
অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত
কিন্তু আজ বুঝতে পারছে ওর সেদিনের অনুভুতি ছিল এক বয়ে যাওয়া শিশুর মত, যাকে তার কাঙ্খিত খেলনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু অ্যাশলেকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন আর সেই অনুভুতি দমন করে রাখতে রাখতে ওর আবেগ তীব্রতর হয়েছে।
অ্যাশলের পরনে তাপ্পিমারা ফ্যাকাসে ইউনিফর্ম, ওর সোনালি চুল গ্রীষ্মের রোদ লেগে তামাটে শনের দড়ির মত পাকানো। স্বপ্নময় চোখের স্বচ্ছন্দ সেই যুবক যাকে সে মরিয়া ভাবে ভালবাসত, যুদ্ধ বাধার পরে সে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। তবে এই পরিবর্তনের জন্য ওকে হাজার গুণ বেশি রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। এক সময় খুব ছিপছিপে আর ফর্সা ছিল। এখন তামাটে আর রোগা। সোনালি গোঁপ যেটা ঠোঁটের ওপর থেকে ঝুলে আছে – ওর চেহারার মধ্যে একটা সৈনিকসুলভ ভাব এনে দিয়েছে।
পুরোনো ইউনিফর্মে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পিস্তলটা জীর্ণ খাপ থেকে ঝুলছে। তলওয়ারের খাপ বুটজুতোকে ছুঁয়ে ঝুলে রয়েছে – মেজর অ্যাশলে উইল্কস – সি.এস.এ.। হাবভাবে, চলনেবলনে এক স্বনির্ভরতা আর কর্তৃত্বের ছাপ। ওর চওড়া কাঁধে আর চোখের দীপ্তিতে এক অচেনা যাদু। আগেকার অলস, পরিশ্রমবিমুখ মানুষ আজ শিকারি বেড়ালের মত সতর্ক – সমস্ত স্নায়ু আজ বেহালার তারের মত আঁটসাঁট করে বাঁধা। এক অদ্ভুত চাউনি আর তামাটে মুখ – ওর অ্যাশলে এখনও সেরকমই সুদর্শন কিন্তু কত আলাদা!
আগে স্কারলেট ঠিক করেছিল বড়দিন টারায় কাটাবে। কিন্তু অ্যাশলের টেলিগ্রাম আসার পরে দুনিয়ার কারও সাধ্য ছিলনা – এমনকি হতাশ এলেনের আদেশও – যে ওকে অ্যাটলান্টা থেকে নড়াতে পারে। যদি অ্যাশলে তূয়েল্ভ ওক্সে যাবার পরিকল্পনা করত, তাহলে স্কারলেটও তাড়াহুড়ো করে টারা চলে যেত, যাতে ও অ্যাশ্লের কাছাকাছি থাকতে পারে। কিন্তু অ্যাশলে ওর পরিবারকে চিঠি লিখে অ্যাটলান্টায় আসতে লিখে দিয়েছিল। সেই মত মিস্টার উইল্কস, হানি আর ইণ্ডিয়া এই শহরে চলেও এসেছে্ন। দু’বছর পরে দেখা আর এখন টারায় বাড়িতে চলে যাওয়া যায়! চলে যাওয়া মানে ওর কণ্ঠস্বর – যা ওকে চঞ্চল করে তোলে – তা থেকে বঞ্চিত হওয়া! চলে যাওয়া মানেই ওর চোখের ভাষা পটা থেকে বঞ্চিত হওয়া যাতে ও বুঝতে পারে অ্যাশলে ওকে ভুলে যায়নি! ককখনো না! এমনকি মা ডাকলেও না!
অ্যাশলে বড়দিনের চারদিন আগে এল। সঙ্গে কাউন্টিরই কয়েকজন সঙ্গী। গেটিসবার্গের পরাজয়ের পর অনেকেই আর নেই। এরাও সাময়িক ছুটিতে এসেছে। ওদের মধ্যে কেড ক্যালভার্ট রয়েছে। অনেকটাই কৃশ হয়ে গেছে আর সারাক্ষণ কাশছে। মুনরোদের দুই ভাই – ১৮৬১র পর এই প্রথম ছুটি পাওয়ায় খুবই উত্তেজিত আর খুশি। অ্যালেক্স আর টোনি ফোনটেন – মাতলামি, হইচই আর ঝগড়ায় ব্যস্ত। অ্যাটলান্টায় নামার পরে এদের গন্তব্যের ট্রেনের জন্য আরও দুঘন্টা অপেক্ষা করতে হত। এই সময়ে মাতাল ভাইরা, অন্য বন্ধুদের অসুবিধের কারণ হয়ে, নিজেদের মধ্যে আর অপরিচিতদের সঙ্গেও অনর্থক কলহে লিপ্ত হবে আর কেউ থামাতে পারবে না – এই সব ভেবে অ্যাশলে ওদের সবাইকে নিয়ে সোজা আন্ট পিটিপ্যাটের বাড়িতে চলে এসেছে।
“আপনি হয়ত মনে করবেন ওরা তো ভার্জিনিয়াতে অনেক লড়াই করার সুযোগ পেয়েছে,” কেড খুব বিরক্তভাবে বলল। দুই ভাই তখন রোঁয়া ফুলিয়ে কে আগে ভেবাচাকা খাওয়া নড়বড়ে আন্ট পিটিকে প্রথম চুমু খাবে তাই নিয়ে লড়াই শুরু করতে যাচ্ছে। “কিন্তু না, আমরা রিচমণ্ডে পৌঁছানোর পর থেকেই ওরা মাতলামি করেছে আর এর ওর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে। প্রোভোস্ট গার্ড এসে ওদের তুলে নিয়েছিলেন – আর অ্যাশলে যদি বাকপটুতার জোরে ওদের ছাড়িয়ে না আনত তাহলে বড়দিন ওদের কয়েদখানায় মানাতে হত।”।
অ্যাশলের সাথে আবার একই জায়গায় থাকার আনন্দে, স্কারলেটের কানে এসব কথা একটাও ঢুকছিল না। এই দু’বধর ধরে অন্য পুরুষদের কি করে যে ওর সুপুরুষ আর আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল এটা ভেবেই ও অবাক হয়ে যাচ্ছিল। অ্যাশলে থাকতে ও কি করে অন্যদের প্রেম-নিবেদন সহ্য করল? মাত্র কয়েকহাত দূরে ও বসে রয়েছে এখন! অনেক কষ্টে ও নিজের চোখের জলকে রোধ করে রাখল। অ্যাশলে সোফায় বসে আছে – এক পাশে মেলানি আর অন্য পাশে ইণ্ডিয়া – হানি ওর ঘাড়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে। ইস, যদি ওর অ্যাশলের পাশে বসার অধিকার থাকত! অ্যাশলের হাত ওর কাঁধ বেষ্টন করে থাকত! যদি ও মাঝে মাঝে অ্যাশলের শার্টের হাতায় মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে দেখতে পারতে যে ও সত্যিই ওখানে আছে! আর ওরই রুমাল দিয়ে চোখ থেকে বেরোনো খুশির অশ্রু মুছে নিতে পারত! মেলানি ঠিক এগুলোই করে চলেছে – লাজলজ্জার ধার না ধরে! লাজুক চোখে, কথা না বলে মনের আনন্দটা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। স্বামীর বাহুবন্ধনে, হাসি দিয়ে, চোখের জল ফেলে, ওর দিকে বারবার তাকাচ্ছে। অথচ স্কারলেট রাগ করতে পারছে না, হিংসেও করার ইচ্ছে হচ্ছে না – কারণ অ্যাশলে অবশেষে বাড়ি আসায় ও এতটাই উত্তেজিত!
গালের যেখানে অ্যাশলে ওকে চুম্বন করেছিল, ওর হাত মাঝে মাঝেই সেখানে উঠে যাচ্ছিল – ওর ওষ্ঠস্পর্শের রোমাঞ্চ বারবার মনে পড়ছিল – তারপর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছিল। মেলি ওর বাহুবন্ধনে ধরা দিয়ে অসংলগ্ন ভাবে কেঁদেই চলেছে – যেন ওকে আর কখনওই ছেড়ে যেতে দেবে না। আর তারপরই ইণ্ডিয়া আর হানি অ্যাশলেকে মেলানির কাছ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চুমু খেল। বাবার সঙ্গে ছেলের সম্পর্কের গভীরতা বোঝা গেল যখন অ্যাশলে শ্রদ্ধাসহকারে বাবাকে চুম্বন করল। তারপর আন্ট পিটিকে – উনি উত্তেজনায় ছটফট করছিলেন। সব শেষে ও স্কারলেটের দিকে তাকাল – অন্য ছেলেরাও ওর পাশে ওকে চুম্বন করার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে – আলতো করে ওর গালে চুমু খেয়ে বলল, “ওহ স্কারলেট – তোমাকে কত সুন্দর লাগছে!”
আর তখনই ও কি কি বলবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সব ভুলে গেল। অনেক পরে ওর মনে হল যে অ্যাশলে ওকে গালে চুমু খেয়েছে – ঠোঁটে নয়। এরপর ও ব্যাকুল হয়ে ভাবতে লাগল, যদি ঘরে ওরা একলা থাকত তাহলে কি ওই লম্বা শরীরটা নীচু করে ওকে তুলে নিয়ে কাছে টেনে অনেকক্ষণ ধরে ধরে থাকত? মনে মনে ভাবল অ্যাশলে সেটাই করত – কারণ এটাই ভাবতে ওর ভাল লাগছিল। তাতে কি হয়েছে – একটা পুরো সপ্তাহ সময় তো আছে! ও ঠিক এর মধ্যে সুযোগ করে ওকে একলা পেয়ে যাবে, তখন জিজ্ঞেস করবে, “সেই যে আমরা দুজনে ঘোড়ায় চড়ে নির্জন রাস্তার ধার দিয়ে বেড়াতে যেতাম – সেটা তোমার মনে পড়ে?” “মনে পড়ে সেই যে রাতে আমরা টারার দোরগোড়ায় বসে চাঁদ দেখেছিলাম – আর তুমি একটা কবিতা বলেছিলে?” (দূর ছাই! কবিতার নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না!, যাক গে!) “আর সেই যে আমার গোড়ালি মচকে গেছিল আর সেই গোধূলিবেলায় তুমি আমাকে দু’হাতে তুলে এনে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলে?”
এরকম কত ঘটনাই না আছে! ও শুধু “তোমার মনে পড়ে?” দিয়ে শুরু করবে। কত প্রিয় স্মৃতি যেগুলো ওকে সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে – যখন ওরা দুই বালক বালিকা দিশাহীন ভাবে কাউন্টির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত চরে বেড়িয়েছে – যখনও মেলানি হ্যামিল্টন রঙ্গমঞ্চে এসে পৌঁছায়নি! গল্প করতে করতে ওর চোখের ভাষায় এমন কিছু ভাবের আনাগোনা হয়ত দেখতে পেত যেটা এখন মেলানির প্রতি স্বামী হিসেবে যে অনুরাগ প্রদর্শন করে তার থেকে আলাদা। মনে হয় বারবেকিউর সন্ধ্যায় ও যেরকম সত্যি কথাটা স্বীকার করে ফেলেছিল, এখনও মনেপ্রাণে ততখানিই ওকে কামনা করে। কিন্তু যদিই বা অ্যাশলে আজও দৃঢ়ভাবে সেদিনের মত ভালবাসার কথাটা স্বীকার করে নেয়, তাহলে ঠিক কি করা উচিত সেই ভাবনাটা ওর মাথায় এল না। ও ভালবাসে – এটা জানাটাই যথেষ্ট। ও অপেক্ষা করবে .... মেলানি যত ইচ্ছে ওর কাছ থেকে সোহাগ আদায় করে নিক! ওর সময়ও আসবে .... মেলানির মত মেয়ে সত্যিকারের ভালবাসার কিই বা বোঝে!
“ডার্লিং, তোমাকে একেবারে ভিখিরির মত দেখাচ্ছে,” ঘরে ফেরার উত্তেজনার প্রথম রেশ যখন একটু কেটে উঠল, তখন মেলানি ওকে বলল। “তোমার ইউনিফর্মে কে তালি লাগিয়ে দিত? নীল রঙের কাপড় দিয়ে সব তাপ্পি দিয়েছে!”
“আরে, আমি তো ভাবলাম আমাকে জবরদস্ত দেখাচ্ছে,” অ্যাশলে এক ঝলক নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে বলল, “একবার শুধু ছেঁড়াখোঁড়া কাপর পরা নোংরা কুড়োনো লোকগুলোকে দেখ, তাহলে আমাকে ঠিক ঠিক লাগবে। মোজ় এই তালিগুলো লাগিয়েছে – আমার মনে হয়েছে কাজটা ও খুব ভালই করেছে – যুদ্ধের আগে ও কখনও ছুঁচ ধরেছে বলে মনে হয় না। আর যদি এই নীল কাপড়ের কথা বল – তাহলে বলি ছেঁড়া ইউনিফর্মের থেকে পরাজিত ইয়াঙ্কিদের ইউনিফর্মের কাপড় দিয়ে তালি লাগানো পোশাক পরা বোধহয় শ্রেয়তর! এছাড়া কোন উপায় আমাদের ছিল না। আর ভিখিরির মত দেখানো নিয়ে বলি যে তোমার ভাগ্য ভাল যে তোমার স্বামীকে খালি পায়ে আসতে হয়নি। গত সপ্তাহে আমার বুটজোড়া একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছিল। আমি তো ভাবছিলাম পায়ে বস্তা বেঁধে আসতে হবে। ভাগ্য ভাল ছিল – দুটো ইয়াঙ্কি ছেলেকে গুলি করে মারতে হয়েছিল। ওদের একজনের বুটজোড়া আমার পায়ে ঠিক ঠিক লেগে গেল!”
লম্বা পা বাড়িয়ে ওর বুটজোড়া সবাইকে দেখাল – তারিফ করার জন্য।
“অন্য ছেলেটার বুটজোড়া আমার পায়ের মাপের ছিল না,” কেড বলল। “দু সাইজ় ছোট – এর জন্য পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। তাও ছাড়িনি – অন্তত ঠাট নিয়ে বাড়ি তো যেতে পারছি!”
“আর শালা শুয়োরটা কিছুতেই আমাদের দুজনের একজনকেও দিল না,” টোনি বলল। “আমাদের ছোট আভিজাত্যময় ফোনটেন পদযুগলে ঠিক লেগে যেত! এই বেঢপ লম্বা জুতো পরে মায়ের কাছে যেতে লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছে, মাইরি বলছি! এই যুদ্ধের আগে উনি আমাদের ক্রীতদাসকেও এটা পরতে দিতেন না।”
“সে চিন্তা করিসনা,” কেডের বুটজোড়ার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে অ্যালেক্স বলল, “বাড়ি যাবার পথে, ট্রেনে ওর পা থেকে খুলে নেব। মায়ের সামনে যাওয়াটা কোন ব্যাপার নয়। ডিমিটি মুনরোকে আমার পায়ের আঙ্গুল বেরিয়ে আছে – এরকম দেখাতে চাইনা।”
“সে কি? ওই বুটজোড়া তো আমার! আমিই তো আগে চেয়েছিলাম,” বলে টোনি ভুরু কোঁচ করে ভাইয়ের দিকে তাকাল। আবার বোধহয় ফোনটেনদের বিখ্যাত মারপিট লেগে গেল ভেবে মেলানি ভয় পেয়ে গেল। ও তাড়াতাড়ি দুজনের মাঝখানে চলে এসে ওদের শান্ত করল।
“আমার গালভর্তি দাড়ি তোমাদের দেখানো হল না, মেয়েরা,” খুব মন মরা হয়ে গালে হাত বোলাতে বোলাতে অ্যাশলে বলল। খুরের খোঁচার কয়েকটা দাগ এখনও বেশ কাঁচা। “সত্যিই খুব সুন্দর দাড়ি হয়েছিল – আর আমি হলফ নিয়ে বলতে পারি – জেব স্টুয়ার্ট কিংবা নাথান বেডফোর্ড ফরেস্ট কারোরই এত সুন্দর দাড়ি ছিল না! কিন্তু যখন আমরা রিচমণ্ডে পৌঁছলাম, এই দুটো বজ্জাত,” বলে ফোন্টেনদের দিকে আঙ্গুল দেখাল, “ঠিক করল যে ওরা যেরকম দাড়ি কামিয়ে ফেলছে, আমারটাও কামিয়ে ফেলতে হবে। আমাকে জোর করে চেপে ধরে দাড়ি কামিয়ে দিয়েছে। ভাগ্য ভাল, যে দাড়ির সাথে সাথে আমার মুণ্ডুটাও কেটে বেরিয়ে যায়নি। ইভান আর কেড বাধা না দিলে গোঁপজোড়াও যেত!”
“অকৃতজ্ঞ কোথাকার! মিসেজ় উইল্কস, আমাকে আপনার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। ওকে আপনি দেখলে চিনতেই পারতেন না – আর ঘরে ঢুকতেও দিতেন না,” অ্যালেক্স বলে উঠল। “”ও আমাদের জন্য প্রোভোস্ট গার্ডকে বলে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে, তার প্রতিদানে আমরা এটুকু করে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আমরা এখুনি তোমার গোঁপটাও কেটে দিচ্ছি।”
“না না, তার দরকার নেই, ধন্যবাদ,” ভয় পেয়ে অ্যাশলেকে শক্ত করে ধরে মেলি তাড়াতাড়ি বলে উঠল। কারণ এই দুই মূর্তিমান সব কিছুই করতে পারে। “আমার মনে হয়, গোঁপেই ভাল লাগছে।”
“এর নাম প্রেম,” ফোন্টেন দুজন খুব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
আন্ট পিটির গাড়ি নিয়ে অ্যাশলে বন্ধুদের যখন স্টেশনে পৌঁছে দিতে গেল তখন মেলানি স্কারলেটের বাহুতে হাত রাখল।
“ওর ইউনিফর্মের কি দুর্দশা, তাই না? আমার কোটটা পেয়ে অবাক হয়ে যাবে। ইস, যদি ওর পাজামার জন্যও আমার কাছে যথেষ্ট কাপড় থাকত!”
মেলানির এই কোটের ব্যাপারটা স্কারলেটের কাছে একটা খুব সংবেদনশীল বিষয়। ওর খুব ইচ্ছে ছিল বড়দিনের উপহার হিসেবে অ্যাশলেকে কোটটা মেলানির বদলে ও নিজে দেবে। ধূসর রঙের উল এখন মুক্তোর চেয়েও বেশি অমূল্য। অ্যাশলে ব্যবহার করত বাড়িতে বোনা কোট। এখন হাল্কা বাদামী রঙের কাপড়ও খুব দূর্লভ। বেশিরভাগ সৈন্যই এখন পরাজিত ইয়াঙ্কি সৈন্যদের ইউনিফর্ম দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। বাদামের খোলের রঙ দিয়ে রাঙিয়ে নেওয়ায় সেগুলো গাঢ় বাদামী রঙের হয়ে গেছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে মেলানির হাতে বেশ কিছু ধূসর কাপড় এসে পড়েছিল – লম্বা কোট বানাবার পক্ষে যথেষ্ট নয় – তবুও কোটই তো! হাসপাতালে মেলানি একটা চার্লস্টনের ছেলের দেখভাল করেছিল। ছেলেটা যখন মারা যায়, তখন ওর অল্প কিছু জিনিষপত্রের সঙ্গে মাথার কিছুটা চুল কেটে নিয়ে আর জীবনের শেষ মুহুর্তগুলোর একটা সান্ত্বনাদায়ী বিবরণ ওর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। যদিও ওর মৃত্যুর আগের কষ্ট আর যন্ত্রণার কথার উল্লেখ করেনি। এরপর মেলানি আর ছেলেটার মায়ের মধ্যে অনেক চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয়। সেই চিঠি থেকে ওর মা জানতে পারেন মেলানির স্বামীও লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছে। তখন উনি ছেলের জন্য রাখা কোটের কাপড় আর পেতলের কিছু বোতাম পাঠিয়ে দেন। কাপড়টা খুব ভাল মানের ছিল – পুরু আর উষ্ণ – আর খুব দামী – নিঃসন্দেহে চোরাই মাল। এটা এখনও দর্জির কাছে রয়েছে। মেলানি ওকে তাড়া দিচ্ছে যাতে বড়দিনের সকালের মধ্যে ওটা পাওয়া যায়। ইউনিফর্মের বাকিটা দেবার জন্য স্কারলেটে যে কোন মূল্য দিতে রাজী ছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অ্যাটলান্টাতে কাপড় জোগাড় করতে পারেনি।
স্কারলেটও অ্যাশলেকে কিছু উপহার দেবে বড়দিনে। কিন্তু মেলানির কোটের তুলনায় সেটা ছিল খুবই সামান্য। ফ্ল্যানেল দিয়ে ও একটা ছোট্ট থলি বানিয়েছিল, যার মধ্যে রেটের ন্যাসাউ থেকে এনে দেওয়া দামী ছুঁচের সেট, লিনেনের তৈরি তিনটে রুমাল – যেটাও একই জায়গা থেকে এসেছিল, সেলাইয়ের সুতোর দুটো গোলা আর কাঁচি ভরে রেখেছিল। কিন্তু ওর ইচ্ছে ছিল আরও ব্যক্তিগত কিছু – যেরকম জিনিষ স্ত্রী স্বামীকে দিয়ে থাকে – যেমন একটা শার্ট, এক জোড়া দস্তানা, আর একটা টুপি দিতে চেয়েছিল। যে ঘাসের টুপিটা অ্যাসলে পরে আছে সেটা যেন কেমন কেমন। এই রকম টুপি স্কারলেটের কোনদিনই পছন্দ নয়। এর মধ্যে কোন আভিজাত্যই নেই। কিন্তু অ্যাটলান্টায় যে সস্তার টুপি পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর থেকে এই টুপি বরং ভাল।
টুপির কথা ভাবতে ভাবতেই ওর রেট বাটলারের কথা মনে পড়ে গেল। সত্যি ওঁর কতগুলো টুপি – গরমকালের জন্য চওড়া পানামা হ্যাট, আচার অনুষ্ঠানের জন্য লম্বা বীভার হ্যাট, শিকারে যাবার টুপি, আরও কালো, নীল আর তামাটে রঙের টুপি। কি করবেন উনি এতগুলো টুপি দিয়ে যেখানে ওর প্রিয় অ্যাশলে যখন ঘোড়ায় চড়ে যায় ওর টুপির পেছন দিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে শার্টের কলার ভিজিয়ে দেয়?
“ওঁর ওই কালো রঙের নতুন ফেল্ট হ্যাটটা দিয়ে দেবার জন্য রেটকে রাজী করাতে হবে,” স্কারলেট ঠিক করল। “টুপিটার ধার বরাবর ধূসর রিবন লাগিয়ে দিলে আর সামনে একটা ফুলের নকশা তুলে দিলে দেখতে ভালই লাগবে।”
কিন্তু ওটা পেতে গেলে রেটকে তো কোন সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে হবে। ওটা অ্যাশলের জন্য চাই কিছুতেই বলা যাবে না! অ্যাশলের নাম শুনলেই ভুরু তুলে সেই চিরপরিচিত নোংরা হাসিটা হাসবেন, আর হ্যাটটাও কিছুতেই দেবেন না! নাহ, ওকে একটা করুণ গল্প ফাঁদতে হবে – হাসপাতালের একজন সৈন্যের একটা হ্যাটের খুব দরকার – ওঁকে আসল কথাটা কিছুতেই জানতে দেওয়া চলবে না।
ও সারাটা বিকেল ধরে অ্যাশলেকে একা পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকল – অন্তত কয়েকটা মিনিটের জন্যে হলেও – কিন্তু মেলানি সারাক্ষণ ওর পাশে বসে রইল, আর ইণ্ডিয়া আর হানি চকচকে ভুরুহীন চোখে ওর লেজুড় হয়ে রইল। এমনকি জন উইল্কস – ওর গর্বিত বাবা পর্যন্ত ছেলের সাথে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ পেলেন না।
সাপারের সময়ও একই ব্যাপার হল। ওরা অ্যাশলেকে যুদ্ধ নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে থাকল। যুদ্ধ নিয়ে! যুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামাতে কার দায় পড়েছে! স্কারলেটের মনে হয় অ্যাশলেও এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে চায় না। যদিও ও কথা অনেক বলল, জোরে জোরে হাসল। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে স্কারলেট ওকে এই প্রথম দেখল। কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলল না। বন্ধুদের নিয়ে নানারকম ঠাট্টা পরিহাসের গল্প বলল, অস্থায়ী বাসস্থান, বৃষ্টির মধ্যে লং মার্চ করে যাওয়া, খিদে নিয়ে চলা এসব নিয়ে রঙ্গ তামাশা করল। আরও বলল, গেটিসবার্গ থেকে পশ্চাদপসরণের সময় যখন গেনেরাল লী কে জিজ্ঞাসা করা হল, “আপনি কি জর্জিয়া ট্রুপের? আমরা আপনাদের, জর্জিয়ানদের ফেলে যেতে পারব না,” তখন ওঁকে কেমন দেখতে লাগছিল।
স্কারলেটের মনে হল যে যাতে ওকে কোন অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর না দিতে হয় তাই এরকম বিরামহীন ভাবে কথা বলে চলেছিল। বাবার চোখে চোখ পড়াতে যেরকম অস্বস্তিভরে চোখ নামিয়ে নিল অ্যাশলে, তখন স্কারলেট বিহ্বলভাবে বোঝার চেষ্টা করল অ্যাশলের মনে কি নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু ভাবনাটাকে ও বেশি পাত্তা দিল না, কারণ তখন ওর একটাই ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল, কি করে অ্যাশলেকে একলা পাওয়া যায়।
তারপর আগুনের সামনে বসে সকলে হাই তুলতে লাগল, আর মিস্টার উইল্কস মেয়েদের নিয়ে হোটেলে চলে গেলেন – আঙ্কল পীটারের জ্বালানো আলো দিয়ে মেলানি, পিটিপ্যাট আর স্কারলেট যখন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছেন, তখন স্কারলেটের মধ্যে একটা শীতল অনুভুতি ছেয়ে গেল। যতক্ষণ দোতলার হলে সবার সাথে দাঁড়িয়ে ছিল ততক্ষণ মনে হচ্ছিল যেন অ্যাশলে ওরই – শুধুই ওর – যদিও ওর সাথে সারা সন্ধ্যায় একলা কথা বলার সুযোগ আসেনি। এখন শুভ রাত্রি বলবার সময় খেয়াল করল মেলানির গাল দুটো লালচে হয়ে গেছে আর ও কাঁপছে। যদিও ও চোখ নামিয়ে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে থাকল, তবু ওর মধ্যে একটা অনিশ্চিত ভাল লাগার অনুভুতি রয়েছে। অ্যাশলে বেডরুমের দরজা খোলার পরেও মেলানি একবারও চোখ তুলে তাকাল না। এমনকি অ্যাশলেও ওর দিকে একবারও না তাকিয়ে শুভরাত্রি বলে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে নিল।
ওদের চোখের সামনেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। স্কারলেটের নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হল। অ্যাশলে আর ওর নেই। ও এখন মেলানির। আর যতদিন মেলানি বেঁচে থাকবে, ও অ্যাশলের সঙ্গে বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সারা পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারবে।
***
আবার অ্যাশলের ভার্জিনিয়াতে ফিরে যাবার সময় হয়ে গেল। আবার সেই তুষারপাত আর বর্ষার মধ্যে লং মার্চ, বরফের মধ্যে অস্থায়ী ক্যাম্পে কাটানো, আবার সেই কঠিন দিনযাপন। ওর উজ্জ্বল মুখে, সুঠাম শরীরে এক মুহুর্তের জন্য একটা ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। গত এক সপ্তাহের এত আনন্দ, এত উৎসাহ সব এক নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে গেল।
স্বপনময় সপ্তাহটা পলকের মধ্যে চলে গেল। বাতাসে ভেসে আসা পাইনের সুগন্ধ – রাংতার ওপর পড়া মোমবাতির আলো, দ্রুত হৃৎস্পন্দন, একই সাথে আনন্দ আর বেদনার সমাহার। এই এক সপ্তাহের সুখস্মৃতি স্কারলেট প্রাণপণে আহরণ করে রাখছিল যাতে অনেক মাস ধরে অবসর সময়ে সেগুলো মনে করে সান্ত্বনা পেতে পারে। নাচ, গান, অ্যাশলের জন্য কিছু নিয়ে আসা, ও কি চাইছে সেটা আন্দাজ করা, ওর যখন কথা বলত সেটা চুপচাপ শোনা, ওকে দেখতে পাওয়া, ওর চেয়ে থাকা – সব ওর মনে গাঁথা হয়ে থাকবে অনেকদিন। একটা সপ্তাহ কত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, কিন্তু যুদ্ধ আর শেষ হতেই চায় না।
বসার ঘরের ডিভানে বসে স্কারলেট অপেক্ষা করছিল। ওর হাতে অ্যাশলের জন্য বিদায়কালীন উপহার। মনে মনে প্রার্থনা করছিল যে মেলানির কাছে বিদায় নিয়ে আসার পরে অ্যাশলেকে ও যেন অল্প সময়ের জন্য হলেও একা পায়। কান পেতে ওপর থেকে ভেসে আসা কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চারদিক যেন খুবই নিস্তব্ধ। এত নিস্তব্ধ যে নিজের শ্বাসপ্রঃশ্বাসের আওয়াজ অব্দি শুনতে পাচ্ছিল। আন্ট পিটি নিজের ঘরে বালিসে মুখ গুঁজে কাদছিলেন। প্রায় আধ ঘন্টা আগে অ্যাশলে ওঁকে বিদায় জানিয়ে এসেছে। মেলানির শোবার ঘর থেকে কোন রকম গুঞ্জন বা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্কারলেটের মনে হল অ্যাশলে যেন অনন্তকাল ধরে ওই ঘরে বসে আছে। মেলানির কাছে বিদায় নেবার প্রতিটা মুহুর্ত ওর কাছে বিশাল লম্বা বলে মনে হচ্ছিল। ও আর কতটুকুই বা সময় পাবে! অ্যাশলের তো তাড়া রয়েছে।
সারা সপ্তাহ ধরে যে যে কথাগুলো ও অ্যাশলেকে বলবে বলে ঠিক করেছিল সেগুলো মনে পড়তে লাগল। কিন্তু বলার বোধহয় আর সময় করে উঠতে পারবে না। হয়ত কিছুই বলবার সুযোগ পাবে না।
কিছু কথা হয়ত একটু বোকা বোকা শোনাত, যেমন, “অ্যাশলে সাবধানে থাকবে”, “পা ভিজে রাখবে না”, “শার্টের তলায় একটা খবরের কাগজ রাখতে ভুলো না, হাওয়া আটকায়”। কিন্তু কত দরকারি কথাও বলার ইচ্ছে ছিল। কত দরকারি কথা ও অ্যাশলের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিল। অন্তত যদি মুখে নাও বলতে পারত, ওর চোখের ভাষা থেকে বুঝে নেবার চেষ্টা করতে পারত।
এত কিছু বলবার, অথচ এখন আর সময়ই নেই! আর মেলানি যদি ওর পিছু পিছু চলে আসে ওকে গাড়িতে তুলে দেবার জন্য, তাহলে সেই সময়টুকুও ও পাবে না! এই এক সপ্তাহে ও একবারও অ্যাশলের সঙ্গে একলা থাকার সময় বের করতে পারল না। মেলানি সারাক্ষণ ওর পাশে থাকত, সপ্রেম দৃষটিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত, আত্মীয়স্বজনরা ঘিরে থাকতেন – সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি – অ্যাশলে একা তঝাকার সুযোগই পায়নি। আর রাতের বেলা শোব্র ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেত আর ও মেলানির সঙ্গে একলা থাকত। গত কয়েকদিনে ও স্কারলেটের দিকে এমন কোন ভাবে তাকায়নি যাতে লোকে সেটাকে বোনের দিকে ভাইয়ের তাকানো কিংবা দুজন আজীবনের বন্ধুর মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় ছাড়া অন্য কিছু মনে করা যেতে পারে। কিন্তু অ্যাশলেকে ও কিভাবে বিদায় দেবে যদি ওকে ভালবাসে কি না বুঝতে পারে?
অনন্তকাল অপেক্ষা করার পর ও ওপরে শোব্র ঘরের দরজা খোলা আর বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেল, তারপর অ্যাশলের বুটের আওয়াজ। নীচে নামার শব্দ। যাক বাবা একাই আসছে! ভগবানকে ধন্যবাদ! মেলানি নিশ্চয়ই এতটাই ভাঙ্গে পড়েছে যে ঘর থেকে বেরোতেই চাইল না। অল্প কয়েকটা মূল্যবান মুহুর্তের জন্য ও অ্যাশলেকে একা পাবে!
অ্যাশলে সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এল, ওর তরবারি বুটের গায়ে ধাক্কা লেগে নড়ে উঠছে। ওর দৃষ্টি বিষণ্ণ। হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু সমস্ত মুখ ফ্যাঁকাসে, রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। স্কারলেট উঠে দাঁড়াল। ওর দেখা সবথেকে সুপুরুষ সৈন্য। ভেবে মনে মনে গর্ব হল। ওর পোশাকআসাক, ওর তরবারি সব কিছু ঝকঝক করছে। আঙ্কল পীটারের মেহনত। নতুন কোটটা ঠিক মাপে মাপে হয়নি। দর্জির তাড়া ছিল, তাই অনেক সেলাই একটু আধটু বেঁকে গেছে। নতুন কোটের চকচকে ধূসর রঙ পুরোনো রঙচটা প্যান্ট আর ক্ষয়ে যাওয়া বুটের সঙ্গে মানানসই লাগছে না। চকচকে রুপোর বর্ম পরেও ওর সামনে দাঁড়ালেও, স্কারলেট ওকে এত উজ্জ্বল বীর লাগত না।
“অ্যাশলে,” ও হঠাৎ মিনতির স্বরে বলে উঠল, “আমি ট্রেনে তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি?”
“থাক না। বাবা, বোনেরাও থাকবে ওখানে। তাছাড়া, ডিপোতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বিদায় জানানোর থেকে এখানে বিদায় জানালেই আমার ভাল লাগবে। কত স্মৃতিই তো থেকে গেল।”
ও তাড়াতাড়ি পরিকল্পনাটা বাতিল করে দিল। ইণ্ডিয়া আর হানি – যারা ওকে খুবই অপছন্দ করে – ওরা থাকলে ও আর একলা কথা বলার সুযোগ পাবে না।
“থাক তাহলে, ও বলল। “এই দেখ অ্যাশলে, তোমার জন্য একটা উপহার আছে।”
দেবার সময় এসে গেছে। একটু লাজুক মুখে ও প্যাকেটটা খুলল। চিনা সিল্কের হলুদ রঙের একটা লম্বা উত্তরীয়, ধারফুলোতে চওড়া করে পাড় বসানো। বেশ কয়েক মাস আগে হাভানা থেকে রেট বাটলার ওর জন্য একটা হলুদ রঙের শাল নিয়ে এসেছিলেন। বেশ জমকালো। ম্যাজেন্টা আর নীল রঙের পাখী আর ফুলের এম্ব্রয়ডারি করা। গত এক সপ্তাহ ধরে খুব ধৈর্য সহকারে এম্ব্রয়ডারিটা তুলে ফেলে উত্তরীয়র মাপে কেটে নিয়ে সেলাই করেছে।
“স্কারলেট, কি সুন্দর! এটা তুমি নিজের হাতে বানিয়েছ? তাহলে তো এটা আমার কাছে খুব মূল্যবান! আমাকে এটা পরিয়ে দাও। আমার নতুন কোট আর উত্তরীয় দেখে ছেলেরা হিংসেয় জ্বলে যাবে!”
অ্যাশলের সরু কোমর বেষ্টন করে পরিয়ে দিয়ে ওটাতে শক্ত করে প্রেমিকার ফাঁস লাগিয়ে দিল। মেলানি ওকে কোটটা দিলেও এই উত্তরীয়টা হল যুদ্ধে পরে থাকার জন্য ওর দেওয়া গোপন উপহার। এটা দেখলেই ওর কথা মনে পড়বে। একটু পিছিয়ে গিয়ে ও গর্বের সাথে দেখল। মনে হল এমনকি জেব স্টুয়ার্টকেও ওর পাগড়ি আর পালকে এর থেকে সুন্দর দেখাবে না।
“এটা খুবই সুন্দর!” ও আবার বলল। তারপর পাড়ের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, “ মনে হচ্ছে, স্কারলেট তুমি এটা শাল কিংবা কোন পোশাক কেটে বানিয়েছ। করা উচিত হয়নি। এই আক্রার বাজারে সুন্দর জিনিষ পাওয়া যে কি শক্ত হয়ে গেছে!”
“ওহ অ্যাশলে, আমি ___”
ও বলতে যাচ্ছিল, “তুমি চাইলে আমি আমার হৃদয় কেটে তোমাকে দিতে পারি”, কিন্তু শুধু বলল, “তোমার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি।”
“সত্যি?” ও জিজ্ঞেস করল। ওর চোখের বিষণ্ণ ভাবটা একটু যেন কাটল। “তাহলে তুমি একটা কাজ আমার জন্য করতে পার স্কারলেট যাতে আমি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারি।”
“কি করতে পারি বল,” খুশিতে স্কারলেট আকাশের চাঁদ এনে দেবার কথাও দিতে পারে।
“স্কারলেট তুমি কি আমার হয়ে মেলির খেয়াল রাখবে?”
“মেলির খেয়াল রাখব?”
তীব্র হতাশায় ওর হৃদয় খানখান হয়ে গেল। ও কি এরকমই কিছু প্রত্যাশা করেছিল? না খুব স্বর্গীয় কিছু একটা দেবার আশা করেছিল এমন কিছু যা অনির্বচনীয়! এই মুহুর্তটা তো অ্যাশলের সাথে ওর নিজের মুহুর্ত – শুধুই ওর! যদিও মেলানি এখানে উপস্থিত নেই, তবুও ওর ম্লান ছায়া ওদের দুজনের মধ্যে এসে পড়েছে! কি করে ও মেলানির নাম নিতে পারল – যখন ও ওকে বিদায় জানাতে এসেছে? কি করে এরকম অসম্ভব একটা ব্যাপার ওর কাছ থেকে প্রত্যাশা করল?
স্কারলেটের ভাবান্তর অ্যা শলের চোখে ধরা পড়ল না। সেই আগাকার দিনের মত, ওর দৃষ্টি স্কারলেটকে ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গেছে।
“হ্যা তুমি একটু ওর দিকে খেয়াল রেখো। ও কত দূর্বল – অথচ ও সেটা বুঝতেই পারেনা। হাসপাতালের কাজ আর সেলাই করতে করতে ও নিজেকে আরও দূর্বল করে ফেলছে। আর ও কত শান্ত আর ভীতু। আন্ট পিটি, আঙ্কল হেনরি আর তুমি ছাড়া ওর কোনও নিকট আত্মীয়ও নেই। মেকনের বাররা আছেন – কিন্তু সে তো খুবই দূর সম্পর্কের। তুমি তো জানই স্কারলেট, আন্ট পিটি একেবারে শিশুর মত। আঙ্কল হেনরির বয়স হয়ে গেছে। মেলানি তোমাকে কত ভালবাসে – শুধু তুমি চার্লির বউ বলেই নয় – তুমি তুমি বলেই। ও তোমাকে নিজের বোনের মতই ভালবাসে। আমার কি হবে ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হয় – যদি আমি মরে যাই – ওর কারও কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। তুমি কথা দিচ্ছ তো?”
স্কারলেট ওর শেষ অনুরোধটা শুনতে পেল না। “যদি আমি মরে যাই” এই অশুভ কথাটা শুনে ও ভয় পেয়ে গেল।
একরাশ ভয় নিয়ে ও প্রত্যেকদিন হতাহতের তালিকায় চোখ বুলিয়ে গেছে। যদি অ্যাশলের কিছু হয়ে যায় তাহলে ও অন্ধকার দেখবে। মনে মনে একটা আশা করে রেখেছে যে যদি কনফেডারেট সৈন্যরা সবাই মরেও যায় তবুও অ্যাশলের কিছু হবে না। আর এখন কি না এরকম অপয়া কথা বলল! ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ও খুব ভয় পেয়ে গেল। যুক্তি দিয়ে কিছুতেই ও ভয়টাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারল না। আইরীশদের কুসংস্কার ওর মধ্যে পুরোমাত্রায় আছে। অ্যাশলের বিষণ্ণ চোখে কিসের ছায়া দেখে ও ভয় পেয়ে গেল।
“এরকম কথা বোলো না। ভাববেও না কখনও! মৃত্যুর কথা মুখে আনতে নেই। তুমি এখুনি ভগবানের নাম স্মরণ কর!”
“তুমিই আমার হয়ে কর। আর আমার জন্য কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিও,” ওর গলার স্বরে উৎকণ্ঠা দেখে হেসে ফেলল।
ও কোন জবাব দিতে পারল না। মনের মধ্যে যে ছবি ভেসে উঠছিল তাতে ও ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে গেছিল। ভার্জিনিয়ার তুষারের মধ্যে অ্যাশলে মরে পড়ে আছে – ওর কাছ থেকে কত দূরে! অ্যাশলে কথা বলে চলল। ওর কথা বলার মধ্যে একটা বিষণ্ণতা ফুটে উঠতে থাকল – একটা হাল ছেড়ে দেওয়া ভাব – যে স্কারলেটের সব রাগ উধাও হয়ে গেল – সব হতাশা চলে গেল।
“এই জন্যই তোমাকে বললাম স্কারলেট। আমি জানিনা আমার কি হবে – আমাদের সবার কি হবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে – আমি এখান থেকে অনেক দূরেই থাকব। বেঁচে থাকলেও সেখান থেকে আমি মেলানির খেয়াল রাখতে পারব না।”
“শে-শেষ মুহুর্ত?”
“যুদ্ধের শেষ মুহুর্ত – জীবনের শেষ মুহুর্ত।”
“অ্যাশলে তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না যে ইয়াঙ্কিরা আমাদের হারিয়ে দেবে? এই তো সারা সপ্তাহ ধরে জেনেরাল লী কি রকম দুর্দান্ত সে কথা ____”
“দেখ সারা সপ্তাহ যা বলেছি, সেটা ছুটি কাটাতে যারা আসে তাদের থেকে আলাদা কিছু বলিনি। বল কেন আমি আন্ট পিটি বা মেলানিকে শুধু শুধু ভয় পাইয়ে দেব? হ্যা, স্কারলেট, আমি মনে করি, ইয়াঙ্কিরা আমাদের কাবু করে ফেলেছে। গেটিসবার্গে শেষের শুরু হয়ে গেছে। এরা সবাই অন্ধকারে আছে। ওরা জানেই না আমরা কিসের মধ্যে দিয়ে চলেছি। তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, আমাদের অনেকেই খালি পায়ে যুদ্ধ করছে – কিন্তু ভার্জিনিয়াতে অবিরাম তুষারপাতে মাটিতে পুরু বরফ জমে গেছে। যখন আমি ওদের দেখি – পায়ে বস্তা জড়ানো – যখন ওরা হেঁটে যায় তুষারের ওপর রক্তের দাগ যখন দেখি – আমার তো তবু একজোড়া বুট আছে – তখন মনে হয় আমিও বুট খুলে ফেলে ওদের মত খালি পায়ে যুদ্ধ করি।”
“ওহ, অ্যা শলে, কথা দাও তুমি কখনও খুলে ফেলবে না!”
“ওদের দেখি – তারপর ইয়াঙ্কিদের দেখলেই আমার মনে হয় শেষের আর বেশি দেরি নেই। জান স্কারলেট – ইয়াঙ্কিরা ইউরোপ থেকে হাজার হাজার সৈন্য কিনছে! হালে আমরা যাদের বন্দী করতে পেরেছি – তারা এমন কি ইংরেজিও বলতে পারে না! ওদের মধ্যে জার্মানদেশের লোক আছে, পোল্যাণ্ডের লোক আছে এমন কি আইরীশরাও রয়েছে যারা গ্যালিক ভাষায় কথা বলে। কিন্তু আমাদের একজন লোক গেলেও আমরা তার জায়গায় অন্য কাউকে পাই না! আমাদের জুতো ছিঁড়ে গেলে, নতুন জুতো পাই না। আমরা আটকে গেছি, স্কারলেট – আমরা সারা পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠব না।”
স্কারলেট মনে মনে ভাবলঃ “কনফেডারেসির সবাই ধুলোয় মিশে যাক, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক! কিন্তু তুমি মরে যেও না! তুমি মরে গেলে আমার আর কিছুই থাকবে না!”
“তোমাকে যেসব কথা বললাম, স্কারলেট, সেগুলো কাউকে বোলো না। আমি কাউকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। আমি তোমাকেও হয়ত এসব বলতাম না যদি আমি তোমাকে মেলানির খেয়াল রাখতে না বলতাম। ও খুবই দূর্বল, তোমার মত শক্ত সমর্থ নয়। তোমরা দুজনে একসাথে থাকলে আমার ভাল মন্দ কিছু হলেও মিশ্চিন্ত থাকতে পারব। বল তুমি কথা দিচ্ছ।”
“হ্যা দিচ্ছি দিচ্ছি!” স্কারলেট কেঁদে উঠল। ওকে মৃত্যুর এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও সব কিছু কথা দিতে পারত। “অ্যাশলে, অ্যাশলে – আমি তোমাকে যেতে দিতে পারব না! তুমি চলে গেলে আমি কোন সাহস পাব না!”
“তোমাকে মনে জোর রাখতে হবে,” ও বলল। গলার স্বরে সামান্য পরিবর্তন। একটু যেন গাঢ় – একটা ঝঙ্কার। যেন ভেতরে থাকা একটা আকুতি ফুটে বেরোল। “তোমাকে সাহসী হতে হবে। নইলে আমি কি করে যুঝে উঠতে পারব বল!”
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের মধ্যে একটা আশার আলো জ্বলে উঠল। অ্যাশলে চলে যাওয়াতে ওর যেমন হৃদয় ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাচ্ছে – তাহলে কি অ্যাশলেরও ওকে ছেড়ে যেতে সেরকমই হচ্ছে? মেলানির কাছে বিদায় নিয়ে আসার মুহুর্তে ওকে যেমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল, এখনও তেমনই দেখাচ্ছে। কিন্তু ওর চোখের ভাষায় ও কিছু পড়তে পারল না। ও আস্তে আস্তে নীচু হয়ে দুহাতে স্কারলেটের মুখটা তুলে ধরে কপালে একটা চুমু খেল।
“স্কারলেট! স্কারলেট! তুমি এত ভাল, এত সাহসী, এত সুন্দর – না তোমার শুধু মুখটাই মিষ্টি নয় – তোমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে তুমি সুন্দর – তোমার শরীর – তোমার মন!”
“ওহ অ্যাশলে!” পুলকিত হয়ে ও আস্তে আস্তে বলল – অ্যাশলের স্পর্শ অনুভব করতে করতে। “আর কেউ বলে না – তুমি ছাড়া ____”
“আমি ভাবতে ভালবাসি যে আমি তোমাকে অন্য সবার চাইতে বেশি বুঝি – তোমার মনের মধ্যে কত সুন্দর স্বপ্ন লুকিয়ে আছে – যেগুলো অন্য কেউ লক্ষ্য করবার মত মনযোগ দেয় না।”
বলতে বলতে ওকে ছেড়ে দিল। কিন্তু চোখের ওপর থেকে চোখ সরাল না। স্কারলেট নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকল কখন সেই ম্যাজিকের মত তিনটে শব্দ ও উচ্চারণ করবে। কিন্তু ও আর কিছু বলল না। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু আন্দাজ করার চেষ্টা করল। মনে হল ওর কথা বলা শেষ হয়ে গেছে।
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ওর প্রত্যাশা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মনে হল ও আর সহ্য করতে পারবে না। “ওহ” বলে ও বসে পড়ল। দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এল। তারপর জানালার বাইরে গাড়িবারান্দার থেকে সেই পরিচিত শব্দটা ভেসে এল, যে শব্দ এই মুহুর্তে অ্যাশলের বিদায়ের থেকেও বেশি বেদনাদায়ক। গ্রীক পুরানে বর্ণিত ক্যারনের (যে মৃত আত্মাদের তার নৌকায় পারাপার করাতো) নৌকার আওয়াজ শুনে প্রকৃতিপূজারিরা যেমন নিঃসঙ্গ বোধ করত, তার থেকেও বেশি নিঃসঙ্গতা বোধ ওর মধ্যে জেগে উঠল। আঙ্কল পীটার গরম কাপড়ে নিজেকে আচ্ছাদিত করে অ্যাশলেকে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছে।
অ্যাশলে খুব মৃদুস্বরে বলল “আসি”, তারপর টেবিলের ওপর থেকে চওড়া ফেল্টের টুপিটা (যেটা স্কারলেট রেটের কাছে থেকে আদায় করেছিল) তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বাইরের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল। বেরোনোর আগে দরজার হাতলটা ধরে একবার ওর মুখের দিকে তাকাল, যেন ওর মুখের অভিব্যাক্তিটা মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে যেতে চাইল। জলভরা ঝাপসা চোখে স্কারলেট দেখতে পেল– বুকের মধ্যে এক অশ্য বেদনার অনুভুতি নিয়ে – ও চলে যাচ্ছে। ওর কাছ থেকে – বাড়ির নিরাপদ আশ্রয় থেকে – হয়ত চিরকালের জন্য – কিন্তু যে কথাটা শোনবার জন্য ও এত উন্মুখ হয়ে ছিল – সেটা না বলেই। সময় কত দ্রুত দলে যায় – কত দেরি হয়ে গেল! ও ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওর উত্তরীয় চেপে ধরল তারপর কাঁপা গলায় বলল, “আমাকে চুমু খাও! আমাকে একটা চুমু খেয়ে বিদায় জানাও!”
অ্যাশলে খুব আলগোছে ওকে নিজের বাহুবন্ধনে নিল, তারপর মুখটা ওর মুখের কাছে নামিয়ে আনল। ওর ঠোঁটের প্রথম স্পর্শ পেয়েই স্কারলেট ওকে জোরে চেপে ধরল। এক মুহুর্তের জন্য ও স্কারলেটের শরীর নিজের শরীরের দিয়ে চেপে ধরল। স্কারলেট অনুভব করল ও কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ও টুপিটাকে নীচে ফেলে দিয়ে তুলে নেবার জন্য নিচু হলস্কারলেটকে ছেড়ে দিয়ে।
“না স্কারলেট, না!” ও খুব আস্তে আস্তে বলল। ওর হাতের চাপে স্কারলেটের কবজি ব্যথায় টনটন করে উঠল।
“আমি তোমাকে ভালবাসি,” স্কারলেট রুদ্ধস্বরে বলল। “আমি সব সময় তোমাকেই ভালবেসেছি। আর কাউকেই আমি ভালবাসিনি। চার্লিকে বিয়ে করেছিলাম – কারণ আমি তোমাকে আঘাত করতে চেয়েছিলাম! আমি তোমাকে এত ভালবাসি যে আমি তোমার কাছে থাকার জন্য পায়ে হেঁটে ভার্জিনিয়াতে চলে যেতে পারি! আমি তোমার জন্য রান্না করে দেব। তোমার বুট পালিশ করে দেব! তোমার ঘোড়ার পরিচর্যা করব! অ্যাশলে – একবার বল – তুমি আমাকে ভালবাস। আমি সারা জীবন শুধু ওই কথাটা জেনেই কাটিয়ে দিতে পারব!”
অ্যাশলে নিচু হয়ে পড়ে যাওয়া টুপিটা তুলে নিল। ওর মুখ দেখে স্কারলেট বুঝতে পারল যে ওর থেকে অসুখী মানুষ এই মুহুর্তে আর কেউ নেই। সেই উদাসীনতা উধাও হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারল অ্যাশলে ওকে ভালবাসে। লজ্জা আর হতাশায় নিজের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে।
“বিদায়,” ভগ্ন কণ্ঠে অ্যাশলে বলল।
দরজা খুলতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে ঘর ভরে দিল, পর্দা দুলে উঠল। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে স্কারলেট দেখল ও গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ম্লান শীতের সকালের আলোয় ওর তরবারি থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। ওর উত্তরীয়র প্রান্ত হাওয়ায় উড়ছে।
0 মন্তব্যসমূহ