সঞ্চালক : পেররো অলিভারেস
অনুবাদ : যুবায়ের মাহবুব
[দুর্লভ এই আলাপচারিতাটি স্প্যানিশ থেকে বাংলায় তর্জমা করেছেন প্রাবন্ধিক-অনুবাদক যুবায়ের মাহবুব। অনুবাদ কাজে সহায়তা করেছেন কবি-প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিন।]

ভূমিকা
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মৃত্যুর পর Foundation for New Latin American Journalism (FNPI) ৪২ বছর পুরনো একটি দুর্লভ ভিডিও প্রকাশ করে। ১৮ মিনিটের এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, সম্প্রচার করেছিল চিলির জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল। সে বছর অক্টোবর মাসে পাবলো নেরুদা নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জয় করেন। কবি সেই সময় ফরাসী রাজধানীতে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
পুরস্কার ঘোষণার দুদিনের মধ্যে প্যারিসে পৌঁছে যায় চিলি টিভির ফিল্ম ক্রু, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আউগুস্তো অলিভারেস। অলিভারেসের সার্বিক পরিচালনা এবং উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি ধারণ করা হয়।
ভিডিওটি দুর্লভ কারণ ল্যাটিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবি নেরুদা এবং শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক গার্সিয়া মার্কেসের একমাত্র ধারনকৃত কথোপকথন এটি। আমাদের জানা মতে ইংরেজি ভাষায়ও এর কোন অনুবাদ হয়নি – স্প্যানিশ থেকেই সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
নেরুদার বয়স তখন ৬৭, গার্সিয়া মার্কেসের বয়স ৪৪। বয়সের ব্যবধান স্বত্ত্বেও তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, দুজনের আন্তরিকতা এই ভিডিওতে পরিস্ফুট। গাবোর সূর্য তখন মধ্যগগনে, মাত্র চার বছর আগে প্রকাশ হয়েছে শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা, হিস্পানিক বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হতে শুরু করেছে। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব নেই – তার নিজের পুরস্কার আরো ১১ বছর দূরে হলেও এই সাক্ষাতকারে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে তিনিও একদিন নোবেল পাবেন!
গাবো আড্ডাটাকে মোটামুটি হালকাভাবে নিলেও নেরুদা বরাবরই আরো সিরিয়াস। মহাকবি তখন জীবনসায়াহ্নে পৌঁছেছেন – পুরস্কারের বছর তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এই অনুষ্ঠান ধারণের দুই বছরের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অনুষ্ঠানে চতুর্থ এক ব্যক্তি আছেন, যিনি সশরীরে না থাকলেও তার ছায়া রুমের ভেতর উপস্থিত। প্যারিসে রাষ্ট্রদূত পদে নেরুদাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন চিলির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আয়েন্দে। মহাদেশের ইতিহাসে কিংবদন্তীতুল্য এই ব্যক্তিত্বের সাথে ভিডিওর তিন চরিত্রের জীবনই কোন না কোনভাবে মিশে আছে। সেই পটভূমি নিয়ে দুটি কথা বলার অবকাশ আছে।
১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে অংশ নেয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নেরুদা। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং পপুলার ফ্রন্টের নেতা আয়েন্দের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। পেশায় চিকিৎসক আয়েন্দে ছিলেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম মার্কসবাদী রাষ্ট্রপতি। তার তিন বছরের শাসনামলে চিলির সমাজ ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। পদে পদে শোষিতের কথা বলতেন আয়েন্দে, এবং তাদের উন্নয়নের জন্যে বিরামহীন কাজ করতেন।
সাধারণ মানুষের কাছে উঁচুমানের সাহিত্য-সংস্কৃতি পৌঁছে দেয়াটাকেও গুরুত্বের সাথে দেখতেন তিনি। সরকারী প্রকাশনালয় থেকে বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রত্নগুলো সহজলভ্য পেপারব্যাক হিসেবে বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই বৃহত্তর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে এই কথোপকথনটি ধারণ ও সম্প্রচার করা হয় সরকারী প্রচার মাধ্যমে।
ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবান বিপ্লবের পর যেমনটা ঘটেছিল, পপুলার ফ্রন্ট সরকারের উত্থানও মহাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে। গার্সিয়া মার্কেস ব্যতিক্রম ছিলেন না – এই সাক্ষাৎকারে তিনি আয়েন্দে সরকারের কর্মকান্ডের জন্যে অকুন্ঠ প্রশংসা ব্যক্ত করছেন। আর অনুষ্ঠানের উপস্থাপক অলিভারেস ছিলেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতির নিকট বন্ধু এবং সহকর্মী। অলিভারেসের ডাকনাম ছিল (হয়তো তার মুখাবয়বের জন্যে) ‘পেররো’ বা ‘সারমেয়’। সবাই তাকে পেররো অলিভারেস বলেই জানতো। ডাকসাইটে সাংবাদিক ছিলেন তিনি, আয়েন্দের প্রশাসনে প্রেস এবং জাতীয় টিভির ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। সব বদলে যায় সেই কালো দিনে। সেদিন সকালে মার্কিন সিআইএ’র প্রত্যক্ষ সমর্থনে এবং জেনারেল আউগুস্তো পিনোশে’র নেতৃত্বে একটি ডানপন্থী মিলিটারী ক্যু সংঘটিত হয়। রাজধানী সান্তিয়াগোয় রাষ্ট্রপতির বাসভবন লা মোনেদা’য় সেনাদের অনবরত শেলিং চলে। অবরুদ্ধ প্রেসিডেন্ট শেষবারের মত তার দেশবাসীদের উদ্দেশ্যে রেডিও মারফত ভাষণ দেন। সরাসরি প্রচারিত ছয় মিনিটের সেই বিদায়ী ভাষণ শেষ হবার কিছুক্ষণ পর আয়েন্দে নিজের দিকে বন্দুক ঘুরিয়ে আত্মহত্যা করেন। ধারণা করা হয় যে একে-৪৭ রাইফেলটি তিনি উপহার পেয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো থেকে।
সেদিন পেররো অলিভারেস-ও ছিলেন লা মোনেদা’য়, রাষ্ট্রপতির বাসভবনের প্রতিরক্ষার জন্যে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু তার বন্ধু এবং সহকর্মীর মৃত্যুর পর তিনিও সিদ্ধান্ত নেন আত্মহননের। তার বয়স ছিল মাত্র ৪৩।
১২ দিন পর রাজধানীর সান্তা মারিয়া ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেন পাবলো নেরুদা। মৃত্যুর অফিশিয়াল কারণ প্রোস্টেট ক্যান্সার, কিন্তু জেনারেল পিনোশে যে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেনি, সেই সন্দেহ আজ অব্দি দূরীভূত হয়নি। বিতর্ক নিরসনের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে নেরুদার লাশ আবার কবর থেকে উত্তোলন করা হয়, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্যে।
বাকি থাকেন গার্সিয়া মার্কেস। এই ঘটনায় তিনি এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন পিনোশে ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন তিনি আরেকটি শব্দও লিখবেন না। গাবো অবশ্য পরে বলেন যে লেখালেখি থেকে বিরত থাকাটা আত্মঘাতী সেল্ফ-সেন্সরশিপেরই নামান্তর, এবং পুনরায় লেখা শুরু করেন। ক্যু-এর ছয় মাস পর ‘আয়েন্দে-কে কেন মরতে হলো’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রবন্ধ রচনা করেন, যেটি কয়েকটি দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটি তার শ্রেষ্ঠ নন-ফিকশন রচনাগুলোর অন্যতম।

অলিভারেস : শুভ সন্ধ্যা!
আমাদের আজকের পরিবেশনা একটি বিশ্ব এক্সক্লুসিভ। টেলিভিশনের পর্দায় আপনারা প্রথমবারের মতো মুখোমুখি দেখতে পাবেন দুজন মহান লেখককে। একজন কলম্বিয়ার স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, লিখেছেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা, আরো লিখেছেন বড় মার অন্ত্যেষ্টিগুলো এবং কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না-র মত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। অপরজন ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী চিলির কবি, আমাদের কবি পাবলো নেরুদা। বিশ্বসাহিত্যের দুই ব্যক্তিত্বের এক সাথে কোন টিভি অনুষ্ঠানে দুজনের উপস্থিতি আজই প্রথম। আমি জানি দর্শকরা তাদের কথোপকথনের বিস্তারিত শোনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তার আগে এই সাক্ষাতকারের নেপথ্যের কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
প্রথমত, গার্সিয়া মার্কেস বর্তমানে বসবাস করছেন কাতালুনইয়া, বার্সেলোনায়। পাবলো নেরুদা তার নোবেল বিজয় উপলক্ষ্যে প্যারিসে একটি ডিনারের আয়োজন করেছিলেন। সেই ডিনারে নেরুদার আমন্ত্রিত একজন বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিতে স্পানঞা থেকে আসেন গার্সিয়া মার্কেস। ডিনারে নেরুদার সঙ্গে আরো ছিলেন অবশ্যই তার স্ত্রী, ফরাসী লেখক রেজিস দেব্রে, গার্সিয়া মার্কেস চিলির চিত্রকর রবের্তো মাত্তা, বর্তমানে যিনি চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বসবাসরত, এবং সাহিত্য ও শিল্প জগত থেকে আরো কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সেই ডিনারের আনন্দঘন পরিবেশে নেরুদা এবং গার্সিয়া মার্কেসের যৌথ অংশগ্রহণে একটি সম্ভাব্য টিভি কথোপকথনের ব্যাপারে প্রথম আলাপ করা হয়। সেই অনুষ্ঠানটিই একটু পর আপনারা দেখবেন। নেরুদার নোবেল জয়ের ঘোষণার ৪৮ ঘন্টা পর আড্ডাটি ধারণ করা হয়েছিল।
গার্সিয়া মার্কেস বর্তমানে আরেকটি উপন্যাস লিখছেন, শিরোনাম গোত্রপিতার হেমন্ত। বইটি এক ধরনের জীবনী যাতে প্রচুর পরিমান ফিকশনের সাথে মিলেছে প্রচুর পরিমাণ বাস্তবতা। একজন ল্যাটিন আমেরিকান স্বৈরাচারীর জীবনী। গার্সিয়া মার্কেস বলেছেন যে মহাদেশের সনাতনী স্বৈরাচারীদের উপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছেন মূল চরিত্রটি – যেমন ভেনেসুয়েলার হুয়ান ভিসেন্তে গোমেস, গুয়াতেমালার হোর্হে উবিকো, (বা নিকারাগুয়ার আনাস্তাসিও) সমোসা।
এই মুহূর্তে বার্সেলোনায় তিনি যে আখ্যানটি লিখছেন তার শুরুতে বৃদ্ধ ডিক্টেটর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন যে প্রচুর হৈ-হুল্লোড়ের সাথে উৎসব পালিত হচ্ছে। তিনি ঘুরে তার পুলিশ প্রধানকে জিজ্ঞাসা করেন, এত হইচই কিসের? পুলিশ প্রধান জবাব দেন, আমরা আজ জন্মবার্ষিকী পালন করছি। স্বৈরাচারী বলেন, কিন্তু আজকে তো আমার জন্মদিন না। পুলিশ প্রধানের উত্তর – না, হুজুর, তবে আজ আপনার দেশশাসনের শতবর্ষ পূর্তি হলো, আমরা তাই উদযাপন করছি। ডিক্টেটর আনমনে বলেন, একটি শতাব্দী কত তাড়াতাড়িই না চলে যায়!
এভাবেই শুরু হচ্ছে মার্কেসের উপন্যাসটি যা আপনারা অচিরেই দেখতে পাবেন। মনে হচ্ছে শতবর্ষের নিঃসঙ্গতার মতোই একটা মহাকাব্যিক মাত্রা পাবে।
গার্সিয়া মার্কেম পাবলো নেরুদার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে কারণেই তিনি প্যারিসে আসেন, নেরুদার সাথে ডিনারে অংশ নেবেন বলে। তাদের মধ্যে কয়েকবার দীর্ঘ আলাপ হয়। সেই আড্ডাগুলোর একটিই এখন আপনারা দেখবেন, নেরুদা আলাপ করছেন কবিতা নিয়ে আর গার্সিয়া মার্কেজ বলছেন উপন্যাসে বিষয়ে।
কলম্বিয়ার বিস্ময়কর প্রতিভা গার্সিয়া মার্কেজ অন্যত্র বলেছেন যে তার আগের জীবনের কোন কর্মকাণ্ডে যদি ফিরে যাওয়ার অবকাশ থাকতো, তাহলে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় প্রত্যাবর্তন করতেন। আজ তিনি এখানে লেখক পরিচয়ে এসেছেন, কিন্তু তারপরও আমরা তাকে অনুরোধ করবো ক্ষণিকের জন্যে হলেও তার সাংবাদিক সত্তায় ফিরে যেতে, আমাদের নোবেল বিজয়ী কবি নেরুদার সাথে আলাপনের লক্ষ্যে। গাব্রিয়েল, আপনি বলুন..
গার্সিয়া মার্কেস :
সাংবাদিকদের বেলায় সেই বিখ্যাত উক্তিটা সবারই জানা, আপনি তাদের বলবেন এক কথা কিন্তু তারা লিখবে আরেক কথা। আমি যা বলেছি বা যেটা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা হলো সাংবাদিকতার পেশায় বিশেষ করে ‘রিপোর্টার’ হিসেবে ফিরে যাওয়া। কারণ আমার কাছে মনে হয় যে একজন লেখক সাহিত্যচর্চায় যত অগ্রসর হন, জীবনের সাধারণ বাস্তবতার সাথে তার সম্পর্ক তত ক্ষীণ হতে থাকে। কিন্তু আপনি যখন রিপোর্টার হিসেবে কাজ করবেন, এই আটপৌরে বাস্তবতার সাথে আপনাকে মুখোমুখি হতে হবে প্রতিদিন, দিনের পর দিন।
এখন এই দূরত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া যদি ঔপন্যাসিকের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে, তাহলে, পাবলো, তোমার কাছে আমার প্রশ্ন – কবিদের বেলায় কী ঘটে? কবিতা কি তোমাদের প্রাত্যহিক বাস্তবতা থেকে আরো দূরে ঠেলে দেয়? নাকি বাস্তবতার গূঢ় রহস্য আবিষ্কার করতে কবিতা তোমাদের সহায়ক হয়?
নেরুদা :
আসলে কবির একটা প্রবণতা থাকে কঠিন বাস্তবতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার। প্রতিদিনকার জীবনে কি হচ্ছে, তার থেকে একটু তফাতে থাকার। বিংশ শতকের শুরুর দিকের কবিরা যেমন, মালার্মের পরে নিভৃতচারী কবিরা। কিন্তু আমার নিজের কথা যদি বলি, আমি কিন্তু সবসময়ই উপন্যাস রচয়িতাদের প্রতি এক ধরনের ঈর্ষা অনুভব করি, কেননা গল্পের সাথে তাদের এখনো সরাসরি সংযোগ আছে, অধিগমনের অধিকার আছে। আমি কাব্যচর্চা ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। কবিতায় যে কাহিনীগুলো আর বলা হয় না, সেগুলো গদ্যসাহিত্যিক বলতে পারেন। অথচ একসময় এগুলো কিন্তু কবিতারও রসদ ছিল, যখন এপিক, মহাকাব্য সব লেখা হতো।
আমার নিজেরও ঝোঁক আছে এপিক কবিতার জন্যে, তাই একজন ঔপন্যাসিক যিনি এত কিছু বলতে পারেন, এত কিছু ব্যক্ত করতে পারেন, তার জন্যে কিছুটা হিংসা তো হয়ই সবসময়। আর এমন কোন লেখক বা ঔপন্যাসিক যদি থেকে থাকেন, যিনি বাস্তবতায় সম্পূর্ণ ডুবে গিয়ে সেখানে যাদুময়্তার খোঁজ করেছেন, তিনি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যার সাথে এই মুহূর্তে আমি কথা বলছি।
গাবো :
আমার কাছে মনে হয় যে সৃষ্টি করতে গিয়ে একজন লেখককে আত্মদহনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এটা কি লেখকবৃত্তিরই অংশ নাকি লেখকসত্তার বিবর্তনের একটি ধাপ, সেটা আমি নিশ্চিত না। কিন্তু আমি যত এগোই, চেষ্টা করি হাতের গল্পটাকে বা উপন্যাসটাকে কাব্যে রূপান্তর করতে। লেখালেখিতে আমার এখনকার যে প্রচেষ্টা, তা হলো ন্যারেটিভ সমাধান বাদ দিয়ে কাব্যিক সমাধানের খোঁজ করা।
আসলে এই আড্ডা যে আমাদের এখন কোথায় নিয়ে যাবে, আমি একদমই বুঝতে পারছি না, কারণ পুরো ব্যাপারটাই তো কপট, স্রেফ টিভির জন্যে সাজানো, তাই না?
নেরুদা :
আসলে তুমি যতটা মেকি ভাবছো, ততটা কিন্তু নয়। দেখো, আমার লেখক জীবনে, আমার কবিতায় আমি কিন্তু তোমার ঠিক উল্টোটা করার চেষ্টা করেছি। কি করে কবিতার মাধ্যমে গল্প বলা যায়, আমি সেই পথ খুঁজে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন অভিজ্ঞতাকে এখন আর ভয় করি না, কারণ এক সময় এই আমিও সেই ধরনের কবিতাকে ঘৃণা করতাম, যখন এপিক কবিতা, গল্প-বলা কবিতাকে সকলে এক যোগে ঘৃণা করতো।
হোমারের মত একটা শহরের পতনের কাহিনী আর কেউ কিন্তু বলার চেষ্টা করলো না। বা ধরো দান্তে, যিনি কিনা মানুষের জীবনসংগ্রাম, তাদের আবেগ-অনুরাগের কথা লিখতেন, রক্তমাংসের সব মানুষ যারা এককালে সত্যি সত্যি বেঁচে ছিল, সেই দান্তের মতও কেউ আর লেখে না। তেমন কবিতার চলই উঠে গেছে।
আমি হোমারও নই, দান্তেও নই তবুও তাদের মত বিষয় নিয়ে লিখতে আমি আর পিছপা হইনা। আরেক ধরনের কবিতা সবাই খুব অপছন্দ করতো, ‘শিক্ষামূলক’ কবিতা, যা মানুষকে ভালো-মন্দ নীতি-উপদেশ শেখায়। কিন্তু আমি ঠিক করলাম যে আমি ঠিক তাই লিখবো, মানুষ যেন আমার কবিতা থেকেও কিছু শিক্ষালাভ করতে পারে।
তোমার ক্ষেত্রে তাহলে তোমার লেখক চরিত্রের বিবর্তন তোমাকে ক্রমশ কবিতার দিকে টানছে, আর আমার বেলায় আমাকে টানছে উপন্যাসের দিকে। এই সবই হলো সাহিত্যিক হিসেবে বিবর্তনের একেকটি ধাপ – লেখক হিসেবে আমাদের তো এই পেশার আনাচ-কানাচ সবই অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। তুমি যেমনটা বললে, একজন রিপোর্টার যেমন সব কিছুতেই হাত পাকায়, আমাদেরও তাই করতে হবে।
গাবো :
তাহলে আমরা বোধ হয় একটা মতৈক্যে আসতে পারি – একজন কবি হিসেবে তুমি আর একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি – এবং আরো সাধারণভাবে বিচার করলে কবিরা কবির বেশে, ঔপন্যাসিকরা ঔপন্যাসিকের বেশে – আমরা এমন একটা সমঝোতায় পৌঁছুতে পারি যে এখন থেকে আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবো।
নেরুদা :
আমি একমত।
গাবো :
মানে কবিরা যদি ক্রমশ ঔপন্যাসিকের মত হয়ে যেতে পারে আর ঔপন্যাসিকরা যদি কবিদের মত, তাহলে সেটা নিয়ে তো আমাদের আর তর্ক করার কিছু নেই। উল্টো বরং আমরা এখন সবাই খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম, সবাই মিলঝিল, খুশী। যেমন এই যে তুমি নোবেল পুরস্কার জিতলে, আমি কিন্তু বেজায় খুশী হয়েছি। একজন কবির নোবেল জয়ে যদি ঔপন্যাসিকরা এত খুশী হতে পারে, তাহলে আমিও আশা করবো যে আমি যেদিন নোবেল জিতবো তুমিও আমার জন্যে ঠিক তেমনই খুশী হবে! কারণ আমার তো মনে হচ্ছে, ঘটনা যেদিকে এগুচ্ছে আর তুমি যেভাবে আমার নামে এত ভাল ভাল কথা বলে বেড়াচ্ছো, আমার তো মনে হয় যে তুমি সুইডিশ নোবেল একাডেমির উপর আসলে সন্দেহজনক প্রভাব খাটাচ্ছো!
নেরুদা :
একেবারেই সন্দেহজনক না, আমার কাছে তো নয়ই, অন্য কারো কাছেও না, কারণ তোমার মহতী কাজের জন্যে সেটা সত্যিই তোমার প্রাপ্য।
কিন্তু আমি যদি আরেকবার আমাদের বিষয়বস্তুর কাছে ফিরে যাই, আমি ঔপন্যাসিকদের অনেক ঈর্ষা করি, এবং সেটা তোমাকে খোলাখুলি বলতে পারি। আমি চাইলেও আসলে গদ্যে কোন গল্প বলতে পারি না। আর এর প্রমাণ হলো আমার মাথায় সব সময় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়: ‘আমি কি এই গল্প কোনো প্রকৃত ঔপন্যাসিককে বলতে পারতাম?’ আর তুমি যেহেতু এখানে থাকো না, থাকো কলম্বিয়া বা বার্সেলোনায়, আমি যখন কোন গল্প শুনি বা নিজ থেকে আবিষ্কার করি, তখন আমি চাইলেও তোমাকে ধরে পেতে সেই গল্পটা শোনাতে পারি না।
গাবো :
মজার ব্যাপার হলো তোমার সাথে আমার যখনই দেখা হয়, বা আমরা যখনই ডিনারের জন্যে একত্র হই, তুমি কিন্তু প্রতিবারই আমাকে দারুণ দারুণ সব গল্প শোনাও। আমার কাছে তখন মনে হয় যে শুধু একটি মাইক্রোফোন থাকলেই হতো – গল্পগুলো যেন বইয়ের পাতায় লেখা হয়ে আছে, এতই চমৎকার সেগুলো।
নেরুদা :
মাইক্রোফোনে গল্পগুলো বললে সেগুলো এত বাজে হবে, যে কেউ আর শুনতে বা পড়তে চাইবে না। আমি ততটা পারদর্শী নই। তবে আমি তোমাকে সত্যি সত্যি বলছি, কবিতা লেখা আমার জন্যে একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। অন্য যে কোন পেশার মতই এখানেও বাধা-বিপত্তি ঘটে, প্রতিবন্ধকতা আসে। মাঝে মাঝে নিজেকে মনে হয় মাছের মত, সাঁতার কাটছি কোন নদীর জলে, অথবা কবিতা নামের এই ছোট মহাসাগরে। এজন্যেই বোধ হয় এত বিভিন্ন ধরনের কবিতা আছে, বিভিন্ন ধরনের লেখা আছে… কিন্তু দিনের শেষে আমি আসলে…
অবশ্য আমি কিন্তু উপন্যাস পড়ি, সব ধরনের উপন্যাসই পড়ি, বলতে গেলে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। সের্বান্তেস এবং তুমি যে কাব্যিক উপন্যাসগুলো নিখেছ, সেগুলো পড়ি। ফরাসী বাস্তববাদী এমিল জোলার বইগুলো, প্রচুর অপরাধ বা ডিটেকটিভধর্মী গল্পের বইও পড়ি।
সত্যি কথা বলতে, পাঠকের জন্যে উপন্যাস একদমই অপরিহার্য। আমার কাছে খুবই অবাক লাগে যখন কোন যাত্রী ট্রেন জার্নির আগে যাত্রাপথে পড়ার জন্যে আমার কোন বই কিনে নেয়। এমনটা ঘটলে আমি খুব খুশী হবো নিশ্চয়ই, কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক স্বাভাবিক ঠেকে না – মানে, জার্নির জন্যে আমার বই কেনা – কারণ বাস্তবে যা ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী তা হলো সে একটি উপন্যাস কিনবে।
আমি আগেও বলেছি উপন্যাস হলো সাহিত্যের বীফ স্টেক। মানুষ খেতে বসে যে মেইন কোর্স চায়, উপন্যাস হচ্ছে তাই।
গাবো :
তাই যদি হয়, কবিতাকে কী বলবে?
নেরুদা :
কবিতা হলো অন্য কিছু।
গাবো :
উপন্যাস যদি বীফ স্টেক হয়, তাহলে কবিতা কী হবে?
নেরুদা :
কবিতা হলো – আমি এখন যে কথাটা বলবো, সেটা একটু হামবড়া মনে হতে পারে – কিন্তু কবিতা হলো প্রেমের মত, ভালোবাসার প্রক্রিয়ার মত, কিন্তু আরো অনেক অন্তরঙ্গ এবং সংক্ষিপ্ত। তবে হ্যাঁ, আমার এই কথায় দ্বিমত উঠতে পারে। কারণ আমি নিজেও অন্যান্য ধরনের কবিতা পছন্দ করি – উদার খোলামেলা কবিতা, মানুষকে যেটি গণআন্দোলনে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
কিন্তু কেউ যখন একটা কবিতার বই হাতে তুলে নেয়, সেটা খুলে পড়তে শুরু করে, তখন যেন কবির আত্মা আর পাঠকের আত্মার মধ্যে একটি গোপন যোগাযোগ সৃষ্টি হলো, যেটাতে আর কেউ অংশীদার হতে পারে না। এই সংযোগটা সাবজেক্টিভ কিন্তু বাস্তব, এর অস্তিত্ব আছে, পাঠকের কাছে বিদ্যুত তরঙ্গের মত অনুভূত হয়, সব পাঠকই কম-বেশি অনুভব করতে পারেন।
গাবো :
আচ্ছা, আমার মনে হচ্ছে আমরা এই বিষয়টা নিয়ে বিশদ আলাপ করে ফেলেছি আর সময়ও এখন ফুরিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাক আমাদের এই সংলাপটা শেষ পর্যন্ত কেমন দাড়ায়। আসলে আমাদের দুজনের মধ্যে সবচেয়ে উদ্দীপনাময় আলোচনাগুলো হয় তখনই, যখন পাবলো আর আমি একা থাকি, এত সাংবাদিক এত মাইক্রোফোন এত ক্যামেরা আশেপাশে থাকে না।
অলিভারেস :
আমি জানতে পেরেছি যে গত তিন-চার রাত আপনারা টানা আড্ডা মেরেছেন।
গাবো :
স্রেফ গপ্পো, সবই আসলে বলে ফেলেছি আমরা, আজকের মত তেমন কিছু বলার নেই আর বোধ হয়।
অলিভারেস :
শেষ কিছু কথা…?
গাবো :
আচ্ছা, আমাদের সময় একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আমি এই সুযোগের সুবিধাটা নিতে চাই। প্রথমত, নোবেল পুরস্কার জয় উপলক্ষ্যে চিলির জনগণকে আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। অত্যন্ত যথার্থ কারণেই এই সম্মানটি চিলির এমন একজন কবিকে প্রদান করা হয়েছে, যিনি আমার মতে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, পৃথিবীর যে কোনো ভাষায়। একই সাথে [সালভাদোর আয়েন্দের] পপুলার ফ্রন্ট সরকারের অনন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতার জন্যে আপনাদের সাথে আমার সংহতি এবং বিপুল আনন্দের অনুভুতি প্রকাশ করতে চাই।
নেরুদা :
গাব্রিয়েল, তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এখন আমার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ফিরে যাবার অনুমতি দাও। চিলির মানুষের জন্যে আমারও অভিনন্দন রইলো, আর আমার প্রতি তোমার আন্তরিক ভালোবাসার জন্যে তোমাকে জানাই ধন্যবাদ। তবে কথাগুলো আমি আরেকভাবে ঘুরিয়ে বলতে চাই। আমি অভিনন্দন জানাবো চিলেকে, প্রথমত সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং সাহসী কর্মকাণ্ড দিয়ে এই দেশটি আমাদের দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের একাংশকে বদলে দেয়ার চেষ্টা করছে। অভিনন্দন জানাই অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় উত্তরণের জন্য আমার দেশ, আমার মাতৃভূমি, চেষ্টা করে যাওয়ার জন্য।
যাক, আমার মনে হয় আমরা এই আলাপের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। চিলিবাসী যারা আমার কথা শুনছে, আমি চাই তারা আরও একজনের কথাও শুনুক। এখানে, গাব্রিয়েল, কেবল তুমি আর আমিই নই, অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আরও একজনকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। এক সিংহ, সত্যিকারের সিংহ। ওর কাছে আমার প্রশ্ন: সিংহ, বল দেখি, এতক্ষণ যাবৎ বকবক করা এই দুই চাচা সম্পর্কে তুমি কী ভাব?
এবং সে কোন কথা বলছে না।
গাবো :
ওর নীরবতাটা খুবই অভিব্যক্তিময়, তাই না?
নেরুদা :
নিশ্চয়ই আমাদের থেকে ও আরো বেশি বিজ্ঞ।
অলিভারেস :
ভদ্রমহিলা মহোদয়গণ, শুধু ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য নয়, বরং বিশ্ব সাহিত্যের দুইজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখককে একসাথে দেখার বিরল সৌভাগ্য আপনারা এতক্ষণ উপভোগ করলেন। চিলির আপামর জনসাধারণের বহুল প্রতীক্ষিত এই নোবেল পুরস্কার বিজয় উপলক্ষ্যে আমাদের কবি পাবলো নেরুদা যেই ভোজনের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে বিশেষ অতিথিদের একজন ছিলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। আমাদের মহাদেশে তো অবশ্যই, সারা বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে আজকের এই কথোপকথন একটি দুর্লভ মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
সৌজন্য : arts.bdnews24.com
1 মন্তব্যসমূহ
দারুণ! একটা মনে রাখার মত সাক্ষাৎকার। ধন্যবাদ অনুবাদককে।
উত্তরমুছুন