সূচনা
একজন ঔপন্যাসিকের একটা উপন্যাস লিখতে কত সময় লাগে ? জানি, এ প্রশ্নের সরাসরি কোন সঠিক জবাব নেই । তবে একথা সত্যি যে, উপন্যাস লেখার সময় নির্ভর করে বিভিন্ন কারণের উপর, যেমন লেখকের মর্জি-মেজাজ, লেখার তাড়না, বিষয়বস্তু ও উপন্যাসের ধরন, শব্দ সংখ্যা এবং অনাকাঙ্খিত বাঁধা ।
কার কথা মনে নেই, উপন্যাস লেখার সময় প্রসঙ্গে একটা পুরনো কথা মনে পড়লো । কথাটি ছিল এরকম: ‘একটা উপন্যাস লিখতে যতটুকু সময় প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই, বেশিও না এবং কমও না ।’
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জাপানী বংশোদ্ভূত বৃটিশ কথাসাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরোর তৃতীয় এবং সবচেয়ে আলোচিত এবং গূরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘দ্য রিমেইনস্ অফ দ্য ডে’ । তিনি এই উপন্যাস লিখেছেন মাত্র চার সপ্তাহে । অথচ প্রথম উপন্যাস ‘এ পেইল ভিউ অফ হিলস্’ (১৯৮২ সালে প্রকাশিত) লিখতে তিনি পুরো দশ বছর ব্যয় করেন । যাহোক, যুদ্ধ-পরবর্তী বৃটেনের অন্যতম উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাসটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, দশ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয় । এই উপন্যাসের জন্য ১৯৮৯ সালে কাজুও ইশিগুরো ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার অর্জণ করেন । এছাড়া ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাসের সুবাদে লেখকের ঝুড়িতে বেশ করেকটি প্রশংসার পালক জমা হয়, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রায়ান কুন্ডে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ ১৪৬তম স্থান দখল করে । এছাড়া ২০০৬ সালে লন্ডনের ‘দ্য অবজারভার’ পত্রিকা এক শ’ পঞ্চাশ জন সাহিত্যিক এবং সমালোচকের ভোট নিয়ে দেখেছে যে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ পর্য্যন্ত বৃটিশ, আইরিশ অথবা কমনওয়েলথ্ দেশের প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাস যৌথ ভাবে অষ্টম স্থানে । ২০০৭ সালে লন্ডনের বিখ্যাত দৈনিক খবরের কাগজ ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর ‘বুকস্ ইউ কান্ট লিভ উইথআউট’ তালিকায় ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ স্থান পেয়েছে । ১৯৯৩ সালে উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় । এতে প্রধান দুই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন অ্যান্টোনি হপকিন্স এবং এমা থম্পসন। এ চলচ্চিত্রটি সারা দুনিয়ায় তুমুল সাড়া ফেলেছিল এবং মোট আটটি একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল ।
যাহোক, এত প্রশংসা এবং পুরস্কার পাওয়া ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাস মাত্র চার সপ্তাহে লেখার আড়ালের গল্প লেখকের কথায় তুলে ধরা এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য । তবে তার আগে উৎসাহী পাঠকদের জন্য উপন্যাসের সারকথা তুলে ধরা হলো ।
উপন্যাসের সারকথা
প্রথম পুরুষে লেখা ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাসের অধিবক্তা স্টিভেন্স পেশায় একজন খানসামা (বাটলার) । লর্ড ডার্লিংটনের খেদমতে সে তার পুরোটা জীবন ব্যয় করে । স্টিভেন্সকে উদ্দেশ্য করে পুরনো সহকর্মী মিজ কেন্টনের একটি চিঠি লিখে এবং সেই চিঠির প্রাপ্তি দিয়ে উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয় । চিঠিতে মিজ কেন্টনের দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন ঘটনা এবং ভাঙ্গনের ইঙ্গিত ছিল । চিঠি পাওয়ার পরে স্টিভেন্সের মনে হয়েছে যে, পুনরায় যদি মিজ কেন্টন আগের চাকুরীতে যোগদান করতে পারে, তাহলে হয়তো তাদের পুরনো এবং ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগবে । যাহোক, একসময় মিজ কেন্টন চাকুরী ফিরে পায় । ধীরে ধীরে তাদের অতীতের পারস্পারিক সম্পর্ক প্রকাশ পেতে থাকে । কিন্তু তারা কেউ একে অপরের কাছে অনুভূতির কথা তুলে ধরতে পারেনি । তাদের আলাপচারিতার মূল বিষয় থাকতো কর্মজীবনের বিভিন্ন ঘটনা । যদিও একসময় মিজ কেন্টন স্টিভেন্সের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, কিন্তু স্টিভেন্স তাতে সাড়া দেয়নি । ঘটনাচক্রে মিজ কেন্টন উপলব্ধি করে যে, সে আসলে তার স্বামীর কথাই ভাবতে চায় এবং অনাগত নাতির মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করবে । উপন্যাসের শেষ দিকে দেখা যায়, স্টিভেন্স জীবনের বাকি দিনগুলো মালিকের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে । এ ভাবেই ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাসটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় । বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে দু’জন নারী-পুরুষের অনুভূতি দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারই কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাসে ।
উপন্যাস লেখার নেপথ্য কাহিনী: কাজুও ইশিগুরোর ভাষায়
‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে (শিরোনাম: ‘কাজুও ইশিগুরো: হাউ আই রৌট দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে ইন ফোর উইকস্’) কাজুও ইশিগুরো নিজেই ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাস লেখার নেপথ্য কাহিনী প্রকাশ করেছেন । এ কথা সত্যি যে, সব মহৎ সৃষ্টির পেছনে কোন না কোন কাহিনী বা ঘটনা লুকিয়ে । ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাস রচনার আড়ালেও কাহিনী আছে এবং সেই কাহিনী লেখকের মুখেই শোনা যাক । উল্লেখ্য, এখানে শুধু চুম্বক অংশটি তুলে ধরা হলো ।
অনেকেই দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হন । তবে যখন উপন্যাস লেখার প্রসঙ্গ আসে, তখন সাধারণ জনমত যে, আনুমানিক চার ঘন্টা এক টানা কাজের পর মস্তিস্ক ঠিক মতো কাজ করে না । আমি সবসময় এই দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছি । কিন্তু ১৯৮৭ সালে গ্রীষ্মকাল ঘনিয়ে আসার সময় আমার কাছে একটা কঠিন পন্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল । আমার স্ত্রী লোরনা সহমত পোষণ করে ।
সেই সময়, যেহেতু আমি পাঁচ বছর আগেই চাকুরী ছেড়ে দিয়েছি, আমি আমার অন্যান্য কাজ এবং লেখালেখি নিয়ে মোটামুটি ভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছি । কিন্তু আমার দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশের পর পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার কারণে লেখালেখিতে ব্যাঘাত ঘটে । তখন অনেকেই আমাকে লেখালেখির প্রতি আরও মনোযোগী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন । এছাড়া ডিনার এবং পার্টি, বিদেশ ভ্রমণ, এমনকি পাহাড় সমান চিঠির স্তুপ – সবকিছু আমাকে লেখালেখি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । আগের বছর আমি একটা নতুন উপন্যাসের অধ্যায় লিখেছিলাম, কিন্তু গত এক বছরে সেই লেখা এক কদমও এগোয়নি।
সুতরাং লোরনা এবং আমি একটা চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হই । আমি চার সপ্তাহের জন্য নির্মম ভাবে দিনপঞ্জি লেখা বন্ধ রাখবো এবং নাটকীয় ভাবে একটা কিছু করবো, যাকে বলে ‘ক্র্যাশ’ । এই ক্র্যাশের সময় আমি কিছুই করবো না, শুধু সোমবার থেকে শনিবার সকাল নয়টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত লিখবো । তবে এর মাঝে দুপুরের খাওয়ার জন্য এক ঘন্টা এবং রাতের খাওয়ার জন্য দেড় ঘন্টা বিরতি নেবো । জবাব দেওয়া তো দূরের কথা, কোন চিঠিই আমি দেখবো না এবং টেলিফোনের ত্রিসীমানায়ও যাবো না । এছাড়া আমাদের বাড়িতে কেউ আসতে পারবে না । নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও লোরনা সংসার দেখভাল করবে । আমরা আশা করি, এভাবেই যে আমি আমার লেখার কাজ শেষ করতে পারবো, তা নয় । বরং আমি মানসিক ভাবে এমন এক জগতে পৌঁছুতে পারবো, যেখানে আমার কল্পনার জগত দৈনন্দিন জীবনের চেয়ে বেশি বাস্তব মনে হবে ।
সেই সময় আমার বয়স ছিল বত্রিশ এবং তখনই আমরা দক্ষিণ লন্ডনের সিডেনহাম এলাকায় একটা বাড়িতে উঠেছি । লেখালেখির জন্য নতুন বাড়িতে একটা আলাদা ঘর ছিল । সেই ঘরে আমি টেবিলের উপর ইচ্ছে মতো কাগজপত্র ছড়িয়ে রাখতে পারতাম এবং দেওয়ালে প্রয়োজনীয় তথ্য-তালিকা এবং টুকে রাখা নোট ঝুলিয়ে রেখেছি । বলা বাহূল্য, আগের দু’টো উপন্যাসই আমি ডাইনিং টেবিলে বসে লিখেছি । সেখানে প্রতিদিন কাজ শেষে কাগজপত্র গুছিয়ে সরিয়ে রাখতে হতো । এভাবেই আমি চার সপ্তাহে ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাস লেখার কাজ শেষ করেছি ।
যাহোক, পেছনের দিকে ফিরে তাকালে আমি সব ধরনের প্রভাব এবং উৎসাহের উৎস খুঁজে পাই । এখানে কমজোরি দু’টো ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. মধ্য-সত্তরে আমি ছিলাম টিনএজার । তখন ‘কনজারভেশন’ নামে একটা থ্রিলার মুভি দেখেছিলাম । সেই ছবিতে জিন হ্যাকম্যান ছিলেন একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক । তিনি বিশেষ ধরনের লোকজনের কথাবার্তা টেইপ্ করতেন । হ্যাকম্যান সেই কাজের মধ্য দিয়ে বিখ্যাত হতে চেয়েছেন । কিন্তু একসময় ভৌতিক একটা চিন্তা তাঁর মস্তিস্কে এসে ভর করে । আপনমনে ভাবলেন, তিনি যেসব টেইপ্ ক্ষমতাশীল লোকদের দেন, তারা হয়তো সেগুলো খুন-খারাবির মতো খারাপ কাজে ব্যবহার করতে পারে । আমি বিশ্বাস করি, হ্যাকম্যানের চরিত্রটি খানসামা স্টিভেন্সের প্রথম দিকে আদর্শ ।
২. আমি ভেবেছিলাম, প্ল্যান মাফিক ‘রিমেইন্স’ উপন্যাসটি শেষ করতে পারবো । কিন্তু কোন এক সন্ধ্যায় টম ওয়েটসের গলায় ‘রুবি’স্ আর্মস্’ গানটি শুনি । এটি একটি ব্যাল্যাড । একজন সৈনিক খুব ভোরে ঘুমিয়ে থাকা তার প্রিয়তমাকে ছেড়ে ট্রেনে করে চলে যাচ্ছে । ঘটনাটি অস্বাভাবিক নয় । ওয়েটস্ গানটি অত্যন্ত দরদ দিয়ে গেয়েছেন । আমার মনে হয়েছে যে, কঠিন হৃদয়ের মানুষেরও সারা চোখেমুখে কোন গভীর দুঃখ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে । গানটি শোনার পরই আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি যে, শেষ মুহূর্তে তিক্ততার মাঝেও স্টিভেন্স মানসিক ভাবে অটল থাকবে ।
শেষ কথা
‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ উপন্যাস লেখায় ঔপন্যাসিক কাজুও ইশিগুরো বিভিন্ন ভাবে উৎসাহিত হয়েছেন এবং মাত্র চার সপ্তাহে তিনি উপন্যাস লিখে শেষ করেন।
1 মন্তব্যসমূহ
উদ্বীপ্তময়...
উত্তরমুছুন