ভাষান্তর : ফারজানা হাফসা
দূর্ঘটনাক্রমে আমি একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লাম, কিংবা কে জানে ঠিক দূর্ঘটনাক্রমে নয় হয়ত। মার্গারেট হাউজ নামের একটা বড় ফ্ল্যাটবাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমি একটা ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলাম যার মালিক আমাকে তার মেয়ের শ্বশুর ধরে নিল। মেয়ের শ্বশুরকে সে কোনদিন দেখেনি বা বহুকাল আগে হয়ত একবারই দেখেছিল। লোকটি কথা বলতে বলতে একসময় অনেক একান্ত কথা বলে ফেলল আমাকে, বললো পরিচিত কিছু মানুষকে সে আসলে ঠিক পছন্দ করে না।
আমাদের এটা করা উচিৎ, ওটা করা উচিৎ নয়; কিংবা আমার স্ত্রীর যা করা উচিৎ ছিল তা সে করেনি অথবা করেছে- এরকম বহুবিধ কথা সে বলে যেতে লাগলো। প্রাণখুলে অনেক অন্তরঙ্গ কথাও নির্দ্বিধায় বলে ফেলল লোকটা।
আমাদের এটা করা উচিৎ, ওটা করা উচিৎ নয়; কিংবা আমার স্ত্রীর যা করা উচিৎ ছিল তা সে করেনি অথবা করেছে- এরকম বহুবিধ কথা সে বলে যেতে লাগলো। প্রাণখুলে অনেক অন্তরঙ্গ কথাও নির্দ্বিধায় বলে ফেলল লোকটা।
আমি তাকে বেশ লক্ষ করছিলাম। প্রথমে যখন সে আমাকে অন্য একজন হিসেবে ধরে নিল, তার ভুল ভাঙ্গাতে চেয়েছিলাম আমি; কিন্তু তারপরেই মনে হল আমার ব্যাপারে তার বিশ্বাস অতি দৃঢ়। আর সে এতটা অন্যমনস্ক অথচ সপ্রতিভ ও একমনা ছিল তার ভাবনায়, আমি তাকে ঠিক বলে উঠতে পারলাম না যে সে আমাকে ভুল মানুষ ভেবে নিয়েছে। তাছাড়া, সত্যি বলতে কি আমি ততক্ষণে ব্যাপারটা উপভোগও করতে শুরু করেছিলাম। এই অন্য একজন মানুষ হওয়া ব্যাপারটা ভাল লাগছিল বেশ। কেমন যেন একটা মোহময়তা ছিল ব্যাপারটাতে। হঠাৎ নিজেকে একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবারের অংশ আর কোন কিছুর সাথে সম্পর্কিত হিসেবে দেখতে পেয়ে পূলকিত বোধ করছিলাম অনেকটা। কোন সম্পর্কের বাঁধনে জড়ানোটা কেমন চমৎকার আর রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল।
ওই ফ্ল্যাটের জিনিসপত্রগুলোতে সচ্ছলতার ছাপ ছিল স্পষ্ট, বোঝাই যাচ্ছিল বড়সড় যৌথ পরিবার এদের। আমার সাথে যিনি কথা বলছিলেন, তিনি বড় কোন উৎসবের জন্য খাবারের আয়োজন করছিলেন, কেকের জন্য উপকরণ আর সস বানানোর জন্য মশলা মেশাচ্ছিলেন। চমৎকার সুবাস ছড়াচ্ছিল খাবারগুলো থেকে। আসন্ন পার্টির প্রস্তুতি আর পারিবারিক আবহটা আমার কাছে কেমন জানি নেশার মত লাগতে লাগলো।
আমার হঠাৎ মনে হতে লাগলো ভদ্রলোক আমাকে যা ভেবেছে আমি হয়ত সেই লোকটিই। সে যদি আমাকে অন্য কেউ ভেবেই থাকে, তাহলে আমি হয়ত অন্য কেউই। হয়ত কোন এক স্বপ্ন থেকে আমি বাস্তবে জেগে উঠেছি, যেখানে আমি তা-ই যা সে আমাকে ভেবেছে । হয়ত আমার পুরনো পরিচয়টাই কোন স্বপ্নের অংশ ছিল। এই ভাবনার সাথে খেলতে খেলতেই একটা সম্ভাবনা এসে হানা দিল মনে-- যে কোন সময় হয়ত সঠিক মানুষটি এসে হাজির হবে। অথবা হয়ত আসল লোকটির স্ত্রী এসে হাজির হবে এবং আমাকে দেখে চিনতে পারবে না।
আমার ভয় বাড়তে শুরু করল - -যে কোন সময় মুখোশ খসে পড়বে আমার। কি করব আমি তখন? আতঙ্কিত বোধ করতে লাগলাম আমি, কেমন জানি ভীতিকর মনে হচ্ছিল ব্যাপারটাকে। তবে আমি তো আর ইচ্ছাকৃতভাবে এর মধ্যে এসে পড়িনি। ওই কক্ষে পুরোটা সময় আমি কোন কথাই বলিনি-- যদিও আমাকে অন্য কেউ একজন ধরে নেওয়া হয়েছে। মনে মনে আমি আসলে ওখানকার অংশ হতে চাইছিলাম, চাইছিলাম আমি কারও কিছু হই। মুখোশ উন্মোচনের সম্ভাব্য একটা মাত্র বাক্য, মৃত্যু আশঙ্কার মত ঝুলে রইল আমার মাথার উপর। অপেক্ষা করতে করতে বাড়ির কর্তার কথা শুনছিলাম। সময় বয়ে চলল আমার অবশ্যম্ভাবী লাঞ্ছনার দিকে।
ওই ফ্ল্যাটে ভুলক্রমে গিয়ে হাজির হওয়ার আগে আমি আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম আসলে- - আমার একমাত্র জীবিত আত্মীয় সে। সমস্ত পৃথিবীতে মনে হয় সেই ছিল আমার সর্বশেষ ঠিকানা, যাওয়ার মত আর কোন জায়গা ছিল না আমার। এখন আমার এই পরিবার আছে, মজাদার নানা খাবার আর একটা উৎসব-আবহের সম্ভাবনা নিয়ে। তবু...
একসময়, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক তার পেছনের দরজাটা খুলে গেল। মুখে বসন্তের দাগওয়ালা, কাল একজন আরব দেশীয় বয়স্ক লোক ঘরে এসে ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, আমাকে ভুলক্রমে যে ব্যক্তি ভাবা হয়েছে ইনি আসলে সেই ব্যক্তি। সে বেশ গুরুগম্ভীর আর স্পষ্টতঃই নিজের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল-- আসল শ্বশুর সে। প্রথমেই ধাক্কা খেলাম এই ভেবে যে আমি তো দেখতে কোনক্রমেই তার মত নই! আমি বয়সে তার চেয়ে তরুণ, তার তুলনায় তরতাজা এবং দেখতে ভাল। আমি প্রাণশক্তিতে ভরপুর, স্বাধীন, চটপটে, ও নিজেকে কোন প্রথায় আবদ্ধ মনে করি না। আমার সামনে বরাবরই সম্ভাবনার অনেক দ্বার খোলা ছিল-- যে কোন পথে চলার। অথচ এই লোকটাকে দেখে কেমন ভারক্লিষ্ট মনে হল। তাকে দেখে মনে হল সে এমন একজন যার সম্ভাবনার দরজাগুলি রুদ্ধ ছিল, ভবিষ্যত পূর্ব-নির্ধারিত ছিল এবং যার জন্য নিয়ম বেঁধে দেয়া ছিল। সে খুব বাজে রকমভাবে মধ্য-বয়সী ছিল-- যেন স্বাধীনতা ও স্বাধীন ভাবনা বঞ্চিত। আমি একমুহূর্তেই এসব উপলব্ধি করে নিয়েছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করেছি আসলে পরে। ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা খেলাম এই ভেবে যে আমাকে এই লোক ভাবা হয়েছে।
লোকটা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মালিক, যে কিনা আমাকে ভুল মানুষ ভেবেছিল, তার দিকে তাকালো এবং মুহূর্তেই বুঝে গেল ঐ লোকটিই প্রকৃত শ্বশুর। আমার মনে হল সে তাকে চিনতে পারল যেন। মানুষ এতটা অমনোযোগী কেমন করে হয়! ঠিক সেইক্ষণে সে আমার দিকে ফিরে তাকালো, রাগতস্বরে জানতে চাইলঃ “তো আপনি কে?”
এরপরের ঘটনাগুলি আমার চোখের সামনে ঘটে গেল একের পর এক। আমার মুখোশ উন্মোচনটি বেশ জনসমক্ষে হলো। হঠাৎ শুণ্য থেকে অনেক মানুষ উদয় হল যেন, এবং ঘটা করে তাদেরকে বলা হল আমার ওই বাড়ির শ্বশুর সাজার ঘটনা। নানা মন্তব্য, বাক্যবাণ, অভিশাপ আর কতক আমুদে দৃষ্টি নিক্ষেপ চলল আমার উপর। এমনভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল ওরা যেন আমি এক দানবীয় অপরাধী। পর্দার আড়াল থেকে মহিলারা আমাকে রহস্যময়ভাবে নিরীক্ষণ করছিল। আমার মধ্যে আচমকা জীবনের ভয় দেখা দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে রাস্তায় নিক্ষেপ করা হল, চারদিকে জন পরিবেষ্টিত আমি-- ওই যৌথ পরিবারের সদস্যরা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। একটা মানচিত্র উঁচু করে তুলে ধরে আমি বলে চললাম- -“একটা ভুল হয়ে গেছে, আমি আসলে মার্গারেট হাউজ বা মার্গারেট কোর্ট খুঁজছিলাম।”
এই গোলযোগের মধ্যে আমি যে জায়গাটা খুঁজছিলাম হঠাৎ তার নাম দেখতে পেলাম পাশের একটা দালানে। আমি নিরবে মানুষগুলোর অপমান এবং উচ্চকিত মন্তব্যগুলো সহ্য করে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি আমার প্রকৃত গন্তব্য সেই পাশের দালানের দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু বাড়ির মালিক, যিনি আমাকে ভুল মানুষ মনে করেছিলেন, বলে উঠলেন-- “ওখানে যাবেন না, ওখানে যাবেন না আপনি।”
আমি মার্গারেট হাউজের দিকে তাকালাম, তারপর চাইলাম মাটির দিকে। দেখলাম অনেক মানুষ উদ্দেশ্যহীনভাবে জটলা করছে ওখানে-- তারা ধাক্কাধাক্কি করছে, অন্যমনষ্ক ও অস্থিরভাবে ঘুরাঘুরি করছে। তাদের অবয়ব কাল, পরনে কাল ওভারকোট, তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ছায়া ওরা, নরকের মধ্যে আছে যেন ওরা। এমনভাবে ঘুরাঘুরি করছিল তারা যেন তাদের পায়ে সীসার ভার। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল ওদের কোন কিছুরই বোধ নেই। কোর্ট প্রাঙ্গণটি ছিল কংক্রিটের তৈরি; ওদের সম্মিলিত উপস্থিতি ওটাকে করে তুলেছিল অন্ধকার, অশুভ, অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক। মনে হচ্ছিল তারা সকলে যেন ক্রোধান্বিত। আমি মার্গারেট হাউজের দিকেই এগুচ্ছিলাম, কিন্তু ওই বাড়ির লোকটির কথা শুনে থেমে গেলাম। মার্গারেট হাউজের আঙিনায় ওই জটলাবদ্ধ, অশুভ ছায়ার মানুষগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা অনুভব করলাম। দিক পরিবর্তন করে ভিড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম আমি, অতঃপর রাস্তায় পা রাখলাম-- নিজস্ব একটা জীবনের পথে।
অনুবাদক
ফারজানা হাফসা
শিক্ষক, গবেষক, অনুবাদক, ব্লগার।
পিএইচডি শিক্ষার্থী,
ফারজানা হাফসা
শিক্ষক, গবেষক, অনুবাদক, ব্লগার।
পিএইচডি শিক্ষার্থী,
ইউনিভার্সিটি অফ রচেষ্টার, ইউএসএ।
1 মন্তব্যসমূহ
যেমন বেন ওকরির গল্প তেমনি খুবই ভাল অনুবাদ হয়েছে!সহজ,সুন্দর,প্রাঞ্জল!লিখে যাও। থেমো না।
উত্তরমুছুন