মূল গল্প : ইতালো কালভিনো
ভাষান্তর:- বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য
ভাষান্তর:- বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য
(এটাকে 'ভাষান্তর' না বলে 'ভাবান্তর' বলাই শ্রেয়। গল্পের মূল সুরটুকু এক রেখে বাকিটা বদলে দেওয়া হয়েছে।)
হাতদুটোকে মুখের কাছে জড়ো করে চোঙা বানিয়ে নিয়ে উপরতলার ফ্ল্যাটটি লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম প্রাণপণে- ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!
দুপুরের রোদের আলোয় আমার এবড়োখেবড়ো ছায়াটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পায়ের সামনে এসে একদম পোষা খরগোশ হয়ে পড়ে রইল।
পাশ দিয়ে একজন চলে যাচ্ছিল। বয়স বোধহয় বিয়াল্লিশ। পেতে চুল আঁচড়ানো। হাতের বাজারের ব্যাগ থেকে দুপুরের বাজার চষে পাওয়া শুকনো পুঁইডাঁটা মাথা বের করে আছে। আমি আবার চেঁচালাম- ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন! কেউ সাড়া দিল না।
লোকটি মাঝপথে থেমে গেল। আমার কাছে এসে বলল, একটা কথা বলব? আরেকটু জোরে চেষ্টা করুন না! নইলে যে ভদ্রমহিলাকে আপনি ডাকছেন, তিনি তো শুনতেই পাবেন না! কত উঁচুতে থাকেন উনি! ডাকটা ঠিকভাবে পৌঁছনোর জন্যও তো একটা ন্যূনতম তীব্রতা চাই! আচ্ছা একটা কাজ করি বরং। আমরা দুজনে মিলে চেষ্টা করি। একসঙ্গে ডাকলে ব্যাপারটা আরও জোরালো হবে। আমি ‘তিন’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠবেন, কেমন?
ব্যাগটা কোথাও রেখে দিন না ! এইভাবে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ডাকবেন? আমি বললাম।
তাতে কী! আমি তো আর মারপিট করছি না! শুধু ডাকব। চলুন, শুরু করি!
আমি রাজি হলাম।
লোকটি গুনতে আরম্ভ করল- এক, দুই তিন…দুজনে চেঁচালাম এবার- ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!
একটা লোক বেল বাজাতে বাজাতে আমাদের পেছন দিয়ে সাইকেল নিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল। উপরের ফ্ল্যাট থেকে কেউ সাড়া দিল না।
কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে সেই সময় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। কারওর হাতে ব্যাট, কারওর হাতে উইকেট, কারওর হাতে বল। কোথাও ম্যাচ খেলতে যাবে। দুজন অপরিচিত মানুষকে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে এইভাবে চিৎকার করতে দেখে অনিবার্য কৌতূহল নিয়ে সটান এগিয়ে এল তারা। বলল, কী ব্যাপার কাকু?!
আমরা বললাম।
সব শুনে ওরা বলল- চলুন, আমরাও ডাকি! গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে। আমাদেরও তো দরকার! সবাই মিলে ডাকলে তিনি উপেক্ষা করতে পারবেন না কিছুতেই। যে মানুষটি আগেরবার ‘এক, দুই, তিন’ বলেছিল, এবারও সে তাই করল। সূর্য এতক্ষণ মাথার একদম উপর উপর ছিল। এবার অল্প হেলে পড়ল। দূরের একটা বাড়ির চালে ডাব পড়ার শব্দ শোনা গেল স্পষ্ট। আমরা সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে শরীর এবং মনের সমস্ত শক্তি কন্ঠস্বরে একজোট করে নিয়ে গলা মেলালাম- ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!
এবারও কোনও সাড়া এল না।
জেদ বেড়ে গেল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঠিক ওইভাবেই আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ডেকে যাচ্ছিলাম কয়েক মুহুর্ত অন্তর। ওই রাস্তা দিয়ে যারা আসছিল, তারা-ই যোগ দিচ্ছিল আমাদের সঙ্গে। বেলুনওয়ালা এল, ফুচকাওয়ালা এল, দুজন গাঁজাখোর এল- একবার করে টেনে তিনবার করে ডাকছে, পার্টির পতাকা নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন- তারাও যোগ দিল। একটি মৌচাকের কায়দায় খুব সন্তর্পণে বেড়ে উঠছিল দলটি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে অনেক লোক জমে গেল রাস্তায়। প্রতি মুহুর্তেই নতুন কোনও মানুষ যোগ দিচ্ছে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে দুপুর আস্তে আস্তে বিকেলের দিকে চলে যাচ্ছিল। উপরের ফ্ল্যাট থেকে এখনও কেউ সাড়া দেয়নি। বাজারের ব্যাগটা ভিড়ের চাপে একদম মুছে গিয়েছে।
একসঙ্গে সবার ডেকে ওঠার ব্যাপারটা একটু জটিল। নিয়মিত অভ্যাস না থাকলে এদিক ওদিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এক্ষেত্রেও হচ্ছিল তাই। কেউ হয়তো অত্যন্ত উত্তেজিত, ‘দুই’ গুনতে না গুনতেই ডেকে দিচ্ছে। সেই ডাকের তোড়েই ভুল করে হঠাৎ ডেকে উঠছে আরও তিন-চারজন। ‘তিন’ গুনলে ডাকছে বাকিরা। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ আবার ‘তিন’ গোনার পরেও গলার আওয়াজ ধরে রাখছে খুব মনোযোগ দিয়ে। সম্ভবত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের লোক। ঘটনা হল, এত ঘেঁটে যাওয়ার পরেও শেষমেশ যে আওয়াজটা তৈরি হচ্ছিল, তা ঠিক ততোটাও খারাপ নয়। দুটো ডাকের মধ্যের বিরতিতে আমরা এক সময় সিদ্ধান্তে আসলাম যে, ‘ম্যাডাম’-কে উচ্চারণ করতে হবে উঁচু এবং দীর্ঘ লয়ে, ‘একটা’-হবে নিচু এবং সংক্ষিপ্ত আর ‘চাকরি দেবেন’ হবে উঁচু এবং সংক্ষিপ্ত। সবাই মোটামুটি একমত হল, এইভাবে ডাকা গেলে খুব তাড়াতাড়ি সফল হওয়া যাবে। আমরা ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিছু নতুন লোক এরমধ্যে জুটে গেল।
হিসাবনুযায়ী গলা মেলানো হল। ফল মিলল এবার। আওয়াজটা বেশ জোরালো হচ্ছে। এই রকম আওয়াজ আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। ‘কোথাও কিছু একটা ভাল হবেই’-এর আশ্বাস নিয়ে খুলির ভিতর তৈরি করতে থাকে বৌদ্ধিক জমি।
ডাক নিয়ে যা যা ঝামেলা ছিল, তা যখন প্রায় মিটিয়ে ফেলা হয়েছে, তখন একজন কথা বলে উঠলো ভিড়ের মধ্যে থেকে। লোকটির মুখ আমি দেখতে পেলাম না। গলাটা খনখনে। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি নিশ্চিত যে, এই বাড়িতেই ম্যাডাম আছে?
আমি বললাম, না।
তাহলে তো চাপ! উনি কি আপনাকে চাকরি দেবেন বলে কখনও কথা দিয়েছিলেন? আরেকজন বলল।
না। একদমই না। আমি বললাম।
আচ্ছা। বুঝেছি। উনি খুবই ক্ষমতাবান একজন মহিলা। কোনও কোম্পানির মালিক বা ওইধরনের কিছু। আপনার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। কিন্তু পাশ করেননি। তাই ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ডাকছেন। বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসেছিল যে লোকটি সে বলল।
না না। ওরকম কিছু নয়। আমি বললাম।
মাফ করবেন। তবে একটি কথা এক্ষেত্রে না জিজ্ঞাসা করে পারছি না। এই বাড়িটিতে কি কোনও বড়ো নেত্রী থাকেন? খনখনে গলার মানুষটি প্রশ্ন করল।
আমি জানি না। ফ্ল্যাটটিতে কেউ থাকে কিনা তাও জানি না আসলে। আমি বললাম।
কথাটি হতাশার জন্ম দিল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে উসখুস করতে আরম্ভ করল লোকজন।
“সেক্ষেত্রে একটু বোঝাবেন দাদা, মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন থেকে আপনি এভাবে “ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!”, “ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!” বলে চিৎকার করছেন কেন”? নতুন আরেকটা গলা এবার প্রশ্ন করল। এই ধরনের কন্ঠস্বরের মানুষদের দাঁতটা সাধারণত উঁচু হয়।
“আমরা অন্য কিছু বলেও সম্বোধন করতে পারি। কিংবা, এইভাবেই ডাকতে পারি অন্য কোথাও গিয়ে। আমার কোনও সমস্যা নেই”। আমি বললাম।
জনগণ আবার বিরক্ত হল।
“ইয়ার্কি করছেন নাকি আপনি আমাদের সঙ্গে”? সেই কোঁচকানো চামড়ার গালের মালিক প্রশ্ন করল।
ধুর! না না! কী যে বলেন! লজ্জিতভাবে বললাম আমি। এদিক ওদিক মাথা ঘোরালাম সমর্থনের আশায়। কাউকে পেলাম না। সবাই মৌন।
ভদ্রগোছের একটি কন্ঠস্বর এবার বলল, যাক গে! যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে! এতক্ষণ ধরে যখন ডেকেই গেলাম, তখন শেষবারের মতো আরেকবার ডেকে দেখাই যাক না কী হয়!
আমরা আবার চেঁচালাম। “ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!” এবার আওয়াজ প্রায় শোনাই গেল না! ভিড়ের অনেকেই ডাকেনি। কয়েকজন মাথা নাড়তে নাড়তে চলেও গিয়েছে এরমধ্যে।
যে যার নিজের রাস্তা ধরল আবার। কেউ এদিকে, কেউ ওদিকে। আমিও আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকলাম ফুটপাথ দিয়ে। মোড়ের মাথায় পৌঁছে বাঁক নেবো, এমন সময় একটা কন্ঠস্বর কানে এলো। তীব্র একটা কন্ঠস্বর। “ম্যাডাম, একটা চাকরি দেবেন!”
বুঝলাম, কেউ একজন থেকে গিয়েছে ওখানে। কেউ কেউ যেমন থেকে যায়। ডেকে চলেছে একভাবে। আর কেউ নেই! কিছু নেই! তবু সে ডেকে চলেছে! এইভাবেই ডেকে চলবেও। খুব জেদি, খুব একগুঁয়ে একজন…
5 মন্তব্যসমূহ
অনুবাদ স্বচ্ছ। গল্পটি মুগ্ধ করেছে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ, অমরদা।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল ।
উত্তরমুছুনএই গল্পটির ভাষান্তর/ ভাবান্তর ব্যবহার করতে চাই। আপনার সাথে ইমেইলে যোগাযোগের কি সুযোগ আছে?
উত্তরমুছুনমূল গল্পটার নাম বলবেন দয়া করে।
উত্তরমুছুন