আমি সে রাতে ঘুমোতে পারিনি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে জানালার শার্শিগুলো কাঁপছিলো। একটি পতঙ্গ ফর ফর করে ঘরের সিলিং এ শব্দ করছিলো। নানারকম চিন্তা মাথায় নিয়ে ব্যাপারটা জানার জন্য আমি ঘরের বাইরে এলাম। আসলে কী হচ্ছিল?
আমি আমার প্যান্টের পকেটে একটি হাত ঢুকিয়ে সিঁড়ির নীচে নেমে এলাম। তখন হলুদ আলোর বাতিগুলো জ্বলছিলো। আমাদের বিল্ডিংএর সিঁড়ির নীচে সবধরনের লোহালক্কড়ের আবর্জনা ফেলে রেখেছে। এখানে কারো একটি মরচেপড়া ক্যাম্প-খাট ভাঁজ করে রাখা আছে। বেডের ওপর একজন লোক কুঁজো হয়ে বসেছিলো ।
আমি লোকটিকে দেখতেই আমার হাত প্যান্টের পকেট থেকে বের করে স্বস্তিতে তার পাশে বসলাম। আর আমার বিরক্তিকর চিন্তাগুলো দূর হয়ে গেল।
লোকটি একটি গাঢ় নীল রঙের জ্যাকেট ও টাই, চকচকে মসৃণ বুটজুতা পরেছিলো। বলতে অস্বস্তিকর বোধ করছি-- একটি কালো ছেড়া আন্ডারওয়্যার লোকটির পরণে ছিলো।
আমি লোকটির দিকে ঘুরে বললাম 'তুমি তোমার স্ত্রীকে কী বলে সম্বোধন করো? তোমার স্ত্রী তোমাকে এই পুরনো পরিধানগুলো দিয়েছে তাই না?
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আমি আমার হাত বাড়িয়ে বললাম 'শুভেচ্ছা কমরেড’।
লোকটি করমর্দন করলো, কিন্তু কিছুই বললো না।
আমি তখন বললাম, 'হ্যাঁ এমন আবহাওয়াই এর কারণ হতে পারে’। বলেই দরজার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলাম।
তখনও লোকটি নীরব ছিলো ।
আমি কিন্তু হাল ছেড়ে দেইনি । 'কেমন করে তারা পারলো? পারলো আমাদের সঙ্গে'?
এবং তরুণ পথিকৃতের মত স্যালুট দিয়ে আমি আমার হাঁটুতে আঘাত করলাম ।
মসৃণ চামড়ার বুট পরিহিত লোকটি সায় দিয়ে বললো, 'জঘন্য লোক'।
আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে বললাম 'না, কিন্তু কেমন করে তারা আসে?’ কারা এই জঘন্য লোকজন সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই?
লোকটি আবারও বললো 'জঘন্য। শুধু বলো, তারা কী চায়? তারা আমাদের কাছ থেকে কী চায়? ঐসব অসভ্য লোকেরা কি শান্ত হবে অথবা কী করবে, হ্যাঁ?’
‘হ্যাঁ’, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, 'তা তুমি কোন এপার্টমেন্টে থাকো'?
‘রাস্তার ওপারে থাকি।’
‘ঠিক আছে, তাহলে সে তোমাকে এগুলো দেবে কেন'?
লোকটি বললো, 'কে'?
‘তুমি জানো, তোমার স্ত্রী' ।
'স্ত্রী কে? আমার কোন স্ত্রী নেই' ।
আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম । একটি কথা জানাতে চাই-- ছেলেবেলা থেকেই আমি কোনো হেঁয়ালি পছন্দ করি না। এসবে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি ।
'তাহলে তোমার প্যান্টগুলো কোথায়'? আমি রাগের স্বরে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম ।
লোকটি কুঁজো অবস্থায় বিমর্ষ হয়ে বারবার হাত নেড়ে বললো 'হ্যাঁ’।
'কি? কেউ কি এগুলো (প্যান্ট) চুরি করেছে'?
'না'।
'শোন কমরেড, আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। আমি একজন সংবেদনশীল মানুষ । সহজে বুঝতে পারি। হেঁয়ালি আমার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক'।
'ঘটনা হলো, আমি রাতে হাঁটতে গিয়েছিলাম... এমন কি প্রাকৃতিক কাজ সারতে পারিনি।’
‘কমরেড পক্ষান্তরে, রাতে সাধারণত সবকিছু পরিস্কার থাকা উচিত। কারণ এসময়ে লোকজন ঘুমিয়ে থাকে। আর তারা বুঝতে পারে না।'
'হ্যাঁ এরকই একজন নির্বোধ আমি—এভাবে আমি জন্মেছি। এটাই সত্য'।
'কী বলতে চাইছো'? আমি ফিরে যাবার উপক্রম করতেই হঠাৎ দেখি লোকটি কাঁদছে । কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, 'এখন, এখন চলো' বলেই আমি লোকটিকে কনুই দিয়ে টেনে তুললাম । লোকটি ক্যাম্প খাট থেকে তার ছাতা হাতে নিয়ে সাবধানে সেখানে শোবার চেষ্টা করলো ।
আমি লোকটিকে আমার রান্নাঘরে নিয়ে এলাম এবং এক গ্লাস পানি দিলাম । লোকটি হঠাৎ করে তার জুতো খুলে একটি জুতোর মধ্যে লাল মোজাদুটো রাখলো ।
আমি বললাম, 'এবার বলো'।
‘আমি তোমাকে বলছি, 'আমি একটি অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন পাগল । এবং আর কী জানতে চাও? আমি যদি এমন স্বভাবের না হতাম, আমি ওদেরকে দেখিয়ে দিতাম’।
লোকটি তার হাত নেড়ে আরেক গ্লাস পানি ঢেলে পান করলো এবং তার হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছলো । আমি তাকে কিছু আচার দেওয়া মাসরুম খেতে বললাম। কিন্তু লোকটি মাথা নাড়ল। তার হাত নাড়িয়ে তার মুখের সামনে থেকে একটি অদৃশ্য মাছি ধরার চেষ্টা করতে লাগলো । 'আমি ওদের সবাইকে চাবুক মারতাম। আমি ওদের সবাইকে চাবুক মারতাম। আমি শক্তিশালী, আমি অভিযোগ করছি না । আমি দেখতেও খারাপ নই, এবং বুদ্ধিমান, ইচ্ছে করলে পরীক্ষাকারীদের ওখানে যে কাউকেই পেটাতে পারতাম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে প্যান্ট দেননি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে প্যান্ট দেননি'। লোকটি নীরব হয়ে গেলো এবং তার কাঁপা হাতে রুটির টুকরো ছিড়ে নিলো ।
আমি বিষন্নবোধ করছিলাম এবং আমার হাঁটু ঘষাঘষি করছিলাম ।
রুটির টুকরো ছিড়তে ছিড়তে লোকটি বললো, “আমি এসবে অভ্যস্ত ছিলাম না । সেদিন আমি একটি দোকানে গিয়েছিলাম । ওরা আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল, অবশ্যই ওরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখেনি। এবং এটা আমি সামলে নিতে পারি। ওরা ভান করে বলেছিল-- 'সুপ্রভাত, ভ্যালেরি পেট্রোভিচ, তুমি কি কিছু ম্যাকারনি খাবার চাও, ভ্যালেরি পেট্রোভিচ'? আমি চলে যাচ্ছিলাম। তখন একটি ছোট্ট একটি মেয়ে, বোধকরি পাঁচ বছর বয়স হবে, ওর মাকে বললো, 'মা, ঐ লোকটির পরণে কোন প্যান্ট নেই কেন'? মনে হচ্ছিল মেয়েটি যেন আমাকে গরম পানি ঢেলে পুড়িয়ে দেবে। ওরে শিশুটি, তোমার মুখটি বন্ধ করে রাখতে পারো না'?”
‘আমি জানি’, আমি বললাম। আর আমার নখ দিয়ে ওয়েলক্লথের ওপর থেকে লেবুর প্রলেপ উঠাবার চেষ্টা করছিলাম।
'এখন বলো-- এটা শীতকাল। গরমকালের জন্য এটা ঠিক আছে, কিন্তু শীতকালে পরে দেখার চেষ্টা করো, চেষ্টা করো শীতে। তখনই জঘন্য সত্য বেরিয়ে আসবে’।
আমি আমার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম ।
'চরম সত্যি কথা হলো, আমি সর্বোপরিই একা'! অন্ধ লোক অন্ধ লোকের সঙ্গেই দেখা করতে যায়, যায় বিশেষ লাইব্রেরীতে। কারণ ওদের মতো অনেক লোক আছে। অন্ধ মানুষ গিজগিজ করছে। । 'কিন্তু আমি একা! আমার মতো শুধুমাত্র একজনই হতভাগা আছে পুরো পৃথিবীতে । একজনই আছে প্যান্টবিহীন । কোন্ মূর্খ আমাকে বিয়ে করবে? কোন্ মূর্খ বলো? ওরা আমাকে করুণা করে, অবশ্যই করুণা করে। যদি মেয়েটিকে কোনো টাকা না দিতে পারো তবে আমার বাড়ি চলো। মেয়েটি দশটা অন্ধলোককে বিয়ে করবে, কিন্তু আমার মত অভাগাকে নয়' ।
আমরা ভোর হওয়া পর্যন্ত কথা বললাম । অথবা লোকটিই কথা বলছিল। আমি শুধু সহানুভূতিশীল হয়ে শুনছিলাম। দরজায় লোকটিকে দেখার পর আমি আমার হাত পকেটে রেখেছিলাম। আমার দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে ভাবছিলাম । আমার হৃদয়ে নতুন ভাবনার উদ্রেক হচ্ছিল । এই ভাগ্যবিড়ম্বিত লোকটির যন্ত্রণা লাঘবের জন্য কিছু করার ইচ্ছে হচ্ছিল । আমার মনে পড়লো- -আমার ফ্রিজে একটি হলুদ খরমুজ ছিল, আমি মনস্থ করলাম পরেরদিন সেটি তাকে দিয়ে আসবো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে ধিক্কার দিলাম। আমি লোকটির ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে বেমালুম ভুলে গিয়েছি। আর বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ওদের মতো পৃথিবীতে অনেকেই আছে। এই হতভাগ্য মানুষেরা দূর্দশাগ্রস্ত-- দৈন্যতায় চরম দুঃখকষ্ট সহ্য করে বেঁচে আছে। এবং আমরা আমাদের সবকিছু থেকেও সন্তুষ্ট হতে পারি না। সবসময় আমাদের চাহিদা লেগেই থাকে। আমাদের টেবিলের ওপর সজোরে কিল মারি। জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে যাই। রাতে ঘুমাতে পারি না। এসব ভালো লক্ষণ নয়-- বন্ধুরা মোটেও ভালো নয় ।

ইংরেজি অনুবাদ : জোয়ান টার্নবুল

লেখক পরিচিতি
আলেকজান্ডার শ্যারিপভ
আলেকজান্ডার শ্যারিপভ পূর্ব রাশিয়ার ভেলিকি উসটিওগে ১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন, ভ্লাদিমিরের কারিগরী শিক্ষায় স্নাতকত্তোর লাভ করেন । বারুদ প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করবার সময় তিনি গল্প লেখা শুরু করেন কিন্তু কোন প্রকাশক তাঁর গল্প প্রকাশ করেননি । পরবর্তীতে তিনি 'সলো' নামক একটি প্রকাশনীতে তাঁর গল্প পাঠান এবং তারা তাঁর গল্প স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করেন। এরপর তাঁর কিছু গল্প মস্কোতে 'ইয়োনিস্ট' ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয় । তিনি দুটো উপন্যাসও লিখেছিলেন যেগুলো এখনো অপ্রকাশিত । উপন্যাস দুটোর নাম ছিলো 'মার্ডার অফ কোচ' এবং 'রেড আন্ডারপ্যান্টস' ।
0 মন্তব্যসমূহ