মূলঃ কেট চপিন
অনুবাদঃ
ফজল হাসান
মিসেস ম্যালার্ডের হৃদপিন্ডের সমস্যার কথা জানা ছিল । তাই অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে তার স্বামীর মৃত্যুর দুঃসংবাদটা তাকে দেওয়া হয়েছিল ।
মিসেস ম্যালার্ডের বোন জোসেফিন চারপাশের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে লুকোচুরির মতো করে সংবাদটা দিয়েছিল । সে তার স্বামীর বন্ধু রিচার্ডসের পাশেই ছিল । রিচার্ডস্ই খবরের কাগজের অফিসে রেলের মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় নিহতদের তালিকায় বেন্টলি ম্যালার্ডের নাম দেখেছে । পরবর্তীতে সে দ্বিতীয় তারবার্তায় পুনরায় বেন্টলির নাম দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে । তারপর সে এই দুঃসংবাদটা বহন করে নিয়ে এসেছে ।
অন্য নারীদের মতো জোসেফিন দূর্ঘটনার খবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না । কিন্তু যখন সে প্রথম শোনে, তখনই বোনের বাহুর ওপর নেতিয়ে পড়ে এবং আহাজারি শুরু করে । একসময় কান্নাটা থিতিয়ে এলে সে একাকী তার ঘরে চলে যায় । তখন তাকে অনুসরণ করার মতো সেখানে কেউ ছিল না।
ঘরের ভেতর খোলা জানালার দিকে মুখ করে ছিল একটা আরাম কেদারা । সেই আরাম কেদারায় সে মানসিক ভাবে পর্যুদস্ত এবং ক্লান্ত-অবসন্ন ভারী দেহটাকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয় ।
জানালা গলিয়ে সে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে ধরে । বাড়ির সামনের খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ-গাছালির চূড়া যেন বসন্তের মাতাল সমীরণে লুটোপুটি খাচ্ছিল । চারপাশের বাতাসে তখনো বৃষ্টির ভেজা সোঁদা গন্ধ আপনমনে ভেসে বেড়াচ্ছিল । নিচের রাস্তায় দ্রব্য-সামগ্রী নিয়ে ফেরিওয়ালা তারস্বরে হাঁক দিচ্ছিল । দূর থেকে তার কানে ভেসে আসছিল কারোর কন্ঠের হালকা সঙ্গীতের মূর্চ্ছণা । বাইরের চতুর্দিক অসংখ্য চড়ুই পাখির কিরমিচির শব্দে মুখরিত । এছাড়া তখন জানালার পশ্চিম দিকে স্তরে স্তরে সাজানো ভাসমান মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নীল আকাশ মাঝেমাঝে উঁকিঝুকি দিচ্ছিল ।
সে আরাম কেদায়ার কুশনে মাথা এলিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ অসাড় হয়ে বসে থাকে । একসময় তার কন্ঠনালী বেয়ে ফোঁপানির মতো একটা হেঁচকি ওপরের দিকে উঠে আসে । তার শরীর এমন ভাবে নড়ে ওঠে, যেন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া কোন শিশু স্বপ্নের ভেতর কাঁদছে ।
সে ছিল কমবয়সী, সুশ্রী এবং শান্ত চেহারার । নিজেকে সংযত রাখার আলামত তার মুখমন্ডলে ছিল, এমনকি সেখানে একধরনের মানসিক শক্তি উপস্থিত ছিল । কিন্তু তখন তার চোখে ছিল বিষাদের মলিন ছায়া এবং তার নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ছিল মলিন আকাশের হালকা প্রলেপ । কিন্তু এটা কোন তাৎক্ষণিক প্রতিফলন ছিল না, বরং তাতে একধরনের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা-ভাবনার দোলাচলে ছিল ।
একটা কিছু তার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং সে আতঙ্কের ভেতর আগন্তুকের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেটা কী ছিল ? সে জানতো না । তবে সেটা ছিল ইন্দ্রয়ের অগোচর এবং বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া অনুভূতি, যা রীতিমত বর্ণনাতীত। কিন্তু সে তা অনুভব করতে পেরেছিল এবং সেটা ছিল আকাশের বুক চিড়ে তার দিকে ভেসে আসা কিছু শব্দ, কিছু ঘ্রাণ, কিছু রঙ, যা চারপাশের হাওয়া ভরে দিয়েছিল ।
তার বুক স্ফীত হয়ে ওঠে এবং সে সারা শরীরে একধরনের উত্তেজনা অনুভব করে । শুরুতে সে আগন্তুককে বুঝতে চেষ্টা করছিল । তারপর সে তার প্রবল ইচ্ছেশক্তি দিয়ে সেটা প্রতিহত করতে চেয়েছিল । কিন্তু সে ছিল অসাড় হাতের মতো শক্তিহীন । একসময় সে যখন হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে এল, তখন তার ঠোঁটের কিঞ্চিৎ ফাঁক গলিয়ে হালকা কন্ঠস্বর বেরিয়ে আসে । প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সে বারংবার উচ্চারণ করে, ‘মুক্ত, মুক্ত, মুক্ত !’ তার দৃষ্টি ফাঁকা এবং তার চোখেমুখে যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল, তা নিমিষেই উবে যায় । ক্রমশ তার চোখ দু’টিতে প্রশান্তি আর স্নিগ্ধতা নেমে আসে এবং উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । তার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি বেড়ে যায় এবং ক্রমশ শরীরের রক্তকণা উষ্ণ হতে থাকে । একসময় তার দেহের প্রতিটি অংশ শিথীল হয়ে আসে ।
সে নিজেকে প্রশ্ন করতে ভোলেনি, তাকে যে আনন্দ মোহবিষ্ট করে রেখেছে তা দানবীয় আনন্দ কিনা । একটা স্বচ্ছ এবং উত্তেজিত অনুভূতি তার এই ধারণাকে নিতান্ত সাধারণ এবং তুচ্ছ ভেবে খারিজ করে দেয় । সে জানতো এধরনের শবদেহের, যার গুটিয়ে রাখা নরম মরা হাত, সেই মুখ যা কখনই তাকে ভালোবাসা দিয়ে রক্ষা করেনি, অসাড় এবং ধূসর, দেখার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সে আহাজারি করবে । কিন্তু সে দেখতে পেল যে, সেই তিক্ত সময়কে অতিক্রান্ত করে কয়েক বছরের একটা দীর্ঘ মিছিল তার দিকে এগিয়ে আসছে, যা পুরোপুরি ছিল তার নিজস্ব, একান্ত আপন । এবং সে তার দু’হাত প্রসারিত করে সেই দীর্ঘ মিছিলকে স্বাগত জানায় ।
আগামী বছরগুলোতে অন্য কারোর জন্য তাকে বেঁচে থাকতে হবে না এবং সে শুধু নিজের জন্য বেঁচে থাকবে । অন্য কোন প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তি, যা দিয়ে একজন পুরুষ বা নারী তার নিজের বাসনাকে সহযোগী অন্য কোন সৃষ্ট জীবের ওপর আরোপ করতে পারে না, তাকে আর অন্ধ ভাবে মোহন জালে আটকে রাখতে পারবে না । সেই ক্ষণিক আলোকিত মুহূর্তে বিষয়টি সে যেভাবে মূল্যায়ন করেছে, তাহলো একধরনের বিশেষ উদ্দেশ্য কিংবা কোন নিষ্ঠুর অভিপ্রায়, যা দন্ডণীয় অপরাধ থেকে নেহাত কম নয় ।
তথাপি সে তাকে ভালোবাসতো এবং এবং তাদের মধ্যে কখনো কখনো ভালোবাসা গভীর ছিল, আবার মাঝে মাঝে ছিল না । এখন তাতে কী যায়-আসে ? হঠাৎ সে উপলব্ধি করেছে যে, আত্মপরিশুদ্ধির সময় সেই ভালোবাসাকে, যা একধরনের অসমাপ্ত রহস্য, মনে করে কী এমন লাভ হবে ।
‘মুক্ত, দেহ এবং আত্মা !’ সে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে ।
বন্ধ দরোজার কাছে জোসেফিন হাঁটু গেড়ে বসে । ভেতরে ঢোকার অনুমতির জন্য সে তালার ফুটোয় ঠোঁট রেখে কাকুতি-মিনতি করে বলে, ‘লুইস, দরোজা খোলো । পায়ে পড়ি, দরোজা খোলো । তুমি স্বেচ্ছায় নিজেকে অসু্স্থ করে তুলছো । তুমি কী করছো, লুইস ? ঈশ্বরের দোহাই লাগে, দরোজা খোলো।’
‘এখন যাও । আমি নিজেকে অসু্স্থ করে তুলছি না ।’
না; খোলা জানালা দিয়ে সে জীবনসুধা পান করছিল । তখন তার কল্পনা অনাগত সময়ের দিকে দোঁড়াচ্ছিল । বসন্তের দিন এবং গরমের দিন, এমনকি সব ধরনের দিন শুধু তার একান্ত নিজের হবে । চটজলদি সে প্রার্থনা করে, তার জীবন যেন প্রলম্বিত হয় । মাত্র গতকালই সে আতঙ্কের সঙ্গে ভেবেছে যে, জীবনটা হয়তো দীর্ঘ হবে ।
একসময় লুইস উঠে দাঁড়ায় । অবশেষে সে বোনের নাছোরবান্দা কাকুতি-মিনতির সাড়া দিয়ে দরোজা খুলে দেয় । তার চোখে বিজয়ের ঐশ্বরিক উজ্জ্বল দ্যুতি । সে তার বোনের কোমড় জড়িয়ে ধরে এবং তারপর দু’জনে মিলে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে । তাদের জন্য রিচার্ডস্ নিচেই অপেক্ষা করছিল ।
কেউ একজন চাবি দিয়ে সামনের সদর দরোজা খুলছে । দরোজা খুলে যিনি ভেতরে প্রবেশ করেন, তার নাম বেন্টলি ম্যালার্ড । তার চোখেমুখে ক্লান্তির ছায়া, হাতে ভ্রমণের থলি এবং ছাতা । সে দূর্ঘটনার জায়গা থেকে অনেক দূরে ছিল এবং এধরনের রেল দূর্ঘটনার খবরও জানতো না । জোসেফিনের মরা কান্না শুনে সে রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়ায় । চটজলদি রিচার্ডস্ সামনে এসে দাঁড়ানোর জন্য সে তার স্ত্রীকে দেখতে পায়নি ।
ডাক্তার এসে বললো, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সে মৃত্যুবরণ করেছে – আনন্দই তাকে পরলোকে নিয়ে গেছে ।
0 মন্তব্যসমূহ