দীপেন ভট্টাচার্য
‘এখানে কেউ মরে না,’ বহু বছর আগে ছয় বছরের বিনতাকে তার বাবা একটা ভূগোলক দেখিয়ে বলেছিল। ‘কে মরে তাহলে বাবা?’ জিজ্ঞেস করেছিল বিনতা তার চোখ গোল করে। ‘অন্য প্রাণীরা। তুমি তো হাতি ভালবাস, কিন্তু হাতি আশি বছরের বেশী বাঁচে না।’
সেদিন বিনতা বোঝে নি কেন হাতি এর চেয়ে বেশীদিন বাঁচবে না। সারা পৃথিবী এখন অভয়ারণ্যে ভর্তি, হাতির দল ঘুরছে সারা আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে পুরাতন চীনদেশে। এই ডামুরি অরণ্যেই রয়েছে কত হাতি, আজ তাদেরই একটা বড় দলের ছবি ভেসে ওঠে বিনতার ঘরে। অদিতার দেহের খোঁজে পাঠানো রোবট-হেলিকপ্টার থেকে পাঠানো ভিডিও ত্রিমাত্রিক গঠনে মূর্ত হয়ে ওঠে ঘরের একপাশে। একটা পাহাড়ের ঢালে ছোট একটা জলাশায়, তাকে ঘিরে কয়েকটা গাছ তাদের ডাল আর পাতা প্রায় ডুবিয়ে রেখেছে জলে। আর জলের ধারেই ওপর হয়ে পড়ে আছে অদিতা, তার দেহের প্রায় অর্ধেকটা জলে। বিনতা ডান হাত্টা দিয়ে নাক আর মুখ চেপে একটা অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে। অদিতার দেহের হাজার হাজার ন্যানোরোবট তাকে বাঁচাতে পারে নি। কেন? ভাবে বিনতা। ছোট রোবটগুলোর কাজই তো এই, হৃদযন্ত্রের ধমনীতে ছোটখাটো প্লেক জমলে সেখানে গিয়ে মুহূর্তে তাকে ধ্বংস করে দেবে, শিরা-উপশিরায় রক্ত জমাট বাঁধতে দেবে না, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে সঙ্গেসঙ্গেই সেটাকে বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা থাকবে। তবে বিনতা এটাও জানে মাথার পেছনে হঠাৎ আঘাত পেলে ন্যানো-রোবটদের কাজ করার সুযোগ নেই। অদিতা কি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছিল? পড়তে পড়তে কি তার মাথায় পাথরের ধাক্কা লেগেছে? নাকি তাকে পেছন থেকে কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করেছে? অদিতাকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বিনতার নিজেকে অসহায় মনে হয়।
রোবট-হেলিক্প্টার দুটো জলাশয়ের ওপর কিছুক্ষণ ভাসে, বিনতা একটি রোবটকে বলে পার্শ্ববর্তী জায়গাটা জরীপ করতে আর দ্বিতীয়টিকে বলে অদিতার দেহকে উদ্ধার করতে। দ্বিতীয় রোবটটি নিচে নেমে আসে, সেটার পাশ থেকে প্রায় আটটি লম্বা চোঙার মত নল বেড়িয়ে আসে, প্রতিটি নলের সামনে মানুষের হাতের মত দশটি করে ধাতব আঙুল, তারা খুব আলগোছে অদিতার দেহ তুলে নিয়ে হেলিকপ্টারের নিচে উঠিয়ে নিয়ে আসে। হেলিকপ্টারের নিচের অংশটায় চারটে ত্রিভুজের মত দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে একটা প্ল্যাটফর্ম বের হয়ে আসে, সেখানে খুব যত্ন করে নল-আঙুলগুলো অদিতার দেহটা রেখে দেয়। প্ল্যাটফর্মটা ওপরে উঠে যায়, দরজাগুলো বন্ধ হয়, নলগুলো নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
যতক্ষণ দ্বিতীয় রোবটটি অদিতার দেহকে উদ্ধার করছিল তত্ক্ষণ প্রথম রোবটটি জলাশয়ের গাছগুলো পেরিয়ে তার পাশেই একটি গর্জনগাছের বনের ওপরে উড়তে থাকে। রোবটের অবলোহিত তরঙ্গের প্রতিচ্ছবিতে বিনতা দেখতে পায় জলাশয় থেকে সেই বনে ঢোকার জন্য একটা অস্পষ্ট পায়ে-হাঁটা পথ। পথটা দৃশ্যমান তরঙ্গে দেখতে পাবার কথা নয়, কিন্তু অবলোহিত তরঙ্গের উষ্ণতায় ফুটে ওঠে মাড়ানো ঘাসের মাঝে পদচিহ্ন। সেই পথ দিয়ে কোনো মানুষ কিছুক্ষণ আগেই গিয়েছে, তার পায়ের স্পর্শের তাপ রয়ে গিয়েছে ঘাসের মধ্যে। এই বনে অন্য মানুষের থাকার কথা নয়, কিন্তু অদিতার মৃত্যুতে কি সেই মানুষের হাত রয়েছে?
“চেতনা দিয়ে যে জীবনের অনুভব, তার অবর্তমানে কোনো ধরণের অস্তিত্বের অর্থ নেই। মৃত্যু হল স্বপ্নহীন ঘুম। আমাদের সচেতন জীবন সবসময়ই ধ্বংস হতে থাকে যখন আমাদের ঘুমে স্বপ্ন থাকে না। জন্মের পূর্বে যেমন চেতনা থাকে না, ঘুমের মাঝেও আমরা সেই অবস্থায় বিরাজ করি। স্বপ্ন-ছাড়া ঘুমের মাঝে নিউরনদের মধ্যে সংকেতের আদান-প্রদানের কম্পাঙ্ক খুব কম হয়ে যায়। সেকেন্ডে এক থেকে তিনবার, অথচ যখন আমরা স্বপ্ন দেখি তখন সেই নিউরনগুলি উঁচু কম্পাঙ্কে যদৃচ্ছভাবে কাজ করে। আবার যখন জেগে থাকি তখনও সেভাবে কাজ করে। তাই স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর স্বপ্নবিহীন ঘুম ও মৃত্যুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, প্রতি রাতে ঘুমের সময় আমরা বহুবার মৃত্যুবরণ করি।”
একটা ছিমছাম ঘরে দশটি ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে বিষাণ। পশ্চিমে সূর্যের লাল আলো জানালার কাঁচ পেরিয়ে ঘরে ঢোকে। বিকেলের এই সময়টাতে পড়াতে চায় না বিষাণ, কিন্তু সময়টা ঠিক করা হয়েছে ঐ দশটি ছাত্রর সুবিধা অনুযায়ী। সারা পৃথিবীর বাছাই করা একশটি ছাত্রদের মধ্যে দশটি ছাত্র এই স্কুলে পড়ছে। এদের বয়স চৌদ্দ থেকে ষাট বছর। গত বছর নব্বই বছর বয়সী এক নারী তার ছাত্র ছিল, এই ক্লাসে পড়তে হলে বয়সের কোনো সীমা নেই। প্রায় দশ বছর ধরে এই স্কুলে পড়ায় বিষাণ। লেকচার দিতে দিতে সে ভাবে পৃথিবীতে সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় শিক্ষার ধারণা কবেই উঠে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রূপান্তরিত হয়েছে ছোট ছোট স্কুলে যেখানে সিলেবাস বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শেষ সূর্যের আলোয় আকাশে ধীর গতিতে চলমান বিমানগুলোর দিকে তাকিয়ে বিষাণ ভাবে বিশালগড় শহরটাও কেমন বদলেছে। বহুদূরে, প্রায় ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে পড়ে রয়েছে এক কালের মহানগরী ঢাকা। এখন সেটা জলে নিমজ্জিত, তার উঁচু সব বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখন একটা অগভীর সমুদ্রের নিচে। আর এই বিশালগড়ে এসে নামছে বিমান পৃথিবীর দূর প্রান্ত থেকে। বিমানগুলো এমনভাবে উড়ছে যেন তাদের কোথাও যাবার তাগাদা নেই। সূর্যালোক, ঠাণ্ডা-গরমে বাহিত বাতাস, বায়ুর ঘনত্বের হেরফের, এমন কি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিঃশব্দে আকাশে উড়ছে বিমানগুলো।
বিষাণ স্কুলটির সবচেয়ে ওপরের তলায় - তিন নম্বর তলায় পড়াচ্ছিল। জানালা দিয়ে দেখা যায় স্কুলের একদিকে ঘন শালবন, তার মধ্য দিয়ে একটা সরু হাঁটা পথ। পথটা একটা বড় রাস্তার ধারে শেষ হয়েছে। সেই রাস্তার ঐ পাড়ে এই শহরের সবচেয়ে উঁচু এবং বড় বাড়িটি। মাটির ওপরে পাঁচটি তলা, কিন্তু সবাই জানে মাটির নিচে সেই বাড়ি বিস্তৃত হয়েছে বিশটি তলাতে। সেখানে জমা আছে বিশ মিলিয়ন বা দু কোটি মস্তিষ্ক। সারা পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন দুই বিলিয়ন বা দুশো কোটি। দুশো কোটির কিছু বেশী মস্তিষ্কের প্রতিলিপি সংরক্ষিত আছে পৃথিবীর নানান জায়গায় এরকম দেড়শটি বাড়িতে। পৃথিবীর আর কোথাও নিরাপত্তা এত কড়া নয় যেটা এরকম মস্তিষ্ক সংগ্রাহাগারে থাকে। দূর থেকে কিছু বোঝা যায় না, সাধারণ বাড়িই মনে হয়, ওপরে সবুজ রঙের ঢালু চাতাল, ফুটপাতের পাড়েই একটা লাল দরজা। কিন্তু সেটা সব সময় বন্ধই থাকে। সেই বাড়িতে কিভাবে ঢুকতে হয় বেশীরভাগ লোকই সেটা জানে না। যার ঢোকার অনুমতি আছে তার জন্য লাল দরজাটা নিজে থেকেই খুলে যায়। পৃথিবীর এই অঞ্চলে হয়ত পনেরো থেকে কুড়ি জন লোকের সেখানে ঢোকার অনুমতি আছে, বিষাণ তাদের মধ্যে একজন। লাল দরজাটির পাশে দেয়ালে একটা সবুজ ফলক, তাতে লেখা ‘নিলয়’। পৃথিবীর সমস্ত মস্তিষ্ক সংরাক্ষাণাগারের নাম হল ‘নিলয়’.
বিকেলের শেষ আলোটা দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে, সেটাকে ধরে রাখার জন্যই ঘরে একটা মৃদু লাল আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকে। এই পৃথিবীতে ঘরের আর রাস্তার বাতি হঠাৎ জ্বলে ওঠে না। বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাতের আঁধারে যে রূপান্তর তাকে উজ্জ্বল বিজলীর আলো দিয়ে মানুষ নষ্ট করে দেয় না। তাই বিশালগড়ের মত শহরেও রাতে ফুটে ওঠে ছায়াপথ, শয়ে শয়ে উজ্জ্বল তারা।
বিষাণ বলতে থাকে, “আমরা বহুদূর এসেছি। প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৌশলকে আমরা নরমভাবে সংযুক্ত করতে পেরেছি। পৃথিবীর বুকে বিশাল নির্মাণই যে মানব জাতির সাফল্য সেই ধারণা থেকে আমরা সরে এসেছি। আমরা সৌর জগতের প্রান্তে মানুষ পাঠাতে পেরেছি, কিন্তু আমরা বুঝেছি মহাশূন্যে বসবাস মানুষের জন্য স্বাভাবিক নয়। তাই সেইসব মহাকাশযানে আমাদের পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে নকল করতে হয়েছে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বাঁচতে দেহের মধ্যে ন্যানো রোবটের সাহায্য নিতে হয়েছে যারা কিনা খুব সহজেই আহত কোষকে সারিয়ে বা সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের পক্ষে অন্য গ্রহে বা উপগ্রহে দীর্ঘমেয়াদী উপনিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় নি।
এ’সব বলতে বলতেই বিষাণ অন্যমনা হয়ে যায়, কিন্তু সেটা ছাত্রদের বুঝতে দেয় না। বলে, “আপনারা জানেন এক হাজার বছর আগে শুধুমাত্র একটি মহাকাশযান, আন্টারেস, সৌর জগতের নিকটবর্তী তারাদের মাঝে পৃথিবীর মত গ্রহ খুঁজতে রওনা হয়ে গেছে। সেই যানটিতে প্রায় পাঁচশো মানুষ আছে যারা কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আর সাতশো বছর আগে পৃথিবী থেকে দূর নক্ষত্রের সমস্ত মানুষবাহী যান পাঠানোকে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল, সেই সাময়িক সিদ্ধান্ত এখন প্রায় স্থায়ী হয়েছে।”
মাথা নাড়ায় সবাই। বিষাণ জানে এসব কোনো কিছুই তার ছাত্রদের অজানা নয়। একদম সামনের সাড়িতে বসা ছিল সিলেয়া নামের মেয়েটি। তীক্ষ্ণ চিবুক আর নাক, স্পষ্ট গালের হাড়, উজ্জ্বল খয়েরী চোখ, পেছনে ছড়ানো কালো চুলের সিলেয়া মাঝে মধ্যেই দুটো হাত তুলে তার দশটা আঙুল নাচের মুদ্রায় খোলে আর বন্ধ করে। মনে হয় সে বিষাণর কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে না, কিন্তু বিষাণ জানে তার একটি কথাও সিলেয়ার কানকে ফাঁকি দেয় নি। ফাঁকি যে দেয় নি সেটা সিলেয়ার হঠাৎ কথা বলে ওঠার মধ্যেই প্রমাণ পেল।
“নিষিদ্ধ করাটা ঠিক হয় নি। মানুষ এই গ্যালাক্সিতে আবির্ভূত হয়েছেই অজানাকে জানার জন্য,” সিলেয়ার কথায় দৃঢ়তা থাকে, সেই দৃঢ়তা এমন যে বিষাণকে মুহূর্তখানেকের জন্য সেটা যেন অপ্রস্তুত করে দেয়, বিষাণের হৃদযন্ত্রে একটা তাল বাদ পড়ে, তারপর আবার খুব দ্রুত চলে।
“ঠিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে আমি বলব না, এর মধ্যে দূরপাল্লার শখানেক স্বয়ংক্রিয় যান কাছের নক্ষত্রদের উদ্দেশ্য পাঠানো হয়েছে,” কথাগুলো বলে নিজেকে একটু বোকা লাগে বিষাণের। সিলেয়া এমন একট হাসি মুখ করে থাকে যেন বিষাণ নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে, কিছু বোঝে না। অথচ বিষাণের বয়স একশ পঞ্চাশ ছুঁলে সিলেয়াই এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। শ্যাম্পেনের গ্লাস উঁচু করে বলেছিল, “পৃথিবীর স্মৃতির রক্ষাকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখতে মানুষটির জন্য।” বিষাণের মুখ কেন জানি লাল হয়ে গিয়েছিল সেটা শুনে। লজ্জায় নাকি আনন্দে, অথবা দুটোতেই! কিন্তু সেই আনন্দের সন্ধ্যাতেও বিষাণ সিলেয়াকে এড়িয়ে গিয়েছিল, সেটা কিছুটা ভয়েই। এই মেয়েটি তাকে যেভাবে আকর্ষণ করেছে তার ফল ভাল হতে পারে না সে জানে।
“আর হাজার বছর আগে যে যানটি পাঠানো হয়েছিল সেটি এখন কোথায় আছে?” সিলেয়ার আর একটি প্রশ্নে বিষাণের সম্বিত ফেরে। কোথায় আছে সেটা সিলেয়া ভাল করেই জানে, কারণ আন্টারেসের শেষ বার্তা আসে তিনশো বছর আগে। আন্টারেস তখন ১৪ আলোকবর্ষ দূরের লাল বামন তারা Wolf ১০৬১ পার হচ্ছিল। সেই বার্তা বলে সেখানে অভিযাত্রীরা পৃথিবীর মত কোনো বাসযোগ্য গ্রহের সাক্ষাৎ পায় নি, অথচ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন সেই তারার চারদিকে বেশ কয়েকটি গ্রহ পৃথিবীর মত হতে পারে।
আন্টারেসের ইঞ্জিন ছিল হাইড্রোজেনের। সূর্য তার অভ্যন্তরে কয়েকটা হাইড্রোজেন পরমাণুকে জুড়ে তৈরি করে হিলিয়াম, সেই সঙ্গে সৃষ্টি করে শক্তির। একে বলে ফিউশান। ঠিক সেইভাবে আন্টারেসের ইঞ্জিন ফিউশান ব্যবহার করে আন্তঃনাক্ষত্রিক পথ পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু সেই নাক্ষত্রিক জাহাজের নাবিকদের মস্তিষ্ক কপি করা ছিল না, সেই প্রকৌশল সৃষ্টি হয়ে আন্টারেস পৃথিবী ছেড়ে যাবার কয়েক শ বছর পরে। তাই সেখানে মৃত্যু ছিল। আন্টারাসের নতুন প্রজন্ম কখনো পৃথিবী দেখে নি। পৃথিবীর কাহিনী তারা শুনেছে কিংবদন্তীর মত।
আন্টারেস পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছিলেন মস্তিষ্ককে যথাযথভাবে নকল করবার। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন মস্তিষ্কের সমস্ত তথ্যকে নকল করে কৃত্রিমভাবে সেই তথ্যকে কম্পুটারে বাস্তবায়িত করা যাবে। সেই মস্তিষ্ক হবে ইলেকট্রনিক। কিন্তু আট হাজার ছয়শ কোটি নিউরন, ছিয়াশি লক্ষ কোটি সিন্যাপসকে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা কঠিন, শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জৈবিক আধারেরই সাহায্য নিলেন। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ - গ্লিয়াল ও নিউরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় সংকেতের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুললেন ত্রি-মাত্রিক জৈবিক মস্তিষ্ক।
টেবিলের ওপরে রাখা পাত্লা একটা স্ক্রীন লাল আলোতে জ্বলে ওঠে। সেদিকে বিষাণ তাকালে দেখে একটা লেখা ফুটে উঠেছে, ‘নিলয়ে’ আপনার উপস্থিতি প্রয়োজন। বিষাণ বোঝে ‘নিলয়ে’ নতুন দেহ এসেছে। কিন্তু সেখানে সবসময় যে তার উপস্থিতি প্রয়োজন তা নয়, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে তাকে ডাকা হয়।
“আজকের মত ক্লাস এখানেই শেষ,” বলে বিষাণ, “আমাকে ‘নিলয়ে’ যেতে হবে। তবে কাল যখন আসবেন নতুন একটা সমস্যার সমাধানে আপনাদের আইডিয়াগুলো নিয়ে আসবেন। সমস্যাটা আন্তর্জালে দেয়া আছে - কপি করা মস্তিষ্ক কি আসলেই আদি মানুষটির সত্তা ও চেতনা বহন করে, নাকি সেই কপি নতুন একটি সত্তার জন্ম দেয়? সমস্যাটির সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর একটি প্রশ্ন হল স্বপ্নবিহীন ঘুম থেকে যখন একটি মানুষ জেগে ওঠে সেটি কি সেই মানুষই যে একটু আগে ঘুমাতে গিয়েছিল? শেষের প্রশ্নটি কি প্রথমটির সঙ্গে সম্পর্কিত?”
এটুকু বলে বিষাণ দ্রুত ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়, তারপর একটু আতঙ্কিত হয়েই দেখে সিলেয়াও একই সঙ্গে বের হয়ে এসেছে। “ডকটর বিষাণ, সিলেয়া নামের একটি মানুষ আপনার ক্লাসে গতকাল এসেছিল, একদম সামনের টেবিলে বসেছিল।” বিষাণ প্রথমে বিস্মিত হয়ে সিলেয়ার দিকে তাকালেও সঙ্গে সঙ্গেই বোঝে এটা একটা প্রশ্ন বা রসিকতার ভূমিকা মাত্র। সিলেয়া বিষাণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আর প্রশ্নটি করার উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “এখন আমার মনে হচ্ছে আমি - আজকের সিলেয়া - গতকালের সিলেয়া থেকে একেবারেই ভিন্ন, যেন আর একটা মানুষ। এটা কি সম্ভব? ”
বিষাণ বোঝে সিলেয়া তার সঙ্গে ঠাট্টাই করছে, কিন্তু ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। “সেটা আপনিই আমাকে কাল বলবেন,” একটু ভদ্রতা-রক্ষাকরা হাসি হেসে বিষাণ এগিয়ে যেতে চায়, কিন্তু সিলেয়ার আরো কিছু পরিকল্পনা ছিল। সে জিজ্ঞেস করে, “আপনার সঙ্গে কি আমি ‘নিলয়ে’ যেতে পারি?”
এটা যে একেবারেই সম্ভব নয় সেটা সবাই জানে, তবু বিষাণ সিলেয়াকে কীভাবে এড়াতে পারবে বুঝে পায় না, বলে, “খুবই জরুরী অবস্থা এখন, এই মুহূর্তে তো যাওয়া সম্ভব নয়।” সিলেয়া হেসে চলে যায়, সে বিষাণের সঙ্গে ঠাট্টা করে যেন মজা পায়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে বিষাণ। তেতলা থেকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি ধরে সে নিচে স্কুলের বাগানে ঢোকে, তারপর প্রায় দৌড়েই বাগানটা পার হয়ে একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে সে শালবনে প্রবেশ করে। অন্ধকার হয়ে আসছে, ছোট বনের রাস্তাটার পাশে মৃদু বাতি জ্বলে। শালবনটা শেষ হয়েছে একটা বড় রাস্তায়, বিশালগড়ের প্রধান রাস্তা এটা। একটা কালো রঙে চকচক করে রাস্তাটা, সৌর সেল দিয়ে রাস্তাটা মোড়া, সূর্য থেকে শক্তি আহরণ করে সেই রাস্তা। কিন্তু রাস্তাটা একেবারেই ফাঁকা, দু-একটি চালকবিহীন বড় বাস নিঃশব্দে চলছে, একপাশে সাইকেলের মত একটি বাহনের জন্য নির্ধারিত রাস্তা - সেখানে মানুষেরা নিজ শ্রমে তাদের বাহন চালাচ্ছে, তার পাশেই আর একটি দাগ দেওয়া পথ, সেখানে তারা একটি চাকার ওপর ছোট প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চলছে, তাদের বাহন কোথায় তারা যেতে চায়, কত দ্রুত যেতে চায় এসবই জানে।
রাস্তা পার হতে একটা ছোট সেতু দিয়ে, সেতুটার উচ্চতা বেশী না, এই শহরের কোনো গাড়ির উচ্চতাই তিন মিটারের চেয়ে উঁচু নয়। বিষাণ সেতুটাতে পা দেওয়া মাত্রই নিচে রাখা পথটা চলতে আরম্ভ করে, নিঃশব্দে। ওপাড়ে বিষাণকে নামিয়ে দিয়ে পথটা থেমে যায়। ‘নিলয়ে’ ঢোকার মুখে একটা ছোট কফির দোকান, সেখান থেকে মৃদু বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। এখানে অনেক সময়ই বিষাণ আসে, কিন্তু আজ সময় নেই, নতুন একটি মৃতদেহ এসেছে, তার মধ্যে পুরোনো মস্তিষ্ক বসাতে হবে।
বিষাণ কাছে আসা মাত্র ‘নিলয়ের’ নিচের লাল দরজা খুলে যায়, বাড়িটা তাকে চিনতে পেরেছে। ঢোকা মাত্র একটা চলন্ত সিঁড়ি বিষাণকে দোতলায় নিয়ে আসে। সেখানে একটু খোলা জায়গা, তার একদিকে একটি সুরক্ষিত দরজা, সেটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। ঘরের ভেতরে মৃদু আলোয় বিষাণর জন্য অপেক্ষা করে তিনজন, দুজন নারী ও একটি যান্ত্রিক রোবট। এদের দুজনকে খুব ভাল করে চেনে বিষাণ - নিলয়ের প্রধান ডকটর তারকার আর প্রধান সার্জন আর প্রকৌশলী স-কুরা। স-কুরা হল একটি মানুষরূপী রোবট যে কিনা নিজেকে মানুষ বলে দাবি করে। সে আরো দাবি করে যে তার আত্ম-উপলব্ধি আছে, কিন্তু তার আশেপাশের মানুষরা এই ব্যাপারে কখনই নিশ্চিত হতে পারে নি। স-কুরার মুখ দেখে সহজে বোঝা যাবে না সে নারী কিংবা পুরুষ, এক্ষেত্রে তার বক্তব্য হল সে একজন পুরুষ। ঘরের মাঝখানে ছিল মানুষ-প্রমাণ একটা নীল রঙের বাক্স। বিষাণ জানে সেই বাক্স কী আছে।
ডকটর তারকারের বয়স বিষাণর মতনই, একগুচ্ছ না-আঁচড়ানো সোনালী চুল এলোমেলোভাবে মুখটাকে ঘিরে আছে। সে দাঁড়ানো আর একজন নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয়, “ইনি ডকটর বিনতা। ডামুরি অভয়ারণ্যের মানুষজনদের দেখাশোনা করেন।” বিনতা মাথা নিচু করে সম্ভাষণ করে, বিষাণও করে। “আমার থেকে বয়সে ছোটই হবে বিনতা,” ভাবে বিষাণ। বিনতা বিষাণকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ডকটর বিষাণ, আপনি আমাকে চিনবেন না, কিন্তু আপনাকে আমি এখানে কাজের আগে দুটো কথা বলতে চাই যদি ডকটর তারকার আমাকে একটু সময় দেন।” তারকার আশ্চর্য হয়, কিন্তু সম্মতিসূচকভাবে মাথা নোওয়ায়। বিনতা স-কুরার দিকে তাকিয়েও মাথা নোয়ায়, স-কুরাও তার জবাব দেয় মাথা নিচু করে। তারপর বিনতা বিষাণকে জানালার কাছে যেতে ইঙ্গিত করে। বিষাণও খুব বিস্মিত হয়ে জানালার দিকে এগোয়। বিনতা পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ডকটর বিষাণ, আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি। শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, আমি আপনার কথা শুনেছি আপনার একজন নিকট মানুষের কাছ থেকে।”
বিষাণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় বিনতার দিকে।
“অদিতা সান আমাকে আপনার কথা বলেছে।”
“অদিতা সান? অদিতা - বন বিশেষজ্ঞ?” বিস্ময়ের বাধ মানে না বিষাণের।
“হ্যাঁ, ওনার কাছ থেকেই,” সায় দেয় বিনতা।
“অদিতা কোথায় এখন?” প্রশ্ন করে বিষাণ।
জানালার বাইরে গাছের মাঝ দিয়ে বড় রাস্তাটা দেখা যায়। অল্প কিন্তু যথেষ্ঠ আলোয় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে, সাইকেল চালাচ্ছে, এক চাকার বাহনে মনে হয় যেন ভেসে যাচ্ছে। আকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে, তার একটু ওপরেই উজ্জ্বল বৃহস্পতি। আর তার ওপরে তৃতীয়ার চাঁদের ফলা। বিনতা বিষাণের চোখে চোখ রাখে, তারপর ডান হাতটা আলতো করে ওপরে তুলে ঘরের মাঝখানে রাখা নীল বাক্সটার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
অদিতা যে ডামুরিতে ছিল বিষাণ জানত, কিন্তু গত কুড়ি বছর তারা নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ রাখে নি। বাইরের সন্ধ্যার বিষণ্নতায় বিষাণের মনে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকার মাদ্রে দে দিওস নদীর পাড়ে সেই অবিরাম বর্ষার কথা, অদিতার অশ্রুধারার কথা। সেই কান্না বিষাণ শেষ পর্যন্ত আর সইতে পারে নি, অদিতাও বিষাণের মৌনতাকে সহ্য করতে পারে নি। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরে দুজন পৃথিবীর দু প্রান্তে চলে গিয়েছিল।
জানালার বাইরে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকে বিষাণ। তৃতীয়ার চাঁদ কিছুক্ষণ পরেই ডুবে যাবে, তার কাস্তের ফলায় মের ক্রিজিয়ামের কালো সমতল দেখা যাচ্ছে। একশো বছরেরও আগে অদিতা আর বিষাণ চাঁদের মের ক্রিজিয়ামের ধারে এক মানমন্দিরে গিয়েছিল এক সপ্তাহের ছুটি কাটাতে। অদিতা হয়তো গিয়েছিল তার ছোটবেলার চাঁদে ভ্রমণের স্মৃতি রোমন্থন করতে। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের সন্তান, দশ বছরের সৌম্যদর্শন বালক সেনভা। সবই ঠিক ছিল, চাঁদের গহ্বরে ঘুরে বেরানো, কম ওজনে হাইজাম্প দেওয়া, উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকাশে পৃথিবীকে দেখা, ভায়োলিনের বাজনা উপভোগ করা। কিন্তু অদিতা তার ছোটবেলায় চাঁদে একটা বিভীষিকার সাক্ষাৎ পেয়েছিল, সেটা তার মনে ছিল না। চাঁদের দিগন্তে সে কি যেন একটা দেখেছিল। সেই বিভীষিকার কথা বিষাণও জানত না। শুধুমাত্র তখনই সেটা অদিতার মনে পড়ল যখন এক দিন সে দেখল সেনভা চাঁদের পোষাক পরে একা একাই মানমন্দিরের নিচের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। অদিতা বেতারে চিৎকার করে সেনভাকে ডাকল, কিন্তু মনে হয় সেনভা তার সব যোগাযোগের যন্ত্র বন্ধ করে রেখেছিল। অদিতা সঙ্গে সঙ্গেই জরুরী অবস্থায় সাহায্য চাইবার ব্যবস্থাগুলো চালু করেছিল, অনুসন্ধানী রোবটদের দুমিনিটের মধ্যে সেনভাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে সেনভা একটা বড় পাথরের আড়ালে চলে গিয়েছিল। রোবটগুলো সেখানে যেয়ে তাকে আর খুঁজে পায় নি। সেনভার উষ্ণ পদচিহ্নও এক জায়গায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সেনভা যেভাবে হাঁটছিল তাতে অদিতার মনে হয়েছিল সে যেন এক সম্মোহনের মধ্যে আছে। এমন একটা সম্মোহন যা কিনা অদিতা তার ছোটবেলায় অনুভব করেছিল চাঁদের দিগন্তে কিছু একটা দেখে। কি দেখেছিল সে বলতে পারবে না, কিন্তু সে অনুভব করেছিল সেই জিনিসটা তাকে ডাকছে। সেই ডাকে অদিতা সাড়া দেয় নি, সেই ডাকে তার সারা শরীরে কাঁটা দিয়েছিল, সেই ডাকে বিভীষিকার ছাপ ছিল। কিন্তু সেনভা নিজেকে আটকাতে পারে নি, সেনভা সেই ডাকে চাঁদের বায়ুরোধী পোষাক আর হেলমেট পরে বের হয়ে গিয়েছিল চাঁদের ঊষর প্রান্তরে । অন্ততঃ এই ছিল অদিতার বিশ্বাস। এটাই সে বলেছিল মানমন্দিরের লোকজনদের, বিষাণকে। কেউ তার কথা বিশ্বাস করে নি, তবে পুরো চন্দ্রপৃষ্ঠ তন্ন তন্ন করেও সেনভার খোঁজ পাওয়া যায় নি। একটা মানুষ চাঁদের বুক থেকে উধাও হয়ে যাবে সেটাও আবার অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। সেনভা সেই যে হারালো, আর তাকে পাওয়া গেল না।
সেনভার বয়স ছিল তখন দশ। তার আট বছর বয়সের একটি মস্তিষ্কের কপি ছিল। সেই মস্তিষ্ককে একটি নতুন সৃষ্ট দেহতে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। অদিতা ও বিষাণ দুজনেই নতুন সেনভাকে কীভাবে তাদের জীবনে গ্রহণ করবে বুঝে পাচ্ছিল না। এই সেনভার মুখ আদি সেনভার মত দেখতে হলেও তাতে কি যেন একটা খাদ ছিল, নতুন সেনভাও বুঝেছিল তাকে তার বাবা মা পুরোপুরি গ্রহণ করে নি। নতুন সেনভা বিদ্রোহী হল, এমন সব কাজ করতে লাগল যে তার বাবা মাকে পুলিশের, মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিতে হল। অবশেষে তার তেরো বছর হলে তাকে কর্ত্তৃপক্ষ উত্তর আমেরিকার একটা সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দিল। এরপর সেনভার সঙ্গে অদিতা আর বিষাণের কয়েকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু বড় হলে সেনভা তাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করে।
বিষাণ আর অদিতাও একসঙ্গে থাকতে পারে না।
বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে বিষাণ বোঝে এসব কথাই বিনতা জানে। সে বলে, “কীভাবে? অদিতা কীভাবে মারা গেল?”
লেখক পরিচিতি
দীপেন ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।
বিজ্ঞানী। গল্পকার।
মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইন্সটিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিয়ার) গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ১৯৭৫ সালে তিনি বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রকাশিত বই : দিতার ঘড়ি, নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো।
‘এখানে কেউ মরে না,’ বহু বছর আগে ছয় বছরের বিনতাকে তার বাবা একটা ভূগোলক দেখিয়ে বলেছিল। ‘কে মরে তাহলে বাবা?’ জিজ্ঞেস করেছিল বিনতা তার চোখ গোল করে। ‘অন্য প্রাণীরা। তুমি তো হাতি ভালবাস, কিন্তু হাতি আশি বছরের বেশী বাঁচে না।’
সেদিন বিনতা বোঝে নি কেন হাতি এর চেয়ে বেশীদিন বাঁচবে না। সারা পৃথিবী এখন অভয়ারণ্যে ভর্তি, হাতির দল ঘুরছে সারা আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে পুরাতন চীনদেশে। এই ডামুরি অরণ্যেই রয়েছে কত হাতি, আজ তাদেরই একটা বড় দলের ছবি ভেসে ওঠে বিনতার ঘরে। অদিতার দেহের খোঁজে পাঠানো রোবট-হেলিকপ্টার থেকে পাঠানো ভিডিও ত্রিমাত্রিক গঠনে মূর্ত হয়ে ওঠে ঘরের একপাশে। একটা পাহাড়ের ঢালে ছোট একটা জলাশায়, তাকে ঘিরে কয়েকটা গাছ তাদের ডাল আর পাতা প্রায় ডুবিয়ে রেখেছে জলে। আর জলের ধারেই ওপর হয়ে পড়ে আছে অদিতা, তার দেহের প্রায় অর্ধেকটা জলে। বিনতা ডান হাত্টা দিয়ে নাক আর মুখ চেপে একটা অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে। অদিতার দেহের হাজার হাজার ন্যানোরোবট তাকে বাঁচাতে পারে নি। কেন? ভাবে বিনতা। ছোট রোবটগুলোর কাজই তো এই, হৃদযন্ত্রের ধমনীতে ছোটখাটো প্লেক জমলে সেখানে গিয়ে মুহূর্তে তাকে ধ্বংস করে দেবে, শিরা-উপশিরায় রক্ত জমাট বাঁধতে দেবে না, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে সঙ্গেসঙ্গেই সেটাকে বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা থাকবে। তবে বিনতা এটাও জানে মাথার পেছনে হঠাৎ আঘাত পেলে ন্যানো-রোবটদের কাজ করার সুযোগ নেই। অদিতা কি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছিল? পড়তে পড়তে কি তার মাথায় পাথরের ধাক্কা লেগেছে? নাকি তাকে পেছন থেকে কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করেছে? অদিতাকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বিনতার নিজেকে অসহায় মনে হয়।
রোবট-হেলিক্প্টার দুটো জলাশয়ের ওপর কিছুক্ষণ ভাসে, বিনতা একটি রোবটকে বলে পার্শ্ববর্তী জায়গাটা জরীপ করতে আর দ্বিতীয়টিকে বলে অদিতার দেহকে উদ্ধার করতে। দ্বিতীয় রোবটটি নিচে নেমে আসে, সেটার পাশ থেকে প্রায় আটটি লম্বা চোঙার মত নল বেড়িয়ে আসে, প্রতিটি নলের সামনে মানুষের হাতের মত দশটি করে ধাতব আঙুল, তারা খুব আলগোছে অদিতার দেহ তুলে নিয়ে হেলিকপ্টারের নিচে উঠিয়ে নিয়ে আসে। হেলিকপ্টারের নিচের অংশটায় চারটে ত্রিভুজের মত দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে একটা প্ল্যাটফর্ম বের হয়ে আসে, সেখানে খুব যত্ন করে নল-আঙুলগুলো অদিতার দেহটা রেখে দেয়। প্ল্যাটফর্মটা ওপরে উঠে যায়, দরজাগুলো বন্ধ হয়, নলগুলো নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
যতক্ষণ দ্বিতীয় রোবটটি অদিতার দেহকে উদ্ধার করছিল তত্ক্ষণ প্রথম রোবটটি জলাশয়ের গাছগুলো পেরিয়ে তার পাশেই একটি গর্জনগাছের বনের ওপরে উড়তে থাকে। রোবটের অবলোহিত তরঙ্গের প্রতিচ্ছবিতে বিনতা দেখতে পায় জলাশয় থেকে সেই বনে ঢোকার জন্য একটা অস্পষ্ট পায়ে-হাঁটা পথ। পথটা দৃশ্যমান তরঙ্গে দেখতে পাবার কথা নয়, কিন্তু অবলোহিত তরঙ্গের উষ্ণতায় ফুটে ওঠে মাড়ানো ঘাসের মাঝে পদচিহ্ন। সেই পথ দিয়ে কোনো মানুষ কিছুক্ষণ আগেই গিয়েছে, তার পায়ের স্পর্শের তাপ রয়ে গিয়েছে ঘাসের মধ্যে। এই বনে অন্য মানুষের থাকার কথা নয়, কিন্তু অদিতার মৃত্যুতে কি সেই মানুষের হাত রয়েছে?
“চেতনা দিয়ে যে জীবনের অনুভব, তার অবর্তমানে কোনো ধরণের অস্তিত্বের অর্থ নেই। মৃত্যু হল স্বপ্নহীন ঘুম। আমাদের সচেতন জীবন সবসময়ই ধ্বংস হতে থাকে যখন আমাদের ঘুমে স্বপ্ন থাকে না। জন্মের পূর্বে যেমন চেতনা থাকে না, ঘুমের মাঝেও আমরা সেই অবস্থায় বিরাজ করি। স্বপ্ন-ছাড়া ঘুমের মাঝে নিউরনদের মধ্যে সংকেতের আদান-প্রদানের কম্পাঙ্ক খুব কম হয়ে যায়। সেকেন্ডে এক থেকে তিনবার, অথচ যখন আমরা স্বপ্ন দেখি তখন সেই নিউরনগুলি উঁচু কম্পাঙ্কে যদৃচ্ছভাবে কাজ করে। আবার যখন জেগে থাকি তখনও সেভাবে কাজ করে। তাই স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর স্বপ্নবিহীন ঘুম ও মৃত্যুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, প্রতি রাতে ঘুমের সময় আমরা বহুবার মৃত্যুবরণ করি।”
একটা ছিমছাম ঘরে দশটি ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে বিষাণ। পশ্চিমে সূর্যের লাল আলো জানালার কাঁচ পেরিয়ে ঘরে ঢোকে। বিকেলের এই সময়টাতে পড়াতে চায় না বিষাণ, কিন্তু সময়টা ঠিক করা হয়েছে ঐ দশটি ছাত্রর সুবিধা অনুযায়ী। সারা পৃথিবীর বাছাই করা একশটি ছাত্রদের মধ্যে দশটি ছাত্র এই স্কুলে পড়ছে। এদের বয়স চৌদ্দ থেকে ষাট বছর। গত বছর নব্বই বছর বয়সী এক নারী তার ছাত্র ছিল, এই ক্লাসে পড়তে হলে বয়সের কোনো সীমা নেই। প্রায় দশ বছর ধরে এই স্কুলে পড়ায় বিষাণ। লেকচার দিতে দিতে সে ভাবে পৃথিবীতে সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় শিক্ষার ধারণা কবেই উঠে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রূপান্তরিত হয়েছে ছোট ছোট স্কুলে যেখানে সিলেবাস বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শেষ সূর্যের আলোয় আকাশে ধীর গতিতে চলমান বিমানগুলোর দিকে তাকিয়ে বিষাণ ভাবে বিশালগড় শহরটাও কেমন বদলেছে। বহুদূরে, প্রায় ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে পড়ে রয়েছে এক কালের মহানগরী ঢাকা। এখন সেটা জলে নিমজ্জিত, তার উঁচু সব বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখন একটা অগভীর সমুদ্রের নিচে। আর এই বিশালগড়ে এসে নামছে বিমান পৃথিবীর দূর প্রান্ত থেকে। বিমানগুলো এমনভাবে উড়ছে যেন তাদের কোথাও যাবার তাগাদা নেই। সূর্যালোক, ঠাণ্ডা-গরমে বাহিত বাতাস, বায়ুর ঘনত্বের হেরফের, এমন কি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিঃশব্দে আকাশে উড়ছে বিমানগুলো।
বিষাণ স্কুলটির সবচেয়ে ওপরের তলায় - তিন নম্বর তলায় পড়াচ্ছিল। জানালা দিয়ে দেখা যায় স্কুলের একদিকে ঘন শালবন, তার মধ্য দিয়ে একটা সরু হাঁটা পথ। পথটা একটা বড় রাস্তার ধারে শেষ হয়েছে। সেই রাস্তার ঐ পাড়ে এই শহরের সবচেয়ে উঁচু এবং বড় বাড়িটি। মাটির ওপরে পাঁচটি তলা, কিন্তু সবাই জানে মাটির নিচে সেই বাড়ি বিস্তৃত হয়েছে বিশটি তলাতে। সেখানে জমা আছে বিশ মিলিয়ন বা দু কোটি মস্তিষ্ক। সারা পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন দুই বিলিয়ন বা দুশো কোটি। দুশো কোটির কিছু বেশী মস্তিষ্কের প্রতিলিপি সংরক্ষিত আছে পৃথিবীর নানান জায়গায় এরকম দেড়শটি বাড়িতে। পৃথিবীর আর কোথাও নিরাপত্তা এত কড়া নয় যেটা এরকম মস্তিষ্ক সংগ্রাহাগারে থাকে। দূর থেকে কিছু বোঝা যায় না, সাধারণ বাড়িই মনে হয়, ওপরে সবুজ রঙের ঢালু চাতাল, ফুটপাতের পাড়েই একটা লাল দরজা। কিন্তু সেটা সব সময় বন্ধই থাকে। সেই বাড়িতে কিভাবে ঢুকতে হয় বেশীরভাগ লোকই সেটা জানে না। যার ঢোকার অনুমতি আছে তার জন্য লাল দরজাটা নিজে থেকেই খুলে যায়। পৃথিবীর এই অঞ্চলে হয়ত পনেরো থেকে কুড়ি জন লোকের সেখানে ঢোকার অনুমতি আছে, বিষাণ তাদের মধ্যে একজন। লাল দরজাটির পাশে দেয়ালে একটা সবুজ ফলক, তাতে লেখা ‘নিলয়’। পৃথিবীর সমস্ত মস্তিষ্ক সংরাক্ষাণাগারের নাম হল ‘নিলয়’.
বিকেলের শেষ আলোটা দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে, সেটাকে ধরে রাখার জন্যই ঘরে একটা মৃদু লাল আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকে। এই পৃথিবীতে ঘরের আর রাস্তার বাতি হঠাৎ জ্বলে ওঠে না। বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাতের আঁধারে যে রূপান্তর তাকে উজ্জ্বল বিজলীর আলো দিয়ে মানুষ নষ্ট করে দেয় না। তাই বিশালগড়ের মত শহরেও রাতে ফুটে ওঠে ছায়াপথ, শয়ে শয়ে উজ্জ্বল তারা।
বিষাণ বলতে থাকে, “আমরা বহুদূর এসেছি। প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৌশলকে আমরা নরমভাবে সংযুক্ত করতে পেরেছি। পৃথিবীর বুকে বিশাল নির্মাণই যে মানব জাতির সাফল্য সেই ধারণা থেকে আমরা সরে এসেছি। আমরা সৌর জগতের প্রান্তে মানুষ পাঠাতে পেরেছি, কিন্তু আমরা বুঝেছি মহাশূন্যে বসবাস মানুষের জন্য স্বাভাবিক নয়। তাই সেইসব মহাকাশযানে আমাদের পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে নকল করতে হয়েছে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বাঁচতে দেহের মধ্যে ন্যানো রোবটের সাহায্য নিতে হয়েছে যারা কিনা খুব সহজেই আহত কোষকে সারিয়ে বা সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের পক্ষে অন্য গ্রহে বা উপগ্রহে দীর্ঘমেয়াদী উপনিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় নি।
এ’সব বলতে বলতেই বিষাণ অন্যমনা হয়ে যায়, কিন্তু সেটা ছাত্রদের বুঝতে দেয় না। বলে, “আপনারা জানেন এক হাজার বছর আগে শুধুমাত্র একটি মহাকাশযান, আন্টারেস, সৌর জগতের নিকটবর্তী তারাদের মাঝে পৃথিবীর মত গ্রহ খুঁজতে রওনা হয়ে গেছে। সেই যানটিতে প্রায় পাঁচশো মানুষ আছে যারা কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আর সাতশো বছর আগে পৃথিবী থেকে দূর নক্ষত্রের সমস্ত মানুষবাহী যান পাঠানোকে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল, সেই সাময়িক সিদ্ধান্ত এখন প্রায় স্থায়ী হয়েছে।”
মাথা নাড়ায় সবাই। বিষাণ জানে এসব কোনো কিছুই তার ছাত্রদের অজানা নয়। একদম সামনের সাড়িতে বসা ছিল সিলেয়া নামের মেয়েটি। তীক্ষ্ণ চিবুক আর নাক, স্পষ্ট গালের হাড়, উজ্জ্বল খয়েরী চোখ, পেছনে ছড়ানো কালো চুলের সিলেয়া মাঝে মধ্যেই দুটো হাত তুলে তার দশটা আঙুল নাচের মুদ্রায় খোলে আর বন্ধ করে। মনে হয় সে বিষাণর কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে না, কিন্তু বিষাণ জানে তার একটি কথাও সিলেয়ার কানকে ফাঁকি দেয় নি। ফাঁকি যে দেয় নি সেটা সিলেয়ার হঠাৎ কথা বলে ওঠার মধ্যেই প্রমাণ পেল।
“নিষিদ্ধ করাটা ঠিক হয় নি। মানুষ এই গ্যালাক্সিতে আবির্ভূত হয়েছেই অজানাকে জানার জন্য,” সিলেয়ার কথায় দৃঢ়তা থাকে, সেই দৃঢ়তা এমন যে বিষাণকে মুহূর্তখানেকের জন্য সেটা যেন অপ্রস্তুত করে দেয়, বিষাণের হৃদযন্ত্রে একটা তাল বাদ পড়ে, তারপর আবার খুব দ্রুত চলে।
“ঠিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে আমি বলব না, এর মধ্যে দূরপাল্লার শখানেক স্বয়ংক্রিয় যান কাছের নক্ষত্রদের উদ্দেশ্য পাঠানো হয়েছে,” কথাগুলো বলে নিজেকে একটু বোকা লাগে বিষাণের। সিলেয়া এমন একট হাসি মুখ করে থাকে যেন বিষাণ নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে, কিছু বোঝে না। অথচ বিষাণের বয়স একশ পঞ্চাশ ছুঁলে সিলেয়াই এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। শ্যাম্পেনের গ্লাস উঁচু করে বলেছিল, “পৃথিবীর স্মৃতির রক্ষাকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখতে মানুষটির জন্য।” বিষাণের মুখ কেন জানি লাল হয়ে গিয়েছিল সেটা শুনে। লজ্জায় নাকি আনন্দে, অথবা দুটোতেই! কিন্তু সেই আনন্দের সন্ধ্যাতেও বিষাণ সিলেয়াকে এড়িয়ে গিয়েছিল, সেটা কিছুটা ভয়েই। এই মেয়েটি তাকে যেভাবে আকর্ষণ করেছে তার ফল ভাল হতে পারে না সে জানে।
“আর হাজার বছর আগে যে যানটি পাঠানো হয়েছিল সেটি এখন কোথায় আছে?” সিলেয়ার আর একটি প্রশ্নে বিষাণের সম্বিত ফেরে। কোথায় আছে সেটা সিলেয়া ভাল করেই জানে, কারণ আন্টারেসের শেষ বার্তা আসে তিনশো বছর আগে। আন্টারেস তখন ১৪ আলোকবর্ষ দূরের লাল বামন তারা Wolf ১০৬১ পার হচ্ছিল। সেই বার্তা বলে সেখানে অভিযাত্রীরা পৃথিবীর মত কোনো বাসযোগ্য গ্রহের সাক্ষাৎ পায় নি, অথচ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন সেই তারার চারদিকে বেশ কয়েকটি গ্রহ পৃথিবীর মত হতে পারে।
আন্টারেসের ইঞ্জিন ছিল হাইড্রোজেনের। সূর্য তার অভ্যন্তরে কয়েকটা হাইড্রোজেন পরমাণুকে জুড়ে তৈরি করে হিলিয়াম, সেই সঙ্গে সৃষ্টি করে শক্তির। একে বলে ফিউশান। ঠিক সেইভাবে আন্টারেসের ইঞ্জিন ফিউশান ব্যবহার করে আন্তঃনাক্ষত্রিক পথ পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু সেই নাক্ষত্রিক জাহাজের নাবিকদের মস্তিষ্ক কপি করা ছিল না, সেই প্রকৌশল সৃষ্টি হয়ে আন্টারেস পৃথিবী ছেড়ে যাবার কয়েক শ বছর পরে। তাই সেখানে মৃত্যু ছিল। আন্টারাসের নতুন প্রজন্ম কখনো পৃথিবী দেখে নি। পৃথিবীর কাহিনী তারা শুনেছে কিংবদন্তীর মত।
আন্টারেস পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছিলেন মস্তিষ্ককে যথাযথভাবে নকল করবার। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন মস্তিষ্কের সমস্ত তথ্যকে নকল করে কৃত্রিমভাবে সেই তথ্যকে কম্পুটারে বাস্তবায়িত করা যাবে। সেই মস্তিষ্ক হবে ইলেকট্রনিক। কিন্তু আট হাজার ছয়শ কোটি নিউরন, ছিয়াশি লক্ষ কোটি সিন্যাপসকে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা কঠিন, শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জৈবিক আধারেরই সাহায্য নিলেন। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ - গ্লিয়াল ও নিউরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় সংকেতের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুললেন ত্রি-মাত্রিক জৈবিক মস্তিষ্ক।
টেবিলের ওপরে রাখা পাত্লা একটা স্ক্রীন লাল আলোতে জ্বলে ওঠে। সেদিকে বিষাণ তাকালে দেখে একটা লেখা ফুটে উঠেছে, ‘নিলয়ে’ আপনার উপস্থিতি প্রয়োজন। বিষাণ বোঝে ‘নিলয়ে’ নতুন দেহ এসেছে। কিন্তু সেখানে সবসময় যে তার উপস্থিতি প্রয়োজন তা নয়, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে তাকে ডাকা হয়।
“আজকের মত ক্লাস এখানেই শেষ,” বলে বিষাণ, “আমাকে ‘নিলয়ে’ যেতে হবে। তবে কাল যখন আসবেন নতুন একটা সমস্যার সমাধানে আপনাদের আইডিয়াগুলো নিয়ে আসবেন। সমস্যাটা আন্তর্জালে দেয়া আছে - কপি করা মস্তিষ্ক কি আসলেই আদি মানুষটির সত্তা ও চেতনা বহন করে, নাকি সেই কপি নতুন একটি সত্তার জন্ম দেয়? সমস্যাটির সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর একটি প্রশ্ন হল স্বপ্নবিহীন ঘুম থেকে যখন একটি মানুষ জেগে ওঠে সেটি কি সেই মানুষই যে একটু আগে ঘুমাতে গিয়েছিল? শেষের প্রশ্নটি কি প্রথমটির সঙ্গে সম্পর্কিত?”
এটুকু বলে বিষাণ দ্রুত ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়, তারপর একটু আতঙ্কিত হয়েই দেখে সিলেয়াও একই সঙ্গে বের হয়ে এসেছে। “ডকটর বিষাণ, সিলেয়া নামের একটি মানুষ আপনার ক্লাসে গতকাল এসেছিল, একদম সামনের টেবিলে বসেছিল।” বিষাণ প্রথমে বিস্মিত হয়ে সিলেয়ার দিকে তাকালেও সঙ্গে সঙ্গেই বোঝে এটা একটা প্রশ্ন বা রসিকতার ভূমিকা মাত্র। সিলেয়া বিষাণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আর প্রশ্নটি করার উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “এখন আমার মনে হচ্ছে আমি - আজকের সিলেয়া - গতকালের সিলেয়া থেকে একেবারেই ভিন্ন, যেন আর একটা মানুষ। এটা কি সম্ভব? ”
বিষাণ বোঝে সিলেয়া তার সঙ্গে ঠাট্টাই করছে, কিন্তু ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। “সেটা আপনিই আমাকে কাল বলবেন,” একটু ভদ্রতা-রক্ষাকরা হাসি হেসে বিষাণ এগিয়ে যেতে চায়, কিন্তু সিলেয়ার আরো কিছু পরিকল্পনা ছিল। সে জিজ্ঞেস করে, “আপনার সঙ্গে কি আমি ‘নিলয়ে’ যেতে পারি?”
এটা যে একেবারেই সম্ভব নয় সেটা সবাই জানে, তবু বিষাণ সিলেয়াকে কীভাবে এড়াতে পারবে বুঝে পায় না, বলে, “খুবই জরুরী অবস্থা এখন, এই মুহূর্তে তো যাওয়া সম্ভব নয়।” সিলেয়া হেসে চলে যায়, সে বিষাণের সঙ্গে ঠাট্টা করে যেন মজা পায়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে বিষাণ। তেতলা থেকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি ধরে সে নিচে স্কুলের বাগানে ঢোকে, তারপর প্রায় দৌড়েই বাগানটা পার হয়ে একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে সে শালবনে প্রবেশ করে। অন্ধকার হয়ে আসছে, ছোট বনের রাস্তাটার পাশে মৃদু বাতি জ্বলে। শালবনটা শেষ হয়েছে একটা বড় রাস্তায়, বিশালগড়ের প্রধান রাস্তা এটা। একটা কালো রঙে চকচক করে রাস্তাটা, সৌর সেল দিয়ে রাস্তাটা মোড়া, সূর্য থেকে শক্তি আহরণ করে সেই রাস্তা। কিন্তু রাস্তাটা একেবারেই ফাঁকা, দু-একটি চালকবিহীন বড় বাস নিঃশব্দে চলছে, একপাশে সাইকেলের মত একটি বাহনের জন্য নির্ধারিত রাস্তা - সেখানে মানুষেরা নিজ শ্রমে তাদের বাহন চালাচ্ছে, তার পাশেই আর একটি দাগ দেওয়া পথ, সেখানে তারা একটি চাকার ওপর ছোট প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চলছে, তাদের বাহন কোথায় তারা যেতে চায়, কত দ্রুত যেতে চায় এসবই জানে।
রাস্তা পার হতে একটা ছোট সেতু দিয়ে, সেতুটার উচ্চতা বেশী না, এই শহরের কোনো গাড়ির উচ্চতাই তিন মিটারের চেয়ে উঁচু নয়। বিষাণ সেতুটাতে পা দেওয়া মাত্রই নিচে রাখা পথটা চলতে আরম্ভ করে, নিঃশব্দে। ওপাড়ে বিষাণকে নামিয়ে দিয়ে পথটা থেমে যায়। ‘নিলয়ে’ ঢোকার মুখে একটা ছোট কফির দোকান, সেখান থেকে মৃদু বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। এখানে অনেক সময়ই বিষাণ আসে, কিন্তু আজ সময় নেই, নতুন একটি মৃতদেহ এসেছে, তার মধ্যে পুরোনো মস্তিষ্ক বসাতে হবে।
বিষাণ কাছে আসা মাত্র ‘নিলয়ের’ নিচের লাল দরজা খুলে যায়, বাড়িটা তাকে চিনতে পেরেছে। ঢোকা মাত্র একটা চলন্ত সিঁড়ি বিষাণকে দোতলায় নিয়ে আসে। সেখানে একটু খোলা জায়গা, তার একদিকে একটি সুরক্ষিত দরজা, সেটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। ঘরের ভেতরে মৃদু আলোয় বিষাণর জন্য অপেক্ষা করে তিনজন, দুজন নারী ও একটি যান্ত্রিক রোবট। এদের দুজনকে খুব ভাল করে চেনে বিষাণ - নিলয়ের প্রধান ডকটর তারকার আর প্রধান সার্জন আর প্রকৌশলী স-কুরা। স-কুরা হল একটি মানুষরূপী রোবট যে কিনা নিজেকে মানুষ বলে দাবি করে। সে আরো দাবি করে যে তার আত্ম-উপলব্ধি আছে, কিন্তু তার আশেপাশের মানুষরা এই ব্যাপারে কখনই নিশ্চিত হতে পারে নি। স-কুরার মুখ দেখে সহজে বোঝা যাবে না সে নারী কিংবা পুরুষ, এক্ষেত্রে তার বক্তব্য হল সে একজন পুরুষ। ঘরের মাঝখানে ছিল মানুষ-প্রমাণ একটা নীল রঙের বাক্স। বিষাণ জানে সেই বাক্স কী আছে।
ডকটর তারকারের বয়স বিষাণর মতনই, একগুচ্ছ না-আঁচড়ানো সোনালী চুল এলোমেলোভাবে মুখটাকে ঘিরে আছে। সে দাঁড়ানো আর একজন নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয়, “ইনি ডকটর বিনতা। ডামুরি অভয়ারণ্যের মানুষজনদের দেখাশোনা করেন।” বিনতা মাথা নিচু করে সম্ভাষণ করে, বিষাণও করে। “আমার থেকে বয়সে ছোটই হবে বিনতা,” ভাবে বিষাণ। বিনতা বিষাণকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ডকটর বিষাণ, আপনি আমাকে চিনবেন না, কিন্তু আপনাকে আমি এখানে কাজের আগে দুটো কথা বলতে চাই যদি ডকটর তারকার আমাকে একটু সময় দেন।” তারকার আশ্চর্য হয়, কিন্তু সম্মতিসূচকভাবে মাথা নোওয়ায়। বিনতা স-কুরার দিকে তাকিয়েও মাথা নোয়ায়, স-কুরাও তার জবাব দেয় মাথা নিচু করে। তারপর বিনতা বিষাণকে জানালার কাছে যেতে ইঙ্গিত করে। বিষাণও খুব বিস্মিত হয়ে জানালার দিকে এগোয়। বিনতা পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ডকটর বিষাণ, আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি। শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, আমি আপনার কথা শুনেছি আপনার একজন নিকট মানুষের কাছ থেকে।”
বিষাণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় বিনতার দিকে।
“অদিতা সান আমাকে আপনার কথা বলেছে।”
“অদিতা সান? অদিতা - বন বিশেষজ্ঞ?” বিস্ময়ের বাধ মানে না বিষাণের।
“হ্যাঁ, ওনার কাছ থেকেই,” সায় দেয় বিনতা।
“অদিতা কোথায় এখন?” প্রশ্ন করে বিষাণ।
জানালার বাইরে গাছের মাঝ দিয়ে বড় রাস্তাটা দেখা যায়। অল্প কিন্তু যথেষ্ঠ আলোয় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে, সাইকেল চালাচ্ছে, এক চাকার বাহনে মনে হয় যেন ভেসে যাচ্ছে। আকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে, তার একটু ওপরেই উজ্জ্বল বৃহস্পতি। আর তার ওপরে তৃতীয়ার চাঁদের ফলা। বিনতা বিষাণের চোখে চোখ রাখে, তারপর ডান হাতটা আলতো করে ওপরে তুলে ঘরের মাঝখানে রাখা নীল বাক্সটার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
অদিতা যে ডামুরিতে ছিল বিষাণ জানত, কিন্তু গত কুড়ি বছর তারা নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ রাখে নি। বাইরের সন্ধ্যার বিষণ্নতায় বিষাণের মনে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকার মাদ্রে দে দিওস নদীর পাড়ে সেই অবিরাম বর্ষার কথা, অদিতার অশ্রুধারার কথা। সেই কান্না বিষাণ শেষ পর্যন্ত আর সইতে পারে নি, অদিতাও বিষাণের মৌনতাকে সহ্য করতে পারে নি। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরে দুজন পৃথিবীর দু প্রান্তে চলে গিয়েছিল।
জানালার বাইরে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকে বিষাণ। তৃতীয়ার চাঁদ কিছুক্ষণ পরেই ডুবে যাবে, তার কাস্তের ফলায় মের ক্রিজিয়ামের কালো সমতল দেখা যাচ্ছে। একশো বছরেরও আগে অদিতা আর বিষাণ চাঁদের মের ক্রিজিয়ামের ধারে এক মানমন্দিরে গিয়েছিল এক সপ্তাহের ছুটি কাটাতে। অদিতা হয়তো গিয়েছিল তার ছোটবেলার চাঁদে ভ্রমণের স্মৃতি রোমন্থন করতে। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের সন্তান, দশ বছরের সৌম্যদর্শন বালক সেনভা। সবই ঠিক ছিল, চাঁদের গহ্বরে ঘুরে বেরানো, কম ওজনে হাইজাম্প দেওয়া, উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকাশে পৃথিবীকে দেখা, ভায়োলিনের বাজনা উপভোগ করা। কিন্তু অদিতা তার ছোটবেলায় চাঁদে একটা বিভীষিকার সাক্ষাৎ পেয়েছিল, সেটা তার মনে ছিল না। চাঁদের দিগন্তে সে কি যেন একটা দেখেছিল। সেই বিভীষিকার কথা বিষাণও জানত না। শুধুমাত্র তখনই সেটা অদিতার মনে পড়ল যখন এক দিন সে দেখল সেনভা চাঁদের পোষাক পরে একা একাই মানমন্দিরের নিচের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। অদিতা বেতারে চিৎকার করে সেনভাকে ডাকল, কিন্তু মনে হয় সেনভা তার সব যোগাযোগের যন্ত্র বন্ধ করে রেখেছিল। অদিতা সঙ্গে সঙ্গেই জরুরী অবস্থায় সাহায্য চাইবার ব্যবস্থাগুলো চালু করেছিল, অনুসন্ধানী রোবটদের দুমিনিটের মধ্যে সেনভাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে সেনভা একটা বড় পাথরের আড়ালে চলে গিয়েছিল। রোবটগুলো সেখানে যেয়ে তাকে আর খুঁজে পায় নি। সেনভার উষ্ণ পদচিহ্নও এক জায়গায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সেনভা যেভাবে হাঁটছিল তাতে অদিতার মনে হয়েছিল সে যেন এক সম্মোহনের মধ্যে আছে। এমন একটা সম্মোহন যা কিনা অদিতা তার ছোটবেলায় অনুভব করেছিল চাঁদের দিগন্তে কিছু একটা দেখে। কি দেখেছিল সে বলতে পারবে না, কিন্তু সে অনুভব করেছিল সেই জিনিসটা তাকে ডাকছে। সেই ডাকে অদিতা সাড়া দেয় নি, সেই ডাকে তার সারা শরীরে কাঁটা দিয়েছিল, সেই ডাকে বিভীষিকার ছাপ ছিল। কিন্তু সেনভা নিজেকে আটকাতে পারে নি, সেনভা সেই ডাকে চাঁদের বায়ুরোধী পোষাক আর হেলমেট পরে বের হয়ে গিয়েছিল চাঁদের ঊষর প্রান্তরে । অন্ততঃ এই ছিল অদিতার বিশ্বাস। এটাই সে বলেছিল মানমন্দিরের লোকজনদের, বিষাণকে। কেউ তার কথা বিশ্বাস করে নি, তবে পুরো চন্দ্রপৃষ্ঠ তন্ন তন্ন করেও সেনভার খোঁজ পাওয়া যায় নি। একটা মানুষ চাঁদের বুক থেকে উধাও হয়ে যাবে সেটাও আবার অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। সেনভা সেই যে হারালো, আর তাকে পাওয়া গেল না।
সেনভার বয়স ছিল তখন দশ। তার আট বছর বয়সের একটি মস্তিষ্কের কপি ছিল। সেই মস্তিষ্ককে একটি নতুন সৃষ্ট দেহতে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। অদিতা ও বিষাণ দুজনেই নতুন সেনভাকে কীভাবে তাদের জীবনে গ্রহণ করবে বুঝে পাচ্ছিল না। এই সেনভার মুখ আদি সেনভার মত দেখতে হলেও তাতে কি যেন একটা খাদ ছিল, নতুন সেনভাও বুঝেছিল তাকে তার বাবা মা পুরোপুরি গ্রহণ করে নি। নতুন সেনভা বিদ্রোহী হল, এমন সব কাজ করতে লাগল যে তার বাবা মাকে পুলিশের, মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিতে হল। অবশেষে তার তেরো বছর হলে তাকে কর্ত্তৃপক্ষ উত্তর আমেরিকার একটা সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দিল। এরপর সেনভার সঙ্গে অদিতা আর বিষাণের কয়েকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু বড় হলে সেনভা তাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করে।
বিষাণ আর অদিতাও একসঙ্গে থাকতে পারে না।
বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে বিষাণ বোঝে এসব কথাই বিনতা জানে। সে বলে, “কীভাবে? অদিতা কীভাবে মারা গেল?”
(চলবে)
দীপেন ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।
বিজ্ঞানী। গল্পকার।
মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইন্সটিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিয়ার) গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ১৯৭৫ সালে তিনি বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রকাশিত বই : দিতার ঘড়ি, নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো।
0 মন্তব্যসমূহ