অরভিন্দ আদিগা
অনুবাদ : সালেহা চৌধুরী
(লেখক পরিচিতি : অরভিন্দ আদিগা ভারতের চেন্নাই শহরে জন্মেছেন ১৯৭৪ সালে। তিনি একজন ভাতীয়-অস্ট্রেলিয়ান লেখক। তাঁর প্রথম উপন্যাস--The White Tiger ২০০৮ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছে। পড়াশুনা করেছেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। পেশায় সাংবাদিক। অন্যান্য উপন্যাস--Between the Assassinations, Last Man in Tower, Selection Day। )
-----------------------------------------------------------------------------------------------
দরগার সাদা ডোমের দিকে লোকটি এগিয়ে চলেছে। বগলের নিচে একটা ভাঁজ করা কাঠের টুল। দরকার হলে যেটাকে খুলে তার উপরে বসা যায়। আর এক হাতে ছবির এ্যালবাম। এবং সাত বোতল সাদা ট্যাবলেট ভর্তি ওষুধ। গন্তব্য স্থানে যেতে চারপাশের ভিক্ষুক গুলোকে দেখেও দেখে না সে। যে লোকগুলোকে কুষ্ঠ ধরেছে তারা সব কম্বলের উপর বসে আছে। যাদের হাত ও পায়ের বিকলাঙ্গ দৃশ্য সে দেখে না। কেউ ভিক্ষার জন্য বসে আছে চাকা চেয়ারে। কেউ দুচোখ ঢেকে বসে আছে। যেখানে হাত থাকার কথা সেখানে সিল মাছের ডানার মত কি যেন। এখন ও-গুলোই সেই বিকলাঙ্গ মানুষের হাত। একটা সাধারণ পা এবং একটি গাছের গুড়ির মত কাটা পা। সে পাছা দুলিয়ে ক্রমাগত বলছে--আল্লাহু! আল্লাহু।
এই দুঃখ- দৃশ্যের প্যারেডকে পাশ কাটিয়ে সে চলছে। ভাবখানা এমন এসব দেখে দেখে সে অভ্য¯ত। যেতে যেতে সে এবার সুলতান ব্যাটারি দরগার পেছনে চলে যায়।
এরপর এসে যোগ দেয় সেইসব দোকানীর সঙ্গে যারা প্রায় আধমাইল লাইন করে নানা কিছু বিক্রি করছে। মেয়েদের জুতো, তাদের বক্ষবন্ধনী, কিছু কিছু টি সার্টের পাহাড় ঠেলে সে এগিয়ে চলে। টি সার্টে নানা সব শ্রাব্য ও অশ্রাব্য কথা লেখা। একটায় লেখা--ফাকিং নিউইয়র্ক সিটি। এরপর নানা সব নকল রঙ্গিন চশমা, নানা ধরণের জুতো সব গুলোই নকল। আডিডাস জুতো আর নিক জুতো আসল কিছু নয়। এর সঙ্গে আছে উর্দু ভাষা ও মালয়লাম ভাষার বিশাল ম্যাগাজিনের পাহাড়। সে এবার এসে দাঁড়িয়েছে নাইক আর গুকি নামের দুটো নকল জিনিস বিক্রির দোকানের মাঝখানে। এরপর টুল পাতে। নিজের দোকান খুলে বসে। যেখানে চকচকে কাপড়ে বড় করে লেখা
রতনকারা শেঠি
সবাইকে আহ্বান জানায়
যৌন বিজ্ঞানের চতূর্থ সন্মেলনে
হোটেল নিউহিলটপ প্যালেস নতুন দিল্লি
যে সব যুবক দরগার মুসলমানদের কাবাবের দোকানে কাবাব খেতে এসেছে, যে সব যুবক সমুদ্র দর্শন করবে বলে এসেছে, এবং কেউ কেউ এসেছে দরগায় প্রার্থনা করতে তারা সকলে রতনকারা শেঠির দোকানের সামনে গোল হয়ে দাঁড়ায়। রতনকারা আরো নানা জিনিস সাজিয়ে সকলকে দেখতে বলে। সেই ছবির এ্যালবাম এবং তার সঙ্গে সাত বোতল সাদা পিল। এরপর সে বোতল গুলোকে খুব ভালো করে সাজায় যেন এই বোতল সাজানোর উপরই দোকানের কেনা বেচা নির্ভর করছে। সে আসলে আড় চোখে তাকিয়ে জেনে নিতে চায় ভিড়টা সত্যিই জমেছে কিনা।
কেউ কেউ যুগলে, কেউ একা, কেউ বন্ধুদের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই সব ছবি আর বোতল দেখছে। যেন মনে হয় ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জের মত তারা সব।
এরপর রতনের কাজ হলো কথা বলে সকলকে এসব ওষুধের গুনাগুনের বিষয় ব্যাখ্যা করা। প্রচার করা সজোরে। এরপর যুবকের ভিড় এত বেশি কেউ কেউ পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে সেই তরুণ যৌন বিজ্ঞানীকে দেখতে চায়। যিনি তাদের সকলের সমস্যার সমাধান করতে পারেন বলে তাদের ধারণা।
এ্যালবাম খুলে প্লাস্টিকেকে মোড়া ছবিগুলো দেখাতে শুরু করেন তিনি। ছবি দেখে সেই সব দর্শক বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে।
ছবি গুলোর দিকে অঙুলি নির্দেশ করে যৌন বিকৃতি ও শরীরের উপরের অত্যাচারের কথা বর্ণনা করেন রতন কারা শেঠি। বলেন পাপ তাপ একজনকে কি করতে পারে। বলেন কি ভাবে এই সব জীবানু পা থেকে উপরে উঠতে থাকে তারপর একসময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। একে একে এরা সব চোখে যায়, নাকে যায়। আকাশে সূর্য অকৃপন। দরগা সেই আলোয় আরো বেশি উজ্জ্বল। জনতা এক একজনকে গুতো মেরে সরিয়ে ছবি গুলোর কাছে আসতে চায়। এরপর রতন তার সেই বিশেষ সাদা পিলের বোতল বের করে। খুব জোরে ঝাঁকাতে থাকে বোতল গুলো।
“এই সব বোতলের সঙ্গে দয়াগঞ্জের হাকিম ভগবান দাসের একটা সার্টিফিকেট আপনাদের দেওয়া হবে। তিনি দিলি¬র অধিবাসী এবং এইসব ব্যাপারে একেবারে দক্ষ বিশেষঙ্গ। এই সাংঘাতিক সাদা পিল গুলো আপনাদের সর্ব প্রকার যৌন ব্যধিকে সারিয়ে তুলবে। দাম মাত্র চারটাকা পঞ্চাশ পয়সা। আপনাদের পাপের চর জন্য এই দাম ধার্য করা হয়েছে। জীবনে আবার সুযোগ আসুক। মাত্র চারটাকা পঞ্চাশ পয়সা।
সন্ধ্যাবেলা ক্লান্ত রতন কারা শেঠি তার দোকান গুটোয়। সেই টুলটার পা গুলো ভাঁজ করে। তারপর ৫৪ নম্বর বাসে উঠে এবার অন্য এক ব্যবসা শুরু করে। দরগার দোকান এখন বন্ধ করে ও। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর আরো কিছু কাজ থাকে। উপরের দিকে দিকে মুখ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। দশ পর্যন্তগোনে। তারপর ব্যাগ থেকে ব্রোসার গুলো বের করে দেখে। প্রত্যেকটি ব্রোসারের উপরে তিনটি করে ইঁদুরের ছবি। এরপর ব্রোসার গুলোকে তাসের মত সাজিয়ে উপরে তুলে ধরে বলতে থাকে--ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলা গন আপনারা সকলে জানেন আমরা এক ভয়ানক ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় জীবন পাত করে চলেছি। আপনাদের সšতান কি ভাবে বেঁচে থাকবে কি ভাবে একটা চাকরি সংগ্রহ করবে সেই নিয়ে আমি জানি আপনাদের ভাবনার শেষ নেই। কারণ আজকের জীবন আর কিছু নয় কেবল--র্যাটরেস বা ইঁদুরের প্রতিযোগিতা। এই সব পুস্তিকা সেই সব ইঁদুর প্রতিযোগিতায় কি ভাবে আপনারা টিকে থাকবেন তারই উত্তর, টিকে থাকবার প্রামান্য দলিল। ওরা কি করে চাকরি পাবে? পেতে কি করতে হবে সেসব উপায় লেখা আছে এখানে। হাজার হাজার সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নোত্তর লেখা আছে এই পুস্তিকায়। যে সব জানা দরকার। কারণ সরকারী বা অন্য যে কোন কাজের জন্য এইসব প্রশ্নউত্তর জানা জরুরি। ব্যাংকে চাকরি পেতে চাইলে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হবে, পুলিসের চাকরি পেতে গেলেও একই ব্যাপার। এরপর সে খুব জোরে শ্বাস টানে। বলে উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি--মুগল সম্রাটের দুটো রাজধানী ছিল। একটা দিলি¬ আর একটার নাম কি? ইউরোপের চারটি রাজধানী একটি নদীর উপরে। সেই নদীর নাম কি? জার্মানির প্রথম রাজার নাম কি? আংগোলার মুদ্রার কি নাম? ইউরোপের একটি শহর তিনটি সাম্রাজের রাজধানী। শহরটির নাম করুন। মহাত্মা গান্ধির হত্যার সঙ্গে দুই জন মানুষের নাম জড়িত আছে। একজন ন্যাথুরাম গডসে, অন্যজন কে? আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা কতটা।
হাতে সেইসব পুস্তিকা নিয়ে লোকটি বাসের দুলনিতে ঝুলতে ঝুলতে ক্রমাগত এইসব বলছে। একজন লোক একটা পুস্তিকা কেনে বিনিময়ে তাকে একটি টাকা দেয়। একসময় এই ব্যবসা বন্ধ করে বাস একটু থামতেই ও নেমে পড়ে।
একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য। রতন তাকে ছয় রংএর একখানা কলম বিক্রি করতে চায়। প্রথমে বলে--একটি কলমের দাম এক টাকা। তারপর বলে--দুটো কলম পাওয়া যাবে এক টাকায়। অবশেষে বলে--এক টাকায় পাওয়া যাবে তিনটি কলম। একজন বলছে সে এসব কিছু কিনবে না কিন্তু বুঝতে পারে মুখে বললেও দেখার ইচ্ছা আছে ভেতরে ভেতরে। এরপর আর একটা জিনিস বেরোয় রতনের থলে থেকে যা বাচ্চাদের জন্য খুবই মজার। এরপর বের করে জ্যামিতি করবার সেট। লোকটা শেষ পর্যন্ত তিন টাকা দিয়ে জ্যামেতির সেটটা কেনে।
এরপর সুলতান ব্যাটারির রাস্তা ছেড়ে ও চলেছে এবার সল্ট মার্কেটের দিকে।
বাজারে গিয়ে পকেট থেকে কিছু ভাংতি নিয়ে সেগুলো ঠিক করতে থাকে। এরপর সেখান থেকে খুচরো পয়সা নিয়ে সে কেনে এক প্যাকেট বিড়ি। তারপর সেই বিড়ির প্যাকেটটাকে সুটকেসে রাখে।
দাঁড়িয়ে আছো কেন? বিড়ি কেনার পর ভাংতি পয়সা তোমাকে দেওয়া হয়েছে। বলে দোকানের নতুন এক সেলসম্যান।
দাঁড়িয়ে আছি কেন? যখন আমি বিড়ি কিনি আমাকে দুই প্যাকেট ডাল ও দেওয়া হয়। এই ভাবেই চলে আমার বিড়ি কেনা। তুমি নতুন, তাই কিছু জানো না।
বাড়িতে ঢোকার আগে রতন ডালের প্রথম প্যাকেট খুলতেই এক দল কুকুর এসে সব ডাল চেটেপুটে খেয়ে এরপর যেখানে ডাল পড়েছিল সেই মাটিও কামড়ে খেতে চায়। তখন রতন ডালের দ্বিতীয় প্যাকেট খোলে। যখন বাড়িতে ঢোকে বুঝতে পারে কুকুর গুলো তখনো ক্ষুধার্ত। কিন্তু তিন প্যাকেট ডাল কিনবার টাকা তার নেই।
বুক টান টান করতে করতে, হাত সোজা করে মাথার উপরে তুলে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সে কোটটা দরজার পাশের হুকে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর চেয়ারে বসে ক্লান্ত রতনকারা শেঠি উচ্চারণ করে--হে কৃষ্ণ হে কৃষ্ণ। তারপর পা দুটো টান টান করে মেলে দেয়। যদিও বাড়ির সবাই রান্নাঘরে কিন্তু টের পেয়েছে রতন বাড়িতে ফিরেছে। আসলে যখন জুতো থেকে দুটো পা বের হয় তার গন্ধ সারা বাড়িতে প্রকট হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েরা কোল থেকে ঝপ করে ফেলে দেয় মেয়েলী ম্যাগাজিন গুলো। এরপর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এমন ভাব দেখায়।
রান্না ঘর থেকে স্ত্রী বেরিয়ে আসে হাতে এক পাত্র জল নিয়ে। তখন রতন বিড়ি পান করতে শুরু করেছে।--আমার মহারানীরা কি এখন কাজে ব্যস্ত? প্রশ্ন করে রতন।
ব্যস্ত আমরা। ঘর থেকে মেয়েরাই উত্তর পাঠায়। মেয়েদের ঠিকমত বিশ্বাস করতে না পেরে ও ঘরে গিয়ে উঁকি দেয়।
ছোট মেয়ে অদিতি ফোটো আলবামকে শাড়ির আঁচলে মুছে ফেলছে। দ্বিতীয় মেয়ে রুকমিনি সাদা পিল গুলো গুনে গুনে ভরছে। মনিকা রুকমিনির বড়। সে বোতলে বোতলে লেবেল লাগাতে ব্যস্ত। তিন মেয়েই পরদিনের ব্যবসার বিভিন্ন জিনিসের তদারকিতে মগ্ন।আর রান্না ঘরে স্ত্রী। থালা বাসনের ঝন ঝন ঠন ঠন শব্দ তুলছে। এরপর যখন একটু বিশ্রামে শরীরটা থিতু, দ্বিতীয় বিড়ি ধরিয়েছে, স্ত্রী একটু সাহস করে কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে--আজ নয়টায় জ্যোতিষীর আসবার কথা।
হূঁ। উত্তর দেয় রতন।
এরপর রতন পা টাকে একটু তুলে ধরে একটা আটকে থাকা বাতাসকে বের করে দিতে। এরপর পাশের রেডিওটাকে কোলের উপর নিয়ে বাজনার তালে তালে পায়ে তাল দেয়। যে শব্দ গুলো জানে বাজনার তালে তালে সেগুলো উচ্চারণও করে।
ও এখানে। জানায় স্ত্রী।
রতন গান বন্ধ করে। জ্যোতিষী এসে সামনে দাঁড়ায় নমস্তের ভঙ্গিতে হাত দুটো কপালে ঠেকিয়ে। লোকটা রতনের পাশে বসে নিজের গায়ের মোটা সার্টটা খুলে ফেলে। তখন রতনের বউ সেটা নিয়ে স্বামীর কোটের পাশে রাখে। এরপর জ্যোতিষী একটি একটি করে ছেলেদের ফটো ওর সামনে মেলে ধরে। ফটো গুলো একটা বড় এ্যালবামে রাখা আছে।
ছেলেরা ভালোই। বলে রতন। এই ছেলেটার বাবা কি করে? প্রশ্ন করে জ্যোতিষীকে।
বাবার একটা দোকান আছে। আতশবাজি বিক্রি করে। দোকানটা আমব্রেলা স্ট্রিটে। ভালো ব্যবসা। ছেলেটা ভবিষ্যতে বাবার দোকানটা পাবে।
নিজের ব্যবসা? রতন একটু অবাক হয়। যেন বেশ একটু খুশী খুশী ভাব তার কণ্ঠে। মনে হয় ইঁদুর প্রতিযোগিতায় লোকটা বেশ একটু এগিয়ে আছে। কেবল দোকানে যারা সেলসম্যানের কাজ করে তাদের চেয়ে অবস্থা ভালো।
মনে হয় রান্নাঘরে স্ত্রী কি যেন ফেলে দিল। রতন যখন সেটা দেখেও দেখে না স্ত্রী আবার কি যেন ফেলে দেয়। রতন রেগে বলে--ব্যাপার কি তোমার?
জন্মকুন্ডলি। হরোসকোপ। কোষ্ঠি। স্ত্রী মিনমিনে গলায় জানায়। কিছু ফেলে দেবার কারণ এই।
চুপ কর। রতন চিৎকার করে স্ত্রীকে থামিয়ে দেয়। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলে--তিন তিনটা মেয়েকে আমার পার করতে হবে। এখন আমি এই সব হরোসকোপ বা কোষ্ঠি নিয়ে ভাববো?
এই বলে ঝপ করে সেই আতশবাজির ব্যবসায়ীর ছেলের ফটোকে জ্যোতিষীর কোলে ফেলে দেয়। জ্যোতিষী সেখানে ক্রশ চিহ্ন দেয়।
ছেলের বাবার কিছু দেনা পাওনার কথা আছে।
যৌতুক? প্রশ্ন করে রতন। ঠিক আছে এই মেয়ের জন্য আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। এরপরের মেয়ে দুটোর কি হবে সব দিয়ে দিলে তা জানি না। এরপর রতন আর কি করবে? কতক্ষণ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হুংকার দেয় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে। রাগ কমায়।
পরের সোমবার ছেলে, ছেলের বাবা এবং আরো কয়েকজন আসে। ছোট মেয়েটা ট্রেতে করে লেবুর সরবত নিয়ে সকলকে বিতরণ করছে। রতন আর তার স্ত্রী ওদের সঙ্গে বসে অছে ড্রইংরুমে। রুকমনির মুখটা জনসন বেবি পাউডারে ধরধবে সাদা। চুলে জেসমিন ফুলের মালা। এরপর বীনায় তারে ঝংকার তুলে একটা গানও করে। রুকমনির চোখ দুটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভবিষ্যত শশুর সামনের একটা গদির উপর বসে আছে। আতশ বাজির ব্যবসায়ী লোকটা মোটাসোটা। পরণে সাদা শার্ট আর সাদা সারোং বা তহবন। কানের পাশে রুপোলি চুলের গোছা। লোকটা গানের তালে তালে মাথা নাড়ছে। রতনের মনে হলো এই ভাবে মাথা নাড়ার অর্থ সে হয়তো মেয়েকে পছন্দ করেছে। আর ওর ভবিষ্যত শাশুড়ি ঘরের করি বর্গা থেকে আরম্ভ করে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সে মহিলা নিজেও ধবধবে ফর্সার বিশাল আয়তনের একজন। ছেলেটাও বাবা মায়ের ধবধবে ফর্সা রং পেয়েছে তবে সে বাবা ও মায়ের মত বিশাল বপু নয়, ছোটখাটো একজন। দেখে মনে হয় সে যেন এই পরিবারের পালিত এক পোশা বেড়াল, উত্তরাধকারী বা বংশ প্রদীপের মত সে মোটেই নয়। গানের মাঝখানে সে তার বাবার কানে কানে কি যেন বলে। ব্যবসায়ী মাথা নাড়ে। ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় এবং ঘর ছেড়ে বাইরে যায়। বাবা তখন তার কড়ে আঙুল তুলে সকলকে দেখায়। সকলে খিল খিল করে হাসে। ছেলেটা ফিরে এসে তার মোটাসোটা বাবা ও মায়ের মাঝখানে কোনমতে ঠেঁসেঠুঁসে বসে। রতনের ছোট দুই মেয়ে ট্রে ভর্তি লেবুর রসের সরবত নিয়ে আবার ফিরে আসে। আতশ বাজির ব্যবসায়ী এবং তার স্থুলাঙ্গি স্ত্রী গ্লাশ নেয়। বাবা মাকে অনুসরণ করে ছেলেটাও। এরপর সে গ্লাশে চুমুক দিতে থাকে। যখনই সে কেবল গ্লাশে ঠোঁট ঠেকিয়েছে আবার বাবার কাঁধে হাতের টোকা দিয়ে কি যেন বলতে চায়। এই সময় আতশবাজির ব্যবসায়ী হাসে না। একটু রেগে ছেলেকে যেতে বলে। কিন্তু ছেলেটা প্রায় দৌড় দিয়ে বাইরে চলে যায়।
ছেলের এই সব বাইরে যাওয়া টাওয়া নিয়ে কেউ কিছু না ভাবে তাই আতশবাজির ব্যবসায়ী রতনকে বলে--তোমার কাছে কি কোন বিড়ি আছে? বিড়ির প্যাকেট রান্নাঘর থেকে আনতে আনতে রতন লক্ষ্য করে ওর সেই হবু জামাই অশোক গাছের গোড়ায় সজোরে পেশাব করছে। বোধহয় এমন ঘটনায় ছেলেটা নার্ভাস হয়ে ঘন ঘন পেশাব করছে--এই কথা ভেবে মনে মনে একটু হাসে রতন। মনে হয় ইতোমধ্যে ছেলেটার জন্য একটু স্নেহও বোধ করে সে, কিছুদিন পরই তো ছেলেটা এই বাড়ির একজন হবে। সব মানুষই বিয়ের ঘটনায় এমন নার্ভাস হয়ে যায়। ছেলেটার মনে হয় পেশাব হয়ে গেছে। সে তার পুরুষাঙ্গ ধরে একটু নাড়া দেয় তারপর ফিরে আসতে চায়। কিন্তু খানিক পরেই মনে হয় ছেলেটা কিসের ভয়ে যেন একেবারে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। তারপর মাথাটা একটু পিছে ঠেলে সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। যেমন করে নিঃশ্বাস নেয় একজন ডুবšত মানুষ।
পরদিন ঘটক এসে বলে আতশবাজির ব্যবসায়ী মেয়েকে পছন্দ করেছে।--তারিখ তাহলে ঠিক কর। এক মাস পর থেকেই বিয়ের হল গুলোর ভাড়া বেড়ে যাবে। এই বলে সে হাতের তালু চুলকায়। যদিও রতন এই কথায় মাথা নাড়ে কিন্তু মনে হয় কোন কারণে সে অন্যমনস্ক।
পরদিন বাসে চেপে রতনকারা শেঠি আমব্রেলা স্ট্রিটের উদ্দেশে যাত্রা করে। সে খাট পালংএর দোকান এবং আরো নানা দোকান পার হয়ে একসময় এসে পৌঁছায় আতশবাজির দোকানের সামনে। সেই মোটা ব্যবসায়ী আতশ বাজির সামনে একটা টুলে বসে আছে। কিছু কাগজের বোমা ও বারুদ সেখানে। দেখে মনে ঈশ্বরের আগুন এবং যুদ্ধের সে সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। ভবিষ্যত জামাইও তখন দোকানে। আঙুল থুতুতে ভিজিয়ে সে হিসাবের খাতাপত্র দেখছে।
মোটা ব্যবসায়ী খুব আস্তে ছেলেকে একটু পা দিয়ে গুতো দেয়।--এই ভদ্রলোক খুব তাড়াতাড়ি তোমার শশুর হতে চলেছে তুমি কি তাকে একটু হ্যালো বলবে না? এই বলে সে রতনের দিকে তাকিয়ে হাসে, বলে--ছেলেটা খুব লাজুক।
রতন চা পান করে। মোটা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে কিন্তু তার চোখ কেবল ছেলেটাকেই লক্ষ্য করছে। একসময় সে ছেলেটাকে বলে--ছেলে তুমি একটু আমার সঙ্গে বাইরে চল দেখি। তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।
দুইজন পথ ধরে হাঁটছে কিন্তু অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলছে না। আমব্রেলা স্ট্রিটের হনুমান টেম্পলের কাছে কতগুলো কলাগাছ জন্মেছে। সেখানে গিয়ে মুখ খোলে রতন শেঠি বলে রাস্তার দিকে নয় মন্দিরের দিকে মুখ করে বসতে। খানিক সময়ের জন্য সে ছেলেটাকে কথা বলতে দেয়। কিন্তু সে গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করছে ছেলেটার চোখের কোন, নাক, কান, চুলের ধার এবং ঘাড়। একসময় সে তরুণের হাতের কবজি চেপে ধরে--কোথায় পেয়েছিলে সেই বেশ্যা যার সঙ্গে তুমি সময় কাটিয়েছো?
ছেলেটা এবার পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু রতন এমন করে কবজি চেপে ধরেছে ছেলেটা বুঝতে পারে কোনমতেই সে পালাতে পারবে না। ছেলেটা তখন রাস্তার দিকে তাকায়। যদি কেউ সেখান থেকে এসে সাহায্য করে বোধকরি সেই আশায়। রতন আরো জোরে হাতে চাপ দেয়। বলে--কোথায়? ঠিক করে বল? রাস্তার ধারে, হোটেলে না বনে জঙ্গলে না কোন দালানের পেছনে?
এই বলে সে ছেলেটার কবজি এমন করে ঘোরাতে শুরু করে মনে হয় তা ভেঙ্গে যাবে।--রাস্তার ধারে। এই বলে সে প্রায় কেঁদে ফেলে। তারপর বলে--তুমি কি করে জানলে?
এবার ছেলেটার দিকে আর তাকায় না রতন। বলে--বাজারের এক বেশ্যা। ছিঃ। এই বলে ছেলেটার গালে ঠাস করে চড় মারে। ছেলেটা কেঁদে ফেলে বলে--মাত্র একবার। এর বেশি নয়।
একবারই অনেক। যখন পেশাব কর তখন কি তোমার খুব জ্বালা যন্ত্রণা হয়?
খুব জ্বলে। ছেলেটা উত্তর করে।
বমি বমি লাগে?
ছেলেটা ঠিক নওসিয়ার মানে জানে না। যখন বুঝতে পারে প্রশ্নটা মাথা ঝাকিয়ে বলে লাগে।
আর কি হয়?
মনে হয় একটা শক্ত মার্বেল আমার দুই পায়ের ফাঁকে কোথায় যেন আটকে আছে। কখনো ভোঁ করে মাথাটা ঘুরে যায়।
তোমার পুরুষাঙ্গ কি এখন উত্তেজিত হয়?
হয়।
এবার বল তোমার সেই যন্ত্রটা এখন দেখতে কেমন? কালো না লাল, না অন্যরকম?
এই সব কথাবার্তার আধঘন্টা পরে দেখা যায় ওই দুই জন মানুষ তখনো কথা বলছে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে।
আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাই। হাত জোড় করে বলে ছেলেটা আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাই। রতন শেঠি মাথা নেড়ে বলে--এখন এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হবে। আমি কি করে আমার মেয়েকে তোমার অসুখে সংক্রামিত হতে দেই? ছেলেটার মিনতি করবার ভাষার ঝোলা শেষ। নাকের ডগা থেকে টপ ট করে ঘাম ঝরে পড়ে। এবার রেগে ছেলেটা বলে-- আমি তোমাকে শেষ করবো। সারোংএ হাত মুছে রতন বলে--সেটা কি করে করবে?
বলবো--তোমার মেয়ে আগে আরো লোকজনের সঙ্গে ঘুমিয়েছে। সে ভার্জিন নয়। সেই কারণে আমি বিয়ে করছি না।
সঙ্গে সঙ্গে রতনকারা শেঠি ছেলেটার চুলের গোছা ধরে পেছনের কলা গাছে জোরে ঠেঁসে ধরে। এরপর সে ছেলেটার মুখে থুতু ছিটায়। রেগে বলে --
এই মন্দিরে যতগুলো দেব দেবী আছে তাদের নামে শপথ করে বলছি--এই কথা যদি বল আমি তোমাকে আমার এই খালি হাতে খুন করবো।
সেদিন দরগায় নিজের দোকানে আগুনের মত লাল শব্দে যৌন ব্যধির নানা কথা সে আশে পাশের তরুণদের বলে। পাপ, অসুখ। তারপর কেমন করে জীবানু পুরুষাঙ্গ থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই সব। চোখে, কানে তারপর বাসা নেয় নাকের ভেতর। এরপর সেইসব ছবি--ক্ষত ধরা নানা সব পুরুষাঙ্গ। কোনটা কালো, কোনটা কোচকানো এমনি নানা ছবি। প্রতিটি ছবিতে মুখ গুলো কালো কলমে সার্কেল করা। এমন করে ছবি গুলো তোলা মনে হয় এরা সারাজীবন ধর্ষণ, অত্যাচার এইসবই করেছে। তারপর বলে --এসব থেকে মুক্তি পেতে আমার এই সব সাদা পিল ছাড়া কোন উপায় নেই।
এরপর গেল তিনমাসের মত। একদিন যখন সে তার নির্দিষ্ট জায়গায় দোকান খুলেছে, চারপাশের ক্লান্ত-করুণ-অসুস্থ যুবক তাকে ঘিরে আছে হঠাৎ একটি দৃশ্যে রতনকারা শেঠির মনে হলো তার হ্রদয় ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যাবে। সে আবার দেখতে পেল সেই মুখ, ঠিক তার সামনে।
কি চাও তুমি? সাপের মত হিশ হিশ করে বলে রতন।--অনেক দেরী করে ফেলেছো। আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কি জন্য এখানে তুমি?
সেই টেবিলটাকে ভাঁজ করে বগলের তলে রাখে। লাল ব্যাগে ভরে ফেলে সেই ধ্বন্বšতরি সাদা পিল। এরপর খুব জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে। একটা পায়ের শব্দ পেছনে। সেই আতশবাজির ব্যবসায়ীর ছেলে। কথা বলতে গিয়ে বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।
আমার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিদিন একটু বেশি করে খারাপ হয়। পেশাব করতে গেলে জ্বালা যন্ত্রনায় আমি একশেষ। আমার জন্য তোমাকে কিছু করতেই হবে। আমাকে তোমার ওই সাদা পিলগুলো দাও। দিতেই হবে তোমাকে। রতন দাঁতে দাঁত ঘসে।--তুমি পাপ করেছো। হারামজাদা তার ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে। একটা বেশ্যার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। এবার তার ফল ভোগ কর।
এরপর রতনকারা শেঠি খুব জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে। এরপর মনে হলো পেছনের পায়ের শব্দ আর নেই। এবং রাস্তায় ও একা।
পরদিন সন্ধ্যায় সেই মুখ আবার দেখতে পায় রতন। তারপর পিছে পিছে সেই পায়ের শব্দ। সে শব্দ তার সঙ্গে বাসস্টপের কাছে এসে থামে। সেই করুন-কাতর গলা বলছে--তোমার সাদা পিলগুলো আমাকে দাও। কিনতে যা টাকা লাগে আমি তোমাকে দেব। কিন্তু রতন এমন কথায় পিছু ফেরে না।
এরপর বাসে উঠে সেই সব ব্রোসার গুলো তাসের মত ধরে তার যা বলবার বলতে থাকে। বলে--র্যাট রেস বা ইঁদুরের প্রতিযোগিতার কথা। দূরে সুলতান ব্যাটারির পাশের দূর্গবাড়ির রেখা চোখে পড়ে। একসময় বাসটা একটু আস্তে চলতে চলতে থামে। ও নিচে নামে। আর একজন ওর সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামে। সে চলতে থাকে। আর একজনও সমানতালে পা ফেলে পিছু পিছু আসছে। এরপর রতনকারা শেঠি ছেলেটার জামার কলার ধরে বলে--ঘটনা কি তোমার? আমি তোমাকে চলে যেতে বলেছি না? আমাকে ছেড়ে চলে যাও। ভাগো।
ছেলেটা রতনের হাত সরিয়ে দেয়। তার সার্টের কলার ঠিক করে।--মনে হয় আমি মারা যাব। তোমার ওই সাদা পিলগুলো আমাকে দিতেই হবে।
শোন তাহলে মন দিয়ে আমি যা বিক্রি করি তা দিয়ে ওখানকার একজনারও অসুখ সারবে না। এটা তোমার মাথায় গেছে না যায়নি?
এক মুহূর্তের নিস্তব্দধতা। ছেলেটা বলে--কিন্তু তুমি তো সেই বিরাট “সেক্সোলজি কনফারেন্সে” গিয়েছিলে তাই না? প্রতিদিন অমন একটা ব্যানারই তো তুমি টাঙ্গিয়ে রাখো। রতন আকাশে হাত দুটো তোলে। বলে--ওই ব্যানার? ওটা তো একদিন আমি একটা রেলস্টেসনে কুড়িয়ে পেয়েছি।
তারপর তুমি বার বার বল দিলি¬র হাকিম ভগবান দাসের কথা। সেটা কি?
হাকিম ভগবান দাস না আমার পাছা। আমব্রেলা স্ট্রিটের একটা দোকান থেকে আমি চিনির দলা কিনি। ঠিক তোমার বাবার আতশবাজির দোকানের পাশে সেই দোকানটা। আমার মেয়েরা সেগুলো বোতলে ভরে লেবেল লাগায় হলো এবার?
এই কথাকে সত্য প্রমানিত করতে রতনকারা শেঠি একটা বোতলের মুখ খোলে। তারপর সাদা পিলগুলো কাগজে বিছায়। মনে হয় পৃথিবীর মাটিতে নতুন বীজ ছড়ানো হলো। বলে সে-- পুত্র তোমাকে সেরে তুলবার মত আমার কিছুই নাই। ছেলেটা মাটি থেকে একটা সাদা পিল কুড়িয়ে নিয়ে মুখে পোরে। সেই পিলের সঙ্গে কিছু ধুলোবালিও ওর পেটে চলে যায়। পাগলের মত সেই পিলকেই ওর পরিত্রান মনে করছে তখন ছেলেটা।
তুমি কি পাগল?
এরপর হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে ছেলেটাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একই প্রশ্ন করে--তুমি কি পাগল?
এরপর সে দেখে সেই ছেলেটার চোখদুটো। গতবার যেমন দেখেছিল তার চেয়েও অনেক খারাপ সে দৃষ্টি। চোখ গুলো পানিতে ভরে আছে আর রং লাল। মনে হয় পেঁয়াজের আচার। এরপর বেশ একটু ধীরে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখে।
ঠিক আছে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। কিন্তু দাতব্যখানা খুলে বসে নেই আমি। তোমাকে এর জন্য টাকা দিতে হবে।
এর আধঘন্টা পর দুজন পুরুষ রেলস্টেসনের পাশে বাস থেকে নামে। এরপর এমন একটা পথ দিয়ে হাঁটছে যা ক্রমাগত অ্ন্ধকার ও সরু হয়ে গেছে। খানিকপর একটা দোকানের সামনে এসে দুজনে থামে। মনে হয় দোকানটা ওষুধের। একটা বড় লাল ক্রশ আঁকা। ভেতরে একটা রেডিওতে কানাড়ি ভাষায় একটা গান বাজছে।--এখান থেকে কিছু কেন। তারপর তোমার পথ দেখ।
রতন চলে যেতে যায় কিন্তু ছেলেটা শক্ত করে ধরে আছে ওর হাত। রতন তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যেতে যায় কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। লক্ষ্য করে দোকান থেকে বেশ কিছু সবুজ বোতল কিনেছে ছেলেটা। রতন মনে মনে ভাবে--কি দুঃখে ওকে এখানে এনেছিলাম। ছেলেটা ভুতের মত ওর সঙ্গে লেগে আছে। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।
সে রাতে অনেকসময় বিছানায় এপাশ ওপাশ করে রতনকারা শেঠি। বউ বিরক্ত হয়।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা বাসে চেপে রতনকারা শেঠি আমব্রেলা স্ট্রিটের সেই আতশবাজির দোকানের সামনে এসে এমন জায়গায় দাঁড়ায় যেন ছেলেটা তাকে দেখতে পায়। এরপর দেখা যায় দুজন মানুষ নিঃশব্দে পথ হাঁটছে। দুজনে এসে বসে আখের রসের সরবতের দোকানে। দোকানের ছোট আখ থেকে রস বের করবার মেসিনটা ঘুরছে। রসের সরবতের কেনা বেচা চলছে। বলে একসময়--তুমি হাসপাতালে যাও। ওরা তোমাকে সাহায্য করবে।
আমি কি করে যাই। ওরা আমাকে চেনে। বাবাকে বলে দেবে।
রতনের মনে পড়ে যায় সেই বিশালবপুর লোকটা। কানে যার চুলের গোছা। লোকটা বসে আছে আতশবাজি ও কাগজের বোমার সামনে।
পরদিন যখন সে কেনাবেচা শেষ করে টেবিলের পা গুলোকে ভাঁজ করছে দেখতে পায় একটা ছায়ামূর্তি। ওরা দরগা পার হয়। পার হয় সেইসব মানুষজন যারা দরগায় ইউসুফ আলীর নামে পয়সা দেবে বলে সেখানে জমা হয়েছে। তারপর পার হয় কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হাত পা বিহীন কিছু মানুষ। ওরা বলছে--আল্লাহু আল্লাহু। সে চোখ তুলে দরগার সাদা ডোম লক্ষ্য করে। সে এবার সমুদ্রের দিকে যায়, ছায়ামূর্তি পেছনে। একটা পাথর পড়ে আছে সমুদ্রের কিনারে। সেখানে নিজের ডান পা রাখে রতন। তখন সমুদ্রের ভেতর জলোচ্ছাস। সাদা ফেনার নাচ। মনে হয় সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে একটা ময়ূর। এবার রতন পিছু ফেরে।
আমার কি করবার আছে বলতে পার তুমি? এইসব সাদা পিল যদি না বিক্রি করি মেয়েদের বিয়ে দেব কেমন করে? ছেলেটা চুপ করে শোনে। এরপর ওরা দুজনে পাঁচ নম্বর বাস ধরে শহরে ফিরে আসে। যেন এই কথা বলতেই এতদূর আসা ওদের। তারপর এ্যাঞ্জেলটকির সামনে এসে বাস থেকে নামে। ছেলেটা সেই কাঠের টেবিল বয়ে আনছে। এরপর সে খুঁজে পায় সেই দোকান যা সে পেতে চেয়েছে। একটা বড় নোটিস আর ছবি। একটি সুখী দম্পতি বিয়ের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় করে লেখা--হ্যাপি লাইফ ক্লিনিক। বিশেষজ্ঞ--ডক্টর এম.ভি কামাঠ এম বি বি এস(মাইসোর), বি. মেক(এলাহাবাদ), ডি.বি.বি.এস(মাইশোর) জি.কম (ভারানাসি) সাফল্য নিশ্চিত।
দেখেছো নামের পরে ডিগ্রি গুলো? ও হলো অত্যšত ভালো ডাক্তার। ওই তোমাকে বাঁচাবে।
বসার ঘরে প্রায় আধ ডজন দুর্বল, নার্ভাস, তরুণ রোগী চেয়ারে বসে। আর ঘরের কোনায় বসেছে বিবাহিত নারী পুরুষ। ওরা দুজনে বসলো বিবাহিত এবং একা মানুষদের মাঝখানে। রতন বেশ একটু অনুসদ্ধিৎসু ভাবে তাকিয়ে দেখছে এরা কারা? ঠিক তাই। তার কাছ থেকে চিনির ডেলা কিনে দিনের পর দিন খেয়ে যাদের কোন ফল হয়নি তারাই এখানে এসে ভিড় করেছে। বছরের পর বছর ধরে রোগমুক্ত হতে চেয়ে বিফল হয়েছে। আজ তারা এখানে। চিনির ডেলা বা সাদা বড়ি ওদের কিছুই করতে পারে নি। এখন হতাশা নামের দীর্ঘ রাস্তা পার হয়ে এখন এখানে। তারা প্রথমে কোন বেশ্যার সংসর্গে পড়েছে, তারপর দরগার ক্লিনিক এখন শেষ সম্বল নিয়ে এখানে। অপেক্ষা করছে শেষ সত্য জানবার।
একজন একজন করে সেই দুবলা পাতলা ক্ষয় হয়ে যাওয়া মানুষেরা চলেছে ডাক্তারের কাছে। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় ডাক্তারের দরজা। এবার রতনকারা শেঠি বিবাহিত মানুষদের দেখে। ভাবে ওরা একা আসেনি। এসেছে যুগলে। দুজনার দুঃখ কষ্ট শেয়ার করবে বলে।
সেই বিবাহিত একজন উঠে দাঁড়ায়। মহিলা চুপচাপ বসে অপেক্ষা করে। কিন্তু কোন মানুষ যখন এই রোগে আক্রাšত এই দুনিয়ায় সে তখন সত্যিই একা। তার কোন বন্ধুবান্ধব বউ বাচ্চা কেউই থাকে না।
ঘরে ঢুকতেই রতনকারা শেঠির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার প্রশ্ন করে--রোগীর কি হও তুমি?
ওরা চেয়ারে বসে। ঘরের দেয়ালে বিশাল এক ছবিতে পুরুষের মুত্রথলি এবং তার প্রজনন ক্রিয়া প্রক্রিয়ার ছবি টাঙানো। কেমন ভাবে দুটো জিনিস পাশাপাশি থাকে সেটা বোঝানোর জন্য। রতনকারা শেঠি ছবির দিকে তাকিয়ে বলে --আমি ওর চাচা।
ডাক্তার ওকে সার্ট প্যান্ট খুলতে বলে। তারপর ওর পাশে বসে। বলে--জিভ বের কর। চোখের ভেতরে কেমন সেটা গভীর ভাবে পরীক্ষা করে। তারপর বুকে টেথিসস্কোপ লাগিয়ে একবার বুকের এপাশ আর একবার বুকের ওপাশ পরীক্ষা করে। রতন মনে মনে ভাবছে--এই পৃথিবীতে বিচার বলে কি কিছুই নেই? একজন তরুণ একবারই একটা বেশ্যার সঙ্গে ঘুমিয়েছে। তারপরই এই অসুখে পড়লো?
ছেলেটার পুরুষাঙ্গ খুব ভালোমত পরীক্ষা করে ডাক্তার। এবার হাত ধোবার বেসিনে গিয়ে ভালোমত হাত ধোয়। বেসিনের উপরে উজ্জ্বল টিউব বাতি। দড়ি টানলেই জ্বলে ওঠে। এরপর ভালো করে মুখ ধুয়ে সে বাতি নেভায়। এরপর সবুজ প্লাস্টিকের বাক্সেও নানা কিছু পরীক্ষা করে। সব কাজ শেষ করে এবার সে ওদের দিকে মুখ ফেরায়। তারপর একটু জোরে শ্বাস টানে।
ওর কিডনি শেষ।
শেষ?
শেষ। ডাক্তার আবার বলে।
তখন রতনকারা শেঠি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখে চেয়ারে বসে সে থর থর করে কাঁপছে।
তোমার কি সব কিছু খেতে এখন বিস্বাদ লাগে? ছেলেটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ডাক্তার।
ছেলেটা দুই হাতে চোখ ঢাকে। রতন ওর হয়ে কথা বলে--ও আসলে অসুখটা পেয়েছে একটা বেশ্যার কাছ থেকে। এতে পাপ তেমন নেই। আসলে ও জানে না এই পৃথিবীর সত্যিকারের নানা ঘটনা। কোথা থেকে কি হয়?
ডাক্তার মাথা দুলিয়ে বলতে চায়--ঠিক তাই। ডাক্তার সেই দেয়াল ছবির কিডনির জায়গায় তর্জনি রেখে বলে--শেষ। কিডনি শেষ।
সকাল ছটায় রতন আর সেই ছেলেটা বাস স্টেসনের দিকে চলেছে। ওরা যাবে মানিপালে। শুনেছে ওখানে একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ আছে। যিনি ওখানকার হাসপাতালে কাজ করেন। বাসস্টেসনে বসে থাকা সবুজ লঙ্গি পরা একজন বলে--মানিপালের বাস সবসময়ই লেট। কখনো পনেরো মিনিট, কখনো আধঘন্টা, কখনো তারো বেশি।--সব কিছু ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে এই শহরে। এভরিথিং ফলিং আপার্ট । যেদিন থেকে মিসেস গান্ধিকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে সেদিন থেকেই এমন। এরপর লোকটা পা দুটো ঝোলাতে ঝোলাতে, অদৃশ্য কোন কিছুতে লাত্থি মেরে বলে--বাস লেট। ট্রেন ঠিকমত আসে না, চলে না। মনে হয় দেশটাকে আবার ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে হবে। না হলে রাশিয়ানদের হাতে না হলে আর কাউকে। আমি তোমাকে বলছি এবং আমার কথা মন দিয়ে শোন তোমার ভাগ্য নিয়ন্তা আমি হতে পারবো না। সে যোগ্যতা আমাদের নেই।
ছেলেটাকে বসতে বলে রতনকারা শেঠি কাগজের কোনাতোলা ঠোঙ্গায় বাদাম নিয়ে আসে। কুড়ি পেন্স একটা প্যাকেটের দাম।--মনে হয় সকালের নাশতা খাওয়া হয়নি তোমার তাই না? ছেলেটা বলে--তা হয়নি। তবে ডাক্তার বলেছে কোন মশলাদার জিনিস না খেতে। খেলে অসুখের জন্য খারাপ। এরপর রতনকারা সেই বাদামওয়ালার কাছে গিয়ে মশলাবিহীন, লবনবিহীন বাদাম কেনে। দুজনে মুচ মুচ করে সেই বাদাম চিবায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ছেলেটা দেয়ালের কাছে ছুটে যায়, খাবার গুলো উগড়াতে পারলেই বাঁচে। কিছু খেলে এমনই হয় ওর। সেই সবুজ লুঙ্গির লোকটা চোখ ছোট করে তাকায়, জানতে চায় ব্যাপার। বলে--ছেলেটার খারাপ একটা কিছু হয়েছে তাই না?
বাজে কথা। খারাপ কিছু নয়। এই একটু ফ্লু জাতীয় কিছু।
এক ঘন্টা পর মানিপালের বাস আসে।
আসার সময়ও তেমন দেরী। প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা বেঞ্চ খালি হয়। ওরা দুজনে বসে। রতন বসে জানালার পাশে। ছেলেটাকে পাশে বসতে বলে।--যাক বাবা শেষ পর্যন্ত সিট পাওয়া গেল। যা ভিড় এই বাসে। রতন একটু হাসে। তারপর খুব ধীরে ছেলেটার পিঠের উপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। ছেলেটা পকেট থেকে টাকা রাখবার ওয়ালেট বের করে। একটা একটা করে পাঁচটা এক টাকার নোট দেয় রতনকারা শেঠিকে।
কি জন্য টাকা দিচ্ছ তুমি? প্রশ্ন করে রতন।
তুমি বলেছিলে আমাকে সাহায্য করতে গেলে তোমাকে কিছু দিতে হবে। ঝপ করে টাকাগুলো ছেলেটার পকেটে ঢুকিয়ে বলে--আমার সঙ্গে এমন করে তোমার কথা বলতে হবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি ঠিকই। কিন্তু পেয়েছো কি তুমি? এটা কেবল একজনকে সাহায্য। মনে রাখবে তুমি আমার কেউ না। তোমার সঙ্গে আমার রক্তের বন্ধন নেই।
ছেলেটা কিছু বলে না।
শোনো ছেলে--তোমার সঙ্গে এ ডাক্তার থেকে সে ডাক্তারের কাছে যাবার আমার সময় নেই। আমাকে টাকা রোজগার করতে হবে। দুটো মেয়েকে এখনো বিয়ে দিতে হবে। ওদের যৌতুক, বিয়ের খরচ, আরো কতকি।
ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে রতনকারা শেঠির কণ্ঠার হাড়ে মুখ ঘসতে থাকে। তারপর ভযংকর ভাবে কেঁদে ওঠে। তার ঠোঁট রতনের বুকে, নিরুপায় হয়ে ছেলেটা ঘসছে তার মুখ। লোকেরা এমন দৃশ্যে কি ভাবে কে জানে। তারা বড় বড় চোখে ঘটনা জানতে চায়।
আর এক ঘন্টা পরে কালো দূর্গ বাড়িটা চোখে পড়ে। দুজনে এক সঙ্গে নামে। রতনকারা শেঠি এবং সেই ছেলে। সে অপেক্ষা করে ছেলেটা বড় করে নাক ঝেড়ে ওর কাছে আসে। সেই কালো গম্বুজের দূর্গ বাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে রতনকারা শেঠি কবে কখন সে ভেবেছিল এই আতশবাজির ব্যবসায়ীর ছেলেকে সাহায্য করতে এত কিছু করবে ও। কেন ওর অসুখ নিয়ে এত বেশি ভাবছে ও। তখনই মনে পড়ে যায় সেই সাদা গম্বুজের ডোমের তলায় সারি সারি হাত পা বিহীন মানুষ ক্রমাগত ভিক্ষার জন্য কাতর হয়ে চিৎকার করছে। এরপর একটা বিড়ি ধরাবে বলে সে দেশালাই বের করে পকেট থেকে। উদাস হয়ে ছেলেটাকে বলে--চল। আমার বাড়ি যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে যে।
------------------------------------------------------------------------------------------------
( আরভিন্দ আদিগার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বিটুইন এ্যাসাসিনেসন’ ১৮টি গল্পের একটি। এই ১৮টি গল্পে তেরী হয়েছে ‘বিটুইন এ্যাসাসিনেশন’ নামের উপন্যাস। একটি নতুন উপন্যাস গঠনশৈলী। ‘সুলতানের ব্যাটারি’ সেখান থেকে নেওয়া)
0 মন্তব্যসমূহ