
ডেথ অব ইভান ইলিচ রুশ ও মেটামরফোসিস বড়গল্পদুটির রচয়িতা বিশ্বসাহিত্যের দুই দিকপাল--লেভ তলস্তয় ও ফ্রানৎস কাফকা। রচনাকালের মধ্যবর্তী ব্যবধান প্রায় তিন দশক। দুটি গল্পের সেটিংয়ে এমন অমিল সত্ত্বেও বহু ধরনের অন্তমিল বই দুটিকে একসঙ্গে আলোচনার পথ সুগম করে দেয়। দুটিরই গল্প শুরু হয় এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। দুটিই নৈরাশ্যবাদী গল্প। ডেথ অব ইভান ইলিচ শুরু হয় এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইভান ইলিচের মৃত্যু আর মেটামরফোসিস শুরু হয় এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রেগর সামসার দৈহিক পরিবর্তন অর্থাৎ মানুষ থেকে পোকা হওয়ার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ গল্পদুটির শুরুতেই যেন ক্লাইমেক্স বা চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে গেল!
গল্পদুটি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজবাস্তবতার ভীষণ সিরিয়াস বিষয় নিয়ে রচিত হলেও লেখকদ্বয়ের বলার স্বর খুবই সরল ও স্বাভাবিক। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা নামের এক ব্যক্তির পোকা বনে যাওয়ার ঘটনাটি যেন সিঁড়ি থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পাওয়ার মতো অতি সাধারণ একটি ঘটনা! অন্তত কাফকা যেভাবে As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams he found himself transformed in his bed into a gigantic insect --তাতে তাই মনে হয়। আধুনিক সাহিত্যে এর চেয়ে ভয়ংকর বাক্য দ্বিতীয়টি নেই বলে স্বীকার করে নিয়েছেন সমালোচকরা। এই বাক্য পড়েই তরুণ বয়সে বিছানা থেকে উঠে বসেছিলেন কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। অন্যদিকে ডেথ অব ইভান ইলিচ-এও আমরা দেখি, শুরুতেই একটি দৈনিকে ইভান ইলিচের মৃত্যুসংবাদ পড়ছে তার অতি কাছের বন্ধুরা। আর পাঁচটা খবর পড়ে আলোচনা করার মতোই তারা ইভান ইলিচের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কেউ কেউ ইভান ইলিচের মৃত্যুতে তার কর্মস্থলে সৃষ্টি হওয়া শূন্যপদে কাকে বসানো যায় সে প্রসঙ্গও টেনে আনে। এভাবেই দুটি গল্পেই একটি সরল আখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি মানবজীবনের গাঢ় ও গূঢ় রহস্যের মধ্যে। এক্ষেত্রে দুটি গল্পেই স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত আয়রনির প্রয়োগ হয়েছে, বলা চলে। কেননা আখ্যানভাগ অতি সরল বা ফ্লাট মনে হলেও বিষয়বস্তু মোটেও তা নয়। পরবর্তীকালে এ দুই লেখকের অনুজ কথাসাহিত্যিক জোনাথন সুইফট একই টেকনিক অবলম্বন করে রচনা করেন ননফিকশন বা প্রবন্ধ--অ্যা মডেস্ট প্রোপোজাল।
দুটি গল্পেরই নামকরণ করা হয়েছে সরলভাবে। নাম থেকেই বিষয়বস্তু আঁচ করা যায়। অর্থাৎ ডেথ অব ইভান ইলিচের নাম থেকেই সাধারণভাবে আন্দাজ করা যায়--কাহিনির কোথাও, বিশেষ করে শেষের দিকে, ইভান ইলিচের মৃত্যু ঘটবে। এবং সেটিই এই গল্পের প্রধান বিষয়। মেটামরফোসিস-এও তদরূপ বোঝা যায়--গল্পের কোথাও রূপান্তরের ঘটনা আছে এবং এই রূপান্তরকে কেন্দ্র করেই গল্পটি। কিন্তু আন্দাজ করা মূল বিষয় দুটিই দুই গল্পের প্রারম্ভিকে ঘটে যায় এবং গল্পকথকদ্বয় এমনভাবে তা তুলে ধরেন যে, সেটি আর আদৌ মূল বিষয় থাকে না। মূল চরিত্রের মৃত্যু কিংবা পোকায় রূপান্তর হওয়ার ঘটনাটি তখন আর মুখ্য নয়, মুখ্য অন্য কিছু। তবে সেটি কী তা জানার জন্য বাকিটা পড়ে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত দুই ভাষা ও কালের দুই মাস্টার কথাশিল্পী জীবন সম্পর্কে তাঁদের যে ক্রিটিক্যাল ভিউ সেটি তুলে আনেন। ইভান ইলিচের জীবদ্দশায় কিংবা গ্রেগর সামসার পোকা-পূর্ব জীবনে থেকে তাদের সামাজিক অবস্থানটা যতটা না বোঝা যায় তার চেয়েও বেশি বোঝা যায় তাদের মৃত্যু কিংবা পরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে।
দুই
ফ্ল্যাশব্যাকে তলস্তয় আমাদেরকে ইভান ইলিচের অতীত জীবনে নিয়ে যান। এখানে তিনি একটা কথা দিয়েই ইভান ইলিচের জীবন সম্পর্কে তাঁর বোঝাপড়া বা স্টাডি অনেকখানি পরিষ্কার করে তোলেন--[...] most simple and most ordinary and therefore most terrible. ইভান ইলিচ তার সমস্ত জীবনব্যাপী প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ধ্যানে-জ্ঞানে সুখী হতে চেয়েছিল। সে তার বাবার তৃতীয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়জন--প্রথমজনের মতো অত ভদ্র-শান্ত নয় আবার ছোটজনের মতো অত অভদ্র-অশান্ত নয়। তেরো বছর বয়সে সে আইনের স্কুলে ভর্তি হয়, একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে সেখানকার নিয়মকানুন মেনে চলে। সমাজের আরোপিত কোনো নিয়মের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা সে করেনি। সে পোশাক পরেছে, খাবার খেয়েছে--সবই প্রচলিত নিয়মে। বিয়ে করেছে প্রচলিত বিশ্বাসে। তার সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে; কারণ সমাজে একজন সুখী মানুষের এসব থাকে। আরো যা থাকে তা হলো সুন্দর একটা বাড়ি। ইভান টাকা জমিয়ে খুব সুন্দর একটা বাড়ি করার পেছনে যথেষ্ট শ্রম দিয়েছে। বিবাহের কিছু বছর পর ইভান বুঝতে পারে, বিবাহ সম্পর্কে তথাকথিত যে ধারণা-- Conducive to the pleasures and amenities of life, তা সবসময় ঘটে না। দাম্পত্য অশান্তির কারণে সে আরো বেশি কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। সমাজ-স্বীকৃত জীবনযাপন করার জন্য স্ত্রীর সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা সম্পর্ক বজায় রাখে। এমনিভাবে তলস্তয় ইভান ইলিচকে খুব সাধারণভাবে একটি সমাজের মেজরিটি বা সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ইভান হয়ে উঠেছে একটি সমাজের Everyman। ইভান তৎকালীন রাশিয়ার পুঁজিবাদী সমাজের মস্ত হাতিয়ার। সমাজের উঁচু শ্রেণি থেকে নির্ধারিত জীবনকে সত্য বলে মেনে চলেছে সারাটা জীবন। তলস্তয় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে উঁচু শ্রেণির সম্পর্ককে মেটাফোর হিসেবে দেখিয়েছেন-- ...that of a fly being drawn to a bright light. একটি মাছি যেমন আলোর মায়াতে তার কাছে ছুটে যায় এবং সেখানে পৌঁছানো মাত্র মারা পড়ে। তেমনি ইভান ইলিচ জীবন ভেবে যে জীবনের পেছনে ছুটে চলে সেই জীবনই তাকে জীবিত থেকেও মৃতের স্বাদ এনে দেয়।
ইভানের মতো গ্রেগরও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সেলসম্যানের চাকরি করে সে। যদিও চাকরিটা তার মোটেও ভালো লাগে না, তথাপি পরিবারের কথা ভেবে ছাড়তেও পারে না। প্রতিনিয়ত নিজের মনের সঙ্গে আপস করে বেঁচে থাকতে হয় গ্রেগরকে। আপস করতে হয় অফিসের বস, পরিবার ও সমাজের সঙ্গেও। আপস করতে করতে একসময় গ্রেগর হারিয়ে ফেলে তার মানবিক সত্তাকে। তার দৈহিক পরিবর্তনটা তারই চূড়ান্ত প্রতিফলন। গ্রেগরের অফিসে যেতে এক ঘণ্টা দেরি হওয়ায় অফিসের বস গ্রেগরের খোঁজ নিতে বাড়ি আসে--অর্থকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় গ্রেগরের প্রতি ঘণ্টা বিক্রি হয়ে যায় টাকার কাছে। অতিরিক্ত এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়া মানেই বাণিজ্য থেকে এক ঘণ্টা দূরে থাকা। গ্রেগরের দরজা খুলতে দেরি হলে গ্রেগরের মা বসকে বোঝায়--গ্রেগর সারাদিন কাজের মধ্যেই থাকে, এমনকি সন্ধ্যায়ও বাইরে যায় না। গ্রেগরের পোকা হয়ে যাওয়ার পর পরিবার কিংবা সমাজের আর কোনো কাজে লাগে না সে। ফলে সে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আপাতদৃষ্টিতে ডেথ অব ইভান ইলিচ হচ্ছে ইভান ইলিচ এবং মেটামরফোসিস হচ্ছে গ্রেগর সামসা নামের খুব সাধারণ দুজন মানুষের গল্প। কিন্তু অ্যাঙ্গেলস ও মার্কসের ‘ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ পাঠসাপেক্ষ জানা যায়, গল্প দুটি আধুনিক পুঁজিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার মেটাফোরিক উপস্থাপন। ইভান আর গ্রেগর হচ্ছে এখানে শ্রমিক শ্রেণি বা proletariat আর অফিসের বসরা হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি। পুঁজিকেন্দ্রিক সমাজে একটা মানুষের পরিচয় ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় তার উৎপাদনক্ষমতার ভিত্তিতে। তাই কাজ করতে করতে তারা ভুলে যায় তাদের মানবিক অস্তিত্বের কথা। তৎকালীন পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও নীতিকে চরম সত্য জেনে পরম মমতায় লালন করেছে ইভান ইলিচ ও গ্রেগর সামসা। নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসে সমাজের চোখে সুখী হতে চেয়েছে তারা। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর তারা প্রচলিত সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নিজ নিজ সত্তার কাছে। সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আবিষ্কার করেছে ওই সমাজকে--যে সমাজে কাজ না থাকলে কাছের মানুষগুলো অচেনা হয়ে যায়, বাতিল হয় সমাজের সদস্যপদ।
তিন
ইভান ইলিচের মৃত্যুসংবাদ শুনে তার সহকারী বন্ধুদের মাথায় প্রথমেই যে চিন্তাটি আসে তা হলো--ইভান ইলিচের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট খালি পদে কাকে নিযুক্ত করা যায়। বন্ধু হারানোর শোক নয়, পদোন্নতি তাদের আলোচনার প্রাথমিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্য যে বিষয়টি তাদের মধ্যে স্বস্তি এনে দেয়, তা হলো--‘ It is he who is dead and not I. ইভান ইলিচের বন্ধুরা তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যায়, যেতে হয় তাই। এটা তাদের কাছে কেবলই একটা Ritual. ইভান ইলিচের স্ত্রী প্রাসকোভইয়া ফেদেরোভনা স্বামীর মৃতদেহ এক ঘরে রেখে অন্য ঘরে ইভান ইলিচের সবচেয়ে কাছের বন্ধু পিটার ইভানোভিচের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে তার পেনশনের টাকার পরিমাণটা বাড়ানো যায় এবং কোন কবরস্থানের জমির দাম অপেক্ষাকৃত কম এই বিষয় নিয়ে।
ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায়, ইভান যখন অসুস্থ ছিল তখন স্ত্রী-কন্যা রুটিন করে তার রুমে প্রবেশ করত। ইভান ইলিচের বেঁচে থাকা তাদের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইভান ইলিচের আত্মজিজ্ঞাসার জায়গাটা কেউই অনুভব করতে পারে না। এমনকি ডাক্তারও ইভান ইলিচকে যন্ত্রের মতো দেখে চলে যায়। ইভান ইলিচ বুঝতে পারে, তাকে কেউই বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাচ্ছে না। সবার কাছে ইভান ইলিচের অসুস্থতা এবং সুস্থ থাকা সমানভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। পরিবারের সবার ধারণা, এই রোগের জন্য ইভান নিজেই দায়ী এবং নিয়মিত ওষুধ সেবনে সেরে উঠবে সে। ফলে ইভান ইলিচের শারীরিক সমস্যার থেকেও ভয়ংকর হয়ে ওঠে তার মানসিক সমস্যা। তার স্ত্রী-কন্যা তাকে অসুস্থ রেখে সাজসজ্জা করে থিয়েটারে যায়। ইভান ইলিচের তখন মনে হয়, এই পৃথিবীটা হচ্ছে একটা থিয়েটার। এখানে চারপাশের সবাই অভিনয় করে চলেছে এবং তাদের জগৎটা হচ্ছে-Mesh of falsity। এবং আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই, এই তথাকথিত প্রগ্রেসিভ সভ্যতার মিথ্যা ও কৃত্রিমতা ইভান ইলিচের মৃত্যুর জন্য দায়ী। মানবজীবনের প্রকৃত সত্যটা অনুভব করতে থাকে ইভান ইলিচ। সে একসময় উপলব্ধি করে, ...Illness is not a question of health or sickness, but of life or death.
অন্যদিকে গ্রেগর সামসা পোকা হয়ে গেলে তার চারপাশের স্বার্থপর মানুষগুলোর চেহারা পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়। মা-বাবা-বোন--এই নিয়ে গ্রেগরের পরিবার। পোকা হওয়ার আগ পর্যন্ত আর পাঁচটা সুখী পরিবারের মতোই ছিল সব। আর গ্রেগরের দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা আয়ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটল পরিবারের অন্যদের আচরণের। বাবা আপেল ছুড়ে গ্রেগরকে ঘরের ভেতর থাকার ইঙ্গিত দেয়, মা গ্রেগরকে দেখলে ভয়ে মূর্ছা যায়, বোন প্রথমদিকে গ্রেগরের খাবারদাবারের দিকে খেয়াল রাখলেও পরে আর রাখে না। গ্রেগরের ব্যবহার্য কোনো কিছু কেউ স্পর্শ করে না। আপাতদৃষ্টিতে গ্রেগর পোকা হয়ে যায় বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মনুষ্য গুণাবলি হারায় না বরং আশপাশের মানুষরাই আপাতদৃষ্টিতে ঠিক থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারাই মনুষ্য গুণাবলি হারিয়ে পোকা হয়ে যায়। এটাই আপাত বাস্তবতার চরম আয়রনি। গ্রেগর যখন পশুর মতো খাটুনি খেটে সংসার চালাত, বাবার ঋণের টাকা পরিশোধ করত তখন পরিবারের আর সবাই আয়েশ করে দিনযাপন করত। আর গ্রেগর যেইমাত্র কাজ হারাল তখন তাকে ছুড়ে ফেলা হলো আবদ্ধ কক্ষে। পরিবারের সকলের কাছে গ্রেগরের মৃত্যু হয়ে উঠল একমাত্র কাম্য। আস্তে আস্তে গ্রেগরের রুম থেকে আসবাবপত্র বের করে নেওয়া হলো। বানানো হলো স্টোররুম।
চার
আফিমের ঘোরে যখন ইভানের শারীরিক যন্ত্রণা কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়ায় তখন ইভান স্বপ্ন দেখে, তাকে একটি গভীর কালো বস্তার ভেতর ঠেলে ঢোকানো হচ্ছে। সে ওই অন্ধকারে পতিত হওয়ার কামনা যেমন করে তেমন ভয়ও করে। যেন সে সাহায্য ও সহযোগিতা দুটোই করে। ঘুম ভেঙে গেলে সে কাঁদতে কাঁদতে ঈশ্বরকে , Why has't Thou done all this? Why have Thou brought me here? Why, why dost Thou torment me so terribly? তারপর সে নীরব হয়ে যায়, তার ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, What is it you want? ইভান উত্তর দেয়, সে ভালোভাবে এবং শান্তিতে বাস করতে চায়, যেমনটি সে সারাজীবন করে আসছে। অতঃপর সে তার অতীত জীবনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অনুভব করে, যত বেশি সে তার বাল্যকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তত বেশি হতাশ হয়ে পড়েছে আর মূল্যহীন হয়ে উঠেছে তার জীবন।
ইভানের স্বপ্নের কালো বস্তাকে যদি কবর বা মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সে মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করছে, আবার তীব্রভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আবার গভীর বস্তাটিকে যদি মাতৃগর্ভের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, চিন্তা-চেতনার জগতে ইভানের পুনর্জন্ম হচ্ছে। বস্তায় প্রবেশ মুহূর্তে যে যন্ত্রণা সে অনুভব করছে তা হলো জন্মমুহূর্তের যন্ত্রণা। যেটাকে ইভান ইলিচের মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে, সেটা আসলে তার দৈহিক মৃত্যু ও আত্মার বা অধ্যাত্মবোধের পুনর্জন্ম।
ইভান তার নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করে, Life, a series of increasing sufferings, flies further and further towards its end-the most terrible suffering. সে এখন খতিয়ে দেখতে চায়-- what it is all for.জীবনের সমস্ত অধ্যায় ঘেঁটে ঘেঁটে মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে ইভান বুঝতে পারে, তার সমস্ত জীবন ধরে সে যা সঠিক বলে মান্য ও গণ্য করেছে তা সবই ছিল ভুল। সে ছিল সুখী--সমাজের চোখে এবং সে সেটাই হতে চেয়েছিল। ইভানের অধ্যাত্মবোধ যখন ম্যাটেরিয়াল বা পুঁজিকেন্দ্রিক জগৎকে অতিক্রম করে যায়, তখন সে মৃত্যুকে জয় করে নতুন জীবন অর্জন করে এবং এই মুহূর্তে যখন সে নিজেকে প্রশ্ন করে-- What is the right thing? ঠিক তখনই তার একটি হাত তার ছেলে ভাসয়ার মাথা স্পর্শ করে। ভাসয়ার মধ্যে ইভান তার বাল্যকালের অবয়ব দেখতে পায়, সে তার জন্য দুঃখ অনুভব করে এবং তার কাছে ক্ষমা চায়। মানুষের ফিজিক্যাল সংস্পর্শে এসে ইভান অনুভব করে, সমস্ত জীবনব্যাপী সে শুধু নিজের চারপাশে একটি দেয়াল স্থাপন করে এসেছে, সরে গেছে অর্থপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক থেকে। যখন সে মানবজীবনের প্রকৃতি বা The truth of life and deathউদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয় তখনই তার পুনর্জন্ম হয়--সে মারা যায় শান্তিপূর্ণভাবে।
মেটামরফোসিসের প্রথম বাক্যেই গ্রেগর সামসার মৃত্যু ঘোষিত হয় এবং গল্পজুড়ে সে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। ইভান ইলিচের মতো গ্রেগর সামসাও মৃত্যুচিন্তার সঙ্গে লড়াই করে চলে প্রতিনিয়ত। সমালোচক মার্টিন গ্রিনবার্গের মতে, Tolstoy’s work is about death literally and existentially; Kafka’s is about death in life. যতক্ষণ না ইভান ইলিচ তার যাপিত জীবনকে মিথ্যা বলে মেনে নেয় এবং স্বীকার করে এটা যেমনটি হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি, ততক্ষণ সে তার আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে সজাগ হতে পারে না। শেষ মুহূর্তে সে আবিষ্কার করে--জীবন ও মৃত্যুর সত্য। তারপর তার মৃত্যু ঘটে। গ্রেগর সামসার ক্ষেত্রে, জীবিত থেকেও সে মৃত সুতরাং মুক্তি মেলে না সহজে। সকালে উঠে গ্রেগর তার যে অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে সেটাই হচ্ছে তার ক্ষেত্রে-- The truth of life and death. এ ক্ষেত্রে, The dream reveals the reality কথাটি উভয়ের ক্ষেত্রে সত্য বলে খাটে।
পাঁচ
চলতি শতকে আমরা দেখছি মানুষ বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। শিল্প বিপ্লব ও বিজ্ঞানের উন্নতির চূড়ান্ত পর্বে আমরা উপস্থিত--মানব প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব-প্রকৃতির এক চরম বিপর্যয় টের পাচ্ছি। মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের সঙ্গে হয়ে উঠছে আমাদের আত্মার আত্মীয়তা। আমরা প্রতিনিয়ত গ্রেগর সামসার মতো পোকা হয়ে যাচ্ছি আমাদের অজান্তেই। ইভান ইলিচের মতো সমাজের প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিটকে পড়ছি আপন সত্তা থেকে। এই সংকটময় অবস্থায় ইভান ইলিচ ও গ্রেগর সামসার জীবনপাঠ আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
লেখক পরিচিতি
মোজাফ্ফর হোসেন
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
ঢাকায় থাকেন
লেখক পরিচিতি
মোজাফ্ফর হোসেন
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
ঢাকায় থাকেন
0 মন্তব্যসমূহ