কল্লোল লাহিড়ীর গোরা নকশাল : পর্ব ১
কল্লোল লাহিড়ীর গোরা নকশাল : পর্ব পাঁচ
কল্লোল লাহিড়ীর গোরা নকশাল : পর্ব ছয়
কল্লোল লাহিড়ী
গোরা নকশাল : পর্ব সাত
-----------------------------------------------------------------ওরা তোমাকে হত্যা করে কোথায় কবর দিয়েছে
আমাকে কিছুই জানালো না
সেই থেকে পুরো স্বদেশ তোমার কবর হয়ে গেলো
মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি মাটিতে, যেখানে তুমি নেই
সেখানেও তুমি জেগে উঠলে।
ওরা ভেবেছে, তোমাকে গুলি করে হত্যা করবে
কবর দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
কিন্তু ওরা মূলতঃ
বিপ্লবের বীজ বপন করেছে।
(এপিটাফ/ এর্নেস্তো কার্দেনাল/ অনুবাদ-পারভেজ চৌধুরী)
এক অন্তর্বতী আলোর গহ্বরের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলেছে যে স্মৃতির মালা সেই উপাখ্যানের পুরোভাগে এক মানুষ জ্যোতির্বলয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীরিক্ষণ করছেন এক শোক মিছিল। তাঁর প্রিয়, তাঁর সুজনের বছর বাইশের এক তরুণের দেহ। কে ও? শুধুই কি সুশান্তর একটা লাশ? তার জলে ডোবা ফুলে ওঠা চেহারায় শুধুই কি মায়ার আস্তরণ? নাকি ওই দেহপটের প্রতিটা পচে যাওয়া গলনাঙ্কের মধ্যে আছে প্রতিবাদের বারুদে ঠাসা মশলার বুনোট। এই এক্ষুনি...এক্ষুনি যেন ফেটে পড়বে সে। দুরন্ত গতিতে আগুনের ঝলকানি নিঃসৃত হবে তার পচে যাওয়া, গন্ধ বেরোনো দেহপট থেকে। ঠিক যেমন বেরিয়েছিল সেবার। জঙ্গলের মধ্যে দাবানল ভেবে এগিয়ে এসে সেই সাঁওতাল বৃদ্ধ রমনী জানতে চেয়েছিল “তোরা খেপাইচ্ছিস ক্যান জঙ্গলটারে?...আমার জঙ্গলের শাল পাতা...কেন্দু পাতা... পোড়াইলি ক্যান তোরা?” আগুনের বর্ণমালার এক নতুন ভাষা রচিত হচ্ছিল কোথাও যেন গোটা জঙ্গলের বহ্ন্যুৎসবে।
গোরা নকশাল সেই লেলিহান শিখার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো এক শীতালু ভোরের উষ্ণতায় পারদের তাপ মাত্রা নির্ণয় করছিল না। বরং তার তরুণ শক্তিতে ধামসার দিম দিম... দ্রুম দ্রুম...শব্দে যে তরঙ্গ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছিল সেটা কোথাও যেন তার বিজয় পথের এক অলীক স্বপ্নের সূচনা করছিল। প্রতিটা আগুনের লেলিহান শিখায় মিশেছিল বারুদের গন্ধ। ভারী হয়ে আসছিল কালো ধোঁওয়ায় জঙ্গলের সুললিত বাতাস। কোথায় হে কালীদাস...? আজ কি দেখছো না তোমার শকুন্তলের অরণ্য ভাঙছে? আজ জ্বলছে সে...? জ্বলছে সে দিমি দিমি দ্রুম দ্রুম ধামসার শব্দে...। জ্বলছে শ্রেনীহীন সমাজের বাসনায়। আজ জ্বলছে সে অন্ন চাই...অধিকার চাই...কাজ চাইয়ের অনন্ত ক্ষিদে বুকে নিয়ে। ভোরের আলোয় কারা যেন গেয়ে উঠছে... “একদিন সূর্যের ভোর...’’। কারা যেন এগিয়ে যাচ্ছে...। আর ঠিক সেই সময়ে...সেই ঊষাকালীন ব্রাহ্ম মুহূর্তে...কোথা থেকে যেন ছুটে আসছে...সেই লেলিহান শিখা...সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার জীয়ন কাঠিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক বুলেট...। মিলিটারীর বুটের আওয়াজ গমগম করছে...নিরেট ধাতব শব্দ তুলছে শুকনো পাতা আর রুক্ষ মাটির ওপর। কুয়াশার শাদা চাদর আর ঘন কালো ধোঁওয়ার আস্তরণ ভেদ করে ওরা সত্যি সত্যি ছিনিয়ে নিচ্ছে অধিকার। ওরা বলছে “এই রাষ্ট্র আমার...এই যন্ত্র আমার...এই মাটি আমার...এই দেশ আমার...”। এক-একটা বুলেট...এক একটা নিশানায় এসে হৃৎপিন্ডটাকে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। বড় প্রিয়জন...বড় কাছের মানুষরা শুয়ে পড়ছেন অন্তিম শয্যায়...। কেউ কাউকে এগিয়ে দিচ্ছে না জল। কেউ কাউকে গন্ডুষে পান করাচ্ছে না জীবনের অমৃত মন্ত্র। কেউ কাউকে বলছে না... “সুদিন আসছে কমরেড...জাতের নামে...ধর্মের নামে...দেশের নামে ভাগ করা চলবে না কাউকে...”।
কিন্তু এই আরণ্যক পরিবেশে ওই মানুষটা কে? হাতে তীর...ধনুক...এগিয়ে আসছে সে...। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা অরণ্যের মধ্যে দিয়ে কে ছুটে আসছে? তুমিই কি তাহলে পার্থ...? পিতামহ ভীষ্মকে এক গন্ডুষ জল উপহার দেবে তার অন্তিম নিঃশ্বাস কালে? দাও...দাও...হে বন্ধু...আমার চিরসখা...ওই দেখ...ওই দেখ...ওখানে পড়ে আছে কমরেড বিমল...ওই দেখ...ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে কামানের গোলায় আত্রেয়ীর দেহ...ওই দেখ...ওখানেই আছে সুচারু...যে একটু আগে একটু আগে চেয়েছিল প্রাণভিক্ষা নয়, মৃত্যুর মহান অধিকার...। হে পার্থ...জল দাও...হে পার্থ...মৃত্যুর অধিকার দাও...হে পার্থ আমার দেশ দাও...আমার স্বাধীনতা দাও...আমাকে ফিরিয়ে দাও আমার শেকল ভাঙার গান...। তুমি কি দেখছো না ভাই ভাইয়ের রক্তে রাঙিয়ে নিয়েছে হাত...তুমি কি দেখছো না এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি আমরা। তুমি কি দেখছো না নিজ দেশে পরবাসী হয়ে গেছে সবাই...?
সেই আরণ্যক ভূমিতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে গোরা নকশাল। কড়জোড়ে প্রার্থনা করে মৃত্যুর। এযাবৎ কাল যে স্বপ্ন চোখে যৌথ খামারের নক্সা এঁকে দিল...এযাবৎ কাল যাদের মনে করলাম এরাই হবে আগামীর কান্ডারী...তারা আজ কেউ নেই পার্থ...তোমার মতো...তোমার মতো একা...এই রণে ভগ্ন শরীরে বেঁচে আছি আমি। এই জীবন আমার নয়...এই জীবন আমি চাইনি কোনোদিন...এই জীবন আমার লাল পতাকার আচ্ছাদনে সাতরঙা রামধনু হয়ে ফিরে আসবে না। এই বিষাদময় ভোরে...আমাকে...আমাকে গ্রহণ করো। গোরা নকশাল ভাবে আর অবাক হয়। এই প্রলাপ...এতো তার নিষিদ্ধ ইস্তেহার নয়। এতো তার মহাকাব্যোচিত ট্রাজিক বীরত্ত্বের শোকগাথা নয়। এতো একনায়কতন্ত্র? তাহলে এতোদিন...এতোদিন যা শিখেছিল...তা ভুল? কেন বারবার মনে পড়বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অসহায় পার্থকে। যে লড়তে চায়নি...। যাকে মিথ্যে বলে...ধর্মের দোহাই দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সংশয়ে। ভাবতে পারে না গোরা নকশাল আর। নাকে পোড়া মাংসের গন্ধ...বারুদের গন্ধ...রক্তের গন্ধ নিয়ে সজ্ঞা হারায়। আর ঠিক তখনি...ঠিক তখনি...সেই গান্ডীবধারী কোঁকড়া চুলের যুবক এক ঝটকায় পিঠের ওপর তুলে নেয় গোরা নকশালকে। তারপর অরণ্যের আদিম প্রগলভতায় সে ছুটতে থাকে...। কারণ সে জানে যাকে নিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে এই আগুনখোকো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই মানুষটা আসলে তার গ্রামের হন্তারকদের বিচার দিতে এসেছে। সে এসেছে তাদের জঙ্গলের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ছুটছে তাই ঝাঁকড়া চুলের বড় টানা টানা চোখের মরুঙ...। ছুটছে...ছুটছে...আর ওদিকে মাথা নীচের দিকে...কপালের পাশ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের টিপ টিপ বর্ষণে গোরা নকশাল দেখছে এক আদিম জনভূমি...যেখানে আর্য নেই...যেখানে সভ্যতা নেই...যেখানে প্রতিষ্ঠান নেই...। চোখের ওপর রক্তের প্রলেপ আঁকা বিহ্বল নিয়ে গোরা নকশাল জানতে চাইলো কে তুমি? মঙরু উত্তর দিল না। গোরা নকশাল বুঝতে পারলো...গোরা নকশাল বললো... আমার আর্য শিক্ষার পাশে...এক অনার্য ভারত আমাকে দিক নির্দেশ করছে নতুন ইতিহাসের...নতুন যুগের...সিধো কানু... তিতুমীরের...। আমার দেশ তার বার্তা পাঠাচ্ছে...। তোমরা কেউ শুনতে পাচ্ছো কী?
অচৈতন্য গোরা নকশালকে চেতনায় নিয়ে এসেছিল যে মানুষগুলো তাদের কাছ থেকে সে এখন সহস্র যোজন মাইল দূরে...। কেন এতো দূরে? কেনো? গোরা নকশাল নাক টেনে জঙ্গলের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে। সবুজ পাতার সোঁদা গন্ধের বদলে তার নাকে আসে পোড়া মাংসের গন্ধ। মাথা তুলতে পারে না গোরা নকশাল..। তুলতে পারে না কারণ হঠাত যদি...সে দেখতে পায় সেই আরণ্যক ভূমিকে? হঠাত যদি সে দেখতে পায় মঙরুকে। হঠাত যদি তার মনে হয় এই যে সামনে সুশান্তর দেহটা বারুদের মতো জ্বলছে চিতায় সেখানে যদি ব্লাস্ট হয়। সুশান্ত যদি নিজেকে ব্লাস্ট করায়! “কমরেড গোরা...ভেঙে ফেলুন নিজের মনের মধ্যের প্রতিটা প্রাচীর। কমরেড গোরা মানুষ কাঁদছে...। কমরেড গোরা আপনি বুঝতে পারছেন না ওরা জাতের নামে...ধর্মের নামে...বিষ দিচ্ছে...ওরা ওদের শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না। ওরা মঙরুকে মেরে ফেলেছে। ওরা জেলে প্রিয়াংশুকে মেরে ফেলেছে...ওরা আপনার সব বন্ধুকে গুম করে দিয়েছে। ওরা আপনার শেষ আশা সুশান্তকেও ওই চিতায় পুড়িয়ে দিচ্ছে...তবুও... তবুও আপনি একবার...একবার...শেষবারের মতো জ্বলে উঠবেন না গোরা নকশাল?” কে বলে এই কথা? কার কন্ঠ স্বর প্রক্ষেপণ হয়ে ঘুরে বেড়ায় তার চারপাশে? মোহজাল বিস্তার করে আবার পথের নামার। আবার এগিয়ে চলার। আবার এক একটা লাশের সীমানা টপকে স্বপ্নটাকে আঁকড়ে ধরবার? গোরা নকশালের চোখের পাশ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে।
পাশে দাঁড়ানো টুকনুর হাতে টুপ টুপ জল পড়লে মনে হয় বৃষ্টি। টুকনু আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখে গোটা আকাশ জুড়ে গরম কালের স্বচ্ছ মেঘ। সেই মেঘে জল নেই আছে উষ্ণতা, আছে তাতিয়ে দেওয়ার উন্মাদনা। তাহলে এই কয়েক ফোটা্র আজলা জল এলো কোথা থেকে? টুকনু তাকায়। আর টুকনু আবিষ্কার করে এই প্রথম...এই প্রথম পাশের মানুষটার চোখে বৃষ্টির ঘনঘটা। এতোদিন সে জানতো একমাত্র সেই কাঁদে। পাপ্পুকে অঙ্কের টিচার মারলে পাপ্পু কাঁদে। বিহারীর ছোট মেয়েটা খাটিয়াতে বসে কাঁদে। কিন্তু...অতবড় একটা মানুষ...যে প্রতি সপ্তাহে থানায় যায় হাজিরা দিতে... যে মানুষ ভয় পায় না পুলিশকে... অন্ধকারে মণির মামদো ভূতকে...। যাকে ভালোবেসে শ্রমিকরা ঘিরে ধরে...বাড়ির সবাই যার সম্বন্ধে কত কথা বলে... ঠাম্মা যত্ন করে খাওয়ায়...সেই লোকটা...সেই গোরা নকশাল কাঁদছে? কান্নাটা এক ছোঁয়াচে প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানের মতো এসে লাগে টুকনুর বুকে। আর এই প্রথম...এই প্রথম সবার মাঝে...লেলিহান অগ্নি শিখার মাঝে...একটা মানুষ পোড়ার উৎকট গন্ধের মাঝে...শ্মশান চিরে কেঁদে ওঠে টুকনু...। জোরে...চিতকার করে। সবাই ভাবে ভয় পেয়েছে ছেলেটা। ততক্ষণে খুলি উপড়ে...ফাটানো হয়েছে সুশান্তর। যে ছেলেটা চশমা ছাড়া দেখতে পেতো না। যে ছেলেটার চোখের মণি খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাকে ভয় দেখিয়ে চুরী করে মারা হলো...। সেই নিঃসহায় বিপ্লবীর দেহ পুড়ছে ছাই হয়ে। টুকনুকে বাড়ি নিয়ে যায় তার হাঁদা। এতো ছোটো ছেলের এইসব কি পোষায়? আর গোরা নকশাল ভাবে কোথাও যেন পুঁতে দেওয়া হল বীজ...যে বীজ একদিন মাথা চাড়া দেবে। যে বীজ ভুলবে না...মরেও ভুলবে না...একদিন...একদিন কারা যেন সুশান্তকে খুন করেছিল। একদিন কারা যেন খুন করেছিল গণতন্ত্রের...অধিকারের...বেঁচে থাকার মূল মন্ত্রকে। (ক্রমশ...)
লেখক পরিচিতি
কল্লোল লাহিড়ী
গল্প লেখেন। টিভিতে সিরিয়ালের কাহিনীর নির্মাতা
0 মন্তব্যসমূহ