অনুবাদ: নাহার তৃণা
ম্যাডিসন স্ক্যায়ারের বেঞ্চটায় সোপি অস্হিরভাবে নড়েচড়ে বসলো। পাখিরা যখন দক্ষিণ দিকে উড়াল দেবার তোড়জোড় শুরু করে, নতুন পশমি কাপড়ের আশায় কিছু নারী যখন তাদের স্বামীদের অতিরিক্ত তোয়াজে ব্যস্ত হয়, আর ম্যাডিসন পার্কের বেঞ্চটাতে বসে থাকা সোপির মধ্যে যখন অস্হিরতা জেগে ওঠে তখন বুঝে নিতে হয় শীত আসছে।
টুপ করে মরা একটা পাতা পড়লো সোপির পায়ের উপর। সোপির জন্য এটা শীত এসে যাওয়ার বার্তা বিশেষ। সে বার্তায় পুরো ম্যাডিসন স্ক্যায়ারের বাসিন্দাদের প্রস্তুতির নেবারও একটা সংকেত থাকে। সোপি বুঝে যায় ম্যাডিসন স্ক্যায়ারের এই খোলা চত্বরে শীত জাঁকিয়ে বসবার আগেভাগেই প্রাণ বাঁচাবার জন্য তার একটা আশ্রয় চাই। সামনের দিনগুলোর চিন্তায় পার্কের বেঞ্চটায় স্হির হয়ে বসে থাকতে ব্যর্থ হয় সোপি।
আসন্ন শীত নিয়ে সোপির কোনো বিলাসী ভাবনা নেই। অবস্হাপন্নদের মতো শীতকালীন অবকাশ যাপনের জন্য জাহাজের পাল তুলে দেয়ার ভাবনাও তাই তার চিন্তায় থাকে না। আরো থাকে না দক্ষিণের আকাশমণ্ডলী কিংবা নেপলসের সমুদ্রতীর নিয়ে বিনোদনের পরিকল্পনা। শীতের তিন মাস ব্ল্যাকওয়েল দ্বীপের জেলের আশ্রয়টুকুই তার একমাত্র চাওয়া। দুবেলা খাওয়া, ঘুমানোর জন্য একটা বিছানা, শীতের কামড় থেকে বাঁচতে একটু উষ্ণতার নিশ্চয়তা আর পুলিশের হ্যাপা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দ্বীপের জেলঘরটাই তার নিশ্চিত আশ্রয়। আর ওই আশ্রয়টুকু তাবত পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর ভেতর সোপির সবচে' কাঙ্খিত চাওয়া।
বছরের পর বছর ধরে ব্ল্যাকওয়েল দ্বীপের জেলঘর তার শীতের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। নিউইর্য়কের অবস্হাপন্নেরা যেমন প্রতি বছর শীতে ফ্লোরিডা কিংবা ভূমধ্যসাগরের তীরের যাওয়ার ব্যাপক সব পরিকল্পনা করে, ঠিক সেভাবে সোপিও প্রতি বছর শীতের সময়টা ব্ল্যাকওয়েল দ্বীপে যাওয়ার ছুতো খুঁজে। সে সময়টা আবারও চলে এসেছে। তিন তিনটে খবরের কাগজ কোটের নীচে গায়ে আর পায়ে জড়িয়েও পার্কের বেঞ্চে শুয়ে গতরাতে শীতে কেঁপেছে সোপি। সে কারণে জেলের গুমটি কিন্তু ওর জন্য আরামদায়ক ঘরখানা সোপির ভাবনায় বার বার হানা দিয়ে যায়।
বিনে পয়সায় থাকা খাওয়ার জন্য শহরে বেশকিছু দাতব্যলয় আছে বটে, যেখানে গেলে সোপির একটা ব্যবস্হা হয়ে যায় দিব্যি। হাত পা ছড়িয়ে থাকার আরামদায়ক ব্যবস্হা আছে সেখানে, এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে ঘোরাফেরাতেও বাধা নেই। শীতভর সেখানে প্রয়োজন মতো সেবা শ্রুশুষাও মিলতো, কিন্তু সেসবে সোপির বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তার একমাত্র আরাধ্য ব্ল্যাকওয়েল দ্বীপের ছোট্ট জেলের ঘর।
দাতব্যলয়ে না যাওয়ার পেছনে সোপির মধ্যে একধরনের আত্মপ্রসাদ কাজ করতো। সে ভাবতো, যদি ওরকম কোনো একটা দাবত্যলয়ে তাকে যেতে হতো তবে কোনো না কোনো কাজ তাকে করতেই হবে। ফেলো কড়ি মাখো তেল, বিনে পয়সায় সেখানে দানছত্র খুলে বসেনি কেউ। মুখে কেউ টাকা চাইবে না তার কাছে। কিন্তু একহাতে সাহায্য দিয়ে অন্যহাতে ঠিকই আদায়ের পদ্ধতি বলবৎ ওসব জায়গাতে। তাদের ইচ্ছার দাস হয়ে কাটাতে হবে সেখানে। অনিচ্ছা সত্ত্বে সময় মতো গোসল করতে হবে..তাদের করা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পইপই করে জেনে নিতে চাইবে তার জীবনের আদ্যপ্রান্ত - যা সোপির ব্যাপক নাপছন্দ।
নাহ্। জেলের জীবন তারচে' ঢের ভালো। জেলে কিছু নিয়মকানুন মানতে হয় বটে, তবে সেখানে একজন মানুষের জীবনে খামোখাই কেউ নাক গলাতে আসেনা।
সোপি দ্বীপের জেল ঘরটাতে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো কাজে নামলো। তার জন্য অনেকগুলো সহজ পথ তার সামনে খোলা ছিলো। এর মধ্যে সবচে' সহজসাধ্যটা হলো, নামীদামী যে কোনো একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পেটপুরে রাতের খাবার খেয়েদেয়ে সটান বলে দেয়া পকেট ফাঁকা পয়সা দেবো কোত্থেকে! নামীদামী জায়গার ভাবসাবই অন্যরকম, তাই রেস্তোরাঁয় কোনো রকম সোরগোল ছাড়াই পুলিশের ডাক পড়বে। তারপর পুলিশ এসে তাকে গ্রেফ্তার করে বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাবে এবং বাকি কাজটুকু ম্যাজিস্ট্রেটই করে দেবেন।
কাজ হাসিলের উদ্দেশ্যে সোপি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়লো। ম্যাডিসন স্ক্যায়ার পেরিয়ে বিখ্যাত ব্রডওয়ে আর ফিফ্থ অ্যাভিনিউ যেখানে মিলেছে সেখানে এসে দাঁড়ালো। এ জায়গাটুকু পেরিয়ে ব্রডওয়ের উত্তরদিক ধরে হাঁটতে শুরু করলো। আলো ঝলমলে এক বিশাল রেস্তোরাঁর সামনে এসে থামলো সোপি। শহরের গণ্যমান্যরা এখানকার বিখ্যাত খাবার চাখার জন্য মনোরম সাজে প্রতি সন্ধ্যায় এই রেস্তোরাঁয় উপস্হিত হন।
সোপির মনে হলো তার প্যান্ট আর জুতোর হাল করুণ হলেও শরীরের উপরের অংশটুকু মোটামুটি চলনসই আছে। চুল, দাড়ি, মুখ সবই বেশ পরিচ্ছন্ন, পরনের কোটটাও মন্দ নয়। একবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছানো গেলেই কম্মো কাবার। টেবিলের উপর থেকে শরীরের যেটুকু দেখা যাবে তাতে তার দৈন্যদশা বেয়ারা ব্যাটার টের পাওয়ার কথা না। তারপর বেয়ারাকে পছন্দ মতো খাবার আনতে বললেই হবে। তাতেই সিদ্ধিলাভ।
রাতে কি কি খাওয়া যায় সেটা নিয়ে সোপি ভাবতে শুরু করলো। তার মানসপটে রাতের খাবার ভর্তি টেবিল ভেসে উঠলো। খাবারের দাম যেন খুব বেশি পড়ে না যায় সেদিকটাতেও খেয়াল রাখা দরকার, যেন বিরাট লোকসান পুষিয়ে নিতে রেস্তোরাঁর মালিক রেগেমেগে ভয়ানক কিছু করে বসার সুযোগ না পান। আবার একই সাথে তার শীতকালীন আশ্রয়ে যাওয়ার ব্যবস্হাও পাকা হয়।
রাতের খাওয়ার সুখ চিন্তা করতে করতে যেইমাত্র সোপি রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকতে যাবে অমনি হেড ওয়েটারের চোখ পড়ে যায় সোপির ছেঁড়াখোঁড়া জুতো আর হতদরিদ্র বেশবাসের দিকে। ব্যাটা যেন প্রস্তুতই ছিল, শক্ত হাতে দ্রুত সে সোপিকে রেস্তোরাঁর দিক থেকে ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে নিয়ে আসলো। বাধ্য ছেলের মতো সোপিও চুপচাপ সেখান থেকে সটকে পড়লো।
সোপি এবার ব্রডওয়ের বিপরীত দিকে হাঁটা দেয়। দ্বীপে তার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটা যত সহজ ভেবেছিল ভাবেচক্করে ততটা সহজ মনে হচ্ছে না এবার। সেজন্য অন্য কোনো ফন্দি আঁটতে হবে তাকে।
সিক্সথ অ্যাভিনিউয়ের কর্ণারে আলো ঝলমলে কাঁচঘেরা বিশাল এক দোকান দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সোপি। রাস্তা থেকে বড়সড় দেখে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো কাঁচ বরাবার। সশব্দে কাঁচ ভেঙে পড়লো, কোণাটা ঘিরে ছুটে আসা লোকের ভিড় জমে গেলো মুহূর্তেই। ছুটে আসা প্রথম লোকটা ছিলো একজন পুলিশ। সোপি কিন্তু সেখানেই অনড় দাঁড়িয়ে ছিলো, পুলিশটিকে দেখে তার ঠোঁটে হাসি ফুটলো।
"অপকর্মটা করে কোথায় সটকালো নচ্ছারটা?" কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলো পুলিশটি।
"তোমার কি মনে হয় না এই অপকর্মের পেছনে আমার হাত থাকতে পারে?" হাসিমাখা আন্তরিক গলায় বললো সোপি। সে তো চাইছিলই পুলিশটি তার দিকে ছুটে আসুক। কিন্তু পুলিশ বাবুটি তাকে পাত্তাই দিলো না। যে এমন অপরাধ করে সে নিশ্চয়ই বেকুবের মতো এখানে দাঁড়িয়ে পুলিশের সাথে কথা বলতে আসবে না। ঢিল ছোঁড়া মাত্রই সে প্রাণপণে দৌঁড়ে পালাবে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে ভেবে নিয়ে পুলিশটি সোপির কথার তোয়াক্কা করলো না। বরং রাস্তার অন্যপাশে ছুটন্ত একজনকে দেখতে পেয়ে তাকে ধাওয়া করতে ছুট লাগালো।
দু'বারের চেষ্টাই ব্যর্থ হলো সোপির, হতাশ মনে, ক্লান্ত পায়ে সে হাঁটা ধরলো।
রাস্তার অন্য পারে আরেকটা রেস্তোরাঁ দেখে থামতে হলো সোপিকে। এটা ব্রডওয়ের সেই রেস্তোরাঁর মতো অত ঠাঁটবাটের নয়। মাঝারি মানের রেস্তোরাঁ। সব ধরনের লোকই সেখানে অবাধে ঢুকতে পারে। রেস্তোরাঁর খাবার অবশ্য তেমন সুস্বাদু না। সোপি তার মলিন বেশবাস নিয়ে সটান ঢুকে পড়লো সেখানে। কেউ ভ্রুক্ষেপও করলো না। পছন্দ মতো একটা টেবিলে বসে সোপি কব্জি ডুবিয়ে খেলো। খাওয়া শেষ করে রেস্তোরাঁর মালিককে সপাটে জানালো টাকাপয়সার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই- অর্থাৎ তার পকেট গড়ের মাঠ।
"এক্ষুনি পুলিশে খবর দিন," সোফি তাদের বললো। " কোন ভদ্রলোককে অপেক্ষায় রাখতে নেই" খানিকটা তৃপ্তিমাখা গলায় যোগ করলো সে।
"এই সামান্য ব্যাপারে আবার পুলিশ কেন!" পাত্তা না দিয়ে বেয়ারাটি অন্য আরেকজন বেয়ারা কে আপদ বিদায়ের জন্য ডাকলো।
দুজন বেয়ারা এসে সোপিকে প্রায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিলো। এমন ভাবে রাস্তার উপর আছড়ে পড়লো, তাতে সোপি বাম কানে ভালোরকমের ব্যথা পেলেও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো না। কোঁকাতে, কোঁকাতে, জামা কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। গ্রেপ্তার হওয়াটা দেখছি ঝকমারি হয়ে যাচ্ছে। দ্বীপের জেল ঘরটার দূরত্ব যেন যোজন যোজন দূরের স্বপ্নে দেখা কিছু। ধারেকাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ সোপির বেহাল অবস্হা দেখে একটুকরো বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেলো।
আরো একবার গ্রেপ্তার হওয়ার ছুতো খুঁজতে খুঁজতে সোপি প্রায় আধমাইলের মতো হেঁটে ফেললো। কেন জানি তার মনে স্হির বিশ্বাস জন্মালো এবার তার চেষ্টা সফল হবেই হবে। এক সুন্দরী তরুণী একটা দোকানের কাঁচের শো কেসে কিছু দেখায় ব্যস্ত, এমন একটা দৃশ্য দেখে সোপি থমকে দাঁড়ালো। দোকানের পাশেই বিশালদেহী এক পুলিশ অফিসারকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে।
সোপির পরিকল্পনা তরুণীর সাথে যেচে গিয়ে আলাপ করা। মেয়েটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল আপাদমস্তক সে একজন ভদ্রনম্র মেয়ে, এ জাতীয় মেয়েরা সচরাচর অপরিচিত কারো সাথে আলাপে আগ্রহী হয় না। অতিরিক্ত গায়েপড়া ভাব দেখালে মেয়েটা পুলিশের সাহায্য চাইবে নিশ্চিত। আর তাতে সোপির কার্য সিদ্ধি হবে। পুলিশ এসে গ্যাঁক করে তাকে পাকড়াও করবে; ভাবতেই খুশির আবেশে আক্রান্ত হলো সে। ভাবনাটা তাকে ব্ল্যাকওয়েল দ্বীপের জেলঘরটার উষ্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে দিলো বুঝি।
সোপি তরুণীর কাছ ঘেষে দাঁড়ালো। তেড়ছা চোখে ইতিমধ্যে একবার দেখে নিয়েছে পুলিশ ব্যাটা তার দিকেই ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে আছে। মেয়েটা কয়েক পা সরে দাঁড়ালো, সোপি তাকে অনুসরণ করে ঠিক তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো , "শুভ সন্ধ্যা বালিকা! একা নাকি? এসো পার্কের চিপায় গিয়ে দুজনে খানিক ইটিশ পিটিশ করি"
পুলিশটা তখনও সোপির দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সোপি যেখানে যাবার জন্য এত কাঠখড় পোড়াচ্ছে তার জন্য পুলিশের উদ্দেশ্যে এখন শুধু তরুণীটির একটা হাত ইশারাই যথেষ্ট। সে এরইমধ্যে মনে মনে দ্বীপের ঘরটার উষ্ণ আমেজটুকু টের পেতে শুরু করেছে। ঠিক তখন তরুণীটি তার দিকে ফিরে আন্তরিকভাবে নিজের একটা হাত রাখলো সোপির কাঁধে। তারপর সোপিকে প্রায় অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো, "কেন নয় বন্ধু?", আনন্দ ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে, "তুমি যদি আমায় এক কাপ কফি খাওয়াতে তবে অবশ্যই তোমার সাথে কথা বলতাম, কিন্তু পুলিশ ভাইও যে এদিকে তাকিয়ে আছে।"
মেয়েটি সোপির হাত ধরে পুলিশের পাশ কাটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। মেজাজটা তেতো হয়ে গেলো সোপির। এত চেষ্টা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত সে গ্রেপ্তার হলো না, কাহিনি কী! এ জীবনে আর কী সে দ্বীপের জীবনের কাছাকাছি যেতে পারবে না! রাস্তার মোড়ের কাছাকাছি এসে সোপি মেয়েটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলো।
সোপি যেখানে এসে থামলো তার চারপাশে বেশ কিছু নাট্যশালা দেখতে পেলো। শহরের এ অংশের রাস্তাগুলো অন্যান্য অংশের চেয়ে তুলনামূলক আলোকজ্জ্বল, মানুষজনের মন ফুরফুরে আনন্দে ভরপুর। এদিককার বিশিষ্ট নারী পুরুষেরা তুলনামূলক ধোপদুরস্ত, আমুদে এবং শীতের মৃদুমন্দ আবহাওয়া উপভোগে অনেক বেশি আগ্রহী। এমন ভরপুর একটা পরিবেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সোপি হঠাৎ আতঙ্কগ্রস্হ হয়ে পড়লো। কোনো ব্যাটার ছেলে পুলিশ আর মনে হয় তাকে গ্রেপ্তার করতে আসবে না। তখনই নামকরা এক নাট্যশালার কাছে একজন পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সোপির মাথায় অন্য কিছু করার মতলব খেলে গেলো।
ফন্দি মাফিক সোপি গলা তুলে চেঁচাতে শুরু করলো, যেন বদ্ধ মাতাল সে। তার পক্ষে যতটা সম্ভব ততখানি গলা ছেড়ে চেঁচালো, হাসলো, নেচেকুঁদে অস্হির হলো। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটি এবার ওরদিকে ফিরে আশেপাশে থাকা মানুষদের আস্বস্ত করতে বলে উঠলো, " এ একজন সাধারণ কলেজ ছাত্র, কলেজকাপ জেতার আনন্দে ফূর্তিতে মেতেছে। কারো কোনো ক্ষতি করবে না সে, ভয়ের কিছু নেই, ছাত্রদের ফূর্তিতে বাঁধা দেবার হুকুম নেই আমাদের উপর।"
বুদ্ধিটা মাঠে মারা গেলো বুঝতে পেরে সোপি চেঁচানো বন্ধ করলো। আজ তার কপালটাই খারাপ। পুলিশেরা যেন পণ করেছে কেউ তাকে ছোঁবেই না। ব্ল্যাকওয়েল দ্বীপ যেন অধরা স্বপ্নের মতো তার স্পর্শের বাইরেই থেকে যাবে। সোপি পরনের পাতলা কোটটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো। কনকনে বাতাসের কামড় এই কোটের পক্ষে আটকানো বেশ কঠিন। হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের কাছে এসে সোপি দেখতে পেলো এক লোক পত্রিকা কেনায় ব্যস্ত, দরজার পাশে তার ছাতাখানা ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো আছে। সোপি টুকটুক করে দোকানে গিয়ে ঢুকলো, তারপর ছাতাখানা বগলদাবা করে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলো। লোকটা কিন্তু ঠিকই সোপির কাণ্ডখানা দেখেছে, সে দ্রুত সোপির পিছু নিলো।
"ও ভাই, ছাতাটা নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? ওটা যে আমার ছাতা!" পেছন থেকে বলে উঠলো লোকটা। "ওহ্ তাই নাকি!" সোপি বললো, "আপনার ছাতা নিয়ে পালাচ্ছিলাম দেখেও পুলিশ ডাকছেন না কেন মশাই? ওই তো কোণটাতে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, জলদি ডাকুন দেখি।" ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বলে উঠলো সোপি। সোপির কথায় লোকটার মধ্যে কোনো হেলদোল ঘটালো না, বরং কেমন একটু বিব্রত ভঙ্গিতে সে হাঁটার গতি খানিকটা কমিয়ে দিলো। সোপিও লোকটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজের গতি কমালো। তার মনটা কু গেয়ে উঠলো, আবারও তার চেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে। কোণটায় দাঁড়িয়ে পুলিশটা ওদের দুজনকে দেখছে। "আমি-" ছাতার মালিক ইতস্তত করলো কিছু বলতে গিয়ে "- ওটা হয়েছে কী- আসলে এসব কীভাবে যে ঘটে যায়- আমি... মানে ইয়ে... আমি দুঃখিত ছাতাটা যদি আপনার হয়ে থাকে নিয়ে যান দয়া করে। আসলে ওটা আমি সকালের দিকে এক রেস্তোরায় কুড়িয়ে পেয়েছি..."
"হ্যাঁ ছাতাটা আমারই বটে!" খরখরে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো সোপি। ছাতার কথিত মালিক ততক্ষণে পালিয়ে বেঁচেছে।
পুলিশটা এরই মধ্যে ওদের লক্ষ্য করা ছেড়ে রাস্তার উপর এক মহিলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেছে। সোপি এবার পূর্বদিক ধরে হাঁটতে শুরু করলো। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে তার। সে শরীরের সবটুকু শক্তি জড়ো করে হাতের ছাতাটা যতটা দূরে সম্ভব ছুঁড়ে ফেললো। এবার তার সব রাগ গিয়ে পড়লো পুলিশের উপর। ব্যাটারা একটাও সুবিধের নয়..যতবার সে গ্রেপ্তার হওয়ার চেষ্টা করেছে ততবারই সে যেন সাধু সন্ত, কোনো অন্যায় করা তার পক্ষে সম্ভব না, এমন ভাব দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটতে থাকলো সে। কপাল খারাপ হলে যা হয়, পার্কের বেঞ্চেই শীতের কামড় খেয়ে আজকের রাতটাও পার করতে হবে তাকে। ভাবতে ভাবতে শহরের পূর্বদিকের বেশ নির্জন একটা রাস্তায় এসে দাঁড়ালো সোপি। এখান থেকে বাঁক নিয়ে ম্যাডিসন স্ক্যায়ারের দক্ষিণ দিক ধরে আবার হাঁটা ধরলো। সে এখন বাড়িমুখো হচ্ছে, বাড়ি! হাহ্, পার্কের একটা বেঞ্চ যদিও একমাত্র সম্বল, আশ্রয়হীন মানুষের কাছে সেটাই বাড়ি বৈকি!
হাঁটতে হাঁটতে নির্জন একটা কোণে এসে সোপি থমকে দাঁড়ালো। পথের পাশে পুরোনো মন্দিরটার দিকে চোখ পড়লো তার। মন্দিরের জানলা ভেদ করে নরম আলোর রেখা এসে পড়েছে রাস্তায়। মন্দির থেকে ভেসে আসা মিষ্টি একটা সুর সোপির কানে এলো। সেখানেই সে কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। আকাশে ঝুলে থাকা চাঁদটা মায়াবী আলো ছড়াচ্ছে মাথার উপর, এ পথে লোকজনের খুব একটা চলাচল নেই বললেই চলে। আশেপাশে থাকা গাছের ডালে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ শুনতে পেলো সোপি। মন্দির থেকে ভেসে আসা প্রার্থনা সঙ্গীতের সুর তাকে কেমন জাপটে ধরলো, স্মৃতির আল ধরে সোপি পৌঁছে গেলো তার বিগত আনন্দমুখর দিনগুলোতে। যে জীবনে সোপির ঘর ভরা আনন্দ ছিলো, ছিলো মায়ের মমতা, ফুলের সুগন্ধ, সুন্দর ভাবনা, বন্ধুদের সান্নিন্ধ্য, স্বচ্ছলতা।
কিছু একটা ঘটে গেলো বুঝি সোপির মধ্যে। তার মনে হলো খুব সঠিক সময়ে সে পুরোনো এই মন্দিরটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অভূতপূর্ব এক অনুভূতিতে হঠাৎই যেন সোপির সমস্ত সত্তা আচ্ছন্ন হলো। সে অনুভব করলো হতাশার কোন চরমতম স্তরে এসে সে দাঁড়িয়েছে। আশা-আকাঙ্ক্ষাহীন উদ্বাস্তু এক জীবন তার। এটাই এখন তার পরিচয়। কোনোভাবে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকা- এটা মানুষের জীবন নাকি! নতুন এক আশায় চনমনিয়ে উঠতে চাইলো যেন সোপির ভেতরটা। ছিন্নমূল জীবনটাকে ভেঙেচুরে নতুন করে সাজানোর আগ্রহ টের পেলো নিজের ভেতর। তার মনে হলো, এই অসহ্য জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়াবে সে। মানুষের মতো করে বাঁচবার চেষ্টায় নামবে। এখনো সময় আছে, এখনো সে অতটা ফুরিয়ে যায়নি। চাইলে সে এখনো জীবনটাকে অর্থবোধক করে তুলতে পারে। আর মিথ্যা সময় অপচয়ে যাবে না সে। আর কোনো ভুল স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা নয়.. প্রার্থনা সঙ্গীতের মধুর স্পর্শে সোপি বুঝি জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেলো। এভাবে নিজেকে আবিষ্কারের এক অপার্থিব উচ্ছাসে সোপির ভেতরটা ভীষণভাবে নাড়া খেলো। একবার একজন তাকে একটা কাজ দিতে চেয়েছিল, কাল সকালেই তাকে খুঁজতে বের হবে। তার মনে হলো, এই অনাত্মীয় পৃথিবীর বুকে নিজের একটা পরিচয় সে ঠিক করে নিতে পারবে।
হঠাৎই কাঁধের উপর কারো হাতের ছোঁয়ায় ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে সোপি দেখলো থলথলে চেহারার এক পুলিশ অফিসার কখন যেন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সন্দেহভরা চোখে সোপিকে জিজ্ঞেস করলো পুলিশ, "এখানে ঘাপটি দিয়ে কী করা হচ্ছে শুনি?"
"কই কিছু না তো!" সোপি কেমন বিহবল ভাবে উত্তর দিলো।
"তুই্ও বললি, আর আমিও বিশ্বাস করলাম আর কী!" বাজখাই গলায় বলে উঠলো পুলিশ অফিসার।
নতুন অনুভবের উদ্যম নিয়ে সোপি পুলিশ অফিসারের ভুল ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিউইর্য়ক শহরের পুলিশের ভুল ভাঙাতে যাওয়াটা মস্ত বোকামি। সোপি সেটা করতে গিয়েই ধরাটা খেলো।
"চল তবে।" পুলিশটা তাকে উদ্দেশ্যে করে বললো।
পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুমে তিন মাসের সাজা দিয়ে সোপিকে দ্বীপের জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো।
লেখক পরিচিতি: ও হেনরি( O. Henry )
শুধুমাত্র মার্কিনমুলুকে নন বিশ্বজুড়েই একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক, সাহিত্যিক হিসেবে আদৃত। ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার(William Sydney Porter)। অলিভার হেনরি ছদ্মনামে তিনি সাহিত্য জীবনের প্রথমার্ধে লেখালেখি করেন। ও হেনরি নামটা পাঠক প্রিয়তা লাভ করলে সে নামেই বাকিজীবন লিখে গেছেন। হাস্যরস, বিশেষ ধরনের চরিত্রায়ন এবং গল্পের শেষ চমকের জন্য বিশ্বসাহিত্যে তাঁর বিশেষ সুখ্যাতি এবং স্হায়ী একটা জায়গা আছে। যা আজও পাঠকের কাছে সমাদৃত। তিনি আমেরিকান জীবনযাপন নিয়ে ছয়শ' গল্প লিখেছেন। জীবনের লক্ষ্য স্হির না থাকায় অর্থাৎ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে বহুবিধ এবং বিচিত্র ধরনের সব কাজ জীবিকা অর্জনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। আঁকাআঁকি এবং সঙ্গীতেও তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিলো।তিনি চমৎকার গিটার এবং ম্যান্ডোলিন বাজাতে জানতেন। তাঁর জীবনটা বেশ নাটকীয়তা ভরপুর ছিলো।
তাঁর প্রথম গল্প সংকলনের নাম "ক্যাবাজেস এ্যান্ড কিংস" (১৯০৪)। নিউইয়র্কে থাকাকালে ৩৮১টির মতো গল্প লেখেন। দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গল্প সংকলন “দ্য ফোর মিলিয়ন"। বিখ্যাত গল্প 'দ্য গিফট অব ম্যাজাই’, ‘দ্য স্কাইলাইট রুম’ ও ‘দ্য গ্রিন ডোর’ এই সংকলনে স্হান পেয়েছিল। পাঠকপ্রিয় অন্যান্য সংকলনের মধ্যে আছে ‘রোডস টু ডেস্টিনি’ ও ‘সিক্সেস এ্যান্ড সেভেনস’। সংকলেনর সব গল্পগুলো তাঁর সমকালকেই ধারণ করে। অধিকাংশ গল্পের চরিত্র সমাজের নিচুতলার মানুষ। তাদের নিঃসঙ্গতা, জীবনের বাস্তবতা তিনি তাঁর গল্পে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা শুধুমাত্র সাহিত্য হিসেবেই পাঠকের কাছে সমাদর পেয়েছে তা নয়, বহুদেশে তাঁর গল্প পাঠ্যক্রমে স্হান করে নিয়েছে। বহুভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর গল্প। বেশকিছু গল্পের চলচ্চিত্রায়ণও হয়েছে। ১৯১০ সালের ৫ জুন নিউ ইয়র্ক সিটিতে ও হেনরি মৃত্যুবরণ করেন।
0 মন্তব্যসমূহ