অনুবাদ: নাহার তৃণা
মিসেস ম্যালার্ডের হৃদরোগ সমস্যা থাকায় আত্মীয় পরিজনেরা সিদ্ধান্ত নিলেন যতটা সম্ভব সর্তকতার সাথে, ধীরে সুস্হে স্বামীর মৃত্যুর খবরটা তাকে দেয়া হবে।
তাকে দুঃসংবাদটা জানানোর গুরু দায়িত্ব গিয়ে পড়ে ছোটো বোন জোসেফিনের উপর। জোসেফিন যথেষ্ট রাখঢাক করে, আকার ইঙ্গিতে বড়বোনকে খবরটা জানায়। স্বামীর বন্ধু রিচার্ডও তখন সেখানে উপস্হিত ছিলেন। রেল দুর্ঘটনার খবর যখন রেলরোড অফিসে তারবার্তার মাধ্যমে পৌঁছায় তখন রিচার্ড সেখানেই উপস্হিত ছিলেন।
খবরটা পেয়েই তিনি সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। বন্ধু ব্রেন্টলি ম্যালার্ডের নাম ছিল নিহতদের তালিকার সবার উপরে। খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে তিনি দ্বিতীয় টেলিগ্রামটা না আসা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেন; এরপর বন্ধুপত্নীর অসুস্হতার কথা মাথায় রেখে অন্য কারো মাধ্যমে হুট করে খবরটা পৌঁছানোর আগে নিজেই তড়িঘড়ি গিয়ে দুঃসংবাদটা পরিবারের অন্যান্যদের জানান।
খবরটা পেয়েই তিনি সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। বন্ধু ব্রেন্টলি ম্যালার্ডের নাম ছিল নিহতদের তালিকার সবার উপরে। খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে তিনি দ্বিতীয় টেলিগ্রামটা না আসা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেন; এরপর বন্ধুপত্নীর অসুস্হতার কথা মাথায় রেখে অন্য কারো মাধ্যমে হুট করে খবরটা পৌঁছানোর আগে নিজেই তড়িঘড়ি গিয়ে দুঃসংবাদটা পরিবারের অন্যান্যদের জানান।
হঠাৎ কোনো দুঃসংবাদ শুনে অনেকেই যেমন প্রচণ্ড রকমের অস্বাভাবিক আচরণ করেন, মিসেস ম্যালার্ড স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে তেমন কিছু করলেন না। জোসেফিনের মুখ থেকে খবরটা শোনার পরপর হঠাৎ এক বুনো অস্হিরতায় বোনের কাঁধ আঁকড়ে কিছু সময় নিয়ে কাঁদলেন। তারপর আকস্মিক ধেয়ে আসা শোকের ঝাপটা এবং কান্নার দমক কিছুটা থিতু হয়ে এলে ধীর পায়ে নিজের শোবার ঘরের দিকে রওনা দিলেন। যাবার আগে ঘরে উপস্হিত সবার উদ্দেশ্যে জানিয়ে গেলেন, এখন কিছু সময় তিনি একা থাকতে চান, কেউ যেন তাকে বিরক্ত করতে না আসে।
শোবার ঘরে এসে তিনি জানলামুখী তার প্রিয় আরাম চেয়ারটিতে গা এলিয়ে দিলেন। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল চরম অবসাদ আর ক্লান্তিতে তার শরীর-মন দুটোই যথেষ্ট জেরবার।
মিসেস ম্যালার্ড জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। গাছে গাছে বসন্তের ছোঁয়ায় জেগে ওঠা নতুন পাতাদের হুল্লোড়। বৃষ্টি ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তাজা গন্ধ। নীচে ফেরিওয়ালা নিজের পসরা বিক্রির তাগিদে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। দূরে বুঝি কেউ গান করছে, দূরাগত সেই সুর ক্ষীণভাবে ভেসে আসে তার কানে। ছাদের কার্নিশে খুনসুটিতে মগ্ন চড়ুইদের কিচিরমিচিরও শোনা যাচ্ছিলো।
এ ঘরের পশ্চিমমুখো জানলার পুরোটা জুড়ে আকাশ। সেখানে এখন মেঘের পরে মেঘ এসে জমেছে। ছেঁড়াখোঁড়া মেঘের আড়াল থেকে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে নীল আকাশ।
মিসেস ম্যালার্ড আরাম চেয়ারের কুশনে মাথা এলিয়ে প্রায় নিশ্চল হয়ে বসে ছিলেন। কেবল যখন কান্নার দমকটা বুকে চিড়ে উঠে আসছিল তখন তার শরীরে মৃদু একটা কাঁপন তৈরি হচ্ছিল, দৃশ্যটা দেখে মনে হতে পারে কোনো শিশু বুঝি ঘুমের ভেতর থেকে থেকে ফোঁপাচ্ছে।
খুব বেশি বয়স হয়নি মিসেস ম্যালার্ডের, তার শান্ত কমনীয় মুখটায় খুব সূক্ষ্ণ কিছু রেখার আভাস আছে বটে, তবে তাতে তাকে বয়স্ক না দেখায় না, বরং চেহারায় ফুটে থাকে একটা ধারালো আত্মবিশ্বাসের ছাপ। কিন্তু এখন কেমন একটা ভোতা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরের আকাশটার দিকে। তার সে দৃষ্টিতে কোনো ঔজ্জ্বল্য নেই বরং সেখানে ফুটে উঠেছে বোধবুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলার অসহায় একটা চিত্র।
গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। ঘটনাটা তখনই ঘটে গেলো। ব্যাপারটা যে কি! তিনিও ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না, বিষয়টা এতই সূক্ষ্ণ যে কোনো নামেও তাকে চিহ্নিত করা যায় না। অথচ তিনি সেটা সন্তর্পণে উপলদ্ধি করতে পারছিলেন নিজের ভেতর, আকাশের ওই নীলের ভেতর, এমনকি বাতাসের বয়ে আনা গন্ধ, বর্ণ আর শব্দের ভেতরও।
তিনি নিজের মধ্যে তীব্র এক আলোড়ন অনুভব করলেন। বুঝতে পারলেন যে অনুভূতিটা তাকে গ্রাস করতে চাইছে, নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে অচেনা অনুভূতিটাকে কাবু করার চেষ্টাও করলেন প্রাণপণ।
কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছিলেন তার ইচ্ছাশক্তি হেরে যাচ্ছে অনুভূতিটার কাছে। শেষমেশ নিজের ব্যর্থতা মেনে নিলেন সুবোধ বালিকার মতো। তখনই তার অবাধ্য ঠোঁট থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো কিছু শব্দ। গভীরভাবে শ্বাস নিতে নিতে তিনি বার বার উচ্চারণ করলেন: "আমি এখন মুক্ত! আমি স্বাধীন!"
তার চোখ-মুখ থেকে অস্বাভাবিকতা সরে গিয়ে সেখানে দেখা দেয় প্রাণের নতুন আভা, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার চোখজোড়া। শরীরময় উষ্ণ রক্তের ছোটাছুটিতে প্রাণ ফিরে এলো তার মধ্যে, এখন আর তাকে অতটা ক্লান্ত, অবসন্ন দেখাচ্ছিল না।
প্রশ্নটা নিজেকে না করেও পারলেন না মিসেস ম্যালার্ড। স্বামীর মৃত্যুকে সামনে রেখে এমন পৈশাচিক উচ্ছ্বাস কে কী বলা উচিৎ? অমানবিকতা? যদিও এমুহূর্তে সেসব ভাবনায় ডুবে থাকতেও খুব একটা রাজী নন তিনি। কারণ তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন কফিনে মোড়া স্বামীর নিথর শরীরটা দেখা মাত্র নিজেকে কোনো ভাবেই ধরে রাখতে পারবেন না। বুকের উপর ভাঁজ করা হাত দুটো নিয়ে অসাড় শুয়ে থাকা, ফ্যাকাশে, বিবর্ণ মুখের মৃত মানুষটা আর কোনো দাবী নিয়ে তার সামনে দাঁড়াবে না। তাই বলে তার জীবনও তো আর থেমে যাবে না! এই মুহূর্তের কঠিন বাস্তবতার ঘেরাটোপে জীবনটাকে আটকে রাখার পক্ষপাতী নন তিনি। সামনের অনাগত একলা থাকার দিনগুলো তিনি স্বাধীনভাবেই খরচ করবেন, ভাবনাটা তার ভেতর থেকে খারাপ লাগার অস্বস্তিটুকু মুছে দিলো। অনাগত ভবিষ্যতকে বুকে জড়াতে চাওয়ার একটা ভঙ্গি তুলে হাতদুটো সামনে মেলে ধরলেন তিনি।
অনাগত দিনগুলোতে তিনি শুধু নিজের জন্যই বাঁচবেন। দাম্পত্যের নামে যে সম্পর্ক নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়, সেরকম সম্পর্ক তার আর রইলো না কারো সাথে। ভালোই হলো একদিক থেকে। মনের বিরুদ্ধে গিয়েও অনেক সময় স্বামীর খুশিতে নিজেকে খুশি দেখানোর মিথ্যে ভণিতায় তাকে আর যেতে হবে না। স্বস্তির বৈকি বিষয়টা। দীর্ঘদিন যুগল জীবনে থাকার কারণে স্বামী নামের মানুষটার প্রতি তারও হয়ত ভালোবাসা জন্মেছিল। আবার মাঝে মধ্যেই তার মনে হতো এই মানুষটার প্রতি মোটেও কোনো ভালোবাসা নেই। এখন আর ওসবে কিস্যু যায় আসে না। তাছাড়া ভালোবাসা বিষয়টাই ভীষণ রহস্যময়, সে রহস্য নিয়ে এখন মাথা ঘামানোটাও বোকামি। এখন সব জটাজল থেকে তিনি স্বাধীন!
“ওহ! অবশেষে আমার শরীর-মন দুটোরই মুক্তি ঘটলো”, ফিসফিসিয়ে উঠলেন মিসেস ম্যালার্ড।
ওদিকে স্বামীর শোকে বড়বোন অসুস্হ হয়ে পড়েন কিনা সেটা নিয়ে চিন্তিত জোসেফিন দরজার বাইরে কান পেতে দাঁড়িয়ে বোনের উদ্দেশ্যে কাকুতি মিনতি করেই যাচ্ছিলো,
" দোহাই লাগে দরজা খোলো। এমন করো না লুইস, দরজা খোলো, এত কান্নাকাটি করলে অসুস্হ হয়ে পড়বে যে!"
"আহ্ যাও তো এখান থেকে! চিন্তার কিছু নেই, আমি ঠিক আছি।"
বোনের কথায় পাত্তার দেবার সময় কোথায় এখন মিসেস ম্যালার্ডের! আর অসুস্হ হওয়ার প্রশ্নও নেই, কারণ তিনি তখন খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে জীবনের অমৃত পানে মগ্ন।
মিসেস ম্যালার্ডের কল্পনার জগতে এক অপার্থিব আলোড়ন উঠলো আগামি দিনগুলোর কথা চিন্তা করে। সামনের দিনগুলো সে গ্রীষ্মেরই হোক কিংবা শীতের, সব তার একান্ত নিজের; কারো সাথে ভাগাভাগিতে যেতে হবে না তাকে। তিনি সেদিনগুলো উপভোগ করতে চান প্রাণভরে, সেই তাগিদে মনে মনে প্রার্থনা করতেও ভুললেন না, তিনি যেন দীর্ঘায়ুন হন।
নাছোড়বান্দা জোসেফিনের লাগাতার অনুরোধে শেষমেশ তিনি দরজা খুলে বিজয়িনীর মতো বোনের সামনে দাঁড়ালেন। তার চোখেমুখে আনন্দের ছটা উপচে পড়ছে, যেন তিনি বিরাট কোনো বাজি জিতে গেছেন। জোসেফিনের কোমর আঁকড়ে একসাথে দুবোন নীচে নেমে এলেন। রিচার্ড নীচে তাদের অপেক্ষায় ছিলেন।
তারা নীচে নেমে আসতেই দেখলেন কেউ একজন সদর দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকছে। হাতে ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে যে মানুষটা ঘরে এসে দাঁড়ালেন তিনি মিস্টার ব্রেণ্টলি ম্যালার্ড! ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে মাখামাখি তার গোটা অবায়ব। দুর্ঘটনার জায়গা থেকে তিনি অনেক দূরে ছিলেন। এমন একটা ঘটনা যে ঘটেছে, সে খবরও তার অজানা ছিলো। সময় মতো স্টেশনে পৌঁছাতে না পারায় তিনি তার নির্ধারিত ট্রেন মিস করেছিলেন।
জোসেফিনের গগণ বিদারী চিৎকার আর বন্ধু রিচার্ডের দ্রুত দৌঁড়ে মিসেস ম্যালার্ডের কাছে ছুটে যাওয়ার মাঝখানে কেমন কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মিস্টার ম্যালার্ড।
ডাক্তার আসার পর মিসেস ম্যালার্ডের মৃত্যুর কারণ জানা গেলো- হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কাটা তার দুর্বল হৃদযন্ত্র সহ্য করতে পারেনি। অতিরিক্ত আনন্দেও অনেকের মৃত্যু ঘটে!

লেখক পরিচিতি: কেইট শোপিনের( Kate Chopin )
আসল নাম ক্যাথরিন ও' ফ্লেয়ার্টি( Katherine O'Flaherty)। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৮৫০ সালে মিসৌরি রাজ্যের সেন্ট লইসে তিনি জন্মগ্রহন করেন। আমেরিকান সাহিত্য জগতের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে কেইট শোপিন সুপরিচিত। বোদ্ধামহলে তিনি বিশ শতকের প্রথম নারীবাদী লেখকদের একজন হিসেবে বিবেচিত। প্রায়শই আধুনিক নারীবাদী সাহিত্য আন্দোলন প্রবর্তনের কৃতিত্ব কেইট শোপিনের, এমনটা চর্চিত হতে দেখা যায়।
কেইট শোপিন একজন অসাধারণ মেধাবী এবং কব্জির জোরসমৃদ্ধ লেখক, যাঁর লেখায় ফরাসী কিংবদন্তী গল্পকার গী দ্য মোপাসাঁ(Guy de Maupassant)'র যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য এবং পাঠক নন্দিত উপন্যাস "দ্য অ্যাওয়েকিং"।
১৯০৪ সালের ২২ আগস্ট কেইট শোপিন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর ৫৪ বছর পরও তাঁর লেখা পাঠকের কাছে সমাদৃত এবং সমসাময়িক নানা ঘটনাপ্রবাহের সাথে একাত্ম হবার মতো আধুনিক।

অনুবাদক পরিচিতি
নাহার তৃণা
গল্পকার। অনুবাদক।
আমেরিকায় থাকেন।
2 মন্তব্যসমূহ
দিদি অনুবাদ খুব ভালো হয়েছে। কখনই মনে হয়নি অনুদিত গল্প পড়ছি।
উত্তরমুছুনদারুণ হয়েছে গো। তার চেয়েও বেশি অবাক করেছো। এই দিয়ে আমি একটা কাঁচা লেখা লিখেছিলাম। তাই আনন্দ অধিক হইলো।
উত্তরমুছুন