পেনিলোপ

মূলঃ ডাল্টন ট্রেভিস্যান

অনুবাদঃ ফজল হাসান


রাস্তার পাশের বাড়িতে এক বুড়ো দম্পতি বাস করতো । মহিলা বারান্দার দোলনা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থেকে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতো । লোকটি গেইটের কাছে এলে মহিলা হাতের সেলাইয়ের জিনিসপাতি ঝুড়িতে রেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেত । লোকটি ছোট্ট বাগান পেরিয়ে বারান্দায় আসতো । তারপর সে দরোজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতো । কিন্তু ঘরে ঢোকার আগে সে চোখের পাতা বন্ধ করে স্ত্রীর ঠোঁটে আদর করতো ।


সব সময় তারা একসঙ্গে সবজির বাগানে কাজে ব্যস্ত থেকেছে । লোকটি আগাছা কেটে পরিস্কার করতো এবং মহিলা এক টুকরো জমিতে লতানো গাছের পরিচর্যা করতো । রান্নাঘরের জানালার ফাঁক গলিয়ে প্রতিবেশিরা দেখতো যে, খাওয়া-দাওয়ার শেষে লোকটি ময়লা থালাবাসন ধুয়েমুছে স্ত্রীকে সাহায্য করছে । প্রতি শনিবার তারা একসঙ্গে হাঁটতে বের হতো । মহিলার দেহের গড়ন স্থূল এবং চোখের মনি নীল । অন্যদিকে লোকটি হালকা-পাতলা এবং তার পড়নে থাকতো কালো পোশাক । গ্রীষ্মকালে মহিলা মান্ধাতা আমলের সাদা ড্রেস পড়তো, কিন্তু তখনও লোকটির গায়ে থাকতো কালো পোশাক । তাদের জীবন ছিল অস্পষ্ট, রহস্যময় । ধোঁয়াশা ভাবে জানা যায় যে, অনেক বছর আগে সন্তানদের মৃত্যর পর তাদের জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা । বাড়িঘর, সন্তানদের কবর এবং পোষা প্রানীদের ছেড়ে দু’জনে কুরিটিবাতে গিয়ে বসতী গড়ে তোলে ।

কুরিটিবাতে তারা শুধু দু’জন । কোন কুকুর নেই, কোন বিড়াল নেই, নেই কোন পাখি । লোকটি যখন কাজে বাইরে যেত, তখনরাস্তার নেড়ী কুকুরের জন্য মহিলা মাঝেমাঝে হাঁড় নিয়ে গেইটের কাছে যেত। কুকুর হাঁড়ের গন্ধ শুঁকতো । সে যদি কোন মুরগী পুষতো এবং মুরগীকে খাইয়ে-দাইয়ে স্বাস্থ্যবান করতো, তাহলে তার মন কোমল হয়ে যেত এবং নিজেদের খাওয়ার জন্য কখনই জবেহ্ করতে পারতো না । লোকটি মোরগ-মুরগী খোয়া ভেঙে দিয়ে সেখানে ক্যাকটাস লাগিয়েছে ।

শনিবার ছাড়া মহিলা এবং লোকটি কখনই বাড়ির বাইরে যেত না । বারন্দায় বসে লোকটি সিগারেটের পাইপ টানতো এবং মহিলা উল এবং উলের কাটা নিয়ে সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকতো । একদিন বাইরে থেকে ফিরে এসে দরোজা খোলার পরপরই তারা পায়ের কাছে মেঝেতে একটা এনভেলাপ দেখতে পায় । অথচ কেউ কোনদিন তাদের চিঠি লিখেনি, এমনকি বিশ্বের তাবত আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবও না । নীল খামের ওপর কারোর নাম-ঠিকানা নেই । উটকো সমস্যা এবং আরো বেশি দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার ভয়ে মহিলা চিঠি পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছে । লোকটি স্বান্তনা দিয়ে বলেছে যে, কেউ তাদের কোন ক্ষতি করবে না ।

লোকটি চিঠি পোড়ায়নি, এমনকি সে চিঠি খোলেও দেখেনি । টেবিলের ওপর চিঠিটা অযত্বনে অনেকদিন পড়ে ছিল । একদিন তারা বৈঠকখানায় টেবিলবাতির আলোর নিচে বসেছিল । মহিলার হাতে ছিল সেলাইয়ের কাজ এবং লোকটির হাতে ছিল খবরের কাগজ । ঠোঁটের ফাঁকে উলের কাঁটা চেপে ধরে মহিলা বয়নের কাজ গুণছিল । গনণায় একবার ভুল করে সে পুনরায় গোণে । লোকটি হাঁটুর ওপর খবরের কাগজ ভাঁজ করে প্রতিটি বাক্য দু’বার করে পড়ে । তার সিগারেটের পাইপে আগুন নিভে গেছে, কিন্তু সে পুনরায় আগুন জ্বালায়নি, বরং নিবীড় মনে সে উলের কাঁটার শব্দ শুনছিল । অবশেষে সে চিঠি খোলে । কেউ খবরের কাগজ কেটে মাত্র দু’টি শব্দ এনভেলাপের ভেতর ভরে দিয়েছে। আর কিছু না । কোন তারিখ নেই, কোন দস্তখতও নেই । একসময় সে কাগজটা স্ত্রীর হাতে তুলে দেয় । মহিলা চিঠি পড়ে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় । কারোর মুখে কোন রা নেই ।একসময় মহিলা হাতের মুঠোয় চিঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ।

‘কি করবে তুমি ?’

‘পুড়িয়ে ফেলো ।’

লোকটি অসম্মতি ভঙ্গিতে দু’পাশে মাথা নাড়ায় । সে খামের ভেতর চিঠি ঢুকিয়ে পকেটে রাখে । তারপর সে মেঝের ওপর পড়ে থাকা মাদুর তুলে পুনরায় খবরের কাগজ পড়তে থাকে ।

মহিলা উল এবং উলের কাঁটা ঝুড়িতে গুছিয়ে রাখে ।

‘ভুলে যাও, বুড়ি মেয়ে । সবার বাড়িতেই চিঠি আসে ।’

বুড়োদের মনে কি কখনো অশনি সংকেত আসে? পকেটের ভেতর এক টুকরো কাগজের কথা লোকটি বেমালুম ভুলে যায় । আরেক সপ্তাহ কেটে গেছে । শনিবার দরোজা খোলার আগে সে জানে চিঠিটা তখনো ওখানেই পড়ে আছে । মহিলা কাছে আসে এবং এমন ভাব করে যেন সে দরোজার নিচে মেঝেতে কোন চিঠি দেখেনি । লোকটি চিঠি তোলে এবং পকেটে ঢুকিয়ে রাখে ।

মাথা নিচু করে মহিলা বয়নের একই কাজ বারংবার গোণে একসময় সে জজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি চিঠিটা পড়বে না ?’

খবরর কাগজের ওপর দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে লোকটি প্রিয়তমা স্ত্রীর মাথার দিকে তাকিয়ে আপনমনে প্রশংসা করে । মহিলার একটাও চুল সাদা হয়নি । এত বছর পরেও মহিলার চোখের মনি সেই প্রথম দিনের মতোই নীল ।

‘চিঠিতে কি লেখা আছে, ইতিমধ্যে আমি তা জানি ।’

‘তাহলে কেন পুড়িয়ে ফেলছো না ?’

এটা একধরনের খেলা । লোকটি তার স্ত্রীকে এনভেলাপ দেখায় । এনভেলাপের ওপর কোন নাম-ঠিকানা নেই । যাহোক, সে এনভেলাপ খোলে । মাত্র দু’টি শব্দ, খবরের কাগজ থেকে কাটা । মুখ খোলা এনভেলাপ ফাঁক করে সে ফুঁ দেয় এবং কার্পেটের ওপর ঝাকায় । কিন্তু এনভেলাপের ভেতরে আর কিছুই নেই । খবরের কাগজ ভাঁজ করার মতো সে চিঠিটা ভাঁজ করে আগের চিঠির সঙ্গে রেখে দেয় । সে লক্ষ্য করে তার সহধর্মিনী বয়নের একটা ভুল ঠিক করে নিচ্ছে ।

মাঝ রাত্তিরে লোকটির ঘুম ভেঙে যায় । চটজলদি সে বিছানা থেকে নেমে জানালার দিকে তাকায় এবং জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে । সে একটা পুরুষের ছায়া দেখতে পায় । লোকটি চলে যাওয়া পর্যন্ত সে হাতের মুষ্টি শক্ত করে ধরে রাখে ।

পরের শনিবার পর্যন্ত প্রতিদিন লোকটি পাড়া-পড়শীদের কাছে খোঁজ-খবর নিয়েছে যে, তারাও একই ধরনের চিঠি পেয়েছে কি না । হয়তো চিঠিটা ভুল করে এসেছে, কেননা খামের ওপর কোন নাম-ঠিকানা নেই । নিদেন হলেও যদি কারোর নাম বা তারিখ অথবা জায়গার নাম লেখা থাকতো, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হতো না । সে দরোজা ধাক্কা দেয় এবং নিচে আরেকটা নীল খামের চিঠি । তার পকেটে আগের চিঠিগুলো আছে । সে খবরের কাগজ খোলে এবং পৃষ্ঠা ওল্টায় । খবরের কাগজের ওপর দিয়ে সেলাই নিয়ে ব্যস্ত স্ত্রীর দিকে তাকায় । একটা জটিল সেলাই নিয়ে মহিলা মাসের পর মাস পেরেশানীতে আছে । লোকটির মনে আছে পেনিলোপের লোককাহিনী, যে সারাদিন যতটুকু উল বুনতো, রাতের বেলা টর্চের আলোয় সেটুকু খুলতো এবং স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতো । এ ভাবেই সে খানকিটা সময় বের করে নিত । লোকটি গল্পের মাঝপথে থামে এবং নিজেকেই প্রশ্ন করে, পেনিলোপ কি স্বামীর অনুপস্থিতিতে ধোঁকা দিত ? কার জন্য সে সেলাই করতো ? ইউলিসিসের ফিরে আসার পরও কি উলের কাঁটার শব্দ শোনা যেত ?

লোকটি বাথরুমের দরোজা বন্ধ করে এবং ছেঁড়া এনভেলাপ খোলে । মাত্র দু’টি শব্দ ... । সে মনে মনে একটা বুদ্ধি আঁটে । এনভেলাপের ভেতর থেকে চিঠি সরিয়ে সে একটা চুল ঢুকিয়ে রাখে । সে আঙটায় জ্যাকেট ঝুলিয়ে রাখে এবং সেই সময় জ্যাকেটের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের হয়ে আছে । দরোজার কাছে দুধের বোতল রেখে মহিলা বিছানায় গিয়েছে । পরদিন সকালে লোকটি জ্যাকেটের পকেটে এনভেলাপ পরীক্ষা করে । তার কাছে মনে হয় সে যেভাবে রেখেছিল, অবিকল সেভাবেই আছে । কিন্তু সে এনভেলাপের ভেতর সাদা চুল খুঁজে পায়নি । রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে লোকটি গোপনে ঘরের ভেতর স্ত্রীর হাঁটাচলার ওপর নজরদারি করে । স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য মহিলা গেইটের কাছে আসে - তার চোখের তারায় অন্য কারোর নেকটাইয়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে । মহিলার ঘাড়ের ওপর থেকে চুল সরিয়ে কোন কামড়ের দাগ আছে কি না, লোকটি তা যাচাই করে । পরবর্তীতে মহিলার অবর্তমানে সে আলমারি খোলে এবং কাপড়-চোপড়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দেয় । পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে পাশের সরু পথ দিয়ে লোকগুলোর যাতায়াতের ওপর দৃষ্টি রাখে । দুধওয়ালা, বেকারীর লোক এবং যুবককে সে চিনতে পারে । ওদের মুখে মেকী হাসি ।

লোকটি স্ত্রীর চলাফেরার ওপর, ঘরের আসবাবপত্রে জমে থাকা ধূলোবালি, এমনকি ফুলের টবের মাটি ভেজা, না শুকনো – সবকিছুর ওপর নজর রাখে । মহিলার সেলাইয়ের কাজের পরিমান দেখে লোকটি সময় গণনা করে । সে জানে, তার স্ত্রী কতটুকু কাজ শেষ করেছে । এছাড়া সে আরো জানে, মহিলা উলের কাঁটা দিয়ে গনণার আগেই কতবার ভুল সেলাই খুলেছে এবং পুনরায় বুনেছে ।

স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ না থাকার জন্য লোকটি কখনই পেনিলোপের উদ্দেশ্য প্রকাশ করেনি । সে গভীর ভাবে খেয়াল করে লাইটপোষ্টের প্রতিচ্ছায়ায় একজনের মুখ দেখেছ । যখন পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়, তখনই সে পা টিপে টিপে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং জোরে এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে দেয় ।

অবশেষে লোকটি একটা অস্ত্র কিনে আনে ।

‘রিভলভার কেন?’ লোকটির সহকর্মী জিজ্ঞেস করে ।

জবাবে সে বলে, ‘শহরে চোরের উপদ্রপ বেড়ে গেছে, তাই ।‘

লোকটির অজুহাত পুরনো । সে ভাবে, মহিলা কী প্রেমিকের মাধ্যমে বিক্রী করার জন্য চাদর বানাচ্ছে ? বিকেলে সে হাঁটুর ওপর খবরের কাগজ মেলে স্ত্রীর গতিবিধির - তার মুখমন্ডল, পড়নের কাপড়চোপড় এবং বেশভূষা - যা অন্য কারোর আগমনের বার্তা বহন করে, প্রতি সজাগ নজর রাখে । মহিলা যদি সেলাইয়ে একটা ভুল করে, তাহলে সে অনেকটা খুলে আবার সেলাই করে ।

মহিলা বারান্দায় স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে । লোকটি আপনমনে ঘরে প্রবেশ করে । তার ভঙ্গি এমন যেন সে মহিলাকে চেনে না । ঘরের ভেতর ঢুকে সে প্রথমেই চারপাশের বাতাসে বিশেষ কোন ঘ্রাণ শোঁকে, আসবাবপত্রের ওপর আলামত খোঁজে, ফুলের টবের মাটি স্পর্শ করে একটা কিছু পরীক্ষা করে। সে জানে, সেই সময় তার স্ত্রী কোথায় আছে ।

মধ্যরাতে লোকটি ঘুম থেকে জেগে ওঠে । সে পাশের বালিশে স্পর্শ করে এবং উষ্ণতা অনুভব করে । দরোজার নিচের ফাঁকা দিয়ে বসার ঘরের আলো দেখা যায় । সেই ঘরে বসে মহিলা সেলাই করে, যা সে সবসময়ই করে । পেনিলোপ কি মাঝরাত্তিরে অন্য দিনের আগাম কাজ করছে ?

চোখ তুলে মহিলা রিভলভার দেখতে পেল । উল ছাড়াই একটা কাটার সঙ্গে আরেকটা কাটার ঘর্ষণ শোনা যাচ্ছে । লোকটি তাকে শাস্তি দিবে, তার কারণ সে কখনই জানতে পারেনি । যেই দু’জনে বিছানায় শুয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ঘুমিয়ে পড়ে ।

অতীত জীবনে মহিলার এক কাজিন ছিল । সে অযথা কসম খেয়ে বলেছিল যে, তার সেই কাজিন মাত্র বারো বছর বয়সে জটিল অসুখে মারা গিয়েছে । সন্ধ্যেবেলায় লোকটি পকেট থেকে চিঠিগুলো বের করে । অনেকগুলো চিঠি । প্রতি শনিবার একটা করে চিঠি এসেছে । সে এক একটা করে চিঠি পড়ে এবং আপননে বিড়বিড় করে ।

লোকটি প্রতি শনিবার চিঠির লেখককে ধরার জন্য সময় অপচয় করতে নারাজ । কিন্তু একটা চিরকুট তার খুবই প্রয়োজন, যা মহিলা এবং তার কাজিনের মধ্যে আদান-প্রদান হয়েছিল । লোকটি নিজেকে ব্যাভিচারিনীর স্বামী ভাবতে শুরু করে । এটা এমন একটা বিশেষ খেলা, যার শেষে সে নিজেকে বিজয়ী মনে করে । হয়তো একদিন সব গোমড় ফাঁস হবে । তাই স্ত্রীকে অযথা উত্ত্যক্ত করার প্রয়োজন নেই ।

লোকটি গেইটের কাছে এসে তার সহচরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় । পুরোটা হাঁটার সময় তারা কেউ কাউকে একটি কথাও বলেনি, এমনকি দোকানপাটের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়নি । ঘরে ঢোকার সময় লোকটি দরোজার নিচে মেঝে থেকে এনভেলাপ তোলে । ঘরে ঢুকেই সে চটজলদি একটা চুল এনভেলাপের ভেতর লুকিয়ে রাখে । তারপর সে টেবিলের ওপর এনভেলাপ রেখে দেয় ।

লোকটি সব সময় এনভেলাপের ভেতর রেখে দেওয়া চুল খুঁজে পায় । তার স্ত্রী দু’ শব্দের চিঠি পড়ে না । আপনমনে সে ভাবে, তাহলে কী মহিলা এনভেলাপের ভেতর চুল স্পর্শ না করে সন্তর্পণে চিঠি খুলে পড়ার গোপন কায়দা-কানুন রপ্ত করেছে ? তার ভুরুতে চিন্তার ভাঁজ পড়ে ।

একদিন বিকেলে লোকটি দরোজা খুলে বুকের ভেতর একটা গভীর নিঃশ্বাস টেনে নেয় । তারপর সে আসবাবপত্রের ওপর হাত বুলিয়ে আনে । তার আঙুলে ধূলোবালি । সে ফুলের টবের মাটি স্পর্শ করে এবং মাটি শুকনো । সরাসরি সে শোবার ঘরে প্রবেশ করে । ঘরের জানালা বন্ধ এবং ভেতরে বাতি জ্বলছে । বৃদ্ধা মহিলা বিছানায় পড়ে আছে । তার হাতে রিভলভার এবং চোখের পাতা খোলা । পড়নের সাদা পোশাক রক্তে লাল হয়ে গেছে ।

লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে । তার চোখেমুখে অনুশোচনার লেশমাত্র চিহ্ন নেই । ঘটনা যেন স্বাভাবিক । পুলিশ এসে তাকে একা রেখে যায় । তার স্ত্রী যখন আত্মঘাতী হয়েছে, তখন সে বাড়িতে ছিল না । অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে প্রতিবেশীরা এসে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে । তখন শোকে সে কোন আহাজারি করেনি । কফিনের হাতল ধরে সে শবদেহ কবরে নামায় । গোরখাদক মাটি দিয়ে কবর ঢেকে দেওয়ার আগেই সে কবরস্থান ত্যাগ করে ।

লোকটি বসার ঘরে প্রবেশ করে । তখনও টেবিলের ওপর সেলাইয়ের কাজ পড়ে আছে, যা তার স্ত্রী শেষ করে যেতে পারেনি । যদি পেনিলোপ কাজটা শেষ করে যেতে পারতো, তাহলে ওটা তারই হতো ।

লোকটি সবুজ সিল্কের শেডের বাতি জ্বালায় । আরামচেয়ারের ওপর সেলাইয়ের ঝুড়িতে আড়াআড়ি ভাবে উলের কাটা পড়ে আছে । তার মনে আছে, সেদিন ছিল শনিবার । কেউ তার কোন ক্ষতি করার কথা ছিল না । মহিলা নিজের অপরাধের মাসুল নিজেই গুণেছে, নাকি তার বুকের ভেতর অকস্মাৎ নিরপরাধ বোধের অনুভূতি জেগে উঠে ? যাহোক, ভুল করে সে চিঠিটা অন্য দরোজার নিচে ছুঁড়ে ফেলে ।

মহিলার আত্মহননের আসল কারণ খোঁজার কোন পথ খোলা নেই । তাই সে শান্তিতে বার্ধ্যকে উপনীত হতে পারে । যদি তর কাছে তাই মনে হয়, তাহলে তার স্ত্রীর মৃত্যু হতো না, কখনই না । অন্য লোকটি খোলা দরোজা এবং জানালা খুঁজতে গিয়ে রীতিমত কাঁপছিল । সে হয়তো গেইটে শবাযান দেখেছে । মৃতদেহ কবরে নামানোর সময় তাদের মধ্যে একজন তার পাশে দাঁড়িয়েছিল । কবরের ভেতর খানিকটা পানি জমেছিল ।

লোকটি প্রতি শনিবার ঘর ছেড়ে বাইরে যায় । অভ্যাসবশতঃ তার হাত বাঁকা হয়ে থাকে । কেননা এই হাত এতগুলো বছর মহিলাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল । দোকানের জানালার পাশে দাঁড়ানোর পর লোকটি তার হাতে স্ত্রী ভার অনুভব করে । যদিও লোকটির স্ত্রী মৃত, তবুও সে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসতে থাকে ।

‘আমি সঠিক ছিলাম’, বারান্দায় পা ফেলে লোকটি দরোজার তালা খুলতে খুলতে পুনর্বার বলে, ‘আমি সঠিক ছিলাম ।’ সে দরোজা খোলে এবং পায়ের নিচে চিঠি চাপা পড়ে । একসময় সে হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে এবং শব্দ করে খবরের কাগজ পড়তে থাকে, যেন নিস্তব্ধতার গভীর চিৎকার তাকে শুনতে না হয় ।


লেখক পরিচিতিঃ ব্রাজিলের সমকালীন কথাসাহিত্যের অন্যতম ছোটগল্প লেখক ডাল্টন ট্রেভিস্যান (পুরো নাম ডাল্টন জ্যারসন্ ট্রেভিস্যান) । তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ১৪ জুন, দক্ষিণাঞ্চলের পারানা প্রদেশের রাজধানী কুরিতিবা শহরে । তিনি পারানা ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করেছেন, কিন্তু অল্প সময়ের জন্য আইনজীবি হিসাবে কর্মরত ছিলেন । পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিকতা পেশায়, বিশেষ করে পুলিশ রিপোর্টার এবং চিত্র সমালোচক হিসাবে কাজ করেন । তিনি চল্লিশের দশকের খ্যাতনামা লেখকদের লেখা প্রকাশের জন্য ‘সোয়াকিম’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন । তিনি চল্লিশটিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন । তাঁর ছোটগল্পের বিষয়বস্তু জন্ম-শহরের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, যা চরিত্রগত দিক থেকে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশ্বজনীন । তাঁর অতি সংক্ষিপ্ত গল্প, যা ‘হাইকু-গদ্য’ নামে পরিচিত, সাধারণতঃ সংলাপধর্মী । এসব ধারালো গল্পে তিনি আমজনতার মৌখিক ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অত্যাচার এবং জীবন-সংগ্রামের নানান বিষয় তুলে ধরেছেন । তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘এ পোলাকিনহা’ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় । ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার অফ কুরিতিবা’ (১৯৬৫) তাঁর অন্যতম সফল এবং বহুল প্রশংসিত গ্রন্থ, যা স্বদেশে এবং বিদেশে একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । তিনি ২০১২ সালে পর্তুগীজ ভাষার অগ্রগামী লেখক হিসাবে বিখ্যাত ‘প্রিমেঁও ক্যামজ্’ পুরস্কার লাভ করেন । এছাড়া তিনি ‘মিনিষ্ট্রি অফ কালচারাল লিটারেরী অ্যাওয়ার্ড’, ‘জাবুতি অ্যাওয়ার্ড’, ‘পর্তুগাল টেলিকম’ এবং ব্রাজিলিয়ান অ্যাকাডেমী অফ লেটার্সের ‘মাচাদো ডি আসিস’ পুরস্কার অর্জণ করেন ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ