ভালোবাসার উর্ধ্বে শাশ্বত মরণ

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

অনুবাদ-মৌসুমী কাদের

মারা যাবার ছ’ মাস এগার দিন আগে সেনেটর ওনেসিমো সানচেস্‌ তাঁর সারা জীবনের প্রত্যাশিত সেই নারীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ওনেসিমোর সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল ‘রোজাল-দেল-ভিরে’ বন্দরে। এটি আসলে একটি মায়াময় গ্রাম,যা রাতের বেলায় জাহাজের আনাগোনায় গোপন এক চোরাচালান ঘাঁটিতে পরিণত হয়, আর দিনের বেলায় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা অনুর্বর শুকনো খটখটে ভূমি,যাকে মরুভূমির সবচেয়ে পরিত্যক্ত এলাকাও বলা যেতে পারে। এটি সবকিছু থেকে এত দূরে যে কেউ সন্দেহই করবে না যে এখানে প্রাণের চিহ্ন আছে বা কেউ তাঁর ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে এখানে। এমনকি এই নামটিও এখন একটি তামাশা মাত্র। কারণ, এই অঞ্চলের একমাত্র গোলাপ ফুলটি সেনেটর ওনেসিমো সানচেস্‌ই ব্যবহার করেছিলেন, সেই সন্ধ্যায়,যেদিন লরা ফারিনা’র সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল।


প্রতি চার বছর অন্তর নির্বাচনী প্রচারণার কাজে জায়গাটি ছিল অপরিহার্য। প্রচারের জন্য কার্নিভালের ওয়াগনগুলো সকালেই এসে পৌছুল। তারপর ট্রাকে করে এলো ভাড়াটে রেড ইন্ডিয়ান দল। শহরের পাবলিক অনুষ্ঠানগুলোর ভীড় বাড়ানোর জন্য এদের ভাড়া করা হয়। এগারটা বাজার কিছু আগে জমজমাট বাজনা শুরু হল। আতসবাজি আর জিপের লাইনের মধ্যে সেনেটরের ঘিয়ে-সাদা গাড়ীটা এসে পৌছুল। সেনেটর ওনেসিমো সানচেস্‌ ধীর-স্থির ভাবলেশহীন ছিলেন এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে নিজেকে অনুত্তাপে ঢেকে রেখেছিলেন। গাড়ীর দরজাটা খুলতেই আগুনের ঝাপটায় কেঁপে উঠলেন তিনি এবং তাঁর খাঁটি সিল্কের শার্টটা ভিজে হালকা স্যুপের রঙ ধারণ করল। বয়সের তুলনায় নিজেকে তাঁর অনেক বেশী বয়স্ক এবং নিঃসঙ্গ মনে হল। আসলে তিনি মাত্র বিয়াল্লিশ পেরিয়েছেন। গোটিনগেন্‌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানের সাথে তিনি মেটালার্জিকাল ইঞ্জিনিয়ার ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি একজন কৌতুহলী পাঠক,কিছু ল্যাতিন সাহিত্যের বাজে অনুবাদ করেছিলেন, তেমন কোন পুরস্কার পাননি। তিনি একজন প্রভাশালী জার্মান নারীকে বিয়ে করে তাঁকে উপহার দিয়েছেন পাঁচটি সন্তান এবং তারা সকলেই নিজ নিজ বাড়িতে সুখে আছে। তিনি সকলের চেয়ে সুখী ছিলেন এতদিন, যতক্ষন না তিন মাস আগে তাঁকে বলা হল যে তিনি আগামী ক্রিসমাসের মধ্যেই মারা যাবেন।

জনসভার প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন প্রায়, সেনেটার তার জন্য নির্ধারিত বাড়িটিতে এক ঘন্টা একা বিশ্রাম নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুয়ে পড়ার আগে তিনি মরুভূমির এতটা পথ জুড়ে বাঁচিয়ে রাখা গোলাপটি গেলাসের জলে ডুবিয়ে রাখলেন; সঙ্গে আনা ডায়েট সিরিয়াল দিয়ে সারলেন দুপুরের লাঞ্চ, যাতে করে তিনি মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য আয়োজন করা ‘ফ্রাইড গোট’টা এড়াতে পারেন। তারপর নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই খেয়ে নিলেন বেদনানাশক বড়িগুলো যাতে তীব্র ব্যাথা ওঠার আগেই তার প্রতিকার হয়। তারপর বৈদ্যুতিক পাখাটি হ্যামকের পাশে টেনে এনে গোলাপের ছায়ায় পনের মিনিট নগ্ন অবস্থায় স্ট্রেচ করে শুয়ে পড়লেন। অমনোযোগী হয়ে ঘুম জড়ানো অবস্থায় যেন তাকে মৃত্যু সম্পর্কে ভাবতে না হয় সেজন্যই এই চেষ্টা। ডাক্তাররা ছাড়া আর কেউ জানেনা যে তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দন্ডিত হয়ে আছেন; যে কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একদম গোপনীয়তায় জীবনের কোন পরিবর্তন ছাড়াই সত্যটি সহ্য করবেন, গর্বের জন্যে নয়, লজ্জ্বাটা লুকোবার জন্য।

বেলা তিনটায় যখন তিনি প্রকাশ্যে হাজির হলেন,তাঁর ইচ্ছা্র পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অনুভূব করলেন তিনি; বিশ্রান্ত এবং পরিচ্ছন্ন,পড়নে ঢোলা লিনেন প্যান্ট এর সাথে পুষ্পশোভিত শার্ট, ব্যথা কমাবার বড়ি খাওয়ায় মেজাজটাও ছিল যথেষ্ট চাঙ্গা। মৃত্যুর ক্ষয় অনেক বেশি ক্ষতিকর যতটা না তিনি মনে করেছিলেন। যাদের জন্য তিনি মঞ্চে উঠে গেলেন তাদেরই জন্য একটা অদ্ভুত উন্নাসিকতা অনুভব হল। তিনি মনে মনে সেই ইন্ডিয়ানদের কথা ভাবছিলেন যারা খালি পায়ে কোনমতে কয়লার গরম সহ্য করতে পারত, তাঁদের জন্য এতটুকু দুঃক্ষবোধ হল না। তিনি কিছুটা ক্রুদ্ধ হয়ে হাত দুলিয়ে তাঁর নিরুত্তর অনুমোদন প্রকাশ করলেন এবং থামাতে বললেন সমবেত ধ্বনি। তাঁর উত্তপ্ত চোখ ছিল জনসমুদ্রে স্থির। পরিমিত গভীর কন্ঠস্বর হৃদয়ে শীতল জলের প্রলেপ লাগিয়ে দিল। যে বক্তৃতাটি অনেকবার পাঠ করে উগরে দেবার জন্য মুখস্থ করা হয়েছিল, আসলে সেটি সত্যি কথা বলে যাওয়া নয় বরং মারকাস্‌ আরলিয়াস্‌ এর মেডিটেশন এর বইয়ের চতুর্থ খন্ড থেকে তুলে আনা কয়েকটি অদৃষ্টবাদী উচ্চারণ মাত্র।

‘প্রকৃতিকে পরাস্ত করবার উদ্দেশ্য নিয়েই আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি’। তাঁর সকল ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই কথাগুলো বলে তিনি ভাষন শুরু করলেন। ‘আমরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে আর থাকবোনা। খারাপ আবহাওয়ায় তৃষ্ণার্ত থেকে ভগবানের অনাথ শিশুর মত নিজ দেশে বিতাড়িত হয়ে থাকবোনা। ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ, আমরা মহান এবং সুখী হব।’

তার বকৃতার একটি নিজস্ব স্টাইল আছে। তিনি বলতে শুরু করলে তার চামচাগুলো কাগজের পাখি তৈরি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। কাগজের পাখিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উড়েটুড়ে মঞ্চে আঘাত খেয়ে আবার সমুদ্রের জলে ভেসে যায়। ঠিক সেই সময়ে অন্যরা পাতাহীন ডালগুলোকে ওয়াগন থেকে বের করে এনে জনতার পেছনে পুতে দিতে থাকে। কার্ডবোর্ডের কতগুলো বাড়ির মডেল তৈরী করা হয়। বাড়িগুলোয় কাঁচার জানালা আর ইটের রঙ লাল। যেন দেখে মনে হয় একটা বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি ছেয়ে আছে।

সেনেটর ল্যাতিন ভাষায় দুটো উদ্ধৃতি দিয়ে তার বক্তৃতা আরও দীর্ঘায়িত করলেন যেন তার সহযোগীরা ধাপ্পাবাজির করার আরও কিছু সময় পায়। তিনি কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরীর যন্ত্র, ডিমে তা দেবার যন্ত্র, এমনকি এমন একটা সুখী পরিবেশের প্রতিশ্রতি দিতে থাকলেন যেন নোনা মাটিতেও শাক-সবজির উৎপাদন সম্ভব হবে। জানালার খোপে গুচ্ছ গুচ্ছ চারাগাছ রোপন করা যাবে। ঐ রুপকথার জগতটি সাজানো শেষ হওয়ামাত্রই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ; ‘দেখুন! ঐ পথেই ওটা আমাদের জন্য হবে’।

সমবেত জনতা ঘুরে দাঁড়ালো। বাড়িগুলোর পেছনে রঙীন কাগজের একটা সমুদ্র তটরেখা আঁকা হয়েছে। এটা কৃত্রিম কাগজের শহরের সর্বোচ্চ বাড়ীটার চেয়েও দীর্ঘ ছিল। শুধু সেনেটার নিজে লক্ষ্য করলেন যে, তৈরীর সময় থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করার ফলে, চড়া আবহাওয়ার কারণে কার্ডবোর্ডের বাড়িটা ভয়াবহভাব ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং দেখতে প্রায় ‘রোসাল-দেল-ভিরের’ মতই দারিদ্রপীড়িত ধূলোমলিন হয়ে আছে।

দীর্ঘ বারো বছরে মধ্যে প্রথমবারের মতো নেলসন ফারিনা সেনেটরকে অভিবাদন করতে গেলেন না। তিনি তার অপরিকল্পিতভাবে তৈরী করা বাড়ির শীতল বাগানে মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রা শেষে হ্যামকে (টাঙানো দোলনা) শুয়েই শুয়েই ভাষনটা শুনলেন। এই বাড়িটা তিনি তাঁর নিজের ফার্মাসিস্ট হাতেই তৈরী করা, যে হাতে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রীকে খুন করেছিলেন। নেলসন শয়তান এর দ্বীপ থেকে নির্দোষ টিয়াপাখিদের সাথে জাহাজে চড়ে ‘রোজাল-দেল-ভিরে’ তে পালিয়ে আসেন । সাথে ছিল সুন্দর এবং ধর্মহীন কালো এক নারী যাঁকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন প্যারামারিবোতে এবং যার গর্ভে তার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল। মেয়েমানুষটা অন্য কাউকে কষ্ট না দিয়ে মারা গেলে স্বাভাবিক কারণেই তাকে স্থানীয় কবরস্থানে ওলন্দাজ নামে সমাহিত করা হয়। কন্যা উত্তরাধিকারসূত্রে তার মায়ের গায়ের রঙ ও ফিগার পেয়েছে এবং সেই সাথে পেয়েছে বাবার হলুদ ও বিস্ময়োৎফুল্ল চোখ। আর একারনেই নেলসন যুক্তিসংগত ভাবেই চিন্তা করতে পারে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীটিকে সে ঘরে ঠাঁই দিয়েছে।

প্রথম নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় থেকেই সেনেটর ওনেসিমো সানচেজের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। নেলসন ফারিনা তার কাছে একটা মিথ্যা পরিচয়পত্র চেয়ে সাহায্যের জন্য মিনতি করেছিল,যাতে করে আইন তাকে ছুঁতে না পারে। সেনেটর বিনীতভাবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে নেলসন ফারিনা হাল ছেড়ে না দিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে যখনই সুযোগ পেয়েছেন তাঁর অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু এবার তিনি তাঁর হ্যামকে বসেই কুচিন্তায় নিমগ্ন থাকলেন; ‘সেনেটর যেন জলদস্যূদের হাতে জীবন্ত অবস্থায় পচে মরে’। জনসভার শেষাংশে যখন চূড়ান্ত হর্ষধনী ও সাধুবাদের কথা শুনলেন, তখন তিনি মাথাটা তুলে বেড়া ডিঙিয়ে বাইরে তাকালেন এবং জনতার পেছনে ঘটে যাওয়া তামাশাগুলো দেখতে লাগলেন। বাড়ীঘরের সাজসরঞ্জাম,গাছপালার কাঠামো, আর সমুদ্রতটরেখা নির্মাণের জন্য সে লোকগুলো লুকিয়ে ছিল তাদের সবাইকেই তিনি দেখতে পেলেন। তারপর কোনরকম চটে না গিয়ে ঘৃণা নিয়ে থুথু ফেললেন।

গালি দিয়ে বললেন, ‘অসাধারণ’! ‘রাজনীতি নিয়ে ভালোই ধান্দাবাজি!’

ভাষণ শেষে গতানুগতিক ভাবেই সেনেটর পটকা ফোটানো আর বাজনার সাথে সাথে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলেন আর এবং শহরের অধিবাসীরা তাদের অভিযোগ শোনাতে থাকলো। সেনেটর তাদের কথা মনযোগ দিয়ে শুনলেন এবং কোনরকম প্রতিশ্রুতি দেয়া ছাড়াই কৌশলে প্রত্যেককে কিছু না কিছু স্বান্তনা দিলেন। একটা বাড়ির ছাদের উপর থেকে ছ’টা ছোট ছোট বাচ্চা সহ একজন মহিলা পটকাবাজি আর হৈ-হল্লা ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি বেশী কিছু চাইনা সেনেটর, শুধু কূয়ো থেকে পানি তোলার জন্য একটা গাধা চাই।’

সেনেটর বাচ্চাগুলোকে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার স্বামীর কোথায়?’

‘তিনি আরুবা দ্বীপে ভাগ্য খুঁজতে গিয়েছিলেন, কিন্তু খুঁজে পেয়েছে এক বিদেশিনী, যার হাসিতে মুক্ত ঝরে’। বেশ স্বচ্ছন্দভাবে হেসে মহিলাটি জবাব দিল।

উত্তরটি শুনে জনতার ভেতর হাসির রোল পড়ে গেল।

‘আচ্ছা ঠিক আছে’, সেনেটর সিদ্ধান্ত নিলেন; ‘তুমি তোমার গাধাটা পাবে’।

কিছুক্ষণ পরই সেনেটরের একজন সহকারী মহিলার বাড়িতে গিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর গাধা হাজির করলো, যার লেজের উপর পাকা রঙ দিয়ে নির্বাচনী স্লোগান আঁকা ছিল; যাতে কেউ কখনও ভুলে না যায় যে এটা সেনেটারের দেয়া উপহার ছিল।

বাকি রাস্তা বরাবর যেতে যেতে সেনেটর আরো ছোট ছোট কিছু অনুভূতি প্রকাশ করলেন, এমনকি শয্যাশায়ী একজন অসুস্থ রোগীকে চামচে তুলে অসুধ খাওয়ালেন, যিনি তার বিছানাটি দরজার সামনে টেনে এনে সেনেটরকে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। একেবারে শেষপ্রান্তে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখতে পেলেন নেলসন ফারিনাকে, যিনি তাঁর ঝুলন্ত দোলনায় শুয়ে ছিলেন এবং তাঁকে ছাইরঙা এবং মনমরা দেখাচ্ছিল। সেনেটর তাঁর চেহারায় কোনরকম সহানুভূতি প্রকাশ না করেই এগিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন।

‘ও হে, কেমন আছো?’

নেলসন ফারিনা বিষন্নতার দৃষ্টি দিয়ে যেন সেনেটরকে গ্রাস করতে চাইলেন। তারপর কোনরকমে জবাব দিলেন, ‘এইতো চলে যাচ্ছে’।

শুভেচ্ছা বিনিময় শুনতে পেয়ে নেলসনের মেয়েটি উঠোনে এসে দাঁড়ালো। ওর পরনে ছিল একটি সস্তা ও মলিন রেডইন্ডিয়ান ফ্রক, নানা রঙের ধনুক দিয়ে সাজানো ছিল চুল,আর সূর্যের তীব্রতা রোধের জন্য মুখে লাগানো ছিল ক্রিম। কিন্তু তারপরও এরকম অবিন্যস্ত অবস্থাতেও বোঝা যাচ্ছিল যে এর মত সুন্দরী সারা দুনিয়ায় কেউ কোনদিন জন্মায়নি।

সেনেটার কতকটা রূদ্ধশ্বাসেই বেড়িয়ে গেলেন। ‘আমার ধ্বংস অনিবার্য!’ বলে তিনি নিশ্বাস নিলেন। অবাক হয়ে ভাবলেন, ভগবান যে কি উন্মাদনায় মানুষ সৃষ্টি করেন!

সে রাতে নেলসন ফারিনা তার মেয়েটিকে সবচেয়ে সুন্দর পোশাকে সাজিয়ে সেনেটরের কাছে পাঠালেন। বন্দুকসহ দুজন গার্ড অসহ্য গরমে মাথা নাড়তে নাড়তে ভারা করা বাড়িটার প্রবেশ কক্ষে রাখা একমাত্র চেয়াটায় তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেল।

সেনেটর পাশের ঘরে ‘রোসল-দেল-ভিরের’ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তখন সভায় ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর ভাষণের সারমর্মটুকু বলার জন্যই এদের জড়ো করা হয়েছিল। মরুভূমির অন্যান্য শহরের গণ্যমান্যদের মতই এদের কথাবার্তা ও চালচলন, যাদের সংগে তিনি প্রতিনিয়তই মিলিত হন। দীর্ঘ রাত্রিকালীন সভা শেষে সেনেটর ভীষন ক্লান্ত ও অসুস্থ বোধ করলেন। তার শার্ট ঘামে ভিজে জপজপ করছিল এবং বৈদ্যুতিক পাখা থেকে আসা গরম হাওয়ায় তিনি সেটা শরীরেই শুকোতে চেষ্টা করছিলেন। বৈদ্যুতিক পাখাটি এমনভাবে বনবন শব্দ করে ঘুরছিল যেন মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে একটা ঘোড়া প্রচন্ড তাপে ছটফট করছে।

‘আমরা নিশ্চয়ই কাগজের পাখি খেতে পারিনা’, তিনি বললেন। ‘আপনারা এবং আমি সকলেই বিশ্বাস করি যে এই ছাগলের গোবরের মধ্যেই একদিন গাছপালা আর ফুল ফুটবে। জলের গর্তে পোকামাকড় আর কেঁচোর পরিবর্তে মাছ ভাসবে। সেদিন আপনাদের বা আমার কারও কিছু করার থাকবেনা। আমি কি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পেরেছি?’

কেউ উত্তর দিলনা। কথা বলতে বলতেই তিনি ক্যালেন্ডারের একটি পাতা ছিঁড়লেন। নিজের হাতেই একটা কাগজের প্রজাপতি বানালেন। তারপর তিনি কোনরকম লক্ষ্য স্থির না করেই বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে সেটি উড়িয়ে দিলেন। প্রজাপতিটা ঘরের চারপাশ ঘুরেটুরে তারপর আধখোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সেনেটর মৃত্যুর সকল জটিলতাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখেই কথা বলে যাচ্ছিলেন।

‘অতএব’,তিনি বললেন, ‘আপনারা ইতিমধ্যে যা জানেন তা আর আমি পুনরাবৃত্তি করবোনা। আমার পুনঃনির্বাচন আমার চেয়েও আপনাদের জন্য কতটা ব্যবসায়িক সফলতা আনবে। আমি, বদ্ধ জলাশয় আর রেড় ইন্ডিয়ানদের ঘামে ক্লান্ত হয়ে আছি, অন্যদিকে আপনারা এর থেকে বাঁচার রসদ খুঁজছেন।’

লরা ফারিনা কাগজের প্রজাপ্রতিটাকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। গার্ডগুলো সিঁড়িতে বন্দুক কাঁধে নিয়ে ঘুমে ঢুলছিল বলে একমাত্র লরাই ওটা দেখতে পেয়েছিল। কয়েকবার পালাক্রমে গড়িয়ে পরার পর প্রজাপতিটা দেয়ালের সংগে ধাক্কা খেয়ে সেখানেই আঁটকে গেল। লরা ফারিনা নখ দিয়ে সেটা টেনে তোলার চেষ্টা করল। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা করতালির শব্দে একজন গার্ড জেগে উঠেছিল সেই শুধুর লরার এই নিস্ফল প্রচেষ্টা লক্ষ্য করল। ‘ওটা কিছুতেই উঠবেনা’, ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে বলে উঠল। ‘ওটা ওখানেই সেঁটে গেছে’।

লরা ফারিনা আবার বসে পড়ল, যখন সভা থেকে লোকজন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

সেনেটর দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঘরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবার পর তিনি লরা ফারিনাকে লক্ষ্য করে বললেন; ‘তুমি এখানে কি করছো?’

সে বললো, ‘আমার চাইবার কিছু নেই’।

সেনেটর ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি ঘুমন্ত গার্ডদেরকে খুঁটিয়ে দেখলেন এবং তারপর দেখলেন লরা ফারিনাকেও, যার অস্বাভাবিক সৌন্দর্য তার যন্ত্রণার চেয়েও বেশি কাম্য। তিনি অনুভব করলেন, ‘মৃত্যু তাঁর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে’।

এসো’, তিনি বললেন।

ঘরে ঢুকতে গিয়ে লরা ফারিনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাজার হাজার টাকার নোট প্রজাপতির মতন হাওয়ায় উড়ছে আর নামছে। সেনেটর পাখাটি বন্ধ করে দিলেন আর কাগজের নোটগুলো ঘরের নানা জিনিষপত্রের উপর সেঁটে বসলো।

সেনেটর স্মিত হেসে বললেন, ‘এমনকি কাগজও উড়তে পারে’।

লরা ফারিনা একটা টুলের উপর বসে পড়ল। তাঁর ত্বক মসৃণ, টানটান, অপরিশোধিত তেলের মত রঙ, রোদে পোড়া তন্বী লেজের মতন ঝুটি করে বাঁধা চুল, আর বড় বড় চোখ দুটি যেন আলোর চেয়েও উজ্জ্বল। লরা যেদিকে তাকিয়ে ছিল সেনেটর সেদিকে দৃষ্টি অনুসরণ করলেন এবং শেষপর্যন্ত ফুলটিকে খূঁজে পেলেন, যদিও সেটি ততক্ষণে শুকাতে শুরু করেছে।

‘একটা গোলাপ, ‘সেনেটর যেন পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন।

‘হ্যাঁ’, কিছুটা হতভম্বভাবে লরা বললো; ‘রিওহাচায়’ ওদের আমি চিনেছি’।

গোলাপ সম্পর্কে কথা বলতে বলতে তিনি জামার বোতাম খুলতে থাকলেন এবং তারপর একটা খাটে বসে পড়লেন। বুকের যেপাশে হ্রৎপিন্ডটা আছে বলে তিনি অনুভব করেন, ঠিক তার উপরে ‘তীরবিদ্ধ হ্রদয়ের’ একটি জলদস্যু ট্যাটু আঁকা আছে। তিনি ঘামে জবজবে শার্টটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলেন আর লরা ফারিয়ার কাছে জুতো খুলে দেবার সাহায্য চাইলেন।

লরা খাটিয়ার মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসলো। সেনেটর তখনও তাঁকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। লরা যখন ফিতেগুলো খুলছিল তখনও তিনি বিস্ময়ে ভাবছিলেন এই সাক্ষাতের কোন অংশটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষ হবে।

‘তুমি নেহাতই বাচ্চা’, সেনেটর বলে উঠলেন।

‘আপনি এটা বিশ্বাস করবেন না’,লরা বললো, ‘আমি এপ্রিলে উনিশে পা দেবো।‘

সেনেটার আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

‘কোন দিন?’

‘এগারই এপ্রিল’, সে বললো।

সেনেটর একটু স্বচ্ছন্দ অনুভব করলেন।

‘আমরা দুজনেই মেষ রাশি’, স্মিত হেসে তিনি বললেন, ‘এটা নিঃসঙ্গতার প্রতিকৃতি’।

লরা মনযোগ দিতে পারছিলনা,কারণ সে বুট জুতোগুলো নিয়ে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছিলনা। অন্যদিকে সেনেটরও ঠিক জানেন না লরা ফারিনাকে নিয়ে কী করবেন। কারণ হঠাৎ প্রেমে পড়ায় তিনি অভ্যস্ত নন। আর তাছাড়া তিনি জানতেন ব্যাপারটার উৎস অমর্যাদাকর। কিছুক্ষন চিন্তা করেই তিনি লরা ফারিনাকে শক্তভাবে হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরলেন, তারপর তার কোমর জড়িয়ে ধরলেন, খাটিয়ার উপর তার শরীরটা নুয়ে পড়লো। তখনই তিনি অনুভব করতে পারলেন যে পরিধানের তলায় লরার শরীর নগ্ন, জঙ্গলের বুনো পশুর গন্ধ যেন তার শরীরে, আর হৃদয় ভয়বিহ্বল, ত্বকে অস্বস্থি তৈরী করা চিটচিটে ঘাম।

‘আমাদের কেউ ভালোবাসে না’,বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

লরা ফারিনা কিছু বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু তার দম নেবার জন্যই সেখানে স্বল্প বাতাস ছিল। তিনি লরাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিলেন। ঘরটা তখন গোলাপ ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল। লরা নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিল। সেনেটর ধীরে ধীরে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন, হাত বুলিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করলেন কিন্তু যেখানে তিনি তাঁকে খুঁজছিলেন সেখানে লোহার মতন শক্ত কিছু একটার স্পর্শ পেলেন।

‘এখানে এটা কি?’

‘একটা তালা’, লরা বললো।

‘এর মানে কি?’ উত্তেজিতভাবে সেনেটর চেঁচিয়ে উঠলেন।

যদিও তিনি বিষয়টি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন, তারপরও জিজ্ঞাসা করলেন;

‘চাবিটা কোথায়?’

লরা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে ফেলল, ‘আমার বাবার কাছে’। ‘বাবা আপনাকে বলতে বলেছেন যে, আপনি যেন আপনার একজন লোককে চাবি আনার জন্য তার কাছে পাঠান আর সাথে যেন একটি লিখিত প্রতিশ্রুতিও থাকে যে আপনি তার সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক করে দেবেন’।

সেনেটর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। তারপর বিরবির করে বললেন, ‘বেজন্মা কোথাকার’!

তারপর তিনি আরাম করার জন্য চোখ বুজলেন এবং নিজেকে যেন কোন এক অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলেন। (মনে করো, তিনি মনে করলেন, যে, এটা তুমি বা অন্য যে কেউই হওনা কেন, মারা যাওয়ার অত আগে নয়, এবং যখন তোমার নামও মনে থাকবেনা, তার পক্ষেও এটা তাড়াতাড়ি নয়।)

তিনি অপেক্ষা করছিলেন ভয়ের কাঁপুনিটা চলে যাবার। ‘আমাকে একটা কথা বলো’, সেনেটর বললেন। ‘তুমি আমার সম্পর্কে কি শুনেছো?’

‘আপনি কি ইশ্বরের দিব্বি দেয়া সত্যটা জানতে চান’?

‘হ্যা, ইশ্বরের-সৎ-সত্য’।

লরা সাহস করে একটু এগুলো, ‘সবাই বলে আপনি আর সকলের চেয়ে খারাপ, কারণ আপনি একদম অন্যরকম’।

সেনেটর একটুও উত্তেজিত হলেন না। চোখ বন্ধ রেখে দীর্ঘক্ষন নীরব থাকলেন, এবং যখন আবার চোখ খুললেন, মনে হলো তিনি ফিরে এলেন তাঁর সবচেয়ে গোপন সহজাত প্রবৃত্তি থেকে।

"ওহ,কি বিচ্ছিরি কান্ড!’,তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার কুত্তার বাচ্চা বাপকে বলে দিও যে আমি তার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেবো।‘

‘যদি আপনি চান, তাহলে আমি নিজে গিয়েই চাবিটা নিয়ে আসতে পারি’, লরা বললো।

সেনেটর তাঁকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে থামালেন।

‘চাবিটার কথা ভুলে যাও’, ‘আমার সংগে কিছুক্ষন ঘুমাও’, তিনি বলতেই থাকলেন, ‘যখন তুমি খুব নিঃসঙ্গ তখ্ন কারও সঙ্গে থাকা ভাল’।

নিস্পলক দৃষ্টিতে গোলাপের দিকে তাকিয়ে থেকে সেনেটরের মাথাটা নিজের কাঁধে তুলে নিল লরা। সেনেটর তার কোমর জড়িয়ে ধরে বনের পশুবগলে মুখ ডুবিয়ে সন্ত্রাসের কাছে নতি স্বীকার করলেন।

লরা ফারিনের সঙ্গে প্রকাশ্য কেলেঙ্কারির অভিযোগে ছ’মাস এগারো দিন পর পদচ্যুত, নিঃসঙ্গ, প্রত্যাখ্যাত অবস্থায় তিনি মারা যাবেন। সেই সময় লরা তাঁর কাছে থাকবেনা বলে মৃত্যুর সময়ে তিনি রাগে-ক্রোধে কাঁদতে থাকবেন।


---------------------------------
টরন্টো, কানাডা

অক্টোবর ৩০, ২০১৬

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ