প্রতিরাতে আমরা আমাদের নির্মিত প্ল্যানেট্যারিয়ামে যেতাম। ক্ল্যারিবেলের পছন্দ ছিল উল্কাপতন ।
‘ওগুলো দারুণ রোমান্টিক, অনেকটা মহাশূন্যে ‘কাঙ্খিত ইচ্ছেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার মতো,’ সে বলে । অন্যদিকে ডেভিডের পছন্দ ছিল বিশাল আকাশের বুকে মনের সুখে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন আকৃতির নিশাচর মেঘ । আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মেঘমালার চলাচল দেখতো এবং মনের ক্যানভাসে নানা ধরনের আকৃতি কল্পনা করতো । অথচ আমি, যে কি না প্ল্যানেট্যারিয়ামের আবিস্কারক, চাঁদের বুকে উঁচু-নীচু পাহাড়-পর্বত এবং উপত্যকা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বেশি যুক্তি সঙ্গত মনে করতাম এবং নিজের মধ্যে ওগুলোর উপস্থিতি চিরদিনের জন্য দাবী করেছি ।
আমরা আকাশের গায়ে ঝুলে থাকে তারা-নক্ষত্র এবং মেঘেদের আনাগোনা পছন্দ করতাম । গরমের সময় বৃষ্টির আগে আকাশ থেকে ঝলমলে রুপালি আলো বিচ্ছুরিত হতো এবং ভেড়ার পালের মতো দল বেঁধে খন্ড খন্ড মেঘ আকাশের একদিক থেকে অন্যদিকে ভেসে যেত ।
আমাদের নির্মিত প্ল্যানেট্যারিয়াম ছিল দু’টো গাছের মধ্যে টাঙানো দোলনার বিছানা, অর্থাৎ হ্যাম্যাক । দোলনা বিছানায় শুয়ে আমরা যেন পুরো ইন্দ্রিয় দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ দৃশ্য উপভোগ করতে পারি, তার জন্য প্রয়োজন মতো গাছের ডালপালা কেটে ফাঁকা জায়গা করে নিয়েছি । টানটান উত্তেজনায় আমাদের ভেতর জগত আন্দোলিত হতে থাকে এবং আমরা হাত-পা প্রসারিত করি । আমাদের মন যখন উজ্জ্বল রোশনাইয়ে আলোকিত হয়, তখন আবেশে আমরা চোখের পাতা বন্ধ করি। তারপর আমাদের মাথার ওপর নিখিল বিশ্বের যেসব অলৌকিক চিত্র আমরা মস্তিস্কের ভেতর ধারণ করে আছি, সেগুলোর নামকরণ করতে থাকি ।
‘সন্ধ্যে বেলায় ঘনিয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়, ক্রোধান্বিত ড্রাগন,’ডেভিড বললো ।
‘মহাশূণ্যে আলোর বিচ্ছুরণ, ভালোবাসার প্রতীক,’ ফিসফিসিয়ে বললো ক্ল্যারিবেল ।
‘চাঁদের বুকে গহ্বর, সূর্য্য থেকে পাওয়া ক্ষতচিহ্ন,’ আমি তীব্র চিৎকার করে বলি ।
স্কুলের সহপাঠী সবাই মনে করতো আমরা নিরেট উন্মাদ, বিকৃত মস্তিস্কের । তারা হয়তো একদিকে ঠিকই ছিল । এখন আমি আনমনে ফেলে আসা সেই সব দিন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি । আসলে আমাদের কথাবার্তা খুব সহজ ছিল না । কেননা আমাদের অদ্ভুদ মন-মানসিকতা অন্যান্য সহপাঠীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল । ক্ল্যারিবেল ছিল ক্লাশের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী । কিন্তু উল্কাপতনের প্রতি তার বিশেষ দূর্বলতা তাকে বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । ‘আমি শুধু দূরের আকাশের বুকে কালপুরুষের বলয়ে বসবাস করতে চাই । কেউ কি আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে ?’ আপনমনে সে নিজেকে বলতো ।
ক্লাশের অন্যান্য সহপাঠীরা ডেভিড এবং আমাকে একহাত নিতো । কিন্তু চাঁদের পাহাড়-পর্বত ও উপত্যকা এবং দৈত্যাকৃতি ভাসমান মেঘের আকৃতি ছিল আমাদের কাছে বড়বেশি শক্তিশালী ।
যাহোক, চাপিয়ে দেওয়া এসব বিচ্ছিন্নতা আমাদের মনে তেমন আঘাত হানতে পারেনি । বরং একটা প্রচন্ড অদৃশ্য শক্তি আমাদের তিনজনকে একত্রিত করে রেখেছিল । আমাদের আচার-আচরণ, অর্থাৎ ছন্দময় দোলনা-বিছানার দুলুনি, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমানে পুরস্কার হিসেবে মনে হয়েছে ।
‘আজ রাতে আমরা আমাদের হাত বাড়িয়ে দিবো এবং শক্তি আহরণের জন্য অ্যান্টিনার মতো আমাদের হাতের আঙুল শূণ্যে মেলে ধরবো,’ গভীর আবেগে ক্ল্যারিবেল ছলোছলো চোখ মেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বললো ।
আমরা তিনজনে দোলনা-বিছানায় থিতু হয়েছি । আমাদের মাঝখানে ক্ল্যারিবেল । বন্য পুস্পরাজির মাতাল গন্ধ আমাদের নাকে ভেসে আসে । আবেশে আমরা চোখের পাতা বন্ধ করি এবং দোলনা-বিছানার দুলুনির কাছে নিজেদের সম্পূর্ণ সমর্পণ করি । মনের আড়ালে আমরা অনুভব করি যে, আমাদের কাছে অলৌকিক কিছু ঘটবে । একটা কিছু ধরার জন্য ঠিক সময়ে আমরা হাত বাড়াই – এক টুকরো অদৃশ্য বিশ্বচরাচর, অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা । আমাদের মনে হয়, খন্ড খন্ড মেঘ যেন ঐশ্বরিক কোনো ক্ষমতা, তারকারাজি যেন ক্ষণিকের স্ফূর্লিঙ্গ এবং হাস্যোজ্জ্বল চাঁদ যেন ডুবে গেছে আকাশের আঁকাবাঁকা সড়কের আড়ালে । একসময় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমরা ঘন উজ্জ্বল আলোর বেষ্টনিতে আটকা পড়ে আছি । আমরা জানি, আমাদের দেহ নিশ্চিন্তে মহাশূণ্যে যাত্রা করেছে । আমরা যত দূরে ভেসে যেতে থাকি, আমাদের দোলনা ক্রমশঃ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে এবং একসময় একটা নিস্প্রভ বিন্দুতে পরিণত হয় । আমরা আমাদের স্কুল ভবন দেখতে পেয়েছি । ধনুক আকৃতির সূর্য্য উদয়ের মতো লাল রঙের ছাদ । সহপাঠীরা এসে হয়তো আমাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে । আমাদের অনুপস্থিতি অনুভব না করে কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ‘ওরা উন্মাদ ।’
হাত বাড়িয়ে আমরা তিনজন আলোর গতিতে দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছি ।
লেখক পরিচিতিঃ
জিওভানা রিভেরো
বলিভিয়ার সমকালীন কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত নারী লেখক জিওভানা রিভেরো । তিনি একাধারে ছোটগল্প লেখক, ঔপন্যাসিক, অধ্যাপিকা এবং সাংবাদিক । তবে গল্পকার হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিত । তার জন্ম সান্তা ক্রুজের মন্টেরো শহরে, ১৯৭২ সালে । তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া থেকে মাষ্টার্স এবং লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন । তাঁর পাঁচটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । এগুলো হলো: ‘নেইমিং দ্য একৌ’ (১৯৯৪), ‘দ্য বিষ্টস্’ (১৯৯৭), ‘দ্য ঔনার অফ আওয়ার ড্রিমস্’ (২০০২), ‘টাচিং ডার্কনেস’ (২০০২) এবং ‘অ্যাগেইন্ষ্ট দ্য মুন’ (২০০৫) । একই বছর তিনি ‘দ্য বিষ্টস্’ ছোটগল্প সংকলনের জন্য ‘সান্তা ক্রুজ মিউনিসিপ্যাল প্রাইজ ফর লিটারেচার’ লাভ করেন । এছাড়া উৎকৃষ্ট মানের লেখালেখির জন্য তিনি একাধিক পুরস্কার অর্জণ করেন । ‘দ্য ক্যামীলিঅ্যানস্’ (২০০২) এবং ‘নাইন্টি-এইট সেকেন্ডস্ উইথআউট শেইড্’ (২০১৪) উপন্যাস রচনা করেন । ‘নাইন্টি-এইট সেকেন্ডস্ উইথআউট শেইড্’ উপন্যাস প্রকাশের পরপরই তার নাম আন্তর্জাতিক পাঠক মহলে ছড়িয়ে পড়ে । সাহিত্য রচনা ছাড়াও তিনি স্থানীয় এবং জাতীয় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন । মেক্সিকোর ‘গুয়াদালাজারা বুক ফেয়ার’ ২০১১ সালে তাঁকে পঁচিশ জন লাতিন আমেরিকার ক্ষমতাধর লেখক/লেখিকার তালিকায় নির্বাচন করে । বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ সান্তা ক্রুজ ডে লা সিয়েরাতে অধ্যাপনা করেন ।
0 মন্তব্যসমূহ