কেনিয়ার গল্প | গৌরবের মুহূর্তগুলো

মূল গল্প :  ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও
অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা

আসল নাম তার ওয়ানজিরু হলেও সে তার খ্রিস্টীয় নাম বিয়াট্রিসটাই বেশি পছন্দ করত। এটা শুনতে বেশি নিখাদ ও বেশি সুন্দর। এমন নয় যে সে কুৎসিত, কিন্তু তাকে সুশ্রীও বলা চলে না। দেখতে সে কালো এবং স্থূল, কিন্তু গড়ন, হ্যাঁ এমনই যে, মনে হত তা মদ দিয়ে পূর্ণ হবার জন্য সবসময় অপেক্ষমাণ। সে বিয়ার-হলে কাজ করত, যেখানে নারীদের সন্তানেরা তাদের ভেতরের জীবনটাকে বিয়ারের ক্যান ও ফেনায় ডোবানোর জন্য আসত।
কাউকে তার দিকে লক্ষ করতে দেখা যেত না। যখন কেবল মালিক বা অধৈর্য কোনও খদ্দের তাকে তার বিয়াট্রিস নাম ধরে ডাকত, তখন হয়ত অন্য খদ্দেররা ক্ষণিকের জন্য তাদের মাথা তুলে তাকাত, ক’সেকেন্ডের জন্য, এই সুন্দর নামের অধিকারিনীটি কে তা দেখতে, কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে তারা আবার ফিরে যেত মদ্যপানে, অশ্লীল কৌতুকে, অট্টহাসিতে এবং পরিবেশনরত অন্য মেয়েদের সঙ্গে রঙ্গতামাশায়। সে ছিল উড়ন্ত এক আহত পাখি, যখন-তখন জোর করে ভূমিতে নামত, আর হেথা-হোথা ঘুরে বেড়াত। তাকে দেখা যেত আলাস্কা, প্যারাডাইস, দি মডার্ন, থোম বা লিমুরুতে আরও যত বিয়ার-হল আছে সেগুলোতে। এর পেছনে অন্য কারণ যে থাকত না, তা নয়। যখন বার-মালিক দেখত, সে যথেষ্ট খদ্দের আকর্ষণ করতে পারছে না, খেপে গিয়ে বিনা বেতনে, বিনা নোটিশে তাকে চাকরি থেকে ছাটাই করে দিত। সে তখন অন্য বারে যেত। কখনও কখনও একই জায়গায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠত, প্রতিদিন সেই একই দৃশ্য, বার বন্ধ হবার ঠিক আগখানটায়, তার চাইতে যেকোনও বিচারে অসুন্দর মেয়েদের নিয়ে কাস্টমারদের মধ্যে সে কী কাড়াকাড়ি! তাদের কী এমন আছে, যা আমার নেই? হতোদ্যম সে নিজেকে জিজ্ঞেস করত। এমন এক বার-সাম্রাজ্যের কল্পনায় বিভোর থাকত বিয়াট্রিস, যেখানকার সে হবে অন্যতম একজন নিয়ন্তা, যেখানে অনুগ্রহপ্রার্থীরা উপহার হিসাবে আনবে বিয়ার, হতাশার হাসি, মাঝে মাঝে অভিশাপ, যা আসলে ঘৃণার আড়ালে লুকানো প্রবল লালসা ও ভালোবাসা বৈ কিছু নয়।

লিমুরুর মূল শহর ত্যাগ করে এর আশপাশে গজিয়ে-ওঠা উপশহরে সে কাজ করতে লাগল। ন্গারারিগা, কামিরিথু, রিরোলি, এমনকি টিকুনুতেও, এবং সর্বত্রই ছিল একই অবস্থা। ওহ্, হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে তারও কোনও খদ্দের জুটে যেত, কিন্তু যেমনটি প্রত্যাশা করত তার প্রতি তেমন মনোযোগ দিত না কেউই, কেউই আসলে তাকে পেতে তেমন আগ্রহ দেখাত না। অসচ্ছল কারও সে ছিল শেষ সহায়। কোনও কল্পনার মায়াজাল নয়, তার প্রতি তেমন কোনও মধুর ছলনাও নয়, যা পঞ্চম বোতল টাসকার [বিয়ার জাতীয় পানীয়] খাওয়ার পর মানুষ করে থাকে। পরবর্তী রাতে বা বেতনের দিন সেই একই খদ্দের এমন ভান করত যে, তাকে চেনেই না, সে তার অর্থবলকে কাজে লাগাত সেই মেয়েদের পেছনে যাদের আছে প্রচুর তোয়াজকারী।

সে এতে কষ্ট পেত। প্রতিটি মেয়েকে সে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবত এবং তাদের প্রতি তার ছিল একধরনের চাপা ক্রোধ মেশানো মনোভাব। বিশেষ করে ইঁয়াগুতি ছিল এমন একজন যে সবসময় তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিত। ইঁয়াগুতি উদ্ধত এবং অমিশুক, কিন্তু লোকে সবসময়ই ভিড় জমাত তার আঙিনায়। মানুষ সামলাতে হিমশিম খেত সে। তার সন্তুষ্টির জন্য লোকে আনত নানা উপহার যা সে গ্রহণ করত তার প্রাপ্য অধিকার হিসাবে। ইঁয়াগুতিকে দেখাতে পারত ক্লান্ত, অধৈর্য ও পুরোপুরি অশিষ্ট, তথাপিও লোক তার পেছনেই ঘুরঘুর করত, যেন তারা একজন স্বাধীন নারীর কড়া কথা, বাঁকা ঠোঁট এবং উদাসীন চাউনির অবজ্ঞাকে উপভোগ করতে ভালোবাসত। ইঁয়াগুতিও ছিল উড়ন্ত এক পাখি, কখনও এক স্থানে স্থির থাকতে পারত না। সে ক্ষুধার্ত থাকত পরিবর্তন ও উত্তেজনার জন্য — নতুন মুখ ও নতুন এলাকা জয়ের নেশায়। তার ছায়াকেও বিয়াট্রিস অপছন্দ করত। সে তার মধ্যে এমন এক মেয়েকে দেখত, যাকে ভালোবাসা যেতে পারে, এক মেয়ে যে পুরোপুরি নিমজ্জিত থেকেও বার ও যৌন-সন্ত্রাসের অপরাধ-জগত থেকে সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারে। বিয়াট্রিস যেখানেই যেত, ইঁয়াগুতির দীর্ঘ ছায়া সাথে সাথেই অথবা খানিক বাদে তাকে অনুসরণ করত।

সে চিরি জেলার ইলমোরোগের উদ্দেশে লিমুরু ত্যাগ করল। একসময় ইলমোরোগ ছিল এক ভুতুড়ে গ্রাম। কিন্তু পুনর্জীবন লাভ করেছিল সেই কিংবদন্তি নারী ইঁয়াঙ্গ’য়েন্দোর কল্যাণে, যাঁর প্রতি সব পপ-দল শ্রদ্ধা জানাত। এটা ছিল তাঁকে নিয়ে, যা নেচে নেচে তরুণ মুতু এবং মুচুন গি ওয়া [গায়কদের নাম] গাইত:

যখন নাইরোবি ছাড়লাম ইলমোরোগের জন্য
জানতাম না কখনও আমি
ধারণ করব আমার এই বিস্ময়-সন্তান
ইঁয়াঙ্গ’য়েন্দো।

এর ফলে, ইলমোরোগকে সবসময় দেখা হত আশার শহর হিসাবে, যেখানে আবসাদগ্রস্ত এবং নিপীড়িতরা খুঁজে পেত বিশ্রাম ও নির্মল জল। কিন্তু এখানেও আবার ইঁয়াগুতি তাকে অনুসরণ করল।

সে লক্ষ করল, ইলমোরোগ কিংবদন্তি সত্ত্বেও, নাচ-গান সত্ত্বেও লিমুরু থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সে বহু কৌশলের আশ্রয় নিল। পোশাক-পরিচ্ছদ? এখানেও কখনও সে এমন বেশি কিছু উপার্জন করত না যা দিয়ে জমকালো পোশাক কেনা যায়। বাসস্থান ভাতা, posho [প্রাত্যহিক রেশন], রোজগেরে ছেলেবন্ধুরা বাদে মাসে পঁচাত্তর শিলিং এমন কী? এরই মধ্যে ইলমোরোগে আম্বি’র [Ambi, ত্বক ফরসা করার ক্রিম] প্রচলন শুরু হয়েছিল এবং বিয়াট্রিস ভাবল এটাই সবকিছুর সমাধান। সে কী লিমুরুতে দেখে নাই, তার চেয়েও কালো চামড়ার মেয়েদের ত্বক-উজ্জ্বলকারী ক্রিম মেখে কদর্য পাপ থেকে রাতারাতি সাদা তারকাতে রূপান্তরিত হতে? লোকেরা তাদেরকে কামাতুর দৃষ্টিতে দেখত, এমনকি তাদের সদ্য-জুটে-যাওয়া বান্ধবীদের নিয়ে গর্বের আতিশয্য দেখাত। পুরুষরা অদ্ভুত জীব, মুহূর্তের অনুসন্ধানী বিশ্লেষণে বিয়াট্রিস এরকম এক সিদ্ধান্তে পৌঁছাল। তারা আম্বি, বিউটন, ফায়ারস্নো, মুনস্নো, পরচুলা, মসৃণ-কেশদাম — এগুলোর বিরুদ্ধে উত্তপ্ত কথাবার্তা বলত, কিন্তু তারা সবসময়ই সেই মেয়ের কাছে যেত যার ত্বক আম্বি দিয়ে উজ্জ্বল করা এবং মাথা ইউরোপীয় বা ভারতীয় কেশের ধাচে তৈরি পরচুলা দিয়ে আবৃত। কালোদের আত্মবিদ্বেষের মূল কারণ খুঁজে বার করবার চেষ্টা বিয়াট্রিস কখনও করত না, সে শুধু বিরোধটাকে মেনে নিয়েছিল এবং একধরনের প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আম্বি প্রয়োগ করেছিল নিজ শরীরে। তার কালো লজ্জা ঘষে তুলে ফেলবার দরকার দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু পর্যাপ্ত আম্বির ব্যবস্থা করবার সামর্থ্য তার ছিল না, সে শুধু মুখে এবং বাহুতে মাখতে পারত, তার পা এবং গলা কালোই থেকে যেত। তাছাড়াও মুখের কিছু জায়গায় সে পৌঁছাতে পারত না, — যেমন কানের পেছনটায় ও চোখের পাপড়ির ওপরের দিকে — এবং এগুলো ছিল তার আম্বি-সর্বস্বতার জন্য সার্বক্ষণিক লজ্জা ও বিরক্তির কারণ।

সবসময় সে তার ওই আম্বি-কালপর্বটাকে শেষদিকের গৌরবের মুহূর্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গভীর অপমানকর বিষয় হিসাবে স্মরণ করত। সে ইলমোরোগ ‘স্টারনাইট বার অ্যান্ড লজিং’-এ কাজ করত। ইঁয়াগুতি তার বালা-পরা হাত এবং কানে ঝোলানো বড় রিং নিয়ে কাউন্টারের পেছনে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকত। বারের মালিকটি ছিল একজন ভালো খ্রিস্টান, নিয়মিত গির্জায় যেত এবং তার কাছে পাওনা ‘হারামবি’ [Harambee — কেনিয়ায় জনকল্যাণমূলক সামাজিক উদ্যোগ] প্রকল্পের সব অর্থ পরিশোধ করত। বিশাল ভূড়ি। পক্বকেশ। মৃদুভাষী। ইলমোরোগে সর্বজন-পরিচিত একজন সাংসারিক লোক। পরিশ্রমীও বটে। বন্ধ হওয়ার আগে সে কখনও বার ত্যাগ করত না। আরও স্পষ্টভাবে বললে, যতক্ষণ না ইঁয়াগুতি বার ত্যাগ করত। অন্য কোনও মেয়ের দিকে তার দৃষ্টি ছিল না, তার আগ্রহ ছিল কেবল ইঁয়াগুতির প্রতি, কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে কোনও প্রতিদান না পেলেও সে তার জন্য সংগোপনে উপহার হিসাবে পোশাক-আশাক আনত। শুধু অঙ্গীকার। শুধু আগামীকালের আশা। অন্য মেয়েদেরকে সে মাসে আশি শিলিং দিত। নিজের ব্যবহারের জন্য ইঁয়াগুতির একটা কামরাও ছিল। ইঁয়াগুতি ঘুম থেকে জাগত যখন খোঁজখবর নেওয়ার দরকার বোধ করত। কিন্তু বিয়াট্রিস ও অন্যান্য মেয়েদের ভোর পাঁচটার দিকে জেগে উঠতে হত, লজিং-বাসিন্দাদের জন্য চা বানানো, বার পরিষ্কার করা, এবং বাসন-কোসন-গ্লাস সাফ করা — এসব কাজ সারতে। তারপর তারা বারে কাজ করত শিফট অনুযায়ী দুপুর দুটো পর্যন্ত, এরপর অল্প সময়ের জন্য কর্মবিরতি। বিকেল পাঁচটায় আবার কাজে লেগে পড়তে হত, প্রস্তুত থাকতে হত খদ্দেরদের জন্য, যাদেরকে তাদের ফেনিল বিয়ার ও হাসি দিয়ে আপ্যায়ন করতে হত রাত বারোটা অব্দি, বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে যতক্ষণ পর্যন্ত খদ্দেররা টাসকার ও পিলসনারের জন্য পিপাসার্ত থাকত। এটা বিয়াট্রিসকে সবসময় বিরক্ত করত, যদিও এতে তার কিছু যেত আসত না। মালিক জেদ ধরত যেন মেয়েরা স্টারনাইটে রাত কাটায়। নইলে তারা পরের দিন কাজে যোগ দিতে দেরি করে ফেলবে, সে যুক্তি দিত। আসলে সে যা চাইত, তাহল মেয়েদের শরীর ব্যবহার করে স্টারনাইটের জন্য আরও বেশি বোর্ডার আকর্ষণ করা। ইঁয়াগুতির নেতৃত্বে বেশির-ভাগ মেয়ে এই নিয়ম ভঙ্গ করত। নিরাপত্তাপ্রহরীকে ঘুষ দিয়ে তারা বাইরে যাতায়াত করত। তারা তাদের বাধাধরা বা একরাতের ছেলেবন্ধুর সঙ্গে দেখা করত সেসব জায়গায়, যেখানে তারা থাকবে মুক্ত এবং যেখানে তাদেরকে নিছক বারপরিচারিকার মত দেখা হবে না। বিয়াট্রিস সবসময় বারেই ঘুমাত। তার সাময়িক একরাতের নাগর চাইত সবচেয়ে কম খরচ করতে। এল এক রাত, যখন মালিক ইঁয়াগুতির কাছে পাত্তা না পেয়ে প্রস্তাব করল তাকে। সে তার কাজের খুঁত খোঁজা দিয়ে শুরু করল, গালাগাল করল, তারপর হঠাৎই তাকে প্রশংসা করতে শুরু করল যদিও প্রায় চাপা ঘৃণা ও অবজ্ঞার সঙ্গে। সে তাকে জোর করে জাপটে ধরল, শুরু করল ধ্বস্তাধ্বস্তি, — বিশাল ভূড়ি, পক্বকেশ, এবং আরও কিছু। বিয়াট্রিস একধরনের অস্বাভাবিক বিতৃষ্ণা বোধ করল লোকটার প্রতি। সে পারছিল না, এইমাত্র যে লোকটি ইঁয়াগুতি দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তাকে সে নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারছিল না। হা ঈশ্বর, সে ভেতর ভেতর ফোঁপাল, ইঁয়াগুতির এমন কী আছে, যা আমার নেই? লোকটা তখন, বিয়াট্রিসের সামনে নিজেই নিজেকে অপমান করল। কাকুতি-মিনতি করল। সে তাকে উপহার দেওয়ার ওয়াদা করল। কিন্তু বিয়াট্রিস নরম হল না। সেই রাতে সেও নিয়ম ভঙ্গ করল। জানালা টপকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। অন্য এক বারে শোবার জায়গা চাইল এবং ভোর ছ’টায় নিজ কর্মস্থলে ফিরে এল। সবার সামনে মালিক তাকে ডাকল এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করল। কিন্তু বিয়াট্রিস যেন নিজেই নিজের প্রতি কিছুটা বিস্মিত হল।

এক মাস কাটল তার বেকার জীবন। অন্য মেয়েদের মর্জিনির্ভর অনুগ্রহের ওপর সে এক রুম থেকে অন্য রুমে কাটাতে লাগল। ইলমোরোগ ছেড়ে অন্যকোনও নতুন শহরে গিয়ে কাজ করবার মত সাহসও তার ছিল না। ক্ষতটা তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। ঘুরে ঘুরে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আম্বি ব্যবহার করা সে ছেড়ে দিল। কপর্দকশূন্য। আয়নায় সে নিজেকে দেখল। এত বুড়িয়ে গেছে! খুব বেশি হলে এক বছর সে কারও কৃপা থেকে বঞ্চিত। তাহলে কেন সে তখন এত খুঁতখুঁতে ছিল, নিজেকেই জিজ্ঞেস করত। কিন্তু যেকোনও কারণেই প্রেমিকের কাছে মিনতি করা বা নগদ অর্থের বিনিময়ে দেহ বিক্রি করতে ভয় পাচ্ছিল সে। যা সে চাইছিল তাহল ভালো একটা কাজ এবং এক বা একাধিক মানুষের সান্নিধ্য, যারা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। বোধহয় সে প্রয়োজনীয়তা বোধ করত একজন মানুষের, একটি গৃহের ও বিছানায় তার পাশে শুয়ে-থাকা একটি শিশুর। সম্ভবত এটাই ছিল তার প্রকৃত চাহিদা যা তাকে সেইসব পুরুষ, যারা বারমেইডের কাছ থেকে অন্য কিছু চায়, তাদের থেকে দূরে রাখত। সে গভীর রাতে বাড়ির কথা স্মরণ করে কাঁদত। সেই সময়গুলোতে তার মায়ের গ্রাম ন্যেরিকে [Nyeri] ঈশ্বরের দুনিয়ায় সবচেয়ে মধুর স্থান বলে মনে হত। সে তার কৃষক বাবা-মার জীবনকে অপরিমেয় আনন্দ, শান্তি ও সুখে ভরিয়ে তুলতে চায়। তার সাধ হয় তাদেরকে দেখতে বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু খালি হাতে কী করে সে ফিরে যাবে? সে যাই হোক, জায়গাটা এখন তার স্মৃতিতে অতিদূরের কোনও দৃশ্যপট ভিন্ন কিছু নয়। এখানে, এই বারে তার জীবন ছিল অচেনাদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একজনের মত। সে আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত, কৃপা থেকে বঞ্চিত। সে ছিল প্রজন্মের তাদেরই একজন, যে আর কখনও মাটির, ফসলের, বাতাসের বা চাঁদের সঙ্গ পাবে না। তমসায় লতাগুল্মের বেষ্টনীতে সেই গুঞ্জন তাদের জন্য নয়, তার জন্য নয় সেই নাচ, এবং আকাশ ছুঁতে চাওয়া তুমুতুমু [TumuTumu] পাহাড়ের সাথে চন্দ্রালোকে প্রেমে মত্ত থাকা। তার গ্রামের সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ল, যে লিমুরুতে একজনের পর আরেকজন ধনীর রক্ষিতা হিসাবে আপাতদৃষ্টিতে জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করা সত্ত্বেও আত্মহত্যা করেছিল, বিষাক্ত গ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে। এই প্রজন্ম মৃত্যু-রহস্য দ্বারা বিস্মিত ছিল না, যেমন এরা উদাসীন ছিল জীবনের রহস্য নিয়ে; রূপলাবণ্য যেন নষ্ট না হয় সেজন্য কতজন অবিবাহিত মা তাদের বাচ্চাকে ল্যাট্রিনে নিক্ষেপ করত? মেয়েদের আত্মহত্যা যেন এক তামাশার ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। সে অক্কা পেল — কোনও জ্বালা-যন্ত্রণা ছাড়াই, তারা বলল। তারপর, এক সপ্তাহ ধরে বিয়াট্রিস আত্মহননের চিন্তা করেছিল। কিন্তু সে নিজেকে এ কাজে প্রবৃত্ত করতে পারেনি।

সে ভালোবাসা চেয়েছিল; সে জীবন চেয়েছিল।

ইলমোরোগে নতুন এক বারের উদ্বোধন হল। ‘ট্রিটপ বার লজিং অ্যান্ড রেস্তরাঁ’। ট্রিটপ কেন, বিয়াট্রিস বুঝতেই পারত না যদি না এটা একাধিক তলাবিশিষ্ট ভবন হত। চায়ের দোকান ছিল নিচ তলায়, এবং বিয়ারের দোকান একেবারে ওপরের তলার একটি কামরায়। বাকি কক্ষগুলো ছিল পাঁচ মিনিট বা এক রাতের ভাড়াটে বাসিন্দাদের জন্য। মালিক ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে, কিন্তু এমন একজন যে এখনও রাজনীতি নিয়ে চর্চা করে। সে ছিল মস্ত এক ধনকুবের, কেনিয়ার প্রতিটি বড় শহরে ছিল তার ব্যবসাকেন্দ্র ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশের সব জায়গা থেকে ডাকসাইটে ব্যক্তিরা তার বারে আসত। মার্সিডিজে করে কেউ। কেউ তাদের বেন্টলিতে। কেউ-বা তাদের জাগুয়ার এবং ডেইমলারে। ডাকসাইটে ব্যক্তিরা আসত ইউনিফরমধারী সোফারসহ, যারা গাড়িতে বসে ঝিমাত আর বিরক্তিসহকারে বাইরে অপেক্ষা করত। তত খ্যাত নয় তেমন কিছু লোকও আসত, যারা আসত বিশিষ্টজনদের শ্রদ্ধা জানাতে। তারা মূলত আলাপ করত রাজনীতি নিয়ে। এবং তাদের কায়কারবার নিয়ে। গল্পগুজব হত বিস্তর। তুমি কি সত্যি জানতে না? অমুক-অমুকের পদোন্নতি হয়েছে। সত্যি? এবং অমুক-অমুককে বরখাস্ত করা হয়েছে। জনগণের তহবিল তসরুফ। কী বোকা, জানো। এসব ব্যাপারে একেবারেই চতুর নয়। তারা তর্কাতর্কি করত, ঝগড়া করত, কখনও-বা হাতাহাতির পর্যায়ে যেত, বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণার সময়। একটি মাত্র বিষয়ে তারা সবাই একমত ছিল যে, লুঅ [Luo] সম্প্রদায় ছিল কেনিয়ার এইসব সমস্যার মূল কারণ; বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বসবাস করত সুবিধার আইভরি-টাওয়ারে এবং ঔদ্ধত্য নিয়ে; কিয়ামবু’র ছিল উন্নয়ন কাজের সিংহভাগ শেয়ার; ন্যেরি এবং মুরাঙ্গার লোকেরা নাইরোবির সব বড় ব্যবসা দখল করে নিয়েছিল, এমনকি চিরি জেলাতেও অনুপ্রবেশ করছিল; আফ্রিকার শ্রমিকরা, বিশেষ করে যারা খেতখামারে কাজ করে, অলস এবং ‘আমাদের’প্রতি ঈর্ষাগ্রস্ত, আমরা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি এই হঠাৎ উন্নয়নের জন্য। অন্যথায় প্রত্যেককে নিজের প্রশংসার গীত নিজেকেই গাইতে হত অথবা ফিরিয়ে দিতে হত অভিনন্দন। মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আনন্দের আতিশয্যে আত্মতুষ্টিতে কেউ-বা বারে উপস্থিত প্রতিজনের জন্য দুই প্রস্থ বিয়ারের অর্ডার দিত। এমনকি ইলমোরোগের গরিব লোকেরাও এখানে আসত nouveaux riches-এর [নব্য ধনিকবৃন্দ, ফরাসি ভাষা] উচ্ছিষ্ট আহার করতে।

এখানে বিয়াট্রিস পরিচ্ছন্নতাকর্মী [sweeper] এবং শয্যা-ছিমছামকারীর [bed-maker] কাজ পেল। এখানে ক’সপ্তাহের জন্য সে বিশালত্বের স্বাদ অনুভব করল। আগে সে যাদের শুধু নামে চিনত এখন সে তাদের শয্যা ঠিকঠাক করে। সে লক্ষ করত কীভাবে দরিদ্ররা বড়লোকের সামনে মদ খেতে চেষ্টা করত এবং নিজেদেরকেও বড়লোক হিসাবে জাহির করবার অভিনয় করত। কিন্তু অচিরেই অদৃষ্ট তার বিরুদ্ধে গেল। অন্য বার থেকে মেয়েরা ট্রিটপে এসে ভিড় জমাল। সেই মেয়েরা যাদেরকে সে চিনত লিমুরুতে, সেই মেয়েরা যাদেরকে সে চিনত ইলমোরোগে। এবং তাদের বেশির ভাগই জড়িয়ে পড়ল এক বা একাধিক মালদার লোকের সঙ্গে, প্রায়শ তাদের অসংখ্য প্রেমিকার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। এবং ইঁয়াগুতিও সেখানে ছিল, যথারীতি কাউন্টারের পেছনে, ধনী ও দরিদ্র উভয়ের নজর তার প্রতি আটকে রেখে। এবং সে, তার আয়ত নয়ন নিয়ে, বালা পরা হাতে, কানে বড় রিং পরে সেই একই ধরনের বিরক্তিব্যঞ্জক উদাসীনতা বজায় রাখত। একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও শয্যা-ছিমছামকারী হিসাবে বিয়াট্রিস এখন যেন আর কারও নজরেই পড়ত না। যেসব মেয়ে সৌভাগ্যের ছোঁয়া পেয়েছিল তারা তাকে অবহেলার চোখে দেখত।

সে স্বপ্ন নিয়ে জীবনকে মোকাবেলা করত। বিছানাগুলো, যাতে এইমাত্র চলল পাঁচমিনিটের ধ্বস্তাধ্বস্তি, যা শেষ হল অস্ফূট শব্দে ও ভেজাদাগ রেখে, সেগুলোতে পরিষ্কার চাদর বিছানোর ফাঁকে ফাঁকে সে জানালার পাশে দাঁড়াত, দেখত গাড়িগুলো এবং সোফারদের, এভাবে সে অচিরেই চিনে ফেলল সব মালিককে গাড়ির নাম্বার-প্লেট ও তাদের সোফারদের ইউনিফরম দেখে। সে এমন প্রেমিকদের স্বপ্ন দেখত যারা তার কাছে আসবে দু-আসনের চোখধাঁধানো মার্সিডিজ স্পোর্টস কার হাঁকিয়ে। কল্পনায় দেখত নিজেকে ওরকম একজন প্রেমিকের তালুবন্দি হয়ে নাইরোবি ও মোমবাসার পথ ধরে হাঁটতে, উঁচু হিলের জুতো পরে মাটিতে ঠকঠক শব্দ তুলে, ছোট ছোট দ্রুত পদক্ষেপে। এবং হঠাৎই হয়ত সে থামত কোনও কাঁচের ডিসপ্লে জানালার সম্মুখে, একইসঙ্গে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠত, ওহ্ ডার্লিং, তুমি কি আমাকে ওগুলো কিনে দেবে না...? ওগুলো কী? কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে হয়ত তার প্রেমিক জানতে চাইত। ওই মোজাগুলো, ডার্লিং। এটা এমন যে, বহুরকমের মোজার — নিখুঁত, উরু অব্দি আচ্ছাদন করা যায় এমন দামি মোজার মালিক হওয়াকে সে তার জন্য অনেক সুখের কিছু একটা মনে করত। আর কখনও সে ছেড়া জিনিস ঠিক করবে না। কক্ষনও না, কক্ষনও না, কক্ষনও না। তুমি বুঝতে পারছ? কক্ষনও না। সে পরক্ষণেই বিভিন্ন রঙের পরচুলার গর্বিত মালিক হত, স্বর্ণকেশি পরচুলা, কালোকেশি পরচুলা, লালচেমাথা পরচুলা, আফ্রো পরচুলা, পরচুলা, পরচুলা, পৃথিবীতে যত পরচুলা আছে সব। কেবল তখনই পুরো দুনিয়া শুধুমাত্র এক বিয়াট্রিসের জন্য গেয়ে উঠত হ্যালেলুয়াহ্ [Hallelujah, ঈশ্বর-বন্দনামূলক গীত]। সেই মুহূর্তগুলোতে সে উল্লাস বোধ করত, স্বীয় তমসাচ্ছন্ন অধ্যায় থেকে উঠে আসত, পাঁচ মিনিটের ক্ষণিক প্রেমের শয্যা-সাজানো বা মেঝে পরিষ্কার করা আর নয়, বিয়াট্রিস, ওয়াঙ্গু মাকেরির উত্তরসূরী, যাঁর চন্দ্রালোকে স্নাত নগ্নদেহ কামনায় কাঁপাত পুরুষদের, যিনি ইঁয়াঙ্গ’য়েন্দো-কন্যা, আধুনিক ইলমোরোগের প্রতিষ্ঠাত্রী, যাঁকে নিয়ে প্রায়শই তারা গান করে যে, তিনি প্রচুর প্রেমিককে নপুংশকে পরিণত করেছিলেন।

তখন সে তাকে লক্ষ করল এবং সে ছিল তার স্বপ্নে দেখা প্রেমিকদের বিপরীত ধরনের কিছু। এক শনিবার বিকালে পাঁচ-টনি লরি চালিয়ে সে এল। ওটাকে সাবধানে পার্ক করল বেঞ্জ, জাগুয়ার আর ডেইমলারগুলোর পাশে, লরি হিসাবে নয়, ওইসব ঝকঝকে ক্রিম-রঙা কাঠামোর একটি হিসাবে, এটাকে নিয়ে তাকে কী গর্বিতই না দেখাত। সে পরেছিল ঢিলাঢালা ধূসর রঙের স্যুট, তার ওপর চাপিয়েছিল খাকি-রঙা মিলিটারি ওভারকোট। সে ওভারকোট খুলল, সযত্নে তা ভাঁজ করল, তারপর সামনের সিটের ওপর রাখল। সে সবগুলো দরজা বন্ধ করল, হালকাভাবে শরীর ঝাড়ল, তারপর লরির চারদিকে হাঁটল, যেন খুঁটিয়ে দেখল এর কোথাও কোনও ক্ষতি হয়েছে কিনা। ট্রিটপে ঢুকবার কয় কদম আগে সে শেষবারের মত ফিরে তাকাল তার লরির দিকে, যা অন্য বাহনগুলোকে বামনে পরিণত করেছিল। ট্রিটপে সে এক কোণ বেছে নিয়ে বসল এবং উচ্চ উদ্ধত কণ্ঠে একটি কেনিয়া’র [কেনিয়ার মদবিশেষ] অর্ডার দিল। সে তৃপ্তির সঙ্গে সেটা পান করল এবং সেইসঙ্গে এদিক-ওদিক তাকাল কোনও মুখের সন্ধানে, যাকে সে চিনতে পারে। সে সত্যি সত্যি হোমরাচোমরাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পেল, কালবিলম্ব না করে সে তার জন্য পোয়াটেক বোতল ভ্যাট-৬৯ অর্ডার দিল। তার এই আতিথেয়তা সামান্য মাথা নেড়ে ও মৃদু বাঁকা হাসি দিয়ে গ্রহণ করা হল। কিন্তু খাতির করবার পর যখন সে আলাপ জমাবার চেষ্টা চালাল, তার সে চেষ্টা প্রবলভাবেই উপেক্ষিত হল। সে একেবারে দমে গেল এবং ‘মুরাতিনা’য় [Muratina, মদের নাম] ডুবে গেল। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য। সে আবার চেষ্টা করল: এবার বিরক্তি প্রকাশ করা ভ্রূ-কোঁচকানো চেহারার মুখোমুখি হতে হল তাকে। আরও মর্মস্পর্শী ছিল কৌতুকে যোগ দেওয়ার জন্য তার উদ্যোগগুলো; সে হেসে উঠছিল অতি উচ্চস্বরে যা বিশাল ব্যক্তিদের থামিয়ে দিচ্ছিল, তাকে একা রেখে তারা চলে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার শেষদিকে সে উঠে দাঁড়াল, অনেকগুলো কড়কড়ে একশ’ শিলিংয়ের নোট গুনল এবং সেগুলো কাউন্টারের পেছনে থাকা ইঁয়াগুতির হাতে তুলে দিল আপাতদৃষ্টিতে সুরক্ষার জন্য। লোকে ফিসফিস করল, গুঞ্জন তুলল; কিছু লোক হেসে উঠল যেন উপহাসচ্ছলে, যদিও বিষয়টা কিছুটা হলেও নাড়া দিয়েছিল তাদেরকে। কিন্তু এই কাজ তাকে তৎক্ষণাৎ কোনও স্বীকৃতি এনে দিল না। সে তার ভাড়া করা রুম নং:৭-এর দিকে টলতে টলতে যেতে লাগল। বিয়াট্রিস তাকে তার রুমের চাবি এনে দিল। লোকটা তার দিকে একপলক তাকাল, এবং সব আগ্রহ হারাল।

এরপর থেকে সে প্রতি শনিবারে আসত। পাঁচটায়, যখন বেশির ভাগ ধনীব্যক্তিকেই আসনে বসে থাকতে দেখা যেত। সে প্রতিদিনই একই ধরনের আচরণ করত, শুধু পয়সা জমা দেওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া, এবং প্রতিবারই ব্যর্থতার সম্মুখিন হত। সে প্রায় প্রতিদিন একই কোনায় বসত এবং প্রতিবারই রুম নং:৭ ভাড়া নিত। বিয়াট্রিস তার আগমন সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই ধারণা করতে পারত এবং নিজের অজান্তেই সে তার কক্ষ ঠিকঠাক করে রাখত। প্রায়শই যখন লোকটা বিশাল ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে বাজেভাবে অপমানিত হত, সে বিয়াট্রিসকে আটকে রেখে তার সঙ্গে কথা বলত, অথবা আসলে কথা বলত সে নিজের সঙ্গে নিজেই, বিয়াট্রিসের উপস্থিতিতে। তার জন্য, এটা ছিল সংগ্রামমুখর জীবন। সে কখনও স্কুলে যেতে পারেনি, যদিও শিক্ষা লাভ করার আকাঙ্ক্ষা তার ছিল। সে কখনও সুযোগ পায়নি। তার বাবা ইউরোপীয় অধ্যুষিত খাড়া-উপত্যকা অঞ্চলে অবৈধ দখলদার হিসাবে বসবাস করত। সেই ঔপনিবেশিক আমলে এটার অর্থ অনেক কিছু। অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে এটার অর্থ ছিল, একজন লোক ও তার সন্তানসন্ততিদের ভবিষ্যৎ চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সাদা দানব ও তাদের সন্তানদের জন্য ঘাম ঝরিয়ে এবং হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে। সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল এবং অন্যান্যদের মত কারাগারে প্রেরিত হয়েছিল। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে সে এসেছিল ঠিক যেমন তার মা তাকে এনেছিল এই পৃথিবীতে। কিচ্ছু না। স্বাধীনতার পর সে দেখল যে, তার তেমন কোনও শিক্ষা নেই যা তাকে উঁচু পদের খালি জায়গায় বসাতে পারে। সে কর্মজীবন শুরু করল একজন কাঠকয়লা প্রস্তুতকারী হিসাবে, তারপর একজন কসাই, ধীরে ধীরে সে তার নিজ উদ্যোগে খাড়া-উপত্যকা ও চিরি জেলা থেকে সবজি এবং আলু নাইরোবিতে পরিবহনের বড় ব্যবসায়ী বনে গেল। সে তার নিজের অর্জনে গর্বিত ছিল। কিন্তু সে ক্ষুব্ধ হত এজন্য যে, অন্য যারা তাদের বর্তমান বিত্তবৈভবের শিখরে আরোহন করেছে ঋণ এবং ভর্তুকি-দেওয়া শিক্ষার বদৌলতে, তার মত লোককে তারা কখনও স্বীকৃতি দেবে না। সে এটা নিয়ে অনবরত চাপা গর্জন করে চলত, শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করত, যা সে কখনও পায় নাই এবং চিন্তা করত তার সন্তানদের জন্য উন্নততর সুযোগ নিয়ে। তারপর সে সযত্নে টাকা গুনত, ওগুলো বালিশের নিচে রাখত এবং বিয়াট্রিসকে বিদায় দিত। কখনও-সখনও সে বিয়াট্রিসকে বিয়ার কিনে দিত, কিন্তু সে স্পষ্টত নারীজাতি সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ ছিল, যাদেরকে সে দেখত পুরুষের টাকাখেকো হিসাবে। তখনও পর্যন্ত সে বিবাহিত ছিল না।

এক রাতে লোকটা তার সঙ্গে শুলো। সকালবেলা সে একটি বিশ শিলিংয়ের নোট বের করে তাকে দিল। একধরনের বাজে অপরাধবোধ নিয়ে সে নোটটা গ্রহণ করল। অনেক সপ্তাহ ধরেই লোকটা এই কাজ করে চলল। বিয়াট্রিস টাকা নিতে আর কিছু মনে করত না। এটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু লোকটা তার দেহের জন্য টাকা দিত, যেমন সে টাকা খরচ করত এক ব্যাগ আলুর জন্য বা এক বস্তা বাঁধাকপির জন্য। এক পাউন্ড সে তাকে দিত তার কথা শোনার কাজের জন্য, ওই লোকগুলো সম্পর্কে অভিযোগের আধার হিসাবে তাকে ব্যবহারের জন্য এবং তার নিজের এক রাতের বোঝা সংগ্রহের পাত্র হওয়ার জন্য। বিয়াট্রিস লোকটির অহংবোধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তার একঘেয়ে গল্পে যার বিষয়বস্তুতে ছিল না বৈচিত্র্য, কিন্তু যেকোনও কারণে, তার ভেতরে, তার গহিন অন্তঃপুরে, সে অনুভব করত, ছিল একটা তেজোদ্দীপ্ত আবেগ, একটা বীজ, একটা ফুল যা হয়ে থাকত আবৃত। তার মধ্যে একজন সহভুক্তভোগীকে সে দেখতে পেত এবং আশা করে থাকত তার আগমনের। তারও ইচ্ছা হত কারও কাছে সব খুলে বলতে। সেও একজন লোকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে চাইত, যে তাকে বুঝতে পারবে।

এবং সে এটা করল এক শনিবার রাতে, আকস্মিকভাবে তার উন্নতির শিখরে কষ্টকর আরোহনের গল্পকে থামিয়ে দিয়ে। সে জানল না, কেন সে এটা করল। হতে পারে বাইরের বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি ঢেউটিনের ছাদে অনবরত মোলায়েমভাবে বাজনা বাজিয়ে চলেছিল। সেই বাজনার ধ্বনি নিয়ে আসছিল উষ্ণতার পরশ ও নিদ্রালু অন্যমনস্কতা। সে শুনবে। তাকে শুনতেই হবে। সে ন্যেরির কারাতিনা থেকে এসেছিল। তার দুই ভাইকে বৃটিশ সেনারা গুলি করে মেরেছিল। আরেকজন মরেছিল জেলখানায়। সে, বলতে গেলে ছিল একমাত্র সন্তান। তার বাবা-মা ছিল দরিদ্র। কিন্তু তারা তাদের একমাত্র জমিতে কঠোর পরিশ্রম করত এবং তার প্রাথমিক স্কুলের ফি দেওয়ার ব্যবস্থা করত। প্রথম ছ’বছর সে খুব খাটল। সপ্তম বছরে সে কিছুটা ঢিলা দিল। ভালো গ্রেড নিয়ে সে পাশ করতে পারল না। সে অবশ্য জানত, তার মত গ্রেড নিয়ে অনেকে ভালো সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে ডাক পেয়েছিল। তার চেয়েও খারাপ গ্রেড পাওয়া অনেকে সবচেয়ে ভালো স্কুলে সুযোগ পেয়েছিল তাদের যোগাযোগের শক্তির বলে। কিন্তু সে কোনও হাই স্কুলে যুক্তিসঙ্গত ফিতে ভর্তি হওয়ার ডাক পেল না। তার অভিভাবকরা কোনও হারামবি স্কুলের ফি-ও জোগাড় করতে পারল না। এবং স্ট্যান্ডার্ড সেভেনে পুনর্বার পড়বার কথা সে আর শুনতে পেল না। সে তার বাপমার সঙ্গে বাড়িতেই কাটাতে থাকল। কখনও কখনও সে তাদেরকে খেতের ও সাংসারের টুকিটাকি কাজে সাহায্য করত। কিন্তু কল্পনা কর, গত ছ’বছর ধরে সে তার পিতামাতা থেকে ভিন্ন এক ছন্দের জীবন যাপন করে আসছিল। গ্রামের জীবন ছিল নিরস। সে মাঝেমধ্যেই কাজের খোঁজে কারাতিনা এবং ন্যেরিতে যেত। প্রতি অফিসেই তারা তাকে একই প্রশ্ন করত: কী কাজ তুমি চাও? তুমি কী জানো? টাইপ করতে পারো? শর্টহ্যান্ড নিতে পারো? সে বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল। ন্যেরিতে যখন সে অশ্রুসজল চোখে এক দোকানে দাঁড়িয়ে ফান্টা খাচ্ছিল, দেখা হয়ে গেল কালো স্যুট ও সানগ্লাস পরা এক যুবকের সঙ্গে। যুবকটি তার দুরাবস্থা দেখে তার সঙ্গে আলাপ জমাল। সে নাইরোবি থেকে এসেছিল। কোনও চাকরির খোঁজ করছ? এটা অত্যন্ত সহজ; বড় নগরীতে চাকরি পাওয়া কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। সে অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। পরিবহন? তার প্রাইভেট-কার ছিল — ঘিয়ে রঙের পিজোঁ। স্বর্গরাজ্য! সকাল হওয়ার অঙ্গীকারে এটা ছিল অপূর্ব এক ভ্রমণ। নাইরোবি। সে তাকে গাড়ি চালিয়ে টেরেস বারে নিয়ে ওঠালো। তারা বিয়ার খেলো এবং নাইরোবি নিয়ে গালগল্প করতে থাকল। জানালা দিয়ে সে নিওন-আলোয় আলোকিত নগরী দেখতে পাচ্ছিল এবং বুঝতে পারছিল ওখানেই আশা। সেই রাতে সে লোকটার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিল, প্রত্যুষের অঙ্গীকার তার মধ্যে এনেছিল ফুরফুরে এক হালকা পুলক। ঘুম হয়েছিল গভীর। সকালে যখন সে জেগে উঠল, ঘিয়েরঙা পিজোঁর সেই লোকটি আর সেখানে ছিল না। সে আর কখনও তাকে দেখতে পেল না। এভাবেই সে শুরু করেছিল তার বার-পরিচারিকার জীবন। এবং এখন থেকে দেড় বছরের মধ্যে সে তার বাবা-মাকে একবারের জন্যও দেখেনি। বিয়াট্রিস ফোঁপাতে শুরু করল। নিজের প্রতি করুণা থেকে সে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল। তার অপমান এবং নিরন্তর ছুটে বেড়ানোর স্মৃতি তার মনে স্পষ্ট ছিল। সে কখনও নিজেকে বার-সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। সবসময় ভাবত, ভালো কোনও কিছু তার জীবনে আসবে। কিন্তু সে ফাঁদে আটকে গিয়েছিল, এটাই একমাত্র জীবন যা সে এখন জানে, যদিও এর সব আইন-কানুন সে এখনও আসলে রপ্ত করতে পারেনি। আবার সে লম্বা শ্বাস নিল এবং ছাড়ল, অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল প্রতিবার গুমরে ওঠার সাথে। হঠাৎ করেই সে নিথর হয়ে গেল। তার কান্না বাতাসে আটকে গেল। লম্বা আবরণে লোকটা আচ্ছাদিত। তার নাকডাকা ছিল প্রবল এবং স্পষ্ট।

সে অদ্ভুত এক ফাঁপা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হল। কেমন একটা তিক্ত-তরল যেন তখন তার ভেতর উছলে উঠতে লাগল। এই নতুন পরাজয়ে তার কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে অনেক লোকের সান্নিধ্যে এসেছিল, যারা তার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করত, যারা হাসত তার খুঁতখুঁতে স্বভাব নিয়ে, যাকে তারা তার সততা জাহিরের বদমতলব হিসাবে মনে করত। সেসব সে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এটা নয়, প্রভু, এটা সম্ভব নয়। লোকটা কি একইরকম পরিস্থিতির শিকার নয়? সে কি শনিবারের পর শনিবার বিয়াট্রিসের কাছে নিজেকে ভারমুক্ত করেনি? সে বিয়াট্রিসের মানবিক সেবার জন্য খরচ করেছে; সে তার দায়িত্ব হিসাবে সকালবেলায় টাসকারের বোতল এবং নগদ পয়সায় তার ঋণ পরিশোধ করেছে। আর এখন তার অন্তরের অশান্তির বয়ান তার কাছে মনে হয়েছে ঘুমপাড়ানি গান! হঠাৎ করেই তার ভেতরের কী যেন একটা মট করে ভেঙে গেল। দেড় বছরের যত ক্রোধ, অপমানের যত তিক্ততা, সব পরিচালিত হল এখন এই লোকটার দিকে।

পরমুহূর্তে যা সে করল, তা যেন করা হল হল দক্ষ হাতের অতি যান্ত্রিক নিপুণতায়।

বিয়াট্রিস লোকটার চোখ স্পর্শ করল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। সে লোকটার মাথা তুলে ধরল। তারপর নামিয়ে রাখল। তার অশ্রুহীন চোখ এখন শীতল এবং স্বাভাবিক। সে তার মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরাল। ওটা তন্নতন্ন করে হাতড়ালো। সে লোকটার সব পয়সাকড়ি বের করে নিল। কড়কড়ে গোলাপি পাঁচটি নোট গুনল। নোট ক’টা ঝটপট তার ব্রেসিয়ারের ভেতর গুঁজে নিল।

অতঃপর রুম নং:৭ থেকে সে বেরিয়ে এল। বাইরে তখনও বৃষ্টি। সে সচরাচর যে জায়গায় থাকত সেখানে যেতে চাইল না। ছোট্ট জিনিসপত্র রাখার রুমে থাকা ও তার রুমমেটের দাম্ভিক বকবকানি সহ্য করার কথা সে এখন চিন্তা করতে পারছিল না। সে কাদা এবং বৃষ্টি ভেঙে হাঁটতে লাগল। নিজেকে সে দেখল ইঁয়াগুতির রুমের দিকে হেঁটে যেতে। সে দরজায় কড়া নাড়ল। শুরুতে কোনও জবাব পেল না। তারপর বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ইঁয়াগুতির ঘুমজড়ানো গলার আওয়াজ শুনতে পেল।

‘কে ওখানে?’

‘আমি। দরজাটা খোলো, প্লিজ।’

‘আমি কে?’

‘বিয়াট্রিস।’

‘এত রাতে, এই অসময়ে?’

‘প্লিজ।’

বাতি জ্বলে উঠল। ছিটকিনি খোলার শব্দ হল। দরজা খুলে গেল। বিয়াট্রিস ভেতরে প্রবেশ করল। সে এবং ইঁয়াগুতি সেখানে কিছুক্ষণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। ইঁয়াগুতির পরনে ছিল স্বচ্ছ নৈশবসন, কাঁধের ওপর একটা সবুজ পুলওভার।

‘খারাপ কিছু ঘটেছে, বিয়াট্রিস?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অতঃপর সে জিজ্ঞেস করল।

‘আমি কি এখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে পারি? আমি খুব ক্লান্ত। এবং আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।’ বিয়াট্রিসের স্বরে আত্মপ্রত্যয় এবং ক্ষমতার রেশ।

‘কিন্তু, কী ঘটেছে?’

‘আমি তোমাকে একটিমাত্র প্রশ্ন করতে চাই, ইঁয়াগুতি।’

তারা তখনও দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল। তারপর, কোনও কথা না বলে, উভয়েই বিছানার ওপর বসে পড়ল।

‘তুমি কেন বাড়ি ছেড়েছিলে, ইঁয়াগুতি?’ বিয়াট্রিস জিজ্ঞেস করল।

আবার নীরব মুহূর্ত। মনে হল ইঁয়াগুতি প্রশ্নটি নিয়ে ভাবছে। বিয়াট্রিস অপেক্ষা করল। কিছুক্ষণ পর ইঁয়াগুতির কথা যখন ভেসে এল, স্বর ছিল কিছুটা কম্পিত, স্খলিত।

‘এটা এক লম্বা কাহিনি বিয়াট্রিস। আমার মা-বাবা যথেষ্ট অবস্থাপন্ন ছিল। তারা ভালো খ্রিস্টানও ছিল। আমরা নিয়মের মধ্যে চলতাম। আমরা কক্ষনও বিধর্মীদের সঙ্গে হাঁটতাম না। আমরা কক্ষনও তাদের পৌত্তলিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম না — যেমন ধরো, নৃত্য এবং খতনার অনুষ্ঠান। কী, কেমন করে এবং কখন খেতে হবে, এ নিয়েও নিয়ম ছিল। তোমাকে অবশ্যই একজন খ্রিস্টান মহিলার মত হাঁটতে হবে। তোমাকে কক্ষনও কোনও ছেলের সঙ্গে দেখা যেতে পারবে না। আইন, আইন সবক্ষেত্রে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার বদলে একই ধরনের পরিবারের আরেকজন মেয়েসহ ইস্টলেইতে [Eastleigh, নাইরোবির উপশহর] চলে যাই। গত এক বছরে আমি আর বাড়ি ফিরি নাই। ব্যস্, এ পর্যন্তই।

আরেকবার নীরবতা। তারা একে অন্যের দিকে তাকাল পারস্পরিক পরিচয় নিয়ে।

‘আরও একটা প্রশ্ন, ইঁয়াগুতি। তুমি চাইলে জবাব না-ও দিতে পার। কিন্তু সবসময় ভেবেছি যে, তুমি আমাকে ঘৃণা কর, আমাকে অবজ্ঞা কর।’

‘না, না বিয়াট্রিস। আমি তোমাকে কক্ষনও ঘৃণা করি নাই। আমি কখনও কাউকে ঘৃণা করি না। এটা এমনই যে, কিছুই আমাকে আগ্রহী করে না। এমনকি পুরুষরাও আমাকে এখন আর তেমন মুগ্ধ করে না। তবু আমি চাই, আমার দরকার তাৎক্ষণিক উত্তেজনা। আমার দরকার সেইসব ভুয়া চাটুকারি চোখের লোককে, যারা আমাকে নিজেকে বুঝতে দেয়, নিজেকে। কিন্তু তুমি, তোমাকে এসবকিছুর ওপরে মনে হত — যেকোনওভাবেই তোমার ভেতরে এমন কিছু ছিল যা আমার নাই।’

অনেক কষ্টে বিয়াট্রিস তার অশ্রুসংবরণ করল।

পরেরদিন সকালে, সে নাইরোবিগামী এক বাসে উঠল। সে বাজারের পথ ধরে হাঁটল, দোকানগুলোর দিকে চোখ ফেলে। তারপর চলে এল সরকারি সড়কে, সোজা কেনিয়াত্তা এভেন্যুতে এবং কিমাথি স্ট্রিটে। সে হোসেন সুলেমান স্ট্রিটের কাছে এক দোকানে ঢুকল এবং অনেকগুলো মোজা কিনল। একজোড়া পড়ল। তারপর নিজের জন্য নতুন পোশাক কিনল। সে আবার এটা পরিবর্তন করল। ‘বাটা’র দোকান থেকে উঁচু হিলের জুতা কিনল, তার পুরনো চেপ্টা হিলেরটা ফেলে দিয়ে সে ওটা পরল। সে ওয়াকাম্বা কিয়স্ক-এ [বুথ বা ছোট দোকান] গেল এবং তার কানে দুল পড়ল। সে আয়নার কাছে গিয়ে ‘নতুন’ নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। হঠাৎ করেই তার প্রচণ্ড খিদে পেল, মনে হল সারা জীবন ধরে সে অভুক্ত। মতিমহলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। অতঃপর সে এগোলো এবং অবশেষে ফ্রানসাইতে প্রবেশ করল। তার চোখে এমন এক দ্যুতি ছিল যা মানুষকে তার দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করল। এটা তাকে রোমাঞ্চিত করল। সে কোনার এক টেবিল বেছে নিয়ে ভারতীয় খাবারের অর্ডার দিল। এক লোক নিজের টেবিল ছেড়ে এসে তার সঙ্গে যোগ দিল। সে লোকটার দিকে তাকাল। বিয়াট্রিসের চোখে প্রফুল্লতা ছিল। লোকটার পরনে ছিল কালো স্যুট এবং তার চোখে ছিল কামনার ভাষা। লোকটা তার জন্য পানীয় কিনল। চেষ্টা করল তার সঙ্গে আলাপ জমাতে। কিন্তু সে নিঃশব্দে খেয়ে চলল। লোকটা তার হাত টেবিলের নিচে রাখল এবং তার হাঁটু স্পর্শ করল। বিয়াট্রিস তাকে এটা করতে প্রশ্রয় দিল। হাত ওপরে উঠল, তার উরুর ওপরে। তখন আচমকা বিয়াট্রিস তার অসমাপ্ত খাবার ও স্পর্শ না-করা পানীয় ফেলে বাইরে বেরিয়ে এল। সে বেশ ঝরঝরে বোধ করল। লোকটা তখনও তাকে অনুসরণ করছিল। সে এটা বুঝতে পারল একবারও চোখ না ফিরিয়ে। লোকটা তার পাশাপাশি হাঁটল বেশ কয়েক গজ। বিয়াট্রিস মনে মনে হাসল, কিন্তু তার দিকে তাকাল না। লোকটা অবশেষে হাল ছেড়ে দিল। সে লোকটাকে গিনোজ-এর [Gino’s, বিপণির নাম] বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁচের জানালার দিকে ঘুমজড়ানো চোখে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় ছেড়ে এল। ইলমোরোগে ফেরার বাসে মানুষ তাকে বসবার জন্য জায়গা ছেড়ে দিল। সে এটাকে তার প্রাপ্য হিসাবে গ্রহণ করল। ‘ট্রিটপ বার’-এ এসে সে সোজা কাউন্টারে গেল। বড়লোকদের স্বাভাবিক ভিড় তখন বারে। তার প্রবেশের মুহূর্তে তাদের কথোপকথন ক’সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল। তাদের কামুক চোখগুলো তার দিকে ফেরানো ছিল। মেয়েগুলোও তার দিকে তাকিয়ে রইল। ইঁয়াগুতি তার বিরক্তি মেশানো উদাসীনতার ভাব রক্ষা করতে ব্যর্থ হল। বিয়াট্রিস তাদের জন্য পানীয় ক্রয় করল। ম্যানেজার তার কাছে এল, যেন কিছুটা দ্বিধা নিয়ে। সে আলাপ করতে চেষ্টা করল। কেন সে কাজ ছেড়ে দিল? এতদিন সে কোথায় ছিল? কাউন্টারের পেছনে ইঁয়াগুতিকে সহায়তা করবার জন্য সে কি এই বারে কাজ করবে? মাঝেমধ্যে? এক পরিচারিকা তাকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। এক হোমরাচোমরা জানতে চেয়েছে সে কি তার টেবিলে যাবে। আরও অনেক চিরকুট আসতে লাগল বিভিন্ন বড় স্থান থেকে একই প্রশ্ন নিয়ে: সে কি আজ রাতে ফ্রি থাকবে? এমনকি নাইরোবি ভ্রমণের আমন্ত্রণসহ। সে কাউন্টার থেকে নড়ল না। কিন্তু সে তাদের-দেওয়া পানীয় গ্রহণ করল তার ন্যায্য পাওনা হিসাবে। অনুভব করল নতুন এক ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাসও।

সে এক শিলিং তুলে নিল এবং তা ফেলল জিউক-বক্সের সরু ছিদ্রে, আর সঙ্গে সঙ্গে জিউক-বক্সে [Juke box, এক ধরনের গান শুনবার যন্ত্র, যার ছিদ্রে [slot] কয়েন ঢুকিয়ে বাটন টিপে পছন্দের গান শোনা যায়] উচ্চগ্রামে বেজে উঠল রবিনসন ম্ওয়াঙ্গির গান হুনিউ ওয়া মাশামবানি [Hunyu wa Mashambani]। সেইসব তুচ্ছ মেয়ে যারা ফসলের খেতে কাজ করে, শহুরে মেয়েদের সঙ্গে তাদের বৈপরীত্য দেখিয়ে সে গান গাইত। তারপর সে চালাল কামারু’র এক গান, এবং কিছু অপরিচিত ব্যক্তি তার সঙ্গে নাচতে চাইল। সে তাদেরকে উপেক্ষা করল কিন্তু তার চারপাশে তাদের ঝটপটানি সে উপভোগ করল। আরেকজন অপরিচিত ব্যক্তির শব্দে সে তার নিতম্ব বাঁকালো। তার দেহ ছিল মুক্ত। সে ছিল মুক্ত। সে পরিবেশের টানটান উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দিল।

সেইসময়, ছ’টার দিকে, আকস্মিকভাবে পাঁচ-টনি লরির লোকটি ভয়ানক ক্রুদ্ধভাবে বারে এসে ঢুকল। এবার তার পরনে মিলিটারি ওভারকোট। তার পেছনে একজন পুলিশ। সে চতুর্দিকে তাকাল। প্রত্যেকের চোখ তার দিকে নিবদ্ধ। কিন্তু বিয়াট্রিস তার নিতম্ব দুলিয়েই চলেছিল। প্রথমে সে বিয়াট্রিসকে চিনতে পারল না, একটি মেয়ে যে তার গৌরবের কিছু মুহূর্তকে উদযাপন করছিল জিউক-বক্সের গান শুনে। তারপর সেই লোকটি বিজয়োল্লাসে চিল্লিয়ে উঠল : ‘এই সেই মেয়ে! চোর! চোর!’

লোকেরা তাদের নিজ-নিজ আসনে গিয়ে বসল। পুলিশ বিয়াট্রিসের হাতে হাতকড়া পরালো। সে বাধা দিল না। কেবল দরজার কাছে গিয়ে সে তার মাথা পেছনে ফেরালো এবং এক দলা থুথু ফেলল। তারপর সে বেরিয়ে গেল পুলিশকে অনুসরণ করে।

বারের স্তম্ভিত নৈঃশব্দ্য আনন্দের অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, যখন কেউ একজন ‘কোনওরূপ হিংস্রতা ছাড়া মধুর ডাকাতি’ নিয়ে কৌতুক করে উঠল। তারা বিয়াট্রিসকে নিয়ে আলাপ জুড়ল। কেউ বলল, তাকে আচ্ছামত পেটানো দরকার ছিল। কেউ কেউ এই ‘বার-মেয়েদের’ নিয়ে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করল। এছাড়াও আরও অনেকেই চোখে পড়ার মত অবিশ্বাস্যভাবে মাথা দোলানোর মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান হারে অপরাধ বিস্তারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করল। ফাঁসির বিলটি কি সকল ধরনের সম্পদ চুরি পর্যন্ত বাড়ানো যায় না? এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাঁচ-টনি লরির লোকটি একজন হিরো বনে গিয়েছিল। তারা সকলে এখন তাকে ঘিরে ধরেছিল বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে এবং জানতে চাইছিল পুরো ঘটনাটি। কেউ কেউ এমনকি তার জন্য পানীয় কিনল। আরও লক্ষনীয় যে, তারা সবাই একাগ্রমনে তার কথা শুনছিল, তাদের মনোযোগী নিস্তব্ধতায় মাঝেমধ্যে ছেদ পড়ছিল কেবল প্রশংসার উচ্চহাসিতে। সম্পদের প্রতি হুমকি প্রতিহত হওয়ার ব্যাপারটা সাময়িকভাবে হলেও তাদের সবাইকে একটা পরিবারিক বন্ধনে বেঁধে ফেলল। এবং লোকটি এই প্রথমবারের মত সম্মতি পেল, পরিপূর্ণ উৎসাহ নিয়ে গল্প বলবার।


কিন্তু কাউন্টারের পেছনে ইঁয়াগুতি ফোঁপাতে থাকল।

-----------------------------------------

টীকা:
তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরে দেওয়া ব্যাখ্যাগুলো অনুবাদকের।


লেখক পরিচিতি
ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও  

কেনিয়ার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র জন্ম। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ ন্গুগি।

তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময়ে, ১৯৬২-তে তাঁর লেখা Black Hermit নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ইংল্যান্ডের লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not Child প্রকাশিত হয়। এটা কোনও পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। ১৯৬৭-তে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তিনি ইংরেজি, খ্রিষ্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস্ ন্গুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন মাতৃভাষা গিকুয়ুতে।

ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ভিন-এ ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য’র একজন সম্মানিত অধ্যাপক (Distinguished Professor)|

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য একজন কথাশিল্পী হিসাবে তাঁর নাম বারবার আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে।

‘গৌরবের মুহূর্তগুলো’ গল্পটি থিয়োঙ্গ’ও-র MINUTES OF GLORY গল্পের অনুবাদ।




অনুবাদক পরিচিতি

শামসুজ্জামান হীরা

মুক্তিযোদ্ধা
গল্পকার। অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ