অনুবাদ: ফজল হাসান
সেদিন বিকেলে তিনজন সৈনিক গ্রামে এসে পৌঁছে । পাম-ফ্রন্ড পানশালায় যাওয়ার পথে তারা রাস্তায় ইতঃস্তত চড়ে বেড়ানো ছাগল এবং মোরগ-মুরগী তাড়িয়ে দেয় ।
তারপর সবাই পানশালায় গিয়ে এক জগ তালের রসের সুরা নিয়ে খুব দ্রুত পান করে, এমনকি তারা সুরার সঙ্গে মাছিও ভক্ষণ করে ।
ওমোভো জানালার ভেতর থেকে লোকগুলোকে দেখছিল এবং অপেক্ষা করছিল কখন তার বাবা বাইরে বেরিয়ে যাবে । সে সময় তারা দু’জনেই রেডিওতে খবর শুনছিল । যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এক পরিবারের কাছ থেকে গ্রান্ডিগ কোম্পানীর এই রেডিওটা বাবা সস্তায় কিনেছিল । একটা সাদা কাপড়ে বাবা রেডিওটাকে পেঁচিয়ে রাখে । তখন ওটা দেখতে অনেকটা শ্রদ্ধা-ভক্তির মূর্তির মতো মনে হয় । তারা দু’জনে বিমান আক্রমন ও বোমা বর্ষণের খবর শোনে । ওমোভোর বাবা সতর্কভাবে মাথার চুল পরিপাটি করে এবং দু’হাতের তালু ঘষে দাড়ি না কামানো মুখে আফটার সেভ মাখে । তারপর অনেক দিনের পুরোনো জীর্ণ কোট গায়ে জড়াতে সে রীতিমতো কসরত করে ।
জানালা গলিয়ে ওমোভো এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে । সেই সময় বাবার উপর প্রচন্ড রাগে তার সমস্ত শরীর রি রি করছিল । গত সাত দিন একই সময় মুখের উপর কালো ঘোমটা টেনে একজন অচেনা মহিলা তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে । স্ত্রস্ত পায়ে সে গ্রামের সরু পথের দিকে যায় এবং একসময় মহাসড়ক পেরিয়ে বন-জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে যায় ।
ইতিমধ্যে রেডিওতে খবর শেষ হয়ে গেছে । ঘোষিকা বলেছে যে, বিশাল আকাশের বুকে সেই রাতে চন্দ্রগ্রহণ দেখা দিতে পারে । ওমোভোর বাবা হাতের তালু দিয়ে মুখের উপর জমে থাকা বিন্দু বন্দু ঘামের ফোঁটা মোছে। তারপর কন্ঠস্বরে তিক্ততার খানিকটা রস ঢেলে স্বগোক্তির মতো করে বললো, ‘এই চন্দ্রগ্রহণ যেন যুদ্ধ থামিয়ে দেবে ।’
‘বাবা, চন্দ্রগ্রহণ কি ?’ কৌতূহলী ওমোভো জিজ্ঞেস করে ।
সমস্ত পৃথিবী যখন অন্ধকারে ডুবে যায় এবং আশ্চর্য্য সব ঘটনা ঘটে ।’
‘কি ধরনের ঘটনা ?’
ওমোভোর বাবা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে । একমুখ ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘মৃত মানুষেরা হাঁটাহাঁটি করে, এমনকি গানও করে । চন্দ্রগ্রহণের সময় বেশী রাত অবধি বাইরে থেকো না, বুঝলে ?’
বাবার কথায় সহমত পোষণ করে হালকা ভাবে ওমোভো মাথা নাড়ে ।
ওমোভোর বাবা বললো, ‘চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ বাচ্চাদের মোটেও পছন্দ করে না । সুযোগ পেলে ওরা বাচ্চাদের হাপিশ করে ।’
বাবার কথা ওমোভো বিশ্বেস করে না ।
ওমোভোকে মাসিক দশ কোবো ভাতা দেওয়ার সময় ঠোঁটের ফাঁকে নিঃশব্দ হাসির রেখা ফুটিয়ে বাবা বললো, ‘রেডিও বন্ধ করে দাও । বাচ্চাদের যুদ্ধের খবর শোনা উচিত নয় ।’
ওমোভো কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করে সুবোধ বালকের মতো রেডিও বন্ধ করে ।
ওমোভোর বাবা দরজার সামনে একধরনের বিশেষ তরল পদার্থ ছিটিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রার্থনা করে । প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর সে একটা হাতব্যাগ নিয়ে চোখেমুখে একধরনের আত্মগরিমার ভাব ফুটিয়ে গটগট শব্দ তুলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বড় রাস্তার বাস স্ট্যান্ডে যাওয়া পর্য্যন্ত ওমোভো বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে । একসময় বাস আসে । ওমোভোর বাবা সেই বাসে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ওমোভো পুনরায় রেডিও চালু করে । তারপর সে জানালার পাশে এসে বসে এবং মহিলার আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে । শেষ বার সে হলুদ রঙের পোশাক পরা মহিলাকে উত্তেজিত হয়ে হৈ চৈ করতে করতে চলে যেতে দেখেছিল । সেই সময় আশেপাশের ছেলেমেয়েরা খেলা বন্ধ করে তার দিকে ট্যাঁরা চোখে তাকিয়েছিল । পরে ওরা বলেছে যে, মহিলার নাকি কোনো ছায়াশরীর নেই । ছেলেমেয়েরা আরো বলেছে, মহিলার পা কখনই মাটি স্পর্শ করে না । মহিলা ওদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় ওরা ঢিল ছোঁড়ে । কিন্তু মহিলা কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি, এমনকি দ্রুত হেঁটে যায়নি, কিংবা পেছনে ফিরেও তাকায়নি ।
বাইরের আবহাওয়া ভীষণ উত্তপ্ত । ক্রমশ চারপাশের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে । গ্রামবাসীরা হাতের অসমাপ্ত কাজ নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে । তিন জন সৈনিক সূর্য্যের তীব্র রোদে বসে তালের রসের সুরা পান করে চুর হয়ে আছে । ওমোভো লক্ষ্য করে যেসব ছেলেমেয়েরা সৈনিকদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে, সৈনিকেরা ওদের ডেকে কথা বলছে, এমনকি কিছু টাকা-পয়সাও দিচ্ছে । ওমোভো দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে এবং বাইরে বেরিয়ে এসে পানশালা অতিক্রম করে হাঁটতে থাকে । সৈনিকেরা বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায় । ফিরে আসার সময় একজন সৈনিক ওমোভোকে কাছে ডাকে ।
‘তোর নাম কি ?’ সৈনিকটি জিজ্ঞেস করে ।
ওমোভো ইতঃস্তত করে । তবুও সে হাসি মুখে বলে, ‘হেকলিপস্ ।’
সৈনিকটি শব্দ করে হেসে উঠে এবং ওমোভোর মুখের উপর এক দলা থুতু ছুঁড়ে দেয় । সৈনকটির মুখের শিরা-উপশিরা ফুলে উঠে । এ ঘটনায় তার সহকর্মীদের মধ্যে কোনো উৎসাহ নেই । তারা মাছি তাড়াতে ব্যস্ত এবং খেলায় মশগুল । সৈনিকদের বন্দুকগুলো টেবিলের উপর পড়ে আছে । ওমোভো লক্ষ্য করে প্রত্যেক সৈনিকের পোশাকে উপর আলাদা নম্বর লেখা আছে ।
সৈনিকটি জিজ্ঞেস করে, ‘মোটা ঠোঁটের জন্য কি তোর বাবা এই নাম রেখেছে ?’
সম্মতির ভঙ্গিতে ওমোভো মাথা নাড়ে ।
সেই সময় আশেপাশের সৈনিকেরা মাথা তুলে ওমোভোর দিকে তাকায় এবং হাসতে থাকে ।
‘তুই একটা ভালো ছেলে,’ স্বাভাবিক গলায় সৈনিকটি বললো । তারপর একটু থেমে সে কন্ঠস্বর পুরো বদলিয়ে ভরী গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কি কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা সেই মহিলাকে দেখেছিস ?’
ওমোভোর দিকে একটা দশ কোবোর নোট এগিয়ে ধরে সৈনিকটি পুনরায় বললো, ‘মহিলা একজন গুপ্তচর । সে আমাদের শত্রুদের সহযোগিতা করে । তুই যদি আবার তাকে দেখিস, তাহলে চটজলদি আমাদের খবর দিবি । কি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস ?’
ওমোভো কোবো নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় এবং জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । মাঝে মাঝে সৈনিকেরা তার দিকে তাকায় । প্রচণ্ড গরমে সে ক্লান্ত হয়ে একসময় চেয়ারে বসে গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় । আচমকা মোরগের কর্কশ ডাকে তার ঘুম ভাঙে । সে বুঝতে পারে, ইতিমধ্যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার নেমে এসেছে । পানশালায় বসে সৈনিকেরা ঝিমুচ্ছে । রেডিওতে প্রতি ঘন্টার খবর শুরু হয়েছে । ওমোভো নিত্যদিনের হতাহতের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে খবর শুনছে । খবরের মাঝে সংবাদ পাঠক হাই তোলে এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের প্রতি ক্ষমা চেয়ে পুনরায় যুদ্ধের খবর পড়ায় মনোনিবেশ করে ।
ওমোভো মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ইতিমধ্যে মহিলা চলে গেছে । সৈনিকেরা পানশালায় নেই । হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে, গোলপাতার ছাউনির দুই ঘরের মাঝখানে সৈনিকেরা হাত নেড়ে একে অপরকে বিদায় জানাচ্ছে। মহিলা পথের শেষ প্রান্তে । ত্বড়িৎ গতিতে ওমোভো নিচে নেমে আসে এবং সৈনিকদের অনুসরণ করে । একজন সৈনিক গায়ের জামা খুলে ফেলেছে । তার পেছনে অন্য আরেক সৈনিকের পাছা এত স্ফীত যে, মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে প্যান্ট ছিঁড়ে যাবে । ওমোভো মহাসড়কে তাদের অনুসরণ করে । বন-জঙ্গলের কাছে পৌঁছানোর পর মহিলাকে অনুসরণ না করে সৈনিকেরা ভিন্ন পথে হাঁটতে থাকে । তারা তাদের পথ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল । চটজলদি ওমোভো মহিলার দিকে নজর ফিরিয়ে নেয় এবং তার দৃষ্টির সীমানায় আটকে রাখে ।
ওমোভো মহিলাকে গভীর জঙ্গলের ভেতর চুপিচুপি অনুসরণ করতে থাকে । মহিলার পরনে বিবর্ণ মলিন পোশাক এবং গায়ে ধূসর রঙের শাল জড়ানো । কালো ঘোমটা দিয়ে সে মুখ ঢেকে রেখেছে । তার মাথার উপর লাল রঙের একটা ঝুড়ি । ওমোভো পরখ করতে বেমালুম ভুলে গেছে যে, মহিলার আদৌ কোনো ছায়া আছে কি না, কিংবা তার পা মাটিতে স্পর্শ করছে কি না।
ওমোভো অসমাপ্ত দালান-বাড়ি, অনাড়ম্বর সাইন পোস্ট এবং নুয়ে পড়া ভাঙা বেড়া পেরিয়ে হাঁটতে থাকে । একসময় সে একটা পরিত্যাক্ত সিমেন্ট কারখানা পেরিয়ে যায় । সারি সারি দালানের ধ্বংসস্তুপ পড়ে আছে এবং শ্রমিকদের আস্তানা মরুভূমির মতো ফাঁকা । সে একটা ঢাউস আকারের বৃক্ষ পেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে দেখে তার নীচে একটা বিশাল জন্তুর আস্ত কঙ্কাল । হঠাৎ গাছের ডাল থেকে টুপ করে একটা সাপ মাটিতে পড়ে গিয়ে হিস হিস করতে থাকে । দূরের উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে তীব্র সঙ্গীতের শব্দের সঙ্গে লোকজনের যুদ্ধের শ্লোগানের আওয়াজ ভেসে আসে ।
ওমোভো সমতল ভূমিতে একটা ক্যাম্পের কাছে আসা পর্যন্ত মহিলাকে অনুসরণ করে । ক্যাম্পের ভেতর আলো-আঁধারিতে ছায়াশরীরগুলো নড়াচড়া করতে থাকে । মহিলা ওদের কাছে এগিয়ে যায় । চারপাশ থেকে ছায়াশরীরগুলো তাকে ঘিরে ধরে এবং ক্যাম্পের ভেতরের পথে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় । ছায়াশরীরগুলো মহিলাকে ধন্যবাদ জানায় এবং তার শব্দ ওমোভোর কানে স্পষ্ট ভেসে আসে । ক্যাম্পের ভেতর থেকে মহিলা যখন বেরিয়ে আসে, তখন তার হাতে ঝুড়ি নেই । অপুষ্টির কারণে চুপষে যাওয়া পেটের শীর্ণ দেহের ছেলেমেয়েরা এবং জীর্ণ পোশাক পরা অন্য মহিলারা তাকে পাহাড়ের উঁচুতে যাওয়ার অর্ধেকটা পথ এগিয়ে দেয় । তারপর অনিচ্ছায় তারা মহিলার হাত এমন ভাবে স্পর্শ করে যেন ভবিষ্যতে কোনোদিন তাদের দেখা হবে না । অবশেষে একসময় তারা ফিরে যায় ।
কর্দমাক্ত একটা নদীর কূলে এসে পৌঁছানো পর্যন্ত ওমোভো মহিলাকে অনুসরণ করে । মহিলা এমন হালকা ভাবে চলাফেরা করে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি এসে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে । নদীতে উল্টো হয়ে ডিঙি নৌকা ভাসছে এবং অন্ধকার পানিতে কাপড়চোপড় ডুবে আছে । পানির উপর বিসর্জনের বিভিন্ন ধরনের জিনিস, যেমন পলিথিন ব্যাগের ভেতর রুটির টুকরো, উচ্ছ্বিষ্ট খাবার এং কোকাকোলার খালি পাত্র, ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে । সে যখন পুনরায় ডিঙি নৌকার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে, তখন সে দেখতে পায় নৌকাগুলোর আকার পরিবর্তিত হয়ে মৃত জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধারণ করেছে । একসময় সে নদীর কূলে পুরোনো দিনের খুচরো পয়সা দেখতে পায় । বাতাসে ভেসে বেড়ানো উৎকট গন্ধ এসে তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে । সেই সময় সে তার পেছনে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় । কেউ একজন কাশছে এবং ওয়াক থু করে মাটিতে থুতু ফেলছে । সে একজন সৈনিকের কন্ঠস্বর চিনতে পারে । সৈনিকটি অন্যদের আরো জোরে হাঁটার জন্য তাড়া দিচ্ছিল । ওমোভো চোখের পলকে একটা গাছের আড়ালে লুকোয় । সৈনিকেরা বুটের ভারী শব্দ তুলে তার পাশ কেটে চলে যায় । একটু পরেই সে চিৎকারের শব্দ শুনতে পায় । সৈন্যগুলো মহিলাকে ধরে ফেলেছে এবং চতুর্দিক থেকে তারা মহিলাকে ঘিরে ধরেছে ।
‘অন্য সবাই কোথায় ?’ ভীড়ের মধ্যে একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে ।
মহিলা চুপ করে থাকে ।
‘তুমি একটা আস্ত ডাইনি । কি, মরতে চাও ? ওরা কোথায় ?’
এবারও মহিলা নিঃশ্চুপ, মুখে কোনো রা নেই । মাথা নীচু করে আছে । সৈন্যদের মধ্য থেকে একজন কাশতে শুরু করে এবং নদীর পানিতে এক দলা থুতু ছুঁড়ে ফেলে।
‘কথা বল ! কথা বল !’ অধৈর্য্য হয়ে সৈনিকটি মহিলাকে ঠাস করে চড় মেরে চিৎকারের সুরে বললো ।
মোটা সৈনিকটি হেঁচকা টানে মহিলার ঘোমটা ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয় । মহিলা হাঁটু না গেড়ে মাথা নীচু করে তুলতে যায় । মহিলার মাথায় কোনো চুল নেই এবং সেখানে একটা গভীর ক্ষত চিহ্ন । তার মুখের পাশে একটা বিবর্ণ দাগ । উদোম বুকের সৈনিকটি তাকে সজোরে ধাক্কা দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায় । বনের ভেতর আলো স্পষ্ট হয়ে উঠার পর ওমোভো প্রথম বারের মতো দেখতে পেল যে, নদীর পানিতে ভাসমান মৃত জন্তুগুলো আসলে বয়স্ক মরা সৈনিক । মরদেহগুলো শ্যাঁওলার সঙ্গে পেঁচিয়ে আছে এবং তাদের চোখগুলো ফুলে গেছে । কোনো কিছু বোঝার আগেই সে পুনরায় চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। হাতের মুঠোয় ছেঁড়া ঘোমটা নিয়ে মহিলা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে । তারপর সে শিরদাঁড়া টানটান করে মোটা সৈনিকটির দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার চোখেমুখে এক দলা থুতু ছুঁড়ে দেয় । বাতাসে ছেঁড়া ঘোমটা দোলাতে দোলাতে সে উন্মত্ত হয়ে গর্জাতে শুরু করে । পাশের দু’জন সৈন্য ভয় পেয়ে পেছনে সরে যায়। মোটা সৈনিকটি চোখমুখের থুতু মুছে মহিলার কোমর বরাবর বন্দুক তাক করে । গুলির শব্দ ভেসে আসার ঠিক এক মুহূর্ত আগে ওমোভো মাথার উপর প্রচণ্ড জোরে বিশাল পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনতে পায়। সৈনিকদের দৃষ্টির আড়লে লুকিয়ে থেকেও সে রীতিমতো ভয়ে পেয়েছে । হঠাৎ সে চিৎকার করে উদ্ভ্রান্তের মতো বন-বাঁদারের ভেতর দিয়ে দৌঁড়ুতে থাকে। সৈনিকেরা তার পেছনে পেছনে ছুটে যায় । পাথরের গায়ে জমে থাকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে সে ক্ষীপ্র গতিতে ছুটতে থাকে । ডাল-পাতার ফাঁক গলিয়ে একটা পেঁচা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । সে একটা গাছের শেকড়ের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় এবং মাটিতে মাথা ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী ঝাপসা হয়ে আসে ।
ওমোভোর যখন জ্ঞান ফিরে আসে, তখন চারপাশ গাঢ় অন্ধকারের ভারী চাদরে ঢাকা । চোখের সামনে সে আঙুল দোলাতে থাকে এবং কোনো কিছুই দেখতে পায় না । ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে চিৎকার করে উঠে এবং উদ্ভ্রান্তের মতো দৌঁড়িয়ে সে একটা বাড়ির দরজার সামনে এসে থামে । যখন সে ধকল কাটিয়ে উঠে খানিকটা আস্বস্ত হয়, তখন রেডিওতে প্রচারিত যুদ্ধের খবর তার কানে ভেসে আসে । একসময় সে নিজেকে বারান্দায় আবিষ্কার করে । ক্রমশ তার দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে উঠে । সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার বাবা বেতের চেয়ারে নিমগ্ন হয়ে বসে আছে এবং তিনজন সৈনিকের সঙ্গে তালের সুরা পান করছে । ওমোভো এক দৌঁড়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তিনজন সৈনিকের দিকে ক্ষিপ্ত আঙুল তোলে ।
‘অবশ্যই তুমি তাদের ধন্যবাদ জানাবে,’ ওমোভোর বাবা বললো । ‘এরাই তোমাকে গহীন অরণ্য থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে ।’
উত্তেজনা কাটিয়ে উঠে ওমোভো বনের ভেতর যা দেখেছে, ঘটনারপুরোটাই সে তার বাবাকে বলতে শুরু করে । কিন্তু চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে বাবা সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একসময় ওমোভোর বাবা ছেলেকে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় ।
লেখক পরিচিতিঃ বেন ওকরি নাইজেরিয়ার একজন জনপ্রিয় এবং সফল ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি । তাকে উত্তর-আধুনিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশক আফ্রিকার লেখকদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয় । তিনি ১৯৫৯ সালের ১৫ মার্চে দক্ষিণ নাইজেরিয়ার মিন্না শহরে জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র দু’বছর বয়সে তিনি বাবা-মার সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি দেন । তবে ১৯৬৮ সালে তিনি লাগোসে ফিরে আসেন । পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য পুনরায় লন্ডনে যান এবং এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশনা করেন । লাগোসে থাকাকালীন সময়ে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমতা এবং স্বদেশী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তার লেখার মূল বিষয় । যদিও কবিতা দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন, কিন্তু তেমন সাড়া ফেলতে না পেরে ছোটগল্প লেখায় মনোনিবেশ করেন । মাত্র একুশ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড শ্যাডোস’ প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের পরপরই তার নাম বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে । তবে সবচেয়ে প্রশংসিত এবং আলোড়িত উপন্যাস ‘দ্য ফ্যামিস্ড রোড’ এবং এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৯১ সালে ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পুরস্কার অর্জণ করেন । তার প্রথম গল্পসংকলন ‘ইন্সিডেন্টস্ অ্যাট দ্য শ্রাইন’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় । তার অন্য দু’টো গল্পগ্রন্থ হলো ‘স্টার্স অফ দ্য নিউ ক্যার্ফু’ (১৯৮৮) এবং ‘টেইলস্ অফ ফ্রীডম’ (২০০৭) । ‘অ্যন আফ্রিকান এলেজি’ (১৯৯৭), ‘মেন্টাল ফাইট’ (১৯৯৯) এবং ‘ওয়াইল্ড’ (২০১২) তার কবিতার বই । তার অনেক উপন্যাস এবং ছোটগল্প বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে । অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছাড়াও তাকে বৃটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানিত ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করা হয় । বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘যুদ্ধের আড়ালে’ গল্পটি বেন ওকরির ‘ইন দ্য শ্যাডো অফ ও্যয়্যর’ গল্পের অনুবাদ । গল্পটি ড্যানিয়েল হলপার্ন সম্পাদিত এবং ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আর্ট অফ দ্য স্টোরিঃ অ্যান ইন্টারন্যাশনাল এন্থোলজি অফ কন্টেম্পোরারী শর্ট স্টোরিজ’ সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে । তবে ১৯৮৩ সালে গল্পটির পূর্ব-সংস্করণ লন্ডনের ‘ওয়েস্ট আফ্রিকা’ ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে গল্পটির পরিবর্ধিত সংস্করণ লেখকের ‘স্টার্স অফ দ্য নিউ ক্যার্ফু’ গল্পসংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
*******

তারপর সবাই পানশালায় গিয়ে এক জগ তালের রসের সুরা নিয়ে খুব দ্রুত পান করে, এমনকি তারা সুরার সঙ্গে মাছিও ভক্ষণ করে ।
ওমোভো জানালার ভেতর থেকে লোকগুলোকে দেখছিল এবং অপেক্ষা করছিল কখন তার বাবা বাইরে বেরিয়ে যাবে । সে সময় তারা দু’জনেই রেডিওতে খবর শুনছিল । যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এক পরিবারের কাছ থেকে গ্রান্ডিগ কোম্পানীর এই রেডিওটা বাবা সস্তায় কিনেছিল । একটা সাদা কাপড়ে বাবা রেডিওটাকে পেঁচিয়ে রাখে । তখন ওটা দেখতে অনেকটা শ্রদ্ধা-ভক্তির মূর্তির মতো মনে হয় । তারা দু’জনে বিমান আক্রমন ও বোমা বর্ষণের খবর শোনে । ওমোভোর বাবা সতর্কভাবে মাথার চুল পরিপাটি করে এবং দু’হাতের তালু ঘষে দাড়ি না কামানো মুখে আফটার সেভ মাখে । তারপর অনেক দিনের পুরোনো জীর্ণ কোট গায়ে জড়াতে সে রীতিমতো কসরত করে ।
জানালা গলিয়ে ওমোভো এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে । সেই সময় বাবার উপর প্রচন্ড রাগে তার সমস্ত শরীর রি রি করছিল । গত সাত দিন একই সময় মুখের উপর কালো ঘোমটা টেনে একজন অচেনা মহিলা তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে । স্ত্রস্ত পায়ে সে গ্রামের সরু পথের দিকে যায় এবং একসময় মহাসড়ক পেরিয়ে বন-জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে যায় ।
ইতিমধ্যে রেডিওতে খবর শেষ হয়ে গেছে । ঘোষিকা বলেছে যে, বিশাল আকাশের বুকে সেই রাতে চন্দ্রগ্রহণ দেখা দিতে পারে । ওমোভোর বাবা হাতের তালু দিয়ে মুখের উপর জমে থাকা বিন্দু বন্দু ঘামের ফোঁটা মোছে। তারপর কন্ঠস্বরে তিক্ততার খানিকটা রস ঢেলে স্বগোক্তির মতো করে বললো, ‘এই চন্দ্রগ্রহণ যেন যুদ্ধ থামিয়ে দেবে ।’
‘বাবা, চন্দ্রগ্রহণ কি ?’ কৌতূহলী ওমোভো জিজ্ঞেস করে ।
সমস্ত পৃথিবী যখন অন্ধকারে ডুবে যায় এবং আশ্চর্য্য সব ঘটনা ঘটে ।’
‘কি ধরনের ঘটনা ?’
ওমোভোর বাবা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে । একমুখ ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘মৃত মানুষেরা হাঁটাহাঁটি করে, এমনকি গানও করে । চন্দ্রগ্রহণের সময় বেশী রাত অবধি বাইরে থেকো না, বুঝলে ?’
বাবার কথায় সহমত পোষণ করে হালকা ভাবে ওমোভো মাথা নাড়ে ।
ওমোভোর বাবা বললো, ‘চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ বাচ্চাদের মোটেও পছন্দ করে না । সুযোগ পেলে ওরা বাচ্চাদের হাপিশ করে ।’
বাবার কথা ওমোভো বিশ্বেস করে না ।
ওমোভোকে মাসিক দশ কোবো ভাতা দেওয়ার সময় ঠোঁটের ফাঁকে নিঃশব্দ হাসির রেখা ফুটিয়ে বাবা বললো, ‘রেডিও বন্ধ করে দাও । বাচ্চাদের যুদ্ধের খবর শোনা উচিত নয় ।’
ওমোভো কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করে সুবোধ বালকের মতো রেডিও বন্ধ করে ।
ওমোভোর বাবা দরজার সামনে একধরনের বিশেষ তরল পদার্থ ছিটিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রার্থনা করে । প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর সে একটা হাতব্যাগ নিয়ে চোখেমুখে একধরনের আত্মগরিমার ভাব ফুটিয়ে গটগট শব্দ তুলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বড় রাস্তার বাস স্ট্যান্ডে যাওয়া পর্য্যন্ত ওমোভো বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে । একসময় বাস আসে । ওমোভোর বাবা সেই বাসে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ওমোভো পুনরায় রেডিও চালু করে । তারপর সে জানালার পাশে এসে বসে এবং মহিলার আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে । শেষ বার সে হলুদ রঙের পোশাক পরা মহিলাকে উত্তেজিত হয়ে হৈ চৈ করতে করতে চলে যেতে দেখেছিল । সেই সময় আশেপাশের ছেলেমেয়েরা খেলা বন্ধ করে তার দিকে ট্যাঁরা চোখে তাকিয়েছিল । পরে ওরা বলেছে যে, মহিলার নাকি কোনো ছায়াশরীর নেই । ছেলেমেয়েরা আরো বলেছে, মহিলার পা কখনই মাটি স্পর্শ করে না । মহিলা ওদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় ওরা ঢিল ছোঁড়ে । কিন্তু মহিলা কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি, এমনকি দ্রুত হেঁটে যায়নি, কিংবা পেছনে ফিরেও তাকায়নি ।
বাইরের আবহাওয়া ভীষণ উত্তপ্ত । ক্রমশ চারপাশের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে । গ্রামবাসীরা হাতের অসমাপ্ত কাজ নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে । তিন জন সৈনিক সূর্য্যের তীব্র রোদে বসে তালের রসের সুরা পান করে চুর হয়ে আছে । ওমোভো লক্ষ্য করে যেসব ছেলেমেয়েরা সৈনিকদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে, সৈনিকেরা ওদের ডেকে কথা বলছে, এমনকি কিছু টাকা-পয়সাও দিচ্ছে । ওমোভো দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে এবং বাইরে বেরিয়ে এসে পানশালা অতিক্রম করে হাঁটতে থাকে । সৈনিকেরা বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায় । ফিরে আসার সময় একজন সৈনিক ওমোভোকে কাছে ডাকে ।
‘তোর নাম কি ?’ সৈনিকটি জিজ্ঞেস করে ।
ওমোভো ইতঃস্তত করে । তবুও সে হাসি মুখে বলে, ‘হেকলিপস্ ।’
সৈনিকটি শব্দ করে হেসে উঠে এবং ওমোভোর মুখের উপর এক দলা থুতু ছুঁড়ে দেয় । সৈনকটির মুখের শিরা-উপশিরা ফুলে উঠে । এ ঘটনায় তার সহকর্মীদের মধ্যে কোনো উৎসাহ নেই । তারা মাছি তাড়াতে ব্যস্ত এবং খেলায় মশগুল । সৈনিকদের বন্দুকগুলো টেবিলের উপর পড়ে আছে । ওমোভো লক্ষ্য করে প্রত্যেক সৈনিকের পোশাকে উপর আলাদা নম্বর লেখা আছে ।
সৈনিকটি জিজ্ঞেস করে, ‘মোটা ঠোঁটের জন্য কি তোর বাবা এই নাম রেখেছে ?’
সম্মতির ভঙ্গিতে ওমোভো মাথা নাড়ে ।
সেই সময় আশেপাশের সৈনিকেরা মাথা তুলে ওমোভোর দিকে তাকায় এবং হাসতে থাকে ।
‘তুই একটা ভালো ছেলে,’ স্বাভাবিক গলায় সৈনিকটি বললো । তারপর একটু থেমে সে কন্ঠস্বর পুরো বদলিয়ে ভরী গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কি কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা সেই মহিলাকে দেখেছিস ?’
ওমোভোর দিকে একটা দশ কোবোর নোট এগিয়ে ধরে সৈনিকটি পুনরায় বললো, ‘মহিলা একজন গুপ্তচর । সে আমাদের শত্রুদের সহযোগিতা করে । তুই যদি আবার তাকে দেখিস, তাহলে চটজলদি আমাদের খবর দিবি । কি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস ?’
ওমোভো কোবো নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় এবং জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । মাঝে মাঝে সৈনিকেরা তার দিকে তাকায় । প্রচণ্ড গরমে সে ক্লান্ত হয়ে একসময় চেয়ারে বসে গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় । আচমকা মোরগের কর্কশ ডাকে তার ঘুম ভাঙে । সে বুঝতে পারে, ইতিমধ্যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার নেমে এসেছে । পানশালায় বসে সৈনিকেরা ঝিমুচ্ছে । রেডিওতে প্রতি ঘন্টার খবর শুরু হয়েছে । ওমোভো নিত্যদিনের হতাহতের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে খবর শুনছে । খবরের মাঝে সংবাদ পাঠক হাই তোলে এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের প্রতি ক্ষমা চেয়ে পুনরায় যুদ্ধের খবর পড়ায় মনোনিবেশ করে ।

ওমোভো মহিলাকে গভীর জঙ্গলের ভেতর চুপিচুপি অনুসরণ করতে থাকে । মহিলার পরনে বিবর্ণ মলিন পোশাক এবং গায়ে ধূসর রঙের শাল জড়ানো । কালো ঘোমটা দিয়ে সে মুখ ঢেকে রেখেছে । তার মাথার উপর লাল রঙের একটা ঝুড়ি । ওমোভো পরখ করতে বেমালুম ভুলে গেছে যে, মহিলার আদৌ কোনো ছায়া আছে কি না, কিংবা তার পা মাটিতে স্পর্শ করছে কি না।
ওমোভো অসমাপ্ত দালান-বাড়ি, অনাড়ম্বর সাইন পোস্ট এবং নুয়ে পড়া ভাঙা বেড়া পেরিয়ে হাঁটতে থাকে । একসময় সে একটা পরিত্যাক্ত সিমেন্ট কারখানা পেরিয়ে যায় । সারি সারি দালানের ধ্বংসস্তুপ পড়ে আছে এবং শ্রমিকদের আস্তানা মরুভূমির মতো ফাঁকা । সে একটা ঢাউস আকারের বৃক্ষ পেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে দেখে তার নীচে একটা বিশাল জন্তুর আস্ত কঙ্কাল । হঠাৎ গাছের ডাল থেকে টুপ করে একটা সাপ মাটিতে পড়ে গিয়ে হিস হিস করতে থাকে । দূরের উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে তীব্র সঙ্গীতের শব্দের সঙ্গে লোকজনের যুদ্ধের শ্লোগানের আওয়াজ ভেসে আসে ।
ওমোভো সমতল ভূমিতে একটা ক্যাম্পের কাছে আসা পর্যন্ত মহিলাকে অনুসরণ করে । ক্যাম্পের ভেতর আলো-আঁধারিতে ছায়াশরীরগুলো নড়াচড়া করতে থাকে । মহিলা ওদের কাছে এগিয়ে যায় । চারপাশ থেকে ছায়াশরীরগুলো তাকে ঘিরে ধরে এবং ক্যাম্পের ভেতরের পথে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় । ছায়াশরীরগুলো মহিলাকে ধন্যবাদ জানায় এবং তার শব্দ ওমোভোর কানে স্পষ্ট ভেসে আসে । ক্যাম্পের ভেতর থেকে মহিলা যখন বেরিয়ে আসে, তখন তার হাতে ঝুড়ি নেই । অপুষ্টির কারণে চুপষে যাওয়া পেটের শীর্ণ দেহের ছেলেমেয়েরা এবং জীর্ণ পোশাক পরা অন্য মহিলারা তাকে পাহাড়ের উঁচুতে যাওয়ার অর্ধেকটা পথ এগিয়ে দেয় । তারপর অনিচ্ছায় তারা মহিলার হাত এমন ভাবে স্পর্শ করে যেন ভবিষ্যতে কোনোদিন তাদের দেখা হবে না । অবশেষে একসময় তারা ফিরে যায় ।
কর্দমাক্ত একটা নদীর কূলে এসে পৌঁছানো পর্যন্ত ওমোভো মহিলাকে অনুসরণ করে । মহিলা এমন হালকা ভাবে চলাফেরা করে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি এসে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে । নদীতে উল্টো হয়ে ডিঙি নৌকা ভাসছে এবং অন্ধকার পানিতে কাপড়চোপড় ডুবে আছে । পানির উপর বিসর্জনের বিভিন্ন ধরনের জিনিস, যেমন পলিথিন ব্যাগের ভেতর রুটির টুকরো, উচ্ছ্বিষ্ট খাবার এং কোকাকোলার খালি পাত্র, ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে । সে যখন পুনরায় ডিঙি নৌকার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে, তখন সে দেখতে পায় নৌকাগুলোর আকার পরিবর্তিত হয়ে মৃত জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধারণ করেছে । একসময় সে নদীর কূলে পুরোনো দিনের খুচরো পয়সা দেখতে পায় । বাতাসে ভেসে বেড়ানো উৎকট গন্ধ এসে তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে । সেই সময় সে তার পেছনে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় । কেউ একজন কাশছে এবং ওয়াক থু করে মাটিতে থুতু ফেলছে । সে একজন সৈনিকের কন্ঠস্বর চিনতে পারে । সৈনিকটি অন্যদের আরো জোরে হাঁটার জন্য তাড়া দিচ্ছিল । ওমোভো চোখের পলকে একটা গাছের আড়ালে লুকোয় । সৈনিকেরা বুটের ভারী শব্দ তুলে তার পাশ কেটে চলে যায় । একটু পরেই সে চিৎকারের শব্দ শুনতে পায় । সৈন্যগুলো মহিলাকে ধরে ফেলেছে এবং চতুর্দিক থেকে তারা মহিলাকে ঘিরে ধরেছে ।
‘অন্য সবাই কোথায় ?’ ভীড়ের মধ্যে একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে ।
মহিলা চুপ করে থাকে ।
‘তুমি একটা আস্ত ডাইনি । কি, মরতে চাও ? ওরা কোথায় ?’
এবারও মহিলা নিঃশ্চুপ, মুখে কোনো রা নেই । মাথা নীচু করে আছে । সৈন্যদের মধ্য থেকে একজন কাশতে শুরু করে এবং নদীর পানিতে এক দলা থুতু ছুঁড়ে ফেলে।
‘কথা বল ! কথা বল !’ অধৈর্য্য হয়ে সৈনিকটি মহিলাকে ঠাস করে চড় মেরে চিৎকারের সুরে বললো ।
মোটা সৈনিকটি হেঁচকা টানে মহিলার ঘোমটা ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয় । মহিলা হাঁটু না গেড়ে মাথা নীচু করে তুলতে যায় । মহিলার মাথায় কোনো চুল নেই এবং সেখানে একটা গভীর ক্ষত চিহ্ন । তার মুখের পাশে একটা বিবর্ণ দাগ । উদোম বুকের সৈনিকটি তাকে সজোরে ধাক্কা দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায় । বনের ভেতর আলো স্পষ্ট হয়ে উঠার পর ওমোভো প্রথম বারের মতো দেখতে পেল যে, নদীর পানিতে ভাসমান মৃত জন্তুগুলো আসলে বয়স্ক মরা সৈনিক । মরদেহগুলো শ্যাঁওলার সঙ্গে পেঁচিয়ে আছে এবং তাদের চোখগুলো ফুলে গেছে । কোনো কিছু বোঝার আগেই সে পুনরায় চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। হাতের মুঠোয় ছেঁড়া ঘোমটা নিয়ে মহিলা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে । তারপর সে শিরদাঁড়া টানটান করে মোটা সৈনিকটির দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার চোখেমুখে এক দলা থুতু ছুঁড়ে দেয় । বাতাসে ছেঁড়া ঘোমটা দোলাতে দোলাতে সে উন্মত্ত হয়ে গর্জাতে শুরু করে । পাশের দু’জন সৈন্য ভয় পেয়ে পেছনে সরে যায়। মোটা সৈনিকটি চোখমুখের থুতু মুছে মহিলার কোমর বরাবর বন্দুক তাক করে । গুলির শব্দ ভেসে আসার ঠিক এক মুহূর্ত আগে ওমোভো মাথার উপর প্রচণ্ড জোরে বিশাল পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনতে পায়। সৈনিকদের দৃষ্টির আড়লে লুকিয়ে থেকেও সে রীতিমতো ভয়ে পেয়েছে । হঠাৎ সে চিৎকার করে উদ্ভ্রান্তের মতো বন-বাঁদারের ভেতর দিয়ে দৌঁড়ুতে থাকে। সৈনিকেরা তার পেছনে পেছনে ছুটে যায় । পাথরের গায়ে জমে থাকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে সে ক্ষীপ্র গতিতে ছুটতে থাকে । ডাল-পাতার ফাঁক গলিয়ে একটা পেঁচা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । সে একটা গাছের শেকড়ের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় এবং মাটিতে মাথা ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী ঝাপসা হয়ে আসে ।
ওমোভোর যখন জ্ঞান ফিরে আসে, তখন চারপাশ গাঢ় অন্ধকারের ভারী চাদরে ঢাকা । চোখের সামনে সে আঙুল দোলাতে থাকে এবং কোনো কিছুই দেখতে পায় না । ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে চিৎকার করে উঠে এবং উদ্ভ্রান্তের মতো দৌঁড়িয়ে সে একটা বাড়ির দরজার সামনে এসে থামে । যখন সে ধকল কাটিয়ে উঠে খানিকটা আস্বস্ত হয়, তখন রেডিওতে প্রচারিত যুদ্ধের খবর তার কানে ভেসে আসে । একসময় সে নিজেকে বারান্দায় আবিষ্কার করে । ক্রমশ তার দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে উঠে । সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার বাবা বেতের চেয়ারে নিমগ্ন হয়ে বসে আছে এবং তিনজন সৈনিকের সঙ্গে তালের সুরা পান করছে । ওমোভো এক দৌঁড়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তিনজন সৈনিকের দিকে ক্ষিপ্ত আঙুল তোলে ।
‘অবশ্যই তুমি তাদের ধন্যবাদ জানাবে,’ ওমোভোর বাবা বললো । ‘এরাই তোমাকে গহীন অরণ্য থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে ।’
উত্তেজনা কাটিয়ে উঠে ওমোভো বনের ভেতর যা দেখেছে, ঘটনারপুরোটাই সে তার বাবাকে বলতে শুরু করে । কিন্তু চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে বাবা সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একসময় ওমোভোর বাবা ছেলেকে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় ।
লেখক পরিচিতিঃ বেন ওকরি নাইজেরিয়ার একজন জনপ্রিয় এবং সফল ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি । তাকে উত্তর-আধুনিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশক আফ্রিকার লেখকদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয় । তিনি ১৯৫৯ সালের ১৫ মার্চে দক্ষিণ নাইজেরিয়ার মিন্না শহরে জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র দু’বছর বয়সে তিনি বাবা-মার সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি দেন । তবে ১৯৬৮ সালে তিনি লাগোসে ফিরে আসেন । পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য পুনরায় লন্ডনে যান এবং এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশনা করেন । লাগোসে থাকাকালীন সময়ে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমতা এবং স্বদেশী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তার লেখার মূল বিষয় । যদিও কবিতা দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন, কিন্তু তেমন সাড়া ফেলতে না পেরে ছোটগল্প লেখায় মনোনিবেশ করেন । মাত্র একুশ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড শ্যাডোস’ প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের পরপরই তার নাম বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে । তবে সবচেয়ে প্রশংসিত এবং আলোড়িত উপন্যাস ‘দ্য ফ্যামিস্ড রোড’ এবং এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৯১ সালে ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পুরস্কার অর্জণ করেন । তার প্রথম গল্পসংকলন ‘ইন্সিডেন্টস্ অ্যাট দ্য শ্রাইন’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় । তার অন্য দু’টো গল্পগ্রন্থ হলো ‘স্টার্স অফ দ্য নিউ ক্যার্ফু’ (১৯৮৮) এবং ‘টেইলস্ অফ ফ্রীডম’ (২০০৭) । ‘অ্যন আফ্রিকান এলেজি’ (১৯৯৭), ‘মেন্টাল ফাইট’ (১৯৯৯) এবং ‘ওয়াইল্ড’ (২০১২) তার কবিতার বই । তার অনেক উপন্যাস এবং ছোটগল্প বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে । অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছাড়াও তাকে বৃটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানিত ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করা হয় । বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘যুদ্ধের আড়ালে’ গল্পটি বেন ওকরির ‘ইন দ্য শ্যাডো অফ ও্যয়্যর’ গল্পের অনুবাদ । গল্পটি ড্যানিয়েল হলপার্ন সম্পাদিত এবং ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আর্ট অফ দ্য স্টোরিঃ অ্যান ইন্টারন্যাশনাল এন্থোলজি অফ কন্টেম্পোরারী শর্ট স্টোরিজ’ সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে । তবে ১৯৮৩ সালে গল্পটির পূর্ব-সংস্করণ লন্ডনের ‘ওয়েস্ট আফ্রিকা’ ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে গল্পটির পরিবর্ধিত সংস্করণ লেখকের ‘স্টার্স অফ দ্য নিউ ক্যার্ফু’ গল্পসংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
*******
0 মন্তব্যসমূহ