আলজেরিয়ার গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
লেখক পরিচিতি:
লেখক হিসাবে তাঁর ঝুড়িতে রয়েছে ছোটগল্প সংকলন, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে সমালোচনা গ্রন্থ সহ দশটি বই । এগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘হু হিড সিবাওয়াহি’স ফুটওয়্যার ইন দ্য স্যান্ড’ (২০০৪) এবং ‘উইয়ংস্ ফর দ্য মুড অব দ্য হোয়াইট উলফ্ (২০০৮) তাঁর ছোটগল্প সংকলন । ‘দ্য স্কিন অব দ্য শ্যাডো’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে । লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে তিনি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন । চল্লিশ বছরের কম বয়সের উদীয়মান আরব বিশ্বের লেখক হিসাবে তিনি ২০০৯-১০ সালে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’-এর ‘বৈরুত৩৯ প্রজেক্ট’ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হন । তাঁর সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে ।

টেলিফোন
জুবায়ের টেবিলের উপর টেলিফোন রেখে আশা করেছে যে, ওটা বাজবে । জুবায়ের মেয়েটির কন্ঠস্বর শুনতে চায় এবং জানতে চায় সে এখনো বেঁচে আছে কি না । সংবাদপত্রের খবর স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন: যারা ছিল, তাদের মধ্যে একজন মহিলা যাত্রী ছাড়া সবাই মারা গেছে ।
নির্ঘাত বেঁচে যাওয়া মহিলাই সারাহ । উড়োজাহাজের যাত্রীদের মধ্যে সারাহর মতো আর কেউ ঔজ্জ্বলতা ছড়িয়ে বাকী জীবন পরিপূর্ণ করতে পারবে না । তাই কী, টেলিফোন? এ কথা তো তুমিই বলেছো । আমি কখনই তোমাকে বদলি করতে পারবো না; তুমিই সেই বস্তু, যা সারাহর কথাগুলো আমার কানে পৌঁছে দেয় । তোমার মাধ্যমে সে আমার আত্মার গভীরে জায়গা করে নিয়েছে । তোমার স্ক্রিনের উপরে যতবার তার নাম্বার আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, ততবার তুমি কী দেখনি আমার ভেতর কতটুকু আন্দোলিত হয়েছে ?
তুমি জানো, সে-ই একমাত্র মানুষ যার নাম্বার আমি কখনই টুকে রাখিনি । বিশেষ ধরনের রিংটোন অথবা ছবি দিয়ে তাকে কখনো পৃথক করে চিনতে হয়নি । তার মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু একটা ছিল, যা তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা গিয়েছে এবং সেটাই তাকে বিশিষ্ট করেছিল । অনেক সময় ফোনের শব্দ শোনার আগেই আমি হ্যান্ডসেট তুলতে ছুটে গিয়েছি । এসবের কোনো কিছুই কেন তোমার মনে পড়ছে না? তার কাছ থেকে একটা ফোন কল দিয়ে আমাকে বাঁচানোর জন্য এখন তুমি কেন তোমার শক্তি একত্রিত করছো না?
বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে এই উজবুক টেলিভিশন আমার সমস্ত চিন্তা-ভাবনাকে দখল করে নিয়েছে, যেমন এই ধরনের একটা সময়ে খাবার কেনার জন্য আমাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে । টেলিভিশন কী ভেবেছে যে, আমার মন এখন খাবার খেতে চায় কিংবা উগরে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক?
তুমি কী ভুলে গেছ যে, আমি তার ফোনের অপেক্ষায় আছি, টেলিফোন? সে ফোন করবে । তুমি কী বাজি ধরতে চাও? তুমিই শর্তাবলী নির্ধারণ করো । যেমন ধরো, তুমি যদি জেত, তাহলে আমি আমৃত্যু না খেয়ে অনশন করবো । অথবা তুমি আমাকে এমন কিছু খেতে বলবে, যা খেলে আমি তৎক্ষণাৎ মারা যাবো । আমি জানি: কখনো আমি এই ঘর থেকে বাইরে যাবো না, যতক্ষণ না লোকজন এসে আমার মৃতদেহ বহন করে বাইরে না নিয়ে যায়, তাহলে কেমন হয়?
[বৈঠকখানা থেকে সামনের দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতে তার কতক্ষণ সময় লেগেছে? মনে হয়েছে যেন দরজা নিজে নিজেই খুলে গেছে ।
সে যা দেখেছে, শুরুতে তা বিশ্বাস করেনি: সারাহ্ একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে এসেছে । সারাহর লাশ সে গ্রহণ করেছে, এই মর্মে লিখিত একটা সত্যায়িত সনদপত্রে দস্তখত করার জন্য পুলিশ তাকে অনুরোধ করে ।
পুলিশের সঙ্গে অযথা নষ্ট করার মতো তার হাতে কোনো সময় ছিল না । বৈঠকখানায় টেলিফোনের পাশে ছিল তার স্থান । সে দরজা বন্ধ করে ।]

দরজা
[আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করো না যে, সে তার নিজের দরজা চেনে না, গল্পকার ।
এটা জানা এবং অজানার উর্ধে ছিল এবং এমন একটা সিদ্ধান্ত ছিল, যা নিজের স্বভাব বোঝে না । সে বলেছে যে, যতবার সে দরজায় করাঘাত করে, ততবারই দরজার আদল রূপান্তরিত হয় এবং সে এ-ও বলেছে যে, তার মধ্যে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একটা কিছুর অনুভূতি হয় ।]
প্রথম স্বীকারোক্তি
কেউ কী ভাবতে পারেন যখন আপনি আপনার নিজের ঘরের দরজায় টোকা দেন, তখন আপনাকে শুনতে হয়, ‘দুঃখিত, স্যার, আপনার অ্যাপার্টমেন্ট এক তলা উপরে ।’ অথচ আপনি দেখলেন যে, সেটি আসলে আপনারই অ্যাপার্টমেন্ট । পরবর্তীতে আবারো গেলেন এবং শুনতে পেলেন, ‘‘দুঃখিত, স্যার, সত্যি কথা বলতে কি রাস্তার উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ে আপনার অ্যাপার্টমেন্ট ।’ কিন্তু আপনি দেখলেন যে, সেটি আসলে আপনারই অ্যাপার্টমেন্ট – সেই একই সব মানুষজন, একই অনুভূতি এবং পান্ডুলিপির ওপরে যেখানে আপনি কলম রেখে গিয়েছেন, ঠিক সেই জায়গায় বহাল তবিয়তে আছে।
আমার ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে একদিন হয়তো উপন্যাসের পান্ডুলিপি হারিয়ে যাবে । অ্যাপার্টমেন্ট হারানোর ভয়ের চেয়ে পান্ডুলিপি হারানোর ভয়ে আমি অধিক ভীত । যখন ঘরে ফিরে আসি, প্রথমেই আমি পান্ডুলিপির খোঁজ নিই এবং বাইরে যাওয়ার সময় সব শেষে ওকে বিদায় জানাই ।
গতকাল আমি আমাদের মহল্লায় ঢোকার পথে দাঁড়িয়েছি এবং আমার সঙ্গে হেঁটে ঘরে যাওয়ার জন্য সারাহকে ডাকি ।
‘আমি অসুস্থ,’ সারাহকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম, ‘তোমার কাঁধে মাথা রাখতে চাই ।’
‘সঠিক ভাবে বলো, তুমি কোথায় আছো, যুবাইর?’
‘দোকানের সামনে যেখান আরব দেশের মিষ্টি বিক্রি হয় ।’
‘আমাদের পাড়ায় আরবীয় মিষ্টির কোনো দোকান নেই । বরং যে দোকানে ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি বিক্রি হয়, তুমি সেই দোকানের সামনে অপেক্ষা করো ।’
‘এই এলাকায় কোথাও ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি বিক্রির দোকান নেই ।’
সারাহ্ আধেক দিন বাদে আমাকে খুঁজে পেয়েছে এবং যেখানে পেয়েছে, সেই জায়গা থেকে সে আমাকে অন্য এলাকায় নিয়ে যায় । ঘরে ঢুকে দেখি পান্ডুলিপির ওপর কলম পড়ে আছে ।
[সে জানতো না যে, অইসব পরিস্থিতির সঙ্গে তাকে মানিয়ে নিতে হতো, নাকি মস্তিস্ক বিকৃতি হওয়ার আগে নিজের হাতে জীবনকে তুলে নিতে হতো । ঠিক সেই মুহূর্তে সে নিজেকে দেখতে পারে: বিছানায় শুয়ে আছে, রান্নাঘরে বসে খাচ্ছে, বসার ঘরে টেলিভিশনে প্রামাণ্যচিত্র দেখছে, বাথরুমে যাচ্ছে – সবকিছু সে সম্পূর্ণ নিজে নিজে করছে । অথচ সবাই তার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ।]
দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি
আমার মধ্যে ঘটে যাওয়া সবকিছু আমি সারাহকে বলেছি । জবাবে সে বলেছে যে, উপন্যাসটি আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে উন্মত্ত করে তুলেছে । একসময় সে ওটাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় এবং পরিহাসের ভঙ্গিতে আমি দীর্ঘক্ষণ প্রচন্ড হেসে তাকে থামিয়েছি । অবশেষে সে উপন্যাসটি নামিয়ে রাখে ।
যদিও প্রতিবেশিদের দেখতে আমাদের প্রতিবেশিদের মতো লাগুক বা না-লাগুক, এবং বিভিন্ন ঠিকানায় আসা পানি, টেলিফোন, বিদ্যুৎ এবং বাড়ি ভাড়া আমি যথারীতি পরিশোধ করে যাচ্ছি, তারপরও নিরাপত্তার আতঙ্কে পরিস্থিতি শান্ত করা ছাড়া আমার অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না ।
আমি শুধু অপেক্ষায় ছিলাম কেউ এসে আমাকে বলবে, ‘দুঃখিত, স্যার, আপনি অন্য দেশে আছেন ।’
বিভ্রান্তি
একটা কাগজে সে তার নাম-ঠিকানা লিখেছে এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে যে, যেখানে যাবে, সেখানেই কাগজটা নিয়ে যাবে । তাহলে সে আগামিতে কখনো হারিয়ে যাবে না । একদিন এক যুবকের হাতে সে কাগজটা তুলে দেয় যেন যুবকটি তাকে বাড়ি ফেরার পথ দেখিয়ে দিতে পারে । যুবকটি তাকে কবরস্থানে যাওয়া পথ দেখিয়ে দেয় ।
সে কবরস্থানে যায় ।
কবরের ভেতর থেকে মৃতরা সবাই উঠে আসে । তাদের সবার হাতে কাগজ এবং কাগজে তাদের ফেলে আসা বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে । এছাড়া প্রিয়জনকে দেওয়ার জন্য তাদের হাতে রয়েছে চিঠি।
চিঠির গায়ে ঠিকানা যেহেতু স্পষ্ট করে লেখা ছিল, তাই ওগুলো প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতে তার বেশি সময় লাগেনি ।
কিন্তু একটা চিঠি প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছানো বাকি ছিল । সে বাড়ির দরজায় টোকা দেওয়ার সময় উপলব্ধি করে যে, চিঠির ওপর ঠিকানা তার নিজের হাতে লেখা ।
তার মতো আদলের একজন লোক এসে দরজা খোলে । যেই পান্ডুলিপি নিয়ে সে কাজ করছিল, সেই একই পান্ডুলিপি নিয়ে দ্বৈত লোকটি কাজ করছে ।
সদৃশ্য লোকটি বললো, ‘দুঃখিত, স্যার ...’
আপনি এই দুনিয়ার কেউ না ।

পুতুল
সারাহ্ বলেছে, সে জানতো না শিশু বয়সে বিছানায় যাওয়ার মুহূর্তে কোথায় তার পুতুল রাখার কথা ছিল । সুতরাং সেই রাতে তার মা কি বলেছিলেন, তা মনে পড়ার কথা না । মা বলেছিলেন, ‘এই পুতুলটা তুমি । সুতরাং এমন কোথাও রেখ না যেখানে তুমি থাকতে চাও না ।’
সারাহ্ পাঁচ-তলা দালানের জানালা দিয়ে পুতুল ফেলে দেয় ।
আমি দালানে ঢোকার প্রবেশ পথে বসেছিলাম এবং অসংখ্য চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ডুবেছিলাম । ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ভারি কিছু মাটিতে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছি ।
ভারি কিছু ছিল সারাহ্ । সারাহর রক্তে কালো পীচ সয়লার হয়ে গেছে এবং তার মাথার মগজ উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বিঁধে আছে । আমি জানি, সারার মস্তিস্ক; ওগুলো কখনই উড়ে যাওয়া থামাতে পারেনি ।
কিন্তু – ভারি বস্তুটি সত্যি কী সে-ই ছিল?
শেষ বার আমি যখন পাঁচ তলায় গিয়েছিলাম, তখন মনে হয়নি আমি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি? আসলে সেই মুহর্তে নয়, যখন সে টেলিফোনে আমাকে বলেছে, ‘আমার সঙ্গে তোমার মা আছেন ।’
‘আমার মা?’
মা আমাকে তার তত্ত্বাবধানে রেখে চলে যেতেন । মা বলেছিলেন যে, সে নাকি দেখতে পুতুলের মতো ।
একসময় তিনি টেলিফোন নামিয়ে রাখেন । আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই । তারপর আমি বৈঠকখানায় যাই (সেই মুহূর্তে আমার মধ্যে কারোর দেহ ছিল) । একমাত্র কফি টেবিলের পাশে বসা পুতুলটা আমি পেয়েছি ।
তাকে দেখতে অনেকটা আমার মায়ের মতো ।
লাশটা যে তার নয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে আমি দৌঁড়ে পাঁচ তলায় উঠি ।
সে-টা ছিল একটা স্বপ্ন । উড়ে যাওয়ার মতো দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে আমি উপরে যাই । যাওয়ার সময় আমার মধ্যে কোনো ধরনের উৎফুল্লতা অনুভব করিনি । উপরে উঠে আমি বৈঠকখানায় পুতুলটি পড়ে থাকতে দেখেছি । পুতুলটি দেখতে অনেকটা সারাহর মতো ।

একটি গল্প
একটি গল্প আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । যদিও প্রত্যাশা করেছিলাম, কিন্তু তারপরও আমি তাকে উপেক্ষা করি ।
আমি ভণিতা করি যে,
আমার গোসল করা জরুরী
গোসলের পরে গায়ে সুগন্ধি লাগাতে হবে
বরফের মধ্যে উষ্ণতা গলিয়ে কিছু একটা পান করতে হবে
গান শুনতে হবে, যে গান বাদ্যযন্ত্রের তার থেকে পালিয়ে গেছে
ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে হবে –
তারপর ... এখন কী ? আমি বিস্মিত ।
একসময় আমি দরজা খুলি এবং বেওয়ারিশ স্তুপের মাঝে গল্পকে খুঁজে পাই । আমার দিকে সে নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে:
‘এখন আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি কেন আমাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছো এবং তোমার উপন্যাসের জন্য বেশি সময় ব্যয় করছো । তুমি ভালোই আছো ।’
আমি সিঁড়িতে গল্পকে ধাওয়া করি । সে গড়িয়ে পড়ে যায় এবং পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলে ।
আমি এখন দিনের বাকিটুকু সময় শব্দের হাসপাতালে কাটিয়ে দিব ।

গল্পসূত্র: ‘টেলিফোন’, ‘দরজা’, ‘পুতুল’ এবং ‘একটি গল্প’ গল্প চারটি আব্দেররাযাক বুকেবার ইংরেজিতে যথাক্রমে ‘দ্য ফোন’, ‘দ্য ডোর’, ‘দ্য ডল’ এবং ‘দ্য স্টোরি’ গল্পের অনুবাদ । গল্পগুলো আরবী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যাডাম তালিব । গল্পগুলো ‘আরব ফিকশন’ ম্যাগাজিনের এগারোতম সংখ্যায় (২০১৬ সালের পহেলা এপ্রিল) প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে ।
0 মন্তব্যসমূহ