১৮৬৩ সালের গ্রীষ্ম আসার পর থেকে, দক্ষিণের মানুষদের হৃদয়ে আবার আশার আলো জ্বলতে শুরু করল। অসহ্য দুঃখকষ্টের মধ্যেও, কালোবাজারীদের উৎপাতে খাদ্যশস্যের স্বল্পতা, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের অসহযোগিতা, মৃত্যু, মহামারী সত্ত্বেও – যা এখন প্রত্যেক পরিবারকেই নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে – দক্ষিণের লোকেরা আবার বলতে শুরু করেছে, “আর একটা জয় হলেই যুদ্ধ শেষ”। গত বছরের থেকে আরও অনেক বেশি আশা নিয়েই বলছে। ইয়াঙ্কিরা অপ্রতিরোধ্য ছিল, কিন্তু অবশেষে ওদের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করেছে।
১৮৬২ সালের বড়দিনের সময় আটলান্টা আর দক্ষিণের মানুষদের খুব সুখের সময়। ফ্রেডরিক্সবার্গে কনফেডারেটদের দূর্দান্ত জয়ে হাজার হাজার ইয়াঙ্কি মারা গেছিল কিংবা ঘায়েল হয়েছিল। সেই ছুটির মরশুমে সবাই উৎসবে মেতে উঠেছিল – আবার ঘুরে দাঁড়ানোর আনন্দে। সেদিনের আনাড়ি ছেলেরা এখন পাকা সৈনিক, যুদ্ধ যাঁরা পরিচালনা করছিলেন তাঁরা সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, আর সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল, বসন্তে আবার যখন যুদ্ধ শুরু হবে তখন ইয়াঙ্কিদের চিরতরে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
বসন্ত এল, যুদ্ধ আবার শুরু হল। মে মাসে আবার কনফেডারেসি চ্যান্সেলর্সভিলে জয়ী হল। জয়ের উল্লাসে পুরো দক্ষিণ উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে গেল।
ঘরের কাছাকাছি ইউনিয়নের অশ্বারোহীবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে কনফেডারেটদের বিজয় হল। এখনও একে অন্যের পিঠ চাপড়ে ওরা হাসাহাসি করে, “হ্যা মশাই, বুড়ো নাথান বেডফোর্ড ফরেস্ট যখন ওদের তাড়া করলেন, তখন ব্যাটারা প্রাণ হাতে করে পালাতে পথ পায় না!” এপ্রিলের শেষের দিকে, কর্নেল স্ট্রেইটের নেতৃত্বে আঠারশো অশ্বারোহীর এক বাহিনী জর্জিয়ার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাল। ওদের উচ্চাশা ছিল আটলান্টা আর টেনেসির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথের সংযোগকে উড়িয়ে দিয়ে আরও দক্ষিণে আটলান্টায় চলে আসবে যাতে সেখানকার কারখানাগুলো আর সামরিক ভাণ্ডারকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।
অসম্ভব চতুর আর সাহসী কৌশল – যেটাতে সফল হতে পারলে দক্ষিণ চুড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু বাদ সাধলেন ফরেস্ট। ওদের তুলনায় মাত্র এক তৃতীয়াংশ কিন্তু অত্যন্ত পারদর্শী অশ্বারোহী নিয়ে তিনি বিপক্ষ বাহিনীকে তাড়া করলেন – আর ওরা রোমে পৌঁছানোর আগেই দিনে রাতে নানাভাবে পর্যুদস্ত করে পুরো বাহিনীকে কব্জা করে ফেললেন!
চ্যান্সেলর্সভিলের জয়ের খবর আর এই খবর প্রায় একই সময়ে আটলান্টায় পৌঁছেছিল। সারা শহর আনন্দ আর বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল। চ্যান্সেলর্সভিলের জয় যদিও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তবুও স্ট্রেইটের হানাদারবাহিনীকে কব্জা করাতে ইয়াঙ্কিদের অবস্থা হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
“না মশাই, দয়া করে ফরেস্টকে ঘাঁটাবেন না,” মজা করে গল্পটা বারবার বলতে বলতে ঠাট্টা করত আটলান্টার লোকেরা।
দক্ষিণের পালে তখন সৌভাগ্যের জোয়ার এসেছে – আর তার ঢেউ মানুষজনকে আনন্দের প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এটা ঠিকই, গ্রান্টের নেতৃত্বে ইয়াঙ্কিরা ভিক্সবার্গকে মে মাস থেকে বেষ্টন করে রেখেছে। এটাও সত্যি যখন চ্যান্সেলর্সভিলে স্টোনওয়াল জ্যাকসন গুরুতরভাবে আহত হয়ে পরে মারা যান – যেটা দক্ষিণের পক্ষে হতাশাজনক লোকসান। ফ্রেড্রিক্সবার্গে জেনারেল টি আর আর কবের মৃত্যুতে জর্জিয়া তার সবথেকে সাহসী আর কৃতি সন্তানকে হারিয়েছে – এটাও সত্যি। কিন্তু ইয়াঙ্কিদের পক্ষে ফ্রেড্রিক্সবার্গ কিংবা চ্যান্সেলর্সভিলের মতন আরো একটা পরাজয় হজম করা খুব মুশিকিলের ব্যাপার হবে। তাই ওদের আত্মসমর্পণ করতে হবে আর তখনই এই নিষ্ঠুর যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একটা গুজব শোনা গেল – যদিও পরে যে সব ডাক এল তাতেও সেই গুজবের সমর্থন পাওয়া গেল – যে লী পেনসিলভানিয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছেন। মানে লী একেবারে শত্রুশিবিরে ঢুকে পড়েছেন!
আটলান্টা উত্তেজনায়, আনন্দে আর প্রতিহিংসা গ্রহণ করার তীব্র কামনায় ফেটে পড়ল। এবার ইয়াঙ্কিরা হাড়ে হাড়ে টের পাবে নিজেদের দেশে যুদ্ধ হলে কি হয়। এবার ওরা বুঝতে পারবে ফসলী জমিকে নষ্ট করে দিলে, ঘোড়া আর গবাদি পশু চুরি গেলে, বারী ঘর দোরে আগুন লেগে গেলে, বৃদ্ধ আর যুবকদের টেনে হিঁচড়ে বন্দী করলে আর নারী আর শিশুদের অনাহারে রাখলে কেমন লাগে!
মিসৌরি, কেনটাকি, টেনেসি আর ভার্জিনিয়াতে ইয়াঙ্কিরা কি করেছে সবাই জানে। এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত এইসব অধিকৃত জায়গাগুলোয় ইয়াঙ্কিরা যে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে সেটার ঘেন্নার সাথে বলে থাকে। টেনেসির পুব দিক থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু এসে আটলান্টায় ভরে গেছে – যে অত্যাচার আর যন্ত্রণা ওদের সহ্য করতে হয়েছে সে গল্প ওদের মুখ থেকেই সরাসরি সবাই শুনেছে। যে কোন সীমান্তবর্তী রাজ্যের মত ওই সব জায়গায় কনফেডারেটদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ কমই ছিল তাই যুদ্ধের কামড় এদের ওপর প্রবলভাবে পড়েছিল। প্রতিবেশী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে লাগিয়েছে, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হয়েছে। এইসব উদ্বাস্তুরা কামনা করছিল যেন পেনসিলভানিয়ার যাবতীয় সম্পদ আগুনে ধ্বংস হয়ে যাক – এমনকি অত্যন্ত মৃদুভাষী বয়ষ্ক মহিলারাও এতে মনে মনে আনন্দ পোষণ করতেন।
খবর পাওয়া গেল যে লী নির্দেশ জারি করেছেন কোনরকম ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত লাগানো যাবে না, লুটপাট করলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, আর সেনাবাহিনী প্রত্যেক দাবিকৃত জিনিষের মূল্য চুকিয়ে দেবে। সবাই লীকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করত তবু এই নির্দেশের ফলে সেই শ্রদ্ধার অনেকটাই ধুলোয় মিশে গেল। এমন সমৃদ্ধশালী রাজ্যের বড় বড় দোকানপাটের ওপর হাত লাগানো যাবে না! কি মনে করছেন জেনেরাল লী? আর আমাদের ছেলেদের পায়ে জুতো নেই, পোশাক নেই, ভাল ঘোড়া নেই; আধপেটা খেয়ে রয়েছে!
ডার্সি মীডের তাড়াহুড়ো করে লেখা একটা চিঠি থেকে এই ঘটনাপরম্পরা আটলান্টার মানুষ প্রথম জানতে পারল। হাতে হাতে ঘুরে এই চিঠি মানুষের মনে ক্রমাগত দ্বেষের সঞ্চার করল।
“বাপী, তুমি কি আমার জন্য একজোড়া বুটের বন্দোবস্ত করতে পার? দু’সপ্তাহ হতে চলল, আমি খালি পায়ে লড়াই করছি – আর নতুন বুট জোগাড় করার কোন সম্ভাবনা আমার নজরে আসছে না। যদি আমার পা দুটো এত বড় না হত, তাহলে হয়ত অন্যদের মত আমিও কোন মৃত ইয়াঙ্কির পায়ের থেকে বুট খুলে নিতে পারতাম। কিন্তু এত বড় পাওয়ালা ইয়াঙ্কি আমি একটাও পাইনি। যদি তুমি জোগাড় করতে পার, তাহলে কিন্তু ডাকে পাঠিও না। কেউ হয়ত সেটা চুরি করে নেবে – যদিও আমি তাকে দোষ দিতে পারব না। ফিলের হাতে ট্রেনে করে পাঠিয়ে দিও। কয়েকদিনের মধ্যেই জানাচ্ছি, আমরা কোথায় থাকব। এই মুহুর্তে ঠিক বলতে পারছি না। আমরা উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি শুধু এইটুকুই জানি। আমরা এখন মেরিল্যাণ্ডে – আর শুনতে পাচ্ছি আমরা পেনসিলভানিয়ায় যাচ্ছি ____
“বাপী আমরা ভেবেছিলাম ইয়াঙ্কিদের অন্যায়ের বদলা নেব, কিন্তু জেনারেল স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন সেটা হবে না। ব্যক্তিগতভাবে একটা ইয়াঙ্কির বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার আনন্দের জন্য আমাকে যদি গুলি করে মেরে ফেলা হয়, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আজ আমরা সর্বোত্তম শস্যখেতের মধ্য দিয়ে মার্চ করে যাচ্ছিলাম। আমাদের এলাকায় এরকম শস্য হয় না। স্বীকার করতেই হবে যে আমরা অল্প একটু লুটপাট করেছি, কারন আমরা সকলেই খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম, আর জেনারেল জানতে না পারলে তাঁকে বেদনাও দিতে পারবে না। কিন্তু ওই শ্যামল শস্য পেয়েও আমাদের কোন উপকার হল না। সব ছেলেই আমাশায় ভুগছিল, আর ওই শস্য ওদের অবস্থা আরও খারাপ করে দিল। কি বলব, পায়ে চোট নিয়ে তবে হাঁটা যায়, কিন্তু আমাশা নিয়ে নয়! বাপী তুমি যে করেই হোক আমার জন্য একজোড়া বুট জোগাড় কোরো। আমি এখন একজন ক্যাপটেন – আর ক্যাপটেনের নতুন পোশাক কিংবা কাঁধে লাগানোর জন্য এপলে থাক বা না থাক একজোড়া বুট থাকাটা খুব জরুরি।
কিন্তু সব থেকে বড় কথা হল, সেনাবাহিনী এখন পেনসিলভানিয়াতে। আর একটা বিজয়, তারপরই যুদ্ধ শেষ। তখন ডার্সি মীড যতজোড়া বুট চাইবে পেয়ে যাবে, আর ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে আসবে আর সবাই আবার আগের মত সুখী হয়ে যাবে। এই সব ভাবতে ভাবতে মিসেজ় মীডের চোখে জল এসে গেছিল। উনি কল্পনায় দেখতে পেলেন ওঁর সৈনিক ছেলে ঘরে ফিরে আসছে, থাকার জন্য।
জুলাই মাসের তিন তারিখে উত্তরদিক থেকে খবর আসা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল যেটা চলল চার তারিখ দুপুর পর্যন্ত। তখন থেকে নানারকম বিকৃত খবর অ্যাটলান্টার হেডকোয়ার্টারে এসে পৌঁছাতে লাগল। পেনসিলভানিয়ার একটা ছোট্ট শহর গেটিসবার্গের কাছে খুব কঠিন লড়াই হয়েছে। লীর সেনাবাহিনীর সেখানে প্রচণ্ড লড়াইএর সম্মুখীন হয়েছে। খুব অনিশ্চিত খবর – এলও অনেক দেরি করে। শত্রুপক্ষের এলাকায় যুদ্ধ। মেরিল্যাণ্ডের মাধ্যমে রিচমণ্ড হয়ে সব শেষে অ্যাটলান্টায় পৌঁছাল।
উদ্বেগজনক পরিস্থিতি – আস্তে আস্তে সারা শহরে একটা হতাশার ছায়া। কি ঘটছে সেটা না জানতে পারার থেকে উদ্বেগজনক আর কিছুই হতে পারে না। যে সমস্ত পরিবারের ছেলেরা সৈন্যবাহিনীতে ছিল তারা অসহায়ভাবে প্রার্থনা করতে লাগল যেন তাদের ছেলেরা পেনসিলভানিয়াতে না থাকে। কিন্তু যাঁদের নিশ্চিত জানা ছিল যে তাঁদের ছেলেরা ডার্সি মীডের বাহিনীতে রয়েছে, তাঁরা দাঁতে দাঁত চেপে নিজেদের প্রবোধ দিতে থাকল যে এত বড় লড়াইয়ে তারা অংশ নিতে পেরেছে, আর তারা নিশ্চয়ই ইয়াঙ্কিদের উচিত শিক্ষা দেবে।
আন্ট পিটির বাড়িতে তিনজন মহিলা কেউ কারও চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ওর ভালভাবেই জানত যে অ্যাশলে ডার্সি মীডের বাহিনীতেই আছে।
পাঁচ তারিখে খারাপ খবর এল – না উত্তরদিক থেকে নয়, পশ্চিম থেকে। সুদীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক অবরোধের পরে, ভিক্সবার্গের পতন হয়েছে – কার্যতঃ মিসিসিপি নদীর ধারে সেন্ট ল্যুইস থেকে নিউ অরলিয়েন্স পর্যন্ত পুরোটাই ইয়াঙ্কিদের দখলে চলে গেছে। কনফেডারেসি এলাকা এখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অন্য সময় হলে এই বিপর্যয়ের খবরে অ্যাটলান্টা আশঙ্কা আর হতাশায় ডুবে যেত। কিন্তু এই মুহুর্তে ওদের ভিক্সবার্গের কথা ভাববার সময় ছিল না। ওরা এখন পেনসিলভানিয়ায় লীর আক্রমণ করার কথাই ভাবছিল। ভিক্সবার্গের পতন সয়ে যাবে যদি লী পূর্বদিকে জয় হাসিল করতে পারেন। ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইয়র্ক আর ওয়াশিংটন এদিকেই পড়ে। এগুলো জয় করতে পারলে উত্তরদিককে বস্তুতঃ অকার্যকর করে দেওয়া যাবে যাতে করে মিসিসিপিতে পরাজয়কে নিষ্ফল করে দেওয়া যাবে।
ক্রমে ক্রমে বিপদের কালো মেঘ শহরের ওপর ছেয়ে গেল। তারপর হঠাৎ সকলে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল সেখানে দুর্যোগের কালো মেঘের বদলে সুন্দর নীলাকাশ আর সূর্যের উজ্জ্বল আলো। বাড়ির সামনের বারান্দায়, ফুটপাথে, এমনকি রাস্তার মাঝখানে দেখা গেল মেয়েরা জটলা করছে আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, কোন খবর যখন পাওয়া যাচ্ছেনা, তার মানে ভাল খবর ধরে নিতে হবে। সবাই সবাইকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছে, সবাই নিজেকে প্রত্যয়ী দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা জোর গুজব চারদিকে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে যে লী মারা গেছেন, যুদ্ধে পরাজয় হয়েছে, হতাহত ব্যক্তির তালিকা আসছে। যদিও কথাটা কারোরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না তবু একটা ভয় ছড়িয়ে পড়ল আর শহরে গিয়ে খবরের কাগজের অফিসে আর হেডকোয়ার্টারে খবর জানার চেষ্টা করতে লাগল – এমনকি খারাপ খবর হলেও।
খবরের আশায় মানুষজন রেলস্টেশনে এসে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত, টেলিগ্রাফ অফিস আর বিভ্রান্ত হেডকোয়ার্টারে এসে ভিড় জমাত। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে এলে আর কেউ যেতেই চাইত না, আর বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভিড় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেত। সবাই চুপ করেই থাকত। হয়ত কখনও কখনও কোন বৃদ্ধ ব্যক্তি অধৈর্য হয়ে নতুন খবর জানানোর জন্য মিনতি করতেন। এতে কোলাহল বাড়ার থেকে একটা আজব নিস্তব্ধতা ছেয়ে যেত যখন বার বার উচ্চারিত হওয়া ঘোষণা শুনতে পেত, “এখনও উত্তর থেকে টেলিগ্রামে ‘যুদ্ধ চলছে’ এছাড়া নতুন খবর কিছু আসেনি।” পায়ে হেঁটে আসা কিংবা গাড়িতে চড়ে আসা মহিলাদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বেড়ে যেতে লাগল। ভিড়ের গরমে আর পায়ের ধুলো উড়ে জায়গাটায় একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। মহিলারা কোন কথা বলতেন না, কিন্তু তাঁদের উদ্বিগ্ন আর বিষন্ন চোখে যে বার্তা ফুটে উঠত সেটা সশব্দ বিলাপের থেকেও বেশি বাঙ্ময়।
বলতে গেলে এমন কোন বাড়িই ছিল না যেখান থেকে কারও পুত্র, কারও ভাই, কারও বাবা, কারও স্বামী, কারও প্রেমিককে যুদ্ধে পাঠানো হয়নি। সবাই নিজের নিজের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা মৃত্যুরই আশঙ্কা করছিল, পরাজয়ের নয়। পরাজয়ের ভাবনা ওরা মনে স্থানই দেয়নি। হয়ত ওদের সেনারা পেনসিলভানিয়ার রৌদ্রশুষ্ক ঘাসের ওপর যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা পড়ছিল, যেমন ঝড়বৃষ্টিতে শস্যের দানা মাটিতে ঝরে পড়ে যায়। কিন্তু যে মহান উদ্দেশ্যের জন্য ওরা জীবন দিচ্ছে, সেটা কখনও পরাজিত হতে পারে না। হয়ত ওরা হাজারে হাজারে ভূপতিত হচ্ছে, কিন্তু ওদের জায়গা নেবার জন্য, অবিনশ্বর আত্মার মত হাজার হাজার নতুন সৈন্য – ধূসর আর বাটারনাট রঙের ইউনিফর্ম পরে আর মুখে বিদ্রোহের বুলি নিয়ে – আবার জেগে উঠছে। এই সব নতুন সৈন্য কোথা থেকে আসবে – কেউ জানেনা। ওরা শুধু জানে স্বর্গের ন্যায় এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ ঈশ্বরের মত লী অলৌকিক শক্তি ধরেন আর ভার্জিনিয়ার সৈন্যদল অপরাজেয়।
স্কারলেট, মেলানি আর মিস পিটিপ্যাট ওঁদের গাড়ির ছাউনি পেছনে সরিয়ে দিয়ে মাথা নিজেদের ছাতা দিয়ে আড়াল করে ‘ডেইলি এক্সামিনারের’ অফিসের সামনে বসেছিলেন। স্কারলেটের হাত এত কাঁপছিল যে ওর ছাতাটা মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিল। পিটি এত উদ্বিগ্ন ছিলেন যে ওঁর গোলগাল মুখের ওপর নাক ক্রমাগতই স্ফুরিত হয়ে খরগোশের মত আওয়াজ বেরোচ্ছিল। মেলানি পাথরের মূর্তির মত বসে ছিল। ওর কালো কালো চোখ, যত সময় যচ্ছিল, বিস্ফারিত হয়ে উঠছিল। দু’ঘন্টার মধ্যে ও একবারই মাত্র কথা বলেছিল – যখন ওর থলি থেকে স্মেলিং সল্টের শিশি বের করে আন্টির হাতে দিল – হয়ত সারা জীবনে এই প্রথম কোমলতা আর মমতা ছাড়া ও কিছু বলল।
“এটা ধর আন্টি – আর যদি মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে – তাহলে গন্ধ নিও। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি – তুমি অজ্ঞান হয়েছ কি আমি পত্রপাঠ আঙ্কল পীটারকে বলব তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। আমি এই জায়গা ছেড়ে নড়ব না যতক্ষণ না আমি জানতে পারি যে – যতক্ষণ না আমি কিছু জানতে পারি। আর আমি স্কারলেটকেও আমাকে ছেড়ে যেতে দেব না।”
স্কারলেটের মোটেই নড়বার ইচ্ছে ছিল না, ইচ্ছে ছিল না এমন কোন জায়গায় চলে যাবার যেখানে ও অ্যাশলের খবর প্রথমেই না পেতে পারে। মিস পিটি যদি মরেও যান, তবু ও এই হায়গা ছেড়ে যেতে পারবে না। অ্যাশলে কোথাও না কোথাও লড়াই করছে – হয়ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে – আর এই খবরের কাগজের অফিসই হচ্ছে একমাত্র জায়গা যেখানে ও সত্যিটা জানতে পারবে।
জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ও বন্ধু আর প্রতিবেশিদের চেনা মুখের খোঁজ করতে লাগল। মিসেজ় মীড – মাথায় একটু তেরচাভাবে বনেটটা পরে, পনেরো বছরের ফিলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে; মিস ম্যাকলিয়োরেরা ওদের গজদন্ত কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে চলেছে; মিসেজ় এলসিং একজন কষ্টসহিষ্ণু মায়ের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপালের ওপর এস পড়া চুলের গোছা সরাতে গিয়ে মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলছেন, ফ্যানি এলসিং তাঁর পাশে ভয়ে সাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। (ফ্যানি নিশ্চয়ই ওর ভাই হিউএর জন্য চিন্তিত নয়। তবে কি সেনাবাহিনীতে ওর সত্যিকারের কোন প্রেমিক আছে যেটা কেউ ধরতে পারেনি?) মিসেজ় মেরিওয়েদার তাঁর গাড়িতে বসে মেবেলের হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মেবেল যে অন্তঃসত্ত্বা সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এই সময় ওর জনসমক্ষে আসার কথা নয়, এমনকি ভাল করে শাল দিয়ে আড়াল করা থাকলেও। কিন্তু ওর এত চিন্তা করার কি কারণ থাকতে পারে? ল্যুইসিয়ানার ট্রুপও পেনসিলভানিয়াতে গেছে এরকম কথা তো শোনা যায়নি। খুব সম্ভব ওর খুদে লোমশ জ়ুয়েভ এই মুহুর্তে রিচমণ্ডে নিরাপদেই রয়েছে।
জনসমুদ্রের প্রান্তসীমানায় হঠাৎ একটা নড়াচড়া দেখা গেল। যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা রেট বাটলারকে জায়গা ছেড়ে দিল। উনি সাবধানে ওঁর ঘোড়াকে চালিয়ে আন্ট পিটির গাড়ির কাছে চলে এলেন। স্কারলেট মনে মনে ভাবলঃ মানুষটার সাহস আছে, কারন এই সময়ে ইউনিফর্ম ছাড়া কাউকে দেখলে উত্তেজিত জনতা তাঁকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে। যত উনি কাছে এগিয়ে আসতে লাগলেন ওর মনে হল ওই সর্বপ্রথম ওঁকে আঘাত করতে পারে। যখন অ্যাশলে আর অন্যান্যরা অভুক্ত অবস্থায়, গরমের মধ্যে, অসুস্থ শরীরে ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে প্রাণপন লড়াই করতে ব্যস্ত, তখন উনি কোন আক্কেলে একটা সুন্দর ঘোড়ায় চড়ে, চকচকে বুট আর দামী সাদা লিনেনের স্যুট পরে, এমন মজবুত আর পুষ্ট চেহারা নিয়ে, দামী চুরুট খেতে খেতে আসতে পারেন!
সংবাদদাতাদের মধ্যে দিয়ে উনি যখন এগিয়ে আসছিলেন তখন সকলে তাঁর দিকে তিক্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছিল। বয়স্ক লোকেরা গজগজ করতে লাগলেন। মিসেজ় মেরিওয়েদার, যিনি কাউকেই পরোয়া করেন না, নিজের গাড়িতে সামান্য দাঁড়িয়ে বেশ জোর গলায় বললেন, “ফাটকাবাজ!” তাঁর কণ্ঠস্বরের বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণার ভাব সকলেই আন্দাজ করতে পারল। উনি সেগুলো গায়ে না মেখে ঘোড়া নিয়ে স্কারলেটের পাশে এসে মেলি আর আন্ট পিটিকে ‘বাও’ করলেন। তারপর ফিসফিস করে স্কারলেটকে বললেন, “তোমার মনে হয় না এখন ডঃ মীডের এসে ভাষণ দিয়ে বলার দরকার যে আমাদের ঝাণ্ডার তলায় আমরা জয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছি?”
উদ্বেগে টান টান অবস্থায় স্কারলেট হিংস্র বেড়ালের মত ওঁর দিকে ফিরে ও ক্রুদ্ধস্বরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিনত উনি হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বলে বলতে লাগলেন,
“ভদ্রমহোদয়াগণ, আমি এইমাত্র হেডকোয়ার্টার থেকে খবর পেয়েছি যে শীঘ্রই হতাহতের প্রথম তালিকা আসতে চলেছে।
যারা ওঁর কথা শুনতে পেয়েছে, তাদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। জনতার মধ্যে আবার একটা নড়াচড়া দেখা গেল – সবাই হোয়াটহল স্ট্রীটে হেডকোয়ার্টারের দিকে ছুটতে লাগল।
“আপনারা যাবেন না,” উনি চেঁচিয়ে বললেন। “ তালিকাটা দুটো খবরের কাগজেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা এখন ছাপা হচ্ছে। আপনারা যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন।”
“ওহ ক্যাপটেন বাটলার!” মেলি চোখে জল নিয়ে বলল। “”খবরটা আমাদের জানিয়ে আপনি অত্যন্ত মহানুভবতার কাজ করেছেন! খবরটা কখন জানা যাবে?”
“যে কোন মুহুর্তেই ওটা জানা যেতে পারে, মহাশয়া। প্রায় আধ ঘন্টা হল, রিপোর্টটা চলে এসেছে। যে মেজর এর দায়িত্বে রয়েছেন, তিনি ছাপা না হওয়া পর্যন্ত রিপোর্টটা প্রকাশ করতে চাইছেন না। উনি ভয় পাচ্ছিলেন, খবরটা জানাজানি হলে হয়ত জনতা কাগজের অফিসে ভেঙ্গে পড়বে। আহ! এই তো!”
খবরের কাগজের অফিসের পাশের দিকের একটা জানলা খুলে একটা হাত বেরিয়ে এল। একতাড়া কাগজ – তাতে সদ্য ছাপা ঘেঁষাঘেঁষি করে অনেক নামের একটা তালিকা। জনতা হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো নেবার জন্য হুড়োহুড়ি করতে থাকল। কোন কোন কাগজ টানতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল। যারা পেয়ে গেল, তারা ভিড়ের বাইরে গিয়ে নাম খুঁজতে থাকল। যারা পায়নি তারা তাদের পাশে গিয়ে বলতে লাগল, “একবার আমাকে দেখতে দিন!”
“একটু লাগামটা ধর,” আঙ্কল পীটারের হাতে লাগামটা ধরিয়ে দিয়ে রেট বাটলার ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। ওরা দেখল উনি দীর্ঘ শরীর নিয়ে দুহাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন। অল্প ক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন পাঁচ ছ’খানা কাগজ নিয়ে। একটা উনি মেলানির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বাকি গুলো অন্য মহিলাদের – ম্যাকলিয়োর বোন্দের, মিসেজ় মীড, মিসেজ় মেরিওয়েদার আর মিসেজ় এলসিংকে দিয়ে দিলেন।
“তাড়াতাড়ি মেলি,” স্কারলেট বলে উঠল। ওর বুক ধুকপুক করছে। তারপর দেখল মেলির হাত কাঁপছে বলে কিছু পড়াই সম্ভব হচ্ছে না।
“তুমিই নাও,” মেলি বিড়বিড় করে বলল। স্কারলেট সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিল। “W” দিয়ে শুরু নাম – কোথায়? ওঃ একেবারে তলায় – একদম ধেবড়ে গেছে। “হোয়াইট” ... ও কাঁপা গলায় পড়ে চলল .... “উইল্কেন্স ... উইন ... জ়েবুলন ... ওহ মেলি, ওর নাম নেই। এই তালিকায় ওর নাম নেই! হে ভগবান ... আন্টি – মেলি, সল্টটা নাকের কাছে ধর! মেলি আন্টিকে তুলে ধর!”
মেলি আনন্দের চোটে কাঁদতে কাঁদতে আন্ট পিটির মাথাটা তুলে ধরে নাকের সামনে স্মেলিং সল্টের শিশিটা ধরল। স্কারলেট অন্য দিক থেকে ভদ্রমহিলার স্থূল শরীরটা ধরে রাখল। মনে ওর খুব আনন্দ। অ্যাশলে বেঁচে আছে। এমনকি ওর কোন চোটও লাগেনি। ভগবান কত দয়ালু – ওর কোন ক্ষতি করেননি। কত ___”
একটা মৃদু কান্নার আওয়াজ পেয়ে ও ঘাড় ঘোরাল। দেখল ফ্যানি এলসিং মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। দেখল হতাহতের তালিকাটা ওদের গাড়ির মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেয়েকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে কোচোয়ানকে নির্দেশ দিলেন, “বাড়ি চল। তাড়াতাড়ি।” স্কারলেট হতাহতের তালিকায় একবার তাড়াতাড়ি চোখ বোলাল। হিউ এলসিং-এর নাম নেই। ফ্যানির নিশ্চয়ই কোন প্রেমিক ছিল, আর সে মারা গেছে। জমায়েতের মানুষজন খুব সহানুভূতি দেখিয়ে এলসিংদের গাড়িকে বেরিয়ে যেতে দেবার জন্য সরে দাঁড়াল। তার পেছন পেছন ম্যাকলিয়োরদের খচ্চরে টানা ছোট গাড়িটা বেরিয়ে গেল। মিস ফেথ চালাচ্ছি। চোখমুখ পাথরের মত কঠিন। এই প্রথম ওর দাতগুলো ঠোঁট দিয়ে ঢাকা। মিস হোপ বোনের স্কার্টের প্রান্ত শক্ত করে ধরে ওর পাশে – নির্বাক নিস্পন্দ – সোজা হয়ে বসে আছে। ওদের খুব বয়স্ক মহিলা বলে মনে হচ্ছিল। ছোট ভাই ডালাস ওদের চোখের মণি ছিল। এই দুই অবিবাহিত মহিলার তিনকুলে আর কেউ নেই। ডালাস আর নেই।
“মেলি! মেলি!” মেবেল খুশি মনে চেঁচিয়ে উঠল। “রেনে নিরাপদে আছে! অ্যাশলেও! ভগবানকে রক্ষা করেছেন!” শালটা ওর কাঁধ থেকে পড়ে গেল। স্পবাই ওর অবস্থাটা দেখতে পেল। কিন্তু এই প্রথম না মিসেজ় মেরিওয়েদার না ফ্যানি এতে ভ্রুক্ষেপ করল। “ওহ, মিসেজ় মীড! রেনে ___” ওর গলার স্বর পালটে গেল হঠাৎ। “মেলি, দেখ! – মিসেজ় মীড, তাহলে কি ডার্সি ___?”
মিসেজ় মীড কোলের দিকে চোখ নামিয়ে রেখেছিলেন। ওঁর নাম ধরে ডাকা সত্ত্বেও উনি মুখ তুললেন না। পাশে কিশোর ফিলের মুখ দেখে সবাই বুঝতে পেরে গেল।
“মা মা – ওই দেখ,” ও খুব অসহায় ভাবে বলল। মিসেজ় মীড মুখ তুলে মেলানির দিকে তাকালেন।
“ওই বুটজোড়া আর ওর লাগবে না,” উনি বললেন।
“হে ভগবান!” মেলি কেঁদে উঠে আন্ট পিটির ভার স্কারলেটের কাঁধের ওপর ঠেলে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ডাক্তারের স্ত্রীর কাছে চলল।
“মা, আমি তো এখনও আছি,” ফিল বলল। মাকে প্রবোধ দেবার জন্য। “তুমি যদি আমাকে শুধু একবার যেতে দাও, আমি সবকটা ইয়াঙ্কিকে মেরে ____”
মিসেজ় মীড শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরলেন, যেন উনি কিছুতেই ওকে যেতে দেবেন না, তারপর ভাঙ্গা গলায় বললেন, “না!”
“ফিল মীড, চুপ কর!” মেলানি চাপা গলায় বলল। মিসেজ় মীডের পাশে বসে ওঁকে জড়িয়ে ধরল। “তোমার কি মনে হয় তুমি ওখানে গিয়ে গুলি খেলে তোমার মার ভাল লাগবে? বোকার মত কথা বোলো না। আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে চল।”
ফিল লাগামটা ধরতেই স্কারলেটের দিকে তাকাল।
“আন্টিকে বাড়িতে রেখেই তুমি মিসেজ় মীডদের বাড়ি চলে এস। ক্যাপটেন বাটলার, আপনি একটু ডঃ মীডকে খবর দিতে পারবেন? উনি হাসপাতালে আছেন।”
ভিড়ের মধ্য দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। কোন কোন মহিলার চোখে আনন্দাশ্রু, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই কত মারাত্মক আঘাত ওদের ওপর নেমে এসেছে বুঝতে পেরে একেবারে হতবাক। স্কারলেট তালিকাটা খুঁটিয়ে পড়ে বন্ধু আর পরিচিতদের নাম দেখছিল। অ্যাশলে ভাল আছে জানার পর ও অন্যান্যদের কথাও ভাববার সময় পেল। কি লম্বা তালিকা! আর সমগ্র জর্জিয়ার মধ্যে অ্যাটলান্টার হতাহতের সংখ্যাই সর্বাধিক!
হে ভগবান! ক্যাল্ভার্ট – রাইফোর্ড, লেফটেন্যান্ট।” রাইফ! স্কারলেটের মনে পড়ে গেল – ওরা দুজনে – অনেকেদিন আগে – একসাথে পালিয়ে গেছিল। কিন্তু রাত্রে দুজনেই ঠিক করল ফিরে আসবে – কারণ ওদের খুব খিদে পেয়েছিল – আর অন্ধকারেও ভয় করছিল।
“ফোনটেন – জোসেফ কে, প্রাইভেট,” ছোট্টখাট্টো বদমেজাজি জো! আর স্যালি ক’দিন আগে ওর বাচ্চার জন্ম দিয়েছে!
“মুনরো – লেফ্যাট, ক্যাপ্টেন!” লেফ তো ক্যাথলীন ক্যালভার্টের কাছে বাগদত্ত ছিল! বেচারা ক্যাথলীন! ওর দুদিক দিয়ে ক্ষতি হল। ভাই – আর প্রেমিক! কিন্তু স্যালির ক্ষতি আরও বেশি – ভাই – আর স্বামী!
খুব ভয়ানক। আর পড়বার সাহস হচ্ছিল না। আন্ট পিটি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন আর মড়াচড়া করছিলেন। খুব কায়দা করে স্কারলেট ওঁকে গাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল, তারপর আবার পড়তে শুরু করল।
“টার্লটন” এই নামটা নিশ্চয়ই তিনবার এই তালিকায় থাকার কথা নয়। নিশ্চয়ই তাড়াহুড়োয় তিনবার ছেপে দিয়েছে! না কিন্তু তা তো নয়! এই তো – “টার্লটন – ব্রেন্টন, লেফটেন্যান্ট” “টার্লটন – স্টুয়ার্ট, কর্পোরাল” “টার্লটন – টমাস, প্রাইভেট”। আর বয়েড তো যুদ্ধের প্রথম বছরেই মারা গেছে – আর কে জানে ভার্জিনিয়ার কোথায় ওকে কবর দেওয়া হয়েছে! টার্লটন্দের সব ভাইরাই চলে গেল! টম আর ওর লম্বা ঠ্যাঙ ওয়ালা দুই যমজ ভাইয়ের আড্ডাবাজ স্বভাব আর বয়েড যার নৃত্যকুশলতার সাথে সাথে ছিল গায়ে জ্বালা ধরা কথাবার্তা।
আর পড়তে পারল না। ভয় হল আরও এরকম কেউ যাদের সঙ্গে ও বড় হয়ে উঠেছে, নেচেছে, ফষ্টিনষ্টি করেছে, চুমু খেয়েছে, তাদের নামও যদি এই তালিকায় থাকে! একটু যদি কেঁদে নিতে পারত তাহলে বুকের মধ্যে যে চাপ তৈরি হয়েছে সেটা একটু হাল্কা হতে পারত।
“স্কারলেট, আমি খুব দুঃখিত,” রেট বাটলার বললেন। ও চোখ তুলল। ভুলেই গেছিল যে উনি এখনও ওখানেই আছেন। “অনেকেই তোমার বন্ধু, তাই না!”
মাথা নাড়ল, তারপর বিষন্নস্বরে বলল, “কাউন্টির প্রায় সব পরিবারেই – সবাই – টার্ল্টনদের তিন ভাইও।”
উনি খুবই গম্ভীর – নিরানন্দময় মুখ – চোখের কোনে কোন চটুলতার ঝিলিক নেই।
“কিন্তু এটাই শেষ নয়,” উনি বললেন, “এটা তো কেবল প্রথম তালিকা। অসম্পূর্ণ। কাল আরও লম্বা তালিকা আসবে।” তারপরে গলা আরও নামিয়ে নিয়ে – যাতে আশেপাশে কেউ শুনতে না পায় – বললেন, “আমি শুনতে পেয়েছি যে জেনারাল লী পরাজিত হয়েছেন। হেডকোয়ার্টারের থেকে জানতে পারলাম তিনি পশ্চাদাপসরণ করে মেরিল্যাণ্ডে আশ্রয় নিয়েছেন।”
ভয়ার্ত চোখ মেলে ওঁর দিকে তাকাল – যদিও ওর ভয়ের কারণ লীর পরাজয় নয়। আরও লম্বা হতাহতের তালিকা আসবে কাল! কালকের কথা তো মোটেই ভাবেনি। আজকের তালিকায় অ্যাশলের নাম দেখেই ও খুব আনন্দে ভেসে গেছিল! আবার আগামীকাল! তার মানে এই মুহুর্তে ও হয়ত বেঁচেই নেই – কিন্তু কালকের আগে কিছুই জানা যাবে না!
“বলুন, রেট, এই যুদ্ধ হওয়ার কি এমন দরকার ছিল? এর থেকে তো ইয়াঙ্কিরা ক্রীতদাসদের কিনে নিতেই পারত, কিংবা আমরাই বিনে পয়সায় ওদের দিয়ে দিলেই বেশি ভাল হত!”
“ক্রীতদাসটা ব্যাপার নয়, স্কারলেট। ওটা তো শুধুমাত্র একটা বাহানা। যদ্ধ সব সময় হবে – কারণ মানুষ যুদ্ধ করতে ভালবাসে। না মেয়েরা নয় – ছেলেরা ভালবাসে। মেয়েদের ভালবাসাকে হেলা করে।
উনি একটু বাঁকা হাসলেন। ওঁর গাম্ভীর্য উধাও। ওঁর পানামা টুপিটা একটু তুলে নিলেন।
“এখন আসি। আমি ডঃ মীডের খোঁজে যাচ্ছি। হয়ত এই মুহুর্তে আমি ওঁর ছেলের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে যাচ্ছি সেটা খেয়াল করবেন না। কিন্তু পরে উনি হয়ত ঘৃণাভরে ভাববেন যে শেষমেশ একজন ফাটকাবাজ কিনা বীরের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছিল!”
স্কারলেট মিসেজ় পিটিকে একটা টনিক খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রিসি আর কুকিকে ওঁর দিকে নজর রাখতে বলে, রাস্তার ওপারে মীডদের বাড়ি গেল। মিসেজ় মীড ফিলকে নিয়ে দোতলায় ডঃ মীডের ফেরার প্রতীক্ষা করছিলেন। মেলানি বসার ঘরে বসে মৃদুকণ্ঠে কিছু সমবেদী প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলছিল। ছুঁচ-সুতো আর কাঁচি দিয়ে ও একটা শোকের পোশাকের রদবদল করছিল। মিসেজ় এলসিং মিসেজ় মীডকে ওটা পরবার জন্য দিয়েছেন। বাড়িতে তৈরি কালো রঙে ছোপানোর জন্য কাপড়চোপড় ফুটন্ত জলে সেদ্ধ করার ঝাঁজালো গন্ধ ঘরময়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রাঁধুনি একটা বড় গামলার মধ্যে মিসেজ় মীডের সমস্ত পোশাক একটা বড় লাঠি দিয়ে নাড়ছিল।
“কেমন আছেন উনি?” স্কারলেট খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল।
“চোখ থেকে জল পড়ছে না,” বলল মেলানি। “যখন কোন মহিলা কাঁদতেও পারেন না, সে বড় মর্মান্তিক! ছেলেরা কেমন করে যে না কেঁদে সব সহ্য করে, জানিনা! মনে হয় মেয়েদের থেকে ওরা অনেক বেশি সবল আর সাহসী হয়। উনি বলছেন পেনসিলভানিয়া গিয়ে নিজে ওকে বাড়ি নিয়ে আসবেন। ডাক্তারবাবুর তো হাসপাতাল ছেড়ে যাবার উপায় নেই।”
“সেটাতো ওঁর পক্ষে খুবই বেদনাদায়ক হবে। ফিল তো যেতে পারে?”
“ওঁর ভয়, চোখের আড়াল হলেই ও গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেবে। তুমি তো জানোই বয়সের তুলনায়, ও অনেক বড়সড়। আর এখন তো ষোল বছর হলেই নিয়ে নিচ্ছে।”
আস্তে আস্তে সব প্রতিবেশীই চলে গেলেন। ওঁরা কেউই ডাক্তারবাবুর সম্মুখীন হতে চাইছেন না। মেলানি আর স্কারলেট একলা বসে সেলাইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেলানিকে খুবই বিষন্ন কিন্তু শান্ত লাগছিল, যদিও অনবরত চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে হাতের পোশাকটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। এখনও যে যুদ্ধ চলছে আর অ্যাশলে মারা গিয়েও থাকতে পারে – এ ভাবনা খুব সম্ভব ওর মাথায় আসেনি। ব্যাকুল হয়ে স্কারলেট ভাবতে থাকল যে রেটের কথাগুলো বলে ও মেলানিকে ওর দুশ্চিন্তায় শামিল করে নেবে কিনা, না নিজের মধ্যেই রেখে দেবে। শেষে ঠিক করল যে এখন কিছু না বলাই ভাল। ও যে কতটা উদ্বিগ্ন সেটা মেলানিকে জানতে না দেওয়াই ভাল। মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিল যে মেলানি আর পিটি নিজেদের দুশ্চিন্তায় এতই মগ্ন ছিলেন যে ওর ভাবান্ত লক্ষ্য করতে পারেন নি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সেলাই করে যাবার পর ওর ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেল। পর্দার ফাঁক দিয়ে ডঃ মীডকে ঘোড়া থেকে নামতে দেখল। কাঁধ ঝুলে পড়েছে, মাথা নীচু, সাদা দাড়ি বুকের ওপর লেগে ছড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে টুপী আর ব্যাগ নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে মেয়ে দুজনের মস্তক চুম্বন করলেন। তারপর ক্লান্ত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন। একটু বাদে লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে জবুথবুভাবে ফিল নীচে নেমে এল। মেয়ে দুজন ভাবল হয়ত ওদের ডেকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু ও কোন কথা না বলে বারান্দায় গিয়ে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। দুহাতের তালুর ওপর মাথা নামিয়ে দিল।
মেলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে দেওয়া হবে না বলে ওর অভিমান হয়েছে। ওর বয়স মাত্র পনেরো! সত্যি স্কারলেট এরকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা!”
“আর তারপর যুদ্ধে গিয়ে মারা যেতে দেওয়া!” স্কারলেট ডার্সির পরিণতির কথা ভেবে বলল।
“ছেলে না থাকার থেকে, সে যদি যুদ্ধে গিয়ে মারা যায় সেটাও ভাল,” বলে মেলানি ঢোঁক গিলল। “তুমি বুঝতে পারবে না স্কারলেট – তোমার তো ওয়েড আছে না। কিন্তু আমি – ওহ স্কারলেট – আমি একটা বাচ্চা চাই! তুমি হয়ত ভাববে আমি কিরকম নির্লজ্জের মত বললাম – কিন্তু আমি সত্যি বলছি – আর সব মেয়েই যেটা চেয়ে থাকে – তুমি তো জানোই।”
স্কারলেট নাক সিঁটকাতে গিয়েও নিজেকে দমন করে নিল।
“ধর যদি ভগবান অ্যাশলেকে নিয়ে নেন – সেটাও আমি সহ্য করতে পারব – যদিও ও না থাকলে আমারও বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছেই নেই! কিন্তু ভগবান আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা দেবেন! কিন্তু ওর কোন সন্তান না থাকলে – ও চলে গেলে আমার কোন সান্ত্বনাই থাকবে না! ওহ স্কারলেট – তোমার কত ভাগ্য! চার্লি না থাকলেও ওর সন্তান তো তোমার আছে! অ্যাশলে চলে গেলে আমার কিছুই থাকবে না! কিছু মনে কোরো না স্কারলেট আমি কতদিন এই নিয়ে তোমাকে কত হিংসা করেছি ___”
“হিংসে করেছ – আমাকে?” স্কারলেটের অপরাধবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই ও বলে ফেলল।
“কারণ তোমার একটা ছেলে আছে – আমার কিছুই নেই! মাঝে মাঝে আমি এমনও মনে করেছি ওয়েড আমারই ছেলে! সন্তান না থাকার ভাবনাটা এতটাই আমাকে বিষন্ন করে তোলে!”
“হায় কপাল,” স্কারলেট খুব স্বস্তির সঙ্গে বলল। আড়চোখে একবার ওর ছোট্ট লাজুক চেহারাটা দেখল। মাথা নীচু করে সেলাই করে চলেছে। মেলানী সন্তান চাইতেই পারে, কিন্তু ওর ছোট্ট শরীরটা মোটেই সন্তানধারণের জন্য উপযুক্ত নয়। লম্বায় একটা বারো বছরের মেয়ের থেকে বেশি হবে না। সরু নিতম্ব আর বুকটা প্রায় সমতল। মেলানির সন্তানধারণের কথাটা ভাবতেই স্কারলেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। আরও অনেক ভাবনা মাথায় চলে এল, যেগুলো মনে আনা উচিত নয়। যদি অ্যাশলের কাছ থেকে মেলানি সন্তানলাভ করে, তাহলে সেটা যেন স্কারলেটের কাছ থেকেই ছিনিয়ে নেবার মত হবে।
“ওয়েডের ব্যাপারে এই সব বলার জন্য আমাকে ক্ষমা কোরো। তুমি জান আমি ওকে কতটা ভালবাসি। তুমি আমার ওপর রাগ করনি তো? বল করেছ নাকি?”
“তুমি কি পাগল হলে?” স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলল। “আর দেখ ফিলকে বারান্দায় গিয়ে একটু সামলাও। ও কাঁদছে।”
0 মন্তব্যসমূহ