হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্প : চাকতি

অনুবাদ : আনিসুজ্জামান

আর্হেন্তিনার কবি ও কথাসাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের জন্ম ১৮৯৯ সালে বুয়েনোস আইরেসে। বনেদি পরিবারে জন্ম নেয়া এই লেখক সারা পৃথিবীর পাঠকদের কাছে তার অতুলনীয় গল্পগুলোর জন্য পরিচিত। কথাসাহিত্যে মৌলিকতা ও সুক্ষ্ণ শিল্পকুশলতা–এই দুই অনন্য অর্জন তাকে লেখকদের লেখক হওয়ার কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। মূল থেকে অনূদিত এই গল্পটি তিনি রচনা করেছিলেন যখন তিনি পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তিহীন।
১৯৮৬ সালে তিনি জেনেভায় মৃত্যুবরণ করেন। বি.স.
স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: আনিসুজ জামান
--------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক কাঠুরে। নামে কী বা আসে যায়। যে-কুটিরে জন্মেছি আর সম্ভবত যেখানে খুব শিগগিরই মারা যাব, সেটা এক বনের প্রান্তে।
শুনেছি বনটা নাকি সমুদ্রের মতোই বিস্তৃত যা সমস্ত পৃথিবীকে ঘিরে আছে, যেখানে আমারটার মতোই অনেক কাঠের কুটির আছে। কোনোদিন সমুদ্র দেখিনি; তাই জানিও না। বনের অপর প্রান্তটিও কখনো দেখিনি। আমার বড় ভাই, যখন আমরা ছোট, আমাকে দিয়ে শপথ করিয়েছিল, দু’জনে মিলে বনের শেষ গাছটিও কেটে ফেলব। বড় ভাই মরে গেছে। আর এখন আমি যা খুঁজছি এবং ভবিষ্যতেও যা খুঁজব তা অন্য কিছু। পশ্চিম দিকে যে নদীটি বয়ে গেছে সেখানে খালি হাতে মাছ ধরি। বনে অনেক নেকড়ে কিন্তু আমি ওদেরকে ভয় করি না। আর আমার কুঠার কোনোদিন আমার সাথে বেইমানি করেনি।
বয়স কত হয়েছে হিসাব করিনি। তবে জানি অনেক বছর পেরিয়ে এসেছি। চোখে আর তেমন দেখি না। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে গ্রামে যাওয়ার ঝুঁকি নিই না। কৃপণ হিসেবেই আমাকে সবাই জানে। কিন্তু বনের এক কাঠুরে কীই বা জমাতে পারে!

তুষারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটি পাথর দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখি। বহুদিন আগে এক সন্ধ্যায় শুনতে পাই এক ক্লান্ত পদক্ষেপ আর তারপরেই টোকা। দরজা খুলতেই ঘরে এসে ঢুকল এক অপরিচিতি লোক। সে ছিল বুড়ো ও দীর্ঘদেহী, গায়ে জড়ানো ছিল জীর্ণ এক চাদর। মুখে লম্বা এক কাটা দাগ। মনে হয় বয়স তাকে অথর্ব করার চাইতে কর্তৃত্বই দিয়েছিল বেশি। তবুও লক্ষ করলাম লাঠি ছাড়া ওর হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। আমাদের মধ্যে সামান্য কথা হলো, যা আজ আর মনে নেই। সে অবশেষে বলল: আমার ঘর-বাড়ি নেই, যেখানে সেখানে ঘুমোই, স্যাক্সনদের এই দেশের পুরোটাই ঘুরে বেড়িয়েছি। কথাগুলো ওর বয়সেরই প্রমাণ দিল। আমার বাবা সবসময় স্যাক্সনদের দেশের কথা বলত; এখন যাকে মানুষ ইংল্যান্ড বলে।

ঘরে ছিল রুটি আর কিছু মাছ। খাবারের সময় কোনো কথা হলো না। বৃষ্টি শুরু হলো। কয়েকটি চামড়া বিছিয়ে দিলাম মাটির মেঝেতে, যেখানে আমার ভাই মারা গিয়েছিল। রাত্রি নেমে আসতে ঘুরিয়ে পড়লাম।
আমরা যখন কুটির থেকে বের হই, তখন চারদিক ফর্সা হয়ে উঠছে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল আর মাটি ছিল নতুন তুষারে ঢাকা। ওর লাঠিটা হাত থেকে ফসকে গেল। আর আমাকে তা তুলে দেয়ার আদেশ করল।
“কেন তোমার কথা মানতেই হবে” বললাম।
“কারণ আমি রাজা” উত্তর এল। ভাবলাম লোকটা পাগল। লাঠিটা কুড়িয়ে হাতে দিলাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বরে বলে উঠল। “স্যাক্সনদের রাজা আমি। অনেক কঠিন যুদ্ধে আমি ওদের জন্য বিজয় নিয়ে এসেছি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে রাজত্ব হারিয়েছি। আমার নাম ইজার্ন। আর আমি ওডিনের বংশধর।

“আমি ওডিনের পূজা করি না, আমি যিশুর পুজারি” বললাম তাকে। যেন আমাকে শোনেনি, এমনভাবে বলে চলল, “নির্বাসনের পথে ঘুরেছি আমি। তবু আজো আমি রাজা; কারণ আমার হাতেই রয়েছে সেই চাকতি। দেখতে চাও?”
হাড়সর্বস্ব হাতের মুষ্টি খুলে ধরল সে। কিছু নেই। তখনই আমার মনে পড়ল যে, সব সময়ই সে হাত বন্ধ করে রেখেছিল।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল: “ইচ্ছে করলে ছুঁয়ে দেখতে পার।” কিছু পাব না জেনেই আমি আঙুল ওর তালুতে ছোঁয়ালাম। বেশ ঠাণ্ডা কিছু একটার স্পর্শ পেলাম আর দেখলাম কোনো কিছুর ঝিলিক, হঠাৎ সে মুঠো বন্ধ করে ফেলল। কিছুই বললাম না। ও ধৈর্যের সাথে বলে চলল যেন এক শিশুর সঙ্গে কথা বলছে: “এটাই হচ্ছে ওডিনের চাকতি। এর একটাই মাত্র পিঠ আছে। যতদিন এটা আমার হাতে থাকবে ততদিন আমি রাজা।”
“এটা কি সোনার”- জিজ্ঞেস করলাম।
“জানি না। এটা ওডিনের চাকতি আর এর একটাই মাত্র পিঠ।”
ঠিক তখনই চাকতিটা নিজের করে পাওয়ার জন্য ভীষণ লোভী হয়ে উঠি। ওটা পেলে একতাল সোনার বদলে বেচে দিতে পারতাম আর রাজা হয়ে যেতাম। ভবঘুরেকে বললাম যাকে আজো ঘৃণা করে চলেছি: “কুটিরের মেঝেতে লুকোনো আছে এক বাক্স মুদ্রা। সবই সোনার যা কুঠারের ফলার মতোই চকচক করছে। যদি তুমি ওডিনের চাকতিটা আমাকে দাও তবে তার বিনিময়ে মুদ্রাগুলো তোমাকে দেব।”
সে দৃঢ়ভাবে বলল: “চাই না ওসব।”
সুতরাং বললাম, “তাহলে তুমি তোমার পথ দেখতে পার।” পিছন ফিরে দাঁড়াল সে।
তাকে মাটিতে ফেলে দেয়ার জন্য ঘাড়ের পেছনে কুঠারের একটি আঘাতই ছিল যথেষ্ট। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের মুঠি খুলে গেল আর দেখলাম বাতাসে একটি ঝিলিক। সঙ্গে সঙ্গে কুঠার দিয়ে জায়গাটা চিহ্নিত করে রাখলাম। তারপর মৃত দেহটা টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেলাম সেই নদীতে যা এরই মধ্যে জোয়ারে ফুলে উঠেছে। ওখানেই ছুঁড়ে ফেললাম তাকে। কুটিরে ফিরে এসে আতিপাতি করে চাকতিটা খুঁজলাম। পেলাম না। বছরের পর বছর হয়ে গেল, এখনো তা খুঁজে বেড়াচ্ছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ