(উরুগুয়ের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ক্রিস্তিনা পেরি রোসসি ষাট দশক-উত্তর লাতিন আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। এ পর্যন্ত তার ৩৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাস ছাড়াও তিনি গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতাও লেখেন। ১৯৪১ সালে জন্ম। ১৯৭২ সালে তিনি উরুগুয়ে থেকে পালিয়ে স্পেনে চলে যান।)
----------------------------------------------------------
প্রায়ই ওরা আসে। বড় বড় শহরের রাস্তা দিয়ে স্থান কালকে স্থগিত করে রেখে ওরা নারী পুরুষ ভেসে বেড়ায়। ওদের পায়ের তলায় শিকড়ের অভাব। এমনকী মাঝে মাঝে ওদের পাও থাকে না।
ওদের চুল থেকে শিকড় গজায় না, কিংবা মাটির সাথে কোন কর্ণিক দিয়েও ওদের বেঁধে রাখে না কেউ। সামনের দিকে ভেসে যাওয়া সামুদ্রিক শ্যাওলার মত ওরা। যদিই কখনও পরিধির কোথাও থেকে যায় তারা সেও ক্ষণিক , সামান্য ক’মুহূর্তের জন্য থেমে থাকা সেসব।
ওদের চুল থেকে শিকড় গজায় না, কিংবা মাটির সাথে কোন কর্ণিক দিয়েও ওদের বেঁধে রাখে না কেউ। সামনের দিকে ভেসে যাওয়া সামুদ্রিক শ্যাওলার মত ওরা। যদিই কখনও পরিধির কোথাও থেকে যায় তারা সেও ক্ষণিক , সামান্য ক’মুহূর্তের জন্য থেমে থাকা সেসব।
তারপর আবার ভাসতে থাকে আর তার ভেতর নিশ্চিত কিছু স্মৃতিকাতরতা থেকেই যায়।
শিকড়ের অভাব তাদের ভেতরে একটা বাতাসের ভাব অর্পণ করে, খুঁতযুক্ত। তার ফলে সব দিকে অস্বাচ্ছন্দ্যের বোধ তৈরী হয়। তাদেরকে কেউ উৎসবে নেমন্তন্ন করে না, বাড়িতেও না। কারণ ওরা সন্দেহভাজন। এটা নিশ্চিত যে বাকী মানুষদের মতই কাজকম্মো করে থাকে এরাও, খায়, ঘুমায়, হাঁটে, এমনকী মরেও যায়। কিন্তু হয়ত গভীর মনঃসংযোগ করে যারা এদের দেখে তারা আবিষ্কার করতে পারে তাদের খাবার খাওয়ার ধরণ, ঘুমনোর ধরণ, হাঁটার ধরণ মরে যাবার ধরণের ভেতর সামান্য, অতি অদৃশ্যপ্রায় তফাৎ আছে। তারা ম্যাকডোনাল্ডের হ্যামবার্গার খায়, পোকিন্স এর চিকেন স্যান্ডউইচ খায়। সে তারা বার্লিন, বার্সিলোনা বা মন্টেভিডিও যেখানেই থাকুক না কেন। আর যেটা সবচেয়ে বাজে ব্যাপার তা হল এখনও অদ্ভুত মেনু থাকে তাদের খাবার টেবিলে- গাসপাচো স্যুপ, পুচেরো স্ট্যু কিংবা ইংলিশ ক্রিম সব একসঙ্গে। গোটা দুনিয়ার সবার মত ওরা রাতে ঘুমায়। কিন্তু কোন জঘন্য হোটেলের ঘরে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় মুহূর্তের অনিশ্চয়তা ওদের ঘিরে ধরে। ওরা বুঝতে পারে না ওরা কোথায় আছে, দিনের কোন সময় এটা, কিংবা শহরের নামটাই বা কি যেখানে ওরা আছে।
শিকড়ের অভাব ওদের চোখগুলোকে একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেয়। একটা মহাজাগতিক স্বনতা , নীলচে জলীয় ভাব, পলায়মান মানুষের চোখ যাদের অতীতে শিকড় শক্ত করে প্রোথিত ছিল অথচ আজ সেখানে নিজেকে রক্ষা করার বদলে ভেসে বেড়াচ্ছে কোথায়... যথাযথ কোন জায়গায় নয়।
কেউ কেউ যদিও জেদী সূক্ষ্ম পরত নিয়ে জন্মায় যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ় শিকড়ে পরিণত হয়। যে কোন কারণেই হোক সেটা তারা হারিয়ে ফেলে। হয় সেটা তাদের কাছে থেকে নিয়ে নেওয়া হয় বা সেটা কেটে বাদ দেওয়া হয়। আর এই জঘন্য কাজটা তাদের প্লেগ রুগীর মত অচ্ছুৎ করে ফেলে। কিন্তু তাদের জন্য সুদূর কোন অনুকম্পা জেগে ওঠার বদলে বিদ্বেষ জেগে ওঠে সাধারণত। লোকে সন্দেহ করে ওরা বুঝি অজানা কোন সন্দেহজনক কাজ করে থাকে। লুঠ ( আদৌ যদি কিছু তেমন থেকে থাকে তা তাদের জন্ম থেকেই থাকা অভাব থেকে বেরোতে চেষ্টা করে) তাদের দোষীতে পরিণত করে।
একবার যদি শিকড় হারিয়ে ফেলে সেই শিকড় আর কখনও শুধরে নেওয়া যায় না। সেই ছিন্নমূলতা বৃথা চলে যায়, বহু সময় কিনারায় থমকে থেমে থাকে, গাছের লাগোয়া... সেই বিরাট অ্যাপেন্ডিক্সের দিকে চেয়ে থাকে আড় চোখে যা গাছকে মাটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। শিকড় ছোঁয়াচে নয়। অজানা শরীরে সে আটকাতেও চায় না।
অন্য সবাই ভাবে এক শহর কিংবা দেশে বহুদিন ধরে থেকে যেতে যেতে হয়ত উদাহরণ স্বরূপ কখনও শিকড়গুলোকে মরা শিকড় কিংবা প্লাস্টিকের শিকড় বলেও ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কোন শহরই এতটা দয়ালু হয় না।
যাইহোক আশাবাদী ছিন্নমূল মানুষেরাও থাকে। যারা বিষয়ের ভাল দিকগুলো নিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। তারা দৃঢ়ভাবে বলে যে শিকড়ের অভাব আসলে চলমানতার এক বিশাল মুক্তি বিশেষ। নির্ভরতার অসুবিধাগুলোকে উড়িয়ে দেয় আর উচ্ছেদকে সমর্থন করে। তাদের আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা জোরাল হাওয়া বয়ে যায় আর বাতাসের হাঁ মুখের ভেতরে তারা অদৃশ্য হয়ে যায় ।
0 মন্তব্যসমূহ