কেনিয়ার গল্প : পল্লি-পুরোহিত

মূল: ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও

অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা


পল্লি-পুরোহিত জশুয়া জমতে-থাকা কালো মেঘ দেখে বিড়বিড় করে একটা শব্দ উচ্চারণ করল: ‘বৃষ্টি’। প্রায় ফিসফিসানির মত, এত চাপাস্বরে কথাটা বলল যে, এক গজ দূরের লোকেরও তা শুনতে পাওয়ার কথা নয়। উঁচু জমির ওপর দাঁড়িয়ে খুব চিন্তামগ্নভাবে সে মেঘ ও আশপাশের এলাকা দেখছিল। তার পেছনের চারকোনা টিনের চালের ঘরটি থেকে ঘন কালো ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছিল। বোঝা যাচ্ছিল গৃহকর্ত্রী ইতিমধ্যেই শামবা [শস্যক্ষেত্র] থেকে ফিরে এসে রাতের খাবার তৈরিতে লেগে পড়েছে। তার ঘরটি ছিল পুরো পাহাড় চূড়ায়, এমন কী তার বাইরেও অন্যসব ঘর থেকে ভিন্ন ধরনের — এক অনন্য ঘর। অন্যগুলো ছিল মাটির দেওয়াল, শণে ছাওয়া গোলাকৃতির কুঁড়েঘর, যা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেগুলো থেকেও কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ঊর্ধ্বমুখে উঠতে শুরু করেছিল।


জশুয়া জানত যে, বেশির-ভাগ কুঁড়েঘরের বাসিন্দারা না খেয়ে বা সামান্য কিছু পেটে দিয়ে সংকুচিত, কোঁচকানো পাকস্থলী নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সে গত ক’মাসে এ ধরনের দৃশ্য দেখেছিল যখন সে ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত এবং দুর্দশাগ্রস্তদের এই আশ্বাস দিয়েছিল যে, যথাসময়ে ঈশ্বর বৃষ্টি দেবেন। যেহেতু খরা ছিল ভয়াবহ, চলছিল অনেক মাস ধরে, মাঠের ফসল পড়েছিল নেতিয়ে, কিছু গিয়েছিল একেবারে শুকিয়ে। গরু-ছাগলগুলো শুকিয়ে লিকলিকে, যথেষ্ট দুধ দেওয়ার অবস্থা তাদের ছিল না বললেই চলে।

এখন বৃষ্টি হলে তা সবার জন্য হবে আশির্বাদস্বরূপ, মনে হয় ফসল আবার প্রাণ পাবে, বেড়ে উঠবে এবং সবকিছুই হবে মঙ্গলময়। মা-বাবার চোখের শুকনো অস্থির দৃষ্টি দূর হবে। আবার সে কালো হয়ে-আসা মেঘের দিকে তাকাল, এবং ধীরে ধীরে বুড়ো লোকটি তার ঘরের দিকে ফিরতে পা বাড়াল।

শিগরি শুরু হল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর বজ্রঝড় আকাশ কাঁপিয়ে তুলল এবং বিজলির আঁকাবাঁকা সাদা রেখাগুলো ক্রোধ আর তীক্ষ্ণতা নিয়ে আকাশের এপাশ ওপাশ এমনভাবে চমকাচ্ছিল যে সে ভীত হয়ে পড়েছিল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে, ছোট ছোট পাকা চুলের সারির মধ্যে ঘোড়ার ক্ষুরের আকারের টাক-মাথা পুরোহিত দেখছিল তেরছাভাবে-পড়া বৃষ্টির ফোঁটা, যা শক্ত মাটিতে আঘাত করছিল এবং ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ‘সদাপ্রভু [Jehovah]! সে জিতেছে!’ শ্বাসরুদ্ধ পুরোহিত বিড়বিড় করল। সে নিজেকে প্রতারিত বোধ করল — বিরক্তি এবং ক্রোধও। কারণ সে বুঝতে পারল, সকালে উৎসর্গের পর এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নামাকে রেইনমেকারের [rainmaker, যে ব্যক্তি তন্ত্র-মন্ত্রবলে বৃষ্টি নামাতে পারে বলে ধারণা করা হয়] বিজয় হিসেবে দেখা হবে, রেইনমেকারের অনুরোধে এক কালো ভেড়া বলি দেওয়া হয়েছিল। হ্যাঁ। এটা ছিল মাকু গ্রামে তাদের মধ্যে দীর্ঘ রেষারেষির ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার চূড়ান্ত এক রূপ।

মাকু ছিল বিচ্ছিন্ন এক ক্ষুদ্র এলাকা। এমনকি সবচেয়ে কাছের মিশনারি কেন্দ্রটি ছিল প্রায় পঞ্চান্ন মাইল দূরে — সড়কযোগাযোগবিহীন একটি এলাকার জন্য যথেষ্ট দূরের পথ। আসলে এটা ছিল শ্বেতাঙ্গ মিশনারি, খামার-মালিক ও প্রশাসকদের আগমনে গুরুতরভাবে প্রভাবিত হতে-যাওয়া শেষ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। আর তাই, যখন দেশের বাকি এলাকার সবাই এরই মধ্যে দেখেছিল যে, রেইনমেকার, জাদুকর ও ওঝা-কবিরাজদের অস্তিত্ব খ্রিষ্টধর্মের হুমকির মুখে বিপন্ন, তখনও এই এলাকাটি দিব্যি রেইনমেকারের প্রভাব ও পরিচালনার অধীনে রয়ে গিয়েছিল।

বিরোধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হল তখন থেকে, যখন থালবাইনি মিশনের রেভারেন্ড লিভিংস্টোন এখানে এলেন এবং জশুয়াকে এই নতুন দুর্জ্ঞেয়-জ্ঞান — নতুন ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। শ্বেতাঙ্গদের ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সবকিছুর স্রষ্টা একমাত্র ঈশ্বর হিসেবে বলা হল। কতগুলো লোক জশুয়ার এই নতুন ধর্মবিশ্বাসে দীক্ষিত হয়েছিল তা দেখার পর রেইনমেকার তার বিরোধীদের প্রকাশ্যে তিরস্কার করেছিল। সে যথেষ্ট রেগে গিয়েছিল এবং জশুয়াকে অনুসরণ না করার জন্য জনগণকে বুঝিয়েছিল। সে তাদেরকে প্লেগ এবং মৃত্যুর ভয়ও দেখিয়েছিল। কিন্তু কিছুই ঘটল না। রেইনমেকার এমন কী জশুয়াকে পর্যন্ত শাসিয়েছিল।

কিন্তু জশুয়া এগুলো গায়ে মাখলে তো! কেন সে মাখবে? সেকি লিভিংস্টোন থেকে এই আশ্বাস পায়নি যে, নতুন ঈশ্বর তার সঙ্গে থাকবেন ‘সবসময়ই, এমন কী কেয়ামত না-হওয়া পর্যন্ত?’

তখন দেখা দিয়েছিল খরা। এবং জশুয়া সবসময় গ্রামে বলে এসেছিল যে, বৃষ্টি নামবে। আর সারাটা সময় ধরে সে বারবার প্রার্থনা করছিল বৃষ্টি নামার জন্য। কিন্তু কিছুই ঘটল না। রেইনমেকার জানাল, এই খরা পুরনো ঈশ্বরের ক্রোধ। সে, রেইনমেকারই একমাত্র ব্যক্তি যে জনগণের জন্য মধ্যস্থতা করতে পারে। আজ পবিত্র মুগুমো বৃক্ষের নিচে ত্রুটিমুক্ত একটি কালো ভেড়া উৎসর্গ করা হল। তখন নামল বৃষ্টি! সারা সকাল জশুয়া ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল, যেন অন্তত সেদিনটিতে তিনি বৃষ্টি না দেন। দয়া করুন প্রভু, আমার প্রভু, আজ বৃষ্টি দেবেন না। দয়া করুন ঈশ্বর, আমার ঈশ্বর, আমাকে ওই রেইনমেকারটাকে হারাতে দিন, এবং তাতে আপনার নাম গৌরবান্বিত হবে। কিন্তু তার আকুল আবেদন উপেক্ষা করে বৃষ্টি নামল।

সে বিমূঢ় হয়ে পড়ল, সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। এবং সারা সন্ধ্যা তার কপালে ভাঁজ পড়ে থাকল। কারও সঙ্গে সে কথা বলল না। সে এমনকি পরিবারের সঙ্গে সান্ধ্যপ্রার্থনা করার কথাও বেমালুম ভুলে গিয়ে শুতে গেল। শুয়ে শুয়ে সে এই নতুন ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবতেই থাকল... ভাবতেই থাকল। যদি শুধু লিভিংস্টোন থাকতেন! সবকিছু হয়ত ভালোভাবে হত! তিনি নিশ্চয়ই তাঁর কালো-বই থেকে পাঠ করতেন এবং তাঁর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন, তাহলে কক্ষনই রেইনমেকার জিততে পারত না। এক সপ্তাহ পরে কোনও এক জনসভায় লিভিংস্টোন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতেন। তখন সবাই বিশ্বাস করত এবং জশুয়া মাকুর অবিসম্বাদিত আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে গণ্য হত।

যখন সে তার বাঁশের খুঁটি আর দড়িতে তৈরি খাটিয়াতে শুয়ে ছিল, তার মনে এক চিন্তা এল, এতই বিস্ময়কর ছিল তা যে, সে না পারছিল নড়তে, না শ্বাস নিতে। তাকে এটা নিয়ে ভাবতেই হবে, তাকে এটা বুঝতেই হবে। নতুন ঈশ্বর সাদা মানুষদের আর সেজন্যই সাদা চামড়ার লোক ছাড়া আর কারও কথা শুনতে পেতেন না। প্রত্যেকের তার নিজের ঈশ্বর ছিল। মাসাইদের [মাসাই, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার নৃগোষ্ঠী] ছিল তাদের। আগিকুদের [আগিকু, কেনিয়ার বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী গিকুর অপর নাম] তাদের। সে কেঁপে উঠল। মনে হল সে সবকিছু বুঝতে পেরেছে। কোনও কোনও ঈশ্বর অন্য ঈশ্বর থেকে শক্তিশালী। লিভিংস্টোনও সম্ভবত এটা জানেন। বোধহয় তিনি আগিকুদের ঈশ্বরকে ভয় পান। সেজন্যই তিনি দূরে চলে গিয়েছিলেন এবং দেখা দেননি খরা চলার পুরো সময়টাতে।

আমি কী করব? আমি কী করব? তখন তার মাথায় পরিষ্কার এক চিন্তা এসে ভর করল। একটা উৎসর্গ সেদিন করা হয়েছিল। খুব সকালে সে সেই পবিত্র বৃক্ষের কাছে যাবে এবং তার লোকের ঈশ্বরের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপন করবে।

সকালটা ছিল অন্ধকার এবং কনকনে ঠান্ডা। প্রথম মোরগ এরইমধ্যে ডেকে উঠেছিল। তার স্বাভাবিক পোশাকের ওপর জশুয়া একটা বড় রেইনকোট চাপিয়ে নিল। সে প্রাঙ্গণ ধরে শ্লথ পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল।

ঘরের কালো আবছা দৃশ্য এবং এর পেছনের গোলাঘরকে মনে হচ্ছিল সজাগ ও অশুভ কিছু একটা বলে। সে ভয় বোধ করল কিন্তু তার মন স্থির করা ছিল; দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে দূরবর্তী অরণ্যের সেই পবিত্র বৃক্ষের কাছে যাওয়া এবং সেখানে নিজ গোত্রের ঈশ্বরের সঙ্গে সমঝোতা করা। পাখিরা উড়ছিল, গাইছিল তাদের স্বাভাবিক প্রত্যুষগীত, ভোরের আগমন বার্তা। জশুয়ার প্রতি তাদের ছিল শোকার্ত সুর, মনে হচ্ছিল তারা যেন তাকে নিয়েই গাইছে। সবসময় যেখানে থাকে, এমন কী জশুয়ার জন্মের আগেও যেখানে ছিল, বিশাল বুড়ো গাছটি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ গাছটিকেও রহস্যময় ও অশুভ মনে হল। এখানেই ঈশ্বরের উদ্দেশে পশুবলি দেওয়া হত প্রবীণদের এবং ওঝা-কবিরাজদের নির্দেশমত। আশপাশের শুকনো ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পথ করে জশুয়া বৃক্ষের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কী করে একজন ঈশ্বরের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারে? তার কোনও ভেড়া ছিল না উৎসর্গ করবার। কিছুই ছিল না তার।

‘আগিকুদের ঈশ্বর, আমার নিজ জনগোষ্ঠীর ঈশ্বর...’ সে থামল। কথাগুলো অতি অবাস্তব শোনাল। মিথ্যা। মনে হল সে নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলছিল। জশুয়া আবার শুরু করল। ‘...ঈশ্বর, আগিকুদের... ’ একটা ছোট্ট অস্পষ্ট হাসি, এবং কচি শাখা ভাঙার শব্দ তার কথায় বাধা সৃষ্টি করল। সে আতঙ্ক বোধ করল এবং দ্রুত তার মাথা ফেরাল। সেখানে দাঁড়িয়ে তার দিকে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল রেইনমেকার। সে আবার হেসে উঠল, ভয়াবহ হাসি কিন্তু বিজয়োল্লাসে ভরা।

‘হুম! তাহলে সাদা মানুষের কুকুর সিংহের গর্তে এসেছে। হা! হা! তাহলে জশুয়া এসেছে সমঝোতা করতে। হা! হা! হা! আমি জানতাম তুমি আমার কাছে আসবে, জশুয়া। সাদা আগন্তুকদেরকে তোমার সেবা দিয়ে এই এলাকায় তুমি বিভেদ এনেছ। এখন একমাত্র তোমার লোকেদের শক্তি দিয়েই তোমাকে পরিষ্কার হতে হবে। আর কিছু শুনতে জশুয়া অপেক্ষা করল না। সে দ্রুত বোবা গাছটি থেকে, রেইনমেকার থেকে দূরে চলে গেল। এটা ভয় ছিল না। না সেই বৃক্ষ না রেইনমেকার, সে আর কাউকেই ভয় পেল না। সে তাদের শক্তিতেও আর ভয় পেল না, কেননা সে বুঝে ফেলেছিল, সবকিছুই ভুয়া, যখন সে গাছটির সঙ্গে কথা বলেছিল। এটা এমন কী পরাজয় বোধও নয়। এটা ছিল অন্য কোনও কিছু, আরও খারাপ... লজ্জাকর। এটা ছিল চরম ফাঁপা ও আশাহীনতার এক অনুভূতি, যা কেবল আসতে পারে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন লোকের মধ্যে, যে তার বিশ্বাসকে বলি দিয়েছে। লজ্জাবোধ তাকে আরও দ্রুত চলতে বাধ্য করল। যখন দিবাশেষে সে বাড়ির দিকে ফিরে চলল, লজ্জা তাকে না বাঁয়ে না ডানে তাকাতে দিল। —

ভ্রমণ ছিল দীর্ঘ। পথ কর্দমাক্ত। কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল থাকলে তো। কিছু সে দেখল না, অনুভব করল না কিছুই। লজ্জার ফাঁপা অনুভূতি এবং নিজের প্রতি ঘৃণা — শুধু এটাই তখন তার মধ্যে খেলা করছিল। পুরনো গাছের নিচে সে কি তার বিশ্বাস বলি দেয়নি? ‘লিভিংস্টোন আমাকে এখন কী বলবেন?’ সে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগল। লিভিংস্টোন আবার তাকে ভর্ৎসনা করবেন। তিনি তাকে অযোগ্য মনে করবেন। একবার জশুয়া যখন পিপাসা নিবারণের জন্য সামান্য এক চুমুক বিয়ার খেয়েছিল, কী নিন্দাটাই না তিনি করেছিলেন। আরেকবার হুঁশিয়ার করেছিলেন, যখন জশুয়া দ্রুত হুকুম না পালন করার জন্য তার স্ত্রীকে পিটিয়েছিল।

‘ঈশ্বরের লোকেদের এ ধরনের আচরণ শোভা পায় না।’ লিভিংস্টোন তাকে ধীর বিষাদময় কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিলেন। হ্যাঁ। কেউ লিভিংস্টোনকে বুঝতে পারত না। একসময় তিনি অযৌক্তিকভাবে হতেন কঠোর এবং উদ্ধত আবার অন্যসময় তিনি হতেন দুঃখিত। যখন পুরু কানাঅলা রোদনিরোধক হেলমেটে ঢাকা মাথা নিয়ে তিনি তাঁর নির্লিপ্ত নীল চোখে তোমার দিকে তাকাবেন, তুমি তাঁর অভিব্যক্তিতে কোনও অলৌকিকত্ব খুঁজে বার করতে পারবে না। জশুয়া এখন নিশ্চিত যে, লিভিংস্টোন তাকে নেতা হওয়ার প্রশ্নে সম্পূর্ণ অপদার্থ, অযোগ্য ভাববেন। সে নিজ সম্পর্কেও তেমনটাই ভাবল।

অবশেষে জশুয়া যখন বাড়ি পৌঁছল সূর্য তখন পূর্বদিগন্তে উঁকি দিয়েছিল। সে বাইরে অপেক্ষা করল, পুরো পাহাড়-চূড়া এবং বাইরের এলাকায় ভালোভাবে চোখ বোলাল। হঠাৎই তার মনে হল সে দৌড়ে পালাচ্ছে, আর কখনও সে ধর্মপ্রচার করবে না। এতটাই গভীর চিন্তামগ্ন ছিল যে, মনে হল, সে তার স্ত্রীর উৎকণ্ঠা, উত্তেজিত চেহারা দেখতেই পায়নি, যখন বাইরে এসে সে জানিয়েছিল, ‘কেউ একজন’, একজন অতিথি এসেছেন এবং তার জন্য ঘরে অপেক্ষা করছেন।

‘কে হতে পারে?’ যত্তসব মেয়েলোক। তারা কখনও বলবে না অতিথিটি কে, শুধু বলবে, ‘কেউ একজন’। কারও সঙ্গে দেখা করবার ইচ্ছা আদপেই তার হচ্ছিল না, কেননা তার কাছে এখন আগাগোড়া সবকিছু স্বচ্ছ মনে হচ্ছিল। এটা কি রেইনমেকার হতে পারত? এরকমটা ভাবতেই সে কেঁপে উঠল। এটা কি গোত্রের কেউ হতে পারত? তাহলে সে তাকে কী বলতে পারত, যখন সে নিজেই বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল? একজন পুরোহিত হবার যোগ্যতা তার ছিল না। ‘আজ যদি লিভিংস্টোনের সঙ্গে দেখা হয়, বলব আমাকে ত্যাগ করতে। তারপর আমি এখান থেকে চলে যাব।’

সে ঘরে প্রবেশ করল এবং থমকে দাঁড়াল। কেননা সেখানে তেপায়া গিকু টুলের ওপর যিনি বসেছিলে তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং লিভিংস্টোন। সারা রাতের সফরে একেবারে ক্লান্ত ও ধ্বস্ত লিভিংস্টোন চোখ তুলে জশুয়ার দিকে তাকালেন। কিন্তু জশুয়া তাঁকে দেখছিল না। সে যেন অন্যকিছু দেখছিল।

সে দেখছিল সেই বেদিটাকে, যার ওপর বলি দিয়েছিল তার সব দৃঢ়বিশ্বাস। সে দেখছিল রেইনমেকারকে, শুনছিল তার বিদ্বেষমেশানো বিজয়সূচক অট্টহাসি।

ছুটে পালাও, জশুয়া! কিন্তু সে নড়ল না।

ছুটে পালাও, জশুয়া! কিন্তু সে লিভিংস্টোনের আরও কাছে ঘেঁষল, যেন সুরক্ষার জন্য।

তাহলে তাঁকে কিছু জানিও না! কিন্তু সে তাঁকে সবকিছু খুলে বলল। এবং একদণ্ডের জন্যও জশুয়া সাহস পেল না মাথা তুলতে। সে মাথা নিচু করেই থাকল। এবং যেহেতু সে সব খুলে বলল, চরম শূন্যতাবোধ ও লজ্জার অনুভূতি সত্ত্বেও, সে বোধ করল তার হাঁটু থেকে শক্তি উবে যাচ্ছে। সে ডুবে যাচ্ছিল... ডুবে যাচ্ছিল..., সে দেওয়ালের সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে সেঁটে পড়ছিল, যদিও তার দৃষ্টি মাটির দিকে নামানোই ছিল। লিভিংস্টোন একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। ঘরটিতে বিরাজ করছিল নিরেট নৈঃশব্দ্য। জশুয়া তার নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিল, ঢিপ্-ঢিপ্। সে অপেক্ষা করছিল, তাকে নিন্দা করার পর এবং এখানে আসাটা কী অযথাই না হয়েছে তা বলার পর লিভিংস্টোনের উঠে দাঁড়ানো এবং চলে যাওয়া দেখবার জন্য।

সাবধানতার সাথে জশুয়া তার চোখ তুলে ধরল। সে লিভিংস্টোনের পুরো হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা দেখতে পেল। জীবনে এর চেয়ে বেশি বিস্মিত আর কখনও হয়নি সে। লিভিংস্টোনের পুরনো নির্দয়তা এবং দৃশ্যমান কঠোরতা তাঁর চোখে আর ছিল না, তার বদলে ছিল তেমন একজন মানুষের শুধু কোমলতা ও প্রসন্নতাপূর্ণ সহানুভূতির চাউনি, যিনি নিশ্চিত হয়েছেন তাঁর নতুন এবং দৃঢ়তর অনুসারী সম্পর্কে। জশুয়া এই চাউনি বুঝে উঠতে পারছিল না এবং তার হৃৎস্পন্দন আরও বেড়ে গিয়েছিল ও শব্দ হচ্ছিল আরও জোরে।

ধীরেসুস্থে আলোচনা করার সাথে সাথে লিভিংস্টোন জশুয়ার ডান হাত তার হাতে তুলে নিলেন এবং বাঁ হাত দিয়ে তার কাঁধে চাপড় দিতে থাকলেন। ভগ্নহৃদয় ও অনুতপ্ত আত্মা সম্পর্কে তিনি বিড়বিড় করে কিছু বললেন। জশুয়া নীরবে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। ‘আসুন আমরা প্রার্থনা করি’, অবশেষে লিভিংস্টোন বললেন।

জশুয়ার স্ত্রী কক্ষে প্রবেশ করল, তাদের সে গভীর উপাসনায় মগ্ন দেখল, এবং রান্নাঘরে ফিরে গেল এই বিস্ময় নিয়ে যে, কী এমন ঘটেছিল! ক’মিনিট পর যখন সে ফিরে এল, লিভিংস্টোনকে মাকুদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে দেখল, এখন, এমন এক সময়ে, যখন বৃষ্টি এসেছিল এবং কেটে গিয়েছিল খরা।

জশুয়া শুনে চলল।

----------------------------------------------------

টীকা: এখানে তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরকার শব্দ/বাক্যগুলো অনুবাদকের।


লেখক পরিচিত
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও

কেনিয়ার কিয়াম্বু জেলার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র জন্ম। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ ন্গুগি।

তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে বিএ পাশ করেন। সেই সময়েই, অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায়, ১৯৬২-তে তাঁর লেখা The Black Hermit নামের নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child প্রকাশিত হয়। এটি লেখেন ইংল্যান্ডের লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। এটা কোনও পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস The River Between, রচিত হয় ১৯৬৫-তে। ১৯৬৭ সালে রচিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তিনি ইংরেজি, খ্রিস্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস্ ন্গুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন তাঁর মাতৃভাষা গিকু এবং সোয়াহিলিতে।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও ১৯৭৬ সালে তাঁর নিজ এলাকা কামিরিথুতে Kamiriithu Community Education and Cultural Centre স্থাপনে সহায়তা করেন। যা অন্য কার্যক্রমের পাশাপাশি এলাকাতে আফ্রিকান নাট্য-আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকত। ১৯৭৭-এ তাঁর অসেন্সরকৃত নাটক Ngaahika Ndeenda (I Will Marry When I Want) কেনিয়ার তদানীন্তন ভাইসপ্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোইকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে এবং থিয়োঙ্গ’ওকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলখানায় অবস্থানকালে তিনি টয়লেট-পেপারের ওপর গিকু ভাষায় প্রথম আধুনিক নাটক Caitaani mũtharaba-Inĩ (Devil on the Cross) রচনা করেন। বৎসরাধিক কাল জেল খেটে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাঁকে আর নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে পুনর্বহাল করা হয় না। সেই সময়কার স্বেচ্ছাচারী সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাঁকে বলপ্রয়োগে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

তাঁর পরবর্তী কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ছোটগল্প সংকলন A Meeting in the Dark (১৯৭৪), Secret Lives, and Other Stories (১৯৭৬); Detained (জেলখানার ডায়েরি – ১৯৮১), Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (১৯৮৬), Matigari (১৯৮৭), Wizard of the Crow (২০০৬), Something Torn and New: An African Renaissance (২০০৯), আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ Dreams in a Time of War: a Childhood Memoir (২০১০) এবং In the House of the Interpreter: A Memoir (২০১২)।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও তার প্রতিটি রচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিক, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দানবীয় রূপ। আবার স্বজাতির হীনম্মন্যতা, লাম্পট্য, স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাটের চিত্র তুলে ধরতেও পেছপা হননি। পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব তাঁর লেখায় বড় স্থান দখল করে থাকে। মানব-মনের বিচিত্র ও জটিল দিক ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর যে মুন্সিয়ানা তা পাঠককে সম্মোহিত করে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যার্ভিন-এ ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য’র একজন সম্মানিত অধ্যাপক (Distinguished Professor)।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য একজন কথাশিল্পী হিসেবে বারবার ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র নাম আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে।

এই সুযোগে বলে রাখা ভালো, গিকু বা সোয়াহিলি ভাষার উচ্চারণ বাংলাভাষাভাষীদের জিহ্বায় আনা খুবই দুরূহ — বলা চলে অসম্ভব। তারপরও মূল উচ্চারণের যথাসম্ভব কাছাকাছি থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রেও মূলানুগ থাকবার চেষ্টা করা হয়েছে।

`এবং বৃষ্টি এল ঝেঁপে’ তাঁর গল্প AND THE RAIN CAME DOWN-এর অনুবাদ।

— অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ