অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন
ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটছি, পথের কোথাও গাছের ছায়া পর্যন্ত দেখলাম না, চারাগাছ কিংবা শেকড়বাকড়ও নেই। এতক্ষণে কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছি। ভেবেছিলাম, ফাটল-ধরা ধূ ধূ প্রান্তরের কোনো কিনারা খুঁজে পাবো না; পেলেও দেখা যাবে সেখানে কিছুই নেই। কিন্তু কিছু একটা পেলাম বটে। গ্রাম আছে, আমরা শুনতে পেলাম কুকুর ডাকছে, মানুষের গন্ধ মিশে ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসছে, যেন একটা আশা এখনো টিকে আছে। তবে গ্রামটি এখান থেকে এখনো বেশ খানিকটা দূরে, ঝড়ো বাতাসের টানে কাছে বলে মনে হচ্ছে।
আমরা সেই ভোরে সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা শুরু করেছি। এখন বিকেল চারটার একটু এদিক-সেদিক হবে। আমাদের একজন আকাশের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়, সূর্য যেখানে ছবির মতো সেঁটে আছে সেখানে চোখটা কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘বেলা চারটে হবে বোধহয়।’
সেই একজন মেলিতোন। আমরা মানে আমি ফাউস্তিনো, এস্তেবান আর আমি তার সঙ্গে আছি। মোটের ওপর চারজন টিকে আছি। তাকিয়ে দেখলাম: সামনে দুজন, পেছনে দুজন। পেছনে যতদূর চোখ যাই তাকিয়ে দেখি, আর কাউকে দেখা যায় না। ‘আর মাত্র চারজন!’- নিজেকেই নিজে বললাম আমি। কিছুক্ষণ আগেই, এগারটার দিকে একুশ জন ছিলাম, কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঝরে গিয়ে চারজনে দাঁড়িয়েছি।
‘বোধহয় বৃষ্টি নামবে’- ফাউস্তিনো বলল।
আমরা তৎক্ষণাৎ উপরের দিকে তাকাই, দেখি, মাথার ওপর দিয়ে ঘন কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ভাবলাম, বৃষ্টি হলেও হতে পারে।
আমরা কে কি ভাবছি তা আর প্রকাশ করি না। কিছুক্ষণ আগে আমরা কথা বলার আগ্রহ হারিয়েছি। এটা হয়েছে অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে। অন্যকোথাও হলে আগ্রহ নিয়েই কথা বলা যেত, কিন্তু এখানে সেটা করা বেশ কঠিন। এখানে কথা বলতে গেলে ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, জিহ্বাও শুস্ক হয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। যে কারণে কেউ কথা বলার আগ্রহ দেখায় না।
বড়সড় একটা বৃষ্টির ফোটা পড়ল। বালিতে একটা সাময়িক গর্ত হয়ে গেল, শুকিয়ে যাওয়ার পর থুতুর মতো দাগ হয়ে গেল। এই একফোটাই। আমরা ভেবেছিলাম এবং চেয়েছিলাম আরো পড়বে। আমাদের চোখগুলো মেলে দিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি আরো আরো বৃষ্টিফোটা। কিন্তু চিহ্নটুকুও পেলাম না। বৃষ্টি হল না। এখন আকাশে তাকালে দেখা যাচ্ছে মেঘগুলো বাতাসের আগে আগে হুড়মুড় করে পালাচ্ছে। গ্রামের দিক থেকে আসা বাতাস মেঘপুঞ্জকে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে। যে-বৃষ্টিফোটা ভুল করে এখানে পড়ে গেছে, তাকে সবশুদ্ধ চেটেপুটে নিয়েছে ধরনি।
কোন সে শয়তান এমন এমন বিশাল একটা প্রান্তর তৈরি করেছে? কি দরকার ছিল, শুনি?
আমরা ফের হাঁটতে শুরু করেছি। বৃষ্টি হবে ভেবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। বৃষ্টি তো হল না! এখন আবার হাঁটছি। যতটা পেরিয়ে এসেছি, তার চেয়েও বেশি হেঁটেছি বলে আমার মনে হয়। হঠাৎই এসব মনে হয় আমার। বৃষ্টি হলে আরো কিছু মনে হত হয়ত। যতদূর মনে পড়ে, এই ফাঁকা প্রান্তরে আমি কোনদিনই বৃষ্টি হতে দেখিনি।
না, এই প্রান্তহীন জমি কোনো কাজের না। এখানে কোনো খরগোস কিংবা পাখি নেই। কতগুলো গাছ আছে মৃত শরীর নিয়ে, আর মাঝে মাঝে কিছু ঘাস গজিয়ে ওঠার আগেই শুকিয়ে শক্ত হয়ে মাটি এঁটে পড়ে আছে। এসব বাদ দিলে কিছুই নেই এখানে।
পূর্বে আমরা এখানে ঘোড়াই চড়ে বের হতাম। কাঁধে থাকত রাইফেল। এখন রাইফেলও নেই সঙ্গে।
আমি সবসময় ভেবেছি, তারা আমাদের রাইফেলগুলো ছিনিয়ে নিয়ে ভালোই করেছে। এই অঞ্চলে ওটা সঙ্গে রাখা বিপজ্জনক। রাইফেলসহ দেখলে হুমকি-ধামকি দেয়ার আগেই গুলি চালিয়ে দিত। তবে ঘোড়ার কথা আলাদা। সঙ্গে ঘোড়া থাকলে অনেক আগেই আমরা হয়ত নদীর সবুজ পানি পান করে শরীর ঠা-া করতাম এবং পেট জুড়িয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতাম। এসবই হত যদি আমাদের ঘোড়াগুলো সঙ্গে থাকত। কিন্তু ওরা রাইফেলগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলোও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
আমি প্রান্তরের এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখি। এত ছড়িয়ে থাকা জমি, অথচ কোনো কাজেরই না। কিছুই দেখার মতো না পেয়ে দৃষ্টি পিছলে পিছলে যায়। কেবল কতিপয় গিরগিটি গর্ত থেকে মাথা বের করে সূর্যের হাবসাব ভুজে নিয়ে আড়ালে চলে যায়। কিন্তু আমাদের যখন এখানে কাজ করতেই হবে তখন আমরা কি আর করব? কিন্তু আমাদের তো করে খাওয়ার জন্যে এই ধু ধু প্রান্তরই দেয়া হয়েছে!
ওরা বলেছে, ‘এখান থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব জমিন তোমাদের।’
‘এই পোড়া মাঠ?’ আমরা জিজ্ঞেস করেছি।
‘-হ্যাঁ, তাই। এই মস্তবড় প্রান্তর।’
আমরা বলতে চেয়েছি, এই প্রান্তর আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা যা চাই সেটি হল নদীর কাছাকাছি চাষযোগ্য জমি। নদীর ওপাশের সবুজ প্রাণযুক্ত জমি। এই শক্ত মষের চামড়া নয়, আপনারা যাকে প্রান্তর বলেন।
কিন্তু ওরা আমাদের এসব কথা বলার সুযোগ দেয়নি। উচ্চপদস্থ আমলাটি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসেনি। সে আমাদের হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘অত অত জমি নিজেদের করে পাচ্ছ বলে ভয় পেয়ে যেও না যেন।’
‘কিন্তু, সেনিওর, প্রান্তটা যে...!’
‘কয়েক হাজার একর জমি আছে এখানে।’
‘কিন্তু এখানে তো পানি নেই। গলা ভেজানোর জন্যে একঢোক পানিও নেই।’
‘বর্ষাকাল তো আছেই। তাছাড়া কেউ তোমাদের কথা দেয়নি যে তোমরা চাষের জমি পাবে। যে-মাত্রই বৃষ্টি হবে, দেখবে ভুট্টা গজিয়ে উঠেছে, যেন তাদের মাটি থেকে টেনে বের করে আনা হয়েছে।’
‘কিন্তু সেনিওর, জমিটা খুব শক্ত, জল ধরে রাখতে পারে না। মনে হয় না, এই পাথুরে জমিতে চাষ করা সম্ভব। কোঁদাল দিয়ে গর্ত করে করে বীজ বপণ করতে হবে, তাতেও কিছু হলে তো!’
‘তোমরা সেটা আবেদনপত্রে লেখো। এখন কেটে পড়ো। তোমাদের উচিত জাদরেল সব মালিককে আক্রমণ করা, যে সরকার জমি দিচ্ছে তাকে নয়।’
‘দেখুন, সেনিওর, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। বলেছি এই প্রান্তরের বিরুদ্ধে। কাজের অবস্থায় না থাকলে, আপনি কাজ করবেনই বা কি করে- আমরা শুধু এই আবেদনটুকু করতে চাচ্ছি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনুন আমরা কি বলতে চাই। আসুন ফের শুরু থেকে আলাপটা শুরু করি...।’
কিন্তু তিনি আমাদের কথায় গা করলেন না।
তো, ওরা আমাদের এই জমি দিয়েছে। আর এই তপ্ত পৃথিবীপৃষ্ঠে ওরা চায় আমরা কিছু বুনি, দেখতে চায় কোনো কিছু আদৌতে গজায় কিনা। কিন্তু এ মাটি থেকে কোনো কিছুই বের করে আনা সম্ভব নয়। এমনকি বাজপাখিও এখানে দেখবে না। তাদের তুমি দেখবে খুব উঁচুতে তড়িঘড়ি করে উড়ে যাচ্ছে, যত শীঘ্রি সম্ভব এই অভিশপ্ত জমি থেকে পালিয়ে যেতে। এখানে তুমি এমনভাবে হাঁটো যেন পদে পদে পা পিছলে পেছনে ফিরে যাচ্ছ।
‘এই জমিটা ওরা আমাদের দিয়েছে,’ মেলিতোন বলে।
ফাউস্তিনো জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’
আমি কিছু বলি না। কেবল ভাবি, ‘মেলিতোনের মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। অতিরিক্ত তাপে সে এসব কথা বকে যাচ্ছে। ওরা আমাদের কেমন জমি দিয়েছে মেলিতোন? এখানে তো বাতাসের জন্যও কিছু নেই যে মেঘ ওড়াবে।’
মেলিতোন আবার বলে, ‘কোনো না কোনো কাজে লাগবে নিশ্চয়। আর কিছু না হলেও, ঘোড়া তো ছোটানো যাবে।’
‘কোন ঘোড়া?’ এস্তেবান জানতে চায়।
আমি এস্তেবানকে খুব একটা খুটিয়ে দেখিনি। এখন যখন সে কথা বলল, আমি তার দিকে তাকালাম। সে একটা জাকেট পরে আছে যেটি তার পেট পর্যন্ত নেমেছে। আর জ্যাকেটের তলা থেকে উঁকি মারছে মুরগির মাথার মতো কিছু একটা।’
‘এই তেবান, তুমি এই মুরগিটা কোথায় পেলে?’
‘মুরগিটা আমার,’ সে বলে।
‘আগে তো ছিল বলে মনে হয় না। কোথা থেকে জোটালে, শুনি?’
‘কিনি নি। আমার নিজের বাড়ির।’
‘খাওয়ার জন্যে এনেছ নিশ্চয়?’
‘না, তার দেখভাল করার জন্যে সঙ্গে নিয়েছি। আমি চলে আসার সময় বাড়িটা খালি হয়ে গিয়েছিল, ওকে খাওয়ানোর মতো কেউ ছিল না। আমি যখনই দূরে কোথাও যাই, ওকে সঙ্গে রাখি।’
‘ওভাবে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাকে বাইরে আনো, বাতাস নিক।’
সে তাকে বগলদাবা করে তার গায়ে ফুঁ দিয়ে বলে, ‘আমরা প্রায় টিলায় পৌঁছে গেছি।’
এস্তেবানের কথা আমি আর শুনতে পাই না। আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছি টিলায় নামার জন্যে, এস্তেবান সবার আগে আছে। সে মুরগির পা দুটো ধরে এদিক-সেদিক দোলাচ্ছে যাতে করে পাথরে ওর মাথায় বাড়ি না লাগে। যত নিচে নামি, জমিন তত ভালো ঠেকে। আমাদের শরীর ধুলোয় ঢেকে যায়। শক্ত পোড়া জমিতে এগারো ঘণ্টা ধরে হাঁটার পর আমাদের নরম ধুলোমাখা মাটির স্বাদ গায়ে মেখে যেন আরাম লাগে।
নদীর ওপরে, কাজুবাদাম গাছগুলোর সবুজ ডগার ওপর দিয়ে একদল সবুজ চাচালাকা উড়ে যায়, তাও আমাদের ভালো লাগে।
এখন আমরা নিকটে কোথাও কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শুনতে পাই। আমরা একটা বাড়িতে পৌঁছুলে এস্তেবান তার মুরগিটার পা খুলে দেয় যাতে সে তার পাদুটোকে অনুভব করতে পারে। তারপর মুরগিটা উধাও হয়ে যায় ঝোপের আড়ালে।
‘এখানেই আমি থামছি’, এস্তেবান আমাদের উদ্দেশ্য করে বলে।
আমরা গ্রামের আরো ভেতরে ঢুকে পড়ি।
যে জমিটা ওরা আমাদের দিয়েছে, সেটি এখন পড়ে আছে পেছনে- সেখানেই।
সূত্র : উত্তরাধিকার
0 মন্তব্যসমূহ