গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প : নিদ্রিতা সুন্দরীও একটি অ্যারোপ্লেন

অনুবাদ : তুষার তালুকদার

নমনীয় এক সৌন্দর্য ছিল তার পুরো অঙ্গে। স্নিগ্ধ ত্বকে পাউরুটির মতো তুলতুলে আমেজ ও পটলচেরা চোখের চাহনির গভীরে আমি তা দেখেছি। সেই সঙ্গে কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া সোজা কালো চুলে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের ঢেউ খেলছিল। হয়তো ইন্দোনেশিয়া বা আন্দিনের মতো প্রাচীন সে সৌন্দর্য, তবে মহাকালিক। তার পরিধেয় প্রতিটি পোশাকে ছিল সূক্ষ্ম রুচির পরিচয়-লিনেক্স (বনবিড়ালের চামড়া) জ্যাকেট, সূক্ষ্ম ফুল অঙ্কিত ঢিলেঢালা সিল্কের ব্লাউজ, লিনেন কাপড়ের ট্রাউজার আর বাগানবিলাস রঙের ছোট ছোট ডোরাকাটা জুতা। আমি প্যারিসের চার্লস ডি গল বিমানবন্দরের চেকলাইনে অপেক্ষা করছিলাম। আর ঠিক তখনই আমি তাকে দেখলাম, সিংহীর মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে। আমার মন তখন অবচেতনভাবেই বলে উঠল, 'এ পর্যন্ত দেখা সকল মেয়ের মধ্যে তুমি সবচেয়ে সুন্দর'। ঠিক অতিপ্রাকৃত কোনো আত্মা ওই মূহূর্তের জন্য এল আর চোখের নিমিষে টার্মিনালের ভিড়ে হারিয়ে গেল।

তখন সকাল ন'টা। সারারাত বরফ পড়ার কারণে সকালের দিকে রাস্তায় যানবাহন তুলনামূলক বেশিই ছিল। হাইওয়েগুলোতে গাড়ির গতি ছিল বেশ ধীর। রাস্তার দু'পাশে ট্রাকগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। বরফ ঝরার আধিক্যে অটোমোবাইলগুলোও নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তবে টার্মিনালের ভেতরের আবহাওয়াটা বসন্তের মেজাজেই ছিল।

আমি একজন ডাচ ভদ্রমহিলার পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। বয়ে আনা এগারোটা স্যুটকেস নিয়ে তিনি কথা কাটাকাটি করছিলেন। এতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পার হয়ে যায়। আমি কিছুটা বিরক্তই হচ্ছিলাম। কিন্তু অতিপ্রাকৃত সুন্দরী ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই ডাচ ভদ্রমহিলার ঝগড়ার নিষ্পত্তির ঘটনাটা আমি বলতে পারব না। তবে টিকিট চেকারের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে আমি স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছিলাম। আর স্বপ্নটাকে পাশ কাটাতে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় তিনি বিশ্বাস করেন কি না। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, 'অবশ্যই, বরং এ ছাড়া অন্য কিছু অসম্ভব'। আমার সঙ্গে কথা বলার সময়টুকুতে তার চোখ কম্পিউটারের পর্দায়ই নিবিষ্ট ছিল। ঠিক সেভাবেই তিনি আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে তাতে বসতে বললেন। সঙ্গে এও জানালেন যে, ইচ্ছে করলে ধূমপান করতেও আমি তা ব্যবহার করতে পারি। প্রত্যুত্তরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষের সুরেই বললাম, 'যতক্ষণ পর্যন্ত এগারো স্যুটকেস বহনকারী ভদ্রমহিলার পেছনে আছি, এটা কোনো ব্যাপার নয়'।

আমার কথায় তিনি একটু প্রশংসাসূচক বাণিজ্যিক হাসি হাসলেন, তবে পর্দার ওপর থেকে চোখ সরালেন না।

এরপর তিনি আমাকে বললেন, 'তিন, চার বা সাতের মধ্যে যেকোনো একটা সিট নাম্বার পছন্দ করুন'।

আমি বললাম, 'চার'।

ক্ষণিকের জন্য দেখলাম তার হাসিটা দীপ্তিময় হয়ে উঠল। তিনি বললেন, 'আমার পনেরো বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো আপনাকে পেলাম যিনি সাত নাম্বার সিট পছন্দ করেননি'।

বোর্ডিং পাসে আমার সিট নাম্বার লিখে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে তিনি আমাকে তা ফিরিয়ে দিলেন। আর একমাত্র তখনই পিঙ্গল চোখে আমার দিকে তাকান তিনি। সেই অতিপ্রাকৃত সুন্দরীকে পুনরায় দেখার আগ পর্যন্ত এই দৃষ্টিই ছিল আমার সান্ত্বনা। তখন আমি আরও জানতে পারি যে বিমানবন্দরের সকল ফ্লাইট দেরিতে যাত্রা করবে।

'কতক্ষণ লাগতে পারে?'

আমার প্রশ্নের উত্তরে একটা মুচকি হাসি দিয়ে তিনি বললেন, 'ঈশ্বর জানেন'। তবে রেডিওতে বলা হচ্ছে, এ বছরের সবচেয়ে বড় তুষার ঝড় আজ সকালে হচ্ছে।'

আসলে তথ্যটি ছিল ভুল। শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঝড় হচ্ছিল সেদিন। কিন্তু ওয়েটিং রুমের প্রথম শ্রেণীর কক্ষগুলোতে সতেজ ফুল আর কোমল সুরের মূর্ছনায় বসন্ত বয়ে চলছিল। এই সৃষ্টির স্রষ্টা হয়তো এমন মনমাতানো পরিবেশই উপহার দিতে চেয়েছিলেন। সবকিছু সেই অতিপ্রাকৃত সুন্দরীকে আপন করে নেওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল। ওয়েটিং রুমের চারপাশে আমি তাকে নিবিড়ভাবে খুঁজতে লাগলাম। তবে আমার এমনতর আচরণে আমি নিজেও কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলাম। আশপাশে বসে থাকা সব পুরুষই ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল যে তারা নিখুঁত বাস্তব জীবনের প্রতিনিধি। আর তাদের স্ত্রীরা সচল দৃশ্যমান জানালার ভেতর দিয়ে অচল বিমানগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো তারা অন্য কারো কথা ভাবছিল নয়তো হিংস্র সিংহের মতো ঝড়ের আক্রমণে বিধ্বস্ত রয়েসির মাঠের দিকে নির্ভার তাকিয়ে ছিলেন। দুপুর হতে না হতেই ওয়েটিং রুমের চারপাশ জনাকীর্ণ হয়ে পড়ল।

ওয়েটিং রুমের বাইরের দৃশ্যটা আরও চমকপ্রদ ছিল। অন্যান্য প্রতিটি ওয়েটিং রুম বিভিন্ন ধরনের মানুষে পরিপূর্ণ। যাত্রীরা তাদের পশু-পাখি, ছেলে-মেয়ে ও ভ্রমণ অনুষঙ্গ নিয়ে সংকীর্ণ করিডোর ও সিঁড়িপথের চারপাশে ক্যাম্পের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছিল। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তৈরি ভবনটিকে মহাকাশে প্রেরিত বিধ্বস্ত এক প্রকাণ্ড ক্যাপসুলের মতো লাগছিল। তবে সে মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, এ পোষ্য পালের ভিড়ে সুন্দরী কোথাও লুকিয়ে আছে। নতুন উদ্দীপনায় আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

দুপুরে খাবারের সময় আমার কেন জানি সবাইকে জাহাজডুবিতে সহায়সম্বলহীন মনে হচ্ছিল। সাতটা রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ও বারগুলোর সামনে মানুষের অন্তহীন লাইন অপেক্ষা করছিল। তিন ঘণ্টার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবগুলো বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়ার বা পান করার মতো সেখানে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সব বাচ্চা একত্রিত হয়ে তাদের কান্নায় কান ঝালাপালা করা এক বিচ্ছিরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কিছুক্ষণের জন্য সবাই যেন পুরোপুরি জৈবিক হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় আমি খাওয়ার মতো দু'কাপ ভ্যানিলা আইসক্রিম পেলাম, তাও আবার বাচ্চাদের একটা দোকানে। প্রতিটি ক্যাফেতে ক্রেতারা উঠার পর পরই ওয়েটাররা চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিচ্ছিল। কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে খুব আরাম করে খাচ্ছিলাম এবং বারবার নিজেকে আয়নায় দেখছিলাম। আমার হাতে ছিল কাডবোর্ডের তৈরি শেষ কাপ ও চামচ এবং মাথায় ছিল সেই সুন্দরীর চিন্তা।

সকাল এগারোটার নির্ধারিত ফ্লাইট অবশেষে রাত আটটায় বিমানবন্দর ছাড়ল। অন্যান্য যাত্রীরা যখন তাদের সিটে পৌঁছে গিয়েছিল, আমি মাত্র বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলাম। অবশেষে এক ফ্লাইট সহকারীর সহায়তায় আমি আমার সিটে পৌঁছাই। আমার হূত্কম্পন প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল যখন দেখলাম সুন্দরী আমার পাশের সিটে বসে আছে। একজন অভিজ্ঞ পর্যটকের মতো জানালার পাশের সিটে বসে আছে সে। আমি মনে মনে ভাবলাম, 'ব্যাপারটা এতই কাকতালীয় যে আমার লেখা হয়তো কেউ কেউ বিশ্বাস না-ও করতে পারে'। আমি কিছুটা তোতলামো করে সুন্দরীর সঙ্গে তাত্ক্ষণিক শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চাইলাম। কিন্তু সে তা শুনলই না। তার বসার ভঙ্গিমা ও জিনিসপত্র গোছানোর স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিল যে সে সেখানে অনেকদিন বাস করতে যাচ্ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসকে সঠিকভাবে নাগালের মধ্যে রেখে সে একটা আদর্শ বাড়ির আদল আনতে চাচ্ছিল। পরক্ষণে, একজন বিমানবালা আমাদের শ্যাম্পেন দ্বারা স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসল। আমি একটা গ্লাস তার জন্য তুলে নিলাম ঠিকই কিন্তু সাধলাম না। ভাবলাম, ঠিক সময় এলেই দেওয়া ভালো। সুন্দরী তখন প্রথমে দুর্বোধ্য ফ্রেঞ্চ ও পরে চলনসই ইংরেজিতে বিমানবালার কাছে এক গ্লাস পানি চাইল। আরও জানাল যে ফ্লইট চলাকালে তাকে যেন কেউ না জাগায়। তার উষ্ণ ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরে প্রাচ্যের বিষাদ ঘিরে ছিল।

পানি দিয়ে যাবার পর, সে একটা প্রসাধনীর বাক্স থেকে দুটো সোনালি রঙের পিল বের করল। বাক্সটা অনেকটা দাদিমার আমলের ট্রাঙ্কের মতো, কোণাগুলো তামা দিয়ে বাঁধানো এবং সেখানে আরও বিভিন্ন রঙের পিল ছিল। সে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে ও নিয়মমাফিক করল। জন্মের পর থেকে কোনোকিছু তার ইচ্ছার বাইরে হয়নি—এমনটাই দেখে মনে হলো। তারপর সে জানালার পর্দা নামিয়ে দিল, সিটটাকে যতটুকু সম্ভব নিচু করল, জুতাসহ কোমর পর্যন্ত কম্বল মুড়ে দিল, স্লিপিং মাস্ক পরল এবং আমার দিকে পেছন ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। নিউ ইয়র্ক যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় সে ঘুমিয়ে কাটাল। এই আট ঘণ্টা ও অতিরিক্ত বারো মিনিটের মধ্যে সে একটুও বিরতি দিল না, একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ল না, এমনকি একটু নড়ল না পর্যন্ত ।

আমার জন্য পুরো সময়টাই ছিল অস্থির। একটা মেয়ে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি বলে আমার বিশ্বাস। তাই আমার পাশে শুয়ে থাকা মোহিনীর জাদু থেকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও বের হতে পারছিলাম না। বিমান উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিমানবালার পরিবর্তে একজন কার্তেসিয়ান নিযুক্ত হলো। একটি টয়লেটারি বাক্স ও এয়ারফোন দেওয়ার জন্য লোকটি সুন্দরীকে জাগানোর চেষ্টা করল। আর রাতের খাবার দেওয়া হবে কি না তা জিজ্ঞেস করাটাও তার জন্য জরুরি ছিল। আমার বারবার নিষেধ সত্ত্বেও সে তাকে জাগানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত স্বয়ং বিমানবালা এসে তাকে নিরস্ত করল। তারপরও খানিকটা অসন্তোষ ছাপ তার চেহারায় ছিল সুস্পষ্ট। কারণ, সুন্দরীর গলায় 'বিরক্ত করো না' জাতীয় কোনো নোটিশ লাগানো ছিল না ।

আমি একা একা রাতের খাবার খেলাম। সুন্দরী জেগে থাকলে তাকে যা বলতাম তা নিজেকেই মনে মনে বললাম। সে নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের ঔষধগুলো যেন মৃত্যুর আহ্বায়ক। প্রতিবার পান করার সময় গ্লাস উঁচিয়ে তাকে অভিবাদন জানালাম—

'সুন্দরী তোমার সুস্বাস্থ্য কামনায়।'

রাতের খাবারের পর বাতিগুলো নিষপ্রভ হয়ে এল। একটা মুভি চলছিল পর্দায়, কেউ দেখছিল না। শুধু আমরা দু'জন, এক অন্ধকার জগতে... একাকী...। শতাব্দীর বড় ঝড় থেমে গিয়েছিল। অসংখ্য তারার মাঝে বিমানটিকে মনে হচ্ছিল গতিহীন। সে মূহূর্তে আমি তাকে দেখলাম। নিবিড়ভাবে। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি মেপে মেপে, কয়েক ঘণ্টা ধরে। তার কপালে স্বপ্ন উড়ে যাচ্ছিল। পানির ওপর ভেসে থাকা মেঘের ছায়ার মতো। জীবনের স্পন্দনও শুধু সেখানেই ছিল। গলার হারটি সোনালি ত্বকের মাঝে ডুবেছিল। সুগঠিত কানে কোনো ছিদ্র ছিল না। মেদবহুল আঙ্গুল থেকে গোলাপি আভা ছড়াচ্ছিল। আর বাম হাতে একটা মসৃণ বালা। সবমিলে বিশ বছরের বেশি মনে হলো না। তবু সন্দেহ হলো, এ বালা আবার বিয়ের প্রতীক না হয়ে থাকে। পরক্ষণে ভাবলাম, এটি হয়তো ক্ষণস্থায়ী বাগদানের স্মারক। আমি জেরার্দো ডিয়েগোর চমত্কার সনেটটি মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম। তখন শ্যাম্পেনের ওপর জমে থাকা বুদবুদের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, 'আমার বদ্ধহাতের পাশে তোমার ঘুমকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করতে আমার নিঃস্বার্থ অকৃত্রিম বিশ্বস্ততা প্রমাণ করাটাই আমার স্বস্তি'। তারপর আমি সিটটাকে তার সিটের কাছাকাছি নামিয়ে আনলাম। বাসর ঘরের বিছানা থেকেও নিজেদের কাছাকাছি মনে হলো আমার। কণ্ঠের মতোই গম্ভীর ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। আর ত্বক থেকে বেরিয়ে আসা কোমল গন্ধটা ছিল তার সৌন্দর্যের একরকম বিশেষায়ণ। সে সময় ইয়াসুনারি কাউয়াতার একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল আমার। বইটা আমি গত বসন্তে পড়েছিলাম। প্রাচীন কিয়োটা বুর্জোয়াদের ওপর লেখা। সেখানে তারা শহরের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েদের নগ্ন ও নেশাগস্ত অবস্থায় দেখতে প্রচুর সময় ব্যয় করত। হয়তো মিলনের ঐকান্তিক ইচ্ছা যন্ত্রণায় উন্মত্ত হয়ে উঠত, কিন্তু তারা সেই মেয়েগুলোকে স্পর্শ করে জাগানোর চেষ্টা করত না। ঘুমন্ত রমণীদের অবলোকন করার মাঝেই ছিল তাদের প্রকৃত সুখ। সেই রাতে সুন্দরীকে অবলোকন করতে গিয়ে আমিও ঠিক একই জরাগ্রস্ত আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। শুধু উপভোগ নয়, ধারণ করেছিলাম আমি তা। অবিশ্বাস্য, তাই না?

শ্যাম্পেনের ঝাঁঝ আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। তখন নিজেই নিজেকে বললাম, 'এই অসময়ের অভিসারে প্রাচীন জাপানিই হই আর যা-ই হই, কী আসে যায় তাতে'। শ্যাম্পেনের তীব্রতা আর মুভির নিঃশব্দ বিস্ফোরণে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠার পর মনে হচ্ছিল যেন মাথা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমি বাথরুমে গেলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম, আমার দু'সিট পেছনে এগারো স্যুটকেস বহনকারী মহিলা দু'পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভুল করে রেখে যাওয়া মৃতদেহের মতো দেখাচ্ছিল তাকে। নানা রঙের মুক্তোয় বাঁধা রিডিং গ্লাসটি পথের মাঝখানে পড়েছিল। আমি এটা কুড়িয়ে তুললাম না। কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ পেলাম তাতে আমি।

শ্যাম্পেনের তীব্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার পর প্রথম আমি নিজেকে আয়নায় দেখলাম। ভালোবাসার প্রগাঢ়তা আমার চেহারাকে ঘৃণ্য ও কুিসত করে তুলেছিল। কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই তখন হঠাত্ বিমানটি দিক পরিবর্তন করল। তবে কিছুক্ষণ পরই আবার দ্রুতগতিতে সোজা চলতে লাগল। 'সিটে ফিরে আসুন' সংকেতটি বারবার দেখানো হচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি সিটে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম, ঈশ্বরের বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি হয়তো ইতিমধ্যে সুন্দরীকে জাগিয়ে তুলেছে। আর সুন্দরী হয়তো ভয় থেকে বাঁচবার জন্য আমার বাহুবিষ্ট হতে পারে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমি ডাচ ভদ্রমহিলার চশমায় প্রায় পা ফেলতে চলেছিলাম। তেমনটা হলে হয়তো খুশিই হতাম। তবে শেষপর্যন্ত আমি পেছনে সরে এলাম। চশমাটাকে তার কোলে ফিরিয়ে দিলাম। আমার আগে সে চার নাম্বার সিটটি পছন্দ করেনি বলে তার প্রতি এক আকস্মিক কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নিল।

সুন্দরীর ঘুম অজেয় ছিল। বিমানটি থামানোর পর তাকে জাগানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে আমি নিজেকে কোনোমতে সংযত করলাম। ফ্লাইটের শেষ ঘণ্টাটিতে তাকে জাগ্রত দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিল আমার। এই ইচ্ছা তার প্রচণ্ড রাগের কারণ হলেও ক্ষতি নেই। হয়তো এই শেষ দেখা আমার স্বাধীনতা ও যৌবনকে পুনরুজ্জীবিত করত। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, 'চুলোয় যাক, কেন যে টৌরাস হয়ে জন্মালাম না'।

অবতরণের পর বাতি জ্বলে উঠার সময়টুকুতে সুন্দরী নিজেই জেগে উঠল। সে যেন একটা গোলাপের বাগানে ঘুমিয়েছিল, তাকে এত সুন্দর ও সতেজ লাগছিল। অনেকক্ষণ পর আমার মনে হলো, বিমানে পাশাপাশি বসে থাকা মানুষগুলো জেগে উঠার পর বয়স্ক দম্পতির মতো একে অপরকে শুভ সকালটুকুও জানায় না। যেমনটা সে জানায়নি। সুন্দরী তার স্লিপিং মাস্কটা খুলে ফেলল, দীপ্তিময় চোখ মেলে তাকাল, সিটটাকে সোজা করল, কম্বলটিকে পাশে সরিয়ে রাখল, চুলগুলো নেড়ে ঠিক করল এবং সবশেষ প্রসাধনীর বাক্সটাকে হাঁটুর ওপর রাখল। অনেকটা সময় নিয়ে দ্রুত ও অপ্রয়োজনীয় কিছু সাজসজ্জা করল। বিমানের গেইট না খোলা পর্যন্ত সে আমার দিকে তাকায়নি। একটু পর লিনেক্স জ্যাকেটটি পরে লাতিন আমেরিকান স্প্যানিশের মাধ্যমে প্রথাগত ক্ষমাপ্রার্থনা জানিয়ে প্রায় আমার ওপর দিয়ে চলে গেল সে। আমাদের দু'জনের গড়া সুন্দর রাতটির জন্য আমাকে একটা ধন্যবাদও জানাল না। এমনকি বিদায় সম্ভাষনটুকুও না। আজকের সকালের মতো সেদিনের সূর্য উদ্ভাসিত আলোয় উজ্জ্বল থাকা সত্ত্বেও সুন্দরী নিউ ইয়র্কের আমাজান জঙ্গলে হারিয়ে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ