেলে প্রধান সড়ক ছেড়ে তাদের জমির ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিয়েছিল। তাই তখন তাকে শিখিয়েছিল কিভাবে টুকরো কাঠ দিয়ে জমির উপর পথ নির্দেশনার ফলক বানাতে হয়। ‘প্রবেশ নিষেধ’-- কথাটি খুব নিখুঁতভাবে ছুরি দিয়ে সে খোদাই করে লিখেও দিয়েছিল। যে ছেলেগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল তাদের সাইকেলগুলোর সম্মিলিত আওয়াজ ছিল বিক্ষিপ্ত থু থু ফেলার মতো। তাদের কণ্ঠস্বর ছিল কর্কশ, ভাঙা-ভাঙা আর পাখির ডাকের মতো মিষ্টি। কিন্তু এইমাত্র শোনা কন্ঠের মতো গভীর না। সে উবু হয়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলো। সেখানে বুটজোড়া দেখা যাচ্ছিল। সে ওপরের দিকে তাকালো আর একজন হালকা পাতলা লম্বা গড়নের মানুষকে দেখতে পেল। যার মুখ ছিল ছায়ার ভেতর। মাথায় ছিল ধূসর ক্যাপ, পরনে হালকা ধূসর হালকা শীত বস্ত্র--সব কিছু মিলিয়ে সে যেন আপাদমস্তক প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এসে কুচঁকে থাকা জ্যাকেট হ্যাঁচকা টানে সোজা করতে করতে সে বলল, আপনি সীমানার উপর দিয়ে এসেছেন। ‘না তো’-- লুমি তার নিজের তাঁবুর দিকে বারবার তাকাচ্ছিল-- আর খুঁটির জন্য সবচেয়ে বড় কোন লাঠিটি চিহ্নিত করা যায় তা ভাবছিল। 

‘তুমি যদি, নিতান্ত নির্বোধ না হয়ে থাকো তবে এ ছোট খালটি নিজের নামে লিখে নিতে পারো। আমি এখানে পাঁচ একর জমি দখল নিয়েছি। এটাই সেই লাইন।’ 

এই বলে সে তার আঙুল শূন্যে উঁচিয়ে ধরল খালের দিকে। 

লুমি কিছুই বলল না। সে বুঝতে পারছিল না এদের মধ্যে ঠিক কে সীমানা উল্লঙ্ঘন করেছে। সে শুধু গভীর অরণ্যের ভেতর তার ভাইকে দেখতে পাচ্ছিলো। ‘আমি জ্যাক’-- সে তার পরিচয় দিয়ে বলল। কিন্তু লুমি নীরবে তাঁবুর জন্য লাকড়ি নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 

‘এটা কখনোই থাকার উপযোগী হবেনা। তুমি যদি গহীন জঙ্গলে অথবা যে কোন জায়গায় হারিয়ে যাও, যেখানে চারপাশে সুরক্ষার জন্য দেয়াল থাকবেনা, মাথার উপর থাকবে না ছাদ, আর তুমি সেখানে এরকম একটা অর্ধসমাপ্ত পশ্চাদ্দেশবিশিষ্ট জিনিস বানাও তাহলে আমার কথা এখন হয়তো উড়িয়ে দিচ্ছ দাও, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই তুমি তোমার মৃত্যুর জন্য বৃষ্টি আর ঝড় বাদলাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছ-- 

বলতে বলতে সে বুট দিয়ে তাঁবুর কাপড়টিকে টেনে প্রায় অর্ধেকটা নামিয়ে ফেলল। লুমি ছিল খুঁটির কাছে। সে বুঝতে পারছিল না পুরো বিষয়টাতে সে প্রচণ্ড রেগে যাবে নাকি তার সঙ্গে তামাশা চলছে। চূড়ান্ত হতভম্ব হয়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাষাই হারিয়ে ফেলছিল। গুছিয়ে কোন কথাই বলতে পারছিল না। ইতিমধ্যে প্রচুর পরিমাণে গাছের মরাডালও জোগার করে ফেলেছিল। সে ডালগুলোকে সজোরে আঘাত করছিল যাতে সেগুলো ছয় ফিট আকৃতির দাঁড়ায়। 

‘এটাই তোমার খুঁটি’-- সে বলতে থাকল, 

‘যেটা তোমার মাপের সঙ্গে মানানসই, অনায়াসে এটা তোমার মাথা ছাড়িয়ে হাতের ডানায় গড়াগড়ি খাবে। কিন্তু আমার নিজের জন্য এর চাইতে লম্বা কিছু দরকার অথচ এটা যা দাঁড়িয়েছে তা অতি জঘন্য।’ 

জঙ্গলে একটা মৃত গাছের গুঁড়ি ছিল যেটি বছর খানেক আগে টাই মাঝখান থেকে কেটে ফেলেছিল। জ্যাক সেই গাছের গুঁড়িতে তাঁবুর খুঁটির এক মাথা, আর অন্য মাথা মাটিতে স্থাপন করল। দুই হাতের যতখানি ধরে অতখানি পাজাঁকোলা করে তাঁবুর জন্য সে কাঠ নিয়ে এলো আর খুঁটির অন্য পাশে বসে সেগুলো চেছেঁ সরু করে তুলতে লাগলো। 

লুমি পাতার উপর বসে পড়ে তার কাজগুলো দেখতে লাগলো। ছেলেটি ছিল তার বাবার সমান উচ্চতার, কিন্তু আরও হালকা পাতলা। সে যখন তার হালকা শীত বস্ত্র খুলে হাতা গোটাচ্ছিল তখন তার মুখের চাইতে উজ্জ্বল উন্মুক্ত বাহু নজরে আসছিল। সে একটা পাতার ডাঁটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে জানতে চাইলো-- 

‘এই কাজে কি সারাটাদিনই লেগে যাবে?’ 

জ্যাক হাসল কিন্তু জবাব দিলনা। সে তাঁবুটিকে যথাযথভাবে দাঁড় করালো, ঝরা পাতা সরিয়ে স্তুপ করল, ছোট ছোট ডালগুলোকে জড়ো করে তার উপরে রেখে দিল। কিছু কিছু টুকরো টাকরা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বটে কিন্তু বেশির ভাগই গোছানো হয়ে গিয়েছিল। 

‘সব গুছিয়ে দিলাম. সহায়তকর্ম সম্পন্ন হলো’। 

লুমি উঠে দাঁড়ালো আর কিছু পাতাকে পা দিয়ে লাথি দিয়ে তাঁবুর দিকে ছুঁড়ে মারল। জ্যাক সেগুলো শান্তভাবে নিজের জ্যাকেট দিয়ে ঝাড়– দিয়ে আবার জড়ো করে খুঁটির ওপর রেখে দিল। সে আবারও লাথি মারল, এবার তার নিজের গায়ের উপরেই এসে পাতাগুলো ছড়িয়ে পড়ল। তার জ্যাকেটটা এত ছোট ছিল যে গা থেকে খুলে ঝেড়ে নিতে হলো শেষে। তারপর দুজন মিলে সব ভাঙাচোরা কাঠের টুকরো, ঝরা পাতাগুলো গুছিয়ে তুলল। এতকিছু করার পরও আশ্রয় স্থানটি যথেষ্ট সুদৃশ্য দেখাচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল ডালপালা পাতায় ঘেরা জরাজীর্ণ এক কুটির। 

বিশ গজ দূরে বসে থাকা আরেকজন ব্যক্তির কাছে বিষয়টা লুকানো ছিলনা। 

‘অন্ততপক্ষে দুই ফিট বাড়াতে হবে, এটাই সমাধান।’ 

সে একটা ম্যাপল পাতা দুই আঙুলের ভেতর পাকিয়ে নিতে নিতে বলল-- 

‘দারুণ হয়েছে, তুমিও এর ভেতর ঢুকতে পারবে। মাটির তাপ শুষে নিতে পারবে এটা ঠিকভাবেই। যতটা সম্ভব ঠেলা ধাক্কা দিয়ে, এটাকে সোজা করে ভেতরে ঢুকতে হবে, চাপ দিতে হবে আবার ধাক্কা দিতে হবে, আবার’-- 

বলতে বলতে হঠাৎ সে থেমে গেলো কারণ তখন তারা দুজন একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে । তার আপাদমস্তক ছিল বাদামি আর ধূসরাবৃত কিন্তু চোখ দুটো নীল অথচ বিবর্ণ। 

‘কেবল তারপরই তুমি এটার ভেতর ঘুমানোর কথা ভাবতে পারো।’ 

সে তাঁবুর ভেতর থেকে লুমির জ্যাকেটটি নিয়ে এর চেন আটকে দিল। ছোট একটা ব্যাগের মত করে এর ভেতর প্রচুর পাতা ভরে দিয়ে হাতা দুটো দিয়ে বেধেঁ একটা চমৎকার বালিশের মত বানিয়ে দিল। 

‘এখন থেকে এটা তোমার দরজার ছিটকিনি। মনে রেখো, দরজা সবসময় বাতাসের বিপরীত রাখতে হবে।’ 

সে পাতা আর খড়িলাকড়ি দিয়ে আরো দুটি স্তম্ভ তৈরি করল দরজার জন্য। হামাগুড়ি দিয়ে সে আগে পা রাখল। লুমি তার ঠোঁট কামড়ে ধরে দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে চাইলে তার শূন্য বাড়িতে ফিরে যেতে পারতো। নয়তো এই ক্ষুদ্র, জরাজীর্ণ গুহায় তাকে থাকতে হবে। সে মাটির উপর উবু হয়ে বসে পড়ে তাঁবুতে ঢুকলো। পাতাগুলো ভিতরে বিস্তৃতভাবে ভাবে ছড়িয়ে থাকলেও তাঁবুটিকে জ্যাক নামের ছেলেটি যথেষ্ট মজবুতভাবেই দাঁড় করাতে পেরেছিল। 

‘আলো কোনদিক থেকে আসবে? দরজার দিক থেকে? ‘নাহ’। জায়গাটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। শুষ্ক আর নরম একরাশ পাতার ভেতর সে যেন বাতাসে উড়ন্ত বুদবুদের মত নিজেকে হালকা অনুভব করছিল। মনে হলো চারপাশ জুড়ে এক ফিস ফিসে প্রতিধ্বনি গাছেদের পাতাদের, প্রকৃতির মর্মরধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে। 

‘পাতাগুলো চাপ দিয়ে সমান করুন’। 

সে নিজে একবার চাপ দিয়ে সমান করে এর উপরে আরো একটি স্তর বানাতে বলল। লুমি তাই করল। তার কাছে সে ব্যাখ্যা করছিল দরজাটা কিভাবে তাঁবুর সবচেয়ে দুর্বল দিক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা শোনার জন্য ধৈর্য রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য। সে তার জ্যাকেট দিয়ে বানানো বালিশটি দিয়ে দরজার মুখটি আটকে দিল। দিনের আলো দ্রুত নিভে আসছিল। ভেতরটা ছিল পুরোই অন্ধকার। সে তার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। সামান্য নড়াচড়াতেও শুকানো পাতাগুলো কর্কশ শব্দে ভেঙেচুড়ে যাচ্ছিল। হয়তো সে নিজেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অথবা এটা ছিল এক মৃত রাত। পৃথিবী থেকে সমস্ত আলো কেউ শুষে নিয়েছিল। 

‘তুমি এটাতে খুব সহজেই রাত্রিযাপন করতে পার, কোনরকম স্লিপিং ব্যাগ ছাড়াই এবং ফ্রেশ একটা ঘুম দিয়ে সকালে জেগে উঠবে।’ 

তার কণ্ঠস্বর তখন আর্দ্র শোনাচ্ছিল। লুমি অনড়ভাবে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে অনুভব করছিল যেন তার উপর যাবতীয় কুয়াশা শিশির বরফ ঝরে পড়ছে। সে যখন তাঁবুর দরজা একপাশ থেকে গুটিয়ে আনছিল ততক্ষণে জ্যাক চলে গেছে। আকাশটাকে দেখে মনে হচ্ছিল কে যেন এক টানে ঘন নীল তুলির আঁচড় দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। পরদিন সে আরো একটি তাঁবু বানিয়ে ফেলল প্রায় খাঁড়ির ঢালুতে। এটা বানাতে তার দ্বিগুণ তিনগুণ সময় লাগালেও চুপিচুপি কাজটা শেষ করে সে খুশি হয়ে উঠল। এটা একদমই তার আগের বানানোটার মতো দেখাচ্ছিল। সে ভিতরে গিয়ে শুয়ে থাকল। বিরক্ত হয়ে একসময় গাছের পাতাগুলো সজোরে আকাশের দিকে তাক করে ছুঁড়তে লাগল। দুটো উড়ন্ত কাকের গায়ে তা লেগেও গেল। 

অবশেষে জ্যাক এলো। কোনো কথা না বলে লুমির কাজ দেখতে লাগল। তার পরনে সেই একই বুট প্যান্ট শার্ট আর হালকা শীত বস্ত্র। 

‘মন্দ হয়নি। তবে আমি আরেকটু নিখুঁত ভাবে কাজটা করেছিলাম। আর এটা তো বৃষ্টিই আটকাতে পারবেনা।’ 

লুমি অবজ্ঞাভরে কাঁধ ঝাকালো। 

‘এটা তোমাকে মেরেও ফেলতে পারে। মানে বৃষ্টিতে ভেজা মানেই তো হাইপোথারমিয়া তাই না? তুমি কি আমার বানানো আরেকটা তাঁবু দেখতে চাও? বেশি না। আধা মাইল হবে।’ 

বলেই সে তাড়াতাড়ি হঁটতে শুরু করলো খাঁড়ির দিকে। লুমি তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রায় দৌঁড়াচ্ছিল। এভাবে যেতে যেতে লুমি সেই অরণ্যকে নজর করে দেখছিল যা তার চোখে এত দিন এত সুন্দর হয়ে ধরা দেয়নি। সেদিকে গাছের সংখ্যা কমই ছিল, বেশি ছিল ঝোপঝাড়, জট পাকানো ডালগুলো ছিল পাতাহীন। 

অবশেষে জ্যাক একটা কাঁটায় ভরা ঝোপের সামনে থামল। লুমি চেষ্টা করছিল তার অভিভূত ভাবটুকু লুকাতে। তাঁবুর দরজাটি ছিল হাতলঅলা যা আবার ডালপালা আর লতা দিয়ে দুই স্তরে বোনা। ভেতরে পাতা দিয়ে নরম তোষকের মত করে বানানো। মাথার কাছে একটা খালি সীমের কৌটা পড়ে আছে। 

‘তোমার বাড়ি নেই কোনো’ 

‘আছে’ 

সেখানে থাকো না কেন? 

সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকতে ঢুকতে জানালো ‘আমি প্র্যাকটিস করছি মানে চর্চা চালাচ্ছি।’ 

‘কিসের জন্য?’ 

সে থেমে তার দিকে তাকালো। 

‘আমি যদি জানতাম সেটা’--। 

রাতের খাবারের জন্য লুমি স্যান্ডউইচ বানালো। রান্নাঘর ছাড়া পুরো বাড়িটাতেই গাঢ় অন্ধকার ঢেকে ছিল। স্যান্ডউইচ হাতে সে আলো আর ছায়ার ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছিল। শুধু তার বাবার ঘরের বন্ধ দরোজাটি এড়িয়ে যাচ্ছিল। 

তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাবা ঘুম থেকে উঠে পড়ল। কারণ তার হাসপাতাল ফার্মেসিতে নাইট শিফটে ডিউটি ছিল। লুমি জানত যে-ডেস্ক চেয়ারটিতে বসে বাবা ঝিমাবে, চোখে ঘুম এসে চোখ ভারি করে রাখবে তবু তাকে জেগে থাকতে হবে। অরণ্যে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো এক অস্তিত্বকে সশরীরে থিতু করতে পারাটা কঠিন কাজ। তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও ছিল ধীর গতি সম্পন্ন। হাত ধোয়ার সময়েও মনে হতো সে কোন কষ্টকর ভারি কাজ করছে। গত রাতেও বাইরে যাবার আগে সে ঘরের ভেতর দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিল। লুমি তখন নিজেকে সেই দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আজ রাতে সুযোগ বুঝে লুমি বলেই ফেললো, 

‘আমি ক্যাম্পে যেতে যাই।’ 

তার বাবা চোয়াল জাবর কাটার মত নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘কিন্তু তোমার স্কুল আছে। আর আমারও কাজের ছুটি নেই।’ 

লুমি তখন অপ্রস্তুতভাবে নখ খুঁটছিল। যেন চলে যেতে পারলে বেঁচে যায়। তার বাবা বলছিল 

‘পরের সপ্তাহে, যখন আমার বন্ধ থাকবে। আমরা বেসমেন্টটা গোছানোরও সময় পাবো।... ক্যাম্পিংও হতে পারে। বিশুদ্ধ বাতাস... এরকম আরো কিছু, এই তো আর কি...’ 

সেও যেন আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। 

তারা আসলে কখনো এর আগে ক্যাম্পিংয়ে যায়নি। এই সব ফুল-ফল লতা-পাতা বিষয়ে খোঁজ রাখত তার মা। মা তাকে বলেছিল কীভাবে তার বাবার ফার্মাকোলজী বইয়ের ভিতর ফুল আর পাতা লুকিয়ে রেখে দিত। মা একটা কুমড়ো গাছ লাগিয়েছিল উঠোনে, যেটি লতায়-পাতায় সুশোভিত হয়ে ফলও ধরতে শুরু করেছিল। মা যেদিন মারা যায় তখন সে স্কুলে। টাই তাকে খুঁজতে আসে। বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির বারান্দার কাছে এ্যাম্বুলেন্সে একটা স্ট্রেচার তুলতে দেখেছিল শুধু সে। বাবা একবার বলেছিল, সে নিজেও শুনেছিল। একবারই, মৃত্যুর কথাটি। এ ধরনের শব্দ কান পর্যন্ত গিয়ে ভীতি জাগায় কিন্তু মগজে কোনো অর্থ সৃষ্টি করতে পারে না। 

সে রাতে কোনো কিছুতে ভয় পেয়ে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে তার মাকে চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই তার সম্বিৎ ফিরে এলেও তার চিৎকার থামছিল না। বাবা আর ভাই মিলে তাকে সামাল দিচ্ছিল। পরপর কয়েক রাতে একই কাণ্ড ঘটতে থাকায় টাই বিরক্ত হয়ে লুমির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কারণ তার এই অবস্থায় বাবা দ্বিগুণ শোকের ভেতর নিপতিত হয়েছিল। তাদের চারপাশ যেন নিঃসীম এক শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। কেউ ঘুমাতে পারতো না, টাই আর বাবা পালা করে রাতে ঘুমাতো, ঘুমের ঔষুধ খেয়ে। লুমিও চাইত। কিন্তু ছোট বলে তাকে দেয়া হত না। তার বাবা যখন নাইট শিফটে কাজে যেত। লুমি তখন অরণ্যে রাত কাটাতে শুরু করল। সে রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠল দ্রুত তাঁবু বানাতে। বড়জোর দু এক ঘণ্টার ভেতর। শীতের মধ্যে পরপর কয়েকটি রাত কাটানোর পর সে তাঁবুর ভিতর বাতাস ঢোকা বন্ধ করা শিখে গেল। পুরোপুরি বুঝে না উঠলেও নির্মাণ বিষয়ের প্রতিটি ধাপ সে যেন অত্যাধিক উৎসাহে গিলে চলছিল। সে তার নিজের হাতে বানানো তাঁবুতে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। হালকা বাতাস কিংবা কোন পশুপাখির শুকনো পাতার উপর চলার আওয়াজ শোনা যেত রাতের নিস্তব্ধতায়। খুব ভোরে ঘুঘু পাখি মিষ্টি সুরে ডেকে উঠত। সেই সুরের খেলা পুরো মন জুড়ে জড়িতে থাকত, যখন রাত নামত, সেই অন্ধকারে ঠাণ্ডা কিভাবে মিশে যেতো ধীরে ধীরে-- তার প্রতিটি পল অনুভব করত। আর সেই অশেষ অন্ধকার রাত্রি ধীরে ধীরে একসময় ফিকেও হতে শুরু করত। 

জ্যাক ফিরে এল। লুমি যেন সমস্ত কিছু নিয়ে এই অপেক্ষাতেই ছিল। জ্যাক তাকে জঙ্গলে খুঁজে পেল, আর এসেই আগুন জ্বালাতে শেখাতে লেগে গেল। প্রথম দিকে যদিও লুমির নরম হাতে আগুনের ফুলকি এসে তাপ লাগছিল কিন্তু খুব দ্রুতই সে টুকরো কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাতে শিখে গেল। 

‘আরে তুমিতো টগবগ করে ফুটছ দেখি’। লুমির মাথার দিকে আঙুল উচিঁয়ে দেখাল সে। সেদিকে তাকিয়ে লুমি কুয়াশা ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। 

‘তোমার মাথা এখন ফুটন্ত কেটলি। এখন এটাকে আপাতত বন্ধ রাখো। নইলে কাঠ গরম হবার আগেই মাথায় আগুন ধরে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।’ 

লুমি স্মিতহাস্য ধরে রেখেই ভ্রুকুটি করল। 

জ্যাক আসলে অন্যসব ছেলেদের চেয়ে একদমই অন্যরকম ছিল। এই বয়সের অন্য ছেলেরা সবসময়ের মানুষের উপর জবরদস্তি খাটাত আর অশ্লীল কথায় মেতে উঠত। তাদের পোশাক আশাক, আচরণ কোন কিছুতেই কোন ভিন্নতা ছিল না। 

গ্যারী নামে তার এক বন্ধু ছিল সে সবসময় কলার উঁচু শার্ট আর সানগ্লাস পরত। একেকটা বিকেল কেটে যেত তাদের উঠানের পাইন গাছে কে কত দূর থেকে তাক করতে পারে জিনিশ ছুঁড়ে মারায়। গ্যারির বোন তাদের জুতো, মাথার ব্যান্ডসহ টুকিটাকি জিনিসগুলোর দায়িত্বে থাকত। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর যেন সব বদলে গেল। তাদের বাসায় ডিনারে বসলে তার মা আমাকে জিজ্ঞেস করত, ‘বাড়িতে ডিনার করে আসোনি? তোমাদের ডাইনিং টেবিলে কটা চেয়ার?’ 

লুমি তার বাবা না ফেরা পর্যন্ত সকালে ঘুমিয়ে থাকত। স্কুল থাকলে গোসল করে নিত। না থাকলে বাবার জন্য অপেক্ষা করত। 

সে আগুন জ্বালালো। মাটিতে পাথর জড়ো করে সেগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করল। ঘাস তুলে সেগুলোর গোড়ার ছোট ছোট শেকড়গুলো খেয়ে নিল। এমনকি সে একটা রুগ্ন ফড়িংও ধরে ফেলল যা ছিল শরতের শেষ চিহ্ন। সে এটার শুঁড়, পাখনা, ঠ্যাং সবকিছু ছিঁড়ে-ভেঙে পাথরের উপর আগুন জ্বালিয়ে ঝলসে নিল। সে ভাবছিল জ্যাকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা। তীব্র ভৎর্সনা আর তিরস্কারের ভেতর দিয়ে তাদের পরিচয়ের সূচনা মুহূর্তটি ভাবতে ভাবতে অস্ফুট আওয়াজ করে উঠল সে, যখন সে একটা ফাঁদ পেতে ধরা পাখি ¯œ্যাকসের জন্য ঝলসে নিচ্ছিল। 

ভোর থেকেই সে তার তাঁবু গুটিয়ে চুল বাঁধার ব্যান্ডেনা দিয়ে পাতার এবং ঘাসে লেগে থাকা শিশির পরিষ্কার করতে লেগে যেত। তাঁবু চিপে ময়লা পানি বের করে বোতলে ভরার কাজটি ছিল সময় সাপেক্ষ এবং ক্লান্তিকর। আগুন জ্বালানোর জন্য সে এভাবে ভেজা অথবা শুকনো, শক্ত অথবা নরম যে কোন ধরনের কাঠ ব্যবহার করতে পারত। চর্চা-- কেবল চর্চার মাধ্যমেই এখন সে যে কোনভাবে আগুন জ্বালাতে পারে। 

‘তাঁবু, আগুন, পানি, খাবার তোমার প্রয়োজনের তালিকাটি সব সময় এই ক্রমানুসারে সাজাবে। তুমি তিন দিন পর্যন্ত পানি ছাড়া আর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত খাবার ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু মাত্র তিনটি ঘন্টাও আগুনের তাপ ছাড়া বাঁচতে পারবে না।’ 

এর মধ্যে টাই চার দিনের থ্যাংকস গিভিংয়ের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। লুমি ঘরে এসে দেখল সে স্প্যাগেটি বানাচ্ছে আর এমনভাবে রান্নাঘর সামলাচ্ছে যেন সে এই বাড়ি ছেড়ে কখনো যায়নি। তার চওড়া কাঁধ আর বিশাল মাথা এক হাঁড়ি সসের পিছনে দেখা যাচ্ছিল। 

‘আর, এযে দেখি বাদাম।’- 

মুখ ভর্তি করে নিয়ে লুমির নাক টিপে দিতে দিতে সে বলল। স্প্যাগাটির পর চকলেট সিরাপ দিয়ে মিল্কশেক বানালো তারা। এমনভাবে টাইকে খাওয়ানো হচ্ছিল যেন সে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। খাওয়া দাওয়া সেরে টাই চললো বাজারের উদ্দেশ্যে। 

পরদিন লুমি টাইকে তার সবচেয়ে ভালো তাঁবুটি দেখাতে নিয়ে গেলো। সে বিস্মিত হয়ে চমক খেলো যেন- ‘আরে এটাতো দেখি দাঁড়িয়ে আছে।’ 

‘শুধু দাঁড়িয়ে আছে? তুমি যদি এটার ভিতর শুয়ে দেখতে।’ 

তার কথা প্রমাণ করতেই যেন সে এটার ভিতর মাথা ঢোকালো। তারা প্রচুর পরিমান পাইন ফল জোগার করেছিল আর এগুলোর ভেতরে থাকা বাদাম বের করতে করতে টাই বলল, স্টোরে যে বাদামগুলো পাওয়া যায় সেগুলো একদমই ছোট ছোট। 

সসম্মানে লুমি মাথা নুইয়ে জানালো এর পেছনে কতটা শ্রম আর সময় ব্যয় হয়েছিল। 

‘তা অবশ্য ঠিক।’ 

থ্যাংকস গিভিং ডেতে টাই লুমিকে সহযোগী শেফ হিসেবে মনোনয়ন দিল। লুমি তার সেরা কাজ দেখিয়ে দিল খোসাসহ ভুট্টার পদ, হানি গ্লেজড হাঁসের রোস্ট, সেদ্ধ আলু ইত্যাদি পরিবেশনে। 

খেতে খেতে টাই বলল ‘সব কিছুর ভেতরেও কিছু যেন মিসিং।’ 

সে (লুমি) কাঁধ ঝাকাঁলো। তাদের মা পিঁয়াজের একটা সস বানিয়ে দিত যা লুমি বানিয়ে উঠতে পারেনি। তবুও আনন্দধ্বনির ভেতর দিয়ে গ্লাসগুলো ক্র্যান আপেল জুসে ভরে উঠল। তাদের বাবা রান্না-বান্না নিয়ে মজার মজার মন্তব্য করে যাচ্ছিল। হাঁসের রান দেখিয়ে বললেন, 

‘দেখো এটার রঙ দেখো।’ 

টাই রাগ দেখিয়ে প্লেট থেকে রানটা তুলে ফেলে দিল। 

‘গাজরে চিনি ছিল।’ 

বাবাকে চামচ দিয়ে খাবার তুলে দিতে গিয়ে ভ্রু সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছিল লুমির। ডেজার্টে তার পছন্দের ডিশ ছিল। ঠান্ডা ক্রিম আর মাখনে ভরা পাইপিঠা। ডেজার্ট মানেই তাদের ডিনার তখন শেষ পর্যায়ে ছিল। লুমি যতটা সম্ভব ধীরে দুই টুকরো পাই খেলো। 

শোবার সময় লুমি শুনল, টাই চিৎকার করে বলছে, 

‘তোমরা কি জানো আমার গার্লফ্রেন্ড আছে, সে আমাকে তার বাসায় থ্যাংকস গিভিংয়ের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে।’ 

লুমি শুয়ে শুয়ে বাবা-ভাইয়ের কথা শুনছিল। টাই দেখতে বেঁটে আর গাট্টাগোট্টা। সিঁড়িতে একধাপ উপর দাঁড়িয়ে সে বাবার চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল। বাবা কিছু বলছিলেন, আবার নিরুত্তর থাকছিলেন। সামনের দিকে দরোজাটা তখনো খোলা। বাবার ধীর পদবিক্ষেপ সিঁড়িতে শোনা যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করেও তা টের পাওয়া যাচ্ছিল। সব শব্দেরা লুমির চারপাশ জুড়ে ফিসফিস করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। জঙ্গল থেকে এক অতৃপ্ত আত্মা যেন ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে ঘুরতে তাকে এমনভাবে ভেদ করে যাচ্ছিল যেন সে মূর্তিবৎ স্থানু কিংবা চিত্রপট। পায়ের আওয়াজ বারবার ফিরে আসছিল। যেন পুরোনো বোতল মাড়িয়ে যাওয়ার মচমচ শব্দ শোনা গেল। জেগে থাকাটা কষ্টকর ছিল। সে ঘরের ভেতরকার উষ্ণতার জন্য কিছু করে উঠতে পারেনি। তোষক আর কম্বলের ভেতর সে স্যান্ডউইচের মতো চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে ছিল। কিন্তু পাশ ফিরতেই সবকিছু নড়েচড়ে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। সে উঠে পড়ল। টাইয়ের কাছে যেতেই তার শক্ত চোয়াল দেখে কারণ জানতে চাইলে উল্টো তাকেই সে বলে বসল, 

‘তোর উচিত না ঐ লোকটার সঙ্গে বাইরে এতটা সময় কাটানো।’ 

সে বসল। বলল, ‘কেউ কোনো ক্ষতি তো করছেনা।’ 

‘আমি জানি’ 

‘তোমার কথার ভঙ্গিতে তা মনে হয়নি।’ 

তার শোবার ঘরের জানালাগুলো অরণ্যের দিকে মুখ করা, কিন্তু শার্সিগুলো নামানো এজন্য শুধু তার দিক থেকেই অরণ্যের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। আকস্মিক দমকা বাতাসে গাছের মাথাগুলো নুয়ে পড়ছিল। একসঙ্গে অনেক ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো ছিল সেই ঝড়ো বাতাসের শব্দ। 

টাই তার গায়ের সুজনীটা ঠিক করে দিয়ে পায়ের কাছে বসল। 

‘আমি তার সম্পর্কে চারপাশে খোঁজ খবর করেছি। সে অনেক কিছু জানে। সে স্টেট পার্কের একজন প্রকৃতিবিদ হিসেবে কাজ করে, তাছাড়া ফিল্ড ট্রিপগুলোতে সে নেতৃত্ব দিতো। পশু-পাখি বৃক্ষরাজির সংরক্ষণার্থে সে প্যামফ্লেট লেখে। কিন্তু তবুও তুমি সাবধানে থেকো। অনেক কিছুই ঘটানোর ক্ষমতা সে রাখে।’ 

‘যেমন-’ 

‘আমি ঠিক জানিনা, তবে তার তো স্ত্রী ছিল, মারা গেছে।’ 

লুমি চেষ্টা করছিল কম্বলে মুখটা ঢেকে ফেলতে কিন্তু ওটা যেভাবে ছিল তার চেয়ে একচুলও নড়ানো গেলনা। 

‘সে এখানে আমাদের জমি কিনে নিতে এসেছে। অথচ তার কোনো বাড়ি কেউ দেখেনি কখনো।’ তারপর এক মেঘাচ্ছন্ন সকালে, সূর্যের আলো চোখে নিয়ে লুমি ঘুমিয়ে পড়ল। ভুলে গেল তাঁবুর ছাদে পড়ে থাকা পাতার জঙ্গল পরিষ্কারের কথা। 

‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ 

তার বাবা বাথরুমের দরোজায় দাঁড়িয়ে এমনভাবে কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকিয়েছিল যেন ঘোলাটে কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখছে তাকে। 

‘আমি ক্যাম্পে যাচ্ছি’- সে বলল। 

‘তোমাকে তাঁবুতে পেয়েছে।’ 

লুমি ঘাড় নাড়ালো। 

‘লন্ঠনের প্রয়োজন থাকলে লন্ঠন নিয়ে যাও। এটার হাতলটা ঠিক করা হয়েছে।’ 

যদিও সে তখন খুব একটা আপত্তি করলনা। কিন্তু লুমি বুঝতে পারছিল কি নিয়ে আলাপটা চলছে। বাবা একটা ইলেকট্রিক ল্যাম্প নিয়ে এসেছিল মার জন্য। কারণ মা গরমের সময় বাইরে উঠোনে বসতে পছন্দ করত। বাবাও বাইরের কাজ শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরে তাদের সঙ্গে যোগ দিত। লুমি যেন দেখতে পাচ্ছিল মা ফোল্ডিং চেয়ারে পা ভাঁজ করে বসে আছে। বাবা আপেলে কামড় দিচ্ছে। 

সেই বিকেলে বাড়ির নিচের বেসমেন্ট থেকে লন্ঠনটা তারা খুঁজে বের করল। সঙ্গে একটা তাঁবুও। 

তারা একটা বাক্সে মায়ের ব্যবহৃত বাগান পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতিগুলো ঠেসে ভরল। লুমি তাঁবু আর লন্ঠন থেকে ধুলাবালি ঝেড়ে জঙ্গলে নিয়ে গেল। একটা তাঁবুর ভেতর সব কিছু গুছিয়ে রাখতে সে ভেতরে ঢুকল। তাঁবুটার মেঝে ছিল স্য্যাঁৎসেঁতে ভেজা, সাদা সাদা পেঁজা তুলায় ভরে যাচ্ছিল চারপাশ। এটা ছিল বছরের প্রথম বরফ। টাই আবারো এক সপ্তার জন্য বাড়িতে এসেছে। 

‘আমাকে এবার বরফ গুহা বানানো শিখিয়ে দাও।’-- 

‘এই পরিমান বরফ যথেষ্ট নয় শেখানোর জন্য।’ 

শেষ বিকেলে তারা দুজন আগুনের পাশে গুটিশুটি হয়ে বসেছিল। লুমি কাঠি দিয়ে আগুন খোঁচাচ্ছিল তবু এটা খুব বেশি জ্বলে উঠছিলনা। 

‘তোমাকে আমার দুটো কথা বলার আছে। প্রথমত, মেরি ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা।’ 

সে তার পিঠের ঝোলানো ব্যাগ থেকে বেগুনী রঙয়ের কিছু বের করে তার দিকে ছুঁড়ে মারল। লুমি প্যাকেটটা খুলে দেখল এটা একটি রেইনকোট। আশ্চর্যজনকভাবে এটা তার গায়ে পুরোপুরি ফিটও করল। গলার লম্বা কলার পর্যন্ত দেয়া চেইনটা সে লাগাল, হুড তুলে দিল। কেবল তার মুখাবয়বটুকু উদ্ভাসিত হয়ে বের হয়ে ছিল। 

‘তোমাকে তো একটা নভোচারী কার্টুন বাচ্চার মত দেখাচ্ছে।’ 

‘আরেকটা কথা কি?’ 

‘আমি চলে যাচ্ছি।’ 

সে চমকে উঠে বলল, ‘মানে কি?’ 

‘আমি যাচ্ছি।’ 

‘কোথায়?’ 

‘যে কোনো কোথাও।’ 

‘কখন এটা জানা যাবে?’ 

‘যখন আমি কোথাও স্থির হতে পারব।’ 

লুমি তার মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ তখন নিস্প্রভ, মলিন বেদনার্ত নীল রঙে ছেয়ে আছে। কোথায় হারালো রহস্যময় সেই রঙ যা মন জুড়ে ছেয়ে থাকত। সে তার হুড আরো মজবুতভাবে আটকালো। হাত দুটো কোটের পকেটে রেখে নিজেকে তাঁবুর গুহায় ঢুকিয়ে দিল। সে জানত জ্যাক জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। একটা পয়সাও সে খরচ করতনা। জঙ্গল বা পাহাড় যে কোন জায়গায় সে থেকে যেতে পারত। কারণ তার না কোন নির্দিষ্ট আবাসন ছিল, না পিছুটান। কিন্তু কোথায় ছিল সে? সেতো একদম উধাও হয়ে গিয়েছিল। পুরোপুরি গায়েব। 

কিছুক্ষণ পর সে শান্তভাবে উঠে দাঁড়ালো। জ্যাক লুমির দিকে এক চিলতে বিষন্ন হাসি নিয়ে তাকালো। আর জানালো যে একটা বরফগুহা সাধারণত আশ্রয় কেন্দ্র থেকে খুব বেশি আলাদা কিছু না। 

‘তুমি কি দেখতে চাও সেরকম একটি ঘর কেমন হতে পারে?’ 

‘তোমার ঘরতো, অবশ্যই দেখব।’ 

‘হ্যাঁ। ঠিক আছে চলো।’ 

লুমি তাকে অনুসরণ করল। তারা খালের ধার দিয়ে অবসন্ন ভাবে হেঁটে যাচ্ছিল। জ্যাকের গোপন আস্তানায় পৌঁছে তারা চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে এলো। 

‘দেখো মাটিতে কি চমৎকার প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ত হয়ে আছে। আমাদের পরিশ্রম বেঁচে গেল। লাঠি দিয়ে একটা নিচু জায়গা দেখিয়ে দিলো সে। আর বলল ‘এটা আরো গভীর করে খুঁড়তে হবে।’ 

তারা আবার তাঁবুতে ফিরে গেল গর্ত পরিষ্কার করা আর বিভিন্ন ধরনের খড়ি, লাকড়ি পাথর জোগাড় করতে। লুমি একটা ছোট পাথর দিয়ে ঘষা মাজা করে যাবতীয় কাঁটা আর অমসৃণতাকে পরিচ্ছন্ন করে তুলছিল। জ্যাকের পাথরটি অবশ্য তার মতই বিশালাকৃতির ছিল যা সে এক হাতে নিয়েই কাজ করছিল। 

যখন তাদের কাজ শেষ হলো, জ্যাক হেসে বলে উঠল, 

‘যাক এটা খুব বেশি সময় নেয়নি। ভালো যে খনন কাজের জন্য তুমি যথেষ্টই ছোটখাটো।’ 

ফলাফল দাঁড়াল মাটিতে পাঁচ ফুট লম্বা গর্ত হল, জ্যাকের সমান্তরালে শুয়ে নিতে তার মনে হচ্ছিল সে যেন ফয়েল প্যাকেটের ভেতর কোনো মোড়ানো ট্যাবলেট। 

‘এখন ছাদ ধরতে হবে।’ 

পাঁজা করা লাকড়ি ও খড়ি ছাদের উপর সাজালো। প্রচুর পাতা আর পাইনের কাঁটা ছড়িয়ে দেয়া হলো। তারা একটা হ্যাশবোল্ট দেয়া দরোজা বানালো। 

‘তুমি যাচ্ছ কখন?’ 

‘সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু।’ 

রাত নেমে এলে তারা তাঁবুর পাশে আগুন জ্বালালো। খাবারের জন্য এক কৌটো মাংস বের করে রান্না করল। লুমি ফিরে গেলো না। আর জ্যাকও কিছু জানতে চাইলোনা। তারা যখন খাচ্ছিল তখন বরফ বড় আকারে পড়তে শুরু করেছে। লুমি মাঝে মাঝে তার মুখ হাঁ করে ধরছিল বরফের দিকে। কারণ মাংসগুলো প্রচুর ঝাল আর গরম ছিল। বনের ভেতরের গাছপালা ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে উঠছিল। 

‘ঠাণ্ডা লাগছে তোমার?’ 

‘জ্যাকেটটা চমৎকার।’ 

কিছু পরে লুমি নিজেকে তাঁবুর ভেতর গলিয়ে দিল। দরোজাটা ভেজিয়ে রাখল আর অর্ধনিমীলিত চোখে দরোজার ফাঁকে তাকিয়ে রইল। যেন তার চোখ কেবলি পর্যবেক্ষণ করছিল ক্যারেন গাছগুলো কিভাবে বরফে হিমে ছেয়ে যাচ্ছে। একটি গাছতো পাতা পর্যন্ত দেখতে না দেখতে বরফে ভরে গেল। সে তার মাথা উঁচিয়ে জ্যাককে দেখবার চেষ্টা করছিল। জ্যাক হাঁটু গেড়ে বসে জিনিসপত্রের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করছিল। তবে নিজের যাত্রার জন্য না। যাত্রার জন্য তার কখনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হতো না। যেহেতু সে কোথাও সুনির্দিষ্ট ভাবে বসবাস করত না। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করলে লুমি দরজাটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। জ্যাক তখনো বাইরে। তার নড়াচড়ার মৃদু খসখসে আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর হ্যাচ ডোর খুলে সে ভেতরে ঢুকল, লুমি জানতে চাইলো ‘তুমি কি একটুও স্থির থাকতে পারো না?’ সে তখন খুব কাছে একদম পাশাপাশি এসে শুয়ে পড়েছে। তার শরীরের উষ্ণতা যেন মাটির ভাপের সঙ্গে মিলেমিশে নাকে ঠেকছিল। সে তার মার কথা ভাবছিল। একটা ছারপোকা তার ঘাড় বেয়ে উঠছিল, অথবা এটা ছিল নেহাৎই এক শিহরণ, কারণে বা অকারণে। রাত বয়ে চলছিল, দীর্ঘ শীত, গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সে ঘুমাতে পারছিল না। মৃতের মতো নিথর হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল শুধু। 

‘কখন তুমি যাচ্ছ?’ সে আবার জিজ্ঞেস করল। 

‘তোমার ঘুম ভাঙার আগেই।’ 

‘তোমার ঠাণ্ডা লাগছে নাতো, গরম হতে পেরেছ?’- 

অনেক দূর থেকে মনে হলেও জীবন্ত স্বরটি ভেসে এলো। 

‘আমি জানতে চাইছিলাম তুমি কি উষ্ণতা পাচ্ছ? 

‘না’ সে সোজাসুজিভাবে বলে উঠল, কারণ একদিক থেকে কথাটা সত্যি ছিল। 

সে ভাবল জ্যাক ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশেষে জ্যাক বলে উঠল, 

‘আসো কম্বলের ভিতরে আসো।’ 

এত পরিষ্কারভাবে কথাটা বলল যে এটা না শোনার ভান করা সম্ভব ছিল না। 

যখন সে তার ডাকে সাড়া দিয়ে কাছাকাছি হল তখনো এক হাত শক্ত করে ঘাস পাতাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। আরেক হাত জ্যাকের উপর। ঘাসের বিছানাটি কেবল জ্যাকের অনুপাতে শোবার জায়গা ছিল। কিন্তু সে কাত হয়ে সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে আড়াল করে দিল। লুমি মাঝখানে ন্যূনতম জায়গা রেখে শুয়ে ছিল। যেভাবেই হোক জ্যাক আগুনের চাইতেও বেশি তপ্ত আরো বন্য নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছিল। 

সেই সব ঘ্রাণ, উষ্ণতা আর বনের ভেতর থেকে আসা পচে ওঠা পাতার বন্য মিষ্টি গন্ধ লুমিকে ঘুমের ভেতর ডুবিয়ে দিল। কিছুতেই সে এই আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া থেকে ভেসে উঠতে পারল না। আরো পরে, রাতের গভীরে, পুনরাবৃত্তির কালে লুমির কেবল মনে হচ্ছিল তাকে জাগিয়ে দেবার জন্যই যেন বার বার জ্যাক জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছিল-- 

‘এখনো ঠাণ্ডা লাগছে তোমার?’ ‘ঘুম পাচ্ছে?’ ‘এখন আরাম লাগছে, উষ্ণবোধ করছ? 

যখন সে জাগল, জ্যাক চলে গিয়েছিল। সে নিজের হাত দিয়েই নিজেকে জাপটে ধরেছিল নিজেকে মানে পরনের সেই জ্যাকেটটিকেই। জেগে উঠতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এমন নয় যে ঘটনাটি খুব বিশেষ কিছু। সেতো জানতোই চলে যাওয়া মানুষটিকে ফেরানোর মত ক্ষমতা তার ছিল না। তাঁবুর বাইরে, বরফের পুরু স্তর ঢেকে ফেলেছিল সমস্ত অরণ্যকে। গাছের প্রতিটি শাখা প্রশাখা এমনকি প্রতিটি পাতা পর্যন্ত। তার মন চাইছিল অরণ্যের ভেতর গিয়ে জ্যাককে ডাকতে। সে যেন অরণ্যের খুব কাছেই অবস্থান করছিল। সে ভয় পাচ্ছিল। ঠাণ্ডায় তার ভেঙে যাওয়া গলার আওয়াজে শীতনিদ্রায় থাকা পাখিগুলো জেগে উঠবে। 

অথচ তার ডাক আর ডাকের প্রত্যুত্তর ঘুঘু পাখির মতো বেজে চলছিল- 

‘কোথায়? কোথায়? কোথায়?’ 

পুরো সকালটা সে বিষন্নচিত্তে বরফ দেখে কাটালো, অজানা-অচেনা বিভিন্ন পথে হেঁটে বেড়ালো, কিন্তু দিনশেষে নিজের সঙ্গে নিজেকেই দেখতে পেল শুধু। সে তাঁবুর কাছে ফিরে এসে জ্যাকের ঘাস বিছানাতেই শুয়ে পড়ল হাত পা ছড়িয়ে। সে হয়তো আসতেও পারে। সে হয়তো হঠাৎই দরোজাটা খুলে ঢুকবে আর তার মাথায় টৌকা মেরে কৃত্রিম র্ভৎসনা করবে তার এই আলসেমি দেখে। 

সে ওখানেই থেকে গেল। কেবল সামান্য খাদ্য আর আগুন জ্বালবার প্রয়োজনে সে বের হতো। কারো সঙ্গে কথা বলতনা। এমনকি নিজের সঙ্গেও না। দ্বিতীয় রাত্রে গভীর অন্ধকারের ভেতর সে একটা ডাক শুনতে পেল। একটা শব্দ, তার নাম। জ্যাক! সে ফিরে এসেছে, শুধু তার জন্য? তাঁবুতে শুয়ে ছিল সে হেলান দিয়ে। বিস্মিত লুমি ফিসফিস করে ভেতর থেকেই সম্ভাষণ জানালো। একবার না বারবার। একরাশ আনন্দ নিয়ে। যদিও এতে তার গলা ব্যথাটা উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছিল। যেন সীল মাছের চোখা মুখ এসে গলায় ঠোকর দিচ্ছিল। 

পুরুষ কণ্ঠটি আবার ডেকে উঠল। এতো টাই! সে ভুলেই গিয়েছিল ভাই তখন বাড়িতে। গলার আওয়াজ ঠাণ্ডায় বসে যাওয়া। এরপর শুধু শূন্যতা। কোথাও কেউ নেই। কিছু নেই। 

অনেকক্ষণ পর সে কিছু একটা শব্দ পেল। যেন একখণ্ড পাথর রাস্তায় গড়িয়ে যাচ্ছে। কোন এক আরণ্যক আত্মা, তার নিজ দেহের দাবি করতে এসেছে। আর লুমি যেন প্রস্তুত তা দিতে। তার নরম বাহু তার গলা চেপে ধরুক, হালকাভাবে তার শরীর তুলে ধরুক। তাকে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরুক যে কোনো ভাবে। যে -কোনো কিছুর জন্য, সবশেষে খুব ছোট আর চেরীর বীজের মতো শক্ত কিছু তাকে বিদ্ধ করুক। 

লুমি ! ভাঙ্গা-ভাঙ্গা আওয়াজ আসছিল অনেক দূর থেকে। যেন টাই তাকে বহুদুর থেকে খুঁজতে খুঁজতে আসছিল। গভীর অরণ্যের ভেতর তার দিশেহারা অবস্থা। অথচ যে উষ্ণতা লুমির ভেতর প্রবাহিত হল এই ডাকের সঙ্গে তা অভাবনীয় আর বেদনাদায়কও বটে। সে দরোজা খুলে লাফিয়ে বের হল। সে সোজা বাড়ির দিকে ছুটছিল। যদিও পথ ছিল পিচ্ছিল বরফে ছাওয়া। সে শুধু পেছন দিক থেকে টাইয়ের ঝুঁকে থাকা শরীরটা দেখতে পাচ্ছিল, যা ঘন কুয়াশার ভেতর দুটো আসপেন গাছের মাঝে দায়ী অভিযুক্তের মতন স্থির হয়ে ছিল। সে সামনের দিকে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেল। ‘তুমি’- টাই তার মুখটা দু হাতে চেপে ধরল। 

‘তুমি আর কতদিন আছ?’ 

‘পুরো সপ্তা।’- বলতে গিয়ে সে সামান্য হাসির চেষ্টা করল। যাকে কোনোমতেই হাসি বলা যায় না। কোনোভাবেই না। লুমি তার হাঁটু দিয়ে তাকে জোরে ঠেলা দিল। কিন্তু তার আগেই টাই তাকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছিল। 

‘আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে?’ সে জিজ্ঞাসা করল। আকস্মিক এক দমকা বাতাস তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেল; লুমি তার কোটের বোতামগুলো বুকের কাছে আঁকড়ে ধরল। 

‘ঈশ্বর, এতো ভয়ানক ঠাণ্ডা, তুমি আছ কোথায়?’ 

‘ক্যাম্পিংয়ে’ 

‘এই আবহাওয়ায় ক্যাম্পিং? কীভাবে সম্ভব? আমি ভেবেছিলাম বাবা বোধহয় প্রলাপ বকছে।’ 

‘আমি জানি কীভাবে গরম হতে হয়।’ ‘কিন্তু আমি তো কোথাও তাঁবু দেখতে পাচ্ছি না। সব জায়গায় খুঁজেছি।’ 

‘আমার কোনো তাঁবু নেই।’ 

সে তার মুখটা ঠাণ্ডা, প্লাস্টিক কোটের ভিতর গলিয়ে দিতে দিতে জানালো। 

‘তাঁবু নেই?’ সে লুমিকে ঠেলা দিল কথাটা বোঝার জন্য। বাতাসে লুমির হুড খুলে গিয়ে গাল আর কান ঠাণ্ডায় ব্যথা করছিল। সে আবার হুড দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলার চেষ্টা করলে টাইয়ের ধাক্কায় তা আবার খুলে পড়ল। টাই তাকে ক্রমাগত ঠেলা দিতে থাকলে সে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। বিস্মিত টাই আরো হতভম্ব হয়ে গেল। যখন দেখল লুমি কাঁদছে। তার হাতে গলিত উষ্ণ বরফকণা ঝরে পড়ছে। 

‘আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও।’ 

ঊর্ধ্বমুখী টাইয়ের মুখ দেখতে পেলোনা লুমি। 

কিন্তু, তাদের দিকে সমস্ত অরণ্য আর অরণ্যের শক্ত কঠিন অথচ ভঙ্গুর গাছগুলো নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।


অনুবাদক
রোখসানা চৌধুরী
প্রবন্ধকার। অনুবাদক।
অধ্যাপক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ