মূল: ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও
অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা
অবশেষে আমিও বিশ্বাস করলাম, সে পাগলি ছিল। এটা স্বাভাবিক। কেননা আমার মা বলেছিলেন, সে পাগলি। এবং গ্রামের সবারই মনে হয় একই ধরনের অভিমত ছিল। এমন নয় যে বুড়িটি কখনও সত্যি এমন অস্বাভাবিক কিছু করত যা পাগলেরা করে থাকে। কখনও সে বেশি কথা বলত না। কিন্তু কখনও কখনও বোধগম্য কোনও কারণ ছাড়াই সে প্রবল আবেগের চাপে অনিয়ন্ত্রিত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত।
লোকজনের দিকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাত, যেন তাদের দৃশ্যমান অস্তিত্বের বাইরেও কিছু সে দেখতে পেত— সেকারণেও হতে পারে তার সম্পর্কে লোকেদের এমন ধারণা জন্মেছিল। কোঁচকানো ত্বক ও অস্থিচর্মসার দেহের সঙ্গে তার জীবন্ত জ্বলজ্বলে চোখজোড়া খাপ খেত না একদম। কিন্তু তার চোখে এমন কিছু একটা ছিল যা কোনও না কোনওভাবে রহস্যময়তা ও অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দিত এবং যা একেবারে শুরু থেকেই তার পাগলামি সম্পর্কে আমার বিশ্বাসে নাড়া দিয়েছিল। সেই ‘এমন একটা কিছু’ কী ছিল, আর কোথায় ছিল সেটা? হতে পারে সেটা ছিল তার মধ্যেই, অথবা যেভাবে সে লোকেদের দিকে তাকায় তাতে, বা নেহাত তার ভাবভঙ্গি, অভিব্যক্তির মধ্যে। হতে পারে সেটা ছিল যেকোনওটার মধ্যে, অথবা একইসঙ্গে সবগুলোর মধ্যে।
এই স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে আমার ভাবনা নিয়ে বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলবার সুযোগ ঘটত। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলতেন, ‘মনে হয় এটা বিষাদ। এই জ্বলন্ত সূর্য, নির্দয় খরা... ছুটে বেড়াচ্ছে আমাদের মগজের ভেতর, আমাদের রূপান্তরিত করছে সাদায় এবং পাগলে!’
আমি তখন বুঝিনি, কেন তিনি এরকম বলতেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি, তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন না, বরং তাঁর ধারণাই উঁচু স্বরে ব্যক্ত করছিলেন। কিন্তু তাঁর কথাই ঠিক ছিল, আমি বোঝাতে চাইছি, ‘সাদা’ সম্পর্কে তাঁর উক্তি।
কারণ পুরো দেশটাকেই সাদা মনে হচ্ছিল — মৃত্যুর মত সাদাটে।
পাহাড়ের চূড়া থেকে চূড়ায় সুবিন্যস্ত চোখজুড়ানো ছোট ছোট শামবাগুলো [শস্যক্ষেত্র] হয়ে পড়েছিল বিরান। ভূমি-উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট, আমাদের জেলার কৃষকদের গর্ব একসময়কার খাটো লতাগুল্মের দৃষ্টিনন্দন বেষ্টনিগুলো শুকিয়ে হয়ে পড়েছিল কী হতচ্ছিরি, ধুলোবালি মাখা। এমনকি আমাদের গ্রামের ঠিক নিচটাতে যে মুগুমো গাছ, কখনও যা শুকাত না, প্রাণবন্ত শ্যামলশোভা নিয়ে যে টিটকারি দিত স্বল্পমেয়াদী খরাকে, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তারও পত্র-পল্লব। অনেকেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করল। আবহাওয়াবিশারদ ও ওঝা-কবিরাজ যাদের কেউ কেউ তখনও ক্ষীণ প্রভাব নিয়ে আমাদের গ্রামে টিকে ছিল, গ্রামবাসীরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসল, সবাই মহাবিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিল।
এদিকে রেডিওর রমরমা অবস্থা। ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস’— যা একসময় কেবল সম্ভাব্য ভ্রমণকারীদের আগ্রহের খবর ছিল, এখন সবারই হয়ে দাঁড়াল প্রধানতম আগ্রহের খবর। হ্যাঁ। মনে হয় কেবিএস-এর [কেনিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস] ও আবহাওয়া-দপ্তরের লোকেরা আবহাওয়া-বার্তা জানানোর জন্য তাদের ম্যাজিক-যন্ত্র দিয়ে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে চলেছিল।
কিন্তু আমাদের গ্রামের সাধারণ নারীপুরুষেরা কেবল মেঘ দেখছিল এবং অপেক্ষা করছিল। আমার বাবার চার স্ত্রী ও গ্রামের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের প্রতিদিনই শামবার দিকে যেতে দেখতাম। তারা বসে বসে গল্পগুজব করত, আর আসলে অপেক্ষা করত সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য যখন ঈশ্বর বৃষ্টি দেবেন। আমাদের নতুন গ্রামের ধুলোভরা পথে যেসব বাচ্চা ছেলেপিলে একসময় খেলাধুলা করত, বন্ধ করে দিয়েছিল তা। সবাই অপেক্ষা করছিল; আকাশের পানে তাকাচ্ছিল চাতকের ন্যায় এবং আশায় বুক বেঁধে।
বহুলোক ভুখা। বেশির-ভাগ পরিবারের তুলনায় আমরা অবশ্য ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার ভাইদের মধ্যে একজন নাইরোবি ও অন্যজন লিমুরুতে কাজ করত।
বৃদ্ধা নারী সম্পর্কে বাবার সেই মন্তব্যটি আমাকে আরও গভীর চিন্তায় ফেলল। মাসের শেষে মা যখন বাজার থেকে কিছু শাক-লতা ও জাহি সিম [কেনিয়ার একধরনের সবজি] কিনে আনলেন আমি সেখান থেকে কিছু আনাজ চুরি করলাম এবং সন্ধ্যাবেলায় বুড়ির মাটির ঘরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। পেয়ে গেলাম সহজেই। গ্রামের কেন্দ্রস্থলেই ছিল বুড়ির কুঁড়েঘরটা। ওটাই ছিল স্ত্রীলোকটির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। আমি সেখানে বহুবার গিয়েছি, তবুও সেই সন্ধ্যা এখনও আমার স্মৃতিতে সবথেকে বেশি উজ্জ্বল। যখন প্রায় নিভে-আসা জ্বালানি কাঠের অঙ্গার ফায়ারপ্লেসে সামান্যই দপদপ করছিল, ভুতুড়ে ছায়া ফেলছিল মাটির দেওয়ালে, আমি তাকে জড়োসড়ো অবস্থায় দেখতে পেলাম ঘরের অন্ধকার এক কোনায়। আতঙ্কিত আমি পালাতে উদ্যত হলাম। কিন্তু পারলাম না। আমি তাকে ‘দাদিমা’ বলে ডাকলাম — যদিও মনে হল ওই সম্বোধন পাওয়ার মত অতটা বৃদ্ধা সে নয় — তাকে আনাজগুলো দিলাম। সে ওগুলোর দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে। তার চোখজোড়া কিছুটা উজ্জ্বল হল। তখন সে তার মুখ নিচু করল এবং বিলাপ করতে লাগল।
‘আমি ভাবলাম এটা “সে”, ফিরে এসেছে আমার কাছে।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল। এবং তারপর,‘আহ্, খরা আমার সবকিছু ছারখার করে দিয়েছে।’
আমি এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলাম না, দ্রুত ছুটে বেরিয়ে এলাম একথা ভাবতে ভাবতে যে, আমার বাবা এসব কিছু জানেন কিনা। বোধহয় সে পাগলিই ছিল।
এক সপ্তাহ পর সে আমাকে ‘তার’ সম্পর্কে বলল। যখন সে খরার বিরুদ্ধে তার জীবনব্যাপী লড়াইয়ের কথা অসংলগ্নভাবে আমায় বলল, আঁধার-ঢাকা সেই কুঁড়েঘরে যে বিষণ্ন পরিবেশ তৈরি হল তা বর্ণনা করা শব্দের সাধ্যের বাইরে।
আমি যেমন বলেছি, আমরা সবাই মাসের পর মাস অধীর আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায় বসেছিলাম। গত রাতে যখন প্রথম ক’ফোঁটা বৃষ্টি হল, তা অস্বাভাবিক এক নিঃসঙ্গতা ও অবসাদে সবার মন ছেয়ে ফেলল। রাস্তাঘাটে কোনও হৈচৈ ছিল না। একমাত্র সন্তানের পাশে বসে তাকিয়ে-থাকা স্ত্রীলোকটি কিছু শুনছিল না। সে শুধু তেপায়া গিকুয়ু টুলের ওপর বসে ফায়ারপ্লেসের ধারে ছোট্ট বিছানায় তার কালো চেহারার সন্তানের তীব্র যন্ত্রণায় মোচড়ানো দেখছিল। যখন প্রায় শেষ হয়ে-আসা আগুন থেকে-থেকে দপদপ করছিল, এটা উন্মোচিত করল একটা কালো চেহারা যা এখন সাদায় রূপান্তরিত। ভুতুড়ে ছায়া দেওয়ালের এমাথা-ওমাথা ছোটাছুটি করছিল যেন একাকী বসে-থাকা দর্শককে উপহাস করতে। আর ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেই চলেছিল:
‘তুমি কি মনে কর, আমি মারা যাব, মা?’ বুড়ি জানত না কী বলবে বা করবে। সে শুধু আশা করতে পারত এবং করতে পারত প্রার্থনা। তবুও ক্ষুধার্ত ছেলেটা অনুনয়ভরা কণ্ঠে বলেই চলল, ‘মা, আমি মরতে চাই না।’ কিন্তু মা অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। উপলব্ধি করল, যেন তার মনোবল এবং শারীরিক শক্তি তাকে ত্যাগ করে গিয়েছে। আবার অনুযোগভরা সেই আকুতি, ‘মা, আমাকে কিছু একটা খেতে দাও।’ নিশ্চয়ই সে জানত না, জানতে পারেনি, স্ত্রীলোকটির কিছুই ছিল না, তার শেষ দানা গমটুকুও শেষ করে ফেলেছিল। সে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, তার প্রতিবেশীদের আর বিরক্ত করবে না, কেননা তারা তাকে দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে টিকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত তারাও তাদের সহায়-সম্বল খরচ করে ফেলেছিল। তথাপিও ছেলেটি ক্ষোভ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন সে তাকে দয়ামায়াহীন একজন মানুষ হিসাবে অভিযুক্ত করছিল।
নিজের পুরুষ ছাড়া একজন নারী কী-ই বা করতে পারত? জরুরি অবস্থার সময় সে তাকে হারিয়েছিল, মাউ মাউদের [Mau Mau, বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইরত কেনিয়ার জাতীয়তাবাদী শক্তি] দ্বারা বা ঔপনিবেশিক সেনাদের হাতে সে নিহত হয়নি, এক বিয়ার পানের আসরে তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এটা এতই আকস্মিক মৃত্যু ছিল যে, পারতপক্ষে লোকে কেবল এটুকুই বলত। ছেলেটাকে দেখবার কাজে তাকে সাহায্য করবার জন্য লোকটা এখন আর নেই।
১৯৬১’র এই রাত ’৪০-এর অপর এক রাত থেকে তার কাছে এতটুকুই ভিন্ন ছিল যে, তখন তার দুই ছেলে খরা এবং অনাহারে একের পর আরেক মারা গিয়েছিল। সেটা ছিল, যাকে বলা হয় ‘কাসাভা দুর্ভিক্ষ’র সময়। লোকে কাসাভা থেকে আটা তৈরি করে খেত বলে ওটাকে এ-নামে ডাকা হত। তখন তার স্বামী তার সঙ্গে ছিল শোক ভাগ করে নেওয়ার জন্য। এখন সে একাকী। তার কাছে ব্যাপারটা খুবই অন্যায্য বলে মনে হল। এটা কি ছিল পরিবারের ওপর কোনও অভিশাপ? সে এমনটাই ভাবল, কেননা তার নিজেরই জন্ম হত না, যদি না এমনই এক দুর্ভিক্ষ থেকে সৌভাগ্যক্রমে তার মাকে মিশনারিরা রক্ষা করত। এটা ঘটেছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রকৃত অর্থে কেনিয়া আগমনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে। রুরায়া দুর্ভিক্ষ (ইংল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ) ছিল গিকুয়ু জনগোষ্ঠীর মোকাবেলা করা তখন পর্যন্ত সবথেকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তার দাদা-দাদি মারা গিয়েছিল, পরিবারের মধ্যে একা সে-ই প্রাণে বেঁচেছিল। হ্যাঁ। যখন সে ছেলেটার অভিযোগের, অনুনয়ের মুখ দেখত, তখন সব দুর্ভিক্ষের ভয়াল চিত্র তার মধ্যে জেগে উঠত। কেন এটা শুধু তার জন্য? কেন অন্য নারীদের জন্য নয়? ছেলেটা তার শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান।
সে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল এবং গ্রামের প্রধানের কাছে গিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, তার কাছে কিছু নেই। তাছাড়া মনে হয়েছিল, সে তাকে বুঝতে পারছে না, অথবা বুঝতে পারছে না যে, খরা প্রকৃতই মানুষ মারতে পারে। সে ভেবেছিল, তার ছেলেটি সেই পুরনো রোগে ভুগছে, যা তাকে প্রায়ই আক্রমণ করে থাকে। অবশ্য মা-ও এরকমই কিছুটা চিন্তা করেছিল। ছেলেটা তার সবসময়ই রোগে-ভোগা এক সন্তান। কিন্তু সে কখনও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। এমনকি এখনও সে নেবে না। না, না, এমনকি হাসপাতালও তাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। তার সাধ্যমত এই পঙ্গুর জন্য যা কিছু করা সম্ভব সেটা করাকে সে প্রাধান্য দিয়েছিল। এবং এইবার সে বুঝল, এটা উপোস যা তাকে মেরে ফেলছিল। গ্রামপ্রধান জানিয়েছিল যে, জেলা-কর্মকর্তা খাদ্যদ্রব্যে রেশন-প্রথা চালু করেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কার্যক্রম’-এর অংশবিশেষ খাদ্য খরা কবলিত এলাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা সম্পর্কে সে আগে কেন শোনেনি? সে-রাতে সে ঘুমিয়েছিল, কিন্তু খুব ভালোভাবে নয়, কেননা পঙ্গুটি জিজ্ঞেস করেই চলেছিল, ‘আমি কি সুস্থ হয়ে উঠব, মা?’
জেলা-কর্মকর্তার কার্যালয়ে লম্বা লাইন। সে তার রেশন নিয়েছিল এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্লথ পায়ে বাড়ি ফিরে চলেছিল। সে ঘরে প্রবেশ না করে বাইরেই বসে পড়েছিল, তার হাঁটুর শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। এবং অদ্ভুত চেহারার নারী-পুরুষেরা তাকে কিছু না বলেই তার ঘর থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে আসছিল। বলার প্রয়োজনও ছিল না। সে জানতে পেরেছিল, তার ছেলে চলে গিয়েছে, এবং আর কখনও সে ফিরে আসবে না।
বৃদ্ধা একবারও আমার দিকে তাকায়নি যখন এসব বলছিল। এখন সে চোখ তুলে তাকাল এবং বলে চলল, ‘আমি এখন একজন বুড়ি। সূর্য অস্তমিত হয়েছে আমার একমাত্র সন্তানের ওপর; খরা তাকে নিয়ে গিয়েছে। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।‘ সে আবার চোখ নামাল এবং নিভে-আসা আগুন খোঁচাল।
যাওয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়ালাম। যদিও সে ভাঙাভাঙা গলায় আমাকে কাহিনিটি বলেছিল, কিন্তু তা এমন ভাষায় যা অবশ্যই কোনও পাগল নারীর হতে পারে না। এবং সেই রাতে (সেটা ছিল রবি বা শনিবার) আমি এই বিস্ময় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, কেন কিছু লোক জন্ম নেয় যন্ত্রণা ভোগের জন্য এবং সহ্য করবার জন্য অসহনীয় দুর্দশা।
দুই বা তিন সপ্তাহ আগে আমি বৃদ্ধার সঙ্গে শেষবারের মত কথা বলি। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার জন্য আমি ভালোভাবে মনে করতে পারছি না। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বলা চলে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, যদিও হালকা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। স্ত্রীলোকেরা শস্য রোপণের কাজে ব্যস্ত। সবার মনে আশা জেগে উঠেছে।
মূলত মুষলধারায় মৌসুমি বৃষ্টির শুরু গতকাল থেকে। একটু আগেভাগেই শুরু। এমন বৃষ্টির দেখা বহুবছর মেলেনি। আমি বৃদ্ধ নারীটির কুঁড়েঘরে উপহারসামগ্রী নিয়ে গেলাম। এবার শাকলতা বা সিম নয়, মিষ্টি আলু। দরজা খুলে তাকে যথারীতি এক কোনায় জড়োসড়ো অবস্থায় দেখতে পেলাম। আগুন নিভে গিয়েছিল। শুধুমাত্র লন্ঠনের কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো তখনও জ্বলে চলেছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। সে সামান্য মাথা তুলল। প্রায় ক্ষয়ে-আসা শীতল আলোতে তাকে সাদা দেখাল। সে তার চোখ সামান্য খুলল। সেগুলোর অস্বাভাবিক অলৌকিক উজ্জ্বলতা সহস্রগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কেবল বাড়তি কিছু তাতে ছিল। দুঃখ নয়। আনন্দ বা উল্লাসের এক চিহ্ন ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন অনেকদিন আগে হারিয়ে-যাওয়া কিছু একটা সে ফিরে পেয়েছে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত। সে হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাসিতে এমন কিছু ছিল, যা অপার্থিব, প্রায় দানবীয় — কুৎসিত। সে কথা বলতে লাগল, দুর্বল সুরে, আমার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার সন্তুষ্টি বা স্বস্তিকে উচ্চস্বরে ঘোষণা করে।
‘আমি তাদের সবাইকে এখন দেখছি। সবাই সদর-দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এবং আমি যাচ্ছি...’
তারপর আবার সে কুঁজো হল। তক্ষুনি কষ্টে জ্বলতে-থাকা লন্ঠনটা দপ করে নিভে গেল, কিন্তু তার আগে নয় যখন আমি দেখেছিলাম আমার দেওয়া সব উপহার ঘরের কোনায় জমা করা, যা কখনও স্পর্শই করা হয়নি।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। রাস্তার পাশের খোলা দরজাগুলোয় আমি দেখতে পেলাম জ্বালানো আগুনের দপদপানি, শুনলাম লোকজনের চেঁচামেচি ও অট্টহাসি।
বাড়িতে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। বাবাও ছিলেন। মা এরই মধ্যে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করেছেন। বৃষ্টি এবং খরা যা এখন আর নেই সেগুলো নিয়ে আমার ভাই-বোনেরা বকবক করে চলেছে। বাবা ছিলেন যথারীতি নীরব এবং চিন্তামগ্ন। আমিও ছিলাম চুপচাপ। আমি কথাবার্তায় যোগ দিলাম না, কেননা আমার মন তখনও সেই ‘পাগলি’ স্ত্রীলোক এবং তাকে উপহার হিসাবে আমার দেওয়া খাদ্য, যা স্পর্শই করা হয়নি তাতে পড়ে ছিল। আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিল, সে-ও কী হারিয়ে গেছে খরায় এবং অনাহারে! ঠিক তখনই ভাইদের মধ্যে থেকে একজন স্ত্রীলোকটিকে নিয়ে ঠাট্টা করে এমন কিছু মন্তব্য করল, যা শুনে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
‘সত্যি পাগলি।’ আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। আর সবাই তখন সচকিত ভীতি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাদের সবাই, কেবল বাবা বাদে — তিনি ফাঁকা অনিমেষ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে।
----------------------------------------
টীকা:
প্রথম বন্ধনীর ভেতরকার শব্দগুলো লেখকের, তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরকারগুলো অনুবাদকের।
লেখক পরিচিতি
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও
কেনিয়ার কিয়াম্বু জেলার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র জন্ম। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ ন্গুগি।
তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে বিএ পাশ করেন। সেই সময়েই, অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায়, ১৯৬২-তে তাঁর লেখা The Black Hermit নামের নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child, প্রকাশিত হয়। এটি লেখেন ইংল্যান্ডের লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। এটা কোনও পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস The River Between, রচিত হয় ১৯৬৫-তে। ১৯৬৭ সালে রচিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তাঁর ঝোঁক লক্ষ করা যায়। তিনি ইংরেজি, খ্রিস্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস্ ন্গুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন তাঁর মাতৃভাষা গিকুয়ু এবং সোয়াহিলিতে।
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও ১৯৭৬ সালে তাঁর নিজ এলাকায় কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার স্থাপনে সহায়তা করেন। এটি অন্য কার্যক্রমের পাশাপাশি এলাকাতে আফ্রিকান নাট্য-আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকত। ১৯৭৭-এ তাঁর অসেন্সরকৃত নাটক I Will Marry When I Want কেনিয়ার তদানীন্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোইকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে এবং থিয়োঙ্গ’ওকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলখানায় অবস্থানকালে তিনি টয়লেট-পেপারের ওপর গিকুয়ু ভাষায় প্রথম আধুনিক নাটক Caitaani mũtharaba-Inĩ [Devil on the Cross] রচনা করেন। বৎসরাধিক কাল জেল খেটে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাঁকে আর নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে পুনর্বহাল করা হয় না। সেই সময়কার স্বেচ্ছাচারী সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাঁকে বলপ্রয়োগে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
তাঁর পরবর্তী কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, দুটো ছোটগল্প সংকলন A Meeting in the Dark [১৯৭৪], Secret Lives, and Other Stories [১৯৭৬]; Detained [জেলখানার ডায়েরি – ১৯৮১], Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature [নিবন্ধগ্রন্থ – ১৯৮৬], Matigari [উপন্যাস – ১৯৮৭], Wizard of the Crow [উপন্যাস – ২০০৬], Something Torn and New: An African Renaissance [নিবন্ধগ্রন্থ – ২০০৯], আত্মজীবনীমূলক দুটো গ্রন্থ, Dreams in a Time of War: a Childhood Memoir [২০১০] এবং In the House of the Interpreter: A Memoir [২০১২]।
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও তার প্রতিটি রচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সমাজ-জীবনের বিভিন্ন দিক, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দানবীয় রূপ। আবার স্বজাতির হীনম্মন্যতা, লাম্পট্য, স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাটের চিত্র তুলে ধরতেও পিছপা হননি। আফ্রিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভয়াবহ দুর্দশার চিত্র তাঁর মত এমন নিখুঁতভাবে আর কে-ই বা ফোটাতে পেরেছেন? পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব তাঁর লেখায় বড় স্থান দখল করে থাকে। মানব-মনের বিচিত্র ও জটিল দিক ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাঁর যে মুন্সিয়ানা তা পাঠককে সম্মোহিত করে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার একজন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে বারবার ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র নাম আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে।
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, আরভিন-এ ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য’র একজন সম্মানীত অধ্যাপক [Distinguished Professor]|
‘খরায় হারিয়ে যাওয়া’ তাঁর গল্প `GONE WITH THE DROUGHT’-এর অনুবাদ। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূলানুগ থাকবার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা
গল্পকার। অনুবাদক।
অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা
অবশেষে আমিও বিশ্বাস করলাম, সে পাগলি ছিল। এটা স্বাভাবিক। কেননা আমার মা বলেছিলেন, সে পাগলি। এবং গ্রামের সবারই মনে হয় একই ধরনের অভিমত ছিল। এমন নয় যে বুড়িটি কখনও সত্যি এমন অস্বাভাবিক কিছু করত যা পাগলেরা করে থাকে। কখনও সে বেশি কথা বলত না। কিন্তু কখনও কখনও বোধগম্য কোনও কারণ ছাড়াই সে প্রবল আবেগের চাপে অনিয়ন্ত্রিত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত।
লোকজনের দিকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাত, যেন তাদের দৃশ্যমান অস্তিত্বের বাইরেও কিছু সে দেখতে পেত— সেকারণেও হতে পারে তার সম্পর্কে লোকেদের এমন ধারণা জন্মেছিল। কোঁচকানো ত্বক ও অস্থিচর্মসার দেহের সঙ্গে তার জীবন্ত জ্বলজ্বলে চোখজোড়া খাপ খেত না একদম। কিন্তু তার চোখে এমন কিছু একটা ছিল যা কোনও না কোনওভাবে রহস্যময়তা ও অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দিত এবং যা একেবারে শুরু থেকেই তার পাগলামি সম্পর্কে আমার বিশ্বাসে নাড়া দিয়েছিল। সেই ‘এমন একটা কিছু’ কী ছিল, আর কোথায় ছিল সেটা? হতে পারে সেটা ছিল তার মধ্যেই, অথবা যেভাবে সে লোকেদের দিকে তাকায় তাতে, বা নেহাত তার ভাবভঙ্গি, অভিব্যক্তির মধ্যে। হতে পারে সেটা ছিল যেকোনওটার মধ্যে, অথবা একইসঙ্গে সবগুলোর মধ্যে।
এই স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে আমার ভাবনা নিয়ে বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলবার সুযোগ ঘটত। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলতেন, ‘মনে হয় এটা বিষাদ। এই জ্বলন্ত সূর্য, নির্দয় খরা... ছুটে বেড়াচ্ছে আমাদের মগজের ভেতর, আমাদের রূপান্তরিত করছে সাদায় এবং পাগলে!’
আমি তখন বুঝিনি, কেন তিনি এরকম বলতেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি, তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন না, বরং তাঁর ধারণাই উঁচু স্বরে ব্যক্ত করছিলেন। কিন্তু তাঁর কথাই ঠিক ছিল, আমি বোঝাতে চাইছি, ‘সাদা’ সম্পর্কে তাঁর উক্তি।
কারণ পুরো দেশটাকেই সাদা মনে হচ্ছিল — মৃত্যুর মত সাদাটে।
পাহাড়ের চূড়া থেকে চূড়ায় সুবিন্যস্ত চোখজুড়ানো ছোট ছোট শামবাগুলো [শস্যক্ষেত্র] হয়ে পড়েছিল বিরান। ভূমি-উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট, আমাদের জেলার কৃষকদের গর্ব একসময়কার খাটো লতাগুল্মের দৃষ্টিনন্দন বেষ্টনিগুলো শুকিয়ে হয়ে পড়েছিল কী হতচ্ছিরি, ধুলোবালি মাখা। এমনকি আমাদের গ্রামের ঠিক নিচটাতে যে মুগুমো গাছ, কখনও যা শুকাত না, প্রাণবন্ত শ্যামলশোভা নিয়ে যে টিটকারি দিত স্বল্পমেয়াদী খরাকে, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তারও পত্র-পল্লব। অনেকেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করল। আবহাওয়াবিশারদ ও ওঝা-কবিরাজ যাদের কেউ কেউ তখনও ক্ষীণ প্রভাব নিয়ে আমাদের গ্রামে টিকে ছিল, গ্রামবাসীরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসল, সবাই মহাবিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিল।
এদিকে রেডিওর রমরমা অবস্থা। ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস’— যা একসময় কেবল সম্ভাব্য ভ্রমণকারীদের আগ্রহের খবর ছিল, এখন সবারই হয়ে দাঁড়াল প্রধানতম আগ্রহের খবর। হ্যাঁ। মনে হয় কেবিএস-এর [কেনিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস] ও আবহাওয়া-দপ্তরের লোকেরা আবহাওয়া-বার্তা জানানোর জন্য তাদের ম্যাজিক-যন্ত্র দিয়ে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে চলেছিল।
কিন্তু আমাদের গ্রামের সাধারণ নারীপুরুষেরা কেবল মেঘ দেখছিল এবং অপেক্ষা করছিল। আমার বাবার চার স্ত্রী ও গ্রামের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের প্রতিদিনই শামবার দিকে যেতে দেখতাম। তারা বসে বসে গল্পগুজব করত, আর আসলে অপেক্ষা করত সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য যখন ঈশ্বর বৃষ্টি দেবেন। আমাদের নতুন গ্রামের ধুলোভরা পথে যেসব বাচ্চা ছেলেপিলে একসময় খেলাধুলা করত, বন্ধ করে দিয়েছিল তা। সবাই অপেক্ষা করছিল; আকাশের পানে তাকাচ্ছিল চাতকের ন্যায় এবং আশায় বুক বেঁধে।
বহুলোক ভুখা। বেশির-ভাগ পরিবারের তুলনায় আমরা অবশ্য ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার ভাইদের মধ্যে একজন নাইরোবি ও অন্যজন লিমুরুতে কাজ করত।
বৃদ্ধা নারী সম্পর্কে বাবার সেই মন্তব্যটি আমাকে আরও গভীর চিন্তায় ফেলল। মাসের শেষে মা যখন বাজার থেকে কিছু শাক-লতা ও জাহি সিম [কেনিয়ার একধরনের সবজি] কিনে আনলেন আমি সেখান থেকে কিছু আনাজ চুরি করলাম এবং সন্ধ্যাবেলায় বুড়ির মাটির ঘরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। পেয়ে গেলাম সহজেই। গ্রামের কেন্দ্রস্থলেই ছিল বুড়ির কুঁড়েঘরটা। ওটাই ছিল স্ত্রীলোকটির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। আমি সেখানে বহুবার গিয়েছি, তবুও সেই সন্ধ্যা এখনও আমার স্মৃতিতে সবথেকে বেশি উজ্জ্বল। যখন প্রায় নিভে-আসা জ্বালানি কাঠের অঙ্গার ফায়ারপ্লেসে সামান্যই দপদপ করছিল, ভুতুড়ে ছায়া ফেলছিল মাটির দেওয়ালে, আমি তাকে জড়োসড়ো অবস্থায় দেখতে পেলাম ঘরের অন্ধকার এক কোনায়। আতঙ্কিত আমি পালাতে উদ্যত হলাম। কিন্তু পারলাম না। আমি তাকে ‘দাদিমা’ বলে ডাকলাম — যদিও মনে হল ওই সম্বোধন পাওয়ার মত অতটা বৃদ্ধা সে নয় — তাকে আনাজগুলো দিলাম। সে ওগুলোর দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে। তার চোখজোড়া কিছুটা উজ্জ্বল হল। তখন সে তার মুখ নিচু করল এবং বিলাপ করতে লাগল।
‘আমি ভাবলাম এটা “সে”, ফিরে এসেছে আমার কাছে।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল। এবং তারপর,‘আহ্, খরা আমার সবকিছু ছারখার করে দিয়েছে।’
আমি এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলাম না, দ্রুত ছুটে বেরিয়ে এলাম একথা ভাবতে ভাবতে যে, আমার বাবা এসব কিছু জানেন কিনা। বোধহয় সে পাগলিই ছিল।
এক সপ্তাহ পর সে আমাকে ‘তার’ সম্পর্কে বলল। যখন সে খরার বিরুদ্ধে তার জীবনব্যাপী লড়াইয়ের কথা অসংলগ্নভাবে আমায় বলল, আঁধার-ঢাকা সেই কুঁড়েঘরে যে বিষণ্ন পরিবেশ তৈরি হল তা বর্ণনা করা শব্দের সাধ্যের বাইরে।
আমি যেমন বলেছি, আমরা সবাই মাসের পর মাস অধীর আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায় বসেছিলাম। গত রাতে যখন প্রথম ক’ফোঁটা বৃষ্টি হল, তা অস্বাভাবিক এক নিঃসঙ্গতা ও অবসাদে সবার মন ছেয়ে ফেলল। রাস্তাঘাটে কোনও হৈচৈ ছিল না। একমাত্র সন্তানের পাশে বসে তাকিয়ে-থাকা স্ত্রীলোকটি কিছু শুনছিল না। সে শুধু তেপায়া গিকুয়ু টুলের ওপর বসে ফায়ারপ্লেসের ধারে ছোট্ট বিছানায় তার কালো চেহারার সন্তানের তীব্র যন্ত্রণায় মোচড়ানো দেখছিল। যখন প্রায় শেষ হয়ে-আসা আগুন থেকে-থেকে দপদপ করছিল, এটা উন্মোচিত করল একটা কালো চেহারা যা এখন সাদায় রূপান্তরিত। ভুতুড়ে ছায়া দেওয়ালের এমাথা-ওমাথা ছোটাছুটি করছিল যেন একাকী বসে-থাকা দর্শককে উপহাস করতে। আর ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেই চলেছিল:
‘তুমি কি মনে কর, আমি মারা যাব, মা?’ বুড়ি জানত না কী বলবে বা করবে। সে শুধু আশা করতে পারত এবং করতে পারত প্রার্থনা। তবুও ক্ষুধার্ত ছেলেটা অনুনয়ভরা কণ্ঠে বলেই চলল, ‘মা, আমি মরতে চাই না।’ কিন্তু মা অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। উপলব্ধি করল, যেন তার মনোবল এবং শারীরিক শক্তি তাকে ত্যাগ করে গিয়েছে। আবার অনুযোগভরা সেই আকুতি, ‘মা, আমাকে কিছু একটা খেতে দাও।’ নিশ্চয়ই সে জানত না, জানতে পারেনি, স্ত্রীলোকটির কিছুই ছিল না, তার শেষ দানা গমটুকুও শেষ করে ফেলেছিল। সে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, তার প্রতিবেশীদের আর বিরক্ত করবে না, কেননা তারা তাকে দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে টিকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত তারাও তাদের সহায়-সম্বল খরচ করে ফেলেছিল। তথাপিও ছেলেটি ক্ষোভ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন সে তাকে দয়ামায়াহীন একজন মানুষ হিসাবে অভিযুক্ত করছিল।
নিজের পুরুষ ছাড়া একজন নারী কী-ই বা করতে পারত? জরুরি অবস্থার সময় সে তাকে হারিয়েছিল, মাউ মাউদের [Mau Mau, বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইরত কেনিয়ার জাতীয়তাবাদী শক্তি] দ্বারা বা ঔপনিবেশিক সেনাদের হাতে সে নিহত হয়নি, এক বিয়ার পানের আসরে তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এটা এতই আকস্মিক মৃত্যু ছিল যে, পারতপক্ষে লোকে কেবল এটুকুই বলত। ছেলেটাকে দেখবার কাজে তাকে সাহায্য করবার জন্য লোকটা এখন আর নেই।
১৯৬১’র এই রাত ’৪০-এর অপর এক রাত থেকে তার কাছে এতটুকুই ভিন্ন ছিল যে, তখন তার দুই ছেলে খরা এবং অনাহারে একের পর আরেক মারা গিয়েছিল। সেটা ছিল, যাকে বলা হয় ‘কাসাভা দুর্ভিক্ষ’র সময়। লোকে কাসাভা থেকে আটা তৈরি করে খেত বলে ওটাকে এ-নামে ডাকা হত। তখন তার স্বামী তার সঙ্গে ছিল শোক ভাগ করে নেওয়ার জন্য। এখন সে একাকী। তার কাছে ব্যাপারটা খুবই অন্যায্য বলে মনে হল। এটা কি ছিল পরিবারের ওপর কোনও অভিশাপ? সে এমনটাই ভাবল, কেননা তার নিজেরই জন্ম হত না, যদি না এমনই এক দুর্ভিক্ষ থেকে সৌভাগ্যক্রমে তার মাকে মিশনারিরা রক্ষা করত। এটা ঘটেছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রকৃত অর্থে কেনিয়া আগমনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে। রুরায়া দুর্ভিক্ষ (ইংল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ) ছিল গিকুয়ু জনগোষ্ঠীর মোকাবেলা করা তখন পর্যন্ত সবথেকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তার দাদা-দাদি মারা গিয়েছিল, পরিবারের মধ্যে একা সে-ই প্রাণে বেঁচেছিল। হ্যাঁ। যখন সে ছেলেটার অভিযোগের, অনুনয়ের মুখ দেখত, তখন সব দুর্ভিক্ষের ভয়াল চিত্র তার মধ্যে জেগে উঠত। কেন এটা শুধু তার জন্য? কেন অন্য নারীদের জন্য নয়? ছেলেটা তার শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান।
সে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল এবং গ্রামের প্রধানের কাছে গিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, তার কাছে কিছু নেই। তাছাড়া মনে হয়েছিল, সে তাকে বুঝতে পারছে না, অথবা বুঝতে পারছে না যে, খরা প্রকৃতই মানুষ মারতে পারে। সে ভেবেছিল, তার ছেলেটি সেই পুরনো রোগে ভুগছে, যা তাকে প্রায়ই আক্রমণ করে থাকে। অবশ্য মা-ও এরকমই কিছুটা চিন্তা করেছিল। ছেলেটা তার সবসময়ই রোগে-ভোগা এক সন্তান। কিন্তু সে কখনও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। এমনকি এখনও সে নেবে না। না, না, এমনকি হাসপাতালও তাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। তার সাধ্যমত এই পঙ্গুর জন্য যা কিছু করা সম্ভব সেটা করাকে সে প্রাধান্য দিয়েছিল। এবং এইবার সে বুঝল, এটা উপোস যা তাকে মেরে ফেলছিল। গ্রামপ্রধান জানিয়েছিল যে, জেলা-কর্মকর্তা খাদ্যদ্রব্যে রেশন-প্রথা চালু করেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কার্যক্রম’-এর অংশবিশেষ খাদ্য খরা কবলিত এলাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা সম্পর্কে সে আগে কেন শোনেনি? সে-রাতে সে ঘুমিয়েছিল, কিন্তু খুব ভালোভাবে নয়, কেননা পঙ্গুটি জিজ্ঞেস করেই চলেছিল, ‘আমি কি সুস্থ হয়ে উঠব, মা?’
জেলা-কর্মকর্তার কার্যালয়ে লম্বা লাইন। সে তার রেশন নিয়েছিল এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্লথ পায়ে বাড়ি ফিরে চলেছিল। সে ঘরে প্রবেশ না করে বাইরেই বসে পড়েছিল, তার হাঁটুর শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। এবং অদ্ভুত চেহারার নারী-পুরুষেরা তাকে কিছু না বলেই তার ঘর থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে আসছিল। বলার প্রয়োজনও ছিল না। সে জানতে পেরেছিল, তার ছেলে চলে গিয়েছে, এবং আর কখনও সে ফিরে আসবে না।
বৃদ্ধা একবারও আমার দিকে তাকায়নি যখন এসব বলছিল। এখন সে চোখ তুলে তাকাল এবং বলে চলল, ‘আমি এখন একজন বুড়ি। সূর্য অস্তমিত হয়েছে আমার একমাত্র সন্তানের ওপর; খরা তাকে নিয়ে গিয়েছে। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।‘ সে আবার চোখ নামাল এবং নিভে-আসা আগুন খোঁচাল।
যাওয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়ালাম। যদিও সে ভাঙাভাঙা গলায় আমাকে কাহিনিটি বলেছিল, কিন্তু তা এমন ভাষায় যা অবশ্যই কোনও পাগল নারীর হতে পারে না। এবং সেই রাতে (সেটা ছিল রবি বা শনিবার) আমি এই বিস্ময় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, কেন কিছু লোক জন্ম নেয় যন্ত্রণা ভোগের জন্য এবং সহ্য করবার জন্য অসহনীয় দুর্দশা।
দুই বা তিন সপ্তাহ আগে আমি বৃদ্ধার সঙ্গে শেষবারের মত কথা বলি। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার জন্য আমি ভালোভাবে মনে করতে পারছি না। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বলা চলে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, যদিও হালকা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। স্ত্রীলোকেরা শস্য রোপণের কাজে ব্যস্ত। সবার মনে আশা জেগে উঠেছে।
মূলত মুষলধারায় মৌসুমি বৃষ্টির শুরু গতকাল থেকে। একটু আগেভাগেই শুরু। এমন বৃষ্টির দেখা বহুবছর মেলেনি। আমি বৃদ্ধ নারীটির কুঁড়েঘরে উপহারসামগ্রী নিয়ে গেলাম। এবার শাকলতা বা সিম নয়, মিষ্টি আলু। দরজা খুলে তাকে যথারীতি এক কোনায় জড়োসড়ো অবস্থায় দেখতে পেলাম। আগুন নিভে গিয়েছিল। শুধুমাত্র লন্ঠনের কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো তখনও জ্বলে চলেছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। সে সামান্য মাথা তুলল। প্রায় ক্ষয়ে-আসা শীতল আলোতে তাকে সাদা দেখাল। সে তার চোখ সামান্য খুলল। সেগুলোর অস্বাভাবিক অলৌকিক উজ্জ্বলতা সহস্রগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কেবল বাড়তি কিছু তাতে ছিল। দুঃখ নয়। আনন্দ বা উল্লাসের এক চিহ্ন ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন অনেকদিন আগে হারিয়ে-যাওয়া কিছু একটা সে ফিরে পেয়েছে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত। সে হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাসিতে এমন কিছু ছিল, যা অপার্থিব, প্রায় দানবীয় — কুৎসিত। সে কথা বলতে লাগল, দুর্বল সুরে, আমার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার সন্তুষ্টি বা স্বস্তিকে উচ্চস্বরে ঘোষণা করে।
‘আমি তাদের সবাইকে এখন দেখছি। সবাই সদর-দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এবং আমি যাচ্ছি...’
তারপর আবার সে কুঁজো হল। তক্ষুনি কষ্টে জ্বলতে-থাকা লন্ঠনটা দপ করে নিভে গেল, কিন্তু তার আগে নয় যখন আমি দেখেছিলাম আমার দেওয়া সব উপহার ঘরের কোনায় জমা করা, যা কখনও স্পর্শই করা হয়নি।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। রাস্তার পাশের খোলা দরজাগুলোয় আমি দেখতে পেলাম জ্বালানো আগুনের দপদপানি, শুনলাম লোকজনের চেঁচামেচি ও অট্টহাসি।
বাড়িতে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। বাবাও ছিলেন। মা এরই মধ্যে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করেছেন। বৃষ্টি এবং খরা যা এখন আর নেই সেগুলো নিয়ে আমার ভাই-বোনেরা বকবক করে চলেছে। বাবা ছিলেন যথারীতি নীরব এবং চিন্তামগ্ন। আমিও ছিলাম চুপচাপ। আমি কথাবার্তায় যোগ দিলাম না, কেননা আমার মন তখনও সেই ‘পাগলি’ স্ত্রীলোক এবং তাকে উপহার হিসাবে আমার দেওয়া খাদ্য, যা স্পর্শই করা হয়নি তাতে পড়ে ছিল। আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিল, সে-ও কী হারিয়ে গেছে খরায় এবং অনাহারে! ঠিক তখনই ভাইদের মধ্যে থেকে একজন স্ত্রীলোকটিকে নিয়ে ঠাট্টা করে এমন কিছু মন্তব্য করল, যা শুনে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
‘সত্যি পাগলি।’ আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। আর সবাই তখন সচকিত ভীতি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাদের সবাই, কেবল বাবা বাদে — তিনি ফাঁকা অনিমেষ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে।
----------------------------------------
টীকা:
প্রথম বন্ধনীর ভেতরকার শব্দগুলো লেখকের, তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরকারগুলো অনুবাদকের।
লেখক পরিচিতি
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও
কেনিয়ার কিয়াম্বু জেলার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র জন্ম। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ ন্গুগি।
তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে বিএ পাশ করেন। সেই সময়েই, অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায়, ১৯৬২-তে তাঁর লেখা The Black Hermit নামের নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child, প্রকাশিত হয়। এটি লেখেন ইংল্যান্ডের লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। এটা কোনও পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস The River Between, রচিত হয় ১৯৬৫-তে। ১৯৬৭ সালে রচিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তাঁর ঝোঁক লক্ষ করা যায়। তিনি ইংরেজি, খ্রিস্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস্ ন্গুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন তাঁর মাতৃভাষা গিকুয়ু এবং সোয়াহিলিতে।
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও ১৯৭৬ সালে তাঁর নিজ এলাকায় কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার স্থাপনে সহায়তা করেন। এটি অন্য কার্যক্রমের পাশাপাশি এলাকাতে আফ্রিকান নাট্য-আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকত। ১৯৭৭-এ তাঁর অসেন্সরকৃত নাটক I Will Marry When I Want কেনিয়ার তদানীন্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোইকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে এবং থিয়োঙ্গ’ওকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলখানায় অবস্থানকালে তিনি টয়লেট-পেপারের ওপর গিকুয়ু ভাষায় প্রথম আধুনিক নাটক Caitaani mũtharaba-Inĩ [Devil on the Cross] রচনা করেন। বৎসরাধিক কাল জেল খেটে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাঁকে আর নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে পুনর্বহাল করা হয় না। সেই সময়কার স্বেচ্ছাচারী সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাঁকে বলপ্রয়োগে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
তাঁর পরবর্তী কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, দুটো ছোটগল্প সংকলন A Meeting in the Dark [১৯৭৪], Secret Lives, and Other Stories [১৯৭৬]; Detained [জেলখানার ডায়েরি – ১৯৮১], Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature [নিবন্ধগ্রন্থ – ১৯৮৬], Matigari [উপন্যাস – ১৯৮৭], Wizard of the Crow [উপন্যাস – ২০০৬], Something Torn and New: An African Renaissance [নিবন্ধগ্রন্থ – ২০০৯], আত্মজীবনীমূলক দুটো গ্রন্থ, Dreams in a Time of War: a Childhood Memoir [২০১০] এবং In the House of the Interpreter: A Memoir [২০১২]।
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও তার প্রতিটি রচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সমাজ-জীবনের বিভিন্ন দিক, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দানবীয় রূপ। আবার স্বজাতির হীনম্মন্যতা, লাম্পট্য, স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাটের চিত্র তুলে ধরতেও পিছপা হননি। আফ্রিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভয়াবহ দুর্দশার চিত্র তাঁর মত এমন নিখুঁতভাবে আর কে-ই বা ফোটাতে পেরেছেন? পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব তাঁর লেখায় বড় স্থান দখল করে থাকে। মানব-মনের বিচিত্র ও জটিল দিক ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাঁর যে মুন্সিয়ানা তা পাঠককে সম্মোহিত করে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার একজন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে বারবার ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র নাম আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে।
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, আরভিন-এ ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য’র একজন সম্মানীত অধ্যাপক [Distinguished Professor]|
‘খরায় হারিয়ে যাওয়া’ তাঁর গল্প `GONE WITH THE DROUGHT’-এর অনুবাদ। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূলানুগ থাকবার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে।
অনুবাদক পরিচিতি
শামসুজ্জামান হীরা
গল্পকার। অনুবাদক।
0 মন্তব্যসমূহ