মূলঃ ক্লারিস লিসপেক্তর
অনুবাদঃ ফজল হাসান
ওরা দু’জন পরস্পর কথা বলার চেয়ে বিড়বিড় করে বেশি । সম্প্রতি ছেলে এবং মেয়েটির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । তাই এই মুহূর্তে ওরা দু’জনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে । এক কথায় ওরা উভয়েই প্রেমের উত্তাল সাগরে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছে । প্রেমের সঙ্গে কি জড়িয়ে থাকে? ঈর্ষা ।
- ঠিক আছে । আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, আমিই তোমার জীবনে প্রথম প্রেম । এই বিশ্বাস আমাকে সুখি করে তুলেছে । কিন্তু সত্যি করে বলো তো, আমাকে চুমু খাওয়ার আগে তুমি অন্য কোনো নারীকে চুমু খাওনি ? মেয়েটি সরাসরি প্রশ্ন করে ।
ছেলেটির কাছে প্রশ্নটি খুবই সহজ এবং সে উত্তরও জানে ।
- হ্যাঁ, আমি আগে একজন মহিলাকে চুম্বন করেছিলাম ।
- কে ছিল ? দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মেয়েটি পুনরায় জিজ্ঞেস করে ।
ছেলেটি স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করে, কিন্তু সে জানে না কিভাবে তার বলা উচিত ছিল ।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে ট্যুর বাস ধীর গতিতে ওপরে উঠতে থাকে । বাসের ভেতর ছেলেটির আশেপাশে অন্যান্য ছেলেমেয়েরা খোশগল্পে মশগুল । খোলা জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস এসে তার চোখেমুখে আলতো পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে এবং পরবর্তীতে চুলের ওপর ঢেউ খেলে খোলা হাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে । তার কাছে মনে হয়, যেন কোনো মা তার নরম আঙুল দিয়ে সন্তানের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন । বেশির ভাগ সময় ছেলেটি চুপচাপ থাকে । তখন সে কিছুই ভাবে না, শুধু মুহূর্তগুলো অনুভব করার চেষ্টা করে এবং মনের মধ্যে সে একধরনের সুখের অনুভূতি উপলব্ধি করে । বন্ধুবান্ধবদের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে মনোযোগের সঙ্গে ভালো লাগার সূক্ষ অনুভূতি উপলব্ধি করা তার কছে খুবই কঠিন কাজ বলে মনে হয় ।
ছেলেটির ভেতর জগতে তেষ্টার ইচ্ছেটা প্রবল হতে থাকে । একসময় সে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কৌতুক করে, এমনকি কন্ঠস্বর উপরে তুলে কথা বলে, যা মোটরের ঘর্ঘর শব্দকে ছাপিয়ে যায় এবং হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হয় । কখনও সে চোখের পাতা বন্ধ করে সুখানুভূতির পরশ উপলব্ধি করে । সে ভেবে পায়নি, কেমন করে তার গলা শুকিয়ে কারবালা হয়ে গিয়েছিল ।
না, গলা ভেজানোর জন্য পানির প্রয়োজনীয়তার কোনো আভাস-ঈঙ্গিত ছিল না । তবে তার তৃষ্ণা নিবারণের সমাধান ছিল মুখের ভেতর লালা জমানো এবং সে-ই কাজই সে করেছে । উত্তপ্ত মুখের ভেতর লালা জমার পর সে ধীরে ধীরে গলাধঃকরণ করে । তারপর একবার নয়, বরং বারবার একই কাজ করেছে । তার মুখের লালা বেশ গরম ছিল এবং সেই গরম লালা তার তেষ্টা মেটাতে পারেনি । তার প্রচন্ড তৃষ্ণা যেন দেহের চেয়ে বড় আকারের রূপ ধারণ করেছিল এবং সেই তৃষ্ণা ক্রমশ তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ।
যদিও কিছুক্ষণ আগে বাইরের বাতাস ছিল মনোরম, কিন্তু এখন মাথার ওপর গনগনে সূর্য্য । আশেপাশের হাওয়া শুষ্ক । প্রচন্ড ধৈর্য্য নিয়ে সে মুখের ভেতর যতটুকু লালা জমিয়েছিল, শুষ্ক বাতাস তার নাসারন্ধ্রে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তা নিমিষে শুকিয়ে যায় ।
ছেলেটি যদি নাক বন্ধ করে এবং মুখ দিয়ে মরুভূমির তপ্ত বাতাস বুকের ভেতর সামান্য টেনে নেয়, তাহলে ?
তবুও সে কয়েক সেকেন্ড সেই কাজ করার চেষ্টা করে । তার দম বন্ধ হয়ে আসে । সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো অপেক্ষা করা, শুধুই অপেক্ষা করা । হয়তো কয়েক মিনিট মাত্র, হয়তো কয়েক ঘন্টা । ইতিমধ্যে তার তৃষ্ণা এত বেশি লেগেছে যে, মনে হয় বছরের পর বছর ধরে তা জমে স্তুপ হয়েছে ।
ছেলেটি জানে না কেমন করে এবং কেন ? কিন্তু তার মনে হয় কাছাকাছি কোথাও সে পানির উপস্থিতি টের পেয়েছে এবং বড় বড় চোখ করে সে জানালার বাইরে রাস্তার উল্টোদিকে ঝোপঝাড়ের আড়ালে পানি খুঁজতে থাকে ।
তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা বন্য পশুর ধারনা মোটেও ভুল হয়নি । রাস্তার অপ্রত্যাশিত বাঁকের পরেই ঝোপঝাড়ের পেছনে সে একটা ঝরণা দেখতে পেল । সেই ঝরণা থেকে পানি পড়ছে ।
ঝরণার কাছে এসে বাস থামে । বাসের আরোহী সবাই প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত । ছেলেটি দৌঁড়ে সবার আগে ঝরণার কাছে গিয়ে পৌঁছে ।
তার চোখের পাতা বন্ধ । কিন্তু যেখান দিয়ে পানি পড়ছিল, সে সেই জায়গায় ঠোঁট দুটি সামান্য ফাঁক করে আলতো ভাবে রাখে । প্রথম ঢোক গেলার সময় গলা বেয়ে নিচে নেমে পানি তার পাকস্থলিতে গিয়ে পৌঁছে এবং পরমুহূর্তে সে পরম শান্তি অনুভব করে ।
তারপর ছেলেটি পরিতৃপ্তির সঙ্গে আরও পানি পান করে । একসময় সে ভাবে, পুনরায় সে জীবন ফিরে পেয়েছে । ধীরে ধীরে তার ক্লান্ত চোখের পাতা খুলতে থাকে ।
একসময় ছেলেটি চোখের পাতা সম্পূর্ণ খোলে এবং তাকিয়ে দেখে তার মুখের ঠিক ডান পাশেই একটা পাথরের মূর্তি । মূর্তির চোখ দুটি তার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । মূর্তিটি একজন নারীর । সেই নারী-মূর্তির মুখ দিয়েই পানি বের হচ্ছে । তার মনে পড়ে, সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম চুমুক পানি পান করার সময় ঝরণার ঠান্ডা পানির চেয়েও হিমশীতল কোনো কিছুর সঙ্গে তার ঠোঁট দুটির স্পর্শ লেগেছিল । তখনই সে বুঝতে পেরেছিল যে, পাথরের নারী-মূর্তির ঠোঁটের সঙ্গে তার ঠোঁটের ছোঁয়া লেগেছিল । মূর্তির ঠোঁট থেকে এক ঝলক বিদ্যুৎতরঙ্গ এসে যেন তার ঠোঁট কাঁপিয়ে দিয়েছিল । তারপর সেই বিদ্যুৎ-তরঙ্গ এক ঠোঁট থেকে অন্য ঠোঁটে ছোটাছুটি করেছিল ।
নিজের মূর্খতার জন্য ছেলেটি তাৎক্ষণিক ভাবে হতভম্ব হয় । আপনমনে ভাবে, সে হয়তো কোনো গোপন প্রণয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে । কিন্তু এ-তো সেই নারী নয়, যার কাছ থেকে অমৃত ধারা বেরিয়ে আসছে – যা জীবনকে সজীব করে তোলে । একসময় সে নিরাভরণ নারী-মূর্তির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।
পাথরের নারী-মূর্তির ঠোঁটে সে চুমু খেয়েছে ।
ছেলেটি সারা শরীরে একধরনের অদৃশ্য পুলক শিহরণ অনুভব করে, যা তার নিজের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছিল । এক অচেনা অনুভূতিতে তার দেহের শিরা-উপশিরার মধ্যে প্রবাহিত রক্তকণা টগবগ করতে থাকে । উত্তেজনায় তার মুখ যেন একখন্ড জ্বলন্ত কয়লা ।
ছেলেটি এক কদম পেছনে, নাকি সম্মুখে গিয়েছিল, তার কিছুই মনে নেই । সেই সময় সে রীতিমতো উত্তেজিত এবং আশ্চার্য্যান্বিত । তবে সে বুঝতে পেরেছিল যে, আগে তার শরীরের যে অংশটুকু নেতিয়ে থাকতো, ওটা-ও তুমুল উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে । তার জীবনে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনই ঘটেনি ।
ছেলেটি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে একাকী ঘামতে থাকে । তার বুকের ভেতর ধুকপুকানির শব্দ আরও দ্রুত হয় । সেই সময় জীবনটা তার কাছে আনকোরা এবং অন্যরকম মনে হয়েছে, যা সে শুধু তখনই উপলব্ধি করতে পেরেছে । দোদুল্যমান সেই পরিস্থিতিতে সে সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ।
ছেলেটির গভীর অনুভব থেকে একসময় সত্যটা বেরিয়ে আসে । তার চোখেমুখে এক অজানা ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে এবং একই সঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতির উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে । আগে সে এই অন্যরকম অনুভূতি কখনই অনুভব করেনি । সে ...
সে একজন পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে ।
লেখক পরিচিতিঃ
বিংশ শতাব্দীর পর্তুগীজ ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক এবং ফ্রাঞ্জ কাফকার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ইহুদী লেখক হিসাবে স্বীকৃত ব্রাজিলের নারী সাহিত্যিক ক্লারিস লিসপেক্তর (পোশাকী নাম খায়া পিঙ্খাশোভনা লিসপেক্তর) । তিনি ১৯২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চল এলাকার চেচেলনিক শহরে এক সম্ভ্রান্ত ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি দু’বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ব্রাজিলের অভিবাসী হন । মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি প্রথম উপন্যাস ‘নিয়ার টু দ্য ওয়াইল্ড হার্ট’ প্রকাশ করেন এবং ‘গ্রাসা আরানহা’ পুরস্কার অর্জণ করেন । এছাড়া ১৯৬১ সালে প্রকাশিত ‘অ্যাপেল ইন দ্য ডার্ক’ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘কারমেন ডোলোরিস বারবোসা’ পুরস্কার লাভ করেন । ‘ফ্যামিলী টাইজ’, ‘দ্য পেশান অ্যাকোর্ডিং টু জি এইস’, ‘দ্য ফরেন লিজিয়ন’, ‘এগুয়া ভিভা’ এবং ‘দ্য আওয়ার অফ দ্য স্টার’ তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস । ‘কোভার্ট জয়’, ‘দ্য স্ট্রিম অফ লাইফ’ এবং ‘হোয়্যার ওয়্যার ইউ অ্যাট নাইট’ তার ছোটগল্প সংকলন । তিনি এডগার এলান পো এবং অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা পর্তুগীজ ভাষায় অনুবাদ করেন । তাঁকে ‘নারী চেকভ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় । তিনি ১৯৭৭ সালের ৯ ডিসেম্বর ওভারিয়ান ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন ।
0 মন্তব্যসমূহ