অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত
(প্রথম খণ্ড)
অনুবাদক : উৎপল দাশগুপ্ত
মুখবন্ধ
গন উইথ দ্য উইন্ড আমেরিকান ঔপন্যাসিক মার্গারেট মিচেলের লেখা একমাত্র সাহিত্যকীর্তি। এই উপন্যাস ১৯৩৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) পটভুমিকায় লেখা এই উপন্যাস একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়। ১৯৩৬ এবং ১৯৩৭ সালে এই উপন্যাস আমেরিকার ‘বেস্টসেলার’ তালিকায় সর্বোচ্চ আসন লাভ করে। ১৯৩৭ সালে এই উপন্যাস পুলিৎজ়ার পুরস্কার পায়। ১৯৩৯ সালে এই উপন্যাসের সফল চলচিত্রায়ন হয়। এত বছর পরে এখনও আমেরিকার পাঠকের কাছে গন উইথ দ্য উইন্ড বাইবেলের পরেই দ্বিতীয় জনপ্রিয় বই।
মার্গারেট মিচেলের জন্ম ১৯০০ সালের ৮ই নভেম্বর জর্জিয়ার অ্যাটলান্টা শহরে। মৃত্যু ১৬ অগাস্ট ১৯৪৯ সালে। তাঁর পরিবারের সকলেই আগ্রহের সঙ্গে আমেরিকার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতেন। বাল্যকালে, কৈশোরে আর যৌবনে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ নিয়ে যে সব ঘটনা উনি শুনেছিলেন, সেগুলোরই ফলশ্রুতি এই উপন্যাস।
উপন্যাসটা আমি প্রথম পড়ি কলেজে পড়াশোনা করার সময়। আমার মতে উপন্যসটা চিরায়ত বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। বইটা নিশ্চয়ই অনেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাভাষায় এর কোন অনুবাদ আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। সময় ও সুযোগ পেলে এর বাংলা অনুবাদ করার ইচ্ছে অনেকদিন থেকেই মনের মধ্যে ছিল। বইটার বিপুলতা দেখে বার বার পিছিয়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেটাই জয়ী হল। আমি সাহিত্যের লোক নই। তাই ভাষার অক্ষমতা থেকে যাবে। যাঁরা কষ্ট করে পড়বেন, তাঁদের কাছে আগেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সব শেষে একটা কথা বলতে চাই। ইংরেজি আর বাংলার প্রকাশভঙ্গী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাই নিখুঁত আক্ষরিক অনুবাদ করলে পাঠককে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। তবুও যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। আর কৃষ্ণকায় মানুষরা সে সময় যেভাবে ইংরেজি বলতেন, সেটা আমি বাঙলা করবার চেষ্টা করিনি – স্বাভাবিক কারণেই। কৃত্রিমতা এসে যেত। তাদের কথাবার্তা আমি সোজা বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছি। শুধু এই দু ধরণের স্বাধীনতা আমি এই অনুবাদে নিয়েছি। ইংরেজি নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলায় নাম দিয়েছি যে দিন ভেসে গেছে (রবীন্দ্রনাথের গানের একটা পঙতি)।
ধন্যবাদান্তে।
উৎপল দাশগুপ্ত
(১)
স্কা
|
রলেট ও’হারা কে সেভাবে সুন্দরী বলা যায় না। তবে সব পুরুষই তার মাধুর্যে এতটাই আকৃষ্ট হত যে কেউ সেটা ধরতে পারত না; যেমন টার্লটন যমজ ভাইরা।
মায়ের মুখের ফরাসি আভিজাত্যের ছোঁয়া আর আইরিশ বাবার মুখের দৃঢ়তার এক অপূর্ব মিশেল স্কারলেটের মুখমণ্ডলকে আকর্ষক করে তুলেছিল। হালকা সবুজের আভা ছিল তার চোখ দুটিতে, চোখের লম্বা পালক আর ভ্রূদ্বয় ছিল ঘন কালো; ত্বকে ছিল শ্বেতশুভ্র পেলবতা। জর্জিয়ার প্রখর সূর্যালোক থেকে এই শুভ্রতা রক্ষা করার জন্য মহিলারা শিরাবরণ, অবগুণ্ঠন এবং আরও নানা ধরণের আচ্ছাদন ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন।
১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসের এক উজ্জ্বল অপরাহ্ণ। স্কারলেট তার বাবার কার্পাস বাগানের ঘেরা বারান্দায় স্টুয়ার্ট এবং ব্রেন্ট টার্লটনদের সাথে বসে গল্প করছিল। ওকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। পরনে ছিল বারো গজের প্রাচুর্যময় সবুজ মসলিনের পোষাক। পায়ে তার বাবার আটলান্টা থেকে নিয়ে আসা মানানসই সবুজ মরোক্কো চামড়ার স্লিপার। পোষাকটি তার সতেরো ইঞ্চির কোমরটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছিল। তার ষোল বছরের তুলনায় পূর্ণবিকশিত বক্ষদেশকে আড়ালও করে রেখেছিল। তার পোষাক ছিল অত্যন্ত শালীন। কেশরাশি সুসম্বদ্ধ ভাবে খোঁপা করে নেট দিয়ে মাথার পেছনে আটকানো। তুষারশুভ্র হাত দুখানি কোলের ওপর জড় করা। চোখের চাউনি কিন্তু বিপরীত ইঙ্গিত বহন করছিল। সযত্নে লালিত স্নিগ্ধ মুখমণ্ডলে্র সবুজাভ দৃষ্টিতে প্রাণবন্ত এবং বলিষ্ঠ অবাধ্যতা উঁকি মেরে যাচ্ছিল। মায়ের মৃদু উপদেশ আর তার ‘ম্যামি’র কঠোর অনুশাসন তার আচ্ছাদনে অবতীর্ণ হতে পারলেও, তার চোখে নয়; চোখের ভাষা নিতান্তই তার নিজস্ব।
দুই ভাই, স্কারলেটের দু’পাশে রাখা দুটো চেয়ারে বসে হেসে হেসে গল্প করছিল। রোদ-চশমা থাকা সত্বেও, রোদের তেজে তাদের দৃষ্টি কিছুটা তির্যক। দুজনেই পায়েই হাটুর নীচে পর্যন্ত ঢাকা জুতো। মৌরসিপাট্টা মেরে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে। দুজনেরই বয়স ১৯ বছর। ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা। বলিষ্ঠ ব্যায়ামপুষ্ট চেহারা। রোদে ঝলসে যাওয়া মুখ। গাঢ় বাদামী লাল চুল। অহংকারি কিন্তু রঙ্গপ্রিয় দৃষ্টি। পরনে একই ধরনের নীল রঙের কোট আর সর্ষে রঙের ব্রীচ। মোটকথা এদের দুজনকে একে অন্যের থেকে আলাদা করা কঠিন।
বাইরে পড়ন্ত সূর্যের আলো ডগউড গাছের শ্বেত পুষ্পপল্লবের আবরণের ওপর বিচ্ছুরিত হয়ে শ্যামল পটভুমিকে ঝলমলে করে তুলেছে। টার্লটন ভাইদের বড় লাল ঘোড়া দুটো বাইরের উঠোনে বাধা। পোষা কুকুরদুটো ঘোড়াগুলোর পায়ের কাছে খুনসুটি করছিল। কুকুরদুটো স্টুয়ার্ট আর ব্রেন্টের সর্বক্ষণের সঙ্গী। এছাড়া ছিল কালো ছোপ ছোপ একটি পাহারাদার সারমেয়। খানিক অলস অভিজাত ভঙ্গিতে সে তার মালিকদ্বয়ের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা করছিল, কারণ সাপারের সময় এগিয়ে আসছিল।
নিত্য সঙ্গী এই প্রাণীকুলের সাথে ভ্রাতৃদ্বয়ের অন্তরঙ্গতা যতটা দৃশ্যমান আসলে তা ছিল তার থেকেও অনেক বেশী গভীর। এরা প্রত্যেকেই খুব স্বাস্থ্যবান, সজীব, ছটফটে, হঠকারী আর বিপজ্জনক। অবশ্য এদের মন জুগিয়ে চলতে পারলে সমস্যা হত না।
কার্পাস বাগানমালিকের সন্তান হওয়ার সুবাদে, দুই ভাইকে আশৈশব নিজে হাতে কোনোও কাজ করতে হয় নি। তা বলে এদের মুখ দেখে এদের নরম বা ঢিলে মনে করার কোন কারন নেই। লেখাপড়ার আর বইখাতার মত নীরস বস্তুর সম্পর্কবর্জিত যে কোনোও দেহাতি লোকের মতই এরাও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর আর তৎপর। অগাস্টা, স্যাভান্না এবং চার্লস্টনের তুলনায়, উত্তর জর্জিয়ার এই ক্লেটনের বসতি কিছুটা নতুন এবং খানিক অমার্জিত। দক্ষিণ অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বনেদী এবং মার্জিত রূচিসম্পন্ন লোকেরা জর্জিয়ার অধিবাসীদের ব্যাপারে বেশ নাক উঁচু মনোভাব পোষণ করতেন। যদিও এতে জর্জিয়ার মানুষের খুব একটা এসে যেত না। লেখাপড়া না জানাকে এরা মোটেই সম্মানহানিকর বলে মনে করত না। বরং তৎপর এবং করিৎকর্মা হওয়াটাকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। ভাল মানের কার্পাস উৎপাদন, ঘোড়ায় চড়তে জানা, ভাল নিশানাবাজ হওয়া, অভিজাত এবং রুচিশীল মহিলাদের সাথে পরিচিত হওয়া এবং ভদ্রলোকের মত নিজের পানীয় বহন করা।
উপরোক্ত সবকটি ব্যাপারেই এই যমজ ভ্রাতৃদ্বয় এক নম্বরে ছিল। শুধু তাই নয়, বইয়ের দুই মলাটের ভেতর যা কিছু বলা থাকত, সেটা না শিখতে পারার পারদর্শিতাতেও এরা কারোর থেকে পিছিয়ে ছিল না। এই কাউন্টির অন্য পরিবারের তুলনায়, এদের অর্থবল, অশ্ববল, আর ক্রীতদাসের সংখ্যা অনেক বেশী ছিল, যদিও এই দুই ভাই স্বাক্ষরতার নিরিখে তাদের দরিদ্রতর প্রতিবেশীদের থেকে বেশ পিছিয়ে ছিল।
এই বিশেষ কারনেই, এপ্রিল মাসের এই অপরাহ্ণবেলায়, টারার বারান্দায় এই অলস আসর বসেছিল। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় খুব সম্প্রতি এই দুই ভাইকে বহিষ্কার করেছে। গত দু’বছরে, এটা চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয় যারা এদের বহিষ্কার করল। টম আর বয়েড, এদের বড় দুই ভাইও, ওদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে, কারন যেখানে এই যমজ ভাইরা স্বাগত নয়, সেখানে তারাও থাকতে রাজী নয়। স্টুয়ার্ট আর ব্রেন্ট নিজেদের এই বহিষ্কারকে একটা বড় ধরনের রসিকতা বলেই মনে করছে। আর স্কারলেট, গত বছর ফ্যেয়াটভিল মহিলা একাডেমি ছাড়ার পরে যে নিজের ইচ্ছেয় একটাও বই পড়েনি, সেও এটাকে একটা মজাদার ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে চায় না।
“আমার ধারণা, তোমরা দুভাই, এমন কি টমও এই তাড়িয়ে দেওয়াটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাও না,” সে বলল। “কিন্তু বয়েডের ব্যাপারটা কি? ওর মধ্যে তো আবার লেখাপড়া শেখার একটা ঝোঁক রয়েছে। আর ওকে তোমরা দুজনে মিলে প্রথমে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তারপর অ্যালাবামা, তারপর সাউথ ক্যারোলাইনা আর এখন জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে আনলে! এভাবে চললে ও যে আর কোনদিন পড়াশোনা শেষ করে উঠতে পারবে না।”
“আরে ও ফ্যেয়াটভিলে জাজ পারমালীর অফিসে গিয়ে আইনও শিখতে পারে,” ব্রেন্ট বেশ অবহেলার সঙ্গে বলল। “তা ছাড়া এমনিতেও টার্ম শেষ হওয়ার আগেই আমাদের বাড়ী ফিরে আসতে হত।”
“কেন?”
“কেন আবার, যুদ্ধ! যে কোন দিন যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আর তুমি নিশ্চয়ই মনে কর না যে যুদ্ধের সময় আমরা কলেজে থাকব। তাই না?”
স্কারলেট একটু যেন বিরক্ত হল। “তোমরা ভাল করেই জান, ও সব যুদ্ধ-টুদ্ধ কিছুই হবে না। এ সব নিতান্তই গুজব। এই তো, গত সপ্তাহেই, অ্যাশলে উইল্কস আর তার বাবা আমার বাপীকে বলছিলেন ওয়াশিংটনে আমাদের কমিশনারদের সাথে মিঃ লিঙ্কনের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি হতে চলেছে – আমাদের কনফেডারেটের১সঙ্গে। আর ইয়াঙ্কিদের২ আমাদের সাথে যুদ্ধ করবার সাহসই নেই। কোন যুদ্ধই হবে না, আর আমি যুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।” [১ কনফেডারেট – গৃহযুদ্ধের সময় আমেরিকার দক্ষিণের ১১ টি রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করবার পক্ষে ছিল। এদের সংক্ষেপে কনফেডারেট বলা হত। যারা এই বিচ্ছিন্নতাবাদের বিপক্ষে ছিল অর্থাৎ উত্তরের রাজ্যগুলো, তাদের বলা হত ইউনিয়নিস্ট] [২ ইয়াঙ্কি – ইউনিয়নিস্টদের পক্ষ নিয়ে যারা লড়াই করেছিল তাদের বলা হত]
“কি বললে, যুদ্ধ হবে না!” দুই ভাই এমন ক্রুদ্ধভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেন মনে হল ওরা খুব ঠকে গেছে।
“যুদ্ধ নিশ্চয়ই হবে সোনা,” স্টুয়ার্ট বলল। হতে পারে ইয়াঙ্কিরা আমাদের ভয় পায়; কিন্তু জেনারাল বোরিগার্ড৩যে ভাবে ওদের ফোর্ট সামটার৪ থেকে পরশুদিন তাড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে ওদের যুদ্ধ করা কিংবা সবার সামনে নিজেদের কাপুরুষ প্রমান করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কেন, কনফেডারেসি _____” [৩ জেনারাল বোরিগার্ড – ১৮৬১ তে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনী ছেড়ে কনফেডারেটদের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারাল হিসেবে যোগ দেন] [৪ ফোর্ট সামটার – ইউনিয়নিস্ট সৈন্যরা চার্লসটনের ফোর্ট সামটারে কনফেডারেটদের কাছে হেরে যায়। এই ঘটনাই গৃহযুদ্ধের সূচনা করে]
স্কারলেট বিরক্ত মুখভঙ্গী করল।
“আর একবারও যদি তোমরা এই ‘যুদ্ধ’ কথাটা উচ্চারণ কর, আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেব। ‘যুদ্ধ’ আর‘অপসারণ’ এই দুটো কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সকাল থেকে রাত্রি, সারাটা সময়, বাপী শুধু যুদ্ধের কথাই বলবেন। এমনকি, তাঁর সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে আসেন তাঁরাও কেবল ফোর্ট সামটার, রাষ্ট্রের অধিকার, অ্যাবে লিঙ্কন এছাড়া আর কথা বলার কিছু পান না। এত বিরক্তিকর লাগে যে মাঝে মাঝে আমার চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। এমন কি কম বয়সি ছেলেরাও - আর তাদের ট্রুপ - এছাড়া যেন কিছু বলবার বিষয়ই পায় না। বসন্তের পার্টিটাই মাটি হয়ে গেল ছেলেদের এই একমুখি আলোচনার জন্য। জর্জিয়া যে অন্তত বড়দিনের পর ইউনিয়ন থেকে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতে আমি খুবই খুশী। নইলে বড়দিনের পার্টিটাও মাটি হয়ে যেত! আর একবারও যদি ‘যুদ্ধ’ কথাটা তোল, তাহলে আমি কিন্তু ঘরে চলে যাব।”
কথাটা স্কারলেট মন থেকেই বলেছিল। যে সব আলোচনার মূল বিষয়বস্তু সে নয়, সে ধরণের আলোচনা বেশীক্ষণ সহ্য করার মত ধৈর্য ওর নেই। অবশ্য কথাগুলো বলার সময় সে সচেতন ভাবে হাসছিল যাতে তার গালের টোল পড়াটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার লম্বা কালো চোখের পালকগুলো প্রজাপতির পাখার মত আন্দোলিত হচ্ছিল। ছেলেদুটো মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল। স্কারলেটও সেটাই চাইছিল। ওরাও ওকে বিরক্ত করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিল। ওর যুদ্ধে আগ্রহ না থাকার ব্যাপারটাকে ওরা মোটেই হেয় করে দেখল না। বরং ওদের মনে হল যুদ্ধ ব্যাপারটা পুরুষ মানুষের বিষয়, মেয়েদের নয়। এ ব্যাপারে অনাগ্রহ, ওদের মনে ওর নারীসুলভ কমনীয়তার প্রমাণ বলেই মনে হল।
একটা ক্লান্তিকর বিষয় থেকে আলোচনা ঘুরিয়ে দিয়ে স্কারলেট ওদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে কথাবার্তায় আবার সচেষ্ট হল।
“তোমাদের আবার বহিষ্কার হওয়া নিয়ে তোমাদের মা কি বলছেন?”
দুই ভাই একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তিন মাস আগে, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিশেষ অনুরোধে ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করে মায়ের ব্যবহার ওদের মনে পড়ে গেল।
স্টুয়ার্ট বলল, “এখনও কিছু বলার সুযোগ পান নি। টম আর আমরা - মা ঘুম থেকে ওঠার আগেই - বেরিয়ে পড়েছি। টম গেছে ফোনটেনদের ওখানে - আমরা এখানে তোমার কাছে।”
“কাল রাতে যখন বাড়ি এলে তখন কিছু বলেন নি?”
“তা বলতে পারো ভাগ্য সহায় ছিল। আমাদের আসার ঠিক আগেই, গত মাসে কেনটাকিতে মা যে মদ্দা ঘোড়াটা কিনেছিলেন, সেটা নিয়ে আসা হয়েছিল। রাস্তাতেই ঘোড়াটা তাঁর বন্য স্বভাবের পরিচয় দিল। জোন্সবোরোতে ট্রেন থেকে যারা ওকে আনতে গেছিল, তাদের মধ্যে দুটো নিগ্রোকে ঘোড়াটা পায়ের তলায় পিষে ফেলে। ঠিক আমরা ঢোকার আগেই, মায়ের বুড়ো মদ্দা ঘোড়াটাকে তো লাথি মেরে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। মা তখন এক বস্তা চিনি নিয়ে ঘোড়াটাকে শান্ত করছিলেন। দারুণ কাজ হয়েছিল। আর নিগ্রোগুলো ভয়ে কড়িবরগায় ঝুলে গোল গোল চোখ করে একবার মা’কে আর একবার ঘোড়াটাকে দেখছিল। মা ঘোড়াটার সাথে গল্প করতে করতে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছিলেন, যেন ওটা একটা ছোট্ট ছেলে। সত্যিই ঘোড়াকে তোয়াজ করার ব্যাপারে মায়ের ধারেকাছে কেউই লাগে না। আমাদের দেখে বললেন, “হে ভগবান, তোমরা এখন বাড়িতে কি করছ? খুবই অপদার্থ তো তোমরা!” ঘোড়াটা আবার অশান্ত হয়ে চিঁহি চিঁহি করা শুরু করল। তখন মা বললেন, “যাও, তোমরা এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। দেখতে পাচ্ছ না সোনামনি তোমাদের দেখে ভয় পাচ্ছে! কাল সকালে আমি তোমাদের ব্যাপারে ফয়সলা করব।” তাই ভোর হতে না হতেই, আমরা তিনজনেই কেটে পড়েছি, মার সামনে যাতে না পড়তে হয়। বয়েড আছে মার সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য।”
“বয়েডের গায়ে আবার হাত তুলবেন না তো?” যে ভাবে মিসেজ় টার্লটন তাঁর সাবালক ছেলেদের ওপর তর্জন করেন সেটা কাউন্টির অন্য সবার মত স্কারলেটেরও চোখে লাগে। দরকার বুঝলে, ঘোড়ার চাবুকটাও ছেলেদের পিঠে চালিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
বিয়াট্রিস টার্লটন একজন অত্যন্ত ব্যস্ত মহিলা। তিনি একটা বড় কার্পাস বাগানের পরিচালনা করতেন। একশ জন নিগ্রো আর আটটি ছেলে মেয়ের দায়িত্ব সামলাতেন। এছাড়া এলাকার সর্বোত্তম অশ্ব প্রজনন কেন্দ্রও তাঁরই তত্বাবধানে ছিল। বেশ বদমেজাজি মানুষ। ছেলেরা মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে বসত আর তিনি রেগে আগুন হয়ে যেতেন। তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল যে ঘোড়া কিংবা ক্রীতদাস, কারও ওপরে চাবুক চালানো যাবে না। তবে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা যে ছেলেদের পিঠে চাবুক পড়লে ক্ষতির চেয়ে লাভই হবে বেশি।
“না – নাহ মা বয়েডকে মারবেন না। ওর গায়ে মা কখনই হাত তোলেন নি। বয়েড আমাদের মধ্যে সব থেকে বড় আবার সব থেকে ছোটখাটো।” স্টুয়ার্ট, নিজের ছ ফুট দুই ইঞ্চির কথা ভেবে, বেশ একটু গর্বের সাথেই বলল। “এজন্যই তো মাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলবার জন্য ওকে রেখে এসেছি। ভগবান করুন, মা যেন আমাদের মারধোর করার অভ্যেসটা ছেড়ে দেন। আমরা উনিশ, টম একুশ; অথচ মা এমন ব্যবহার করেন যেন আমাদের বয়েস মাত্র ছয়!”
“কাল উইল্কসদের বারবেকিউ পার্টিতে তোমাদের মা নতুন ঘোড়ায় চেপে আসবেন কি?”
“ইচ্ছে তো ছিল। কিন্তু বাবা বললেন এখনও ওটা খুবই বিপজ্জনক। আর মেয়েরাই ওঁকে আসতে দেবে না। ওরা বলেছে, অন্তত একটা পার্টিতে মা যেন লেডির মত যান, ঘোড়ার গাড়ি চেপে।”
“কাল নিশ্চয়ই আর বৃষ্টি হবে না,” স্কারলেট বলল। “এ সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়েছে। বারবেকিউ যদি শেষ পর্যন্ত ঘরের ভেতরে গিয়ে মানাতে হয়, তার থেকে খারাপ আর কিছু হতেই পারে না।”
“আরে না না। কাল আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আর জুন মাসের মত গরম থাকবে,” বলল স্টুয়ার্ট। একবার সূর্যাস্তটা লক্ষ কর। এতটা লাল আগে কখনও দেখিনি। আবহাওয়া কেমন থাকবে সূর্যাস্ত দেখেই আন্দাজ করা যায়।”
জেরাল্ড ও’হারার সদ্যকর্ষিত আবাদি বহু দূরে গিয়ে রক্তিম দিকচক্রবালরেখার সাথে মিশে গিয়েছে। ফ্লিন্ট নদী ছাড়িয়ে টিলার পেছনে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে রক্তিমাভা ছড়িয়ে ঢলে পড়ছে। এপ্রিল মাসের উষ্ণতা সরে গিয়ে বাতাসে মৃদু শীতল ভাব। ওরা সেদিকে তাকিয়ে রইল।
এ বছর বসন্ত একটু আগেই এসে গিয়েছে। কখনো কখনো হালকা বৃষ্টি। বাতাস সামান্য উষ্ণ। পীচের গোলাপি মুকুল আর ডগউডের শ্বেতশুভ্র ফুলে জলা আর দূরবর্তি টিলাগুলো আবৃত। জমির হালচাষ প্রায় শেষের মুখে। অস্তগামী সূর্যের অরুণাভা, জর্জিয়ার লাল মাটিতে প্রতিফলিত হয়ে গাঢ়তর লালবর্ণ ধারণ করেছে। আলের ওপরের মাটিতে গোলাপী আভা। ছায়া ঘেরা নীচের মাটিতে সিঁদুরে লালের ছ্বটা। চুনকাম করা ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ইটের বহির্বাটিগুলো লালের সমুদ্রে কতগুলো দ্বীপের মত লাগছে। সমতল মধ্য জর্জিয়ার হলুদ মাটির মত কিংবা উপকূলবর্তী কালো মাটির আবাদির মত উত্তর জর্জিয়ার আলগুলো সোজা আর লম্বা নয়। অজস্র আলপথ এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে। নদীর জল যাতে এই উর্বরা জমিকে ধুয়ে না দিতে পারে।
জর্জিয়ার এই লাল মাটিই হল তুলো উৎপাদনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ। বর্ষাকালে এই মাটি রক্তের মত লাল, খরায় ইটের গুঁড়োর মত। মমতাময় সাদা গৃহের সারি, শান্ত চষা জমি আর শ্লথগতি হলুদ নদীর দেশ। আবার বৈপরিত্যেরও সমাহার ঘটেছে এ দেশে। সূর্যের তীব্র রশ্মি। আবার ছায়াঘন সবুজ বন। দিগন্ত বিস্তৃত কার্পাস আবাদি উষ্ণ সূর্যালোকে প্রশান্ত প্রসন্নতায় হেসে ওঠে। সীমান্ত জড়িয়ে আছে ঘন অরণ্যে; গ্রীষ্মের দাবদাহে যে অরণ্য শীতল, খানিক রহস্যময়ী, প্রাচীন, সহিষ্ণু। যেন মৃদুস্বরে বলছে, “সাবধান, সাবধান! আমরা একবার তোমাদের গ্রাস করেছিলাম। আবারও করতে পারি।”
বাইরে থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, লোহার শেকলের ঝিনঝিনি, নীগ্রোদের তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ ভেসে এল। তিনজনেই বুঝতে পারল, জমি চষা শেষ করে আজকের মত শ্রমিকেরা খচ্চর নিয়ে ফিরে এল। বাড়ির ভেতর থেকে স্কারলেটের মা এলেন ও’হারার মৃদু স্বর ভেসে এল। তাঁর চাবির বাক্সবাহিকা কালো মেয়েটিকে ডাকলেন। মেয়েটি বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিল, “আজ্ঞে, যাই।” তার পায়ের শব্দ পাকশালার দিকে মিলিয়ে গেল। এখানেই এলেন মাঠ থেকে ফেরা শ্রমিকদের প্রাপ্য খাদ্য সামগ্রী ভাগ করে দেবেন। চিনে মাটির বাসন আর রুপোর কাঁটা ছুরি চামচের আওয়াজ ভেসে আসছে টুংটাং। সাপারের (সান্ধ্য আহারের) জন্য পোর্ক টেবিল সাজাচ্ছে। পোর্ক টারার খানসামা।
শেষ আওয়াজে দুই ভাই বুঝতে পারল যে এবার তাদের বাড়ি ফেরা উচিত। মায়ের মূখোমুখি হবার একদম ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই সময় নিচ্ছিল। আর মনে মনে আশা করছিল, স্কারলেট ওদের সাপারে আহ্বান জানাবে।
“কালকের কথাটা একটু ভেবে রেখ স্কারলেট,” ব্রেন্ট বলল। আমরা এখানে ছিলাম না। বারবেকিউ আর বল নাচের কথাও জানা ছিল না। তাই বলে কাল সন্ধ্যায় আমরা যথেষ্ট নাচের সুযোগ পাব না, সেরকম নিশ্চয়ই হবে না। তুমি নিশ্চয়ই সবাইকে আবার কথা দিয়ে রাখ নি?”
“সত্যিই দিয়ে ফেলেছি। কি করে জানব যে তোমরা চলে আসবে? শুধুই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করলে একা হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকত যে।”
“তু -- মি! একা হয়ে যেতে!” ছেলে দুটো খুব জোরে হেসে উঠল।
“দেখ ডার্লিং, কথা দাও যে প্রথম ওয়াল্টস তুমি আমার সঙ্গে নাচবে আর একদম শেষেরটা স্টু-এর সাথে। আর হ্যা, সাপারটা আমরা একসাথেই খাব। সিঁড়ির ল্যানডিঙে বসব, যেমন আগের বার বসেছিলাম আর ম্যামি জিন্সিকে আবার আমাদের ভাগ্য বলে দিতে বলব।”
“আমি ম্যামি জিন্সির ভাগ্য গণনায় বিশ্বাস করি না। মনে নেই বলেছিল যে আমার বিয়ে হবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যার চুল হবে ঘন কালো রঙের আর লম্বা কালো গোঁপ থাকবে! আমি কালো চুলের লোক মোটেই পছন্দ করি না।”
“তুমি নিশ্চয়ই লাল চুল ভালোবাস, তাই না ডার্লিং?” ব্রেন্ট এক গাল হাসল। যাই হোক তুমি আমাদের ওয়াল্টস আর সাপারের জন্য কথা দিলে কিন্তু।”
“কথা যদি দাও, তাহলে একটা গোপন কথা তোমাকে বলে দেব,” স্টুয়ার্ট বলল।
“কি গোপন কথা?” স্কারলেট উত্তেজনায় বাচ্চা মেয়ের মত চেঁচিয়ে উঠল।
“যেটা কাল অ্যাটলান্টায় শুনলাম, সেটা কি স্টু? তাই যদি হয়, সেটা কাউকে বলব না বলে কথা দিয়েছি যে।”
“হ্যা, মিস পিটি যেটা বললেন।”
“মিস কে?”
“অ্যাশলে উইল্কস কে তো তুমি জান। ওর পিসী – মিস পিটিপ্যাট হ্যামিলটন – চার্লস আর মেলানি হ্যামিলটনেরও পিসী। অ্যাটলান্টায় থাকেন।”
“খুব চিনি! আর ওঁর মত বোকার হদ্দ বুড়ি আর একটা দেখিনি।”
“সে যা হোক, কাল যখন আমরা অ্যাটলান্টায় বাড়ি আসার ট্রেনের অপেক্ষা করছিলাম, ওঁর ঘোড়ার গাড়ি ডিপোর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। উনি কিছুক্ষণ আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন। তখনই বললেন যে উইল্কসদের বল পার্টিতে কাল একটা বাগদানের ঘোষণা করা হবে।”
“ওঃ, সে তো জানি,” স্কারলেট হতাশ স্বরে বলে উঠল। ওই যে ওঁর বোকচন্দর ভাইপোটা – চার্লি হ্যামিলটন আর হানি উইল্কস। সবাই জানে – অনেক বছর ধরেই জানে – যে ওরা একদিন না একদিন বিয়ে করবে। যদিও চার্লির এ ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ আছে বলে কোনোদিনই মনে হয় নি।”
“ওকে বোকা মনে কর তুমি?” ব্রেন্ট জিজ্ঞেস করল। “গত বড়দিনে, তুমি ওকে তোমার পাশে খুব ঘুর ঘুর করতে দিয়েছিলে।”
“কোন উপায় ছিল না,” স্কারলেট কাঁধ ঝাঁকাল। “ওকে আমার কেমন যেন ভিতু ভিতু মনে হয়।”
“আর তা ছাড়া ওদের বাগদানের কথা ওখানে মোটেই ঘোষণা করা হচ্ছে না।” স্টুয়ার্ট কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল। “অ্যাশলের সাথে মেলানির – মানে চার্লির বোনের বাগদান।”
স্কারলেটের মুখের অভিব্যাক্তি বদলাল না, কিন্তু ওর ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গেল। কোন পূর্বাভাষ ছাড়াই হঠাৎ ধাক্কা খেলে যেরকম হয়। প্রথমে বুঝতেই পারল না কি হয়েছে। সে এত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যে যখন ও স্টুয়ার্টের দিকে তাকাল, সে ধরেই নিল যে স্কারলেট খুবই আশ্চর্য হয়েছে এবং আরো কিছু জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। স্টুয়ার্টের বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা খুব পাকা নয়।
“মিস পিটি বলছিলেন যে এই ঘোষণা হয়ত পরের বছরের জন্যই মুলতুবি থাকত; বিশেষ করে মেলানির শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু যে ভাবে চারদিকে শুধু যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, তাতে দুটো পরিবারই চাইছে বিয়েটা তাড়াতাড়ি মিটে গেলেই ভাল। তাই কাল সন্ধ্যেবেলা খাবার সময় এই বাগদানের ঘোষণা করা হবে। দেখ স্কারলেট তোমাকে গোপন কথাটা বলেই ফেললাম। তোমাকে আমাদের সাথে সাপার খাওয়ার কথা দিতেই হবে।”
“সে আর বলতে,” স্কারলেট যান্ত্রিকভাবে বলল।
“আর ওয়াল্টস গুলো?”
“সব।”
“তুমি খুব মিষ্টি! বাজী ধরতে পারি, অন্য ছেলেরা হিংসেয় নীল হয়ে যাবে!”
“করুক যত খুশী হিংসে,” ব্রেন্ট বলল। ওদের দেখে নেবার জন্য আমরা দুজনই যথেষ্ট। কাল সকাল থেকেই বারবেকিউতে বসছি আমরা।”
“কি বললে?”
স্টুয়ার্ট আবার বলল।
“নিশ্চয়ই।”
দু ভাই একে অন্যের দিকে বিজয়ী দৃষ্টিতে তাকাল। যদিও একটু অবাক যে হয় নি তা নয়। ওরা বিশ্বাস করে যে ওরাই স্কারলেটের পছন্দের পাণিপ্রার্থী। কিন্তু এই প্রথম ও এত সহজে রাজী হয়ে গেল। সাধারণত, ও ওদের অনুরোধ উপরোধ করতে বাধ্য করে, হ্যা কিংবা না কিছুই বলতে চায় না। ওরা অভিমান করলে হেসে উড়িয়ে দেয়, রেগে গেলে নিরুত্তাপ হয়ে যায়। আর এখন কাল প্রায় সারাদিনের জন্য কথা দিয়ে দিল। বারবেকিউতে এক সাথে বসবে, সব কটা ওয়াল্টস এক সাথে (আর ওরা চেষ্টা করবে যাতে কাল শুধু ওয়াল্টস নাচই হয়)আর সাপার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হওয়া মনে হচ্ছে যেন একটা আশীর্বাদ।
সাফল্য লাভ করার উত্তেজনায়, দুজনে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল। বারবেকিউর কথা, বল নাচ, অ্যাশলে উইল্কস, মেলানি হ্যামিলটন এই সব। একজন অন্যজনের কথার পিঠে কথা বলে, নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করে, আর মাঝে মাঝেই সাপারে নিমন্ত্রণ করার জন্য স্থুল ইঙ্গিত করে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওদের খেয়াল হল স্কারলেট কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আবহাওয়াটা যেন পালটে গেছে। কিন্তু কিভাবে সেটা ওদের মাথায় ঢুকল না, অপরাহ্ণের সেই দ্যুতি এখন ম্রিয়মাণ। যেন ওরা কি বলাবলি করছে, স্কারলেট তাতে মন দিচ্ছে না, যদিও প্রয়োজনে তার প্রতিক্রিয়া গুলো একেবারে ব্যাকরণ মেনে সঠিক। অতএব আরো কিছুক্ষণ কথা চালাবার চেষ্টা করে, কিছুটা হতবুদ্ধি, কিছুটা বিরক্ত হয়ে অবশেষে দু ভাই অত্যন্ত অনিচ্ছাসহকারে ঘড়ির দিকে তাকাল।
সূর্য একেবারে পাটে নেমে গেছে। নদীর অন্য পারে লম্বা গাছগুলোকে কালো ছায়ামূর্তির মত লাগছে। সোয়ালো পাখিরা দ্রুত পায়ে উঠোন পেরিয়ে আসছে। মুর্গি, হাঁস আর টার্কির দল হেলতে দুলতে মাঠ থেকে ফিরে আসছে।
স্টুয়ার্ট হাঁক লাগাল “জীমস!” একটু বাদেই, একজন লম্বা কালো ছেলে, দু ভাইয়েরই সমবয়সিই হবে, ছুটতে ছুটতে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাঁধা ঘোড়ার পাশে দাঁড়াল। জীমস দুই ভাইয়ের নিজস্ব পরিচারক। ছোটবেলায় একসাথে খেলাধুলো করেছে। ওদের দশম জন্মদিনের উপহার হিসেবে জীমসকে পেয়েছে। ওকে দেখতে পেয়ে কুকুরগুলো ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়ল। ছেলে দুটো বাও করে স্কারলেটের করমর্দন করল। বলল কাল ওরা ভোর হতেই উইল্কসদের ডেরায় পৌঁছে যাবে আর স্কারলেটের অপেক্ষা করবে। এরপর ওরা ঘোড়ায় চেপে রওয়ানা দিল; পেছনে পেছনে জিমস।
রাস্তা ধরে কিছুটা যাবার পরে বাঁক নিতেই, টারা যখন চোখের আড়াল হল, ব্রেন্ট একটা ডগউড গাছের তলায় ঘোড়া থামাল। স্টুয়ার্টও। কালো পরিচারকটিও একটু পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাগাম হালকা হতেই ঘোড়া দুটো জমি থেকে নরম ঘাস খেতে শুরু করল। কুকুরগুলো আবার লাল মাটিতে শুয়ে পড়ে সতৃষ্ণ চোখে সোয়ালো পাখির আনাগোনা দেখতে লাগল। ব্রেন্টের চওড়া অকপট মুখে একটা বিহ্বল ছাপ; হয়ত সামান্য অসন্তুষ্টও।
“দেখ,” সে বলল। “তোর মনে হয় না যে আমাদের সাপারে ডাকা উচিত ছিল ওর?”
“আমি তো ভেবেছিলাম ডাকবে,” স্টুয়ার্ট বলল। “আমি অপেক্ষা করতেই থাকলাম, কিন্তু কোথায় করল? কি মনে হয় তোর?”
“কিছুই বুঝতে পারছি না। আমারও তো তাই মনে হয়েছিল। অনেকদিন বাদে দেখা হল। আমাদেরও বলবার অনেক কিছুই ছিল!”
“মনে তো হয়েছিল, আমাদের দেখে ও খুব খুশী হয়েছে। যখন আমরা এলাম।”
“আরে আমিও তো তাই ভেবেছিলাম।”
“তারপর, শেষের দিকটায় একদম যেন চুপ মেরে গেল। এমন ভাব করল যেন খুব মাথা ধরেছে!”
“হ্যা, আমিও খেয়াল করলাম। তবে ও নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাই নি। কি হয়েছিল বলে মনে হয় তোর?”
“কে জানে! আচ্ছা এমন কিছু কি আমরা বলে ফেলেছি – যাতে করে ও রেগে গেছে?”
“সেরকম কিছু তো মনে আসছে না। তা ছাড়া স্কারলেট যখন রেগে যায় সবাই জানতে পারে। অন্যান্য মেয়েদের মত চুপচাপ মেনে নেবার পাত্রীই নয় ও।”
“হ্যা ওর এই ব্যাপারটাই আমি খুব পছন্দ করি। রেগে গেলে অন্যদের মত একটা ঠাণ্ডা অথচ ঘৃণার মনোভাব নিয়ে বসে থাকে না। সোজাসুজি বলে দেয়। মনে হয় আমরা এমন কিছু একটা করেছি বা বলে ফেলেছি যেটা ওকে এত চুপচাপ হয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিংবা অসুস্থ বোধ করেছে। জোরের সাথে বলতে পারি, আমাদের দেখে ও খুশীই হয়েছিল আর আমাদের সাপারে ডাকবার কথাও ভেবেছিল।”
“আমরা বহিষ্কৃত হয়েছি বলে এরকম করল? তোর কি মনে হয়?”
“বোকার মত কথা বলিস না। দেখলি না যখন সেটা বললাম, কি রকম প্রাণ খুলে হাসল। আর স্কারলেটও বই, পড়াশুনো এসব ব্যাপারে আমাদের মত করেই ভাবে।”
ব্রেন্ট ঘোড়াটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে, নিগ্রো ছেলেটাকে ডাকল।
“জীমস!”
“আজ্ঞে?”
“মিস স্কারলেটের সাথে আমাদের কি কথাবার্তা হয়েছে শুনেছিস তো?”
“না না হুজুর – মিষ্টার ব্রেন্ট! আপনি কি করে ভাবলেন যে আমি আপনাদের কথাবার্তায় আড়ি পাতব?”
“আড়ি পাতিসনি! গুলি মার! তোরা কালোরা চার পাশে কি কি ঘটছে, সব জানিস। মিথ্যুক কোথাকার! আমি নিজের চোখে দেখেছি, তুই চন্দ্রমল্লিকার ঝোপের কাছে, আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলি! এখন বল, আমরা মিস স্কারলেটকে – রেগে যাবার মত কিংবা দুঃখ পাওয়ার মত কিছু বলেছিলাম কি?”
এভাবে আবেদন করার পর জীমস আর কোন ভনিতা না করে ভুরু কোঁচ করে একটু ভেবে নিল।
“না হুজুর, রেগে যাবার বা দুঃখ পাওয়ার মত কিছুই আপনারা বলেছেন বলে আমি তো শুনিনি। বরং আপনাদের দেখে উনি খুবই খুশী হয়েছিলেন, আর আপনাদের সাথে উনি খুব আনন্দের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তারপর যখন আপনারা মিস্টার অ্যাশলে আর মিস মেলি হ্যামিলটনের ব্যাপারে বললেন – ওরা বিয়ে করতে যাচ্ছে – তারপর থেকেই উনি চুপ করে গেলেন।”
ভাইরা পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, কিন্তু ব্যাপারটা ওদের বোধগম্য হল না।
“জিমস ঠিকই বলছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন,” স্টুয়ার্ট বলল। “ওর তো অ্যাশলের ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ কখনো দেখি নি। হ্যা ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু ওর ব্যাপারে কোন দূর্বলতা ছিল বলে জানি না।”
ব্রেন্ট ওর কথায় সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল –
“কিংবা এটা নয়তো – হয়ত অ্যাশলে বাগদানের ঘোষণার কথা ওকে নিজের মুখে বলে নি – একজন পুরোনো বন্ধুকে – অন্যদের বলার আগে – তাই ও হয়ত দুঃখ পেয়েছে। মেয়েরা আবার এসব ব্যাপারকে খুবই গুরত্ব দেয়।”
“হতেই পারে। নাই বা যদি বলে থাকে তো অসুবিধে কোথায়? চমক দেবার জন্য ব্যাপারটা গোপন রাখার অধিকার তো সবারই আছে; স্বাভাবিক ভাবেই কেউ চাইতে পারে তার বাগদানের খবর নিয়ে বেশী হইচই না হোক। কি বল? আমরাও তো জানতে পারতাম না। মেলির পিসী যদি না কথাটা আমাদের কাছে ফাঁস করতেন। কিন্তু স্কারলেটের তো জানা থাকার কথা যে আজ না হোক কাল অ্যাশলের সাথে মিস মেলির বিয়ে হতই। এ তো কত যুগ ধরে জানি। উইল্কস আর হ্যামিলটনরা সব সময় নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে। সবাই জানত। যেমন হানি উইল্কস মিস মেলির ভাই চার্লিকে বিয়ে করবে।”
“যেতে দে। তবে ভেবেছিলাম ও আমাদের সাপারে ডাকবেই। এখন বাড়ি ফিরে মায়ের মুখোমুখি হতে একদম মন চাইছে না রে। আমাদের বের করে দেওয়া নিয়ে অনেকক্ষণ বক বক শুনতে হবে – যেন আমাদের এই প্রথম বের করে দেওয়া হল!”
“দেখা যাক। হয়ত বয়েড এতক্ষণে ওঁকে সামলে নিয়েছে। বাঁটকুলিটা মানুষকে কথায় বশ করতে খুব ওস্তাদ কিন্তু। জানিসই তো মাকে ঠাণ্ডা করতে একমাত্র ও-ই পারে।”
“ঠিকই বলেছিস। তবে একটু সময় তো ওকে দেওয়াই উচিত। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে মাকে গুলিয়ে দেবে আর মা হাল ছেড়ে বলবেন যে ওই কথার মারপ্যাঁচ গুলো আইন ব্যবসায় কাজে লাগানোই বেশী ভাল। কিন্তু এত অল্প সময়ে বেচারা নিশ্চয়ই সব বুঝিয়ে উঠতেই পারেনি! কি মনে হয় জানিস? মা নতুন ঘোড়াটা নিয়ে এতই উত্তেজিত রয়েছে যে সাপারের টেবিলে বসার আগে খেয়ালই করবে না যে আমরা ফিরে এসেছি। বয়েডের সঙ্গে কথা বলা তো দুরস্ত! আর সাপারের আগেই একপ্রস্থ চেঁচামেচি হয়ে যাবে। রাত দশটার আগে বয়েড এটা বলার সুযোগই পাবে না যে চ্যান্সেলার তোর আর আমার সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তারপরে আমাদের কারোরই কলেজে থাকাটা সম্মানের হত না। আর মাকে চ্যান্সেলারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট করে তুলতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে, যখন মা শেষমেশ বয়েডকে বলবে যে ও কেন চ্যান্সেলারকে গুলি করল না! নাঃ, মাঝরাতের আগে কিছুতেই ঘরে ফেরা যাবে না!”
দু’ভাই বিমর্ষ চোখে একে অন্যের দিকে তাকাল। বুনো ঘোড়ার ব্যাপারে, শিকার করবার ব্যাপারে, প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলায় এদের মনে কোন ভয়ডর নেই। কিন্তু ওরা ওদের লাল চুল মায়ের বাক্যবানকে, বিশেষ করে মায়ের চাবুককে অত্যন্ত ভয় পায়, কারন দরকার পড়লে ওই চাবুক ওদের পিঠে পড়তে দেরি হয় না।
“তার থেকে চল উইল্কসদের ওখানে যাওয়া যাক,” ব্রেন্ট বলল। “অ্যাশলে আর মেয়েরা সাপারে আমাদের পেয়ে খুশীই হবে।”
স্টুয়ার্ট একটু অস্বস্তি বোধ করে।
“না না ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই কালকের বারবেকিউর আয়োজন নিয়ে ওরা ব্যস্ত আছে আর তা ছাড়া _____”
“ওঃ! একদম ভুলে গেছিলাম,” ব্রেন্ট তাড়াতাড়ি বলল। “নাঃ ওখানে যাওয়া চলবে না।”
এরপর বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ ওরা ঘোড়ায় চড়ে পাশাপাশি চলতে লাগল। স্টুয়ার্টের বাদামি গালে অস্বস্তি বোধ থেকে হালকা লালের ছোঁয়া। গত গ্রীষ্মের আগে পর্যন্ত স্টুয়ার্ট আর ইন্ডিয়া উইল্কসের মধ্যে একটা পূর্বরাগের সম্ভাবনা ঘোরাফেরা করছিল। দুই পরিবার আর পুরো কাউন্টির প্রকাশ্য সম্মতিতেই। সকলে মনে করেছিল ধীর স্থির ইন্ডিয়া উইল্কসের প্রভাবে স্টুয়ার্টও কিছুটা সংযত হয়ে উঠবে। হয়ত স্টুয়ার্ট ইন্ডিয়াকে বিয়ে করতে রাজীও হয়ে যেত। কিন্তু ব্রেন্ট এটাকে মেনে নিতে পারেনি। ও ইন্ডিয়াকে পছন্দ যে করত না তা নয়। কিন্তু মনে করত যে মেয়েটা খুবই সাধারণ আর ভীরু স্বভাবের। আর সেজন্যই ও কোনোদিনই ইন্ডিয়ার প্রেমে পড়েনি যাতে স্টুয়ার্টকে সঙ্গ দিতে পারে। সেই প্রথম দুই ভাইয়ের পছন্দ আলাদা আলাদা খাতে বইছিল। একজন অতি সাধারণ মেয়ের প্রতি অনুরক্ত হওয়ায় ও স্টুয়ার্টের ওপর মনে মনে একটু ক্ষুব্ধই হয়েছিল।
তারপর গত গ্রীষ্মে, জোন্সবোরোর ওকগাছ পরিবেষ্টিত পার্কে ওরা দুজনেই একসাথে আবিষ্কার করল স্কারলেটকে। অনেক বছর ধরেই চেনে ওকে। এক সময় খেলাধুলোও করেছে একসাথে – বলা যেতে পারে ওদের খুবই পছন্দের খেলার সাথী। কারন স্কারলেট ওদের মতই, গাছে আর ঘোড়ায় চড়তে, দুটোতেই সমান পারদর্শী ছিল। ওরা অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করল যে সেই স্কারলেট এক জন অত্যন্ত আকর্ষণীয় নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
জীবনে প্রথম লক্ষ্য করল যে ওর ডাগর সবুজ চোখ দুটো কেমন কথায় কথায় নেচে ওঠে। যখন হাসে, গাল দুটোতে কি গভীরভাবে টোল পড়ে। কি সুন্দর ছোট ছোট ওর হাত দুটো। কি সরু কটি! ওদের মন্তব্য শুনে স্কারলেট উচ্ছল হাসিতে একেবারে গড়িয়ে পড়ল। ওদের দুজনকে ও যে অসাধারণ জোড়ি বলে মনে করে সে কথা বলাতে ওরা একটু বেশী রকম গলে গেল।
সেটা ছিল ওদের জীবনের একটা স্মরণীয় দিন। মাঝে মাঝে যখন ওরা এ নিয়ে কথা বলত তখন দুজনেই এই ভেবে আশ্চর্য হত যে ওরা স্কারলেটকে আগে কেন লক্ষ্য করেনি! আসল কারনটা ওরা অবশ্য ধরতেই পারে নি, যেটা হল সেদিন স্কারলেটই চেয়েছিল ওরা ওকে লক্ষ্য করুক। কোন পুরুষ মানুষ তাকে ছাড়া আর কারও প্রেমে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া স্কারলেটের পক্ষে অসম্ভব ছিল। স্টুয়ার্ট আর ইন্ডিয়া উইল্কসকে হেসে গল্প করতে দেখায় ওর শিকারীসত্বা জেগে উঠেছিল। শুধু স্টুয়ার্টের শিকারেই তার মন ভরে নি, ব্রেন্টকেও তার মোহজালে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আবদ্ধ করেছিল। ওরা দুজনেই অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সঙ্গে এই ফাঁদে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বর্তমানে দুজনেই স্কারলেটের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ইন্ডিয়া উইল্কস আর লাভজয়ের লেটি মুনরো – যার সাথে ব্রেন্টের একটা শিথিল প্রেমের ব্যাপার চলছিল, এখন ওদের মনোজগত থেকে বহু দূরে চলে গেছে। যদি স্কারলেট ওদের দুজনের কোন একজনকে বেছে নেয়, তাহলে অন্য জন কি করবে এ প্রশ্ন কখনও ভেবে দেখে নি। যখন ব্যাপারটা দানা বাঁধবে তখন দেখা যাবে। এই মুহুর্তে অবশ্য একটি মেয়েতেই দুজনের মধ্যে কোন মনান্তর তৈরি করতে পারে নি। এরা একে অপরকে হিংসে করত না। এমন একটা পরিস্থিতি, যেটা তাদের প্রতিবেশীদের কাছে কৌতুহলের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর তাদের মায়ের কাছে বিরক্তির কারন। মা স্কারলেটকে একেবারেই পছন্দ করতেন না।
“ওই সেয়ানা মেয়েটা তোমাদের কোন একজনকে যদি বিয়ে করতে রাজী হয়, সেটাই হবে তোমাদের যথযোগ্য শাস্তি। এও হতে পারে যে ও তোমাদের দুজনকেই বিয়ে করতে চাইবে। তখন তোমাদের জর্জিয়া ছেড়ে উটায়৫ থাকতে হবে। অবশ্য মর্মনরা৬ যদি থাকতে দেয়! যেটা সব থেকে চিন্তার ব্যাপার সেটা হল ওই দুমুখো, সবুজচোখো ডাইনিটা তোমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেবে আর তোমরা একে অন্যকে গুলি করে মারবে। সেটা হলে অবশ্য খারাপ হয় না।” [৫ উটা – আমেরিকার পশ্চিম উপকূলেরে একটা রাজ্য। ১৮৪৮ সালে মেক্সিকো থেকে কেটে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। মর্মনরা এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করে। ওরা বহুবিবাহ করত। উটা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ৪ জানুয়ারি ১৮৯৬তে যখন মর্মনরা বহুবিবাহ প্রথা তুলে দিতে রাজী হয়।] [৬ – মর্মন – উটার প্রথম অধিবাসী যাদের মধ্যে বহুবিবাহপ্রথার চল ছিল ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত]
সেদিনের পর থেকে স্টুয়ার্ট ইন্ডিয়ার উপস্থিতিতে বেশ অস্বস্তি বোধ করে। অবশ্য ইন্ডিয়া এ নিয়ে ওকে কখনই কোন কটূ কথা বলেনি। হাবে ভাবে বুঝতেও দেয়নি যে স্টুয়ার্টের আকস্মিক আনুগত্য পরিবর্তনের কথা সম্বন্ধে সে অবহিত। স্টুয়ার্ট জানে যে ইন্ডিয়া মনে মনে এখনও ওকেই ভালবাসে; আর নিজের আচরণ যে ভদ্রলোকসুলভ হয় নি, সেটাও ভেতরে ভেতরে অনুভব করে। ওকে ও এখনও খুবই পছন্দ করে; সম্মানও করে ওর বংশমর্যাদার জন্য, ওর মিষ্টি স্বভাব আর শিক্ষাদীক্ষার জন্য এবং আরো অনেক সুন্দর গুণের জন্য। কিন্তু মেয়েটা কেমন যেন ফ্যাকাসে আর নিরস। আর স্কারলেট কত প্রাণবন্ত; ওর মধ্যে রয়েছে এক সদা পরিবর্তনশীল আকর্ষণ। ইন্ডিয়ার সঙ্গে তোমার অবস্থান তুমি সবসময়ই উপলব্ধি করতে পারবে, কিন্তু স্কারলেট সম্বন্ধে সেটা আন্দাজ করা খুব শক্ত। এটা একটু অসুবিধেজনক হলেও এর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে।
“চল, তাহলে কেড ক্যাল্ভার্টের কাছেই যাওয়া যাক; সাপার ওখানেই সারা যাবে। স্কারলেট বলছিল ক্যাথলীন চার্লস্টন থেকে বাড়ি ফিরেছে। হয়ত ওর কাছে ফোর্ট সামটারের নতুন খবর কিছু পাওয়া যাবে।”
“ক্যাথলীন! না রে। আমি বাজী ধরে বলতে পারি ফোর্ট যে ওখানে আছে সেটাই ও জানে না। ওটা যে ইয়াঙ্কি সৈন্যের দখলে চলে গেছিল, এখন আবার আমরা ফিরে পেয়েছি, এটা জানে আশা করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! ওখানে ও কটা বল নাচে গেছে আর কতগুলো ফুলবাবুকে পাকড়াও করতে পেরেছে সেটুকুই বলতে পারবে।”
“সে ওর আবোল তাবোল শুনতে মজাই লাগবে। আর মায়ের ঘুমোতে যাওয়া অব্দি কোথাও তো লুকোতে হবে!”
“সে আমিও ক্যাথলীনকে পছন্দই করি আর ওর বকবকানিতে মজাই পাই। ক্যারো রেট আর চার্লস্টনের অন্যদের সম্বন্ধেও জানা যাবে। কিন্তু ওর ওই ইয়াঙ্কি সৎ মায়ের সাথে আবার এক টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করাটা একটু অসহ্য লাগবে।”
“অত রাগ করিস না স্টুয়ার্ট। উনি মানুষ খারাপ নন।”
“না রাগ করি নি। ওঁর জন্য আমার দুঃখই হয়। কিন্তু যাদের জন্য দুঃখ হয় সেরকম মানুষ আমার ভাল লাগে না। উনি সারাক্ষণ হই চই করবেন, চেষ্টা করবেন ঠিক ঠিক কথা বলার যাতে তুই অস্বস্তিতে না পড়িস, কিন্তু শেষমেশ ঠিক ভুল কথাটাই বলে ফেলবেন! মাথাটা আমার গরম হয়ে যায়। আর ওনার মতে তো আমরা দক্ষিণের লোকেরা সবাই বর্বর! মাকে পর্যন্ত একথা বলে দিয়েছেন। দক্ষিণের লোকজনদের সম্পর্কে ওনার একটা ভয় কাজ করে। যতক্ষণ আমরা থাকি, উনি যেন মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে থাকেন। ওনাকে আমার একটা রুগ্ন মুর্গীর মত লাগে, জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে সিঁটিয়ে বসে থাকেন। যেন কেউ এদিক ওদিক করলেই লাফ মেরে চম্পট দেবেন!”
“তুই ওঁকে দোষ দিতে পারিস না। তুই তো কেডের পায়ে গুলি মেরেছিলি!”
“ঠিক কথা। কিন্তু আমাকে জ্বালাতনের একশেষ করেছিল। নইলে আমি কখনওই করতাম না,” স্টুয়ার্ট বলল। তবে কেড সে কথা মনে রাখে নি। ক্যাথলীন, কিংবা রেফোর্ড কিংবা মিঃ ক্যাল্ভার্টও ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছেন।একমাত্র ওই ইয়াঙ্কি সৎমাই চেঁচামেচি করেছিলেন। আমাকে বর্বর বলে গাল পেড়েছিলেন।আর বলেছিলেন যে অসভ্য দক্ষিণের লোকের কাছে কোনও সভ্য মানুষই নিরাপদ নয়!”
“বেশ। কিন্তু তুই ওঁকে দোষ দিতে পারিস না। প্রথমত উনি ইয়াঙ্কি, তাই আমাদের মত ভদ্র ব্যবহার ওঁর কাছ থেকে আশা করা ঠিক হবে না। সব থেকে বড় কথা তুই সত্যিই গুলি চালিয়েছিলি, আর ও ওঁর সৎছেলে।”
“গুলি মারো! কিন্তু তাই বলে এটা আমাকে অপমান করার যথেষ্ট কারণ হতে পারে না! তুই তো মায়ের নিজের ছেলে। তোকে যখন টোনি ফোনটেন পায়ে গুলি করল, তখন মা কি এরকম কিছু করেছিলেন? শুধু ডঃ ফোনটেনকে ব্যান্ডেজ করে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। আর বলেছিলেন নেশা করার জন্য হয়ত টোনির হাতের নিশানা ঠিক ছিল না। মনে আছে এ কথায় টোনি কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল?”
দুজনেই জোরে হেসে উঠল।
“মায়ের কোন তুলনাই হয় না!” কিছুটা আবেগের সাথে বলে উঠল ব্রেন্ট। “যেখানে যেমন করা উচিত, মা সব সময় ঠিক সেটাই করেন। আর অন্যদের সামনে তুই কখনও অস্বস্তিতে পড়বি না।”
“কিন্তু বাবার আর বোনদের সামনে মা সাংঘাতিক অস্বস্তিকর কিছু বলে ফেলতে পারেন, যখন রাতে ঘরে ঢুকব,” খুব হতাশ ভাবে বলল স্টুয়ার্ট। “তার মানে আমরা ইউরোপে বেড়াতে যেতে পারব না। মা বলেছিলেন যদি আবার কোন কলেজ আমাদের বের করে দেয় তাহলে আমরা এই লোভনীয় সফরে যেতে পারব না।”
“আমাদের কিছু যায় আসে না। কি বলিস? কি আছে ইউরোপে? ওখানে কি এমন কিছু দেখার আছে, যা আমাদের জর্জিয়াতে নেই। বাজী রেখে বলতে পারি ওদের ঘোড়াও এত জোরে ছুটতে পারে না, আর ওদের মেয়েরাও এত সুন্দরী নয়। আর বাবা যে রাই হুইস্কি খায় তেমন জিনিসও ওখানে মিলবে না।”
“অ্যাশলে উইল্কস বলছিল, ওদের দেশে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর আর ওখানকার সঙ্গীত স্বর্গীয়। ইউরোপ অ্যাশলেকে খুব মুগ্ধ করেছে। ও সব সময় ওখানকার কথা বলে।”
“তুই তো ভাল করেই জানিস উইল্কসরা গান আর বইয়ের ব্যাপারে বেশ পাগল; আর প্রাকৃতিক দৃশ্য। মা বলেন এর কারন হল ওদের ঠাকুরদা ভার্জিনিয়া থেকে এসেছিলেন। ভার্জিনিয়ার লোকেরা আবার এসব জিনিসকে খুব গুরুত্ব দেয়।”
“থাকতে দাও ওদের ওসব নিয়ে। আমাকে শুধু ভাল একটা ঘোড়া দাও চড়বার জন্য, ভাল মদ দাও পান করার জন্য, ভাল মেয়ে দাও প্রেম করার জন্য, আর মন্দ মেয়ে দাও ফষ্টিনষ্টি করার জন্য ......... যে ইচ্ছে ইউরোপে যাক ………. আমি কোন পরোয়া করি না। ধরে নে, সামনেই যুদ্ধ, আর আমরা ইউরোপে! তাড়াতাড়ি ফিরতেও পারব না। আমি বরং যুদ্ধে যেতেই বেশী রাজী ইউরোপ যাওয়ার চেয়ে।”
“আমিও তাই। ব্রেন্ট আমি বুঝতে পেরে গেছি কোথায় আমরা সাপারের জন্য যেতে পারি! চল, আমরা অ্যাবেল ওয়াইন্ডারের কাছে যাই আর বলি যে চারজনে আবার বাড়ি চলে এসেছি। বাড়ী ফিরলেই নানারকম জবাবদিহি করতে হবে।”
“এটা একটা ভাল আইডিয়া!” ব্রেন্ট সজোরে বলে উঠল। “ওর কাছে সৈন্যদলের সম্বন্ধে জানা যাবে আর ইউনিফর্মের জন্য কোন রঙ বেছে নেওয়া হল সেটাও।”
“যদি জ়ুয়েভ৭ সৈন্য হয়, আমি সৈন্যদলে যোগ দেবার ব্যাপারে আবার নতুন করে ভাবব। ওই সব ঢোলা লাল প্যান্টে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। ওগুলো ঠিক মেয়েদের লাল রঙের পাজামার মত”। [৭ জ়ুয়েভ -ফরাসী সেনাবাহিনীর অ্যালজেরিয়ান পদাতিক বাহিনী। এদের ইউনিফর্মে অনেকদিন পর্যন্ত লাল রঙ ব্যবহার হত]
“আপনারা কি মিঃ ওয়াইন্ডারের বাড়িতে যাবার কথা ভাবছেন? ওখানে গেলে কিন্তু সাপার পাওয়া যাবে না,”জিমস বলল। ওদের রাঁধুনি মরে গেছে আর এখনও নতুন কোন রাঁধুনি আসে নি। একজন মাঠে কাজ করার লোককে দিয়ে রান্না করাচ্ছে। নিগ্রোরা বলছে ও হচ্ছে এখানকার সব থেকে খারাপ রাঁধুনি।”
“হে ভগবান! একটা নতুন রাঁধুনি কিনে নিলেই তো পারে।”
“কোথা থেকে কিনবে? ওরা এত গরীব, ওদের চার জনের বেশী ক্রীতদাস কখনই ছিল না।”
জিমসের কথায় স্পষ্ট শ্লেষ। টার্লটনদের একশজন ক্রীতদাস, তাই জিমসের সামাজিক অবস্থান খুব সুরক্ষিত। অন্যান্য বড় প্ল্যান্টারদের ক্রীতদাসদের মত সেও ছোট প্ল্যান্টারদের, যাদের ক্রীতদাসের সংখ্যা কম, তাদের একটু হেয় করে দেখত।
“মেরে তোর চামড়া আমি ছাড়িয়ে নেব,” স্টুয়ার্ট খুব হিংস্রভাবে বলল। “কি সাহস তুই অ্যাবেল ওয়াইন্ডারকে‘গরীব’ বলে অপমান করছিস! গরীব হতে পারে, কিন্তু ও বেজন্মা নয়। সাদা অথবা কালো কেউ যদি ওঁকে অপমান করে তাহলে তাকে আমি দেখে নেব! এই কাউন্টিতে ওর থেকে কাবিল লোক নেই। শুধু শুধু ওকে সৈন্যদলের লেফটেনান্ট করেনি!”
“আমার জানা ছিল না,” বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে জিমস বলল। আমার ধারণা ছিল সেনাদলের অফিসার শুধু ধনী সাদা মানুষদের থেকেই নেওয়া হবে; ছোটলোকদের থেকে নয়।”
“কি বললি, ও ছোটলোক? তুই ওর সঙ্গে স্ল্যাটারিদের তুলনা করবি, যারা হল সত্যিকারের সাদা ছোটলোক? অ্যাবেল হয়ত গরীব। বড় চাষী কিংবা প্ল্যান্টার নয়। তা সত্ত্বেও যদি ওকে লেফটেনান্ট করে থাকে, তাহলে কোন কালো লোকের সে নিয়ে বলার অধিকার নেই। সৈন্যদল জানে ওরা কি চায়।”
তিন মাস আগে, যেদিন জর্জিয়া ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সেদিনই অশ্বারোহী সৈন্যদল তৈরি করা হয়। আর সেদিন থেকেই যুদ্ধের গুজব জোরদার হতে শুরু করে। এখনও এটার কোন নাম দেওয়া হয় নি। নামের অভাব ছিল বলে নয়। আসলে সবারই নিজস্ব কিছু ভাবনা ছিল আর কেউই নিজের ভাবনাটাকে ছেড়ে দিতে চাইছিল না। “ক্লেটনের বুনো বেড়াল”, “অগ্নিভুক”, “উত্তর জর্জিয়ার অশ্ববাহিনী’, “জ়ুয়েভ”, “ইনল্যাণ্ড রাইফেল” (যদিও রাইফেলের ব্যবহারই হবে না, পিস্তল, তরবারি আর ছুরি দেওয়া হবে), এই রকম। যতক্ষণ না ফয়সালা হয় ততক্ষণ সবাই এটাকে “ট্রুপ” এই নামেই ডাকছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই টিঁকে গেল।
অফিসার নির্বাচন সদস্যরাই করেছিল। কাউন্টিতে এমন একজনও ছিল না যার সামরিক অভিজ্ঞতা ছিল, দু একজন মেক্সিকো আর সেমিনোলের যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈন্য ছাড়া, যারা আবার ট্রুপের সদস্যদের পছন্দের নয়। ওরা টার্লটনদের চার ছেলে আর ফোনটেনদের তিন ছেলেদের যথেষ্ট পছন্দ করত, বিশ্বাসও করত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওরা ওদের বাছতে অনীহা জানাল।টার্লটনদের মধ্যে ছিল সংযমের অভাব আর ফোনটেনদের মেজাজ ছিল তিরিক্ষে। অ্যাশলে উইল্কসকে ক্যাপটেন করা হল, কারন সে খুব ভাল ঘোড়সওয়ার। মাথা খুব ঠাণ্ডা আর শৃঙ্খলাপরায়ণ। রেফোর্ড ক্যাল্ভার্টকে করা হল ফার্ষ্ট লেফটেনান্ট, কারন রেফকে সবাই ভালবাসত আর অ্যাবেল ওয়াইন্ডারকে করা হল সেকেণ্ড লেফটেনান্ট।
অ্যাবেল ছিল খুব বিচক্ষণ, বিশালদেহী, নিরক্ষর, কিন্তু সহৃদয় ব্যক্তি। বয়সেও অন্যদের থেকে বড় ছিল। মহিলাদের সম্মান করত। ট্রুপে খুব একটা উন্নাসিকতা ছিলনা। অনেকেরই বাবা, ঠাকুরদা ছোট চাষী থেকে বড় হয়েছেন। অ্যাবেল এ তল্লাটের সব থেকে ভাল নিশানাবাজ। বলা হত, পঁচাত্তর গজ দূর থেকেও কাঠবেড়ালির চোখে গুলি করে লক্ষ্যভেদ করতে পারত। ঘরের বাইরে থাকবার অভ্যেস ছিল। ওকে যে সম্মান দেখান হত তার জন্য সে কোনরকম দম্ভ প্রকাশ করত না। কিন্তু প্ল্যান্টারদের মহিলারা আর ক্রীতদাসরা কখনো ভুলতে পারত না যে ও জন্মসূত্রে বনেদী ছিল না।
প্রথম প্রথম ট্রূপে শুধুই প্ল্যান্টারদের পরিবারের ছেলেদেরই নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রত্যেকেই নিজেদের ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, ইউনিফর্ম আর চাপরাশি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। ক্লেটন কাউন্টিতে ধনী প্ল্যান্টারদের সংখ্যা কমই ছিল। তাই ট্রুপের লোকবল বাড়ানোর জন্য ছোট ছোট চাষীদের পরিবারের ছেলেদেরও নিয়োগ করতে হয়েছিল। এছাড়া যারা শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত, কিংবা জেলে, এমনকি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল গরীব সাদা মানুষদেরও দলে নেওয়া হয়েছিল।
তূলনামূলক ভাবে গরীবশ্রেণীর লোকেরাও স্বচ্ছল লোকদের মতই, যুদ্ধ হলে, ইয়াঙ্কিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে পিছু পা হবে না। কিন্তু এদের কোন বাড়তি সম্পদ ছিল না যা দিয়ে এরা ট্রুপকে অর্থকরী সাহায্য করতে পারে। অনেক ক্ষুদ্র চাষীরই ঘোড়া ছিল না, ওরা খচ্চর দিয়েই চাষের কাজ চালিয়ে নিত। যুদ্ধের জন্য সেটাও দিয়ে দিলে রোজগারের পথটাও বন্ধ হয়ে যাবে। কোন কোন গরীব সাদা মানূষের কাছে অন্তত একটা খচ্চর থাকাটাই অনেক। শিকারি আর জেলেদের কাছে আবার সেটুকুও ছিল না। ওদের ছিল দিন আনি দিন খাই অবস্থা। বছরে পাঁচ ডলারও একসাথে দেখার সুযোগ হয় না এদের। তবে নিজেদের দারিদ্র নিয়ে এদের যথেষ্ট গর্ব ছিল যেমন ধনী প্ল্যান্টারদের ছিল ঐশ্বর্য নিয়ে। দান হিসেবে কোন কিছু নেওয়াটাকে এরা অপমান বলে মনে করত। তাই প্রত্যেকের অনুভুতিকে সম্মান জানিয়ে এবং ট্রুপকে শক্তিশালী করার জন্য, স্কারলেটের বাবা, জন উইল্কস, বাক মুনরো, জিম টার্লটন, অর্থাৎ সব বড় প্ল্যান্টাররাই, একমাত্র অ্যাঙ্গাস ম্যাকিন্টশ বাদে, সবাই ট্রুপকে অর্থ, ঘোড়া আর লোকবল দিয়ে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। প্রত্যেক প্ল্যান্টার ঠিক করে নিয়েছিলেন যে তাঁরা নিজেদের ছেলেদের ছাড়াও নির্দিষ্ট সংখ্যক অন্য সদস্যদেরও সাজ সরঞ্জাম দেবার বন্দোবস্ত করবেন। ব্যাপারটা এমন ভাবে করা হবে যাতে কেউই এঁদের ঘোড়া বা অন্যান্য সরঞ্জাম গ্রহণ করে অসম্মানিত বোধ না করেন।
ট্রুপ সপ্তাহে দুবার অনুশীলন করবার জন্য জোন্সবোরোতে মিলিত হত। প্রার্থণা করত যেন যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যায়। তখনও অবশ্য সকলের জন্য ঘোড়ার আয়োজন করা যায় নি। কিন্তু যাদের ছিল তাঁরা নিজেদের মত করে অনেক ধুলো উড়িয়ে, আদালতের পেছনের জমিতে অশ্বারোহীবাহিনীর রণকৌশল অনুশীলন করে চলত। মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে তরবারি আস্ফালন করত। যাদের ঘোড়া ছিলনা, তাঁরা বুলার্ডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তামাক চিবোতে চিবোতে আর আড্ডা দিতে দিতে মহড়া দেখত। অথবা তারা গুলি ছোঁড়া অভ্যাস করত। কেউ শেখাবার ছিল না। কিন্তু এরা ছিল জন্মাবধি তুখোড় নিশানাবাজ।
নানা ধরণের অস্ত্রশস্ত্র মজুদ থাকত। কোন কোন অস্ত্র ছিল পুরোনো। নতুন বসতি গড়বার সময় অ্যালঘেনি পর্বত পেরিয়ে আসার সময় যেসব অস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছিল সেসব যেমন ছিল তেমনি ইংল্যান্ডে তৈরি আধুনিক রাইফেলও ছিল।
অনুশীলন শেষ হলে জোন্সবোরোর একটা প্রদর্শণীকক্ষে সবাই জমায়েত হত। অফিসারদের চেষ্টা থাকা সত্বেও ট্রুপে নিজেদের মধ্যে ছোট খাট লড়াই এড়াতে পারতেন না। তাই ইয়াঙ্কি আক্রমণের আগেই নিজেদের মধ্যে ঝাগড়াতেই, বেশ কিছু সদস্যের গুরুতর আঘাত লাগত। এরকমই একটা ঝগড়ার সময় স্টুয়ার্ট টার্লটন কেড কাল্ভার্টকে আর টনি ফোনটেন ব্রেন্টকে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল। যে সময় ট্রুপের গঠন হয়, সেই সময় যমজ ভাই দুজন সবে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে এসেছে। ওরা খুব আগ্রহ সহকারেই দলে নাম লেখাল। কিন্তু এই গুলি চালানোর ঘটনার পর ওদের মা আবার ওদের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। এই দু’মাস ওরা এই অনুশীলনের আড্ডার অভাব বোধ করেছে আর লেখাপড়া করা যে শুধুই সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে।
“আমাদের এত ঘুরে অ্যাবেলের বাড়ি যাবার দরকার নেই,” ব্রেন্ট পরামর্শ দিল। “মিঃ ও’হারার পুকুরের ধার দিয়ে গিয়ে ফোনটেনদের ক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলে এক্ষুণি পৌঁছে যাব।”
“ওখানে গেলে শুধু অল্প মাংস আর সব্জী ছাড়া কিছুই খেতে পাবেন না,” জীমস শেষ চেষ্টা করল।
“তুই কিছুই পাবি না,” স্টুয়ার্ট হাসল। “তার কারন, তুই এখন বাড়ি গিয়ে মাকে বলবি যে আমরা খেতে আসতে পারছি না।”
“না না সে আমি পারব না,” জিমস ভয়ে কঁকিয়ে উঠল। “মিস বিয়াট্রিসকে আমি আপনাদের থেকে কম ভয় পাই না। প্রথমেই উনি কলেজ থেকে আপনাদের বের করে দেওয়ার জন্য আমাকেই দায়ী করবেন! আর আপনাদের ফেরত না নিয়ে গেলে আপনাদের বদলে আমাকেই উত্তম মধ্যম দেবেন, কারন ওনার মনে হবে এই সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী! যদি আপনারা আমাকে মিঃ ওয়াইন্ডারে ওখানে নিয়ে না যান, তাহলে সারা রাত আমি জঙ্গলে বসে থাকব। হয়ত পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস ভে্বে সেপাইরা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তবু মিস বিয়াট্রিসের কবলে পড়ার থেকে সেটা ভাল।”
দু’ভাই কালো ছেলেটার দৃঢ় সংকল্প দেখে একটু ঘাবড়ে গেল আবার ভেতরে ভেতরে রেগেও যাচ্ছিল।
“সেপাইদের হাতে ধরা পড়াটা খুবই বোকার মত কাজ হবে। মা’ও এক সপ্তাহ ধরে চেঁচামেচি করার মত আরো একটা বিষয় পেয়ে যাবে। এই কালোগুলো মাঝে মাঝে সত্যিই সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়ায়। কখন কখন মনে হয় যারা এই ব্যবস্থাটা তুলে দিতে চাইছে, তারা ঠিকই করছে।”
“দেখ আমার মনে হয় আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইছি না, জিমসেরও সেটার মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়। ওকে সাথে নিয়ে যাওয়াই ভাল। আর শোন গাধা, তুই খবরদার ওদের ক্রীতদাসদের কাছে আমরা এই খাই – সেই খাই আর তোরা এই খাস – এসব বলে কোন রকম বাতেলা মারবি না! তাহলে মা কে বলে দেব আর তোর যুদ্ধে যাওয়া বন্ধ করে দেব।”
“বাতেলা? না হুজুর। আমি বাতেলা মারি না। মিস বিয়াট্রিস যেমন তোমাদের আদব কায়দা শিখিয়েছেন, তেমনি আমাকেও শিখিয়েছেন।”
“খুব একটা লাভ হয় নি। তিনজনেরই,” স্টুয়ার্ট বলল। “চল, তবে যাওয়া যাক।”
তিনজনে রওয়ানা দিল। খানিকটা যাবার পরে ব্রেন্ট চেঁচিয়ে ভাইকে বলল, “আচ্ছা স্টু, তোর কি মনে হয় না স্কারলেটের আমাদেরকে খেতে বলা উচিত ছিল?”
“আমি তো সারাক্ষণই ভাবছিলাম, করবে। কে জানে _______”
দ্বিতীয় পর্ব----------------------------------

হাত দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মনের ভেতরে তোলপাড় করছে। চোখে মুখে বেদনার ছোঁয়া। প্রশ্রয় পেয়ে বেড়ে ওঠা শিশু – যা চেয়েছে সেটাই পেয়ে অভ্যস্ত – জীবনে প্রথম তার ব্যতিক্রম হতে চলেছে।
অ্যাশলে শেষ পর্যন্ত মেলানি হ্যামিলটনকে বিয়ে করবে!
নাঃ এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। দু’ভাই নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করছে। নিশ্চয়ই এটা বাজে রসিকতা। অ্যাশলে কিছুতেই মেলানিকে ভালবাসতে পারে না। কেউই পারে না ওই ইঁদুরের মত ছোট্টখাট্ট মেয়েটাকে ভালবাসতে। খানিক অবজ্ঞার সাথেই ও মেলানির রোগা অপরিণত চেহারাটাকে মনে করার চেষ্টা করল, ওর পান পাতার মত মুখটাকে, যেটা অত্যন্ত সাধারণ আর বৈশিষ্টহীন। অ্যাশলে নিশ্চয়ই ওকে অনেকদিন দেখে নি। গত বছর টুয়েল্ভ ওকসে পার্টির পরে অ্যাশলে দুবারের বেশি অ্যাটলান্টায় যায় নি। নাঃ অ্যাশলে কিছুতেই মেলানির প্রেমে পড়ে নি। আর নিশ্চয়ই ওর ভুল হচ্ছে না – কারন অ্যাশলে তো ওরই – স্কারলেটের প্রেমেই পড়েছে। ও একদম নিশ্চিন্ত এ ব্যাপারে!
স্কারলেট ম্যামির থপ থপে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তাড়াতাড়ি পায়ের ওপর থেকে পা টা সরিয়ে নিল, আর মুখটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। ম্যামিকে কোন কিছু সন্দেহ করতে দেওয়া যাবে না। ম্যামি ও’হারা পরিবারকে প্রাণ মন দিয়ে ভালবাসত। ও’হারাদের গোপন কথাকে নিজের গোপন কথা বলে মনে করত। আর যদি মনে করে কেউ তার কাছ থেকে কিছু লুকোতে চাইছে, তাহলে প্রাণপাত করে সেই কথা ঠিক বের করে ফেলবে। স্কারলেট এটাও ভাল করে জানত, যদি ম্যামির কোন কৌতুহল হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কথাটা এলেনের কানে তুলবে। তখন হয় স্কারলেটকে মায়ের কাছে সব খুলে বলতে হবে অথবা বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে গল্প তৈরি করতে হবে।
হল পেরিয়ে ম্যামি এসে ঢুকল। দশাশই চেহারার মহিলা। বেশ বয়েস হয়েছে। হাতির মত কুতকুতে কিন্তু সজাগ চোখ। কুচকুচে কালো, পাক্কা আফ্রিকান। শেষ রক্তবিন্দু অবধি ও’হারা পরিবারের স্বার্থ দেখবে। এলেনের প্রধান অবলম্বন, কিন্তু তাঁর তিন মেয়ের এবং সমস্ত চাকর-বাকরের হতাশা আর আতঙ্কের কারন। যদিও ম্যামি নিগ্রো ছিল, তবু তাঁর আচার আচরণ আর আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত উচ্চশ্রেণীর ছিল। বড় হয়েছিল সোলঁঞ্ঝ রোবিল্যারের তত্ত্বাবধানে। উনি হলেন এলেন ও’হারার মা, অত্যন্ত সুন্দরী, কিন্তু শীতল এবং উন্নাসিক প্রকৃতির ফরাসী মহিলা,যিনি তাঁর ছেলেমেয়ে কিংবা চাকর-বাকরদের আদব-কায়দা লঙ্ঘণের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে পিছিয়ে যেতেন না। ম্যামি এলেনেরও ম্যামি ছিল। এলেনের বিয়ের পর সাভান্না থেকে পশ্চিমে চলে এসেছে। যাকে সে ভালবাসত তাকেই সে বকাবকি করত। স্কারলেটের প্রতি ওর ভালবাসা আর গর্ব এত বেশি ছিল যে ও ওকে অনবরত শাসন করত।
“ভদ্রলোকেরা কি চলে গেছেন? কি ব্যাপার মিস স্কারলেট, তুমি ওদের খেয়ে যেতে বললে না? পোর্ককে আমি দুটো প্লেট বেশি লাগাতে বলেছিলাম। এটা কি ধরণের ভদ্রতা তোমার?”
“খালি যুদ্ধ আর যুদ্ধ নিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। খাবার টেবিলেও একই কথা চলতে থাকত! বিশেষ করে বাপী এসে আবার মিঃ লিঙ্কনকে নিয়ে ওদের সঙ্গে হট্টগোল শুরু করতেন।”
“মিস এলেন আর আমি তোমাকে পইপই করে শেখালেও তোমার আদব কায়দা খেতমজুরদের মতই রয়ে গেল! আর তোমার শাল কোথায়? বাইরে, রাতের বেলা হিম পড়ে তুমি সর্দিজ্বর বাধিয়ে বসবে। চল, ভেতরে চল, মিস স্কারলেট।”
একটা ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার সঙ্গে স্কারলেট ম্যামির দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। ভাগ্য ভাল ম্যামি তাঁর শাল গায়ে না দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়ায় ওর মুখের দিকে নজর দেয় নি।
“না আমি এখানে বসে সূর্যাস্ত দেখব। কি সুন্দর লাগছে! তুমি দয়া করে আমার শালটা দিয়ে যাও। বাপী আসা পর্যন্ত আমি এখানেই বসি।”
“তোমার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে যে তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে,” ম্যামি সন্দেহের সুরে বলল।
“না মোটেই না,” স্কারলেট অসহিষ্ণুভাবে বলল। “তুমি শালটা এনে দাও।”
ছোট ছোট পা ফেলে ম্যামি ফের হলঘরে গেল। স্কারলেট শুনতে পেল সিঁড়ির তলা থেকে খুব মিহি গলায় ওপরতলার পরিচারিকাকে ডাকল।
“রোজ়া, মিস স্কারলেটের শালটা দাও।” তারপর রেগে গিয়ে, “মহারাণী হয়েছেন সব! দরকারের সময় তার টিকির দেখা পাওয়া যাবে না! এখন আমাকেই সিঁড়ি বাইতে হবে!”
স্কারলেট সিঁড়ির মচ মচ শব্দ শুনতে পেয়ে উঠে দাঁড়াল। ম্যামি ফিরে আসলেই তো আবার সেই আতিথেয়তার অভাব নিয়ে লেকচার শুরু করবে। ওর মনে হল এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আবার বকাবকি আর সহ্য হবে না। নিজেই যখন সে নিজের জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় লুকোবে যতক্ষণ না তার এই দুঃখ একটু কমে? হঠাৎ একটা আশার আলো দেখতে পেল। বাপী দুপুরে উইল্কসদের প্ল্যানটেশন টুয়েল্ভ ওকসে গেছেন। ডিলসিকে কেনার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে। ডিলসি ওখানকার মুখ্য পরিচারিকা আর ধাত্রী। মাস ছয়েক আগে বাপীর পরিচারক পোর্ক ডিলসিকে বিয়ে করেছে। তারপর থেকে দিন রাত বাপীকে জ্বালাতন করে চলেছে ওকে কিনে নেবার জন্য। যাতে ওরা এক জায়গায় থাকতে পারে। শেষমেশ বাপী নিমরাজি হয়ে ওকে কেনবার প্রস্তাব নিয়ে গেছেন।
বাপী নিশ্চয়ই দুঃসংবাদটা সত্যি কিনা জানতে পারবেন। যদি কিছু শুনতে নাও পান, তবু ওদের হাবভাব, ব্যস্ততা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, আর কিছু আন্দাজ তো করবেন। যদি বাপীকে একলা পাই তাহলে ঠিক বুঝে যাব যে সত্যিটা আসলে ওই বজ্জাত ছোঁড়া দুটোর রসিকতা।
জেরাল্ডের ফেরার সময় হয়ে এসেছে। ওকে যদি ওঁর সঙ্গে একলা দেখা করতে হয়, তাহলে বাইরে গেটের কাছে অপেক্ষা করতে হবে। ও চুপি চুপি বেরিয়ে এল। তারপর ভাল করে নিশ্চিত হয়ে নিল যে ম্যামি ওপর থেকে ওকে লক্ষ্য করছে না। কেউ ওকে দেখছেনা বুঝে ও ওর সবুজ ফুলপাতার স্কার্টটাকে একটু তুলে নিয়ে গেটের দিকে দ্রূতপায়ে এগিয়ে চলল। রাস্তার দুধারে সেডার গাছের সারি একটা অন্তরাল তৈরি করেছে। ওখান থেকে স্কারলেটকে নজর করা খুব শক্ত।
গাছের একটা গুঁড়ির ওপর বসে সে বাপীর অপেক্ষা করতে লাগল। আসার সময় অবশ্য পেরিয়ে গেছে, কিন্তু স্কারলেট মনে মনে চাইছিল একটু দেরি হোক। এই বিলম্বে সে নিজেকে খানিকটা সামলে নিতে পারবে যাতে বাপীর মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয়। সময় পেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু উদগ্রীব হয়েও জেরাল্ডের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ওর কানে এসে পৌঁছল না। জেরাল্ডের খুব জোরে জোরে অশ্বচালনার অভ্যেস। বেদনা আবার ওকে গ্রাস করে নিল।
“কিছুতেই সত্যি হতে পারেনা,” সে ভাবল। “ইশ, কেন যে বাপী আসছে না!”
ওর চোখ আঁকাবাঁকা রাস্তার শেষ সীমানা পেরিয়ে চেয়ে আছে। সকালে বৃষ্টির পরে পথটা এখন রক্তের মত লাল। মনে মনে সেই রাস্তা ধরে, ফ্লিন্ট নদী পেরিয়ে ও টুয়েল্ভ ওকসে পৌঁছে গেল। যেখানে অ্যাশলে থাকে। পথটাকে মনে হল অ্যাশলের কাছে যাবার রাস্তা। পাহাড়ের চূড়ার ওপরে গ্রীক মন্দিরের ধাঁচে সাদা রঙের সেই বাড়িটা।
“ওঃ অ্যাশলে! অ্যাশলে!” যতই মনে পড়তে লাগল, ওর হৃতকম্পন তত দ্রূত হতে লাগল।
আস্তে আস্তে ওর মন থেকে টার্লটন ভাইদের কাছ থেকে শোনা গুজব মনের ওপর যে দুঃসহ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর নিজেকে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছিল, সেই ভাব কাটিয়ে উঠে, দুবছর ধরে নিজের মধ্যে গোপন রাখা অনুভুতিটা দিয়ে সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আগে কখনই ও অ্যাশলের প্রতি কোন আলাদা আকর্ষণ অনুভব করেনি। ছোটবেলায়, মাঝে মাঝেই অ্যাশলে ওদের বাড়িতে আসা যাওয়া করত, কিন্তু কখনও ওকে কোন বিশেষ চোখে দেখে নি। তবে দুবছর আগে, ইউরোপ ঘুরে আসার পরে, অ্যাশলে যখন সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য ওদের বাড়ি এসেছিল, ওর ওকে ভাল লেগে গেছিল। বাস!
সেদিন স্কারলেট বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে ছিল। দেখল অ্যাশলে বৃক্ষাচ্ছাদিত দীর্ঘ পথ বেয়ে ঘোড়ায় চড়ে এল। পরনে একটা ধূসর রঙের ঢোলা পোষাক, গলাবন্ধ শার্ট থেকে টাই ঝুলছে, টাইপিনের ওপর খোদাই করা মেডুসার মাথা, মাথায় পানামা টুপি, পায়ে চকচকে জুতো। আজও ছবিটা ও চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পায়। ঘোড়া থেকে নেমে, লাগাম এক নিগ্রো শিশুর হাতে ছুঁড়ে দিয়ে স্বপ্নিল চোখে স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, “তাহলে তুমি বড় হয়ে গেছ স্কারলেট!” তারপর ধীর পায়ে উঠে এসে স্কারলেটের হাত তুলে ধরে আস্তে চুম্বন করল। সেই কণ্ঠস্বর ওর হৃদয়ে আলোড়ন তুলে দিল। সেই কন্ঠস্বর ও জীবনে ভুলতে পারবে না।
সেই মুহুর্ত থেকে স্কারলেট অ্যাশলেকে কামনা করেছে, ঠিক যে ভাবে একজন অবুঝ শিশু খাবার জিনিসের জন্য কিংবা ভাল ঘোড়ার কিংবা নরম বিছানার জন্য বায়না করে তেমনি।
তারপরে, দু বছর ধরে সপ্তাহে অন্তত একবার অ্যাশলে টারায় এসেছে আর স্কারলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। অবশ্য টার্লটন ভাইদের মত এত ঘন ঘন নয় বা ফোনটেনদের মত এত নাছোড়বান্দা ভাবে নয়।
এ কথা সত্যি, ও কখনো স্কারলেটকে প্রেম-প্রস্তাব দেয় নি। অন্যরা স্কারলেটকে দেখলে যেরকম গদগদ হয়ে পড়ত, ওর মধ্যে সেরকম কোন অভিব্যাক্তিও লক্ষ্য করেনি। তবুও স্কারলেট নিশ্চিত জানে অ্যাশলে ওকেই ভালবাসে। এতে কোন ভুল নেই। কত সময় ও লক্ষ্য করেছে, কি ব্যাকুলতা আর বিষণ্ণতা নিয়ে অ্যাশলে ওর দিকে চেয়ে থেকেছে। ওর সহজাত প্রবৃত্তি আর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অন্য কিছু ভাববার সুযোগই দিচ্ছে না। নাঃ ও একশো ভাগ নিশ্চিত যে অ্যাশলে ওকেই ভালবাসে। আর সে কথা বলতে অসুবিধে কোথায় ছিল? এটা স্কারলেট কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। অবশ্য, অ্যাশলের অনেক ব্যাপারই ও বুঝে উঠতে পারে না।
ওর ব্যবহার সবসময়ই খুব মার্জিত। অথচ কি নির্লিপ্ত! কেউই ওর মনের কথা আঁচ করতে পারবে না, আর স্কারলেট তো একেবারেই নয়। আশে পাশে সবাই যখন মনের কথা খোলাখুলি বলতে ভালবাসে, তখন অ্যাশলের মন্ত্রগুপ্তি খুবই বিরক্তিকর। নাচ গান, আড্ডা মারা, শিকার করা, বাজী ধরা, কোন কিছুতেই সে কম যায় না। বিশেষ করে অশ্বচালনাতে তো ও সবার থেকে এগিয়ে। তবু ও সবার থেকেই আলাদা, কারন শুধু ফুর্তি করাকে ও মোটেই অন্যদের মত জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করে না। বই পড়া, ধ্রূপদী সঙ্গীত শোনা আর কবিতা লেখা এই হল ওর প্রিয় শখ।
ও এত সুদর্শন, এত মার্জিতভাবে নির্লিপ্ত, অথচ ক্লান্তিকরভাবে ইউরোপের কথা বলে চলে? আর অসম্ভব স্বপ্নবিলাসি! স্কারলেটের এসব ব্যাপারে একদম আগ্রহ নেই, অথচ অ্যাশলেকে ও ভীষণ চায়। আধো অন্ধকারে সামনের বারান্দায় বসে অ্যাশলের সঙ্গে গল্প করে অনেকদিন কাটিয়েছে, আর সে সব রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে, আর নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছে যে এর পরে যেদিন আবার দেখা হবে, অ্যাশলে ওর পাণি প্রার্থণা করবে। কিন্তু সেই পরের দিনও নতুন কিছু ঘটেনি, শুধু অ্যাশলের প্রতি তার আকর্ষণ আরও দূর্বার হয়েছে।
ও অ্যাশলেকে ভালবাসত, ওকে চাইত, কিন্তু ওকে বুঝতে পারত না। বাতাসের গতির মত কিংবা নদীর স্রোতের মত সে ছিল সরল আর দ্বিধাহীন, তাই জটিলতা বোঝার কোন ক্ষমতা ওর ছিল না। জীবনে এই প্রথম ও কোন জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
অ্যাশলে হল সেই ধরনের ব্যাক্তিত্ব, যে অবসর সময়ে, কোন কিছু করার বদলে কোন কিছু নিয়ে ভাবতে বেশী ভালবাসবে আর অবাস্তব স্বপ্নের জাল বুনে চলবে। ও একটা সুদূর কল্পলোকে বাস করতে ভালবাসে। মাঝে মাঝে ওকে অত্যন্ত অনিচ্ছাভরে বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়। ভাল লাগা আর ভাল না লাগার দ্বন্দ্বের মধ্যে না পড়ে সে শুধু আশেপাশের মানুষকে পর্যবেক্ষণ করত। জীবন সম্বন্ধেও সে ছিল অত্যন্ত উদাসীন।
এতটা দূর্জ্ঞেয় হওয়া সত্বেও ও কেন অ্যাশলের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, সেটা স্কারলেটের অজানা। অ্যাশলে যেন এক রহস্যময় বন্ধ দরজা, যার চাবি কিংবা তালা কিছুই নেই। ওর চরিত্রের যে সব দিকগুলো ও বুঝতে পারত না, সেগুলোর জন্যই ওকে আরো ভালবাসতে ইচ্ছে করত। আর ওর সম্ভ্রমপূর্ণ কিন্তু সংযত আচরণ ওকে নিজের করে পাবার জন্য স্কারলেটের জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ও যে ওকে একদিন না একদিন বিবাহের প্রস্তাব দেবেই এ নিয়ে ওর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এখন অবধি কোন কিছুর জন্য বায়না করে সেটা না পাওয়ার অভিজ্ঞতা তার হয় নি। আর হঠাৎ বজ্রপাতের মত কি শুনতে পেল? না অ্যাশলে মেলানিকে বিয়ে করছে! হতেই পারে না!
এই তো মাত্র গত সপ্তাহে, যখন ওরা ফেয়ারহিল থেকে বিকেল বেলা ঘোড়ায় চড়ে ফিরছিল, তখন অ্যাশলে বলেছিল, “স্কারলেট, তোমাকে একটা খুব দরকারি কথা বলার আছে। কি ভাবে বলব, বুঝতে পারছি না।”
ও লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল এতদিনে প্রতীক্ষার অবসান হবে। কিন্তু কি ভেবে অ্যাশলে বলল, “না, আজ থাক। বাড়ির কাছে এসে পড়েছি। এখন গুছিয়ে বলার সময় হবে না। ওঃ স্কারলেট আমি যে কত কাপুরুষ, বোঝাতে পারব না।” তারপর তাড়াতাড়ি ঘোড়া চালিয়ে, স্কারলেটকে টারায় পৌঁছে দিল।
গাছের গুঁড়ির ওপর বসে স্কারলেট সেই সুখস্মৃতি স্মরণ করছিল। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, ওই কথায় অত আনন্দ পাওয়ার কিছু ছিল না। কথাগুলোর ভয়ঙ্কর অন্য কোন অর্থ আছে। হয়ত অ্যাশলে ওকে মেলানির সঙ্গে বাগদানের খবরটাই বলতে চেয়েছিল!
ওঃ বাপী কখন যে ফিরবে? আর এই উদ্বেগ সহ্য হচ্ছে না। স্কারলেট উৎসুক চোখে বিসর্পিল রাস্তায় চোখ রাখল আবার। আবারও হতাশ হল।
সূর্য দিগন্তের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়েছে। লালচে ভাব মিলিয়ে গিয়ে এখন গোলাপী আভা। আকাশের উজ্জ্বল নীল রঙ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এখন নীলচে সবুজ। গোধুলির অপার্থিব নৈঃশব্দ চুপি চুপি স্কারলেটকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলল। চরাচরে নিষ্প্রভ আলো। মাটির রক্তাক্ত লাল রঙ এখন বিবর্ণ বাদামী। খচ্চর, গরু, ঘোড়া আস্তাবলে ফেরার অপেক্ষা করছে।
নদীর ধারের উজ্জ্বল সবুজ পাইন গাছের সারি আলো আঁধারিতে এখন আকাশের পটভুমিতে কালো। পাহাড় পেরিয়ে উইল্কসদের বাড়ির সাদা সাদা চিমনিগুলোও ধীরে ধীরে ঘন ওক বনের অন্তরালে মিলিয়ে গেল। শুধু কতগুলো আলোর বিন্দু দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ওখানে একটা বাড়ি আছে। স্যাঁতস্যাঁতে হেমন্তের বাতাসের সৌরভ আর চষা মাটির সোঁদা গন্ধ স্কারলেটকে আচ্ছন্ন করে তুলল।
সূর্যাস্ত, ঋতু পরিবর্তন, শ্যামল প্রাকৃতিক শোভা, স্কারলেটের কাছে এসব নতুন কোন ব্যাপার নয়। শ্বাস প্রশ্বাস নেবার মত খুবই উদ্দেশ্যহীন ভাবে এই সব সৌন্দর্যকে উপভোগ করেছে। সচেতনভাবে সৌন্দর্য বলতে সে কতগুলো নির্দিষ্ট জিনিসই বুঝত, যেমন নারীর মুখ, সিল্কের পোশাক, আর ঘোড়া। তবুও আজকের সন্ধ্যার আবছায়া আলোয়, টারার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য তার অশান্ত মনকে খানিকটা শান্ত করল। এই মাটিকে সে খুব ভালবাসে। প্রার্থণার সময় মোমবাতির আলোয় মায়ের মুখটা যতখানি ভাল লাগে ঠিক ততখানি।
এখনও সেই আঁকাবাঁকা রাস্তার প্রান্তে জেরাল্ডের ফিরে আসার কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। আর একটু দেরি হলেই ম্যামি ওকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে। তারপর ভেতরে নিয়ে গিয়ে তর্জন গর্জন শুরু করবে। হঠাৎ খেয়াল করল, কোন কারনে, খচ্চর, গরুর দল ভয়ে এদিক ওদিক পালানোর চেষ্টা করছে। বুঝতে পারল, জেরাল্ড ও’হারা, খুব দ্রূতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরছেন।
টিলার ওপর থেকে তাঁকে আর তাঁর লম্বা স্বাস্থ্যবান ঘোড়াকে দেখা গেল। তাঁর লম্বা ধবধবে সাদা চুল মাথার পেছন দিকে সোজা হয়ে হাওয়ায় ভেসে আছে। পেটে চাপড় মেরে আর চেঁচিয়ে ঘোড়াটাকে বেড়াঝোঁপ টপকাতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
মনের দূর্ভাবনাকে সরিয়ে রেখে, স্কারলেট খুব গর্বের সঙ্গে বাপীর ঘোড়া ছোটানো দেখতে লাগল। জেরাল্ড সত্যিই একজন পাকা অশ্বারোহী।
“বুঝতেই পারি না বাপী কেন ঘোড়া নিয়ে লাফ দিয়ে বেড়া ডিঙোতে চান, বিশেষ করে পেটে যদি দু’এক পেগ পড়ে,” স্কারলেট ভাবল। “গত বছর এই সময়ই তো টপকাতে গিয়ে পড়ে হাঁটু ভেঙেছিলেন। মা’কে তো কথাও দিয়েছিলেন যে আর কখনও লাফাবেন না।”
স্কারলেট তাঁর বাপীকে ভয় করত না। মনে করত তার বোনেদের থেকে বাপী তার অনেক বেশী সমসাময়িক। বেড়া টপকানো আর সেটা বউএর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে তিনি এক ধরণের শিশুসুলভ আনন্দ পেতেন; আবার একটা অপরাধবোধও কাজ করত। স্কারলেটও কড়া নজর এড়িয়ে ম্যামিকে ঠকানোতে একই রকম আনন্দ পেত। গাছের গুঁড়ির থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাপীকে দেখতে লাগল।
তাঁর বিশাল ঘোড়া বেড়ার কাছে পৌঁছেই, পাখির মতই অবলীলাক্রমে শুন্যে ভেসে বেড়া টপকে চলে এল। তার আরোহী চেঁচিয়ে আর পেটে চাপড় মেরে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। তাঁর সাদা চুল হাওয়ায় উড়ছে। জেরাল্ড লক্ষ্য করেন নি যে স্কারলেট অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।
“আমাদের কাউন্টি কিংবা আমাদের এই অঞ্চলেই আর একটা ঘোড়াও নেই যেটা তোকে হারিয়ে দিতে পারবে,” ঘোড়ার উদ্দেশ্যে বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে গর্ব ঠিকরে পড়ছিল। তারপর চুল, টাই আর শার্ট ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। স্কারলেট জানে যে মার সঙ্গে দেখা করার আগে একটু গুছিয়ে নিচ্ছেন, যাতে মায়ের মনে কোন রকম সন্দেহ না হয়। ওর মনে হল এটাই হল বাপীর সাথে কথা বলার সঠিক সময়।
একটু জোরে হেসে উঠল। ও চেয়েছিল জেরাল্ড যাতে একটু চমকে ওঠেন। জেরাল্ড মেয়েকে দেখতে পেলেন। ওঁর চোখে মুখে একটু অপ্রতিভ কিন্তু বেপরোয়া ভাব ফুটে উঠল। ঘোড়া থেকে সাবধানে নামলেন, কারন হাটুটা এখনও স্বচ্ছন্দ হয় নি। তারপর ওর দিকে এগিয়ে এলেন।
“তাহলে পুস,” ওর গালে একটা টোকা দিয়ে বললেন, “তুমি আমার ওপর লুকিয়ে নজর রাখছ? যেমন তোমার বোন স্যুয়েলেন গত সপ্তাহে করেছিল! আর মা’কে গিয়ে আমার নামে লাগাবে?”
তাঁর কণ্ঠে কিছুটা উষ্মা আর কিছুটা মিনতি। স্কারলেট জিভ দিয়ে একটা আমোদসূচক শব্দ করে বাপীর টাই ঠিক করে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাপীর নিঃশ্বাস ওর মুখে এসে পড়ছে। তাতে হালকা বুরবোঁর সৌরভ, তামাকের গন্ধের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার। বাপীর শরীরের এই গন্ধের সংমিশ্রণটা স্কারলেট খুব পছন্দ করে। অন্য পুরুষ মানুষের কাছ থেকে এলেও।
“না বাপী, আমি স্যুয়েলেনের মত মাকে গিয়ে লাগাব না,” স্কারলেট আশ্বস্ত করল। তারপর জেরাল্ডের দিকে চেয়ে দেখে নিল পোষাক পরিচ্ছদ ঠিক দেখাচ্ছে কি না।
জেরাল্ড ছোটখাট মানুষ ছিলেন, লম্বায় পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি। কিন্তু ভুড়ি আর দশাশই ঘাড় আর কাঁধের জন্য, বসে থাকা অবস্থায়, অপরিচিত লোকেরা তাঁকে লম্বা চওড়া মনে করত। আর এলাকার লোকেরা তাঁকে খুবই মান্যগন্য করত।
ষাট বছর বয়েস, কোঁকড়া চুলগুলো ধবধবে সাদা, মুখে কোন রকম বলিরেখা নেই আর তাঁর নীল চোখদুটো ছিল, সজীব, প্রাণবন্ত আর তারুণ্যে ভরপুর। তাঁর চোখ মুখ দেখে বোঝা যায় তাঁর পূর্বপুরুষেরা অনেকদিন আগে সুদূর আয়ার্ল্যান্ডের বাসিন্দা ছিলেন – গোলগাল, খর্ব নাসিকা, উজ্জ্বল বর্ণ, আর হঠকারী।
কিন্তু এই রাগী চেহারার মানুষটার হৃদয় ছিল খুবই কোমল। তিরষ্কৃত হয়ে কোন ক্রীতদাস যদি মনমরা হয়ে থাকে, কিংবা কোন বেড়ালের বাচ্চা মিউ মিউ করে, অথবা কোন শিশু যদি কান্নাকাটি করে, তবে সেটা তাঁর পক্ষে সহ্য করা খুব মুস্কিল। যারা তাঁর সাথে দেখা করতে আসত, তারা পাঁচ মিনিটেই এই কোমল হৃদয়ের আভাস পেয়ে যেত, কিন্তু সেটা তাঁকে বুঝতে দিত না। কারন সেটা তাঁর অহংকে আঘাত করত। উনি মনে করতেন, যখন উনি কাউকে বকাবকি করছেন, বা চেঁচিয়ে কোন আদেশ দিচ্ছেন, তখন সবাই তাঁর ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। উনি কখনও বুঝতে পারেন নি যে একমাত্র যাঁকে এই প্ল্যান্টেশনের লোকেরা অমান্য করতে সাহস করত না তিনি হলেন এলেন, তাঁর স্ত্রী। কিন্তু এই রহস্য তাঁকে কখনও জানতে দেওয়া হয় নি। এলেন সহ বাগানের সকলের মধ্যেই একটা গোপন কিন্তু স্নেহের বোঝাপড়া ছিল যেন জেরাল্ডের হুকুমই এই বাগানের আইন।
স্কারলেট অবশ্য অন্যদের তুলনায়, জেরাল্ডের মেজাজকে কম ধর্তব্যের মধ্যে আনত। ও ছিল জেরাল্ডের সব সন্তানদের মধ্যে বড়। তাঁর তিনজন পুত্রসন্তান শৈশবেই মারা গেছে। জেরাল্ডও বুঝেছিলেন, এই বয়সে, তাঁর আর পুত্র সন্তান পাবার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। তাই উনি স্কারলেটের সাথে যখন কথাবার্তা বলতেন, তখন তাকে ছেলের মর্যাদা দিয়েই কথা বলতেন। স্কারলেট এতে খুবই অভিভূত হত। ওর দুই ছোটবোনের থেকে বাপীর সাথে হাবভাবে তারই সব থেকে বেশি মিল। ক্যারীন – যার পুরো নাম ছিল ক্যারোলাইন আইরীন – নারীসুলভ কমনীয় আর স্বপ্নবিলাসী। আর স্যুয়েলেন – যার পুরো নাম স্যুসান এলিনর – নিজেকে একজন মার্জিত রূচির অভিজাত মেয়ে হিসেবে তুলে ধরতে চাইত।
এছাড়া, স্কারলেট আর জেরাল্ডের মধ্যে একটা অলিখিত কিন্তু পারষ্পরিক গোপনীয়তার চুক্তি ছিল। স্কারলেট আধ মাইল ঘুরে গেটের কাছে না গিয়ে অনেক সময়ই বেড়া ডিঙিয়ে বেরোত। আবার অনেকে সময় ছেলেদের সঙ্গে বেশ রাত করে আড্ডা দিত। জেরাল্ডের চোখে পড়লে বকাবকি করতেন ঠিকই। কিন্তু এলেনের কাছে লাগান নি। আর স্কারলেটও কখনও বাপীর ঘোড়া নিয়ে বেড়া টপকানোর কিংবা পোকারে কত টাকা হেরেছেন জানতে পারলেও (যেটা কউন্টির পরচর্চা থেকে জেনে ফেলাটা খুবই স্বাভাবিক), মায়ের কাছে বলে দিত না। জেরাল্ড আর স্কারলেট এ ব্যাপারে একমত ছিল যে এগুলো এলেনের কানে তুললে, এলেনের কোমল মনে আঘাত লাগবে।
বিলীয়মান আলোয় স্কারলেট জেরাল্ডের দিকে তাকাল। কেন জানি না ওর মনে হল বাপীর সান্নিধ্য খুব স্বস্তিদায়ক। বাপীর মধ্যে সজীব, পার্থিব কিন্তু বন্য একটা ব্যাপার আছে, যেটা ওকে আকর্ষণ করে। বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা না থাকায় ও বুঝতে পারে না যে ওর মধ্যে সেই একই বিশেষত্বগুলো রয়েছে। এলেন আর ম্যামির এই বিশেষত্বগুলো দূর করে দেবার সদৈব প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও।
“যাক এখন তোমাকে ঠিকঠাক লাগছে,” স্কারলেট বলল, “মনে হয় না কেউ তোমার কসরত ধরতে পারবে; অবশ্য যদি না তুমি নিজেই বলে ফেল। কিন্তু, তোমার হাঁটু ভেঙ্গে যাবার পরে – আর এই বেড়াটা টপকাতে গিয়েই – কাজটা মনে হয় _____”
জেরাল্ড রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন, “শেষমেশ নিজের মেয়ের কাছে শুনতে হবে না কি আমার কি করা উচিত আর কি উচিত নয়? ভাঙলে আমার ঘাড় ভাঙবে, সেটা মনে রেখো। তাছাড়া, বল তো শাল না জড়িয়ে, তুমি এসময় বাইরে কি করছ?”
স্কারলেট বুঝে ফেলল বাপী খুব অভ্যস্ত কায়দায় নিজেকে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন। ও আলতো করে বাপীর হাতের ফাঁকে নিজের হাতটা ঢুকিয়ে বলল, “তোমারই জন্য অপেক্ষা করছিলাম বাপী। এত দেরি হবে তোমার বুঝতে পারি নি। জানতে ইচ্ছে করছিল ডিলসিকে তুমি কিনে ফেললে কি না।”
“হ্যা কিনেছি তো। কিন্তু দামটা আমাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। জন উইল্কস তো এমনিই দিতে চাইছিলেন। কিন্তু আমি – আমি বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে কাউকে ঠকিয়েছি, এ কথা বলার সুযোগ আমি দিতে চাই না। দু’জনের জন্য আমি তিন হাজার ডলার দিলাম।”
“হে ভগবান! তিন হাজার ডলার! তোমার তো প্রিসিকে কেনার দরকার ছিল না!”
“তাহলে এখন আমার মেয়েই আমার কাজের দোষগুণ বিচার করবে!” জেরাল্ড আবার চেঁচিয়ে উঠলেন। “প্রিসি একটা একরত্তি মেয়ে ___”
“জানি ওকে। একেবারে চালু মাল,” প্রত্তুত্তরে বলল স্কারলেট, খুব শান্ত ভাবে, বাপীর চেঁচানো কে গায়ে না মেখে। “নিশ্চয়ই ডিলসি বায়না করেছিল।”
জেরাল্ড একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। কেউ ওঁর কোমল মনের আভাস পেয়ে গেলেই উনি লজ্জিত হয়ে পড়েন। স্কারলেট খুব জোরে হেসে উঠল।
“ঠিক আছে। না কিনে উপায় ছিল কি? ডিলসি যদি সারাদিন ওর জন্য উতলা হয়ে থাকত তাহলে? তবে আর কখনও আমার কোন নিগ্রোকে এই রকম বিয়ে করতে দেব না। খরচায় পোষাবে না। যাই হোক চল পুস, এবার খাবার জন্য এগোনো যাক।”
ততক্ষণে ছায়া আরও ঘন হয় এসেছে। আকাশে যে সবজে ভাবটা ছিল চলে গেছে, আবহাওয়ায় একটা শীতলতার স্পর্শ। স্কারলেট দেরি করতে লাগল আর ভাবতে লাগল, কি ভাবে বাপীর কাছে অ্যাশলের ব্যাপারটা তুলবে। কি উদ্দেশ্য, সেটা বাপীকে কিছুতেই জানতে দেওয়া চলবে না। ব্যাপারটা বেশ শক্ত। জেরাল্ডের মত ওর মধ্যেও কোন কূটকাচালি নেই, তাই দু’জনেরই গুঢ় উদ্দেশ্য কিছু থাকলে চট করে ধরা পড়ে যায়।
“টুয়েল্ভ ওকসে কেমন আছে সকলে?”
“ঠিকই আছে। কেড ক্যাল্ভার্টও ছিল। ডিলসির ব্যাপারটা মিটে যাবার পরে আমরা গ্যালারিতে বসে একটু মদ খেলাম। কেড সবেমাত্র অ্যাটলান্টা থেকে ফিরেছে। ওখানে সবাই বিপর্যস্ত, সারাক্ষণ যুদ্ধের কথা ___”
স্কারলেট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। যদি জেরাল্ড কোনভাবে যুদ্ধ আর জর্জিয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এসব নিয়ে আলোচনায় বুঁদ হয়ে যান তাহলে বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে সেটাই চলতে থাকবে।
“কালকের বারবেকিউ-এর ব্যাপারে কিছু বলাবলি করছিলেন?”
“হ্যা, মনে পড়েছে। বলছিলেন তো। মিস – কে যেন বেশ ওর নামটা – আরে ওই যে ভারি লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি জানো অ্যাশলের পিসতুতো বোন – ও হ্যা মিস মেলানি হ্যামিলটন, ঠিক – ও আর ওর ভাই চার্লস – ওরা ত অ্যাটলান্টা থেকে এসে গিয়েছে আর ____”
“ওহ, ও সত্যিই এসেছে?”
“হ্যা এসেছে। আর সত্যি কি মিষ্টি মেয়ে, নিজেকে নিয়ে কখনও বড়াই করে না – ঠিক যেমন লেডিদের হওয়া উচিত। না চল চল, আর দেরি করলে তোমার মা আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে যাবেন।”
খবরটা শুনে স্কারলেট একেবারে নিভে গিয়েছিল। ওর মনে খুব আশা ছিল যে মেলানি হ্যামিলটন কোন না কোন কারনে অ্যাটলান্টাতে আটকে থাকবে। কিন্তু বাপীও যখন ওকে শুনিয়ে মেলানির প্রশংসা করলেন, তখন খোলাখুলি কথা বলা ছাড়া ওর কোন উপায়ই থাকল না।
“অ্যাশলেও ছিল ওখানে?”
“হ্যা ছিল,” জেরাল্ড নিজেকে স্কারলেটের বাহুমুক্ত করে তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালেন। “তাহলে তুমি এজন্যই আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে? সেটা সোজাসুজি বললেই পারতে!”
কি বলবে স্কারলেট ভেবে পেল না। ওর মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠল।
“কি হল, বল!”
স্কারলেট তবুও চুপ করে রইল। ওর মনে হল যদি বাপীকে ও চুপ করতে বলতে পারত!
“হ্যা ও ছিল। আর অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। ওর বোনেরাও। ওরা সবাই কালকের বারবেকিউতে তোমাকে নিশ্চয় করে যেতে অনুরোধ করেছে। আমিও কথা দিয়েছি তুমি নিশ্চয়ই যাবে। এবার আমাকে বল তো পুস, তোমার আর অ্যাশলের মধ্যে ব্যাপারটা কি?”
“সেরকম কিছু নয় তো।” স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলে বাপীর হাত ধরে টানল। “চল, ভেতরে চল বাপী।”
“তাহলে এখন তুমি ভেতরে যেতে চাইছ,” জেরাল্ড মন্তব্য করলেন। “কিন্তু তোমার মতিগতি ঠিক মত না বুঝে, আমি তো এখান থেকে নড়ছি না। তাই ইদানিং তোমার হাবভাব আমার কেমন কেমন লাগছিল! ও তোমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে না কি?”
“না,” স্কারলেটের সংক্ষিপ্ত জবাব।
“আর দেবেও না,” জেরাল্ড বললেন।
ওর মনের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল। চোখে মুখে রাগ প্রকাশ পেল। জেরাল্ড হাত তুলে ওকে শান্ত করলেন।
“আমার কাছে শুনে নাও। জন উইল্কস নিজে আমাকে বলেছেন। অ্যাশলে মিস মেলানিকে বিয়ে করবে। কাল সবাইকে জানাবে ওরা। এখন কাউকে বলতে মানা করেছেন।”
স্কারলেট জেরাল্ডের বাহু থেকে হাত সরিয়ে নিল। তাঁর মানে খবরটা সত্যি!
একটা তীব্র বেদনার অনুভুতি তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ওর বাপী মেয়ের ভাবান্তর লক্ষ্য করলেন। তাঁর মনে একটু সহানুভুতি, একটু উষ্মায় উদ্বেল হয়ে উঠল। এ এমন এক সমস্যা, যার সমাধান তাঁর সাধ্যের বাইরে। উনি স্কারলেটকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কিন্তু তার ছেলেমানুষী সমস্যা তাঁকে খুব বিব্রত করে তুলল। এলেনকে বলতে পারত। সে ঠিকই একটা উপায় খুঁজে বের করত।
উত্তেজিত হয়ে পড়লেই তিনি গলা চড়িয়ে কথা বলতেন। চেঁচিয়ে বললেন, “তুমি কি সকলের কাছে নিজেকে হাস্যাষ্পদ করতে চাও ____ আমাদের সবাইকে হাস্যাষ্পদ করে তুলতে চাও? তুমি এমন একজনের পেছন নিয়েছ যে তোমাকে ভালই বাসে না। অথচ তুমি চাইলে এই কাউন্টির অনেককেই তোমার পছন্দের তালিকায় রাখতে পারতে।”
রাগে আর অপমানে, স্কারলেট মনবেদনা চেপে রাখতে পারল না।
“মোটেই আমি ওর পেছন নিইনি। আমি শুধু আশ্চর্য হয়েছি!”
“মিথ্যে কথা বলছ,” বলেই স্কারলেটের মুখ দেখে তাঁর মনও ব্যথিত হয়ে উঠল। “মন খারাপ কোরো না মা। তোমার বয়স তো কত অল্প, আর দেখ কত ভাল ভাল ছেলেরা রয়েছে।”
“তোমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল, মায়ের বয়স তখন মাত্র পনেরো। আর আমি এখন ষোল!” ধরা গলায় বলল স্কারলেট।
“তোমার মায়ের কথা আলাদা,” জেরাল্ড বললেন। “ও কি তোমার মত এত অস্থিরচিত্ত? নাও এবার একটু হাসো। সামনের সপ্তাহে আমি তোমাকে চার্লস্টনে নিয়ে যাব। তোমার পিসী ইউল্যালির কাছে। আর ওখানে ফোর্ট সামটার নিয়ে ওদের মাতামাতি দেখে, এক সপ্তাহের মধ্যে তুমি অ্যাশলেকে ভুলে যাবে। দেখে নিও।”
“উনি ভাবছেন যে আমি ছেলেমানুষ,” স্কারলেট ভাবল। “আর মনে করছেন নতুন কোন খেলনা পেলেই আমি সব ভুলে যাব!”
“এবার এই আলোচনা বন্ধ কর,” জেরাল্ড বললেন। “একটুও বুদ্ধি থাকলে অনেক আগেই স্টুয়ার্ট বা ব্রেন্ট টার্লটনদের একজনকে তুমি বিয়ে করতে পারতে! একটু ভেবে দেখো মা। ওদের একজনকে তুমি বিয়ে কর। তারপর আমার আর জেমস টার্লটনের খামার একসাথে চলবে, আর আমি তোমাদের জন্য একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে দেব। ঠিক যেখানে আমাদের দুজনের খামার এসে মিলেছে। সেখানে পাইনগাছের বন থাকবে ______”
স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। “তুমি কি আমাকে ছেলেমানুষ ভাবা বন্ধ করবে। চার্লসটনে আমার মোটেও যাবার ইচ্ছে নেই। চাই না আমার সুন্দর বাড়ি! ওই দুজনের একজনকেও আমি বিয়ে করতে চাই না! আমি শুধু চাই _____” নিজেকে সামলে নিল, কিন্তু তখন দেরী হয়ে গেছে।
জেরাল্ড খুব শান্ত কণ্ঠে, আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলেন। মনে হল খুব ভেবে ভেবে কথাগুলো বলছেন, যেটা ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ।
“তুমি শুধু অ্যাশলেকে বিয়ে করতে চাও, কেমন? কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে তুমি ওকে পাবে না। ও যদি তোমাকে বিয়ে করতে রাজীও হত, তাহলেও ওর মনে অনেক সংশয় থাকত।” তারপর স্কারলেটের চোখে মুখে বিস্ময় দেখে বললেন, “হ্যা, জন উইল্কস আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবুও বলছি। আমি চাই আমার মেয়ে সুখী হোক। কিন্তু তুমি অ্যাশলেকে বিয়ে করে সুখী হতে পারতে না।”
“না, আমি হতাম। নিশ্চয়ই সুখী হতাম।”
“হতে না মা। দুজনে মনের দিক থেকে একরকম না হলে, বিয়ে করে সুখী হওয়া যায় না।”
স্কারলেটের চেঁচিয়ে উঠে বলতে ইচ্ছে করল, “তাহলে তুমি আর মা কি করে সুখী হলে? তোমরা তো মনের দিক থেকে এক নও!” কিন্তু বলল না। তার প্রগলভ আচরণে বিরক্ত হয়ে বাপী ওর কান মুলে দিতে পারেন।
জেরাল্ড ধীরে ধীরে বলে চললেন, “উইল্কসরা আমাদের থেকে আলাদা। এ অঞ্চলের অনেকের থেকেই আলাদা। ওরা নিজেদের আত্মীয় পরিজনদের মধ্যেই বিয়ে করে। সেটাই ভাল। ওদের ব্যতিক্রমী চিন্তা ভাবনা ওদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”
“কিন্তু অ্যাশলে ___”
“তুমি চুপ কর। ওর বিরুদ্ধে আমি কিছু বলছি না। বরং আমি ওকে খুব পছন্দ করি। ব্যতিক্রমী বলতে আমি ওদের পাগলাটে বলি নি ও ক্যাল্ভার্টদের মত একটা ঘোড়ার জন্য সব কিছু বাজী লাগিয়ে বসবে না, কিংবা টার্লটনভাইদের মত মাতলামি করে বেড়ায় না, বা ফোনটেনদের মত বদরাগি নয়, যারা পান থেকে চুন খসলে মানুষ খুন করতে পারে। এ ধরনের পাগলামো তাও বোঝা যায়। ভগবান না করুন, জেরাল্ড ও’হারার মধ্যেও এসব দোষ থাকতে পারত। এটাও আমি বলব না যে তুমি ওর বউ হওয়া সত্বেও অ্যাশলে অন্য কোন মেয়ের সাথে পালিয়ে যেত। সেটা করলেও ওকে বুঝতে কোন অসুবিধে হত না। কিন্তু ওকে বুঝে উঠতে পারাটাই কঠিন। আমার ওকে ভাল লাগে। তবে ওর চিন্তা ভাবনার মাথা মুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারিনা। ওর কথাবার্তা আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগে। তুমিই বল না, কবিতা, সঙ্গীত, পুরোনো পেন্টিং এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ওর মাথা ঘামানোর কোন মানে তুমি খুঁজে পাও?”
“ওকে বিয়ে করলে, এ সবই আমি বদলে দিতে পারতাম,” স্কারলেট প্রতিবাদ করল।
“ও তাই ভাবছ বুঝি?” একটু শ্লেষের সঙ্গেই জেরাল্ড বললেন। “তাহলে জেনে নাও কোন বউই তার স্বামীকে একটুও বদলাতে পারে না। আর অ্যাশলে কে? ওদের পরিবারের সবাই ওরই মত। চিরটা কাল! নিউ ইয়র্ক আর বোস্টনে নাটক আর তৈলচিত্রের প্রদর্শণীর জন্য কি ভাবে ছুটে যায় দেখনি? আর ইয়াঙ্কিদের কাছ থেকে বাক্স বাক্স ফরাসী আর জার্মান বই কিনে আনে? তারপর সেই সব বই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে পড়বে আর ভগবান জানে কি সব স্বপ্ন দেখতে থাকবে? এসব বাজে কাজে লেগে না থেকে, পুরুষমানুষের মত শিকার করে কিংবা পোকার খেলেও তো সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারত!”
অ্যাশলের পৌরুষ নিয়ে খোঁটা দেওয়ায় স্কারলেট মনে মনে খুব চটে গেল। “এ তল্লাটে অ্যাশলের থেকে ভাল ঘোড়ায় চড়তে আর কেউই পারে না। হয়ত ওর বাবা ছাড়া। আর পোকার খেলার কথা বলছ? কেন গত সপ্তাহেই তো তুমি জোন্সবোরোতে ওর কাছে দুশো ডলার হেরেছ!”
“তার মানে ক্যাল্ভার্টের ছোড়াগুলো আবার আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেছে!” জেরাল্ড হাল ছেড়ে দিলেন। “নইলে কত টাকা তুমি কি করে জানবে? অ্যাশলে সব থেকে পাকা লোকের সঙ্গেই ঘোড়ায় চড়ে আর পোকার খেলে, সে হল আমি। আর মদ খেতে থাকলে ও টার্লটনদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু মুশকিল কোথায় জানো – ওর মন এগুলোতে নেই। তাই আমার ওকে অন্য রকম মনে হয়।”
স্কারলেট নিশ্চুপ হয়ে গেল। কোন প্রতিবাদ করতে পারল না। বাপী যা বলছেন সেটা পুরোপুরি সত্যি। এই সব মজার ব্যাপারগুলো, যেটা ও এত ভাল ভাবে করতে পারে, সেগুলোতে ওর শুধুমাত্র একটা আলগা আকর্ষণ রয়েছে। অথচ আর সবাই এসব কাজে কত আনন্দ পায়!
জেরাল্ড স্কারলেটের চুপ করে থাকার কারন ভাল করেই বুঝতে পারলেন। একটু জয়ের হাসি হেসে বললেন, কি সোনা, তুমি নিজেও স্বীকার করছ যে কথাগুলো সত্যি। তাই না? তাহলেই বল অ্যাশলের মত বর নিয়ে তুমি কি করবে? ওদের প্রত্যেকের মাথায়ই একটু ছিট আছে।” তারপর একটু মন ভোলানোর মত করে বললেন, “আমি যে টার্লটনদের কথা বললাম, ভেবো না যে আমি তোমাকে কোন জোর করছি। ওরা খারাপ নয়। কিন্তু তোমার যদি কেড কাল্ভার্টকে মনে ধরে, তাহলেও আমাদের আপত্তি নেই। ওরাও ভাল। তবে দোষের মধ্যে হল যে ওর বাবা একজন ইয়াঙ্কিকে বিয়ে করেছেন। আর একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখ মামনি। আমি এই টারা তোমাকে আর কেডকেই দিয়ে যাব।”
“দোহাই তোমার, তুমি এরকম করে জোর কোরো না। আমি কেডকে চাই না। আর টারা বা অন্য কোন পুরোনো প্ল্যান্টেশন নিয়েই বা কি হবে যদি আমি _____”
স্কারলেট বলতে যাচ্ছিল “যদি আমি মনের মানুষকে না পাই”। কিন্তু ও যেভাবে জেরাল্ডের দেওয়া উপহার অবজ্ঞার সাথে প্রত্যাখান করল, তাতে উনি যার পর নাই অসন্তুষ্ট হলেন। এলেনের পর এই প্ল্যান্টেশনকেই উনি সর্বাধিক ভালবাসতেন। উনি গর্জন করে উঠলেন।
“তাহলে, স্কারলেট ও’হারা, তুমি এটাই বলতে চাও, যে টারা, আমাদের এই খেত, এর কোনোই মূল্য নেই?”
স্কারলেট একগুঁয়েভাবে ঘাড় নাড়ল। ওর মনের এখন যে অবস্থা, তাতে বাপী রেগে গেল কি গেল না, তাতে ওর কিছুই এসে যায় না।
“জমিই এই সংসারে একমাত্র সম্পদ, যার কোনো মূল্য আছে!” জেরাল্ড চেঁচিয়ে বললেন। তাঁর ছোট ছোট হাত দুটো রাগতভাবে ওঠা নামা করতে লাগল। “কারন এই মাটিই অনন্তকাল টিকে থাকে। এ কথা ভুলে যেও না। এটাই একমাত্র সম্পদ, যার জন্য কাজ করতে হয়, লড়াই করতে, দরকার পড়লে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।”
অধৈর্য হয়ে স্কারলেট বলে উঠল, “ওঃ বাপী তুমি একদম আইরীশদের মত কথা বলছ!”
“কি মনে কর, আমি তার জন্য লজ্জা পাই? না! গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে। আর ভুলে যেও না তুমিও অর্ধেক আইরীশ! আর যাদের শরীরে বিন্দুমাত্র আইরীশ রক্ত আছে, তারা মাটিকে, নিজেদের আশ্রয়কে, মা বলে মনে করে। এই মুহুর্তে, তোমার জন্যই আমার লজ্জা হচ্ছে। আমি তোমাকে পৃথিবীর সুন্দরতম খেত দিতে চাইলাম। আর তুমি নাক কুঁচকোলে!”
বেশ একটা তৃপ্তি নিয়ে চেঁচিয়ে জেরাল্ড স্কারলেটকে বকছিলেন। হয়ত আরো কিছুক্ষণ চলত। কিন্তু হঠাৎ ওর দুঃখপীড়িত মুখের দিকে নজর পড়তেই থেমে গেলেন।
“তুমি তো এখনও কিশোরি। তুমিও একদিন অনুভব করবে – এই মাটির টান – যদি তোমার মধ্যে আইরীশ রক্ত থাকে। তুমি তো শিশু। তোমার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছ। আরো একটু বড় হও, তখন বুঝতে পারবে ___। এখন তুমি শুধু কেড, বা যমজভাইদের একজনকে পছন্দ করে নাও – তেমন হলে – ইভান মুনরোর কোন এক ছেলে হলেও চলবে – তারপর দেখো আমি তোমার জন্য কি কি করি।”
“ওহ বাপী।”
এতক্ষণ কথাবার্তা বলে, জেরাল্ড পরিশ্রান্ত বোধ করছিলেন। এমন একটা সমস্যা তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ার জন্য বিরক্তও বোধ করছিলেন। সব থেকে বড় কথা হল, কাউন্টির সব থেকে অভিজাত পরিবারের ছেলেদের ব্যাপারে তাঁর অমত নেই জানানোর পর আর টারা প্ল্যান্টেশনের যৌতুক দেবার লোভ দেখানোর পরেও স্কারলেটের মনমরা ভাব মুছে যায় নি, এতে তিনি ক্ষুব্ধ বোধ করছিলেন। ওঁর কাছ থেকে কোন উপহার পেলে সবাই হাততালি দেবে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, এটাতেই উনি অভ্যস্ত।
“নাও, আর মুখ ভার করে থেকো না। কাকে বিয়ে করছ তাতে কিছু এসে যায় না। যেটা প্রয়োজন সেটা হল চিন্তাভাবনার সাদৃশ্য। তাকে ভদ্রলোক হতে হবে। আর সাদার্নার হিসেবে সে গর্ববোধ করে কি না। মেয়েদের ভালবাসা বিয়ের পরেই আসে।”
“বাপী, এটা তো পুরোনো দিনের ধারণা!”
“কিন্তু খুব মজবুত ধারণা। ভালবেসে বিয়ে করার এই আমেরিকান ধারণা – ঠিক যেন চাকর বাকর কিংবা ইয়াঙ্কিদের মত। মা বাবা পাত্র-পাত্রী পছন্দ করে বিয়ে দেবেন – এই সব বিয়েই টেঁকসই হয়। এই ধর তোমার মত একটা বোকা মেয়ে কি করে বুঝবে যে কে ভদ্রলোক আর কে ইতর? উইল্কসদের কথাই ধরা যাক। এত পুরুষ ধরেও কি ভাবে ওদের শক্তি আর গর্ববোধ ধরে রাখতে পেরেছে? কিছুই নয়, ওরা সব সময় নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে, তাই। আর ওদের পরিবারও সেটাই চায়।”
“ওঃ!” স্কারলেটের হৃদয় আবার ব্যথায় ভরে উঠল।
“আবার কাঁদছ মামনি?” জেরাল্ড বিব্রত হয়ে বললেন। ঝুঁকে পড়ে অপটু হাতে স্কারলেটের চিবুক ধরে ওর মুখটা তুলে ধরলেন। তাঁর চোখে সমবেদনার দৃষ্টি।
“না কাঁদছি না” বলে স্কারলেট এক ঝটকায় সরে গেল।
“না তুমি সত্যি বলছ না। কিন্তু আমি তোমার জন্য গর্ববোধ করছি। তোমার আত্মমর্যাদা বোধের জন্য। কাল তুমি বারবেকিউতে মাথা উঁচু করে যাবে। আমি চাই না কেউ বলুক যে তুমি এমন একজন কে ভালবাস যে সাধারণ বন্ধুত্ব ছাড়া তোমাকে তার মনে জায়গা দেয় নি।”
“মনে জায়গা নিশ্চয়ই দিয়েছিল,” স্কারলেট বেদনার্ত মনে ভাবল। “অনেকখানিই দিয়েছিল। আমি জানি। ওহ, আর একটু সময় পাওয়া গেলে আমি ওকে দিয়ে বলিয়ে নিতে পারতাম! ইশ! নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করা উচিত এরকম একটা ধারণা উইল্কসদের মধ্যে না থাকলে কত ভাল হত!”
জেরাল্ড স্কারলেটের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন, আর বললেন, “চল, এবার খাবার সময় হয়ে গেছে। হ্যা আর এসব শুধু তোমার আর আমার মধ্যেই থাকা ভাল। তোমার মা কে এ নিয়ে জ্বালাতন করে লাভ নেই। নাও চোখ মুখ মুছে নাও।”
রুমালে মুখ মুছে বাপীর হাত ধরে ও এগিয়ে গেল। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে স্কারলেট আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু অন্ধকারে মনে হল বারান্দায় তার মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাথায় বনেট, গায়ে শাল আর হাতে দস্তানা। পেছনে থমথমে মুখে ম্যামি। তার হাতে এলেনের ওষুধের পেটি,যা দিয়ে তিনি পীড়িতদের শুশ্রুষা করেন। ম্যামিকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই রেগে আছে। অপছন্দের কিছু হলে ম্যামির রেগে যাওয়ার অভ্যেস।
“মিস্টার ও’হারা,” এলেন বললেন। সতের বছর বিয়ে হবার আর ছটি সন্তানের জন্ম দেবার পরেও তিনি এই লৌকিক সম্বোধন ছাড়তে পারেন নি। “স্ল্যাটারিদের ওখানে অসুস্থতার খবর পেয়েছি। এমির বাচ্চা হয়েছে। বোধহয় বাঁচবে না। তার আগে ব্যাপটাইজ় করতে হবে। ম্যামিকে নিয়ে ওখানেই যাচ্ছি। যদি কিছু করতে পারি।”
তারপর প্রশ্নসূচকভাবে জেরাল্ডের দিকে তাকালেন। একটা আনুষ্ঠানিক অনুমোদন কেবল, কিন্তু জেরাল্ডের অহংবোধকে পরিতৃপ্ত করে।
“জানি না কেন এইসব বেজন্মা সাদারা তোমাকে এই সাপারটাও নিশ্চিন্ত মনে খেতে দেবে না! কি আর করবে? যাও। নইলে তো তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতেও পারবে না।”
“এইসব নিগ্রো আর গরীব বেজন্মা সাদাদের জন্য উনি কখনও কি রাতে শুতে পারেন!” ম্যামি একঘেয়ে স্বরে গজগজ করতে লাগল।
“আজ খাবার টেবিলে আমার জায়গাটা তুমি নিও সোনা,” দস্তানাপরা হাতে স্কারলেটের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে এলেন বললেন।
অশান্ত মন নিয়েও মায়ের হাতের যাদুষ্পর্শে আর মায়ের সিল্কের ড্রেস থেকে লেবুর ফুলের সুগন্ধ স্কারলেটকে কিছুটা সান্ত্বনা দিল। স্কারলেটের মনে হত তার মাকে ঘিরে এমন কিছু একটা যাদু আছে যা তাকে সব সময় স্বস্তি আর আনন্দ দেয়।
জেরাল্ড এলেনকে সাবধানে গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। তারপর গাড়োয়ানকে সাবধানে গাড়ি চালাবার আদেশ দিলেন। টোবি এই আদেশটা মোটেই সন্তুষ্ট মনে নিল না। মনে হল তার কাজে এটা জেরাল্ডের ফোপরদালালি। অবশ্য মুখে কিছু বলল না। এলেনকে নিয়ে ম্যামি আর টোবি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
“যদি আমি স্ল্যাটারিদের জন্য এত কিছু না করতাম, তাহলে ওদের অন্য জায়গায় পয়সা দিয়ে করাতে হত,” জেরাল্ড রাগতস্বরে বললেন। “আর এর জন্য ওদের কয়েক একর জলা জমি বিক্রী করে দিতে বাধ্য হত। তাহলে অন্তত ওদের হাত থেকে বাঁচা যেত।” তারপর একটু হেসে, যেন কোন পুরোনো রসিকতার কথা মনে পড়েছে, বললেন, “চল, পোর্ককে গিয়ে বলা যাক, ডিলসিকে কেনার বদলে ওকেই আমি উইল্কসদের কাছে বেচে দিয়েছি।”
ঘোড়ার লাগাম একজন নিগ্রো পরিচারকের হাতে দিয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। স্কারলেটের মর্মবেদনার কথা বিলকুল ভুলে গিয়ে তাঁর পরিচারকের পেছনে লাগবার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ভারি মন আর শরীর নিয়ে স্কারলেটও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। ভাবতে লাগল, অ্যাশলের সঙ্গে ওর বিয়ে হলে সেটা নিশ্চয়ই ওর বাপী আর এলেন রোবিল্যার ও’হারার বিয়ের থেকে বেশি অসঙ্গত হবে না। মাঝে মাঝে ও অবাক হয়ে ভাবে যে বাপীর মত একজন অনুভূতিহীন এবং অমার্জিত মানুষের সঙ্গে মায়ের মত একজন মহিলার বিয়ে হয়েছিল, যাঁরা জন্মসূত্রে, শিক্ষাদীক্ষায় আর মানসিকতায় এত আলাদা!
তৃতীয় পর্ব-----------------------------------
এলেন ও’হারার বয়স বত্রিশ বছর। সেই যুগের মাপকাঠিতে তাঁকে মধ্যবয়স্কা মহিলা বলা যেতে পারে। তিনি ছ’টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তার মধ্যে তিনটি বেঁচে নেই। ছোটখাটো জেরাল্ডের তুলনায় তিনি প্রায় এক মাথা লম্বা। কিন্তু তাঁর চলাফেরা থেকে এই ব্যাপারটা কাউকে খেয়াল করার সুযোগ দিতেন না। মসৃণ, দুগ্ধফেননিভ ত্বক। গ্রীবা সরু এবং লম্বা। মাথার সঘন কেশরাশিকে সামাল দেবার জন্য সামান্য হেলানো। ফরাসি মায়ের কাছ থেকে তিনি তাঁর গভীর চোখ, চোখের কালো পালক আর কালো কেশরাশির উত্তরাধিকারি হয়েছিলেন।
বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন উন্নত নাসিকা, চৌকর গণ্ডদেশ আর ঋজু কপোল। ১৭৯১ এর বিপ্লবের সময়, তাঁর মায়ের বাবা-মা হাইতিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর তাঁর বাবা নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন। তাঁর চেহারার মধ্যে যে আত্মাভিমান লক্ষ্য করা যেত সেটা অবশ্য তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ। সেই আত্মাভিমানের মধ্যে কোন ঔদ্ধত্য ছিল না। ছিল ঔদার্য আর বিষন্নতা। অবশ্য কোনরকম কৌতুকরসবোধ তাঁর একদমই ছিল না।
বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন উন্নত নাসিকা, চৌকর গণ্ডদেশ আর ঋজু কপোল। ১৭৯১ এর বিপ্লবের সময়, তাঁর মায়ের বাবা-মা হাইতিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর তাঁর বাবা নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন। তাঁর চেহারার মধ্যে যে আত্মাভিমান লক্ষ্য করা যেত সেটা অবশ্য তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ। সেই আত্মাভিমানের মধ্যে কোন ঔদ্ধত্য ছিল না। ছিল ঔদার্য আর বিষন্নতা। অবশ্য কোনরকম কৌতুকরসবোধ তাঁর একদমই ছিল না।
একজন অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর চোখে ছিল দীপ্তির অভাব, হাসিতে উষ্ণতার আর কন্ঠস্বরে ছিল স্বতঃস্ফুর্ততার অভাব। তিনি উপকুলবর্তি জর্জিয়ার বাচনভঙ্গিতে কথা বলতেন। স্বরবর্ণের থেকে ব্যঞ্জনবর্ণের ওপর জোর থাকত বেশি। ফরাসি বাচনভঙ্গির কোন চিহ্ন তাঁর কথাবার্তায় ছিল না। অত্যন্ত মৃদুভাষী – এমন কি কাউকে শাসন করার সময়ও তাঁর কন্ঠস্বর ওপরে উঠত না। তবু টারায় তাঁর আদেশ অমান্য করার সাহস কারও ছিল না। তাঁর স্বামী জেরাল্ডের আদেশ অবশ্য অনেক সময়ই লোকে নিঃশব্দে অগ্রাহ্য করত।
স্কারলেট যতদূর মনে করতে পারে, ওর মাকে একই রকম দেখে আসছে। মৃদুভাষী, দৃঢ়, ঋজু, দক্ষ এবং অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। তিনটি সন্তানের মৃত্যুর আঘাত সহ্য করেছেন। কিন্তু স্কারলেট তাঁকে কখনও ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। যখন চেয়ারে বসেন, স্কারলেট লক্ষ্য করেছে, কখনই পেছনে হেলান দেন নি। খাবার সময় ছাড়া, কিংবা যখন রোগীর শুশ্রুষা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, মা কখনও খালি হাতে বসে থাকেন না। অন্তত কোন একটা সূচিকর্ম নিয়ে বসবেনই। অতিথির উপস্থিতিতে কোনো সুক্ষ্ণ এম্ব্রয়ডারির কাজ। অন্য সময়ে জেরাল্ডের কোঁচকানো ছেঁড়া শার্টের রিফু, বা মেয়েদের কিংবা দাসদাসীদের পোশাক সেলাইয়ের কাজ। এছাড়া এলেন সময়ে সময়ে রান্নাবান্নার তদারকি, এ ঘর ও ঘর ঘুরে ঘুরে ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখার তদারকি এই সব নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
স্কারলেট কখনই তাঁকে তাঁর অনাড়ম্বর প্রশান্তি থেকে বিচ্যুত হতে দেখেনি। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত আচার বিচারেও নিয়মানুবর্তিতা ছিল কঠোর। তা সে দিন কিংবা রাতের যে কোন সময়ই হোক না কেন। যখন এলেন বলডান্সে যাবার প্রস্তুতি নেন, কিংবা কোন অতিথিকে সঙ্গ দেবার প্রয়োজন পড়ে, বা কোন কাজে জোন্সবোরোতে যাবার প্রয়োজন পড়ে তখন ঠিক দু’ঘন্টা, ম্যামি আর দুজন ক্রীতদাসী লাগে সাজগোজ করবার জন্য। অথচ, যখন কোন জরুরি প্রয়োজনে তৈরি হতে হয়, তখন কি সুন্দর চট করে তৈরি হয়ে চলে যান।
স্কারলেটের শোবার ঘর ছিল হলের অন্য প্রান্তে, মা বাবার ঘরের বিপরীতে। যখন ছোট ছিল তখন থেকেই দেখেছে অনেক সময় ওই ঘরে ভোর হতে না হতেই কোন নিগ্রো বালিকা ভীত সন্ত্রস্তভাবে কড়া নেড়েছে। জরুরি প্রয়োজনে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের বেরিয়ে যাবার হালকা পায়ের শব্দ পেয়েছে। কখন কখন দরজা একটু ফাঁক করে দেখতে পেয়েছে মা ওষুধের বাক্স হাতে বেরিয়ে এসেছেন। মার্জিতভাবে সাজগোজ করা, চুল মাথার পেছনে পরিপাটি করে বাঁধা।
মা হলঘর দিয়ে পা টিপে টিপে যেতে যেতে ফিস ফিস করে দৃঢ় কিন্তু দরদভরা স্বরে বলতেন, “একদম জোরে কথা নয়। মিঃ ও’হারা জেগে যাবেন। আমরা সময় মতই পৌঁছে যাব।” এই কন্ঠস্বর স্কারলেটকে খুব স্বস্তি দিত। ও আবার শুয়ে পড়ত। নিশ্চিন্ত মনে। মা যে খুব ভরসার জায়গা।
তারপর সকালে এলেনকে যথারীতি ব্রেকফাস্টের আয়োজনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত। তখন তাঁর চোখে মুখে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তির ছাপ হয়ত থাকত, কিন্তু কথায়বার্তায় কিংবা ব্যবহারে কিছুই বোঝা যেত না। হয়ত, সারা রাত একা হাতেই জন্ম কিংবা মৃত্যুকে সামলাতে হয়েছে। হয়ত ডঃ ফোনটেন কিংবা তাঁর ডাক্তার ছেলে কেউই অন্য কলে ব্যস্ত থাকার জন্য আসতে পারেন নি। তাঁর চরিত্রে একটা ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা ছিল, যেটা সবাই সমঝে চলত। তাঁর মেয়েরা, চাকরবাকর, এমন কি জেরাল্ডও। অবশ্য জেরাল্ড সেটা মরে গেলেও স্বীকার করতে পারবেন না।
মাঝে মাঝে রাত্তিরবেলা স্কারলেট চুপি চুপি ঘুমন্ত মায়ের গালে চুমু খেয়ে আসত। মায়ের ঠোঁট দেখে ভাবত, উনি কি কখনও কিশোরিদের মত চটুল হেসে বান্ধবীদের সাথে গোপন কথা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন? মনে হয় না। মা তার ভরসার জায়গা; তার মা সব কিছু জানেন।
কথাটা ঠিক নয়। অবশ্য স্কারলেটের জানার কথাও নয়। এলেন রোবিল্যার তখন পনেরো বছরের কিশোরী। আর পাঁচটা মেয়ের মতই, সেও তার বান্ধবীদের সাথে জীবনের সব গোপন কথা ভাগাভাগি করে নিত। কেবল একটি কথা ছাড়া। সেই বছরই তার জীবনে জেরাল্ড ও’হারার প্রবেশ। ওর থেকে আঠাশ বছরের বড় জেরাল্ড। আর সে বছরই তার জীবন থেকে চিরবিদায় নেয় তার জ্যেঠতুতো ভাই ফিলিপ রোবিল্যার। কাজল-চোখো আর দূরন্ত ফিলিপ রোবিল্যার যখন স্যাভান্না ছেড়ে চিরতরে চলে গেল, সে যেন এলেনের সমস্ত আনন্দ, সমস্ত ফূর্তিও নিয়ে চলে গেল। যে আইরীশ ভদ্রলোক তার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন, তিনি শুধু এলেনের বাইরের নিরুত্তাপ খোলসটাকেই গ্রহণ করলেন, মন অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে।
অবশ্য জেরাল্ড এই বিবাহকে তাঁর অভাবনীয় ভাগ্য হিসেবেই নিলেন। কি পাননি তার হিসেব করার কথা মনেও আসেনি। তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর মত একজন মানুষ যার কিনা কোন রকম পারিবারিক আভিজাত্যই ছিল না, তিনি এমন একজনকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেলেন, যাঁর পারিবারিক মর্যাদা প্রশ্নাতীত। জেরাল্ড নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন।
মাত্র একুশ বছর বয়সে, একবস্ত্রে তিনি আয়ার্ল্যান্ড থেকে আমেরিকায় পালিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সমস্ত কুকীর্তিকে পেছনে ফেলে। ইংরেজ সরকার তাঁকে একজন স্বত্বভোগী নিষ্কর্মা জমিদারের খাজনা আদায়কারীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিল। তাই তাঁকে সময় নষ্ট না করে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। যদিও জেরাল্ডের মতে লোকটা এক নম্বরের বেজন্মা ছিল আর শিস দিয়ে “দি বয়েন ওয়াটার” এর প্রথম কয়েক লাইন গেয়ে তাঁকে রীতিমত অপমান করেছিল।
বয়েনের যুদ্ধ১ অন্তত একশ বছর আগে হয়েছিল। অবশ্য ও’হারা পরিবার আর তাদের পড়শীদের কাছে মনে হত যেন গতকালকের ঘটনা, - যে যুদ্ধে তাদের সব স্বপ্ন, সম্পদ ধুলোয় মিশে গেছিল। অরেঞ্জের উইলিয়ামের ঘৃণ্য বাহিনীর কাছে যখন স্টুয়ার্টের যুবরাজ পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছিলেন। [১ বয়েনের যুদ্ধ – ১৬৯০ সালে অপসৃত রাজা জেমস ২ এবং ইঙ্গল্যান্ডের রাজা উইলিয়াম ৩ (অরেঞ্জের যুবরাজ) এর মধ্যে বয়েন নদীর ধারে হয়েছিল। উইলিয়াম এই যুদ্ধে জয়ী হন।]
এই সব নানা কারনে, জেরাল্ডের পরিবার এই ঝগড়াকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। কিন্তু ইংরেজ পুলিশ ব্যাপারটাকে সহজে মেনে নেয় নি, কারন ও’হারা পরিবা্রের সরকার বিরোধী ভুমিকা নিয়ে ওদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এর ভয়াবহ পরিণাম থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য, কেবল জেরাল্ডই নয় তাঁর পরিবারের অনেকেই পালিয়ে গেছিলেন। জেমস আর এন্ড্রুস – জেরাল্ডের বড় দুই ভাই – অনেক বছর আগেই আমেরিকা পালিয়ে এসেছিলেন। জেরাল্ডের শুধু এটুকই মনে আছে যে দু’জন যুবক কখন কখন মধ্যরাত্রে লুকিয়ে বাড়িতে দেখা করতে আসতেন। তাঁদের বাড়ির শুয়োরের আস্তাবল থেকে কিছু রাইফেল উদ্ধার হবার পরে পরেই তাঁরা পালিয়ে যান। এখন সাভান্নায় তাঁরা সফল ব্যবসায়ী। ‘কে জানে ওরা কোথায় আছে’ এই বলে মা এই দুই দাদা সম্বন্ধে বলতেন। জেরাল্ডকে এঁদের কাছেই পরে পাঠানো হয়েছিল।
বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময়, মা তাঁর গালে একটা চুমু দিয়েছিলেন। বাবা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তুমি কে সেটা ভুলে যেও না। আর কারও দয়ার ওপর থেকো না।’ তাঁর পাচজন লম্বা ভাই তাঁকে প্রশংসামিশ্রিত স্নেহের হাসি দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন। জেরাল্ডই পরিবারের মধ্যে সব থেকে ছোট, আর ছোট খাট মানুষ ছিলেন।
তাঁর পাঁচ ভাই আর বাবা সকলেই ছ’ফুটের ওপর লম্বা ছিলেন। জেরাল্ড ছিলেন মাত্রা পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি। এর জন্য জেরাল্ডের মনে কোন দুঃখ ছিল না। কোন কিছু অর্জন করার ব্যাপারেও উচ্চতার অভাব কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং তাঁর এই আঁটসাঁট ছোট খাটো চেহারাই তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছিল, তিনি অনেকে আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, বেঁটে মানুষকে লম্বা মানুষের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। আর জেরাল্ড খুবই পরিশ্রমী ছিলেন।
তাঁর লম্বা ভাইয়েরা সকলেই খুব বিষণ্ণ আর চুপচাপ থাকতেন। পরিবারের হৃতগৌরব তাঁদের কাছে খুবই পীড়াদায়ক ছিল যেটা কখনো কখনো তাঁদের শ্লেষের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে যেত। যদি জেরাল্ডও ওঁদের মত শক্তিশালী হতেন তাহলে হয়ত তিনিও একই রকম হতেন এবং গোপনে সরকারের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতেন। কিন্তু জেরাল্ড ছিলেন, তাঁর মায়ের ভাষায়, গোঁয়ারগোবিন্দ, এবং বদমেজাজি আর কথায় কথায় হাত চলত। হেলতে দুলতে চলা খর্বকায় মোরগের মত তিনি সদম্ভে চলাফেরা করতেন। তাঁর পরিবারের সকলেই অবশ্য তাঁকে ভালবাসতেন এবং এটাকে প্রশ্রয়ের চোখেই দেখতেন। কেবল নজর রাখতেন যে ভাইয়ের মারকুটে স্বভাব যেন কোন গুরুতর অশান্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
আকেরিকাতে পদার্পণ করার সময় তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা যদি তেমন বলবার মত নাও থেকে থাকে, জেরাল্ড সে ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামান নি। অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ তির্যক মন্তব্য করলেও ঊনি খুব একটা পরোয়া করতেন না।। তাঁর মা তাঁকে পড়তে শিখিয়েছিলেন আর গোটা গোটা অক্ষরে লিখতেও শিখিয়েছিলেন। হিসেব করাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল। এইটুকুই তাঁর পুঁথিগত বিদ্যার দৌড়। ল্যাটিন ভাষা বা আয়ার্ল্যান্ডের ইতিহাস সম্বন্ধেও তাঁর উল্লেখযোগ্য কোন জ্ঞান ছিল না। তেমন কোন কবিতা কিংবা সঙ্গীতও তাঁর জানা ছিল না। লেখাপড়া জানা মানুষদের অবশ্য তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। তবে তাঁর মনে হত, এই নতুন দেশে এত রাত জেগে পড়াশুনো করবার কি এমন প্রয়োজন, যখন ্মূর্খ অজ্ঞানী লোকেরাও তো এখানে এসে বেশ কপাল ফিরিয়ে নিয়েছে? এই দেশে দরকার শক্তসমর্থ লোকের যারা কঠোর পরিশ্রম করতে পিছপা হবে না।
জেরাল্ডের গোটা গোটা হাতের লেখা আর হিসেবের দক্ষতার জন্য জেমস আর এন্ড্রুস ওঁকে নিজেদের স্টোরে বহাল করে দিয়েছিলেন – লেখাপড়া অল্প জানা থাকা সত্ত্বেও। জেরাল্ডের সাহিত্যে রুচি কিংবা সঙ্গীতে পটুত্ব থাকলেই বরং তাঁর মূল্য কমে যেত। সেই সময়ের আমেরিকা আইরিশদের জন্য সম্ভাবনাময় স্থান ছিল। জেমস আর এন্ড্রুস আমেরিকায় জীবন শুরু করেছিলেন ওয়াগনে মাল তোলার কাজ দিয়ে। সেইসব ওয়াগন সাভান্না থেকে জর্জিয়ার ছোট ছোট শহরে মাল সরবরাহ করে থাকত। কিন্তু অল্প দিনেই তাঁরা ফুলে ফেঁপে উঠে নিজেদের একটা স্টোরও খুলে বসলেন। এঁদের সঙ্গ পেয়ে জেরাল্ডও উন্নতি করতে থাকলেন।
আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চল তাঁর বেশ ভাল লেগে গেল। নিজেকে দক্ষিণের অধিবাসী বলতে তিনি গর্ববোধ করতেন। হয়ত এদের অনেক ব্যাপারস্যাপারই তাঁর বোধগম্য হত না। তবুও তিনি নিজের মত করে এই অঞ্চলের আদবকায়দা রপ্ত করে নিয়েছিলেন – পোকার খেলা, ঘোড়দৌড়, ডুয়েল খেলার নিয়ম, রাজ্যের অধিকার, ইয়াঙ্কিদের অন্তর থেকে ঘৃণা করা, ক্রীতদাস প্রথা, কার্পাস চাষের সুবিধা, বেজন্মা সাদা চামড়ার মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা আর মহিলাদের প্রতি ফলাও করে সৌজন্য প্রকাশ। তামাক চিবোনোর অভ্যেসও রপ্ত করেছিলেন। হুইস্কি খাওয়ার অভ্যেস তাঁর বরাবরই ছিল। কিন্তু জেরাল্ড আসলে জেরাল্ডই রয়ে গেলেন। হয়ত তাঁর অভ্যেস আর জীবনচর্যায় কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছিল, কিন্তু তাঁর আচরণ তিনি পরিবর্তন করেন নি, যদিও অল্প চেষ্টা করলে সেটা অসম্ভব ছিল না। যে সব ধান এবং কার্পাস প্ল্যান্টাররা তাঁদের রাজ্য ছেড়ে সাভান্নায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের মার্জিত আভিজাত্য তাঁর খুব ভাল লাগত। তবে তিনি নিজে খুব একটা মার্জিত হয়ে উঠতে পারেন নি। তাঁদের কথা বলবার মৃদু ভঙ্গী তাঁর কানে মধুর লাগত, কিন্তু তিনি তাঁর অভ্যস্ত ভঙ্গীতে উচ্চস্বরেই কথা বলতেন। এঁরা বাজীতে হেরে গিয়েও মর্যাদাবোধ বিসর্জন না দিয়েও হাসি মুখে হার স্বীকার করে নিতে পারতেন – জেরাল্ড মনে মনে সেটারও তারিফ করেতেন। দারিদ্র কি সেটা একসময় অনুভব করেছেন। তাই কখনও হেরে গেলে সেটা চুপচাপ মেনে নিতে পারতেন না। এই তরুন আইরিশ মানুষটির মধ্যে এক সজীব অস্থিরতা ছিল, যেটা উপকূলবর্তি এইসব মানুষের মধ্যে ছিল না।
যেটা তাঁর মনে হত প্রয়োজনীয় বলে, সেটা তিনি এঁদের কাছ থেকে গ্রহন করতেন, আর অপ্রয়োজনীয় যেটা, তৎক্ষণাৎ বাতিল করে দিতেন। দক্ষিণের সমস্ত রীতিনীতির মধ্যে পোকার খেলা তাঁর কাছে বিশেষ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল – পোকার খেলা এবং হুইস্কি পান করার ক্ষমতা। তাস খেলবার সহজাত প্রতিভার বলে তাঁর তিনটি মূল্যবান সম্পত্তির মধ্যে দু’টি অর্জন করেছিলেন – এ্ তাঁর খানসামা আর দুই, প্ল্যান্টেশন। তৃতীয়জন হলেন তাঁর স্ত্রী। জেরাল্ড মনে করতেন ঈশ্বরের অপার করুণায় স্ত্রীকে তিনি লাভ করেছিলেন।
পোর্ক – তাঁর খানসামা – নিকষ কালো, কিন্তু বেশবাসে ফিটফাট – একে জিতে ছিলেন সেন্ট সাইমন দ্বীপের এক প্ল্যান্টারের সঙ্গে সারা রাত পোকার খেলে। ধাপ্পাবাজীতে তিনি জেরাল্ডের থেকে কম যেতেন না। কিন্তু নিউ অরলিন্সের রাম হজম করার ক্ষমতায় জেরাল্ডের ধারে কাছেও যেতে পারেন নি। তিনি অবশ্য দ্বিগুণ মূল্যে পোর্ককে আবার কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেরাল্ড কিছুতেই রাজী হন নি, সেটাই তাঁর প্রথম ক্রীতদাস। আর তাঁর স্বপ্নই ছিল অনেক ক্রীতদাসের আর বিস্তীর্ণ চাষযোগ্য জমির মালিক হওয়া। অবশ্য পরে বুঝেছিলেন যে পোর্ক হল সেই অঞ্চলের এক নম্বর খানসামা।
জেমস আর এন্ড্রুসের মত সারাদিন দর কষাকষিতে ব্যস্ত থাকা কিংবা রাত্রে মোমবাতির আলোয় পাতার পর পাতা হিসেব মেলানো যে তিনি করবেন না এ ব্যাপারে তিনি মনস্থির করেই ফেলেছিলেন। তাঁর মনে হত, তাঁর দাদাদের মত যারা কারবার থেকে পয়সা উপার্জন করে তাঁদের সামাজিক অবস্থান যথেষ্ট সম্মানজনক নয়। তাই তিনি চেয়েছিলেন প্ল্যান্টার হতে। একজন পোড় খাওয়া আইরিশম্যানের মত –যাঁকে নিজের জমি হারিয়ে সেই জমিতেই বর্গাদার হিসেবে কাজ করতে হয়েছে – তিনি বিঘের পর বিঘে সবুজ শস্যক্ষেতের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। নিজের বাড়ি, নিজের প্ল্যান্টেশন, নিজের ক্রীতদাস, নিজের ঘোড়া - দৃঢ়ভাবে এবং অবিচল থেকে তিনি এইসব লক্ষ্যপূরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এই নূতন দেশে অন্ততঃ দুটো বিপদের সম্ভাবনা নেই। এক, গলাকাটা কর, আর দুই, জমি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবার দুশ্চিন্তা। কিন্তু শুধু উচ্চাশা থাকলেই তো হবে না। সেটা পূরণ করার একটা পরিকল্পনা থাকাটাও প্রয়োজন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই সত্যিটা তিনি উপলব্ধি করলেন। উপকূলবর্তি জর্জিয়াকে ধনী সম্প্রদায় যেভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন, তাতে এই লক্ষ্যপূরণ হওয়াটা বেশ দুষ্কর ছিল।
খানিকটা ভাগ্যের জোরে, আর খানিকটা পোকার খেলার বিশেষ পারদর্শিতার জন্য একটা প্ল্যান্টেশন তিনি শীঘ্রই হস্তগত করে ফেললেন, পরে যেটার নামকরণ করেছিলেন টারা। তারপর তিনি উপকুল এলাকা ছেড়ে পাহাড়ি উত্তর জর্জিয়ায় চলে এলেন।
বসন্তের এক উষ্ণ সন্ধ্যেবেলা স্যাভান্নার এক পানাগারে বসেছিলেন। এমন সময় কাছেই বসে থাকা এক অপরিচিত ব্যাক্তির কথোপকথন তাঁর কানে এল। বারো বছর দেশের মধ্যভাগে কাটিয়ে ভদ্রলোক সম্প্রতি স্যাভান্নায় ফিরে এসেছেন। জেরাল্ডের আমেরিকা আসবার এক বছর আগের কথা। সরকার মধ্য জর্জিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ইন্ডিয়ানদের থেকে দখল করে একটা লটারির মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে বিতরণ করেছিলেন। ভদ্রলোক সেই লটারিতে কিছু জমি পেয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটি প্ল্যান্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্ত দূর্ভাগ্যবশতঃ, তাঁর বাড়িটি আগুনে পুড়ে যায়। সেই ‘অভিশপ্ত জায়গাটি’ এখন তিনি যে কোন ভাবে হস্তান্তর করতে আগ্রহী।
একটা প্ল্যান্টেশনের মালিক হবার অদম্য ইচ্ছে জেরাল্ডের মনে অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই যেচে সেই অপরিচিত ব্যক্তিটির সাথে গিয়ে আলাপ জমালেন। জানতে পারলেন ক্যারোলাইনা আর ভার্জিনিয়া থেকে অনেকেই উত্তরাঞ্চলে ভাগ্যানুসন্ধানে যাচ্ছে। তাঁর আগ্রহ আরও প্রবল হল। বহুদিন স্যাভান্নায় বসবাস করে জেরাল্ড বুঝতে পেরেছিলেন যে উপকূলবর্তি এলাকার তুলনায় জর্জিয়ার অন্য জায়গাগুলি ছিল অনগ্রসর। আর ইন্ডিয়ানদের উৎপাত তো লেগেই আছে। দাদাদের ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি মাঝেসাঝে অগাস্টায় গেছেন। স্যাভান্না নদী থেকে প্রায় একশ মাইল ভেতরে। সেখান থেকে আরও ভেতরে গিয়ে ছোট ছোট পশ্চিমের শহরগুলোও দেখে এসেছেন। তাঁর মনে হয়েছিল, সেখানকার বসতিও উপকূলবর্তি এলাকার বসতির মতই জমজমাট। কথাবার্তা থেকে আন্দাজ করলেন ভদ্রলোক যে সব জায়গার কথা বলছেন সেটা স্যাভান্না থেকে অন্ততঃ আড়াইশ মাইল ভেতরে। উত্তর এবং পশ্চিম প্রান্তে। চ্যাটাহূচি নদী থেকে খুব একটা দক্ষিণে নয়। জেরাল্ড জানতেন সেই নদী পেরিয়ে উত্তর দিকের অংশ এখনও চেরোকী জাতির দখলে। ইন্ডিয়ানদের নিয়ে কোন সমস্যা হয় কি না জানতে চাওয়ায় ভদ্রলোক জানালেন ওইসব জায়গায় নতুন শহর গড়ে উঠছে আর প্ল্যান্টেশনও শ্রীবৃদ্ধিলাভ করছে।
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে যখন কথাবার্তা ঝিমিয়ে এল, জেরাল্ড খুব নিরীহভাবে ভদ্রলোককে পোকার খেলার আহ্বান জানালেন। খেলা চলতে চলতে রাত তখন প্রায় শেষের দিকে। প্রত্যেকের পেটেই বেশ কিছু তরল পানীয় গেছে। সবাই নিজের নিজের তাস টেবিলের ওপর রেখে হাত তুলে দিলেন। শুধু জেরাল্ড আর সেই ব্যক্তি তখনও পুরোদমে যুদ্ধ করে চলেছেন। ভদ্রলোকটি তাঁর পকেট থেকে পয়সাকড়ি বের করে টেবিলে রাখলেন। সব থেকে ওপরে রাখলেন তাঁর প্ল্যান্টেশনের দলিল। জেরাল্ডও তাঁর পকেট ঝেড়ে সব টাকা পয়সা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। সবার ওপরে রাখলেন তাঁর টাকার থলি। অবশ্য ওই থলির মধ্যে যে টাকাকড়ি ছিল সেগুলোর মালিক যদি তাঁর দাদারাও হয়ে থাকেন, তাঁর জন্য তাঁর বিবেক খুব একটা দংশন করল না। মনের ইচ্ছে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি সব থেকে সহজ রাস্তা বেছে নেওয়ারই পক্ষপাতী। এছাড়া নিজের ভাগ্য এবং জুয়া খেলার পারদর্শিতার ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। হেরে গেলে দাদাদের এই টাকা কি ভাবে ফেরত দেবেন এই চিন্তা তাঁর মাথায় একবারও এলো না।
“মনে করবেন না যে আপনি খুব জিতে গেলেন। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম যে আমাকে আর ওই জমির ওপর কর গুনতে হবে না। বাড়িটাও বছর খানেক আগে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চার দিক আগাছায় ভরা। যাই হোক জমিটা এখন আপনারই।” ভদ্রলোক কাগজ কলম আনতে বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
সে রাত্রে, যখন পোর্ক তাঁকে শোবার জন্য বিছানা তৈরি করে দিচ্ছিল, তখন জেরাল্ড খুব গুরুত্বসহকারে বোঝালেন, “তোর যদি আয়ার্ল্যান্ডের দেশী মদ খাবার অভ্যেস না থাকে, তাহলে তাস খেলার সময় কখনও হুইস্কি খাবি না।” নতুন মালিকের প্রতি সমীহ দেখিয়ে আর তাঁর পা থেকে জুতো খুলতে খুলতে, স্থানীয় ভাষায় অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে যে জবাব সে দিয়েছিল, সেটা বোঝার সাধ্য এই দুজন ছাড়া আর কারও ছিল না।
একদিকে পাইন গাছের সারি। অন্যদিকে ওক গাছের। আঙ্গুরলতার জট। মাঝখান দিয়ে ফ্লিন্ট নদীর কাদা মাখা জল নীরবে বয়ে চলেছে। সেই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে দুদিক থেকে যেন আলিঙ্গন করে রেখেছে। একটা ছোট ঢিপির ওপর দাঁড়িয়ে (যেখানে আগের বাড়িটি ছিল) জেরাল্ড সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর নবলব্ধ সম্পদ। দুদিকে সারিবদ্ধ গাছ তাঁর নিজের, পরিত্যক্ত ঘাসজমি তাঁর, এমনকি ম্যাগনোলিয়া গাছের সারির নিচে থেকে কোমর অবধি বেড়ে ওঠা আগাছাও তাঁরই। অকর্ষিত বিস্তীর্ণ জমি, পাইন গাছের সারি, তলায় লাল মাটিতে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ঝোপ – সবই জেরাল্ড ও’হারার সম্পত্তি। আইরীশ জেদের বশবর্তি হয়ে সর্বস্ব বাজী রাখার পুরষ্কার।
সেই অব্যবহৃত জমির সামনে দাঁড়িয়ে জেরাল্ড চোখ বন্ধ করলেন। এতদিনে তিনি যেন গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। কল্পনায় একটা সাদা চুনকাম করা বাড়ি দেখতে পেলেন। তাঁর বাড়ি। ঠিক যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানেই তৈরি হবে তাঁর স্বপ্নের সেই বাসস্থান। রাস্তার ওপারে গড়ে উঠবে তাঁর গোয়ালঘর আর আস্তাবল। আর পাহাড়ের কোল থেকে নদীর বুকে এসে পড়া একরের পর একর লাল মাটিতে হবে তুলোর চাষ, যাতে সূর্যের আলো পড়লে হাঁসের পালকের মত সাদা আলো ঝলমল করে উঠবে। ও’হারাদের ভাগ্য আবার ফিরে যাবে।
নিজের সামান্য সঞ্চয় ছিল। অনিচ্ছুক দাদারাও কিছু টাকা ধার দিলেন। জমি বন্ধক রেখেও কিছু টাকা জোগাড় হল। কয়েকজন দাস ক্রয় করে টারায় চলে এলেন। ওভারসিয়ারের পরিত্যক্ত চার কামরার বাড়িতে বানালেন সাময়িক বাসস্থান। তাঁর স্বপ্নের সাদা বাড়িটা শুধু তৈরি হওয়ার অপেক্ষা।
মাঠ পরিষ্কার করিয়ে সেখানে তুলোর চাষ শুরু করলেন। জেমস আর এন্ড্রুসের কাছ থেকে আরো কিছু টাকা ধার নিলেন। আরো কয়েকজন দাস ক্রয় করার জন্য। ও’হারাদের মধ্যে গোষ্ঠিপ্রীতি প্রবল ছিল। ভাল-মন্দ সব সময়েই একে অন্যের পেছনে দাঁড়াত। তবে এর পেছনে বিশেষ কোন আবেগ কাজ করত না। অনেক দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা বুঝেছিলেন যে পারিবারিক ঐক্য বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই দুনিয়াকে মোকাবিলা করা সহজ হয়। তাঁরা জেরাল্ডকে টাকা ধার দিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই জেরাল্ড সেই টাকা সুদে আসলে ফেরত দিয়ে দিলেন। উদ্বৃত্ত আয় থেকে ধীরে ধীরে আশেপাশের জমিগুলোও কিনে ফেললেন। তাঁর প্ল্যান্টেশনের সীমানা বাড়তে লাগল। সাদা বাড়িটাও এখন স্বপ্ন নয়। বাস্তব।
নদীর পাড় ধরে ঢালু সবুজ জমি। পুরনো ওক গাছে ঘেরা। সেই জমির ওপর তাঁর দাসেরা খোলামেলা একটা বাড়ি বানাল। ওক গাছের শাখা প্রশাখার স্নেহময় ছায়া দিয়ে ঘেরা। জেরাল্ড এখানে সুদূর অতীতের মমতার ছোঁয়া পান। ঝোপঝাড় সরিয়ে দিয়ে, বারমুডা ঘাস আর গুল্ম লাগিয়ে লনটাকে পুনরূদ্ধার করা হল। যাতে সেটার দেখভাল ঠিক মত হয় সেদিকেও জেরাল্ড নজর রাখলেন। সেডার গাছ আচ্ছাদিত ক্রীতদাসদের বাসস্থান। একটা স্থায়িত্বের সূচনা। ঘোড়ায় চড়ে ফেরার সময় দূর থেকে যখন তাঁর বাড়ির চূড়া দেখতে পেতেন, সবুজ বনানীর মধ্যে থেকে, গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠত। প্রত্যেকবারই নতুন করে দেখার আনন্দ তাঁকে পেয়ে বসত।
সেই ছোট্ট, একগুঁয়ে মানুষ, জেরাল্ড শেষ পর্যন্ত করে দেখালেন!
প্রতিবেশীদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক। ব্যতিক্রম শুধু ম্যাকিন্টশরা। তাঁর জমির বাঁদিকে ওঁদের জমি। আর স্ল্যাটারিরা। তাঁর জমির ডান দিক থেকে নদীর ধারের জলা জমি আর জন উইল্কসদের প্ল্যান্টেশনের মধ্যে বিস্তৃত এঁদের তিন একর জমির সামান্য সম্বল।
ম্যাকিন্টশেরা ছিলেন উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের অরেঞ্জ সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের যত গুণই থাকুক না কেন, জেরাল্ডের চোখে তাঁরা অত্যন্ত জঘন্য। এঁরা জর্জিয়ায় আছেন সত্তর বছর ধরে। তার আগে তাঁরা কয়েক পুরুষ ধরে ক্যারোলাইনাতেও থেকেছেন। তবু তাঁদের পূর্বপুরুষরা যে উলস্টারের লোক ছিলেন জেরাল্ড মনে করতেন এঁদের ঘৃণা করার জন্য সেটাই যথেষ্ট কারণ।
ওঁরাও ছিলেন খুবই স্বল্পভাষী এবং জেদী ধরনের মানুষ। বিয়েশাদীও নিজেদের আর ক্যারোলাইনার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যপারটা এরকম নয় যে জেরাল্ডই একমাত্র লোক যিনি এঁদের দেখতে পারতে না। আরও অনেকেই এঁদের সম্বন্ধে বিরূপ মনভাব পোষণ করতেন। এঁরা মিশুক লোক ছিলেন, কিন্তু মনে করতেন ম্যাকিন্টশদের মধ্যে সহনশীলতার খুব অভাব। বিশেষ করে একটা গুজব শোনা যেত যে ম্যাকিন্টশেরা নাকি ক্রীতদাসপ্রথা তুলে দেবার পক্ষে। পরিবারের যিনি কর্তা – অ্যাঙ্গাস – তিনি কাউকে ক্রীতদাসত্ব থেকে রেহাই দিয়েছেন বলে শোনা যায় নি। তাঁর কয়েকজন ক্রীতদাসকে কিছু বহিরাগত ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রী করার মত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধও তিনি করেছিলেন। তবু গুজবটা খুব ছড়িয়ে পড়েছিল।
“উনি যে ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ করবার পক্ষে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই,” কথায় কথায় জেরাল্ড বলেছিলেন জন উইল্কসকে। “তবে কি জানেন, অরেঞ্জম্যানরা, নীতি আর স্বার্থের মধ্যে সংঘাতে নীতি বিসর্জন দিতে কখনওই পিছপা হয় না।”
স্ল্যাটেরিদের ব্যাপারটা আবার অন্য রকম। ওরা ছিলেন সাদা চামড়ার গরীব মানুষ। এর ফলে, ম্যাকিন্টশেরা প্রতিবেশীদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যে সম্মান আদায় করতে পেরেছিলেন, স্ল্যাটেরিদের সে ক্ষমতা ছিল না। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত অলস আর ঘ্যানঘ্যানে প্রকৃতির মানুষ। জেরাল্ড কিংবা জন উইল্কস অনেকবারই ওঁদের জমি কিনে নেবার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু স্ল্যাটেরি পরিবারের কর্তা প্রতিবারই সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে এসেছেন। তাঁর রুগ্ন চেহারার স্ত্রী অনেক হাড়জিরজিরে সন্তান-সন্ততির জন্ম দিয়েছেন। সন্তান-সন্ততির সংখ্যা প্রতি বছরই বেড়ে চলেছিল। টম স্ল্যাটেরির কোন ক্রীতদাস ছিল না। তিনি আর তাঁর বড় দুই ছেলে কখনসখনো নিজেরাই জমিতে তুলোর চাষ করতেন। তাঁর স্ত্রী অন্যান্য ছেলে মেয়েদের নিয়ে সব্জীর ক্ষেতের দেখভাল করতেন। অবশ্য সঠিক অর্থে সেটাকে এখন আর সব্জী ক্ষেত বলা যায় না। তুলোর উৎপাদন মোটেই ভাল হত না। আর শ্রীমতি স্ল্যাটেরি প্রায়ই গর্ভবতি থাকার জন্য সব্জীর ক্ষেতের ফলনের থেকেও ভরণপোষণ চালানো মুস্কিল ছিল।
টম স্ল্যাটেরিকে প্রায়ই তাঁর পড়শীদের আঙ্গিনায় গিয়ে তুলোর বীজ কিংবা পেট ভরাবার জন্য ‘অল্প’ মাংস ভিক্ষা করতে দেখা যেত। যেটুকু তেজ স্ল্যাটেরিদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে তাঁরা পাড়া-পড়শীদের ঘৃণা করতেন, বিশেষ করে ধনী পড়শীদের ‘উন্নাসিক নিগ্রোদের’। কাউন্টির নিগ্রোরাও সাদা চামড়ার এই সব আবর্জনাদের বেশ অবজ্ঞার চোখে দেখত। স্ল্যাটেরিরা এদের হাবভাবে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতেন। কি খাবারদাবার, কি পোশাকপরিচ্ছদ, কি রোগে পড়লে বা বয়স হলে যত্নআত্তি, সব কিছুতেই নিগ্রোরা তাঁদের টেক্কা দিত! এরা এদের মালিকদের গর্বে গর্বিত, আর তাঁদের কিনা সমাজে ছিটেফোঁটাও সম্মান নেই!
ইচ্ছে করলে, টম স্ল্যাটেরি তাঁর জমি তিনগুণ দামে বিক্রী করে দিতে পারতেন। তাঁর প্রতিবেশীরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন। যদিও তাঁর মনে হত বছরে এক গাঁট তুলো বিক্রী করে আর পড়শীদের কাছে চেয়েচিন্তে দিন গুজরান করা অনেক বেশী সুখের।
এরা ছাড়া জেরাল্ডের সঙ্গে অন্য প্রতিবেশীদের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কারো কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। এই ছোট্ট মানুষটা যখন তাঁর বিশাল সাদা ঘোড়ায় চেপে যাতায়াত করতেন, তখন উইল্কসরা, ক্যাল্ভার্টরা, টারল্টনরা কিংবা ফোনটেনরা তাঁকে হেসে অভিবাদন করতেন। কখন কখনও বা একপাত্র পানীয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। জেরাল্ডের প্রাণখোলা হাসি, সহানুভুতিশীল হৃদয়, খোলামেলা ব্যবহার, তাঁর চেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যেস আর মেজাজকে ছাপিয়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই এঁদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। এই চরিত্রগুণ তাঁর মেয়েরা, কুকুরেরা আর দাসদাসীরাও বুঝে গেছিল।
যখন জেরাল্ড কোথাও যেতেন তখন বেশ একটা শোরগোল পড়ে যেত। তাঁর ঘোড়াকে ঘিরে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করত। ছোট ছোট কালো কালো ছেলেমেয়েরা ছুটে আসত তাঁকে দেখতে আর ঘোড়াটাকে একবার ছুঁয়ে দেখবার জন্য। তাঁর ভালোমানুষি বিদ্রূপকে কেউ গায়েও মাখত না। সাদা বাচ্চারা ঘোড়ায় চেপে ঘোরানোর বায়না করত। কৈশোরত্তীর্ণা মেয়েরা তাঁর কাছে নির্দ্বিধায় নিজেদের প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে পরামর্শ চাইত। আর বেহিসেবী দেনায় জড়িয়ে পড়ে সদ্য লায়েক হয়ে ওঠা ছেলেরাও সম্মান বাঁচানোর জন্য তাঁকেই ভরসা করত।
“হতভাগা, এক মাস ধরে তুমি টাকাটা ফেরত দাও নি!” জেরাল্ড হুঙ্কার দিয়ে বলতেন। “তা কথাটা এতদিন চেপে রেখেছিলে কেন? আমাকে টাকার কথাটা বলতে কি হয়েছিল?”
তাঁর কথা বলবার রুক্ষভঙ্গীতে সবাই অভ্যস্ত ছিল। তাই কেউ কিছু মনে করত না। বরং ভয়ে ভয়ে হেসে বলত, “কি জানেন স্যর, আপনাকে এই সামান্য ব্যাপারে কষ্ট দিতে চাই নি। আর বাবা – জানেনই তো ______”
“তোমার বাবা যথেষ্ট ভদ্রলোক। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে একটু কড়া। টাকাটা রাখ। তবে আর কখন যেন না শুনতে পাই।”
প্ল্যান্টারদের স্ত্রীরা অবশ্য অনেক পরে জেরাল্ডকে গ্রহণযোগ্য মানুষ বলে মনে করতে পারলেন। শ্রীমতি উইল্কসের সম্বন্ধে জেরাল্ড মনে করতেন “অসামান্য মহিলা যাঁর নীরবতা প্রশংসা করার মত।” একদিন সন্ধ্যেবেলা তিনি তাঁর স্বামীকে বললেন, “উনি হয়ত একটু রুক্ষভাষী, কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক।” সেদিন থেকেই জেরাল্ড আবালবৃদ্ধবনিতার স্বীকৃতি লাভ করলেন।
তবে এই স্বীকৃতি পেতে পেতে দশটা বছর কেটে গেছে। জেরাল্ড জানতেও পারেন নি যে তাঁর প্রতিবেশীরা প্রতি মুহুর্তে তাঁকে যাচাই করে দেখে তবেই নিজেদের লোক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিজে অবশ্য প্রথম দিন থেকেই মনে করেছেন যে এ তাঁর নিজের জায়গা, আর এঁরা তাঁর নিজের লোক।
দেখতে দেখতে জেরাল্ড তেতাল্লিশ বছর বয়সে পা রাখলেন। পেশীবহুল চেহারা আর মুখের রক্তিমাভা দেখে তাঁকে একজন ছোটখাটো জমিদার বলেই মনে হয়। নিজেকে হঠাৎ খুব নিঃসঙ্গ বলে মনে হতে লাগল। মনে হল, তাঁর টারা, তাঁর বন্ধুবান্ধব, এসব যেন যথেষ্ট নয়। মনে হল একজন জীবনসঙ্গিনী না হলে পরিপূর্ণতা আসে না।
টারারও একজন কর্ত্রীর খুব প্রয়োজন। মাঠের কাজ থেকে তুলে এনে একজন নিগ্রো দাসকে রান্নার কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু তবুও সঠিক সময়ে খাবার পাওয়া যায় না। আরেকজন দাসীকে পরিচারিকার কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু তবু আসবাবপত্র ধূলিধূসরিত। যখন অতিথিরা আসেন তখন সাফ করবার জন্য হুলস্থূল পড়ে যায়। পোর্কই একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিচারক। তাঁর কাজ সাধারণ ভাবে সবার ওপর নজর রাখা। কিন্তু জেরাল্ডের ঢিলেঢালা স্বভাবের জন্য সেও আলসে হয়ে পড়েছে। অবশ্য জেরাল্ডের শোবার ঘর আর বিছানা পরিচ্ছন্ন রাখে, আর খাবার টেবিলের আদব কায়দাতেও কোন ত্রুটি রাখে না। বাকি সবই নিজের খেয়ালে চলছে।
নির্ভুল আফ্রিকান প্রজ্ঞায় প্রত্যেক নিগ্রোই জেনে ফেলেছে যে জেরাল্ড যতটা গর্জান ততটা বর্ষান না। আর এই সুবিধেটা তারা হাড়ে হাড়ে উশুল করে নেয়। উনি প্রায়ই কাউকে না কাউকে বিক্রী করে দেবার হুমকি দেন, নয়ত চাবুক চালানোর ভয় দেখান। তবে এখন পর্যন্ত কাউকেই বিক্রী হতে হয় নি। আর চাবুক একবারই মাত্র চলেছে। সেটাও জেরাল্ডের প্রিয় ঘোড়াকে সারাদিনের শিকারের থেকে ফেরার পর ঠিকমত ডলাই মলাই করা হয় নি বলে।
জেরাল্ড লক্ষ্য করেছিলেন তাঁর প্রতিবেশীদের গৃহিণীরা কত দক্ষভাবে দাসদাসীদের পরিচালনা করে ঘরদোর ঝকঝকে রাখেন। এর জন্য এই সব মহিলাদের উদয়াস্ত কতখানি পরিশ্রম করতে হয় সে সম্বন্ধে অবশ্য তাঁর কোন আন্দাজ ছিল না। তিনি শুধু ফলাফলটা দেখতে পেতেন আর মুগ্ধ হতেন।
অবশেষে একদিন সকালবেলা তিনি অনুভব করলেন যে একজন গৃহকর্ত্রীর খুব জরুরী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেদিন তাঁকে শহরে যেতে হবে আদালতের কাজে। তাই তৈরি হচ্ছিলেন। পোর্ক তাঁর পছন্দের শার্টটা নিয়ে এল, একেবারে দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায়। একমাত্র তাঁর পরিচারক ছাড়া সেটা আর কেউ পরার কথা ভাবতেই পারবে না।
“মিস্টার জেরাল্ড,” জেরাল্ডকে রেগে যেতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পোর্ক বলল। “আপনার যেটা দরকার সেটা হল একজন গৃহিণী। এমন একজন গৃহিণী যাঁর বাড়িতে অনেক ‘নিগার’ আছে।”
জেরাল্ড পোর্কের প্রগলভতার জন্য ধমক লাগালেন। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করলেন কথাটা ভুল নয়। তিনি নিশ্চয়ই একজন বউ চান, ছেলেমেয়ে চান। কিন্তু যদি এখনই কিছু না করেন, তাহলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি মিস্টার ক্যাল্ভার্টের মত যাকে তাকে বিয়ে করতে পারবেন না। মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত ইয়াঙ্কি গভর্নেসকেই বিয়ে করে ফেললেন। তাঁর স্ত্রীকে একজন লেডি হতে হবে আর শ্রীমতি উইল্কসের মত অভিজাত পরিবারের মেয়ে হতে হবে। আর টারাকে পরিচালনা করবার ক্ষমতা থাকতে হবে। যেমন শ্রীমতি উইল্কস তাঁর নিজের খাসতালুকে করে থাকেন।
দুটো অসুবিধে ছিল। এক, ওই অঞ্চলে বিবাহযোগ্যা মেয়ের অভাব। আর দুই, যদিও জেরাল্ড এখানে দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন, তবু তিনি এই অঞ্চলে ‘নতুন’ এবং সর্বোপরি বিদেশী। যদিও উপকূলবর্তি অভিজাত পরিবারগুলোর থেকে মধ্য জর্জিয়ার মানুষজন অনেক কম উন্নাসিক ছিল, তবুও কেউই তার মেয়েকে এমন কারও হাতে তুলে দিতে চায় না, যার পূর্বপুরুষের ইতিহাস সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা যায় না।
জেরাল্ড ভাল করেই জানতেন কাউন্টির মানুষ তাঁকে পছন্দ করলেও – যাঁদের সঙ্গে তিনি শিকারে যাচ্ছেন, মদ্যপান করছেন, কিংবা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন – তাঁরা কেউই তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করতে এগিয়ে আসবেন না। ‘জেরাল্ড ও’হারাকে আমার মেয়ের সঙ্গে মাখামাখি করতে দিইনি’ এরকম ধরনের আলোচনা হোক, সেটাও তাঁর পছন্দ নয়। অবশ্য এর জন্য তাঁর কোন হীনমন্যতা জাগেনি। ব্যাপারটাকে এলাকার একটা উদ্ভট খেয়াল হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। সৎপাত্র হিসেবে গণ্য হতে গেলে দক্ষিণদেশে বাইশ বছরের থেকে অনেক বেশি সময় অতিবাহিত করতে হবে, তাঁর নিজের জমি জায়গা এবং ক্রীতদাস থাকতে হবে, আর জুয়া খেলায় কেতাদুরস্ত হতে হবে।
“জিনিসপত্র গুছিয়ে নে। আমরা স্যাভান্না যাব,” পোর্ককে বললেন জেরাল্ড। “আর শোন! বেফাঁস কথা একদম বলবি না। তাহলে কিন্তু তোকে বিক্রী করেই ছাড়ব।”
হয়ত জেমস আর এন্ড্রুসের তাঁকে বিয়ের ব্যাপারে দু’চারটে উপদেশ দিতে পারতেন। হয়ত তাঁদের পুরনো বন্ধুবান্ধবদের বিবাহযোগ্যা কন্যা থাকলেও থাকতে পারে যে জেরাল্ডের মনোমত হবে আর তাঁরাও জেরাল্ডকে পাত্র হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি করবেন না। জেমস আর এন্ড্রুস খুব ধৈর্য ধরে তাঁর কথা শুনলেন, কিন্তু উৎসাহব্যাঞ্জক কোন কথা বললেন না। স্যাভান্নায় সাহায্য করবার মত সেরকম আত্মীয় স্বজন তাঁদের ছিল না। যখন তাঁরা আমেরিকায় এলেন সে সময় তাঁরা দুজনেই বিবাহিত। আর তাঁদের পুরোনো বন্ধুদের মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। এখন যে যার সন্তান প্রতিপালন করছে।
“তুই তো তেমন কিছু ধনী নোস। আর তোর খুব একটা বড় পরিবারও নেই,” জেমস বললেন।
“আমি কিছু পয়সা জমিয়েছি। আর আমি একটা বড় পরিবার তৈরি করে নিতে পারব। তবে আমি যাকেতাকে বিয়ে করতে পারব না।”
“ওরে বাবা, তোর তো খুব উঁচু নজর,” জেমস শুষ্কস্বরে বললেন।
তবে ওঁরা জেরাল্ডের জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না। জেমস আর এন্ড্রুস যথেষ্ট প্রবীন হয়েছেন আর স্যাভান্নায় সকলেই তাঁদের সমীহ করেন। বন্ধুবান্ধবও তাঁদের কম ছিল না। এক মাস ধরে তাঁরা জেরাল্ডকে নিয়ে সেই সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করলেন। নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ গ্রহন করলেন।
“একজনকেই আমার পছন্দ হয়েছে,” শেষমেশ জেরাল্ড বললেন। “অবশ্য যখন আমি এদেশে এলাম, তখনও তাঁর জন্মই হয় নি।”
“কার কথা বলছিস, শুনি?”
“মিস এলেন রোবিল্যার,” কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন জেরাল্ড। এলেন রোবিল্যারের ঈষৎ তির্যক কিন্তু গভীর চক্ষুযুগল তাঁকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল। মাত্র পনের বছরের একটা মেয়ের আচারে ব্যবহারে কেমন নিগুঢ় ঔদাসিন্য! তবু জেরাল্ড একেবারে মোহিত হয়ে গেছিলেন। মেয়েটির চোখের বিষাদগ্রস্ত চাহনি তাঁকে ব্যথিত করে তুলেছিল। আর ওর সাথে আলাপও করেছেন অত্যন্ত কোমল স্বরে। যেটা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না।
“আরে তুমি তো ওর বাবার বয়সী!”
“কিন্তু আমি তো যথেষ্ট শক্ত সবল রয়েছি!” জেরাল্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন।
জেমস শান্তভাবে বোঝাতে লাগলেন।
“জেরি, বুঝতে চেষ্টা কর। স্যাভান্নায় সব মেয়েদের থেকে এই মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্ভাবনা সব থেকে কম। ওর বাবা হলেন একজন রোবিল্যার। ওঁর রক্তে ফরাসী আভিজাত্যের অহঙ্কার। মেয়েটির মা – তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি – একজন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত মহিলা ছিলেন।”
“তাতে কিছু এসে যায় না,” জেরাল্ড বললেন খানিক উষ্মা নিয়ে। “মেয়েটির মা বেঁচে নেই। আর ওর বাবা – রোবিল্যার আমাকে পছন্দ করেন।”
“একজন কর্মঠ মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই। তবে জামাই হিসেবে নয়।”
“তাছাড়া মেয়েটাও রাজী হবে না,” এন্ড্রুস বলে উঠল। “ও তো ওর উড়নচণ্ডে পিসতুতো ভাই – ফিলিপ্স রোবিল্যার – ওকেই ভালবাসে। প্রায় বছরখানেক হল। অবশ্য ওর পরিবারের সবাই দিন রাত মেয়েটার পেছনে লেগে আছে ওকে ভুলে যাবার জন্য।”
“ও তো লুইসিয়ানায় চলে গেছে, এ মাসে, তাই না?” জেরাল্ড বললেন।
“তুমি কি করে জানো?”
“জানি,” জেরাল্ড বললেন। এই অমূল্য সংবাদটা যে পোর্ক জোগাড় করে এনেছে সেটা চেপে গেলেন। এটাও ফাঁস করলেন না যে ফিলিপ্স তার পরিবারের চাপেই পশ্চিমে চলে গেছে। “আমার মনে হয় না ওদের প্রেম এত গভীর ছিল না যে ওকে ভুলতে পারবে না। পনের বছর বয়সে ভালবাসার ব্যাপারে আর কতটুকুই বা ধারণা হতে পারে।”
“ওঁরা বরং ওই উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেটাকেই জামাই হিসেবে পছন্দ করবে তোমার চেয়ে।”
তারপর একদিন যখন জেমস আরে এন্ড্রুস যখন জানতে পারল যে পিয়ের রোবিল্যার তাঁর মেয়ের বিয়ে তাঁদের ছোটখাটো আইরীশম্যান ভাইয়ের সাথেই দিতে চলেছেন, তখন ওঁরা যার পর নাই বিস্মিত হলেন। স্যাভান্নার ঘরে ঘরে ফিলিপ্স রোবিল্যারকে নিয়ে নীরব গুঞ্জন ছিল। তাই কেউ ভেবেই পেল না যে রোবিল্যারদের সব থেকে কমনীয় মেয়েটির সাথে কি ভাবে অট্টভাষী লালমুখো জেরাল্ডের বিয়ে হবে, যে কি না আবার মেয়েটির থেকে অন্তত এক মাথা বেঁটে।
জেরাল্ড নিজেও ব্যাপারটা এত সহজে মিটে যাবে ভাবতে পারন নি। তাঁর কাছে পুরো ঘটনাটাই অলৌকিক। যখন এলেন ম্লান কিন্তু শান্তভাবে তাঁর বাহুতে আলতো করে হাত রেখে বললেন, “আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজী আছি মিস্টার ও’হারা”, তখন বিনয়ে তাঁর বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল।
তড়িতাহত রোবিল্যাররা হয়ত আংশিকভাবে সিদ্ধান্তের কারণ আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। শুধু এলেন আর তাঁর ম্যামিই জানতেন আসল ঘটনা। যেটা জানার পর সারা রাত এলেন এক অবোধ শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে আকুল হয়েছিলেন। সকালে যখন সবার সামনে এলেন তখন তিনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত এক নারী।
প্যাকেটটা নিউ অরলিয়েন্স থেকে এসেছিল। অচেনা হাতে এলেনের নাম লেখা। অশুভ কিছু আন্দাজ করেই দুরু দুরু বুকে ম্যামি তার কিশোরি কর্ত্রীকে প্যাকেটটা এনে দিয়েছিল। ওর থেকে বের হল এলেনের একটা ছোট্ট স্ট্যাচু, ওরই হাতে লেখা ফিলিপ্স রোবিল্যারকে উদ্দেশ্য করে চারটে কথা, আর নেউ অরলিয়েন্সের এক যাজকের কাছ থেকে একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, যাতে তিনি জানিয়েছেন শুঁড়িখানায় মদ্যপ অবস্থায় মারামারি করে ফিলিপ্সের মৃত্যু হয়েছে। একটা আর্তনাদ করে এলেন জিনিসগুলো মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
“ওঁরা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বাপী আর পলিন আর ইউল্যালি! আমি ওঁদের ঘেন্না করি! ওঁদের সব্বাইকে ঘেন্না করি! আমি ওঁদের আর দেখতে চাই না। এমন জায়গায় চলে যেতে চাই, যেখানে ওঁদের মুখ আর কখনও দেখতে না হয়! এই শহরে – যাঁদের দেখলে ওর কথা মনে পড়ে যাবে – তাঁদের কারও মুখ দেখতে চাই না আমি!”
ম্যামিও সারা রাত কেঁদেছিল। এলেনের কষ্ট ও সহ্য করতে পারছিল না। সকাল হবার মুখে ম্যামি বোঝাতে চেষ্টা করল, “সেটা কি করে হবে, সোনা?”
“হতেই হবে। উনি স্নেহশীল। আমি ওঁকেই বিয়ে করব। না হলে আমি চার্লসটনের মঠে চলে যাব।”
এই মঠে যাবার হুমকি কাজ করেছিল। হতভম্ব, ভগ্নহৃদয় পিয়ের রোবিল্যার বাধ্য হয়ে বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের সকলে ক্যাথলিক হলেও তিনি মনে প্রাণে প্রেসবিটারিয়ান ছিলেন। মেয়ের মঠবাসিনী হওয়ার থেকে জেরাল্ড ও’হারাকে বিয়ে করা তাঁর কাছে শ্রেয়তর মনে হয়েছিল। পারিবারিক মর্যাদার অভাব ছাড়া মানুষটার বিরুদ্ধে বলবার মত আর কিছু নেই।
অতএব, এলেন তাঁর মধ্যবয়সী স্বামীর সাথে স্যাভান্না ছেড়ে চলে গেলেন। এখন তিনি আর রোবিল্যার নন। তাঁর সাথে টারায় এল ম্যামি এবং আরো কুড়িজন নিগ্রো দাস-দাসী। আর কখনও ফিরে আসেন নি।
পরের বছর তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হল। জেরাল্ডের মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হল কেটি স্কারলেট। জেরাল্ড পুত্রসন্তান আশা করেছিলেন। তাই একটু নিরাশ হলেন। অবশ্য এতটা নয় যে তার প্রত্যেক দাস-দাসীদের ‘রাম’ পান করাতে কার্পণ্য করবেন। আর নিজেও আনন্দের আতিশয্যে প্রচুর পান করে বেহেড মাতাল হয়ে পড়লেন।
জেরাল্ডের বিয়ে করার সিদ্ধান্তে এলেনের কোন পশ্চাত্তাপ হয়েছিল কিনা কেউ জানে না, আর জেরাল্ড তো ননই। তবে জেরাল্ড স্ত্রীগর্বে অসম্ভব গর্বিত ছিলেন। শান্ত শহর স্যাভান্না ছেড়ে আসার সময়, এলেন তাঁর স্মৃতিগুলোও পেছনে ফেলে এসেছিলেন। উত্তর জর্জিয়া কাউন্টিতে পদার্পণ করার মুহুর্ত থেকেই এই জায়গাকেই নিজের দেশ বলে মেনে নিয়েছিলেন।
শুধুমাত্র ফরাসি ঔপনিবেশিক শৈলীতে নির্মিত সুষমামণ্ডিত বিলাসবহুল বাসস্থান চিরতরে পেছনে ফেলে আসা নয়, তার আকৈশোরের পরিচিত পরিবেশ থেকেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে বিছিন্ন করে ফেললেন। যে পরিবেশে এলে্ন সেটার বৈপরিত্য সাগর পার হওয়া প্রবাসের সঙ্গেই তুলনা করার মত।
উত্তর জর্জিয়ার অসমতল ভূমি মানুষকে পরিশ্রমী হতে বাধ্য করেছে। মালভূমির সীমানা পেরিয়ে ব্লু রিজ পর্বতমালার পানে তাকালে পাহাড়ের পাদদেশে অসংখ্য গ্র্যানাইটের টিলা আর বড় বড় পাইন গাছের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে। তাঁর উপকূলবর্তি অঞ্চলের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সব কিছুই কেমন বন্য লাগে, কেমন অশান্ত লাগে। তিনি দেখেছেন জঙ্গলের শান্ত সৌন্দর্য, শৈবালে মোড়া সবুজ দ্বীপ, সাদা বালি ছড়ানো উষ্ণ বেলাভূমি আর তালগাছের সারি।
গ্রীষ্মের কঠোর দাবদাহ আর তীব্র শীতের প্রকোপ, এখানে দুটোই প্রবল। এখানকার মানুষের প্রাণশক্তি আর ঔচ্ছ্বল্য, এলেনকে বিস্মিত করে। এঁরা উদার, সৌজন্যশীল এবং সহৃদয়। আবার পরিশ্রমী, অসহিষ্ণু আর সহজেই রেগে যান। বেলাভূমির মানুষ, ভাল মন্দ সব কিছুতেই ঔদাসিন্য দেখাতে অভ্যস্ত। অথচ এই উত্তর জর্জিয়ার মানুষের মনে একটা বন্যপ্রকৃতি কাজ করে। স্যাভান্নার জীবনে একটা স্থিতাবস্থা বিরাজ করে। উত্তর জর্জিয়ার জীবনযাত্রা তূলনামূলকভাবে নবীন আর প্রাণোচ্ছল আর চঞ্চল।
স্যাভান্নার যে সমস্ত মানুষের সান্নিধ্যে এলেন এসেছেন, তাঁরা সকলেই যেন একই ছাঁচে তৈরি। তাঁদের জীবনচর্যা, দৃষ্টিভঙ্গী একই সুরে বাঁধা। এখানে প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট, অন্যের থেকে আলাদা। উত্তর জর্জিয়ার মানুষ আমেরিকার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। এখানে যেমন ক্যারোলাইনা আর ভার্জিনিয়া থেকে মানুষ এসেছেন, তেমনি ইউরোপ থেকেও বহু মানুষ এসেছেন। জেরাল্ডের মত অনেকেই আছেন যাঁরা এসেছেন ভাগ্য অন্বেষণের জন্য। আবার কেউ কেউ আছেন এলেনের মত, যাঁরা বনেদী বংশের সন্তান, কিন্তু পরিবার ছেড়ে দূরে চলে এসেছেন বৈচিত্রের সন্ধানে। আবার অনেকেই হয়ত বিনা কারণেই চলে এসেছেন, নতুন কিছু প্রবর্তন করার তাড়নায়।
নানা ধরনের সংষ্কৃতি আর পটভূমির মানুষ এসে জড়ো হওয়ায়, এখানে বেশ একটা অনাড়ম্বর পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছিল। এলেনের চোখে ব্যাপারটার মধ্যে একটা নতুনত্ব ছিল। উপকূলবর্তী মানুষের প্রতিক্রিয়া কোন পরিস্থিতিতে কেমন হবে সেটা আন্দাজ করা অনেক সহজ ছিল। এখানে সেটা আন্দাজ করা বেশ কঠিন, আর তাঁকে বুঝিয়ে দেবার কেউ ছিল না।
তুলোর তখন প্রচুর চাহিদা। সারা বিশ্ব জুড়ে। আর তাই এই দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষরা দ্রূততার সঙ্গে স্বচ্ছল হয়ে উঠছিলেন। লাল মাটি থেকে উৎপন্ন তুলো ছিল সেই স্বছলতার হৃৎস্পন্দন। মাত্র এক পুরুষের পরিশ্রমেই তাঁরা ধনী হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে পুরুষানুক্রমে কি হতে পারে!
একটা নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি এখানকার মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করত। আর তারা জীবনটাকে উপভোগ করত খোলামেলা ভাবে। এই জীবনযাত্রা এলেনের কাছে অপরিচিত। এঁদের কাছে টাকাপয়সা আর ক্রীতদাস এত প্রভুত পরিমাণে ছিল যে এঁরা অবসর এবং খেলাদূলার অনেক সময় পেতেন আর সেটা উপভোগও করতেন। ওঁরা কখনই এত ব্যস্ত থাকতেন না যে ঘন ঘন শিকারে যাওয়া, কিংবা ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়া কিংবা বারবেকিউর আয়োজন করতে পিছিয়ে থাকতেন।
এলেন কোনদিনই পুরোপুরি এঁদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন নি। আসলে তাঁর অস্তিত্বের একটা বড় অংশই স্যাভান্নায় ত্যাগ করে এসেছিলেন। কিন্তু উনি এঁদের সারল্য, অকপটতা আর অমায়িকতাকে সম্মান করতে শিখেছিলেন। এঁদের মধ্যে কোনরকম ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল না, আর যে যেরকম তাকে সেভাবেই গ্রহণ করতে পারত।
অল্প সময়েই তিনি কাউন্টির সবার ভালবাসা আদায় করে নিলেন। তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী। দয়ালু কর্ত্রী, স্নেহময়ী মা এবং একনিষ্ঠ স্ত্রী। অন্তরের যে বেদনা আর কর্তব্যপরায়ণতা তিনি চার্চকে সঁপে দিতে চেয়েছিলে, সেটা কাজে লাগল একজন মা হিসেবে, পরিবারের পেছনে আর তাঁর স্বামীর সেবায়। যে স্বামী তাঁকে স্যাভান্না থেকে বের করে আনতে পেরেছিলেন আর কোন অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে সেই বেদনাদায়ক স্মৃতিকে উস্কে দেবার চেষ্টা করেন নি।
স্কারলেটের বয়স যখন এক বছর, আর ম্যামির মতে মেয়েদের যতখানি স্বাস্থ্যবতী হওয়া উচিত তার থেকেও বেশি স্বাস্থ্যবতী, তখন এলেনের দ্বিতীয় সন্তান সুসান এলিয়নরের জন্ম হল, যাকে সব সময়ই স্যুয়েলেন বলেই ডাকা হত। তারপর যথাসময়ে এলো ক্যারীন, পরিবারের বাইবেলে যার নাম লেখা হল ক্যারোলাইন আইরীন। এর পরে, পর পর তিনজন পুত্রসন্তান হল। কিন্ত দূর্ভাগ্যক্রমে, তিন জনেই, হাঁটতে শেখার আগেই বিদায় নিল। বাড়ি থেকে মাত্র একশ গজ দূরে, একটা সেডার গাছের তলায় তারা ঘুমিয়ে আছে। ‘জেরাল্ড ও’হারা, জুনিয়ার’ এই বলে তিনটে ফলকে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
এলেন যেদিন টারায় পা রাখলেন, সেদিন থেকে এখানে অনেক পরিবর্তন দেখা দিল। মাত্র পনের বছর বয়স কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তাঁকে শেখানো হয়েছিল, বিয়ের আগে মেয়েরা হবে, সুন্দরী, কমনীয়, শান্ত, আলঙ্কারিক। কিন্তু বিয়ের পরে তাঁদের একটা পরিবার চালাতে হবে, যেখানে সাদা কালো মিলিয়ে শতাধিক মানুষ থাকতে পারে।
অন্যান্য অল্পবয়সী মেয়েদের মত এলেনও এই শিক্ষা পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি ম্যামিকে পেয়েছিলেন, যে অত্যন্ত অলস নিগ্রোর কাছ থেকেও কাজ আদায় করে নিতে পারে। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই, টারার শ্রী আর শৃঙ্খলা ফিরে এল।
টারার বাড়িটার কোন ছিরিছাঁদ ছিল না। প্রয়োজনমত এখানে ওখানে ঘর তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এলেনের হস্তক্ষেপে এই অপরিকল্পিত গৃহও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। জর্জিয়াতে সেডার গাছের শোভা ছাড়া কোন প্ল্যান্টারের বাড়িই সম্পূর্ণ হত না। বড় রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত সেডার গাছের সারি লাগিয়ে পথটাকে শীতল এবং ছায়াছন্ন করে তুললেন। এর ফলে চতুষ্পার্শের শ্যামলিমা আরো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠল। সাদা ইটের দেওয়ালের ওপর হালকা বেগুনি রঙের লতার আবরণ। দরজার পাশে মেদির ঝোপে হালকা গোলাপি ছোট ছোট ফুল। উঠোনে সাদা ম্যাগনোলিয়া ফুলের সমারোহ। সব মিলিয়ে বাড়িটার অনেক ত্রুটিই আড়াল হয়ে গেল।
বারমুডা ঘাসের লন আর ক্লোভার গুল্মের সমাবেশে, গ্রীষ্মে আর বসন্তে এক অনাবিল সবুজের জৌলুষ। জুঁই আর জিনিয়ার কুঁড়ি আর ফুলের লোভে লোভে বাড়ির পেছন থেকে টার্কি আর শ্বেতশুভ্র রাজহাঁসের দল প্যাঁক প্যাঁক করে বেরিয়ে চলে আসত। এগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একজন কালো পাহারাদার মোতায়েন করা হয়েছিল। একটা মোটা তোয়ালে নাড়িয়ে নাড়িয়ে সেই নিগ্রো শিশুটির কাজ ছিল এই দলকে কেয়ারির কাছে ঘেঁষতে না দেওয়া। কিংবা মুখে আওয়াজ করে ওদের ভয় দেখানো। ওদের পেছনে ধাওয়া করে ধরবার অনুমতি না থাকায় শিশুটির মনের আসল ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে যেত।
এক ডজন শিশুকে এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছিল। টারাতে একজন পুরুষ ক্রীতদাসের এটাই প্রথম দায়িত্ব। তারপর যখন দশ বছর বয়স হত তাদের ‘বুড়োবাবা’র কাছে কাজ শিখতে পাঠানো হত। প্ল্যান্টেশনের মুচী। অথবা অ্যামোস নামে ছুতোরের কাছে। আর ছিল ফিলিপ, গোয়ালের তদারকির জন্য এবং কাফি নামে খচ্চর দেখভাল করবার ছেলে। এইসব কাজ শেখবার ঝোঁক যেসব শিশুদের মধ্যে থাকত না তাদের মাঠের কাজে সাহায্যের জন্য লাগানো হত। নিগ্রোদের চোখে এরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবার সুযোগ নষ্ট করল।
এলেনের জীবনও খুব স্বস্তির বা খুব সুখের ছিল না। উনি অবশ্য স্বস্তির জীবন প্রত্যাশাও করেন নি। সুখের জীবন কি মেয়েমানুষের ভাগ্যে জোটে! বিশেষ করে যে সমাজ পুরুষের দ্বারা শাসিত। সেটা না মেনে তো কোন উপায় নেই। বিষয় সম্পত্তি কার নামে? পুরুষমানুষ। সেটা পরিচালনা করার দায়িত্ব? নারীর। সুনাম পুরুষদেরই প্রাপ্য। মহিলাদের কাজ তাঁদের বুদ্ধি বিবেচনার তারিফ করা। সামান্য আঙ্গুলের ব্যাথাতেই পুরুষ মানুষ কাতর হয়ে পড়েন। আর নারীরা প্রসববেদনা মুখ বুজে সহ্য করেন যাতে পুরুষ মানুষের অসুবিধে না হয়। মাতাল স্বামীর রুক্ষ কণ্ঠস্বরকে গায়ে না মেখে তাঁকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল স্ত্রীর কর্তব্য। পুরুষেরা অশিষ্ট এবং স্পষ্টভাষী। নারীরা কোমল, শান্ত এবং ক্ষমাশীল।
অসামান্যা মহিলাদের সান্নিধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন।, তাঁরা শিখিয়েছেন কিভাবে প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও নিজের মাধুর্য বজায় রাখতে হয়। তাঁর তিন মেয়েও এরকমই অসামান্যা নারী হয়ে উঠুক, এটাই তাঁর মনোগত বাসনা। তাঁর ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে খুব একটা অসুবিধে নেই। স্যুয়েলেন লেডি হয়ে ওঠার জন্য বদ্ধপরিকর। নিজেকে আকর্ষক করে তোলার জন্য মায়ের উপদেশ মন দিয়ে মেনে চলে। ক্যারীন স্বভাবতই লাজুক আর শান্ত। মুস্কিল হল স্কারলেটকে নিয়ে। ওর মধ্যে জেরাল্ডের স্বভাবটাই বেশি প্রকট। তাই তার কাছে লেডি হয়ে ওঠার ব্যাপারটা সহজ হল না।
স্কারলেটের খেলাধূলার বন্ধুচয়ন ম্যামির কাছে বেশ শিরঃপীড়ার কারন হল। আশেপাশের নিগ্রো ছেলেমেয়েরা আর প্রতিবেশীদের ছেলেরাই তার বেশি পছন্দের খেলার সঙ্গী। নিজের বোনেদের কিংবা উইল্কস পরিবারের সুশিক্ষা প্রাপ্ত মেয়েদের প্রতি কোন আগ্রহই তার নেই। এলেনের কোন মেয়ে এরকম উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠবে ম্যামি সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারত না। মাঝে মাঝেই বলতে বাধ্য হত, “একটু লেডিদের মত ব্যবহার কর।”। এলেন অবশ্য এতটা অসহিষ্ণু ছিলেন না। তিনি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেন। এই সব খেলার বন্ধুর থেকেই কোন একসময় মেয়েরা তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নেয়, এটা তিনি জানতেন। মেয়েদের প্রথম কর্তব্য হল বিবাহিত হওয়া। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিতেন সবে তো শৈশব, একটু প্রাণোচ্ছ্বল এই যা। পুরুষদের চোখে কিভাবে লাবণ্যময় হয়ে উঠতে হয় সেটা শেখার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে।
এলেন আর ম্যামি এটাই নজরে রাখছিলেন। স্কারলেট যত বড় হয়ে উঠতে লাগল, দেখা গেল এই লাবণ্যময়তার গুণটাই সে ভাল মত রপ্ত করে ফেলেছে। অন্য কোন ব্যাপারেই তার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। বেশ কয়েকজন গৃহ শিক্ষয়িত্রীর প্রয়াস আর বছর দুয়েক ফেয়্যাটভিল ফিমেল অ্যাকাডেমিতে লেখাপড়া করা সত্ত্বেও তার শিক্ষাগ্রহণ অসম্পূর্ণই থেকে গেল। কাউন্টিতে তার মত চারুতার সাথে নাচে অংশ নিতে আর কোন মেয়ে পারে না। কিভাবে হাসলে তার গালে টোল পড়ে সে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে পুরুষের চোখে, সেটাও সে ভাল করেই জানে। এটাও জানে কিভাবে পায়রা পায়ে চললে তার স্কার্টের আন্দোলন পুরুষের বুকে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়েই মুখ নীচু করে চোখের পাতা পিট পিট করে ব্রীড়া প্রদর্শন। সব থেকে বেশি জানত কিভাবে নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাকে পুরষদের কাছে গোপন রেখে শিশুসুলভ সারল্য দেখিয়ে তাদের মন জয় করা যায়।
যে সমস্ত গুণের সমাহারে একজন আদর্শ এবং কাম্য পত্নী হওয়া যায়, সেগুলো এলেন মৃদুস্বরে উপদেশ দিয়ে আর ম্যামি বকুনি দিয়ে স্কারলেটের মধ্যে সঞ্চারিত করবার চেষ্টা করতেন।
“তোমাকে আরো শান্ত, আরো ধীর স্থির হতে হবে সোনা,” মেয়েকে বলেছিলেন এলেন। “ভদ্রলোকদের মুখের কথা কেটে কখনও কথা বলবে না। যদি তুমি সেই ব্যাপারে বেশি জান, তবুও। কোন ভদ্রলোকই মুখরা মেয়ে পছন্দ করেন না।”
“অল্পবয়সী মেয়েরা যদি সব সময় ঘাড় আর থুতনি নেড়ে নিজের মত জাহির করতে থাকে ‘আমি তো এরকম করি’ বা ‘আমি একদম পছন্দ করি না’, তাহলে সেই মেয়েদের কপালে বর জোটে না, বুঝলে!” ম্যামি সাবধান করেছিল। “এরকম সময়ে তোমাকে চোখ নামিয়ে নিয়ে মিষ্টি করে বলতে হবে ‘আপনি ঠিকই বলেছেন স্যর’ অথবা ‘আমিও সেটাই চাই স্যর’।”
দুজনে মিলে ওকে ভদ্রমহিলাকে কেমন হতে হবে শেখানোর চেষ্টা করতে থাকলেও, স্কারলেট কেবল শান্ত থাকার ভনিতাটুকুই রপ্ত করল। অন্তরের যে অনুভুতি থেকে চরিত্রের এই মাধুর্য উৎসারিত হবে সেটা ও শিখতে পারল না। আসলে শেখার প্রয়োজনই বোধ করল না। এতেই সে রীতিমত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এটাই তো সে চেয়েছিল। জেরাল্ড একবার গর্ব করে বলেছিলেন যে আশেপাশের পাঁচটা কাউন্টির মধ্যে স্কারলেটই হল সবথেকে সুন্দরী। কথাটা আংশিকভাবে হলেও সত্য। ওর পাণিগ্রহণের প্রস্তাব শুধু মাত্র নিকটস্থ যুবমণ্ডলী থেকেই নয় এমন কি অ্যাটলান্টা আর স্যাভান্না থেকেও আসত।
এলেন আর ম্যামির প্রচেষ্টায়, ষোল বছর বয়সে, স্কারলেটকে খুবই সুন্দরী, কমনীয় আর আকর্ষক লাগত। কিন্তু আসলে সে ছিল অসম্ভব জেদী, দাম্ভিক আর একগুঁয়ে মেয়ে। আইরীশ বাবার বদমেজাজ সে ভাল মতই আয়ত্ব করেছিল। মায়ের মত নিঃস্বার্থ সহিষ্ণুতার প্রকাশ ছিল তার ভান। এলেন অবশ্য এই ছল চাতুরি বুঝতে পারেন নি। স্কারলেট মায়ের কাছে নিপাট ভাল মেয়েটি হয়ে থাকত। মা জানতেই পারতেন না যে তাঁর মেয়ে কত বদমেজাজি আর কেমন উচ্ছৃঙ্খল। মায়ের তীব্র ভর্ৎসনাকে স্কারলেট ভয় পেত।
ম্যামির চোখকে ধোকা দেওয়া অবশ্য অত সহজ ছিল না। স্কারলেটকে মাঝে মাঝে হাতে নাতে ধরে ফেলত। এলেনের থেকে ম্যামির নজর অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ছিল। ম্যামিকে ও কখনই বেশি দিনের জন্য বোকা বানাতে পারত না।
এই দুই স্নেহশীলা রমনী অবশ্য স্কারলেটের স্ফূর্তিবাজ প্রকৃতি, চপলতা আর মাধূর্যকে মোটেও অপছন্দ করতেন না। এইসব বৈশিষ্ট দক্ষিণের মহিলাদের কাছে গর্বের বিষয় ছিল। তবে স্কারলেটের মধ্যে জেরাল্ডের উদ্দাম আর উদ্ধত স্বভাবের প্রতিফলন ঘটেছে লক্ষ্য করেই ওঁদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। ওঁরা ভয় পেতেন যে বিয়ের বন্দোবস্ত পাকাপাকি করার আগেই, স্কারলেটের এই দোষগুলো সবার কাছে ধরা পড়ে যাবে।
বিয়ে করার ভাবনা স্কারলেটের মধ্যেও এসেছিল। অ্যাশলেকে বিয়ে করতে হবে। আর এর জন্য তাকে যদি শান্ত হবার কিংবা নম্রতার অভিনয় করতে হয়, বা শিশুসুলভ সারল্য দেখাতে হয় – ছেলেদের মন পাওয়ার জন্য, তাহলে সেটাই ভাল। কেন যে ছেলেদের এরকম উদ্ভট পছন্দ, সেটা তার মাথাতে কিছুতেই ঢুকত না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে যে ব্যাপারটা কাজ করে। এর গুঢ় কারনটা বোঝবার চেষ্টাই ও করে নি। মানব মনের জটিলতা – এমন কি নিজের মনের জটিলতাও – বোঝবার ধৈর্য তাঁর নেই। ও শুধু জানে যদি ও ‘এরকম এরকম’ পথে এগোয়, তাহলে অপর পক্ষ থেকে ‘এরকম এরকম’ প্রতিক্রিয়া পাবে। ঠিক অঙ্কের নিয়মে! আর যখন লেখাপড়া শিখত, অঙ্ক ব্যাপারটাই তাঁর কাছে সব চাইতে সহজ মনে হত।
পুরুষদের মনস্তত্ব স্কারলেট যদি বা সামান্য বুঝত, মেয়েদের মনস্তত্ব সম্বন্ধে তার ধারণা আরও অস্পষ্ট ছিল। মেয়েদের সম্পর্কে তাঁর কোন আগ্রহই ছিল না। বান্ধবী বলতে সেরকম কেউ ওর কখনই ছিল না। সে জন্যে ওর মধ্যে কোন অভাববোধও ছিল না। ওর চোখে যে কোন নারী – নিজের বোনেরা সহ – তার স্বাভাবিক প্রতিপক্ষ। মোহের জাল বিছিয়ে পুরুষদের বশ করাই সবার একমাত্র লক্ষ্য।
সব মেয়েই – একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন তার মা।
এলেন ও’হারা আলাদা। স্কারলেটের ভাবনায় তার মা পবিত্রতার প্রতীক। অন্য কোন মানুষ তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন না। শিশু বয়সে ও প্রায়ই মায়ের সঙ্গে কুমারী মা মেরীকে মিলিয়ে ফেলত। বড় হয়ে এখন মনে হয় তার মা সত্যিই মা মেরীর থেকে কোন অংশে কম নন। ওর কাছে এলেন হলেন এক স্বর্গীয় নিরাপদ আশ্রয়। ওর মা হলেন ন্যায়, সত্য, স্নেহ আর অসীম জ্ঞানের সাক্ষাত প্রতিভূ – এক কথায় এক অসামান্যা নারী।
স্কারলেট মনে প্রাণে চাইত মায়ের মত হতে। মুশকিল হল ন্যায়সঙ্গত, সত্যবাদী আর নিঃস্বার্থ হতে গেলে জীবনের অনেক আনন্দই জলাঞ্জলি দিতে হয় আর একই সাথে অনেক প্রণয়ীকেও। জীবন এত ছোট যে এই সব সুখকর মুহুর্তগুলো ছাড়তেই ইচ্ছে হয় না। একদিন যখন ওর অ্যাশলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে তখন ও ঠিক এলেনের মত হয়ে যাবে। তার আগে অন্তত .......
চতুর্থ অধ্যায়
সকাল দশটা। এপ্রিল মাস হিসেবে, দিনটা উষ্ণ। সূর্যের সোনালী রশ্মি, জানালার নীল পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকে স্কারলেটের ঘরকে আলোকিত করে দিয়েছে। দেওয়ালের হালকা হলুদ রঙের ওপর আলো পড়ে ঝলমল করছে। মেহগিনি কাঠের আসবাবপত্র দেখাচ্ছে গাঢ় লাল। মেঝেতে রোদ্দুর পড়ে কাঁচের মত চক চক করছে, কার্পেট পাতা জায়গাটুকু ছাড়া।
বাতাসে গ্রীষ্মকালের পূর্বাভাস। জর্জিয়া থেকে বসন্ত বিদায় নেয় নেহাতই আনিচ্ছায়। কাঠফাটা গরম আসার আগে অনেকদিন পর্যন্ত বাতাসে থাকে হালকা ঊষ্ণতার ছোঁয়া। নতুন ফোটা ফুলের হালকা সুবাসে স্কারলেটের ঘর ভরে গেল। জানালার বাইরে ড্রাইভওয়ের দু’পাশে ফোটা ড্যাফোডিল ফুলের রঙ্গীন সমাহার। মাটি জুড়ে জুঁই ফুলের হলুদ আস্তরণ। জানালার নীচে, মকিংবার্ড আর জে পাখিরা মাগনোলিয়া গাছের দখল নিয়ে তাদের চিরাচরিত ঝগড়া শুরু করেছে। জে পাখির কর্কশ চিৎকারের বিনিময়ে মকিংবার্ডের মিষ্টি সুরেলা প্রত্যুত্তর।
এরকম উজ্জ্বল সকালগুলোতে স্কারলেট জানালার সামনে গিয়ে কার্ণিশে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। টারার বাতাস থেকে সুরভি আর পরিবেশ থেকে নিসৃত ধ্বনি উপভোগ করার জন্য। তবে আজ টারার নীল আকাশ আর রোদ উপভোগ করতে মন চাইল না। শুধু মুখ ফুটে বেরিয়ে গেল, “যাক বাবা, বৃষ্টি হচ্ছে না!” বিছানার ওপর আপেল-সবুজ সিল্কের বল ড্রেসটা সুন্দর করে প্যাক করে রাখা আছে একটা কার্ডবোর্ড বাক্সের মধ্যে। টুয়েল্ভ ওকসে নিয়ে যাবার জন্য, যাতে বল-ডান্সের আগে পরে নেওয়া যায়। স্কারলেট একটু মাথা নাড়ল। সব কিছু ওর পরিকল্পনা মত চললে, ওই ড্রেসটা পরার দরকার হবে না। বল শুরু হবার অনেক আগেই ও আর অ্যাশলে বিয়ে করার জন্য জোন্সবোরো রওয়ানা হয়ে যাবে। এখন চিন্তার কথা হল – বারবেকিউতে কি পরে যাবে?
কোন পোশাক পরলে ওকে সুন্দরী লাগবে আর অ্যাশলের চোখে দুর্নিবার দেখাবে? সকাল আটটা থেকে ও এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওয়ার্ডরোব থেকে একটার পর একটা ড্রেস বের করে চলেছে। একটাও পছন্দ হচ্ছে না। বাতিল করা পোশাকে মেঝে, টেবিল, চেয়ার আর বিছানার ওপর ডাঁই হয়ে আছে। গোলাপি রঙের অরগ্যাণ্ডির ড্রেসটা খুবই মানানসই। কিন্তু গত গ্রীষ্মে, যখন মেলানি এসেছিল, তখন টুয়েল্ভ ওকসে ওটাই পরে গেছিল। নিশ্চয়ই ওর মনে থাকবে! কালো রঙের পোশাকটাও ওর গাত্রবর্ণের সাথে খাপ খায়। তবে বয়সটা একটু বেশি লাগে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর ষোল বছরের মুখটা দেখল। কোথাও কি চামড়া কুঁচকে গেছে? বলিরেখা দেখা যাচ্ছে? থুতনির পেশী ঝুলে পড়েছে? মেলানির তারুণ্যের পাশাপাশি তাকে বয়ষ্ক দেখালে একদম চলবে না! ল্যাভেণ্ডার রঙের মসলিনের পোশাকটা সুন্দর হলে কি হবে ওকে একেবারেই মানায় না। ক্যারীনের মত স্কুলের মেয়েদেরই বেশি মানায়। মেলানির গাম্ভীর্যের কাছে ওকে স্কুলের মেয়ে লাগা চলবে না! আর এই সবুজ রঙের টাফেটা ড্রেসটা খুবই পছন্দের, ওকে মানায়ও ভাল, কিন্ত বুকের কাছে একটা ছোট তেলের দাগ রয়েছে! ওখানে পিন দিয়ে একটা ব্রোচ লাগিয়ে নেওয়াই যায়। কিন্তু মেলানির নজরে ঠিক পড়ে যাবে। সূতির নানা রঙের আরও অনেক পোশাক রয়েছে। কিন্তু সেগুলো এই পার্টিতে পরবার মত না। কাল যে সবুজ রঙের মসলিনের বম্ব্যাজ়িন ড্রেসটা পরেছিল, সেটাও ভাল, কিন্তু ওটা তো বিকেলে পরার জন্য। গ্রীবার কাছটা নীচু। বারবেকিউতে পরা উচিত না। কিন্তু কিছু করার নেই! তাছাড়া নিজের গ্রীবা আর বাহু নিয়ে ওর যথেষ্ট গর্বই আছে। যদিও একেবারে সকালেই সেগুলো প্রদর্শণ করা শোভন নয়।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পার্শ্বাভিমুখ থেকে দেখল। না, ওর গঠন নিয়ে লজ্জা পাবার মত কিছু নেই। মরাল গ্রীবা, সুডৌল বাহু মনোরঞ্জক। উন্নত, আকর্ষণীয় বক্ষ। অনুন্নত বক্ষ পোশাকের কারসাজীতে আড়াল করে রাখার প্রয়োজন ওর কখনও হয়নি। যেমন বেশির ভাগ ষোল বছরের মেয়েদের হামেশাই করতে হয় নিজেদের পরিনত দেখানোর জন্য। এলেনের তন্বী বাহুসৌষ্ঠব আর শুভ্র গাত্রবর্ণ ওর চেহারার মধ্যেও প্রতীয়মান। এজন্য ওর মনে খুবই অহঙ্কার। একটু যদি মায়ের মত লম্বা হতে পারত! পেটিকোট তুলে পা দু’খানা দেখল। সত্যিই সুন্দর। এমন কি ফ্যেয়াটভিল অ্যাকাডেমির মেয়েরাও বলত! কি দুঃখের কথা এগুলো দেখানো যাবে না! আর কটিদেশ? ফ্যেয়াটভিল, জোন্সবোরো কিংবা তিন তিনটে কাউন্টিতে কারও এমন পাতলা কটি নেই! ম্যামিকে বলতে হবে কোমরে লেসটা যেন বেশ টাইট করে বাঁধে। দরজা খুলে কান পাতল। নীচের তলায় হল থেকে ম্যামির ভারি পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খুব চেঁচিয়ে বেশ অধৈর্যভাবে ম্যামিকে ডাকল। ও জানে মা এখন রান্নাঘরে। কুকিকে আজকের রান্নার সামগ্রী বের করে দিচ্ছেন। সুতরাং ওর চিৎকার শুনতে পাবেন না।
“কেউ কেউ মনে করে আমি বোধহয় উড়তে পারি,” ম্যামির গজগজ শোনা গেল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার শব্দও পাওয়া গেল। বেশ রণংদেহী মূর্তিতে ঢুকল। হাতের ট্রে’তে ধূমায়িত প্রাতরাশ। মাখন লাগানো দুটো রাঙা আলু, বাজরার কেক, আর গ্রেভীসহ একটা বড় হ্যামের টুকরো। খাবারের পরিমাণ দেখে স্কারলেট একেবারে জ্বলে গেল। ম্যামির লৌহকঠিন নিয়মটা মনে পড়ল না। কোন পার্টিতে যাবার আগে ও’হারা পরিবারের মেয়েদের পেটপুরে খেয়ে যেতে হবে, যাতে পার্টিতে আর খাবার ইচ্ছে না হয়।
“মিথ্যেই এনেছ এসব। আমি খাব না। তুমি কিচেনে ফেরত নিয়ে যেতে পার।”
ম্যামি ট্রে’টা টেবিলে রাখল। তারপর কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়াল।
“আজ্ঞে হ্যা ম্যাডাম! তুমিই খাবে! আগের বারবেকিউএর সময় আমার শরীর ভাল ছিল না। তাই তোমাকে খাইয়ে পাঠাতে পারি নি। এখানকার প্রত্যেকটা জিনিস তোমাকে খেতে হবে।”
“মোটেই খাব না! এখন এস, এই লেসটা আমার কোমরে খুব টাইট করে বেঁধে দাও। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।”
“মিস স্কারলেট! লক্ষ্মীটি! একটু খেয়ে নাও। মিস ক্যারীন আর মিস স্যুয়েলেন কোন ঝামেলা করে নি।”
“ওরা তো খাবেই!” ব্যাঙ্গের সুরে বলল স্কারলেট। “একটা খরগোশের যতটুকু বুদ্ধি আছে সেটাও ওই দুটোর নেই! আমি খাচ্ছি না! মনে সেবার ক্যাল্ভার্টদের পার্টিতে যাবার আগে তুমি আমাকে পূরো এক ট্রে খাইয়ে পাঠিয়েছিলে! ওরা স্যাভান্নার আইসক্রীম আনিয়েছিল। আমি মাত্র এক চামচই খেতে পেরেছিলাম! আজ আমি মজা করতে চাই। প্রাণভরে খাব!”
এই অবাধ্যতায় ম্যামির মনে একটা ধিক্কারবোধ তৈরি হল। রাগে ওর ভুরু কুঁচকে গেল। ম্যামির ভাবনায় একজন অল্পবয়সি মেয়ের কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় সে ব্যাপারে কতগুলো বদ্ধ ধারণা ছিল, ঠিক যেমন ওর মনে সাদা চামড়া আর কালো চামড়ার মানুষের মধ্যে প্রভেদের ব্যাপারে ছিল। এ ব্যাপারে কোন মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়া তার কল্পনার বাইরে। স্যুয়েলেন আর ক্যারীন ওর হাতের পুতুল। ওর সব কথাই মান্য করে চলে। কিন্তু স্কারলেটের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয় ওকে বোঝাতে যে ওর স্বাভাবিক প্রবণতাগুলো একেবারে ‘অলেডিসুলভ’। সেই কঠিন যুদ্ধে জেতার জন্য যে সব ছল চাতুরির আশ্রয় নিতে হয় সেগুলো কোন সাদা চামড়ার মানুষের মাথা থেকে বেরোবে না।
“লোকে এই পরিবার সম্বন্ধে কি বলে সেটা নিয়ে তোমার মাথাব্যথা না থাকলেও আমার আছে!” ও গরগর করতে লাগল। “আমি কারও কাছে শুনতে চাই না যে তুমি পার্টিতে গিয়ে হ্যাংলার মত খেয়েছ। পার্টিতে পাখির মত অল্প খেতে হয়। তাহলেই লেডি বলে বোঝা যায়। আমি চাই না তুমি মিস্টার উইল্কসের পার্টিতে গব গব করে খাও।”
“মা তো খান। কিন্তু মা তো লেডি,” স্কারলেট খড়কূটো ধরার চেষ্টা করল।
“বিয়ে হয়ে গেলে, তুমিও খেতে পারবে। তোমার বয়সে মিস এলেন পার্টিতে গিয়ে দাঁতে কুটোটাও নাড়তেন না। তোমার ইউল্যালী মাসীও নয়। কিন্তু এখন ওঁদের বিয়ে হয়ে গেছে। যে সব মেয়েদের বিয়ে হয় নি, তারা পার্টিতে বেশি খেলে বর পাকড়াও করতে পারে না।”
“বিশ্বাস করি না। আগের বার, যেবার তুমি অসুস্থ ছিলে। আমি আগে থেকে খেয়ে যাই নি। অ্যাশলে উইল্কস বলেছিল, মেয়েদের ঠিকমত খেতে দেখলে ও খুব আনন্দ পায়।”
ম্যামি আশঙ্কাজনকভাবে মাথা নাড়ল।
“দেখ ভদ্রলোকেরা যেটা বলেন আর যেটা ভাবেন দুটো একেবারে আলাদা। আর মিস্টার অ্যাশলে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন বলে তো শুনিনি।”
স্কারলেট মুখভঙ্গী করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামলে নিল। ম্যামিতো খাঁটি কথাই বলেছে! ওর মুখের অবস্থা দেখে ম্যামি কৌশল বদল করল। ট্রে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
“ঠিক আছে। এই তো কুকিকে তখন বলছিলাম, লেডি চেনা যায় সে কি খায় না তাই দেখে। আর আমি তো মিস মেলি হ্যামিলটনের মত কম খেতে আর কাউকেই দেখি নি। ওই সেই যে যখন উনি মিস্টার অ্যাশলে – না না – মিস ইন্ডিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।”
একটু সন্দেহের চোখে ম্যামির দিকে তাকাল স্কারলেট। কিন্তু সারল্য আর অনুশোচনা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। স্কারলেট যে মিস মেলানি হ্যামিলটনের মত লেডি নয় এর জন্য অনুশোচনা।
“আচ্ছে রাখ ট্রে’টা। আর লেসটা আমাকে টাইট করে বেঁধে দাও,” একটু বিরক্তি দেখিয়ে বলল। “তারপর আমি অল্প খাবার চেষ্টা করব। এখনই খেয়ে নিলে ওটা টাইট করে বাঁধতে অসুবিধে হবে।”
“যুদ্ধজয়ের আনন্দ লুকিয়ে, ম্যামি ট্রে’টা টেবিলের ওপর রাখল।
“কি পরবে আমার সোনা?”
“ওটা,” স্কারলেট মসলিনের সবুজ ড্রেসটা দেখাল। আবার ম্যামির রণংদেহী মূর্তি।
“ককখনো না। ওটা সকালে পরবার পোশাক নয়। বিকেল তিনটের আগে তুমি বুক খোলা পোশাক পরতে পারো না। আর ওই ড্রেসটা শুধু বুক খোলা নয় হাতকাটাও। তাছাড়া রোদ লাগিয়ে তুমি চামড়াটা যেরকম কালো করে ফেলেছিলে, অনেক যত্ন করে, দুধের সর লাগিয়ে সেটা আমি ঠিক করেছি। আমি কিছুতেই ওটা নষ্ট হতে দেব না। তোমার মাকে আমি এখুনি বলছি।”
“আমার ড্রেস পরার আগে মা’কে একটা কথাও যদি বলেছ, তাহলে আমি কিচ্ছু খাব না বলে দিচ্ছি,” স্কারলেট শীতল স্বরে বলল। “ড্রেস পরে নেবার পর আর বদলাতে দেবার জন্য সময় পাবেন না।”
ম্যামি হাল ছেড়ে দিল। বিকেলের ড্রেস সকালে পরাটা মেনে নেওয়া ভাল। বরং খেয়ে না গিয়ে পার্টিতে হামলে পড়ে খাওয়া দাওয়া করলেই বেশি খারাপ দেখাবে।
“নাও কিছু একটা ধরে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াও,” ও হুকুম দিল।
স্কারলেট বিছানার একটা ছত্রী ধরে নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়াল। ম্যামি ওর সরু কোমরের দিকে গর্বের সঙ্গে তাকাল।
“আমার সোনার মত এত সরু কোমর কোন মেয়ের নেই,” অনুমোদনের আভাস ম্যামির গলায়। মিস স্যুয়েলেনের কোমরে কুড়ি ইঞ্চি টাইট করলেই ও মুচ্ছো যায়!”
“ফুঃ!” হাঁপাতে হাঁপাতে বেশ কষ্ট করেই বলল স্কারলেট। “আমি জীবনে কখনও মূর্চ্ছা যাই নি।”
“কখন সখনো মুচ্ছো যাওয়াটা খারাপ কিছু নয়,” ম্যামি উপদেশের সুরে বলল। “তোমার আবার বেশি বেশি সাহস! অনেকদিন থেকেই বলব বলে ভেবেছি, সাপ, ইঁদুর, পোকামাকড় দেখে ভয়ে মুচ্ছো যাওয়াটা একটু ভাল। বলছি না বাড়িতে এসব করতে। কিন্তু যখন অন্যদের সাথে থাক তখন। আর তোমাকে বলেছি _____”
“উঃ, একটু তাড়াতাড়ি কর। অত কথা বোলো না। দেখে নিও, আমি ঠিক বর পাকড়াও করে নেব। মূর্চ্ছা না গিয়েও, ভয় না পেয়েও। উফ, খুব টাইট লাগছে। ড্রেসটা পরিয়ে দাও।” ম্যামি সাবধানে সেই বারো গজের বুক আর হাতকাটা সবুজ মসলিনের পোশাক স্কারলেটকে পরিয়ে দিল।
“রোদ্দুরে, কাঁধের ওপর শালটা ফেলে রাখবে। খবরদার, গরম লাগলেও সরাবে না,” ও আদেশ দিল। “নইলে বুড়ী মিস স্ল্যাটারলির মত বাদামী হয়ে ফিরবে। এখন খেয়ে নাও, সোনা। বেশি তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। তাহলে বমি হয়ে যাবে।”
স্কারলেট বাধ্য মেয়ের মত খেতে বসল। ভাবল পেট ভরে গেলে কি ওর কি আর নিঃশ্বাস নেবার জায়গা থাকবে! বেসিনের স্ট্যাণ্ড থেকে একটা বড় তোয়ালে এনে স্কারলেটের বুক আর ঘাড়ে পেঁচিয়ে দিয়ে কোলের ওপর পেতে দিল। স্কারলেট প্রথমেই হ্যামটা তুলে নিয়ে জোর করে মুখের মধ্যে ঠেলে দিল। হ্যাম ও ভালবাসে।
“হে ভগবান! কেন আমার বিয়ে হয়ে যায় নি?” বিতৃষ্ণার সাথে কথাটা বলে রাঙা আলুটা খেতে শুরু করল। “যা আমি করতে চাই না, সেটাই সারাক্ষণ করতে করতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমাকে দেখাতে হবে আমি নাকি পাখির থেকেও কম খাই! যখন আমার দৌড়তে ইচ্ছে করবে তখন আমাকে পা টিপে টিপে হাঁটতে হবে। ওয়াল্টজ় নাচতে নাচতে অজ্ঞান হয়ে পড়বার ভান করতে হবে! যদিও আমি দু’দিন ধরে ক্লান্ত না হয়ে নেচে যেতে পারব! যে ছেলেটার মাথায় আমার অর্ধেক বুদ্ধিও নেই তাকে হেসে হেসে বলতে হবে, “সত্যি, আপনি কি দারুণ!” ‘আমি কিছুই জানি না’ ভান করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি যাতে ছেলেরা আমার জানা জিনিস আমাকে বোঝাতে পারে আর মনে মনে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে পারে! – না আর একটুও খেতে পারব না।”
“একটা গরম কেক খাও,” ম্যামি অনড়ভাবে বলল।
“আচ্ছা বল তো বর ধরবার জন্য একটা মেয়েকে বোকাসোকা সাজতে হবে কেন?”
“মনে হয়, পুরুষ মানুষ কি চায় সেটা জানে না। কিন্তু ভাব দেখায় যে জানে। ওরা যেটা চায় বলে ভাবে, সেটা দিতে পারলে অনেক ঝামেলা এড়ানো যায়। ওরা আসলে চায়, মেয়েরা ছোট্ট হবে, কম খাবে, আর বুদ্ধিশুদ্ধি একদম থাকবে না। ছেলেদের মনে যদি সন্দেহ থাকে যে মেয়েটার ওর থেকে বেশি বুদ্ধি, তাহলে ওকে বিয়েই করবে না। তাহলে তো মেয়েটা লেডিই নয়।”
“বিয়ের পরে তো বুঝতেই পেরে যায় যে বউএরও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে!”
“ঠিক। কিন্তু তখন তো দেরি হয়ে গেছে। বিয়ে করে ফেলেছে। আর তাছাড়া ভদ্রলোকেরা চান তাঁদের বউদের বুদ্ধিশুদ্ধি থাকুক।”
“দাঁড়াও, একদিন না একদিন, আমি ঠিক যা খুশি বলব, যা খুশি করব। সেটা যদি কারও কারও পছন্দ না হয় তো আমার বয়েই গেল!”
“তুমি এরকম কিছুই করবে না,” ম্যামির গলা গম্ভীর। অন্তত যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি। কেকগুলো খেয়ে নাও। দরকার হলে একটু গ্রেভি মাখিয়ে নাও।”
“ইয়াঙ্কি মেয়েদের মনে হয় না এরকম বোকা সাজতে হয়। যখন আমরা সারাটোগা গিয়েছিলাম – গত বছর – দেখলাম ওরা দিব্বি বুদ্ধিমানের মত আচরন করছে – আর ছেলেদের সামনেই।”
ম্যামি নাক কোঁচকাল।
“এটা সত্যিই যে ইয়াঙ্কি মেয়েরা মুখের ওপর কথা বলে দেয়। কিন্তু আমি সারাটোগাতে কোন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব পেতে দেখিনি।”
“কিন্তু বিয়ে তো ইয়াঙ্কিদের করতেই হবে। নইলে এমনি এমনি ওরা বেড়ে যাবে কি করে? ওরা নিশ্চয়ই বিয়ে করে। বাচ্চা কাচ্চা হয়। ওদের সংখ্যা তো নেহাত কম নয়!”
“ছেলেরা ওদের টাকার জন্য বিয়ে করে,” ম্যামি হার মানার পাত্রী নয়।
স্কারলেট কেকটা গ্রেভিতে ভিজিয়ে নিয়ে মুখে পুরল। ম্যামি খুব একটা ভুল বলছে না মনে হয়। এলেনও ওকে এই ধরনের কথা বলেছিলেন কিছুদিন আগে। তবে আরেকটু সূক্ষ্ম ভাবে। সব মায়েরাই তাঁদের মেয়েদের অসহায়, নির্ভরশীল, লাজুক হতে শেখাতেন। আর সত্যি বলতে কি, এই সব অভিনয়ে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট মাথা খাটাতে হয়। ও হয়ত সত্যিই একটু হঠকারী। মাঝে মাঝে দু’একটা ব্যাপারে আশলের সঙ্গে ওর যে মতভেদ হয় নি তা তো নয়! ও বেশ জোরের সাথেই আশলেকে নিজের মতামত জানিয়েছে। হয়ত ওর ঘোড়ায় চড়া, খেলাধুলো করা এসব অভ্যেস পছন্দ না হওয়ায় অ্যাশলে ওকে ভুলে গিয়ে মেলানির দিকে ঝুঁকেছে। কৌশলটা পাল্টাতে হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে অ্যাশলে যদি এই সব মেয়েলি ন্যাকামিতে ভুলে যায়, তাহলে অবশ্য ওর সম্বন্ধে যে শ্রদ্ধা স্কারলেটের আছে সেটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। যে পুরুষ মেয়েদের কান্না আর ন্যাকামিতে গলে যায়, সেই রকম পুরুষকে পাওয়ার থেকে না পাওয়াই ভাল। কিন্তু মনে হয় সব পুরুষমানুষই একরকম।
আগে যদি কৌশলে ভুল হয়েই থাকে কি আর করা যাবে! আজকে ওকে ঠিক রাস্তা নিতে হবে। ওকে ওর চাইই চাই। তার জন্যে আর মাত্র কয়েক ঘন্টাই সময় বাকি আছে! যদি অজ্ঞান হলে, বা অজ্ঞান হবার ভান করলে কাজ হয়, তবে তাই সই। যদি বোকার মত হাসা-কাঁদা, বোকা সাজা, ন্যাকামি করা এসবও করতে হয় সেও মঞ্জুর। দরকারে ওকে ক্যাথলীন ক্যাল্ভার্টকেও ন্যাকামিতে ছাড়িয়ে যেতে হবে। আজকের দিনটা হাতছাড়া করা কোনমতেই চলবে না।
দূর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, স্কারলেটকে এ কথা বলার মত কেউ ছিল না যে যেটা ওর সত্যিকারের ব্যক্তিত্ব, যদিও কারো কারো কাছে প্রচণ্ডভাবে সজীব, সেটাই ওর আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার আসল কারণ। সেটা আড়াল করতে গেলেই বরং ও জৌলুস হারাবে। কেউ বললেও হয়ত খুশি হত, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারত না। সভ্যতার যে খণ্ডমুহুর্তের অংশ সে, তার অনেক আগে থেকেই, স্ত্রীজাতির বুদ্ধিমত্তার ঔৎকর্ষকে কোন রকম স্বীকৃতি দেওয়ার ধারনাটাই হাস্যকর ছিল।
***
লালমাটির পথ ধরে, ঘোড়ার গাড়িতে উইল্কসদের প্ল্যান্টেশনে যেতে যেতে স্কারলেটের মনে একটা পাপমিশ্রিত আনন্দ কাজ করছিল। মা কিংবা ম্যামি কেউই আজকের বারবেকিউএর পার্টিতে থাকবেন না। তাই ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাবার সময়, ভুরু কোঁচ করে বা ঠোঁটের ইশারায় কেউ বাধা দেবে না। স্যুয়েলেন নির্ঘাত কাল ওর নামে লাগাবে। তাতে অবশ্য খুব কিছু এসে যাবে না। যদি প্ল্যান মত সব কিছু চলে তাহলে অ্যাশলের সাথে বিয়ে কিংবা পালিয়ে যাওয়ায় প্রথমে একটু আধটু বিরক্ত হলেও আখেরে সবাই খুশিই হবে। নাঃ মা আজ পার্টিতে যেতে না পারায় স্কারলেট খুশিই হয়েছে।
ব্র্যান্ডির ঝোঁকে সকাল সকালই জেরাল্ড জোনাস উইল্কারসনকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন। ছেড়ে যাবার আগে ওর কাছ থেকে প্ল্যান্টেশনের হিসেবপত্তর বুঝে নেবার জন্য এলেনকে টারাতেই থেকে যেতে হয়েছে। তাঁর ছোট অফিসে স্কারলেট ওর মাকে একটা চুমু খেয়ে বিদায় নিয়ে এসেছে। তখন উনি ওঁর লম্বা সেক্রেটারি আর তাড়া তাড়া কাগজপত্র নিয়ে বসেছিলেন। জোনাস উইল্কারসন পাশেই দাঁড়িয়ে। অপমানজনক ভাবে বরখাস্ত হওয়ায় চোখেমুখে চাপা ঘৃণা ফেটে পড়ছে। কাউন্টির সেরা ওভারসিয়ারের চাকরি থেকে বরখাস্ত! তাও কেন? না একটু সামান্য ফষ্টিনষ্টি করার জন্য! এমি স্ল্যাটারির বাচ্চার বাবা ও ছাড়া আরও অনেকেই হতে পারে! জেরাল্ডকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে। জেরাল্ডও সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারেন নি। কিন্তু মিস এলেনের সেই এক গোঁ! এই দক্ষিণের সব্বাইকে জোনাস ঘেন্না করে। ওদের শীতল সৌজন্যবোধের জন্য। আর ওর সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে এদের অবজ্ঞার মনোভাব! আর সব থেকে ঘেন্না এলেন ও’হারাকে। দক্ষিণের যা কিছু ঘৃণ্য এলেন হচ্ছেন সেই সবের প্রতিমূর্তি।
প্ল্যান্টেশনের প্রধান পরিচারিকা হিসেবে ম্যামি এলেনকে সাহায্য করার জন্য থেকে গেছে। গাড়ির চালক টোবির পাশে ডিলসি মেয়েদের নাচের ড্রেসের লম্বা বাক্স কোলে নিয়ে বসেছে। জেরাল্ড তাঁর নিজের বড় শিকারি ঘোড়ার পিঠে পাশে পাশে চলছেন। ব্র্যান্ডির কৃপায় শরীর বেশ গরম আর মনটাও ফুরফুরে হয়ে আছে। উইল্কারসনকে বিদায়ের ঝামেলাটা এত সহজেই মিটে যাবে আশা করতে পারেন নি। দায়িত্বটা উনি এলেনের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। বারবেকিউতে যেতে না পারার জন্য এলেনের হতাশা, বান্ধবীদের সাথে দেখা না হওয়ার দুঃখ, এসব তাঁর মাথায়ও এলো না। বসন্তের এই সুন্দর সকালে, তাঁর ক্ষেত সবুজ হয়ে আছে, পাখিরা সুন্দর গান গাইছে, আর তাঁর নিজেকে খুব অল্পবয়সি আর ফূর্তিবাজ লাগছে, তখন অন্যের কথা ভাবার সময় কোথায়? কখনো কখনো ছোট ছোট আইরীশ খুশির গান গেয়ে উঠছেন আবার কখনো রবার্ট এমেটের লেখা “তার বীর যোদ্ধা যেথায় ঘুমায়ে রয়েছে, সেথা হতে বহুদূরে” জাতীয় দুঃখের গানও গুনগুন করে উঠছেন।
জেরাল্ড খুশির জোয়ারে ভাসছিলেন। সারাটা দিন ধরে ইয়াঙ্কি আর যুদ্ধ নিয়ে গলা ফাটাতে পারবেন। তাঁর তিন কন্যাকে তাদের পোশাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। তিনি ওদের নিয়ে বেশ গর্বিত বোধ করছেন। গতকাল সন্ধ্যেয় স্কারলেটের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন তিনি বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। তাঁর কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে যে ও খুব সুন্দরী, আর এ ব্যাপারে তাঁর কৃতিত্বও কিছু কম নয়। আয়ার্ল্যান্ডের পাহাড়ের মত সবুজ ওর চোখ দুটো। আর দেশের কথা মনে পড়তেই তাঁর বেশ ভাল লাগতে লাগল; কেমন একটা কাব্যিক মূর্ছনা আছে দেশটার নামে। এ কথা মনে হতেই তিনি বেসুরো গলায় মেয়েদের শোনাবার জন্য গেয়ে উঠলেন “পরনে সবুজ বাস”।
মায়েরা যেমন দুষ্টু শিশুদের দিকে স্নেহময় প্রশ্রয়ে দৃষ্টিতে তাকায়, তেমনি ভাবে ওঁর দিকে তাকিয়ে স্কারলেট ভাবল, সন্ধ্যে হতে না হতেই বাপী একেবারে মদে চূর হয়ে যবেন। ফেরবার পথে অভ্যেস মত টুয়েলভ ওকস আর টারার যত বেড়া আছে, ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আসতে থাকবেন। শুধু ভাগ্য আর ঘোড়ার শিক্ষার ওপর ভরসা করে। সেতুর ওপর দিয়ে না এসে, ঘোড়া নিয়ে নদী সাঁতরে ফিরবেন। তারপর তর্জন গর্জন করতে করতে বাড়ি ফিরবেন। পোর্ক নিয়ত একটা ল্যাম্প নিয়ে সমনের হলে অপেক্ষা করবে। উনি আসলে অফিসের সোফাতে শুইয়ে দেবে।
যে ধূসর রঙের স্যুটটা পরে যাচ্ছেন, সেটা একেবারে কর্দমাক্ত হয়ে যাবে। তখন এলেনকে শপথ নিয়ে বোঝাবেন যে কাল রাতে তাঁর ঘোড়া সেতু থেকে নদীতে পড়ে গিয়েই এই দশা। সবাই তাঁর মিথ্যে ধরে ফেলবে। অবশ্য কেউ স্বীকার করবে না। ফলে উনি নিজেকে খুব চতুর ভাববেন।
বাপী খুবই মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। কিন্তু বেশ স্বার্থপর আর দায়িত্বজ্ঞানহীন, সেটা মানতেই হবে। স্কারলেট মনে মনে ভাবল। সকাল থেকেই ও এত উদ্দীপ্ত আর খুশি ছিল যে জেরাল্ডসহ সবার জন্যই ওর মনে একটা বাৎসল্য জেগে উঠল। নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধে ও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। আজকের দিন ফুরোনোর আগেই ও অ্যাশলেকে নিজের করে পেয়ে যাবে। সূর্যের তাপটা আরাম দিচ্ছে। ওঁর চোখের সামনে জর্জিয়ার বসন্ত নিজেকে মেলে ধরেছে। শীতকালে বৃষ্টিতে তৈরি খানাখন্দ জাম গাছের সবুজ ঝোপে ঢাকা পড়ে গেছে। বড় বড় গ্র্যানাইট পাথরের চাঁইগুলোর ওপর হালকা বেগুনি রঙের চেরোকির ফুলের আস্তরণে ঢেকে গেছে। নদী পেরিয়ে টিলাগুলোর মাথায় ঝলমলে সাদা ডগউড ফুলের বিন্যাস যে সবুজ বনানীর ওপর তুষারের আস্তরণ। চারদিকে সাদা থেকে গাঢ় গোলাপী রঙের সমাহার। মৃদুমন্দ বাতাস বুনো ফুলের সৌরভ বহন করে নিয়ে আসছে।
“আজকের এই সুন্দর সকাল সারা জীবন আমার মনে গেঁথে থাকবে,” মনে মনে বলল স্কারলেট। “ কে বলতে পারে, আজ আমার বিয়ের দিনও হতে পারে।”
দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগল, আজ বিকেলে এই শ্যামলিমার মধ্যে দিয়ে কিংবা সন্ধ্যেবেলা চাঁদের আলোয় ও আর অ্যাশলে ঘোড়া ছুটিয়ে জোন্সবোরোর পথে রওয়ানা হয়ে যাবে। একজন যাযককে সঙ্গে নিয়ে। পরে অবশ্য ওদের আবার অ্যাটলান্টার কোনো পুরোহিতের সামনে নতুন করে বিবাহের শপথ নিতে হবে। তবে সেটা এলেন আর জেরাল্ডের মাথাব্যথা। স্কারলেটের অন্য কোন মেয়ের প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে এলেন কতটা বিরক্ত হবেন সেটা ভেবে অবশ্য ও একটু ঘাবড়ে যাচ্ছিল। যদিও ওর আনন্দ দেখে, এলেন নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন। আর যে জেরাল্ড কাল বারবার অ্যাশলেকে বিয়ে করার ব্যাপারে ওকে বার বার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সাবধান করছিলেন, উনিও নিশ্চয়ই তাঁদের পরিবারের সাথে উইল্কস পরিবারের এই কুটুম্বিতা খুব আনন্দের সঙ্গেই মেনে নেবেন।
“ওসব বিয়ের পরে ভাবলেও চলবে,” এই ভেবে স্কারলেট মন থেকে অস্বস্তিটা সরিয়ে দিল।
এমন সুন্দর বসন্তের সকালে, যখন চারদিক সবুজ, পাখিরা গান গাইছে, আর পাহাড়ের ওপাশ থেকে উইল্কসদের প্ল্যান্টেশনের চিমনি দেখা যাচ্ছে, তখন ভাল লাগা ছাড়া অন্য কোন অনুভুতি আসা খুব মুশকিল।
“ওই বাড়িতেই আমি সারা জীবন থাকব। এই রকম পঞ্চাশ কিংবা তারও বেশি বসন্ত আমার জীবনে আসবে। আমি আমার ছেলেমেয়েদের আর নাতিনাতনিদের কাছে আজকের এই সুন্দর দিনটার অনেক গল্প করব।” ওর খুশি আর বাঁধ মানছিল না। এত খুশি যে জেরাল্ডের সঙ্গে “পরনে সবুজ বাস” গানে গলা মেলাল। জেরাল্ড ওকে গলা চড়িয়ে উৎসাহ দিলেন।
“সকাল থেকেই তোর এত খুশি হবার কারণটা বুঝলাম না,” স্যুয়েলেন একটু বিরক্ত ভাবেই বলল। স্কারলেটের সবুজ ড্রেসটা পরলে ওকে অনেক বেশি ভাল লাগত এই ভাবনাটা এখনও মন থেকে সরাতে পারেনি। নিজের ড্রেস আর বনেট ধার দেবার ব্যাপারে স্কারলেট এত স্বার্থপর! আর মা সব সময়ই ওঁর হয়ে কথা বলবেন! যেন সবুজ স্যুয়েলেনের মানানসই রঙ নয়! “তুই আর আমি খুব ভাল করেই জানি – বাপীও বলছিলেন – আজ অ্যাশলের বাগদানের ব্যাপারটা ঘোষণা করা হবে। তুই তো আবার বেশ কিছুদিন ধরে ওর পেছনে লেগে আছিস!”
“সেটা যা তুই ভাবিস,” স্কারলেট সংযত ভাবে জবাব দিল। আজ কোন ভাবেই মনের প্রসন্নতা নষ্ট হতে দেবে না। কাল সকালে মিস স্যু যে কি অবাকই না হবে!
“স্যুসি, এটা তুই ঠিক বললি না,” ক্যারীন বলে উঠল। “স্কারলেটের নজর ব্রেন্টের দিকে।”
স্কারলেট সবুজ চোখে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। ওঁর মত মিষ্টি মেয়ে সত্যি হয় না! ওরা সবাই জানে যে ত্রয়োদশী ক্যারীনের ব্রেন্টের প্রতি একটা দূর্বলতা আছে। ব্রেন্ট টার্লটন অবশ্য ওকে স্কারলেটের ছোট্ট বোন হিসেবেই দেখে। তবে এলেনের অনুপস্থিতিতে, ও’হারা পরিবারের সবাই ব্রেন্টকে নিয়ে ক্যারীনের পেছনে লাগে যতক্ষণ না ও কেঁদে ফেলে।
“না রে বোন, ব্রেন্ট মোটেই আমার মনের মানুষ নয়,” স্কারলেট খুব উদার। “আর ব্রেন্টও আমার সম্বন্ধে সেরকম ভাবে না। ও তো তোর বড় হবার অপেক্ষায় রয়েছে।”
আনন্দে ক্যারীনের গালদুটো গোলাপী হয়ে উঠল। মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা চলতে থাকল।
“স্কারলেট, সত্যি!”
“তুই জানিস স্কারলেট মা চান না এত অল্প বয়সে ক্যারীন ভালবাসা, বিয়ে এসব নিয়ে কথা বলুক। আর তুই ওর মাথার মধ্যে আজেবাজে ভাবনা ঢুকিয়ে দিচ্ছিস!”
“যা তুই মায়ের কাছে নালিশ কর! কিচ্ছু এসে যায় না,” স্কারলেট জবাব দিল। “তুই বোনকে দাবিয়ে রাখতে চাইছিস কারণ তুই জানিস আর বছরখানেকের মধ্যে ও তোর থেকে অনেক বেশি সুন্দর দেখতে হয়ে যাবে।”
“এই মেয়েরা, তোমরা ভদ্রভাবে কথাবার্তা বল, নাহলে তোমাদের পিঠে আমাকে দু’চার ঘা লাগাতে হবে,” জেরাল্ড সাবধান করলেন। “একটু চুপ কর! চাকার শব্দ আসছে না? টার্লটন কিংবা ফোনটেনরা হবেন।”
মিমোজ়ার ঘন অরন্যে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা আর ফেয়ারহিলের পথ যেখানে এসে মিশেছে, সেদিকে এগোতেই ওঁরা ঘোড়ার খুরের আর গাড়ির চাকার শব্দ শুনতে পেলেন। গাছের পাতার আড়াল থেকে মেয়েদের হাসি আর কথাবার্তার আওয়াজ কানে এল। জেরাল্ড আগে আগে চলছিলেন। পথদুটো যেখানে এসে মিশেছে, টোবিকে বললেন গাড়ি থামাতে।
“টার্লটনদের মহিলারা,” জেরাল্ড মেয়েদের জানালেন। তাঁর চোখমুখ উদ্ভাসিত। এলেনের পরে, এই কাউন্টিতে অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে মিসেজ় টার্লটনকেই তিনি সবথেকে বেশি পছন্দ করতেন। “আর লাগাম মিসেজ় টার্লটনের হাতেই! ইনি এমন একজন অসামান্যা মহিলা যিনি কুসুমের মত কোমল কিন্তু বজ্রের মত কঠিন হাত দিয়ে ঘোড়াদের ভাল বাগ মানাতে পারেন! দুঃখের কথা হল তোমাদের কারও হাতই ওরকম নয়।” মেয়েদের দিকে করুণা মেশানো স্নেহের চোখে তাকিয়ে বললেন। “ক্যারীন তো ঘোড়া দেখলেই ভয় পায়; লাগাম ধরলে স্যু’র হাতে ফোসকা পড়ে যায়, আর স্কারলেট তোমার--''
“তবুও আমি কোনদিনই ঘোড়া থেকে পড়ে যাই নি,” স্কারলেট রেগে গিয়ে বলল। “আর প্রত্যেকবারই শিকারে গিয়ে মিসেজ় টার্লটন ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে যান!”
“আর পুরুষ মানুষদের মত কলারের হাড় ভেঙে ফেলেন, সেটা বল!” জেরাল্ড বললেন। “অজ্ঞানও হয়ে যান না বা হইচইও করেন না। এখন এ সব কথা থাক, এসে পড়লেন মনে হয়।”
জেরাল্ড পাদানীর ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে এক ঝটকায় টুপিটা খুলে ফেললেন। টার্লটনদের গাড়ি দেখা গেল। রঙচঙে পোশাকে মেয়েরা গাড়ি ভরে রয়েছে। জেরাল্ডের অনুমান ঠিক। লাগাম মিসেজ় টার্লটনের হাতে। টার্লটনদের চার মেয়ে, তাদের ম্যামি, বল-ড্যান্সের ড্রেস ভর্তি লম্বা লম্বা কার্ডবোর্ডের বাক্স, সব মিলিয়ে এত ভর্তি, যে কোচোয়ানের বসবার জায়গা হত না। তাছাড়া নিজের ইচ্ছেতে বিয়্যাট্রিস টার্লটন কখনওই ঘোড়ার রাশ – কালো কিংবা সাদা – কারও হাতে ছাড়তেন না। তিনি কৃশ হলেও তাঁর দেহ সুগঠিত। তাঁর গাত্রবর্ণ অত্যন্ত শুভ্র আর তাঁর চুল ছিল টকটকে লাল। মনে হত শরীরের সমস্ত রঙ যেন তাঁর চুলই দখল করে নিয়েছিল। খুব ভাল স্বাস্থ্য আর অফুরন্ত শক্তির আধার ছিলেন তিনি। আটটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। প্রত্যেকেই প্রাণোচ্ছল আর তাঁরই মত লাল চুলের অধিকারী। এদের প্রত্যেকের প্রতিই ছিল তাঁর স্নেহমিশ্রিত অযত্ন অথচ কঠিন শৃঙ্খলার শাসন। ঠিক যেমন ছিল তাঁর অশ্বশাবকদের প্রতি। “শাসন কর, কিন্তু ওদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিও না” এই ছিল তাঁর নীতি।
ভদ্রমহিলা ঘোড়া ভালবাসতেন আর সারাক্ষণ ঘোড়ার ব্যাপারে কথা বলতে ভালবাসতেন। তিনি শুধু ওদের ব্যাপারে ভাল বুঝতেনই না, কাউন্টির পুরুষদের তুলনায় ওদের অনেক ভাল সামলাতে পারতেন। টিলার ওপরে বাড়িতে ওঁর আট ছেলেমেয়ে যেমন এলোমেলো ঘুরে বেড়াত, ঠিক তেমনি তাঁর অশ্বশাবকরাও আস্তাবল থেকে বেরিয়ে লনে দৌড়াদৌড়ি করে। যখন তিনি প্ল্যান্টেশন পরিদর্শনে যান তখন তাঁর ছেলেমেয়েরা, অশ্বশাবকেরা আর বেশ কিছু শিকারি কুকুর তাঁর সঙ্গী হয়। তিনি মনে করতেন তাঁর ঘোড়াদের, বিশেষ করে নেলী নামে ঘোটকী, মানুষের মতই বুদ্ধি ধরে। গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য যদি কোনদিন সে ঘোটকীকে নিয়ে ঘুরতে বেরোনোর সময় পেরিয়ে যেত, তখন তিনি কোনো নীগ্রো শিশুকে এক বাটি চিনি দিয়ে বলতেন, “যা, নেলীকে এক মুঠো চিনি খাইয়ে দে আর বলে দিস কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে নিয়ে বেরোব।”
ঘোড়ায় চড়তে হোক বা না হোক, দু’একটা উপলক্ষ ছাড়া, তিনি অশ্বারোহীর পোশাকেই চলাফেরা করতে ভালবাসতেন। যদি হঠাৎ ঘোড়ায় চড়ার দরকার পড়ে? রোদ বৃষ্টি যাই থাকুক না কেন, প্রতিদিন সকালে নেলীকে জিন চড়িয়ে বাড়ির সামনে ঘোরানো হত। যাতে মিসেজ় টার্লটন গৃহকাজ থেকে ঘন্টাখানেকের জন্য ফুরসৎ পেতে পারেন। তবে ফেয়ারহিল পরিচালনা করা বেশ শক্ত কাজ। অনেকদিনই নেলী এরকম পায়চারি করতে থাকত আর বিয়েট্রিস টার্লটন তাঁর অশ্বারোহীর পোশাক অন্যমনষ্কভাবে বাহুর ওপর তুলে নিয়ে কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। সকলে স্কার্টের তলায় তাঁর চকচকে বুটজোড়া দেখতে পেত।
আজ একটা ফ্যাকাশে কালো সিল্কের ড্রেস পরেছেন পুরোনো বেষ্টনী দিয়ে পায়ের দিকটা আঁটসাঁট করে বাঁধা। তবুও তাঁকে অশ্বারোহীর পোশাক পরে আছেন বলেই মনে হচ্ছে। কারণ ড্রেসটা প্রায় সেরকম ভাবেই সেলাই করা হয়েছে। যে কালো টুপিটা পরেছেন তার ওপরে একটা কালো পালক। যেন তাঁর পুরোনো কোন শিকারে যাবার টুপির প্রতিরূপ।
জেরাল্ডকে দেখতে পেয়ে তিনি চাবুকের ইশারায় লাল ঘোড়াদুটোকে দাঁড় করালেন। গাড়ির পেছনে থেকে তাঁর চার মেয়ে হই হই করে ওঁদের অভ্যর্থনা করল। যেন টার্লটনদের সাথে ও’হারাদের কতদিন পরে মোলাকাত হল! মাত্র দু’দিন আগেই পরষ্পরের সাথে পরষ্পরের দেখা হয়েছে। আসলে ওরা ছিল অত্যন্ত মিশুকে, বিশেষ করে ও’হারার মেয়েদের সাথে ওদের খুব ভাব। মানে স্যুয়েলেন আর ক্যারীনের সাথে। স্কারলেটের সাথে মাথামোটা ক্যাথলীন ক্যালভার্ট ছাড়া কউন্টির আর কোন মেয়েরই তেমন সদ্ভাব ছিল না।
গ্রীষ্মকালে, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই, কাউন্টিতে কোথাও না কোথাও বারবেকিউ আর বলডান্সের আসর লেগেই থাকত। লালচুলো টার্লটনরা সবাই ছিল খুব হুল্লোড় আর ফূর্তিবাজ। প্রতিটি বারবেকিউতেই ওদের হই হই দেখে মনে হত যেন জীবনে এই প্রথম ওরা কোন বারবেকিউতে এল। গোলগাল মিষ্টি চার বোন ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। ওদের পোশাক হাওয়ায় পতপত করে উড়ে একে অন্যের ওপর পড়ছে। ঘাসে বোনা রোদটুপিগুলোর ওপর দিয়ে ছোট ছোট ছাতাগুলো গায়ে গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে। টুপিগুলোর তলা থেকে এক একজনের মাথার এক একরকম লালচুল দেখা যাচ্ছে। হেটির গাঢ় লাল, ক্যামিলার স্ট্রবেরি লাল, র্যান্ডার তামাটে লাল, আর ছোট্ট বেটসির গাজরের মত লাল।
“কি সুন্দর লাগছে আপনার মেয়েদের,” ওঁদের গাড়ির পাশে ঘোড়া দাঁড় করিয়ে জেরাল্ড বললেন। “কালে কালে ওরা আপনাকেও ছাড়িয়ে যাবে!”
মিসেজ় টার্লটন ঈষৎ কটাক্ষ করে মৃদু হেসে প্রশংসা উপভোগ করলেন। মেয়েরা চেঁচিয়ে উঠল, “মা আবার তুমি ওরকম চোখ বাঁকিয়ে তাকাচ্ছ? বাপীর কাছে নালিশ করে দেব বলে দিলাম!” “কি জানেন মিস্টার ও’হারা, মা আপনার মত সৌম্যদর্শন মানুষ কাছে থাকলে আমাদের কোন সুযোগই দেন না!”
এই সব হাস্য পরিহাসে, অন্যদের সাথে স্কারলেটও হেসে উঠল। আবার মায়ের সংগে মেয়েদের এই সহজ সম্পর্কে খানিক আশ্চর্যও হল। মা যেন ওদেরই সমবয়সী! মায়ের সঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তা ও ত কল্পনাতেই আনতে পারে না! অথচ টার্লটনদের মেয়েদের সঙ্গে তাদের মায়ের সম্পর্ক কত মধুর! মায়ের পেছনে লাগার জন্য, বা মায়ের সমালোচনা করার জন্য, বা মা কে বকার জন্য ওরা যা কিছু বলে তার মধ্যে একটা স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ও লুকিয়ে আছে। তা বলে এই নয়, স্কারলেট তাড়াতাড়ি নিজের মনে বলল, যে ও এলেনের পরিবর্তে মিসেজ় টার্লটনকেই মা হিসেবে চায়, কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে এই রকম হই চই করতে পারলে মন্দ হত না। অবশ্য এলেনের সম্পর্কে এরকম ভাবনাটাই তাঁকে অসম্মান করা। স্কারলেট বেশ লজ্জাই পেল। ও ভাল করেই জানে ওঁর মেয়েরা এর জন্য কোন অপরাধ বোধ করে না। অথচ ওর মনে কেন যে এই ধন্দ কিছুতেই বুঝতে পারে না।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধি থাকলেও স্কারলেটের মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতার অভাব ছিল। তবুও অবচেতনভাবে ওর মনে হল, যে টার্লটনরা বাচ্চা ঘোড়ার মত অশান্ত আর খরগোশের মত চঞ্চল। বাবা আর মা দু’দিক থেকেই ওরা জর্জিয়া – বলতে গেলে উত্তর জর্জিয়ারই আদি বাসিন্দা। সেই জন্যই ওদের মধ্যে একটা স্বভাবসিদ্ধ একরোখা ভাব আছে আর আছে একটা প্রবল আত্মবিশ্বাস। এই মনোভাব উইল্কসদের মধ্যেও আছে, তবে ওদের চিন্তা ভাবনার পরিসর সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিন্তা ভাবনার বৈষম্য থাকলেও কোন দ্বন্দ্ব নেই। অথচ মৃদুভাষী সম্ভ্রান্ত ফরাসি মনোভাবাপন্ন মা আর ঘোর বিষয়ী মনোভাবাপন্ন আইরীশ বাবার মেয়ে স্কারলেটের মনে এত সংশয়, এত দ্বিধা কেন! স্কারলেট মা কে যেমন দেবীর মত ভক্তি করতে চায়, তেমনই তাঁর সঙ্গে আহ্লাদিও করতে চায়। ওথচ দুটোই একসাথে সম্ভব বলে মনে করতে পারে না। আর এই সংশয় থেকেই ও পুরুষ মানুষের কাছে নিজেকে একজন কমনীয়, লজ্জাশীলা নারী হিসেবে তুলে ধরতে চায় অথচ মনে মনে তাদের কাছে থেকে দু’একটা চুম্বনেরও প্রত্যাশা করে।
“এলেন সকাল সকাল আবার কোথায় গেল?” মিসেজ় টার্লটন জিজ্ঞেস করলেন।
“আমাদের ওভারসিয়ারকে জবাব দেওয়া হল। তাই ওর কাছে হিসেবপত্র বুঝে নিতে হচ্ছে। আর তিনি কোথায়? আর ছেলেরা?”
“আরে, ওরা তো সেই সাত সকালেই টুয়েলভ ওকসে চলে গেছে। পানীয়ের মিশ্রণ ঠিক মত হল কি না টেস্ট করার জন্য! যেন এখন থেকে কাল সকাল পর্যন্ত সেটা করবার আর কোন সুযোগ আসবে না! আমি তো মিস্টার উইল্কসকে অনুরোধ করব কাল সকাল পর্যন্ত আটকে রাখতে। দরকার হলে আস্তাবলেই শুতে দিতে! পাঁচ পাঁচটা মাতাল লোক সামলানো খুব মুশকিল! তিনটে অব্দি তাও চলে--”
জেরাল্ড লক্ষ্য করলেন মেয়েরা মুখ টিপে হাসছে। উইল্কসদের আগেরবারের বারবেকিউ থেকে কি অবস্থায় বাড়ি ফিরেছেলিনে সেটা মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
“আপনি আজ ঘোড়ায় চড়ে এলেন না, মিসেজ় টার্লটন? নেলীকে ছাড়া আপনাকে ভাবাই যায় না! আপনি হলেন যাকে বলে একজন স্টেন্টর১!” [১ স্টেন্টর – গ্রীক পুরাণে ইলিয়াডে বর্ণিত একজন দূত (সংবাদ বাহক) যার কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রের মত।]
“কি বললেন? আমি স্টেন্টর!”, মিসেজ় টার্লটন জেরাল্ডের বাচনভঙ্গী নকল করে চেঁচিয়ে উঠলেন। “মানে সেই যার কাংস্যনিন্দিত গলা! আপনি নিশ্চয়ই সেন্টর২ বলতে চেয়েছিলেন?” [২ সেন্টর – গ্রীক পুরাণে বর্ণিত কল্পিত প্রাণী যার ঘোড়ার মত শরীর আর মানুষের মত মুখ।]
“আরে স্টেন্টরই হোক, কি সেন্টর!” ভুল বুঝতে পেরেও একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে জেরাল্ড প্রত্যুত্তর দিলেন। “যখন শিকারি কুকুরগুলোকে উৎসাহ দেন তখন আপনার গলা থেকে বজ্রনির্ঘোষ বের হয়।”
“ঠিক হয়েছে, মা”, বেটি বলল। “তোমাকে কতবার বলেছি যে শেয়াল দেখলেই তুমি তারস্বরে চেঁচাও।”
“ম্যামি তোমার কান পরিষ্কার করার সময় তুমি যেভাবে চেঁচাও, তত জোরে নয়!” মিসেজ় টার্লটন জবাব দিলেন। “আর তোমার মাত্র ষোল বছর বয়স! ও হ্যা আজ নেলীর বাচ্চা হয়েছে, তাই আজ ওকে নিয়ে বেরোতে পারি নি।”
“তাই বুঝি!” জেরাল্ডের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল। তাঁর আইরীশ রক্তে ঘোড়া নিয়ে আসক্তি প্রবল। মিসেজ় টার্লটনের পাশাপাশি মা কে রেখে স্কারলেট আবার ধাক্কা খেল। মায়ের কাছে ঘোড়া কিংবা গরুর বাচ্চা হয় না। মূর্গিরাও বলতে গেলে ডিম পাড়ে না। এলেন এই সব ব্যাপারে কথা বলা পছন্দই করেন না। মিসেজ় টার্লটনের কাছে এসব নিয়ে আলোচনা করা কোন ব্যাপারই নয়!
“নিশ্চয়ই মাদা বাচ্চা!”
“না না, সুন্দর মদ্দা বাচ্চা। লম্বা লম্বা ঠ্যাং। একদিন এসে দেখে যাবেন। একেবারে সত্যিকারের টার্লটন ঘোড়া। আমার বেটির কোঁকড়া চুলের মত লাল রঙের।”
“আর দেখতেও একেবারে বেটির মত,” বলে উঠল ক্যামিলা। তারপর ড্রেস, টুপি, স্কার্টের ভিড়ে হেসে গড়াগড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল। বেটি চটে গিয়ে ওকে চিমটি কাটতে শুরু করল।
“মেয়েরা তো সকাল থেকে উৎসাহে ডগমগ করছে,” মিসেজ় টার্লটন বললেন। “যখন থেকে অ্যাশলে আর ওর ওই অ্যাটলান্টার পিসতুতো বোনের ব্যাপারটা জানতে পারলাম – কি যেন নাম মেয়েটার? – মেলানি? – ঈশ্বর ওর মঙ্গল করুন – কি মিষ্টি মেয়ে! – তখন থেকেই আমার মেয়েরা ওখানে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে ওর নাম আর মুখটা ঠিক মনে করতে পারছি না। আমাদের কুকি আবার উইল্কসদের খানসামার বউ। আজ সন্ধ্যেবেলা যে ওদের দু’জনের বাগদানের ঘোষণা হবে ওর কাছেই জানা গেছে। কুকি আজ সকালে আমাদের বলল। শুনে মেয়েদের উত্তেজনা দেখে কে! আমি তো এত উত্তেজনার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না! এ তো জানা কথাই, যে অ্যাশলে যদি ম্যাকনের ওদের আত্মীয় বার পরিবারের কোন মেয়েকে বিয়ে না করে তাহলে একেই বিয়ে করবে! যেমন হানি উইল্কস মেলানির ভাই চার্লসকে বিয়ে করবে। আপনিই বলুন, মিস্টার ও’হারা উইল্কসরা নিজেদের পরিবারের বাইরে বিয়ে করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? ধরুন যদি --''
আরও যেসব কথা হেসে হেসে উনি বলে যাচ্ছিলেন সেগুলো স্কারলেটের কানে আর ঢুকছিল না। এক মুহুর্তের জন্য ওর মনে হল সূর্য যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সারা পৃথিবী ছায়ায় ঢেকে গেছে, আর সব কিছু থেকে রঙ শুষে নিয়েছে। শ্যামল প্রকৃতি হঠাৎ যেন ফিকে হয়ে গেছে। সাদা সাদা ডগঊডের ফুলগুলো মলিন হয়ে গেছে। একটু আগের দেখা রঙীন ফুলের সমাহার ফ্যাকাসে আর বিবর্ণ লাগছে। স্কারলেট গাড়ির পর্দা ধরে নিজেকে সামলে নিল। মাথার ওপর ছাতাটা নড়ে গেল। অ্যাশলের বাগদানের কথাটা জানা এক রকম ব্যাপার। কিন্তু যখন সেটা নিয়ে সবাই ঘরোয়া আলোচনা ফেঁদে বসে তখন অসহ্য হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ও নিজেকে সামলে নিল। আকাশের আড়াল থেকে সূর্য বেরিয়ে এল। আবার চারদিক ঝকঝকে হয়ে উঠল। অ্যাশলে ওকেই ভালবাসে, সেটা নিশ্চিত। যখন সন্ধ্যেবেলা বাগদানের ঘোষণা করা হবে না, তখন মিসেজ় টার্লটনের মুখের অবস্থা কি হবে, ভেবে ও মনে মনে একটু হেসে ফেলল। কি অবাকই না হবেন যখন ওদের পালিয়ে যাবার খবর পাবেন! সবাইকে বলে বেড়াবেন, ‘দেখেছো কি ধড়িবাজ মেয়ে ওই স্কারলেটটা! মেলানি সম্বন্ধে যা যা বললাম, চুপটি করে সব শুনে গেল-- আর এদিকে অ্যাশলে আরও--’ নিজের মনে হেসে ওর অজান্তেই গালে টোল পড়ল। বেটি সবই শুনছিল আর লক্ষ্য করছিল। সব দেখে শুনে বেশ ধাঁধায় পড়ে গেল।
“সে আপনি যাই বলুন না কেন, মিস্টার ও’হারা,” মিসেজ় টার্লটন বেশ জোরের সঙ্গে বলে চলেছেন। “এই যে নিজেদের মধ্যে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটাই খুব বাজে! অ্যাশলের সাথে মেলানির বিয়ের ব্যাপারটাই মেনে নিতে পারছি না! তার ওপর আবার ইন্ডিয়া বিয়ে করবে ওই ফ্যাকাসে দেখতে চার্লস হ্যামিলটনকে --'
“চার্লিকে বিয়ে না করলে ইন্ডিয়া আর কোন বর পাকড়াও করতে পারবে না,” র্যান্ডি নিষ্ঠুরভাবে বলে উঠল। নিজের জনপ্রিয়তার নিয়ে ওর খুব অহঙ্কার। “ওই ছেলেটাকে ছাড়া আর কাউকে ধরতেও পারে নি এখনও! ছেলেটা অবশ্য ওকে খুব একটা পাত্তাটাত্তাও দেয় না। তোর নিশ্চয়ই মনে আছে স্কারলেট, গত ক্রিসমাসের সময় ও কিভাবে তোর পেছন ছাড়ছিলই না!”
“বোকার মত কথা বলিস না,” ওর মা বললেন। “পিসতুতো জ্যাঠতুতো ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়া একেবারেই ঠিক নয়। এমনকি পরবর্তি প্রজন্মের হলেও। এতে বংশ দূর্বল হয়ে পড়ে। ঘোড়াদের মত ন্য় ব্যাপারটা। কুলুজি ঠিক রাখলে ভাইয়ের সাথে বোনের কিংবা বাবার সাথে মেয়ের সঙ্গেও ভাল ঘোড়ার বাচ্চা পয়দা করা যায়। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এটা খাটে না। হয়ত বংশের আভিজাত্য অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ে।”
“না, ম্যাডাম, আমি একমত হতে পারলাম না। আপনিই বলুন আমাদের তল্লাটে উইল্কসদের থেকে ভাল পরিবার আর একটাও আছে কি? আর সেই ব্রায়ান বোরু যখন ছোট ছিল, তখন থেকেই ওরা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করা শুরু করেছে।”
“এটা বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। এর কুফলটা তো দেখাই যাচ্ছে। না অ্যাশলের ব্যাপারে বলতে চাই না। খুবই সুদর্শণ আর বলিষ্ঠ। তবুও কি ___ সে যাক। উইল্কসদের মেয়ে দুটোকে দেখুন – কি ফ্যাকাশে চেহারা। আর ওই মেলানি? কঞ্চিবাঁশের মত লিকপিকে – ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে! কিছুতেই উৎসাহ নেই। নিজের মতামতও নেই। সবসময় “হ্যা ম্যাডাম”, “না ম্যাডাম”। মুখ দিয়ে আর কিছু রা’ই কাড়বে না! বুঝতে পারছেন তো কি বলতে চাইছি? নতুন রক্ত দরকার। আমার লাল চুলের মেয়েদের কিংবা আপনার স্কারলেটের মত মেয়ের। আমাকে ভুল বুঝবেন না। মানুষ হিসেবে উইল্কসদের তুলনা হয় না। আমিও ওঁদের পছন্দ করি, সেটাও আপনি জানেন। তবে সত্যি কথাটা খোলাখুলি বলা ভাল। সাধারণ পরিস্থিতিতে ওঁদের অসুবিধে হবে না। কিন্তু সঙ্কটে পড়লে? আমাকে একটা বড় ঘোড়া দিন। বর্ষার দিন হোক কি খটখটে শুকনো দিনে, আমার তাকে নিয়ে কোন অসুবিধে হবে না। নিজেদের মধ্যে বিয়ে ওঁদের অন্যদের থেকে কেমন যেন আলাদা করে দিয়েছে। সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকবেন, বা পিয়ানোয় টুং টাং করবেন। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, অ্যাশলে শিকার করার থেকে বই পড়তে বেশি পছন্দ করবে। হ্যা, মিস্টার ও’হারা আমি সত্যিই বিশ্বাস করি! আর ওঁদের হাড়ের গঠনও লক্ষ্য করে দেখবেন – খুবই সরু। ওঁদের প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান বাবা আর স্বাস্থ্যবতী মা _____”
“উঁ – হু ---উঁ --- উঁ --- ম,” সহসা এলেনের কথা মনে পড়তেই, জেরাল্ড বেশ অস্বস্তি বোধ করলেন। যে আলোচনা উনি এত উপভোগ করছেন, এলেন সেটা মোটেই পছন্দ করতেন না। যদি জানতে পারেন এসব আলোচনা মেয়েদের সামনে খোলাখুলি চলেছে তাহলে হয়ত উনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। কিন্তু নিজের প্রিয় বিষয় – সেটা ঘোড়া নিয়েই হোক কি মানুষ নিয়ে – একবার কথা বলতে শুরু করলে, মিসেজ় টার্লটনের আর আর পাঁচজনে কি ভাবছে না ভাবছে তার পরোয়াই করেন না।
“আমি যা বলছি, ভেবেচিন্তেই বলছি। আমার কয়েকজন তুতো ভাইবোন ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করেছিল। সত্যি বলছি, তাদের ছেলেমেয়েদের কোলাব্যাঙের মত ড্যাবড্যাবে চোখ। কি দুঃখের কথা! আমার বেলায় তো আমিএকদম বেঁকে বসেছিলাম। বলেছিলাম, “দেখ মা, আমি পারব না। তারপর আমার ছেলেমেয়েরা কুঁদো হবে না রুগ্ন হবে কে জানে! মা তো একবারে অজ্ঞান, তবে ঠাকুমা আমাকে সাথ দিয়েছিলেন। তিনিও ঘোড়াদের প্রজননের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতেন কিনা। বলেছিলেন যে আমি একদম ঠিক কথা বলছি। মিস্টার টার্লটনের সঙ্গে পালিয়ে যেতে সাহায্যও করেছিলেন! দেখুন আমার ছেলেমেয়েদের! স্বাস্থ্যবান, লম্বাচওড়া; কেউই রুগ্ন, হাড়জিরজিরে নয়। অবশ্য বয়েড মাত্র পাঁচ ফুট দশ। আর উইল্কসদের দিকে তাকান _____”
“না – মানে – বলছিলাম কি ম্যাডাম,” মেয়েদের দিকে চোখ পড়তেই সন্ত্রস্ত হয়ে জেরাল্ড মাঝপথে কেটে বলে উঠলেন। ক্যারীন হাঁ করে কথাগুলো গিলছে, আর স্যুয়েলেনের চোখেমুখে অপার কৌতুহল। এলেনকে গিয়ে যদি আপত্তিকর কিছু জিজ্ঞেস করে বসে তাহলে! এরপর কি আর তাঁর সঙ্গে মেয়েদের পাঠাতে ভরসা পাবেন? স্কারলেট অবশ্য এসব কথায় কানই দেয় নি। তাঁর আদরের পুস সত্যিকারের লেডির মত নিজস্ব কোন ভাবনায় মশগুল হয়ে আছে।
বেটি টার্লটন তাঁর মুখরক্ষা করল।
“কি হল মা! এবা চল!” অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “এই রোদ আর ভাল লাগছে না। ঘাড়ে ঘামাচি বেরিয়ে গেল!”
“এক মিনিট, ম্যাডাম,” জেরাল্ড বললেন। “আমাদের ট্রুপে আপনার ঘোড়াদের বিক্রি করবার ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন কি? যুদ্ধ তো যে কোন দিন বেধে যেতে পারে। ছেলেরা ব্যাপারটাকে মিটিয়ে নিতে চাইছিল। এটা ক্লেটন কাউন্টির ট্রুপ। সেজন্য ক্লেটন কাউন্টির ঘোড়াই ওদের দিতে চাই আমরা। অথচ আপনি একগুঁয়ের মত আপনার সেরা ঘোড়াগুলো হাতছাড়া করতে চাইছেন না।”
“যুদ্ধ হয়ত হবেই না,” মিসেজ় টার্লটন তাল মিলিয়ে জবাব দিলেন। অ্যাশলেদের অদ্ভুত বিবাহরীতি থেকে তাঁর মন সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে।
“সে কথা অমন নিশ্চিত করে বলা যায় না, ম্যাডাম ____”
“মা!”, বেটি আবার অসহিষ্ণু। “তুমি আর মিস্টার ও’হারা একথাগুলো তো টুয়েলভ ওকসে পৌছেও বলতে পার। এখন থাক না!”
“ঠিক আছে, মিস বেটি,” জেরাল্ড বললেন। “ঘড়ি ধরে দেখ, তোমার মা’কে মিনিট খানেকের বেশি আটকাবো না। এই তো আমরা টুয়েলভ ওকসে পৌঁছে গেলাম বলে। কিন্তু ওখানে সবাই – বড় ছোট সকলেই – ঘোড়ার ব্যাপারে জানতে চাইবেন। বলতে আমার খারাপই লাগছে – তোমাদের মা এমন মার্জিত এবং সুন্দরী লেডি হওয়া সত্ত্বেও নিজের ঘোড়ার ব্যাপারে একটু কিপটে। আপনার দেশাত্ববোধের দোহাই, মিসেজ় টার্লটন! আমাদের কনফেডারেসি নিয়ে কি আপনার একটুও মাথাব্যাথা নেই?”
“মা!” ছোট্ট বেটসি কেঁদে উঠল। “র্যান্ডা আমার জামার ওপর বসে পড়েছে। আমার ড্রেস কুঁচকে যাচ্ছে!"
“ঠিক আছে বেটসি, র্যান্ডাকে তুমি ঠেলে সরিয়ে দাও, আর চুপ কর! আর মিস্টার ও’হারা অ্যামার কথা শুনুন,” চোখ পাকিয়ে জেরাল্ডকে বললেন। “কনফেডারেসি নিয়ে আমাকে খোঁটা দেবেন না। আমি আপনাদের থেকে কনফেডারেসিকে কোন অংশে কম ভালবাসি না। আমার চারজন ছেলে ট্রুপে আছে। আপনার একজনও নয়! আমার ছেলেরা নিজেদের সামলাতে পারে, কিন্তু আমার ঘোড়ারা নয়! যদি জানতাম যে সে ঘোড়াগুলো ভদ্রলোকেরা চড়বেন, যাঁরা ঘোড়ায় চড়তে জানেন, তাহলে আমি বিক্রি কেন, এমনিই দিয়ে দিতাম। কিন্তু চড়বে তো সব ছোটলোকের দল, যারা খচ্চরে চড়ে থাকে, যারা জানেই না ঘোড়ায় জিন কি করে চড়াতে হয়। সেটাতেই আমার আপত্তি! সেই বুদ্ধুগুলো আমার সুন্দর ঘোড়াগুলোর অযত্ন করবে, সে আমি সইতে পারব না। ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমার ঘোড়া নিতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু না মিস্টার ও’হারা, আপনারা বরং অ্যাটলান্টা থেকে অন্য ঘোড়া ওই ছোটলোকদের জন্য কিনে নিন। ওরা বুঝতেও পারবে না!”
“মা আমরা কি যাব না?” এবারে ক্যামিলা অস্থির হয়ে পড়ল। “তুমি ভাল করেই জান যে শেষমেশ তুমি তোমার প্রিয় ঘোড়াগুলো দেবে! বাপী আর ভাইরা যখন তোমাকে বোঝাতে থাকবেন যে ঘোড়াগুলো কনফেডারেসির দরকার, তখন তুমি কাঁদতে কাঁদতে হলেও ঘোড়াগুলো দিয়ে দেবে!”
মিসেজ় টার্লটন মৃদু হেসে চাবুক তুললেন।
“এরকম কিছুই আমি করব না,” হালকা করে ঘোড়াদের স্পর্শ করে বললেন। ওরা আবার ছুটতে লাগল।
“একজন সত্যিকারের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মহিলা,” মাথায় টুপি পরে নিজেদের গাড়ির পাশ নিয়ে বললেন। “চালাও টোবি। আমরা ওঁকে ঠিক রাজি করিয়ে ফেলব। তবে উনি একদম ঠিক কথা বলেছেন। ভদ্রলোক না হলে তার ঘোড়ায় চড়ার অধিকারই হয় না। ওদের সঠিক জায়গা হল পদাতিক বাহিনীতে। দুঃখের কথা হল, পুরো ট্রুপ তৈরি করার জন্য এই কাউন্টির প্ল্যান্টারদের যথেষ্ট ছেলে নেই। কি বলিস পুস?”
“বাপী, তুমি একটু পেছনে পেছনে চল, আর নয়ত আগে আগে। তোমার ঘোড়ার পায়ে পায়ে এত ধুলো উড়ছে – আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে,” স্কারলেট বলল। কথাবার্তা বলতে ওর একদম ভাল লাগছিল না। এতে ওর নিজের ভাবনার তাল বার বার কেটে যাচ্ছিল। টুয়েলভ ওকসে পৌঁছানোর আগেই যেন ওর মুখ আর মন দুশ্চিন্তামুক্ত দেখায়। জেরাল্ড বাধ্য ছেলের মত লাল ধুলোর ঝড় উঠিয়ে টার্লটনদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন যাতে উনি প্রাণভরে ঘোড়া নিয়ে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
পঞ্চম অধ্যায়
নদী পেরিয়ে ওদের গাড়ি টিলায় চড়ল। টুয়েল্ভ ওকস নজরে আসার আগেই স্কারলেট লম্বা লম্বা গাছের মাথার ওপরে পাতার ফাঁক দিয়ে ঝাপসা ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পেল। বাতাসে ভেসে আসছে হিকোরি কাঠের আগুনে ভেড়ার মাংস আর পোর্ক ঝলসানোর সুঘ্রাণ।
বারবেকিউর চুল্লী, যেগুলো কাল থেকেই অল্প আঁচে জ্বলছে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই গনগনে লাল হয়ে উঠেছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝলসানোর সময় মাংস থেকে রস গড়িয়ে পড়ে হিস হিস শব্দ হচ্ছে আর আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। স্কারলেট জানে যে জন উইল্কসের বিশাল অট্টালিকার পেছনের ওকের বাগান থেকে বাতাস এই সুবাস নিয়ে আসছে। ওঁদের বাড়ির প্রত্যেকটা বারবেকিউই ওখানেই হয়। জায়গাটা অল্প ঢালু, গোলাপ বাগানের পাশে। খুব ছায়াছন্ন, মনোরম জায়গা। ক্যাল্ভার্টরা যেখানে বারবেকিউ করেন তার থেকে অনেক বেশি মনোরম। মিসেজ় ক্যাল্ভার্ট বারবেকিউতে তৈরি খাবার ভালবাসেন না। বলেন বারবেকিউ হয়ে যাওয়ার পর অনেকদিন পর্যন্ত সেই খাবারের গন্ধ বাড়িতে থেকে যায়। বাড়ির থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে অনাচ্ছাদিত সমতলভুমিতে কাঠফাটা রোদ্দুরের মধ্যে ওঁদের বারবেকিউর আয়োজন করা হয়। আতিথেয়তার জন্য এলাকায় জন উইল্কসের খুব সুনাম। বারবেকিউর আয়োজনেও তাঁর উচ্চ রুচির পরিচয় পাওয়া যেত।
উচ্চমানের লিনেনে ঢাকা পিকনিকের টেবিলগুলো গাছের ছায়ায় রাখা হত। টেবিলের দু’পাশে বেঞ্চ। হেলান দেবার ব্যবস্থা নেই। চেয়ার আর মাটিতে পেতে বসার জন্য ঘরের থেকে গদি নিয়ে এসে ইতস্তত রেখে দেওয়া হত। অনেকে বেঞ্চে বসতে চাইতেন না, তাঁদের জন্য। মাংস গ্রীল করার উনোন থাকত বেশ দূরে যাতে ধোঁয়া এসে অতিথিদের জ্বালাতন করতে না পারে। বড় বড় লোহার গামলায় বারবেকিউ স্যস আর ব্রানজ়ুইক স্ট্যু ভাসত। অন্তত এক ডজন নিগ্রো, মিস্টার উইল্কসের নির্দেশ মত, ট্রে হাতে অতিথিদের খাদ্য পরিবেশন করার জন্য ছোটাছুটি করত। গোলাবাড়ির পেছনে আরো একটা বারবেকিউর চুল্লী থাকত। বাড়ি চাকরবাকররা, সহিসরা, অতিথিদের সঙ্গে আসা পরিচারিকারা জমিয়ে বারবেকিউ করত। হো কেক, রান্না করা শুয়োরের অন্ত্র (যেটা নিগ্রোদের খুব প্রিয় আহার্য), আর মরসুমি তরমুজ খুব পরিতৃপ্তি করে খেত।
স্কারলেট প্রাণভরে তাজা পোর্ক রোস্ট হওয়ার আঘ্রাণ নিল। মনে মনে ভাবল যতক্ষণে ওগুলো তৈরি হয়ে যাবে, ততক্ষণে নিশ্চয়ই ওর খিদে পেয়ে যাবে। এখন ওর পেট একদম ভরা; আর এত টাইট করে কোমরে দড়ি বাঁধা, যে খালি ঢেকুর তুলতে ইচ্ছে করছে। তা হলেই কেলেঙ্কারি! কেবল মাত্র বয়স্ক লোক আর অতিবৃদ্ধা মহিলারা ঢেকুর তুললেই কোন রকম সমাজবিধি লঙ্ঘন হয় না।
টিলা বেয়ে ওপরে উঠে যেতেই সুন্দর সাদা বাড়িটা দেখা যেতে লাগল। লম্বা লম্বা থাম, চওড়া চওড়া বারান্দা, আর সমতল ছাদ। যেন এক লাবণ্যময়ী নারীর মত। টারার চেয়েও স্কারলেট টুয়েল্ভ ওকসকে বেশি ভালবাসত। টুয়েল্ভ ওকসের সৌষ্ঠব কিংবা আভিজাত্য কোনটাই জেরাল্ডের বড়িতে ছিল না।
লম্বা বাঁকানো ড্রাইভওয়েতে বেশ কিছু জিন লাগানো ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়িও এসেছে। অতিথিরা নামতে নামতে একে অন্যকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। পার্টিতে আসতে পেরে উদ্দীপ্ত নিগ্রোরা হাসিমুখে জানোয়ারগুলোকে শস্যাগারের কাছে নিয়ে গিয়ে জিন খুলে দিচ্ছে সারাদিনের জন্য। এক দঙ্গল সাদা আর কালো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা চারদিকে ছোটাছুটি করে খেলছে আর কে কতটা খেতে পারবে তাই নিয়ে উত্তেজিত হয়ে কল কল করছে। বাড়ির সামনে থেকে পেছন অবধি লম্বা হলে পুরুষ এবং মহিলারা গিজ গিজ করছে। ও’হারাদের গাড়ি যখন বাড়ির সামনে এসে থামল, স্কারলেট দেখল মেয়েরা সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরে, এক হাতে একে অন্যের কোমর বেষ্টন করে প্রজাপতির মত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ঊঠছে আর নামছে। মাঝে মাঝে থাম ধরে হাতলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে হেসে হেসে ছেলেদের ডাকাডাকি করছে।
ফরাসী জানালার ফাঁক দিয়ে স্কারলেট দেখল সিল্কের পোশাক পরিহিত বয়স্ক মহিলারা ড্রয়িংরুমে গোল হয়ে বসে বাচ্চা, অসুখবিসুখ, কার সাথে কার বিয়ে হল, কার হল না, এই সব নানা বিষয়ে আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত। টম, উইল্কসদের পরিচারক, একটা রুপোর ট্রে নিয়ে, হল থেকে হাসিমুখে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এসে, সুবেশ যুবকদের শরবত পরিবেশন করছে।
রোদ ঝলমলে সামনের বারান্দায়ও অনেক অতিথি সমাগম হয়েছে। স্কারলেটের মনে হল কাউন্টির সমস্ত মানুষ এখানে চলে এসেছে। টার্লটনের চার ভাই আর তাদের বাবা লম্বা লম্বা থামের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রেন্ট আর স্টুয়ার্ট যথারীতি একসঙ্গে। বয়েড আর টম তাদের বাবা জেমস টার্লটনের পাশে। মিস্টার ক্যালভার্ট তাঁর ইয়াঙ্কি স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে। পনের বছর জর্জিয়াতে কাটিয়েও ভদ্রমহিলা এখনও এখানকার পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন নি। সকলেই ওঁর সাথে ভদ্র এবং সহৃদয় ব্যবহার করেন এবং নিজেকে এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারার জন্য সহানুভূতিশীল। তবে এঁরা একথা একদমই ভুলতে পারেন না যে ইনি একসময় মিস্টার ক্যাল্ভার্টের সন্তানদের গৃহশিক্ষিকা ছিলেন। রেফোর্ড আর কেড, ক্যাল্ভার্টের দুই ছেলে, আর তাদের লাস্যময়ী, ব্লন্ড বোন ক্যাথলীন, গোমড়ামুখো জো ফোনটেন আর ওর হবুবউ মিষ্টি চেহারার স্যালি মুনরোর পেছনে লাগছে। অ্যালেক্স আর টোনি ফোনটেন ডিমিটি মুনরোর কানে কানে কিছু বলছে আর মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। প্রায় দশ মাইল দূর লাভজয় থেকেও কোন কোন পরিবার এসেছেন। ফ্যেয়াটভিল, জোন্সবোরো, এমনকি আটলান্টা আর ম্যাকন থেকেও কেউ কেউ এসেছেন। জনারণ্য; তুমুল কোলাহল; হাসিঠাট্টার পরিবেশ।
দেউড়ির সিঁড়ির কাছে জন উইল্কস দাঁড়িয়ে। রুপোলী চুল, সৌম্য চেহারা। উষ্ণ আতিথেয়তার প্রতিমূর্তি, ঠিক যেন জর্জিয়ার গ্রীষ্মকালের সূর্যের মত অমলিন। হানি উইল্কস তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে। ওকে সকলে হানি বলে ডাকে কারণ ও ছোট বড় সবাইকেই এমনকি খেতমজুরদেরও এটা বলেই ডাকে। আগত অতিথিদের অভিবাদন করতে গিয়ে ও ছটফট করছিল আর হেসে গড়িয়ে পড়ছিল।
বাবার সংযত আচরণের পাশে হানির পুরুষদের নজর কাড়বার এই উচ্ছল প্রয়াস দেখে স্কারলেটের মনে হল, মিসেজ় টার্লটনের কথাটা হয়ত ভুল নয়। উইল্কসদের পুরুষদের চেহারায় একটা পারিবারিক বৈশিষ্ট আছে। ঘন সোনালি ভুরু আর ধূসর চোখ। অথচ হানি আর ওর বোন ইন্ডিয়ার ভুরু অত ঘন নয় আর চোখও কেমন যেন ফ্যাকাসে। হানিকে ভুরুহীন খরগোশের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আর ইন্ডিয়ার চেহারা তো বৈশিষ্টহীন।
ইন্ডিয়াকে কোথাও দেখতে পেল না। স্কারলেট জানে ও নিশ্চয়ই রান্নাঘরে চাকরদের তদারকি করছে। বেচারা ইন্ডিয়া, ভাবল স্কারলেট, মা মারা যাবার পর থেকে ঘরদোর সামলাতে গিয়ে আর বর পাকড়াও করার সময়ই পায় না। এক স্টুয়ার্ট টার্লটন ছাড়া। আর ও যে হানির থেকে বেশি সুন্দরী তাতে স্কারলেটের দোষ কোথায়!
স্কারলেটদের দেখতে পেয়েই জন উইল্কস নেমে এলেন ওকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করার জন্য। নামতে নামতে স্যুয়েলেনকে বোকার মত হাসতে দেখে বুঝল ভীড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি রয়েছেন।
গাড়ি থেকে হেসে জন উইল্কসকে ধন্যবাদ দিতে দিতে স্কারলেট খানিক শ্লেষের সঙ্গে ভাবল আমি অন্তত ওরকম বুড়োহাবড়া প্রেমিক পছন্দ করতাম না!
স্যুয়েলেনকে সাহায্য করবার জন্য ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন। স্যুয়েলেনের হাব ভাব দেখে স্কারলেটের ইচ্ছে হল ওকে কষে একটা চড় মারে। হতে পারে ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি এই কাউন্টির অন্যদের থেকে অনেক বেশি জমির মালিক আর সহৃদয় মানুষ। কিন্তু তাঁর বয়স চল্লিশ হয়ে গেছে। মুখে পাতলা তামাটে দাড়ি আর কেমন যেন ব্যস্তবাগীশ আইবুড়ো হাব ভাব। যাই হোক, নিজের পরিকল্পনার কথা মনে রেখে, স্কারলেট চড় মারার ইচ্ছেটা পরিহার করল। তারপর মিষ্টি হেসে ওঁর দিকে তাকাল। অভিভূত হয়ে মিস্টার কেনেডি স্যুয়েলেনের দিকে হাত বাড়িয়েও স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
স্কারলেট জন উইল্কসের সঙ্গে মৃদু বাক্যালাপ করতে করতেই চারদিকে চকিত দৃষ্টি ফেলে অ্যাশলেকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু ও দেউড়ির আশে পাশে কোথাও ছিল না। অনেকেই ওকে অভিবাদন জানাল। স্টুয়ার্ট আর ব্রেন্ট টার্লটন ওঁর দিকে এগিয়ে এল। মুনরোর মেয়েরা এগিয়ে এসে ওর ড্রেসের প্রশংসা করতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই ওকে ঘিরে ধরল। ওর শ্রুতিগোচর হওয়ার জন্য সকলেই খুব হল্লা করতে শুরু করল। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু অ্যাশলে কোথায়? মেলানী আর চার্লস? কাউকে বুঝতে না দিয়ে ও চারদিকে দেখতে লাগল। হলের ভেতর কলরবমুখর মানুষজনের মধ্যেও খোঁজার চেষ্টা করল।
হাসি ইয়ার্কির ফাঁকে ফাঁকে চার দিকে চোখ চালাতে চালাতে ওর নজর হঠাৎ একজন অচেনা আগন্তুকের দিকে পড়ল। হলের মাঝখানে একলা দাঁড়িয়ে বেহায়ার মত ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরুষমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারার নারীসুলভ তৃপ্তি আর বুককাটা ড্রেস পরে থাকার জন্য বিব্রত বোধ করা, এই দু’ধরনের একটা মিশ্র অনুভুতির স্রোত ওর মধ্যে বয়ে গেল। বয়স বেশির দিকেই, অন্তত পঁয়ত্রিশ। বেশ লম্বা এবং শক্তিশালী। ওর দেখা যে কোন ভদ্রলোকের তুলনায় অনেক বেশি চওড়া কাঁধ আর পেশীবহুল চেহারা। চোখে চোখ পড়তেই উনি হাসলেন। যত্নকরে ছাঁটা কুচকুচে কালো গোঁপের নীচে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে ধবধবে সাদা দাঁতের সারি বের করে। তামাটে চেহারা, অনেকটা জলদস্যুদের মত। সপ্রতিভ কালো চোখ। জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া অথবা কুমারী নারীর ইজ্জত হরণ করা জলদস্যুদের যেমন হয়। হাসির মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব আর তরল পরিহাসের অভিব্যক্তি। স্কারলেটের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। ওর মনে হল এরকম দৃষ্টিতে ওর অপমানিত বোধ করা উচিত। কিন্তু কি লজ্জা, ওর তো অপমান বোধ হচ্ছেই না! ভদ্রলোক কে সেটা স্কারলেটের জানা নেই, কিন্তু তামাটে মুখটা দেখে মনে হয় কুলীন বংশেরই কেউ হবেন। পুরু লাল ঠোঁটের ওপর ঈগলের মত নাক, চওড়া কপাল আর দীর্ঘায়ত চোখ।
একটুও না হেসে ও চোখ সরিয়ে নিল। কেউ একজন ডাকল, “রেট! রেট বাটলার! এদিকে আসুন! জর্জিয়ার সবথেকে কঠিন হৃদয় মহিলার সাথে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।” শুনতে পেয়ে উনিও সেদিকে চলে গেলেন।
রেট বাটলার? নামটা খুব চেনা চেনা। যেন কোন একটা রগরগে কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে আছে নামটা! যাকগে, এখন অ্যাশলেকে ছাড়া অন্য কারুর ব্যাপারে ভাবার সময়ই নেই।
“ওপরে গিয়ে চুলটাকে একটু ঠিক করে আসি,” ও ব্রেন্ট আর স্টুয়ার্টকে বলল। ওরা অনেকক্ষণ থেকেই ওকে পাকড়াও করার তালে ছিল। “আমার জন্য একটু অপেক্ষা কর। এরমধ্যে অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে যদি কেটে পড় তাহলে কিন্তু খুব রেগে যাব।”
অন্য কারও সাথে ফ্লার্ট করলে আজ স্টুয়ার্টকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল। সকাল থেকেই অবিরাম পান করে চলেছে। দু’চোখে ‘এসো এক হাত হয়ে যাক’ ধরনের দাম্ভিক দৃষ্টি। এর থেকে সমস্যা তৈরি হতে পারে সেকথা ভাল করেই জানা আছে স্কারলেটের। যাবার সময় হলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু দাঁড়াল। দেখতে পেল ইন্ডিয়া বাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে এল। আলুথালু চুল, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওকে হেসে অভিবাদন জানাল। বেচারি ইন্ডিয়া! বিবর্ণ চুল আর চোখের পালক আর লম্বাটে থুতনির জন্য এমনিতেই ওর বয়স কুড়ি বছর বেশি লাগে। স্কারলেটের খুব জানতে ইচ্ছে করে স্টুয়ার্টকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে আনার জন্য ইন্ডিয়া কি ওকে ওকে মনে মনে ঘৃণা করে! অনেকেই বলে থাকে ইন্ডিয়া এখনও স্টুয়ার্টকেই ভালবাসে। তবে উইল্কসদের সম্পর্কে জোর দিয়ে কেউই কিছু বলতে পারে না। যদি স্কারলেটকে পছন্দ নাও করে, হাবে ভাবে সেটা কখনো বুঝতেই দেয় নি। আগের মতই নির্লিপ্ত সৌজন্য দেখিয়েই ও স্কারলেটকে অভ্যর্থনা করে।
ওর সঙ্গে হেসে একটু কথা বলেই স্কারলেট সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। পাশ থেকে কেউ একজন খুব লাজুক গলায় ওর নাম ধরে ডাকল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল চার্লস হ্যামিলটন। সুন্দর চেহারা, শুভ্র কপালের ওপর একরাশ নরম বাদামি চুল এসে পড়েছে, গাঢ় বাদামি রঙের চোখে স্বচ্ছ, কোমল দৃষ্টি। সর্ষে রঙের ট্রাউজ়ার, কালো কোট, প্লীট দেওয়া শার্ট আর কেতাদুরস্ত টাইয়ে খুব সুন্দর লাগছিল ছেলেটাকে। স্কারলেট ঘুরে তাকানোয় গালদুটো অল্প লাল হয়ে উঠল। মেয়েদের ব্যাপারে চার্লস যথেষ্ট লাজুক। আর লাজুক হবার কারণে, ও দূর থেকেই সুন্দরী, লাস্যময়ী, সহজলভ্য মেয়েদের দেখে মোহিত হয়। এর আগে স্কারলেট ওকে সাধারণ সৌজন্য দেখানো ছাড়া বিশেষ পাত্তা দেয়নি। আজ যখন দু’হাত বাড়িয়ে একগাল হেসে ওকে অভিবাদন জানাল, তখন ও আনন্দে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল।
“কি ব্যাপার চার্লস হ্যামিলটন! কি দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে! নিশ্চয়ই আমার মন চুরি করতে অ্যাটলান্টা থেকে এতদূর এসেছ!”
অপ্রত্যাশিত আনন্দে বিহ্বল হয়ে চার্লস স্কারলেটের নরম উষ্ণ হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে, মুগ্ধদৃষ্টিতে ওর চঞ্চল সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েরা অন্য ছেলেদের সাথে এভাবেই কথা বলে? ওর সাথে তো কেউ বলে না! ওর থেকে অনেক কম সুপুরুষ ছেলেরা, যাদের থেকে ও অনেক ব্যাপারেই শ্রেষ্ঠ – তাদের সাথেও মেয়েরা কত রকম ফষ্টিনষ্টি করে। কবে থেকেই তো চেয়েছে মেয়েরা ওর সাথেও ওরকম করুক! অবশ্য কখনও যে হয় নি তেমন নয়। কিন্তু তখন এমন জড়তা এসে যায় যে ও কথা খুঁজে পায় না! তারপর রাত্রে বিছানায় শুয়ে একরাশ ভাল ভাল কথা মনে পড়ে যায় আর ভাবে এর পরে ঠিক বলতে পারবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে মেয়েরা একবার হতাশ হয়েছে তারা ওকে আর দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না!
এমন কি হানি – যার সঙ্গে ওর বছরখানেক বাদে বিয়ে হবে বলে ধরেই নেওয়া হয়েছে – ওর সঙ্গেও কথা বলতে গেলেও জড়তা এসে যায়। মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় ইন্ডিয়া যে ওর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে সেটা চার্লসের প্রেমিকসুলভ আচরণের জন্য নয়। ইন্ডিয়ার ছেলেঘেঁসা স্বভাবের জন্য। যে কোন ছেলের সাথেই ও এটা করবে। ওকে বিয়ে করার ব্যাপারেও চার্লস মন থেকে তেমন সাড়া পায় না। বইতে প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে যে রসসিক্ত আবেগের কথা লেখা থাকে, তেমন কোন আবেগই ইন্ডিয়ার ব্যাপারে ওর আসে না। সুন্দরী, সাহসী, দুরন্ত প্রেমিকাই মনে মনে ওর পছন্দ।
আর স্কারলেট মন চুরি করবার কথা বলে ওর পেছনে লাগছে!
যথাযথ প্রত্যুত্তর দেবার ইচ্ছে হল, কিন্তু সে আবার সব গুলিয়ে গেল। তবু ভাগ্য ভাল বলতে হবে, স্কারলেট উত্তরের প্রত্যাশা না করেই অনবরত কথাবার্তা চালিয়ে গেল। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। এটা কি স্বপ্ন না সত্যি! বিশ্বাসই হয় না!
“এইখানে চুপটি করে দাঁড়াও, যতক্ষণ না ফিরে আসি। বারবেকিউ আমি তোমার সঙ্গেই খেতে চাই। অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে যেও না যেন। আমি কিন্তু ভীষণ হিংসুটে, বলে দিচ্ছি,” লাল ঠোঁট নেড়ে বলে গেল। গালের দু’পাশে টোল পড়িয়ে। সবুজ চোখের ওপর কালো পালকগুলো বার বার ওঠানামা করতে লাগল।
“না, যাব না,” কোনক্রমে ও বলে ফেলল। স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে স্কারলেট মনে মনে ওকে কসাইয়ের সামনে বাছুরের সঙ্গে তুলনা করছে!
ভাঁজ করা হাতপাখা দিয়ে চার্লসের বাহুতে মৃদু টোকা দিয়ে ঘুরে যখন ওপরে উঠতে গেল, দেখতে পেল রেট বাটলার নামের সেই লোকটা একা একা চার্লসের থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার মানে চার্লসের সাথে ওর কথাবার্তা সবই উনি শুনেছেন। উনি যখন স্কারলেটকে দেখে হুলোবেড়ালের মত হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে অল্প হাসলেন, তখন ও একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল। মনে হল অত্যন্ত দৃষ্টিকটূ ভাবে উনি ওর আপাদমস্তক লেহন করে নিলেন। এরকম নির্লজ্জ দৃষ্টিতে ও একদমই অভ্যস্ত নয়।
“অসভ্য, জানোয়ার কোথাকার!” স্কারলেট মনে মনে ফুঁসল। “এমনভাবে তাকাল যেন আমি অন্তর্বাসটুকুও পরে নেই!” তারপর গটগট করে ওপরে উঠে গেল, কোনদিকে না তাকিয়ে।
শোবার ঘরে, যেখানে উপহার সামগ্রী রাখা হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে দেখল ক্যাথলীন ক্যাল্ভার্ট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের ওপর দাঁত দিয়ে চাপ দিয়ে সেগুলোকে আরো লাল করবার চেষ্টা করছে। ওড়নার লাল গোলাপগুলো ওর গালের রঙের সাথে মিলে গেছে। নীল চোখদুটো উত্তেজনায় চকচক করছে।
“ক্যাথলীন,” নিজের বুকের দিকের কাপড়টা একটু ওপরে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করল, “নীচের তলায় বাটলার নামের ওই অসভ্য লোকটা কে রে?”
“হায় কপাল, তুই জানিস না!” ক্যাথলীন ফিসফিস করে উত্তেজিতভাবে বলল। তারপর আড়চোখে যেদিকে ডিলসি আর উইল্কস মেয়েদের ম্যামি গল্প করছিল, সেদিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “জানি না মিস্টার উইল্কস কি ভাবছেন ..... । জোন্সবোরোতে উনি মিস্টার কেনেডির ওখানে গিয়েছিলেন – তুলো কেনা কিংবা ওইরকম কোন ব্যাপারে – মিস্টার কেনেডিকে ওঁকে সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে। একা তো আর রেখে আসতে পারেন না।”
“ওঁর ব্যাপারটা কি?”
“কি বলব, উনি কোথাও আমন্ত্রিত হন না!”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ।”
স্কারলেট মনে মনে খবরটাকে হজম করার চেষ্টা করল। কোথাও আমন্ত্রিত হন না এমন লোকের সাথে এক ছাতের তলায় হওয়ার সুযোগ এর আগে কখনও আসে নি। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর।
“কি করেছেন এমন?”
“কি বলব, স্কারলেট! ভদ্রলোকের প্রচণ্ড বদনাম। ওঁর নাম রেট বাটলার। চার্লসটনে থাকেন। ওঁর আত্মীয়-স্বজনরা যথেষ্ট ভদ্রলোক। ওঁরা এই ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কই রাখেন না। গত বছর গরমের সময় ক্যারো রেট বলেছিল ওঁর সম্বন্ধে। ওঁদের কোন আত্মীয় নয় যদিও, তবু সবই জানে ওঁর সম্বন্ধে। ওঁকে ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল! ভাব একবার! ঘটনাটা এতই কদর্য ছিল যে ক্যারোও জানতে পারে নি! তারপর আরো আছে – যে মেয়েটাকে উনি বিয়ে করলেন না।”
“বল্, বল্।”
“তুই কি কিছুই শুনিস নি সোনা? সেবার ক্যারো সবই বলেছিল। ও যে এগুলো সব জানে, ওর মা জানতে পারলে লজ্জায় মরে যাবেন। সে যাই হোক। একবার মিস্টার বাটলার চার্লসটনেরই এক মেয়েকে ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরতে নিয়ে গেছিলেন। সে কে ছিল সেটা জানতে পারি নি, তবে কোন একজনকে আমার সন্দেহ হয়। মেয়েটা মোটেই ভাল নয় – নইলে পড়ন্ত বিকেলবেলা একা একা কেউ একজন পুরুষমানুষের সাথে বেরিয়ে যায়? কি বলব তোকে, রাত প্রায় কাবার করে দুজনে ফিরে এল! কি না ঘোড়াটা নাকি পালিয়ে গেছিল – আর ওঁদের গাড়িটা একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছিল – ওঁরা নাকি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভাব একবার ____”
“ভাবতে পারছি না রে। তুই বল,” স্কারলেট দুরন্ত কৌতুহলে জানতে চাইল। মনে মনে, সব থেকে খারাপ ব্যাপারটাই হয়েছ্ এই আশা নিয়ে।
“পরের দিন, উনি ওকে বিয়ে করতে রাজী হলেন না।”
“ওহ,” স্কারলেটকে নিরাশ লাগল।
“উনি বললেন – মানে – উনি এমন কিছুই করেন নি যাতে ওকে বিয়ে করতে হবে। মেয়েটার ভাই ওঁকে বেরিয়ে আসতে বলল। উনি বললেন ওই বুদ্ধু মেয়েটাকে বিয়ে করার চেয়ে বরং গুলি খেয়ে মরে যাওয়া ভাল। শেষমেশ উনি মেয়েটার ভাইয়ের সঙ্গে ডুয়েল লড়লেন। ভাইটা ওঁর গুলি খেয়ে মারা গেল। ওনাকেও চার্লসটন ছেড়ে চলে যেতে হল। এখন তাই কেউ ওঁকে আমন্ত্রণ জানায় না,” ক্যাথলীনের বলাও শেষ হল আর ডিলসি ফিরে এল স্কারলেটের প্রসাধনের তদারকি করতে।
“কোন বাচ্চা হয়েছিল?” ক্যাথলীনের কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল স্কারলেট।
ক্যাথলীন জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। “তবে মেয়েটার একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেল,” স্কারলেটের কানে কানে ফিসফিস করে বলল।
আমার আর অ্যাশলের মধ্যে এরকম কিছু একটা হলে খুব ভাল হত। ও যেরকম ভদ্রলোক, আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হত। তবু ওই বোকা মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ার জন্য রেট বাটলারকে মনে মনে তারিফ না করে থাকতে পারল না।
***
বাড়ির পেছন দিকে একটা বিশাল ওক গাছের ছায়ায় রোজ়উডের একটা নীচু আসনে স্কারলেট বসল। মৃদু বাতাসে ওর পোশাক একটু এলোমেলো। পায়ের সবুজ মরক্কো চপ্পল অল্প উঁকি দিচ্ছে। যেটুকু প্রদর্শণ করলেও লেডি থাকা যায়, ঠিক সেটুকু। হাতে ধরা প্লেটের খাবার স্পর্শ করে নি। সাতজন প্রণয়প্রার্থী ওকে ঘিরে রেখেছে। বারবেকিউ জমে উঠেছে। হাসি হুল্লোড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। রোস্টেড মাংস আর গ্রেভির সুগন্ধে বাতাস ভরপুর। মৃদুমন্দ বাতাসে চুল্লির ধোঁয়া মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। তখন মহিলারা মৃদু প্রতিবাদ করার ভান করছেন আর ঘন ঘন তালপাখা নাড়িয়ে ধোঁয়া তাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
অল্পবয়সী মেয়েরা বেশিরভাগই টেবিলের দুদিকে রাখা বেঞ্চগুলোতে যার যার সঙ্গীকে নিয়ে বসেছিল। কিন্তু স্কারলেট ভেবে দেখল বেঞ্চে ওর দুই দিকে মাত্র দুজন ছেলেই বসতে পারবে, তার বেশি নয়। তাই ও সবার থেকে আলাদা হয়ে বসেছে, যাতে ওর আশে পাশে একসঙ্গে অনেক ছেলেই জুটতে পারে।
বিবাহিত মহিলারা দলবেঁধে বাগানে বসেছেন। তাঁদের পরনে গাঢ় রঙের পোশাক। এইসব বিবাহিত মহিলারা, বয়স যাই হোক না কেন, অবিবাহিত মেয়েদের থেকে আলাদা হয়ে দল বেঁধে বসতেন। বয়সের সুযোগ নিয়ে ঠাকুমা ফোনটেন ক্রমাগত সশব্দে ঢেকুর তুলে চলেছিলেন। আর ওদিকে বেচারা সতেরো বছরের অ্যালিস মুনরো প্রথম গর্ভাবস্থাজনিত গা গুলোনোর অস্বস্তিকে প্রাণপনে দমিয়ে রেখেছে। এঁরা সবাই মিলে বংশবৃত্তান্ত আর স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত আলোচনায় মগ্ন। অল্পবয়সীদের কাছে এইসব আলোচনা যেমন কৌতুহলব্যঞ্জক তেমনই জ্ঞানগর্ভ।
স্কারলেট খানিক অনুকম্পা নিয়ে এঁদের দিকে তাকাল। ঠিক যেন কয়েকজন হৃষ্টপুষ্ট মুর্গি বসে আছেন। এঁদের জীবনে ফুর্তি করবার কোন জায়গা নেই। ওর মাথায় অবশ্য এটা এল না যে অ্যাশলেকে বিয়ে করার পরে ওকেও এই আসরেই যোগ দিতে হবে। ওকেও এই ধরনের অনুজ্জ্বল পোশাক পরতে হবে, আর ফুর্তি করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। আসলে, সব অবিবাহিত মেয়ের মতই ওর কল্পনাও বিয়ের বেদী অবধিই পৌঁছায়। তাঁর বেশি নয়। তবে এই মুহুর্তে অস্থির মনটাকে কোনভাবেই অন্য দিকে লাগাতে চাইছে না।
খুব মার্জিতভাবে ও প্লেটে রাখা একটা বিস্কিটে ছোট্ট একটা কামড় লাগাল, ঠিক একজন লেডির মত। ম্যামি নিশ্চয়ই খুশি হত। অবশ্য খিদেও নেই একেবারে। অসংখ্য পাণিপ্রার্থীরা ওকে ঘিরে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে এরকম নিঃস্ব এর আগে কখনওই মনে হয় নি। কি এক অজ্ঞাত কারণে অ্যাশলের ব্যাপারে কাল রাতের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। অ্যাশলেকে বাদ দিয়ে অন্য প্রণয়প্রার্থীকে টেনে আনতে ওর কোন অসুবিধেই হয় নি। কাল বিকেলের আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে। ওর হৃদয়স্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। গালের রঙ ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
অ্যাশলে ওর প্রণয়প্রার্থীদের দলে ভেড়বার কোন চেষ্টাই করে নি। এমন কি আসার পর থেকে অ্যাশলের সঙ্গে একলা কথা বলার কোন সুযোগও পায় নি। হ্যা, বাড়ি পেছনের বাগানে দেখা হওয়ার পর অ্যাশলে এগিয়ে এসে হেসে ওকে অভ্যর্থনা করেছে। মেলানির বাহু ওর হাতে ধরা ছিল। মেলানী ওর কাঁধ অবধিও লম্বা নয়।
ছোটোখাটো, রুগ্ন চেহারা। মনে হচ্ছিল যেন মায়ের বিশাল লম্বা স্কার্ট পরে পুঁচকে একটা মেয়ে। ওর বাদামী চোখের লজ্জাজড়ানো ভীরু দৃষ্টির জন্য আরো বেশি করে মনে হচ্ছিল। ওর ঘন লম্বা কোঁকড়া চুল নেট দিয়ে মাথার ওপর এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যে ওর পানপাতার মত মুখের গঠন আরও স্পষ্ট লাগছিল। চোয়ালের কাছটা চওড়া আর থুতনির কাছটা ছুঁচলো। ভীতু কিন্তু মুখটা মিষ্টি। তবে বড্ড সাধারণ। আর ওর এমন কোন নারীসুলভ আকর্ষণ নেই যে এই সাধারণ ভাবটা আড়াল হয়ে যাবে। সরল, সাদাসিধে আর স্বচ্ছ্ব। তবু ওর চলাফেরার মধ্যে একটা চাপা আভিজাত্য আছে যেটা মন ছুঁয়ে যায়, কিন্তু ওর বয়স মনে হয় যেন সতের বছরের অনেক বেশি।
স্কারলেটকে দেখে মিষ্টি হেসে ওর সবুজ ড্রেসটার প্রশংসা করল। স্কারলেট তখন অ্যাশলের সাথে আলাদা করে কিভাবে কথা বলা যায় সেটা ভাবতে ব্যস্ত। তাই প্রত্যুত্তরে ওর জবাবটা তত শিষ্ট হয় নি। ভীড় থেকে দূরে, মেলানির পায়ের কাছে একটা টুলে বসে অ্যাশলে ওর সাথে হেসে, গল্প করে একটানা সঙ্গ দিয়ে গেছে। সেই স্বপ্নময় হাসি যেটা দেখতে স্কারলেট ভালবাসে। অ্যাশলের কোন কথায় মেলানি হেসে উঠল। ওর চোখে একটা ঝিলিক মেরে গেল। আড়াল থেকে স্কারলেট দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে মেলানিকে খুবই সুন্দর লাগছে। অ্যাশলের চোখে চোখ রাখল মেলানি। ওর সাদামাটা মুখে একটা হালকা আভা। প্রেমপূর্ণ হৃদয়ের ভাষা যদি কখনও মুখে ফুটে ওঠে, তাহলে এই মুহুর্তে সেটা মেলানি হ্যামিলটনের মুখে ফুটে উঠেছে।
ধূসর রঙের অরগ্যান্ডির পোশাক, সাথে চেরি রঙের ঝালর দেওয়া বক্ষাবরক ওড়না ওর অপরিপুষ্ট শরীরটা আড়াল করে রেখেছে। মাথায় হলুদ রঙের হ্যাট, চেরি রঙের লম্বা ঝালর দেওয়া, মাখনের মত নরম ত্বককে উজ্জ্বল করে তুলেছিল। মাথার দু’পাশ থেকে সোনার লম্বা ঝোলা দুল, শান্ত চোখের পাশে দুলছিল। শীতকালের নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণির মধ্যে ঝরে পড়া পাতার মত বাদামি সেই চোখ।
ওদের দিক থেকে নজর সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পেরে উঠল না। আর যতবার দেখছে তত ও ফুর্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওকে ঘিরে থাকা ছেলেদের সাথে নাচ, গান, হাসি ঠাট্টা চালিয়ে যেতে লাগল। ওদের প্রশংসাসূচক কথা নানারকম মুখভঙ্গী করে উড়িয়ে দিতে লাগল। বলল এগুলো কোনটাই কেউ মন থেকে বলছে না, তাই ও কারও কথাই বিশ্বাস করছে না। দুঃখের বিষয়, অ্যাশলে ওর এইসব কথাবার্তায় কোন মনযোগই দিল না, আর আপন মনে মেলানির সঙ্গে গল্প করায় ব্যস্ত রইল। মেলানির দৃষ্টি থেকে পরিষ্কার যে অ্যাশলে ওরই, আর কারও নয়।
এজন্যই স্কারলেট নিঃস্ব বোধ করছিল।
ওপর ওপর কেউই স্কারলেটকে দুঃখী বলে ধরতে পারবে না। আজকের বারবেকিউতে সেই হল সবার নয়নের মনি, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যে উন্মাদনা আজ পুরুষকুলে ও সৃষ্টি করতে পেরেছে আর তাঁরই ফলশ্রুতি হিসেবে নারীকুলের ঈর্ষা উৎপাদন করতে পেরেছে, তাতে অন্যদিন হলে ওর পরিতৃপ্তির সীমা থাকত না।
চার্লস হ্যামিলটন, স্কারলেটের নজরে পড়ার সুবাদে, সাহসী হয়ে ওর ডানদিক দখল করে বসে আছে। টার্লটন ভাইদের প্রভূত চেষ্টা সত্ত্বেও ওকে নড়ানো যায় নি। এক হাতে স্কারলেটের তালপাতার পাখা আর অন্য হাতে বারবেকিউর প্লেট। হানির চোখে চোখ না পড়ার সযত্ন প্রয়াস। এদিকে হানির প্রায় কেঁদে ফেলবার জোগাড়। কেড বসেছে স্কারলেটের ডান পাশে। স্কার্টে টান দিয়ে স্কারলে্টের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে আর চোখ পাকিয়ে স্টুয়ার্টের দিকে তাকাচ্ছে। ওর সঙ্গে যমজ ভাইদের প্রায় হাতাহাতি হবার জোগাড়। দু’চারটে গালি দু’পক্ষ থেকেই বেরিয়ে গেছে। ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি ওক গাছের ছায়া আর টেবিলের মধ্যে চক্কর কাটছেন। খাবারদাবার নিয়ে আসছেন স্কারলেটকে প্রলুব্ধ করার জন্য। যেন এই কাজটা করার জন্য কোন চাকর ওখানে নেই! ফলে স্যুয়েলেনের বিরক্তি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, মাঝে মাঝেই সেটা ভদ্রতার মুখোস খুলে বেরিয়ে পড়ছে। ক্যারীনেরও কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সকালে স্কারলেটের আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও, ব্রেন্ট শুধু একবার ওর মাথার রিবন নাড়িয়ে দিয়ে, “কি খবর বোন” বলে সম্পূর্ণভাবে স্কারলেটের দিকে মনযোগ দিয়ে বসে আছে। ব্রেন্ট তো ওর সঙ্গে কি মিষ্টি ব্যবহার করে, সব সময় কত গুরুত্ব দিয়ে ওর কথা শোনে, আর তাই জন্যেই না বড় হবার পর ওকেই বর হিসেবে কল্পনা করে রেখেছে! এখন মনে হচ্ছে স্কারলেটই ওকে দখল করে নিয়েছে! মুনরোর মেয়েরা অবশ্য ওদের বিরক্তি গোপন করেই রেখেছে। ফোনটেনদের ছেলেরাও স্কারলেটের শিবিরে যোগ দিয়েছে। কিন্তু যে ভাবে স্কারলেটের কাছাকাছি যাবার জন্য কসরত করে চলেছে সেটা কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি!
স্কারলেটের আপত্তিকর ব্যবহার দুই বোন চোখের ইশারায় হেটি টার্লটনকে জানাল। ‘চরিত্রহীন’, স্কারলেটের জন্য এটাই উপযুক্ত বিশেষণ। নিজের নিজের ছাতা তুলে নিয়ে তিন কন্যা একসাথে ঘোষণা করল যে খাওয়াদাওয়া অনেকে হয়ে গেছে, তারপর কাছে দাঁড়ানো ছেলেদের কাঁধে হাত রেখে বায়না করল গোলাপের বাগান, ঝর্ণা, গ্রীষ্মাবাস এসব দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের সুকৌশলী পশ্চাদপসরণ অন্তত একজন মহিলা আর একজন পুরুষের নজর এড়িয়ে গেল না।
তিনজন প্রণয়প্রার্থীকে টেনে নিয়ে যাওয়া দেখে স্কারলেট মুখ টিপে হাসল। কি দেখতে যাচ্ছে? না জন্ম থেকে যেগুলো বার বার দেখেছে সেগুলোই! আড়চোখে অ্যাশলেকে দেখল। নাঃ ও মেলানির দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিছুই লক্ষ্য করে নি। স্কারলেটের বুকটা মুচড়ে উঠল। ইচ্ছে করল মেলানির শুভ্র ত্বক খামচে রক্ত বের করে দিতে। খুব তৃপ্তি হয় তাহলে!
মেলানির ওপর থেকে চোখ ঘোরাতেই ও রেট বাটলারকে দেখতে পেল। ভীড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে জন উইল্কসের সঙ্গে কথা বলছেন। উনি ওর ওপর নজর রাখছিলেন আর চোখে চোখ পড়তেই কথা নেই বার্তা নেই হেসে উঠলেন। স্কারলেট এটা ভেবে অস্বচ্ছন্দ বোধ করতে লাগল যে উনি হলেন এখানে উপস্থিত একমাত্র ব্যক্তি (যাঁকে কেউ আমন্ত্রণ জানায় না) যিনি স্কারলেটের উদ্দাম আচরণের আসল রহস্যটা টের পেয়ে গেছেন। আর সেটা বুঝতে পেরে একটা অবজ্ঞামিশ্রিত আনন্দ লাভ করছেন। ওঁকে আঁচড়ে দিতে পারলেও ওর মনে শান্তি হবে।
“যদি বিকেল পর্যন্ত এই বারবেকিউতে টিঁকে থাকতে পারি,” মনে মনে ভাবল স্কারলেট, “মেয়েরা যখন বিশ্রাম নেবার জন্য ওপরে চলে যাবে, আমি নীচে থেকে যাব অ্যাশলের সাথে কথা বলার জন্য। আমার জনপ্রিয়তা ও নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবে।” তারপর আর একটা কথা ভেবে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। “মেলানির দিকে নজর না দিয়ে ওর কোন উপায়ও তো ছিল না। ওর পিসতুতো বোন বলে কথা! আর আমার মত জনপ্রিয়তাও তো বেচারার নেই। অ্যাশলে নজর না দিলে বেচারা একেবারে একা হয়ে যেত।”
ভাবনাটা ওর মনে বেশ সাহস সঞ্চার করল। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবার চার্লসের প্রতি মনোনিবেশ করল। চার্লসের বাদামি চোখ আশায় জ্বলজ্বল করে উঠল। দিনটা ওর কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। স্কারলেটের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। হানি ওর স্মৃতি থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। হানি যেন কর্কশকন্ঠী চড়াই পাখি। আর স্কারলেট সুরেলা খঞ্জনা পাখি। স্কারলেট ওর সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করতে লাগল। হাজারটা প্রশ্ন করে চলল। তারপর আবার নিজেই জবাব দিয়ে দিল। অন্যদের মাঝে ওকে চটপটে প্রমাণ করার জন্য। স্কারলেটের এই পক্ষপাত লক্ষ্য করে অন্য ছেলেরা খানিক হতবুদ্ধি আর খানিক বিরক্ত হল। চার্লস! যে কিনা পরপর দুটো কথা গুছিয়ে বলতে পারে না! ভদ্রতা দিয়ে রাগ ঢাকা দেওয়া ওদের পক্ষে বেশ শক্ত হয়ে পড়ল। অ্যাশলে ছাড়া সবাই রাগে ফুঁসছে। তবুও জয়ের আনন্দটা মাটি হয়ে গেল।
খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরে স্কারলেট আশা করছিল যে ইন্ডিয়া আসর গুটিয়ে মহিলাদের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলবে। প্রায় দুটো বাজে। মাথার ওপরে সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে। কিন্তু তিন দিনের ধকলে ক্লান্ত ইন্ডিয়ার গাছের ছায়ায় বসে থাকতে ভালই লাগছিল। ফ্যেয়াটভিল থেকে আসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছিল। উনি কানে একটু কম শোনেন।
চারপাশে একটা অলস আচ্ছন্ন পরিবেশ। নীগ্রো দাসদাসীরা টেবিল পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। হাসিঠাট্টা, কথাবার্তা ঝিমিয়ে এসেছে। অনেকেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। সকলেই হোস্টেসের সকালের আসরের সমাপ্তির প্রতীক্ষা করছেন। তালপাতার পাখাও অনেক মন্থর গতিতে চলছে। অনেক ভদ্রলোকই ভরপেট ভোজনের পর গরমে ক্লান্তি প্রকাশ করছেন। বারবেকিউ শেষ হল। সূর্য মধ্যগগনে থাকা পর্যন্ত সবাই একটু বিশ্রাম নিতে চাইছিল।
সকালের সরগরম পার্টির পর, সন্ধ্যাবেলা বলডান্স শুরু হবার মাঝে এই মধাহ্ন ব