আন্তন চেখভের গল্প : লটারির টিকেট

অনুবাদ : সুদর্শনা রহমান

ইভান দ্রমিত্রিজ মধ্যবিত্ত মানুষ, বৎসরে আয় ১২০০ রুবেল। তাতে তিনি বেশ সুখে আছেন । রাতের খাবর শেষে প্রতিদিনের মতো আজও খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন ।

খাবার টেবিল পরিষ্কার করতে করতে ওনার স্ত্রী মাসা বল্লেন, "আজকের কাগজটা আর দেখা হয়ে ওঠেনি, দেখতো লটারির ফলাফল বেরিয়েছে কিনা" ?


"হ্যাঁ, বের হয়েছে কিন্তু, তোমার টিকিটের ডেট না ওভার হয়ে গেছে?'', বল্লেন ইভান ।

" না না ওটার মেয়াদ আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত আছে" উত্তরে স্ত্রী জানালেন ।

" ও আচ্ছা, তাহলে নম্বরটা বল"

"সিরিজ ৯,৪৯৯ আর টিকিটের নম্বর হচ্ছে ২৬"

" দাড়াও, দেখছি মিলিয়ে"

ইভানের নিজের অবশ্য লটারি ভাগ্যে কোনোই বিশ্বাস নেই তবুও, যেহেতু কাগজটা চোখের সামনেই মেলা তাই নম্বরগুলোতে নজর বুলাতে লাগলেন । দ্বিতীয় লাইনের প্রথম সারিতে এসে তার চোখ আটকে গেল অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি তিনি খানিক ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন । লটারির টিকিটটার নম্বরের দিকে এক নজর তাকিয়েই হাত থেকে কাগজটা রেখে দিলেন, হটাৎ কেমন যেন শীত করতে লাগলো ওনার, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল বরফ শীতল একটা অনুভূতি, পেটের ভেতরেও মনে হচ্ছে একদল প্রজাপতির নাচানাচি জুড়ে দিয়েছে, হাতে পায়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে, রীতিমতো ঘেমে উঠলেন তিনি ।

" মাসা, ৯,৪৯৯ এইতো এখানে'', নিষ্প্রাণ ভাবে উচ্চারণ করলেন ইভান ।

"৯,৪৯৯?", মাসা বিবর্ণ মুখে জানতে চাইলেন, ওর হাত থেক ভাজ করা টেবিল ক্লথ খসে পড়লো মাটিতে ।

" সত্যি, সত্যি ……………..এইতো দেখ না এখানে রয়েছে !"

" আর টিকিটের নম্বর ?"

" ও হ্যাঁ ! টিকিটের নম্বরও ঠিকই আছে । আচ্ছা অপেক্ষা করো একটু খানি, এই তো আমাদের সিরিজের নম্বর মিলে গেছে ! কিন্তু বুঝতে পারছো তো…………………………………"

শিশুরা যেমন নূতন কিছু দেখলে অবাক চোখে চেয়ে থাকে ইভান ও ঠিক তেমনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মাসার মুখের দিকে তাকিয়ে । মাসা ও হাসিমাখা মুখে স্বামীর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন উদগ্রীব হয়ে বাকী টুকু শোনার অপেক্ষায়, আকস্মিক প্রাপ্তি লাভের আশায় উদ্দীপনায়, উত্তেজনার মধুর আবেশে ভিতরে ভিতরে থির থির করে কাঁপন শুরু হয়েছে তাঁরও ।

দীর্ঘক্ষন বিরতি দিয়ে ইভান বল্লেন," সিরিজ নম্বরটা যখন মিলে গেছে, তখন জিতে যাবার ও একটা সম্ভবনা আছে তবে সেটা শুধুই সম্ভবনা মাত্র, দেখছি দাঁড়াও !"

" দেখ না তাহলে ভাল করে !"

" অপেক্ষা করো, নিরাশ হবার মতো যথেষ্ট সময় আছে আমাদের । ৭৫,০০০ রুবেল, শুধু মোটা অংকের টাকাই নয় একই সাথে ক্ষমতা আর সম্পদ ও তো বটে ! এক মিনিট সবুর করো, সিরিজ নম্বর তো ২৬ তাইনা ? আচ্ছা ধরো, আমরা যদি টাকাটা জিতে যাই তাহলে কি হবে ?"

স্বামী স্ত্রী দুজনের জোরে হেসে উঠে পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন । ৭৫,০০০ রুবেল জিতে যাবার সম্ভবনা দুজনকেই বিস্ময়ে অভিভূত করে রেখেছে, এমনটি হবার কথা তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি, এতো টাকা দিয়ে তাঁরা করবেন কি, কি কিনবেন, যাবেনটাই বা কোথায় ? শুধু এই মুহূর্তে দুজনেরই মাথার ভেতর ঘুর পাক খাচ্ছে নম্বর ৯,৪৯৯ আর ৭৫,০০০ রুবেলের অংকের সংখ্যা, কেন যেন আর কোনো রকম সুখানুভূতি বোধ করছিলেন না দুজনেই।

ইভান খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে ঘরের এ মাথা ও মাথা পায়চারী করতে লাগলেন অস্থির পায়ে, প্রাথমিক উত্তেজনা খানিকটা কেটে গেছে ইতিমধ্যেই ।

" মনে করো লাটারির টাকাটা যদি আমারা পাই তাহলে, আমাদের পুরা জীবনটাই পাল্টে যাবে । যদিও টিকিটটা তোমার কিন্তু, যদি আমার হতো তাহলে প্রথমেই ২৫,০০০ রুবেল দিয়ে একটা ভাল এলাকায় বাড়ি কিনে নূতন ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়ে নিতাম, তারপর ধরো টুকিটাকি কিছু কেনা কাটা, খানিকটা এদিক সেদিক বেড়ানোর আর খুচরো ধার গুলো শোধ করতে আরও হাজার দশেক রুবেল খরচ করতাম । বাদ বাকী ৪০,০০০ রুবেল ব্যংকে জমা রেখে সুদের টাকায় দিব্যি চলে যেতো দুজনের দিন গুলো" ।

একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন মাসা হাত দুটো কোলের উপর জড়ো করে বল্লেন, " সত্যিই ভাল এলাকায় একটা বাড়ি হলে বেশ হয়" ।

"টুলা অথবা ওরল প্রদেশে কোথাও হলে খুব ভাল হয় কি বল, আমাদের তো আর বিলাস বহুল গ্রীষ্ম আবাসের দরকার নেই । তাছাড়া, বাড়িটা থেকে যাতে দুটো পয়সা আয় হয় তাও তো ভাবতে হবে ? "

ইভান সুখ স্বপ্নে বিভোর হন নানা রঙের ছবি একে চলেন, হেমন্তের সুশীতল বারিধারায় স্নাত সন্ধ্যা, গ্রীষ্মের দবদাহে সেন্ট মার্টিন নদীর পাড়ে আর বাগানে বৈকালিক লম্বা ভ্রমণ, সুশীতল ভদকার গ্লাসে আয়েশি চুমুক সাথে থাকবে নোনা মাশরুম আর সসে জারানো শসা………………বাচ্চারা বাগানে খেলা করতে করতে তুলে আনবে মাটির সোঁদা গন্ধ মাখা তরতাজা গাঁজর বা মূলা……………….তারপর তিনি সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে সাম্প্রতিক প্রকাশিত কোনো ফ্যসান ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাবেন কিম্বা পরনের ওয়েস্ট খুলে মুখ ঢেকে শুয়ে আরামের ঘুম দেবেন ।

সেন্ট মার্টিনের রোঁদ ঝলমলে গ্রীষ্মের পর শুরু হবে মেঘলা ঘোলাটে আবহাওয়া সাথে বয়ে আনবে ঝর ঝর বারিধারা রাতদিন ভর, পাতা শূন্য শাখার গাছ গুলোর মৃদু মর্মর আওয়াজ আর ভেজা স্যাতসেতে ঠাণ্ডা বাতাস । কুকুর গুলো, ঘোড়া আর মুরগীর পাল ভিজে জুবুথুবু, বিষণ্ণ ম্রিয়মান । বাইরে বেরুবার উপায় থাকবে না ক্রমাগত কয়েক দিন ধরে তাই, যতো ঘোরাঘুরি ঘরের ভেতরেই, জানালা বাইরে নজরে আসবে শুধু ধূসর প্রকৃতি !

" মাসা নিশ্চয় প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব কষবে" স্ত্রীর দিকে এক নজর বুলিয়ে মনে মনে ভাবেন ইভান," লটারির টিকিটটা যে ওর, আমার তো আর নয় । বিদেশে গিয়ে যদি হোটেলে স্ত্রীর নজর বন্দী থাকতে হয় তাহলে, আর বিদেশে গিয়ে কি লাভ……………….আমি তো ওকে ভাল করেই জানি এছাড়া আর কিছুই করবে না ও"

এবং এই প্রথম বারের মতো ইভান অনুভব করে মাসা ঘরকন্না করতে করতে কেমন যেন ফ্যাকাসে আর বুড়িয়ে গেছে, অথচ তিনি এখনো রয়ে গেছে স্বাস্থ্যবান জোয়ান চাইলে আর একটা নূতন বিয়েও করতে পারেন ।

" ধুর, কি সব আবোল তাবোল ভাবছি", নিজের মনে বকেন ইভান আবার পরোক্ষণেই ভাবেন, " কিন্তু মাসার বিদেশে যাওয়ার দরকারটা কি, ওখানে গিয়ে সে করবেটা কি? জানি ও অবশ্যই যাবে সে নেপলসেই হোক কিবা ক্লিনে, টাকাটা যে মাসারই । টাকা পাবার সাথে সাথে মাসা বদলে যাবে, ও তখন হয়ে দাঁড়াবে আমার পথের কাঁটা, টাকাগুলো হয় ও সিন্দুকে তালা মেরে রাখবে নাহয়, নিজের আত্মীয়দের বিলিয়ে দেবে আর প্রতিটি পাই পয়সার জন্য আমাকে ওর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে" ।

ইভান দমিত্রিচ স্ত্রীর আত্মীয়দের কথা ভাবতে শুরু করেন, মাসার ভাইবোন, মামা, খালা, ফুপু চাচারা একেক জন যেন সাক্ষাৎ শয়তান, টাকার গন্ধ পেলেই পিলপিল করে ছুটে আসবে পঙ্গপালের মতো, যতোসব অকালকুস্মাণ্ড, হাভাতের দল। ওদের যদি একবার কিছু দেয়া হয় তাহলে, বার বার চাইবে আর যদি কিছু না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাহলে নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করে গালিগালাজ শুরু করে দেবে ।

এরপর, ইভানের নিজের আত্মীয়দের মুখ গুলো একে একে মনে করলেন, রক্ত চোষা জোঁকের চেয়ে কম নয় কেউ, সব পিশাচের দল মনে মনে তীব্র ঘৃণা বোধ করেন তিনি ।

স্ত্রীর মুখখানি তাঁর কাছে অসহ্য মনে হোলো, ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে উঠলো মন, " বোকা মেয়ে লোকটা টাকার কি কদর জানে, আমাকে হয়তো একশ রুবেলের একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বাকী টাকা গুলো সব সিন্দুকে ভরে তালা দিয়ে রাখবে"।

এখন ইভানের দৃষ্টিতে আর ভালবাসার লেশ মাত্র নেই, নেই তাঁর স্ত্রীর নজরেও, রাগ এবং ঘৃণা মিশ্রিত খর চোখে উভয় উভয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন । মাসা ও তাঁর স্বামীকে ভাল করেই জানেন, তিনি দিব্যি বুঝতে পারছেন কি চলছে ইভানের মনে, ইভানের নজর যে তাঁর টাকার দিকে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, হয়তো টাকাটা হাতে পাবার সাথে সাথেই ইভান সেগুলো ছিনিয়ে নেবার ফন্দি আঁটছে ।

বারে, মাসার বুঝি আর কোনো সাধ আহ্লাদ নেই, এতো ক্ষণ সেও তো দিবাস্বপ্নে বুঁদ হয়েই ছিল । "পরের পয়সায় বাবুগিরি করা অতো সহজ না" মনে মনে ভাবে সে ।

স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনের দিকে প্রতিপক্ষের মতো চেয়ে থাকেন, দুজনের নজর থেকে ভালবাসার সব বাষ্প উধাও যেন, তাঁরা কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দাঁড়ানো, যে কোনো সময় শ্বাপদের মতো পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পরবেন ; মাসার দিকে বিষাক্ত নজর হেনে ইভান কাগজের চতুর্থ পাতা থেকে জোরে শব্দ করে পড়তে থাকেন, " সিরিজ ৯,৪৯৯ আর টিকিট ৪৬ নম্বর ২৬ নয় !"

মুহূর্তের মধ্যেই ঘৃণা আর আশা মিলিয়ে গেল একই সাথে আর দুজন যেন নূতন করে উপলব্ধি করলেন, তাঁদের ঘরটা বড় দমচাপা, বিশ্রী রকমের ছোট আর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে, রাতের খাবার গুলো ও যেন পেটে জমে ডেলা পাকিয়ে গেছে মোটে হজম হয়নি এতক্ষণেও, আর আজকের সন্ধ্যাটা ও যেন অহেতুক কুৎসিতকর রকমের লম্বা………………………..

"কি অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা,মানে কি এসবের'' ভুতগ্রস্থের মতো বিড় বিড় করে বল্লেন ইভান, "ঘরটা যে কতকাল ঝাড়পোঁছ করা হয়নি, চারিদিকে নোংরা আবর্জনার স্তুপ, মানুষের বসবাসের অযোগ্য, মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে যাই, এর চেয়ে গলায় দড়ি দেওয়াও অনেক ভাল !"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ