অনুবাদ : ফজল হাসান
এ হলো বোর্হেস, অন্যজন, যা সচরাচর দেখা যায় । আমি বুয়েন্স আয়ারসের রাস্তায় হাঁটি । হয়তো যাণ্ত্রিক ভাবে এখন থেমেছি এবং প্রবেশ পথের খিলান এবং দরোজার ভেতরের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছি । আমার হাতে ডাকযোগে বোর্হেসের সংবাদ এসে পৌঁছেছে, অথবা আমি তার নাম শিক্ষকদের নামের তালিকায় কিংবা জীবনীমূলক কোনো পুস্তকে দেখেছি ।
আমার অভিজ্ঞতা সমূহ সময়ের নিক্তি, মানচিত্র, সপ্তদশ শতাব্দীর ছাপাখানার মুদ্রাক্ষর, শব্দ প্রকরণ শাস্ত্র, কফির স্বাদ এবং রবার্ট লুইস স্টিভেন্সনের গদ্যসাহিত্যে পরিণত হয়েছে । পছন্দের এসব জিনিসগুলো বোর্হেস মামুলি ভাবে ভাগাভাগি করেছেন । কিন্তু ওগুলো অভিনেতার পোশাকের মতো দৃষ্টিনন্দন হয়েছে । হয়তো কথাটা বাড়িয়ে বলার মতো শোনাবে যে, আমাদের সম্পর্কটা তিক্ততায় ভরা । আমি বেঁচে আছি এবং বেঁচে থাকার জন্য আমাকে আমি প্রতিনিয়ত সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি । তার কারণ হলো বোর্হেস যেন সাহিত্য চর্চার কলেবর প্রসারিত করতে পারেন । তার সাহিত্য রচনায় আমার পূর্ণ সমর্থন আছে । আমি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিচ্ছি যে, নির্ভুল কয়েক পৃষ্ঠা সে-ই লিখেছে । কিন্তু সেসব পৃষ্ঠাগুলো আমাকে রক্ষা করতে পারবে না । কেননা লেখার মধ্যে যেসব ভালো জিনিস রয়েছে, তা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এমনকি অন্য মানুষটিরও নয় । বরং তা স্বয়ং ভাষা কিংবা প্রথাগত নিয়মের এক্তিয়ারভুক্ত।
এসবের বাইরে আমি পুরাদস্তুর এবং অপরিহার্য ভাবে নিঃশেষিত । বিস্মৃতি এবং কিছু ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত শুধু আমার জন্য, যা অই লোকটির মধ্যে বেঁচে আছে । যদিও আমি জানি, সবকিছু সে বিকৃত ভাবে তছনছ করে এবং সে যা না, তার থেকে বেশি বলে, তবুও আমি একটু একটু করে আমার সত্ত্বার সবটুকু তার মধ্যে উজাড় করে দিচ্ছি । স্পিনোজা বিশ্বাস করতেন যে, প্রয়োজনে সবকিছুই তার নিজের মতো করে থাকবে, যেমন পাথরের ইচ্ছে অনন্তকাল সে পাথর হয়েই থাকবে এবং বাঘ বাঘের মতোই থাকবে। আমি বোর্হেসের মধ্যে টিকে থাকবো, আমার মধ্যে নয় (আদৌ আমি যদি কেউ একজন হই)। যাহোক, অন্যদের গ্রন্থের তুলনায় আমি তার গ্রন্থের মধ্যে আমাকে খুঁজে পাই । বস্তি কিংবা শহরতলীর পুরাণ কাহিনী থেকে আমি সরে এসে সময় এবং অসীমের খেলায় মেতে উঠেছি । কিন্তু সেই সব খেলা
এখন বোর্হেসের । তাই আমাকে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে হবে । আমার জীবন দোদুল্যমান, স্মৃতিভ্রম । ধীরে ধীরে আমার মধ্যে আমি হারিয়ে যাচ্ছে এবং আমার কাছে সবকিছুই আতংকিত মনে হচ্ছে । আমার সবকিছু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, অথবা অন্য লোকটির হাতের মুঠোয় তালুবন্দি হচ্ছে ।
আমি নিশ্চিত নই, আমাদের দু’জনের মধ্যে কে এই লেখা লিখেছে ।
লেখক পরিচিতি:
এ হলো বোর্হেস, অন্যজন, যা সচরাচর দেখা যায় । আমি বুয়েন্স আয়ারসের রাস্তায় হাঁটি । হয়তো যাণ্ত্রিক ভাবে এখন থেমেছি এবং প্রবেশ পথের খিলান এবং দরোজার ভেতরের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছি । আমার হাতে ডাকযোগে বোর্হেসের সংবাদ এসে পৌঁছেছে, অথবা আমি তার নাম শিক্ষকদের নামের তালিকায় কিংবা জীবনীমূলক কোনো পুস্তকে দেখেছি ।
আমার অভিজ্ঞতা সমূহ সময়ের নিক্তি, মানচিত্র, সপ্তদশ শতাব্দীর ছাপাখানার মুদ্রাক্ষর, শব্দ প্রকরণ শাস্ত্র, কফির স্বাদ এবং রবার্ট লুইস স্টিভেন্সনের গদ্যসাহিত্যে পরিণত হয়েছে । পছন্দের এসব জিনিসগুলো বোর্হেস মামুলি ভাবে ভাগাভাগি করেছেন । কিন্তু ওগুলো অভিনেতার পোশাকের মতো দৃষ্টিনন্দন হয়েছে । হয়তো কথাটা বাড়িয়ে বলার মতো শোনাবে যে, আমাদের সম্পর্কটা তিক্ততায় ভরা । আমি বেঁচে আছি এবং বেঁচে থাকার জন্য আমাকে আমি প্রতিনিয়ত সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি । তার কারণ হলো বোর্হেস যেন সাহিত্য চর্চার কলেবর প্রসারিত করতে পারেন । তার সাহিত্য রচনায় আমার পূর্ণ সমর্থন আছে । আমি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিচ্ছি যে, নির্ভুল কয়েক পৃষ্ঠা সে-ই লিখেছে । কিন্তু সেসব পৃষ্ঠাগুলো আমাকে রক্ষা করতে পারবে না । কেননা লেখার মধ্যে যেসব ভালো জিনিস রয়েছে, তা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এমনকি অন্য মানুষটিরও নয় । বরং তা স্বয়ং ভাষা কিংবা প্রথাগত নিয়মের এক্তিয়ারভুক্ত।
এসবের বাইরে আমি পুরাদস্তুর এবং অপরিহার্য ভাবে নিঃশেষিত । বিস্মৃতি এবং কিছু ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত শুধু আমার জন্য, যা অই লোকটির মধ্যে বেঁচে আছে । যদিও আমি জানি, সবকিছু সে বিকৃত ভাবে তছনছ করে এবং সে যা না, তার থেকে বেশি বলে, তবুও আমি একটু একটু করে আমার সত্ত্বার সবটুকু তার মধ্যে উজাড় করে দিচ্ছি । স্পিনোজা বিশ্বাস করতেন যে, প্রয়োজনে সবকিছুই তার নিজের মতো করে থাকবে, যেমন পাথরের ইচ্ছে অনন্তকাল সে পাথর হয়েই থাকবে এবং বাঘ বাঘের মতোই থাকবে। আমি বোর্হেসের মধ্যে টিকে থাকবো, আমার মধ্যে নয় (আদৌ আমি যদি কেউ একজন হই)। যাহোক, অন্যদের গ্রন্থের তুলনায় আমি তার গ্রন্থের মধ্যে আমাকে খুঁজে পাই । বস্তি কিংবা শহরতলীর পুরাণ কাহিনী থেকে আমি সরে এসে সময় এবং অসীমের খেলায় মেতে উঠেছি । কিন্তু সেই সব খেলা
এখন বোর্হেসের । তাই আমাকে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে হবে । আমার জীবন দোদুল্যমান, স্মৃতিভ্রম । ধীরে ধীরে আমার মধ্যে আমি হারিয়ে যাচ্ছে এবং আমার কাছে সবকিছুই আতংকিত মনে হচ্ছে । আমার সবকিছু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, অথবা অন্য লোকটির হাতের মুঠোয় তালুবন্দি হচ্ছে ।
আমি নিশ্চিত নই, আমাদের দু’জনের মধ্যে কে এই লেখা লিখেছে ।
লেখক পরিচিতি:
দক্ষিণ আমেরিকা, তথা লাতিন আমেরিকার, সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য যেসব কথাসাহিত্যিক বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে হোর্হে লুইস বোর্হেস অন্যতম । তার পোশাকী নাম হোর্হে ফ্রান্সিসকো ইসিদোরো লুইস বোর্হেস আচেভেদো । তিনি ১৮৯৯ সালের ২৪ আগষ্ট বুয়েন্স আয়ার্সের এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯১৪ সালে তিনি পরিবারের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে গমণ করেন এবং পরবর্তীতে স্পেনে যান । সেখানে তিনি কয়েক বছর বসবাস করে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন এবং সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন । তিনি ১৯৫৫ সালে আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল পাবলিক লাইব্রেরীর পরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন এবং পরবর্তীতে ইউনিভর্সিটি অফ বুয়েন্স আয়ারসের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন । তার ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য গার্ডেন অফ দ্য ফর্কিং পাথস্’ (১৯৪১), ‘আর্টিফিসেস’ (১৯৪৪), ‘দ্য আলেফ’ (১৯৪৯), ‘দ্য মেকার’ (১৯৬০), ‘ব্রডি’স রিপোর্ট’ (১৯৭০), ‘দ্য বুক অফ স্যান্ড’ (১৯৭৫) এবং ‘শেক্সপিয়ার’স মেমোরী’ (১৯৮৩) । তার প্রায় সব গল্পই সাদামাটা বিষয় নিয়ে, যেমন বিভ্রান্তিকর অবস্থা, কল্পকাহিনী, আরশী, দর্শণ এবং ধর্ম । মৌলিক লেখা ছাড়াও তিনি বিশ্বনন্দিত লেখকদের, বিশেষ করে এডগার এলান পো, ফ্রাঞ্জ কাফকা, হারমেন হেসে, রুডইয়ার্ড কিপলিং, উইলিয়াম ফকনার, ওয়াল্ট হুইটম্যান এবং ভার্জিনিয়া উলফ্, বিভিন্ন লেখা অনুবাদ করেন । যদিও তিনি ইংরেজি, লাতিন, ফরাসি, ইতালিয়ান এবং জার্মান ভাষা জানতেন, কিন্তু সাহিত্য রচনা করেছেন মাতৃভাষায়, অর্থাৎ স্পেনীয় ভাষায় ।
১৯৬১ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের পর তার সাহিত্য কর্ম পাঠক ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই বিশ্ব জুড়ে তার জীবনে খ্যাতি এসেছিল অনেক দেরিতে, কিন্তু সেই খ্যাতি ছিল নিশ্চিত এবং স্থায়ী। বলা হয়, তাকে নিয়ে এবং তার সাহিত্য কর্ম নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এত বেশি আলোচনা-সমালোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং গবেষণাপত্র রচিত হয়েছে যে সেগুলোর সঠিক সংখ্যা জানা অসম্ভব । সমালোচকদের মতে তিনি লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ভূবনে একটা বিশাল স্তম্ভ । নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী লেখক । তার লেখা লাতিন আমেরিকার পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেককেই দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছে । তার সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক জে এম কোয়েৎজি বলেছেন, ‘অন্যদের তুলনায় তিনি স্পেনীয় কথাসাহিত্যের ভাষাকে পরিমার্জিত করেছেন, যার ফলে স্পেনীয়-আমেরিকান কথাসাহিত্যে এক শ্রেনীর লেখকদের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।’ ষাট বছর পূর্তির আগেই তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান । তিনি যকৃৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৬ সালের ১৪ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইহলোক ত্যাগ করেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘পরপারবাসীদের আলাপচারিতা’ গল্পটি হোর্হে লুইস বোর্হেসের ইংরেজিতে অনূদিত ‘এ ডায়লগ বিটুইন ডেড মেন’ গল্পের অনুবাদ । অন্যদিকে ‘বোর্হেস এবং আমি’ গল্পটি হোর্হে লুইস বোর্হেসের ইংরেজিতে অনূদিত ‘বোর্হেস অ্যান্ড আই’ ছোটগল্পের অনুবাদ । স্পেনিশ ভাষা থেকে গল্প দুটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এন্ড্রু হার্লি এবং ১৯৬০ সালে প্রকাশিত লেখকের ‘দ্য মেকার’ গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল । পরবর্তীতে গল্প দুটি ‘কালেক্টেড ফিকসিওনেস্ অফ হোর্হে লুইস বোর্হেস’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয়
গল্পসূত্রঃ ‘পরপারবাসীদের আলাপচারিতা’ গল্পটি হোর্হে লুইস বোর্হেসের ইংরেজিতে অনূদিত ‘এ ডায়লগ বিটুইন ডেড মেন’ গল্পের অনুবাদ । অন্যদিকে ‘বোর্হেস এবং আমি’ গল্পটি হোর্হে লুইস বোর্হেসের ইংরেজিতে অনূদিত ‘বোর্হেস অ্যান্ড আই’ ছোটগল্পের অনুবাদ । স্পেনিশ ভাষা থেকে গল্প দুটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এন্ড্রু হার্লি এবং ১৯৬০ সালে প্রকাশিত লেখকের ‘দ্য মেকার’ গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল । পরবর্তীতে গল্প দুটি ‘কালেক্টেড ফিকসিওনেস্ অফ হোর্হে লুইস বোর্হেস’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয়
0 মন্তব্যসমূহ