ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও'র গল্প : এবং বৃষ্টি এল ঝেঁপে

অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা

ইঁয়োকাবি লাকড়ির বিরাট বোঝাটা তার দুর্বল পিঠ থেকে নিচে ফেলল। বোঝাটা তার কুঁড়েঘরের দরজার বাইরের শক্ত মেঝেতে পড়ে চাপা শব্দ তুলল। কনুই বাঁকিয়ে কোমরে শিথিল দুহাত রেখে সে ক’সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বোঝার ওপর বসে দুর্বোধ্য এক লম্বা নিশ্বাস ছাড়ল। যাক, শেষপর্যন্ত ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফেরা গেল। সারাদিনের গাধার মত হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিশ্রাম একটা আনন্দের ব্যাপার।


সারাটা জীবন ধরে সে কাজ করছে, কাজ করে চলেছে, এবং কোনও একটা দিনও বয়ে আনেনি তার জন্য স্বস্তি। হতাশা এবং দুঃখবোধকে কবর দেওয়ার একটা পন্থা হিসাবে সে এটাকে বেছে নিয়েছে, কিন্তু খুব যে একটা সফল হয়েছে তা নয়। ওখানে বসে ফাঁকা দৃষ্টিতে সে শূন্যে তাকিয়ে রইল, জীবনটা তার কাছে অর্থহীন মনে হল, সে সত্যি ক্লান্তি বোধ করল শারীরিক ও মানসিকভাবে।

বুঝতে পেরেছিল, বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। মাত্র ক’সপ্তাহ আগে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে টের পেয়েছিল, মিশমিশে ঘন কালো চুলের মধ্যে দু’তিন গোছা চুলে ধূসর রঙের পোঁছ লেগেছে। সে আঁৎকে উঠেছিল এবং আর কখনও আয়না দেখবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। এত বয়স। এবং কোনও সন্তান ছাড়া! এটাই ছিল দুশ্চিন্তা। এটা ছিল অচিন্ত্যনীয়। সে বাঁঝা।

দীর্ঘদিন আগেই ব্যাপারটা সে মোটামুটি জানতে পেরেছিল। তার নিজের জন্য এবং সমাজে তার অবস্থানের প্রশ্নে এর তাৎপর্য বুঝতে পারায় মনে সে একধরনের জ্বালা বোধ করত। হতাশার মস্ত এক কীট এবং অপূরণীয় ক্ষতির চিন্তা তার মজ্জায় জট পাকিয়ে থাকত এবং তাকে কুড়েকুড়ে খেত।

এটা একধরনের আশাহীনতা, মানবজীবনের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, যা একজন লোকের মধ্যে তখনই দেখা দেয়, যখন দৃঢ় স্বপ্ন ও প্রত্যাশাগুলো, যেগুলোর ওপর সে স্থাপন করেছে তার সারাটা জীবনকে, যেগুলোর বাস্তবায়ন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

ইঁয়োকাবির প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু তার মধ্যে যা ছিল অবিচল, তা হল ‘অনেক’ সন্তান। জীবনের শুরু থেকে তার একটাই আকাঙ্ক্ষা, বিয়ে করা আর সন্তান লাভ করা। রাতের বেলা দপদপ্ শব্দে-জ্বলা আগুনের ধারে স্বামীর সঙ্গে বসে-থাকা একজন বয়স্কা নারী হিসেবে নিজেকে সে সবসময় দেখত, যখন তাদের সন্তানেরা বিস্ময়ভরা চোখ এবং বিরাট হাঁ-করা মুখ নিয়ে পাশে বসে তার মুখ থেকে শুনবে মজার মজার সব লোকগাঁথা। যেমন আশা করেছিল তেমন স্বামীই সে পেয়েছিল, কিন্তু... কিন্তু *মুরুঙ্গু [*পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকার কোনও কোনও জনগোষ্ঠীর উপাস্য ঈশ্বরের নাম], তাকে কোনওকিছু দিতে পারেননি। সমাধান দিতে পারেননি তার ক্রন্দনের, তার আকাঙ্ক্ষার, তার প্রত্যাশার। বিশাল প্রত্যাশাগুলো তার অপূর্ণই থেকে গেল।

একটি তিক্ত ঈর্ষা তার ভেতর জন্ম নিয়েছিল। সে পার্বত্য এলাকার অন্যসব নারীর সংসর্গ এড়িয়ে চলত, এমন কী শিশুদের ‘উপশমকারী’ স্পর্শও। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই কী তার বিরুদ্ধে দল বাঁধেনি? তারা কী একে অন্যেতে চোখ টিপছে না তাকে লক্ষ করে? যা সে চাইত তা হল নিজেকে একান্তভাবে নিজের জগতে গুটিয়ে রাখতে।

এমন কী তার বহুদিনের বাল্যসখি নিজেরি, যে বিবাহিতা এবং একই এলাকায় বাস করে, হঠাৎ করেই ইঁয়োকাবি তাকে শত্রু ভাবতে শুরু করেছিল। ঈর্ষা করে তার ঘরে যাওয়া থেকেও নিজেকে বিরত রেখেছিল, এমন কী প্রসবকালে তাকে দেখতে যাওয়া থেকেও, যাকে সমাজের সাধারণ ভব্যতার একটা অংশ হিসেবে মনে করা হয়। নিজেরির বাচ্চাকাচ্চা সম্পর্কে ইঁয়োকাবির কোনও ধারণা ছিল না। সুতরাং, আপনি দেখছেন, তার প্রচণ্ড এই অবসাদ মাত্র ঘণ্টা খানেক আগেকার নয়, বলা যায় সারাজীবনে তিলে তিলে গড়ে-ওঠা পুঞ্জিভূত অবসাদ। ইঁয়োকাবি স্মরণ করল গানের ছোট্ট ক’টি কলি, যা তার মা সবসময় গাইতে পছন্দ করত।

একজন নারী যার নেই সন্তান, একটিও সন্তান,
তাকে পেয়ে বসতেই পারে অবসন্নতা, ক্লান্তি।
একজন সন্তানহীনা নারী সে তো হবেই একাকী,
সুতরাং ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন তাকে!


সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তার মাটির কুটিরের দিকে যেখানে তার স্বামী আর সে কাটিয়ে দিয়েছে সুদীর্ঘ সময়। তার কাছে মনে হল তার মা তার জন্য গান গাইছিল। হতে পারে কি, সে ছিল অভিশপ্ত? হতে পারে কি, সে ছিল অশুচি? কিন্তু তারপরও তার স্বামী তাকে অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা রোগ সারাবার কোনও ব্যবস্থা বাতলে দিতে পারেনি।

যে বেদনা তার হৃদয় জুড়ে বিরাজ করছিল, সহসাই তা বেড়ে গিয়ে প্লাবিত করল তার অন্তস্তল, তার কণ্ঠদেশ। এটা ছিল বাস্তব, সেই বস্তুটি। এটা তার শ্বাস রুদ্ধ করে তুলছিল, তাকে মেরে ফেলছিল। নামহীন বস্তুটি তার জন্য ছিল খুব বেশি একটা কিছু। সে উঠে দাঁড়াল এবং তাড়াহুড়ো করতে লাগল কুটির ত্যাগ করবার জন্য, পাহারের চূড়া থেকে দূরে যাওয়ার জন্য, কোথায় যাবে সে জানে না। সে ভূতে-পাওয়া এক প্রাণীর মত পরিচালিত হয়েছিল। আকাশের অসীম উচ্চতায় রক্তচক্ষু সূর্য তখন তার বিশ্রামের গন্তব্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু নারীটি ঘর ছেড়ে দ্রুত ছুটে চলেছিল। বসে থাকতে বা বিশ্রাম নিতে সে ছিল অপারগ। বস্তুটি তাকে তা করতে দেবে না।

সে পাহাড়ের ওপরে উঠল। কিছু সে অনুভব করল না বা দেখল না। তার নিচে বিছানো ছিল আবাদ-করা ফসলের খেত। প্রসারিত ছিল উপত্যকা পর্যন্ত, মিশে গিয়েছিল ঝোপ এবং জঙ্গলের সঙ্গে। ঘরে প্রত্যাবর্তনরত স্ত্রীলোকদেরকে দেখা যাচ্ছিল বিভিন্ন ধরনের বোঝা নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে। নিজেরি তাদের মধ্যে ছিল। যান্ত্রিকভাবে, বা সহজাত প্রবৃত্তির বশে ইঁয়োকাবি তাদেরকে এড়িয়ে গেল। সে আড়াআড়ি পথে মাঠ পেরিয়ে তাড়াতাড়িই উপত্যকায় পৌঁছে গেল। পায়েচলা পথ এড়িয়ে সে ঝোপের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল। কাঁটা তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করলেও ঝোপঝাড়ের গোলকধাঁধা ঠেলে সে এগোচ্ছিল। জায়গাটির বন্য ও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন পরিবেশ মনে হচ্ছিল আশ্চর্যজনকভাবে তার মানসিক বৈকল্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এমন কী, এখনও সে জানে না, কোথায় সে যাবে। সহসাই সে নিজেকে আবিষ্কার করল এক বনের মধ্যে যেখানে আগে সে কখনও আসেনি। কোনও আলোর আভাস ছিল না, এবং মনে হচ্ছিল আকাশ বদলে গেছে। অরণ্য এমনই গহিন ছিল যে, সে মেঘের হাসি আর দেখতে পাচ্ছিল না। অরণ্যের গভীর রহস্যে পতনের ভয়ে প্রথমবারের মত সে দ্বিধান্বিত হল। কিন্তু সেই নামহীন বস্তুটি তাকে এগিয়ে যেতে তাড়িত করতে লাগল।

বনের মধ্যে ছিল এক লম্বা শিলাখণ্ড। মনে হচ্ছিল, এটা কোনও অবসাদগ্রস্ত পথচারীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ইঁয়োকাবি ওটার ওপর গিয়ে বসল। সে তার স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে আসতে শুরু করেছিল, কিন্তু সে তখনও ছিল বিভ্রান্ত ও ধ্বস্ত। সে সময় সম্পর্কে ধারণা করতে পারছিল না অথবা কত দূর সে হেঁটেছিল সে সম্পর্কে। একটি স্বর তাকে লক্ষ করে উচ্চারিত হল, জোরে নয়, ফিসফিস করে –

‘...নারী, তুমি যদি এখানে বসে থাক, তুমি মারা যাবে — নিঃসঙ্গ এক নারীর ভূতে-পাওয়া মৃত্যু।’

সে মরতে চায় না। এখনও নয়। সে নিজেকে টেনে তুলে দাঁড় করাল। দুঃখ-নৈরাশ্যের গাঢ় মেঘ তথাপিও তার ওপর জেঁকে বসে থাকল। যাহোক, শেষপর্যন্ত সে নিজেকে খোলা জায়গায় টেনে নিতে সক্ষম হল। খোলা? না। পুরো এলাকাটাকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল। সূর্যের মনে হয় অকালমৃত্যু হয়েছিল এবং নিষ্প্রভ ধূসর রং ছেয়ে ফেলেছিল বিশ্বচরাচর। আবর্জনার ঘূর্ণী তুলে প্রবল বেগে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছিল। আকাশ কোঁচকানো চেহারা ধারণ করেছিল এবং সেথায় কিছুটা বদমেজাজি মেঘের দল জমা হচ্ছিল। তারপর বিজলির চমকানি, বিদ্যুচ্চমক সেইসঙ্গে বধির-করা বজ্রধ্বনি — কক্কড়াৎ। আকাশের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তার পায়ের নিচেকার পৃথিবী কাঁপতে লাগল। এবং কোনও বাড়তি সতর্ক-বার্তা ছাড়াই শুরু হল বৃষ্টি।

শুরুতে সে এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে, নড়াচড়া করতে পারছিল না। প্রথম ক’ফোটা বৃষ্টি শরীরে পড়তেই আনন্দের কেমন এক অনুভূতি তার ভেতর খেলে গেল। হ্যাঁ! বৃষ্টির প্রথম ফোটাগুলোতে ছিল আরামদায়ক আবেশ, এবং সে এমনটাই বোধ করেছিল যেন সে তার শীতল হৃদয় শীতল বৃষ্টিতে মেলে ধরতে পারবে। সে কাঁদতে চাইল বা চাইল চিৎকার করতে, ‘এসো! এসো বৃষ্টি! ধুয়ে দাও আমাকে, সিক্ত কর আমাকে শীতল মৃত্যুতে!

বৃষ্টি যেন তার বোবা-কান্না শুনতে পেল, তাই তার ওপর মুষল ধারায় ঝরতে লাগল। বৃষ্টির নরম স্পর্শ চলে গিয়েছিল। ওটা এখন তাকে ক্রমবর্ধমান ক্রোধ নিয়ে আঘাত করতে থাকল। এটা ছিল আতঙ্কজনক। তাড়াতাড়ি তাকে বাড়ি ফিরতে হবে ভিজে মরার হাত থেকে বাঁচবার জন্য। শরীরে যতটুকু তেজ যোগাতে সে সক্ষম হল তাই দিয়ে উন্মাদের মত ছুটতে লাগল। সে ভয়ে আক্রান্ত হল এবং মনে হল তার সমগ্র জীবন যেন একটি সংগ্রামে কেন্দ্রীভূত — শীতল বৃষ্টির রোষানল থেকে নিজেকে মুক্ত করবার সংগ্রাম। কিন্তু সে সংগ্রাম বজায় রাখতে পারছিল না। এক ক্লান্ত নারীর জন্য বৃষ্টির ঝাপটা ছিল যথেষ্ট প্রবল। সুতরাং, যখন সে চূড়ার দিকে এগোলো, সিদ্ধান্ত নিল হেঁটে চলার এবং নিজেকে বৃষ্টির হাতে সঁপে দেওয়ার।

আর সেইসময় সে কোমল কিন্তু আবেগজড়ানো মানবকণ্ঠের কান্না শুনতে পেল। নারীসুলভ সহজাত জ্ঞান তাকে জানান দিল, এটা এক শিশুর কান্না। সে থামল এবং বাঁয়ে তাকাল। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছিল, তাই ঢালের ঠিক নিচে ঝোপের দিক থেকে ভেসে-আসা কান্নার শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। আবার নিচে যাওয়ার চিন্তা, যখন তার গন্তব্য খুব কাছে, ইঁয়োকাবির জন্য ছিল নেহাত এক যন্ত্রণার ব্যাপার। এটা ছিল পরীক্ষার মুহূর্ত, সেই মুহূর্ত যা কদাচিৎ আমাদেরকে দেওয়া হয় নিজেদেরকে প্রকৃত মানুষ প্রমাণ করবার জন্য। মুহূর্তটি দুর্লভ। এটা আসে, যদি গ্রহণ করা না হয়, চলে যায়, আমাদের চিরতরে অনুশোচনায় ফেলে।

প্রকৃতপক্ষেই পুরোপুরি অবসন্ন, নাকের ডগায় তার লক্ষ্যস্থল, পুরনো ঈর্ষা চাগিয়ে উঠল এবং তাকে আবার তীব্রভাবে খোঁচাতে লাগল। অন্যের শিশুকে সে বাঁচাবে! সে ওপরে উঠতে শুরু করল... ওপরে...। কিন্তু আবার জোরেশোরে গর্জন তুলে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল, তৎক্ষণাৎ আবেগতাড়িত এবং শঙ্কিত, বৃষ্টির প্রচণ্ড ক্রোধকে ছাপিয়ে সে মাথা তুলে দাঁড়াল। ইঁয়োকাবির হৃদস্পন্দন প্রায় থেমে গেল। সে আর এক পা-ও ফেলতে পারছিল না। কান্নার শব্দ তার অন্তরে অনবরত বেজে চলেছিল। সে ঘুরে দাঁড়াল এবং চূড়া থেকে নিচে নেমে ছোট ঝোপটার দিকে যেতে লাগল, যদিও সে ছিল খুবই ক্লান্ত এবং জানত না আবার সে পাহাড় বেয়ে উঠতে পারবে কিনা। প্রায় দু-তিন বছরের এক শিশু, ছোট্ট এক আশ্রয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়েছিল, যা কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টির হাত থেকে তাকে রক্ষা করেছিল।

ইঁয়োকাবি কিছু জিজ্ঞেস না করে শিশুটিকে তার বাহুতে তুলে নিল। শিশুটিকে তার শরীর দিয়ে রক্ষা করতে চেষ্টা করল যখন সে আবার ওপরে উঠতে লাগল। খুব কষ্টে তার পা তুলতে হচ্ছিল। কিন্তু, আহ্ কী উষ্ণতা! কী মধুর পুনর্জীবনী উষ্ণতা যা এক জীবন-ধারা থেকে আরেক জীবন-ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিল! ইঁয়োকাবির জমাট রক্ত যেন গলে গিয়ে নাচছিল তার শিরা-উপশিরায়। পিচ্ছিল মাটিকে ভয়ঙ্করভাবে মাড়িয়ে যখন ওপরে উঠছিল, সে লাভ করেছিল নতুন আশা এবং বিশ্বাস। সে কেঁদে চিৎকার করে উঠল, ‘ওকে রক্ষা করতে দিন। হে মুরুঙ্গু, ওকে রক্ষা করতে আমাকে সময় দিন। তারপর নাহয় আমাকে মরে যেতে দিন!’ বৃষ্টি মনে হল তার প্রার্থনায় কান দিচ্ছিল না, অথবা করুণা করছিল না তার অতিরিক্ত ওজনের জন্য। তাকে একাই লড়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু বেঁচে থাকবার নতুন করে জেগে-ওঠা বিশ্বাস তাকে শক্তি যোগাচ্ছিল এবং চূড়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সে, যখন পা হড়কে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সে জেগে উঠল, নিঃশঙ্কচিত্ত, লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। বাচ্চাটা তার না হলে তাতে এমন কী এসে যায়? বাচ্চাটি কি তাকে দেয়নি উষ্ণতা, যে উষ্ণতা তার শীতল হৃদয়কে পুনঃপ্রজ্জ্বলিত করেছিল? সুতরাং সে লড়ে চলল, বাচ্চাটা তাকে আঁকড়ে ঝুলে রইল নিজেকে রক্ষা করবার জন্য। প্রকৃত অর্থেই সে আপন শক্তিতে পা টেনে-টেনে পাহাড়ের ওপর উঠল। তখন বৃষ্টি থামল।

ভিজে একেবারে জবজবে, অবসন্ন এবং ক্ষুধার্ত ইঁয়োকাবি শান্তভাবে চূড়া বরাবর ভারী পায়ে শ্লথ গতিতে তার কুঁড়েঘরের দিকে হেঁটে যেতে লাগল। বিজয় তার রক্তে জোয়ার তুলেছিল। এক নতুন আলো জ্বলজ্বল করছিল তার চোখে, যেন তা চ্যালেঞ্জ করছিল আসন্ন গোধূলিকে। বিজয় তার বাস্তব শারীরিক দুঃসহ ক্লেশ দূর করে দিয়েছিল। সে তার কুঁড়েঘরে পৌঁছাল এবং বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।

দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কে তার স্বামী উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। মনে হল, ইঁয়োকাবি তাকে দেখেনি। সে শুধু বাচ্চাটার দিকে ইশারা করেছিল এবং তার স্বামী ওটাকে শুকনো কাপড়ে জড়িয়ে দিয়েছিল। সে তার স্ত্রীর জন্যও কিছু বস্ত্র আনল এবং গনগনে আগুনে আরও ক’টা খড়ি গুঁজে দিল, সারাক্ষণ বিস্ময় নিয়ে কাটাল এই চিন্তায়, ইঁয়োকাবি কোথায় পেল এই বাচ্চাটাকে!

ইঁয়োকাবি এক ধরনের চিত্তবিভ্রমের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। সে বিড়বিড় করছিল,‘... বৃষ্টি... বৃষ্টি... এল... ঝেঁপে...।’ তারপর অশ্রবণযোগ্য শব্দের মাঝে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল।

কিছুক্ষণ বাদে তার স্বামী ভালোভাবে শিশুটির দিকে তাকাল। ইঁয়োকাবি এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই তার স্বামীর চোখের বিস্ময়ভরা চাউনি লক্ষ করেনি, যখন সে শিশুটিকে চিনতে পারল যে, সে আর কেউ নয় নিজেরির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। প্রথমে সে বুঝতে পারল না, আশ্চর্য হল, কী করে তার ঈর্ষাকাতর বউ এই শিশুটির সংস্পর্শে আসতে পেরেছিল!

তারপর তার মনে পড়ল। সে নিজেরিকে পাগলের মত সারা পাহাড়-চূড়ায় ছোটাছুটি করতে দেখেছিল তার শিশুটির খোঁজে; সে বলেছিল যে, তার বাচ্চাটি পালিয়ে গিয়েছিল অন্য সন্তানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। ইঁয়োকাবির স্বামীর মধ্যে বিরাট এক গর্ব উথালপাথাল করছিল যখন সে ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল খবরটা জানাতে; আর এটা ভাবতে যে, তার স্ত্রী এই কাজটি করেছে।




লেখক পরিচিত
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও

কেনিয়ার কিয়াম্বু জেলার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র জন্ম। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ ন্গুগি।

তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে বিএ পাশ করেন। সেই সময়েই, অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায়, ১৯৬২-তে তাঁর লেখা The Black Hermit নামের নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child প্রকাশিত হয়। এটি লেখেন ইংল্যান্ডের লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। এটা কোনও পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস The River Between, রচিত হয় ১৯৬৫-তে। ১৯৬৭ সালে রচিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তিনি ইংরেজি, খ্রিস্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস্ ন্গুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন তাঁর মাতৃভাষা গিকু এবং সোয়াহিলিতে।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও ১৯৭৬ সালে তাঁর নিজ এলাকা কামিরিথুতে Kamiriithu Community Education and Cultural Centre স্থাপনে সহায়তা করেন। যা অন্য কার্যক্রমের পাশাপাশি এলাকাতে আফ্রিকান নাট্য-আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকত। ১৯৭৭-এ তাঁর অসেন্সরকৃত নাটক Ngaahika Ndeenda (I Will Marry When I Want) কেনিয়ার তদানীন্তন ভাইসপ্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোইকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে এবং থিয়োঙ্গ’ওকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলখানায় অবস্থানকালে তিনি টয়লেট-পেপারের ওপর গিকু ভাষায় প্রথম আধুনিক নাটক Caitaani mũtharaba-Inĩ (Devil on the Cross) রচনা করেন। বৎসরাধিক কাল জেল খেটে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাঁকে আর নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে পুনর্বহাল করা হয় না। সেই সময়কার স্বেচ্ছাচারী সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাঁকে বলপ্রয়োগে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

তাঁর পরবর্তী কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ছোটগল্প সংকলন A Meeting in the Dark (১৯৭৪), Secret Lives, and Other Stories (১৯৭৬); Detained (জেলখানার ডায়েরি – ১৯৮১), Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (১৯৮৬), Matigari (১৯৮৭), Wizard of the Crow (২০০৬), Something Torn and New: An African Renaissance (২০০৯), আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ Dreams in a Time of War: a Childhood Memoir (২০১০) এবং In the House of the Interpreter: A Memoir (২০১২)।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও তার প্রতিটি রচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিক, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দানবীয় রূপ। আবার স্বজাতির হীনম্মন্যতা, লাম্পট্য, স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাটের চিত্র তুলে ধরতেও পেছপা হননি। পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব তাঁর লেখায় বড় স্থান দখল করে থাকে। মানব-মনের বিচিত্র ও জটিল দিক ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর যে মুন্সিয়ানা তা পাঠককে সম্মোহিত করে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যার্ভিন-এ ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য’র একজন সম্মানিত অধ্যাপক (Distinguished Professor)।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য একজন কথাশিল্পী হিসেবে বারবার ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র নাম আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে।

এই সুযোগে বলে রাখা ভালো, গিকু বা সোয়াহিলি ভাষার উচ্চারণ বাংলাভাষাভাষীদের জিহ্বায় আনা খুবই দুরূহ — বলা চলে অসম্ভব। তারপরও মূল উচ্চারণের যথাসম্ভব কাছাকাছি থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রেও মূলানুগ থাকবার চেষ্টা করা হয়েছে।

`এবং বৃষ্টি এল ঝেঁপে’ তাঁর গল্প AND THE RAIN CAME DOWN-এর অনুবাদ।



— অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ