বেন ওকরির গল্প : সেজউইক

অনুবাদক : রুমা মোদক

সেজউইক নামে লোকটি আমাদের উপস্থিতিতে একটা অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলো। সে ছিল একজন ক্রিকেটার। কিন্তু সে শুধু আর একজন ক্রিকেটার হয়েই থাকলো না। বরং ক্রিকেটের সীমানা অতিক্রম করে সে অন্য কিছু হয়ে গেলো। কিছু সময়ের জন্য সে একটি নতুন কিছুতে নিজের কৃতিত্ব দেখালো।

তার সম্পর্কে নানারকম গুজব বাতাসে ভাসছিল এবং যেহেতু সেসব গুজব সম্পর্কে সে নিজে নীরবতা বজায় রেখেছিল, লোকজন গুজবগুলোকে সত্য বলেই ধরে নিচ্ছিলো। কেউ জানতো না সে কোথায় থাকে, তার সময়ই বা কীভাবে কাটে। সবাই মোটামুটি একটা স্থির সিদ্ধান্তে, উপনীত হয়েছিল সে শয়তানের সাথে বাস করে। আর অন্যরা যারা তার গুণমুগ্ধ ছিলো, তারা ভাবলো সে হয়তো কোন বনাজী ওষুধপত্রের গবেষণার সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যা তেমন ক্ষতিকর কিছু নয়।

প্রকাশ্যে সে আর ক্রিকেট খেলতে আসে না তাও প্রায় বছর গড়িয়ে গেলো। বরং সে একটা অদ্ভুত রকম ক্রিকেট ধাঁচের গলফ খেলতে শুরু করল।

যাকে আমরা বছর ধরে দেখি না, কথা বলি না, বিখ্যাত ক্রিকেটার হিসাবে যে কিনা আমাদের আদর্শ ছিলো, ছিলো স্বপ্নপুরুষ, সে কিনা একদম একঘরে বিচ্ছিন্ন একটা মানুষ হয়ে গেলো? আমাদেরতো কোন ভুল বা অন্যায় কিছুই ছিলো না তার কাছে, তার সামান্য একটু হাসিই আমাদের জন্য যথেষ্ট প্রাপ্তি ছিলো কিংবা শুধুমাত্র আমাদের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নেয়া। আমরা তার মুখের একটুখানি হাসিতেই উদ্বেলিত হয়ে উঠতাম, অতীতে তার সে অপূর্ব হাসি আমাদের স্মৃতি গ্রাস করেছিলো, একত্রিত আমরা তার প্রত্যাশায় ছিলাম শুধু............।

সে দাঁড়িয়েছিল একটা জঙ্গলের পাশে, একটা ক্রিকেট বল দিয়ে ঘূর্ণন তৈরি করে নিক্ষেপ করল। তার হাত থেকে বলটি অনেক দূরে মাটিতে পড়ে বেশ একটা ঘূর্ণন তৈরি করলো, নোংরা পানিতে ঘূর্ণি তৈরি করে বিস্ময়করভাবে কতোক্ষণ একটা গাছের শিকড়ে জিরিয়ে তারপর আবার গাছের পাশ দিয়ে চক্কর কেটে কিছুদূর একটি ছোট্ট নদীতে গড়িয়ে পড়লো।

আমরা হতাশায় ডুবে গেলাম, পালাতে চাইলাম, কিন্তু তার হাসিতে এমন জাদুকরি কিছু ছিলো আমরা পালাতে পারলাম না, আটকে গেলাম। অপলক দৃষ্টিতে বলটির দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলাম। দেখলাম বলটি তার গতিপথ পরিবর্তন করে পানিতে ভেসে যেতে থাকলো। কিন্তু কী আশ্চর্য পানিতে ভেসে ভেসে বলটি ইঞ্চি ইঞ্চি করে আমাদের দিকেই অগ্রসরমান হতে থাকলো।

এবং হঠাৎ, উপস্থিত সবার চোখের সামনে সবাইকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে একটি অসম্ভব ঘটনা ঘটে যেতে লাগলো। বলটি পানিতে তীব্র ঘূর্ণিতে পাক খেতে লাগলো, পাক খেতে লাগলো যতোক্ষণ না বলটি পানি থেকে জমিতে উঠে পড়লো। উপস্থিত জনতার তুমুল বিস্ময়াভিভূত প্রশংসা গায়ে মেখে বলটি হঠাৎ তার গতি পরিবর্তন করে একটি গর্তে ঢুকে বসে থাকলো, মনে হলো যেনো অদৃশ্য কেউ গতিপথ নির্ধারণ করে বলটিকে গর্তে শুইয়ে দিলো।

এটি একটি বিস্ময়াকর ঘটনা, যা সবার চোখের সামনে ঘটে সবাইকে চমকে দিয়েছিলো। অথচ ঘটনাটি ঘটলো কী নির্বিকার অথচ ক্রিকেটের সমস্ত ব্যাকরণকে অস্বীকার করে। সেজউইক কালো লোকটি, সেই থেকে হয়ে গেলো একজন কিংবদন্তি। আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠলো সে।

পরবর্তীতে আমরা দেখলাম সে দারুণ একটি বাড়িতে বাস করছে। তুষারাবৃত জানালা দিয়ে সে আবারও নির্বিকারভাবে খেলাটি দেখিয়ে আমাদের চমকে দিতে চাইলো। কিন্তু অবাক কান্ড! পরপর দুইবার চমক দেখাতে ব্যর্থ হলো সে। তৃতীয়বার অবশ্য সে সফল হলো। বলটি তার বিখ্যাত ঘূর্ণন শুরু করল। আর আমরা পুনরায় মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলাম কিভাবে একটি বল নির্বিকারভাবে ঘূর্ণন পরিভ্রমণ শেষে দূরে গিয়ে গর্তে আশ্রয় নেয়।

কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই তখন নীচে, সেজউইক ছিল, আমি ছিলাম। সেজউইকের পরিচিত কয়েকজন ছাড়াও আরো একজন ব্যক্তি সেখানে ছিল। তাঁর নাম জ্যাকসন। যে কিনা একদা খুব বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিল বলে শুনেছি এবং পরিপাটি চটপটে এই লোকটি সেজউইকের কাছে ছিলো খুব সম্মানিত ব্যক্তি।

পরিপাটি জ্যাকসনের হাতে ছিল একটি কনুই বাঁকানো বল। যা তার বিশেষত্ব প্রকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করছিল। সেজউইক ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁর দৃষ্টিতে ছিল সম্ভ্রম। জ্যাকসনের প্রতি তীব্র কৌতুহল আর আগ্রহ স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেজউইকের আগ্রহ কৌতুহল চর্চার গতিপথ যে বদলে গেছে জ্যাকসনেরও তা অজানা ছিল না। জ্যাকসন বিখ্যাত খেলোয়ার কিন্তু সেজউইক যা করে দেখিয়েছে, তা কেবল খেলা নয়। ব্যাখ্যার অতীত জাদুকরি এক ব্যাপার। মনে হতে পারে পাগলাটে রহস্যময়। স্পিন এবং গতির ঘূর্ণনের সুদক্ষ কারিশমাও হতে পারে এটি। কিন্তু সত্যি হলো এই যে সেজউইক এমন কিছু আয়ত্তে এনেছিল যে স্বপ্নেও কেউ ভাবে নি এটা আয়ত্তে আনা সম্ভব।

মূলত এটা তার নতুন দক্ষতা, সম্পূর্ণ নতুন এক বিশেষত্ব যা কিনা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো এক দুর্বোধ্য রহস্যময়তায়। এমনকি জ্যাকসন পর্যন্ত জানতো না এটা কিভাবে সম্ভব হলো। সেজউইকের এই সামান্য কৃতিত্ব অনুকরণীয় জ্যাকসনকে নামিয়ে এনেছিল এক সাধারণ মানে। কোন ধরণের মুগ্ধতা, রহস্য কিংবা অবাস্তব ঘটনা ছাড়াই।

যাই হোক, সেজউইক কিন্তু নিজেইকে সাধারণ, স্বাভাবিক জটিলতাহীন রেখেছিল। কিন্তু সে যে ক্যারিশমা দেখিয়েছিল, সেই যে বলের ঘূর্ণন, কৌশলী ঘূর্ণন এটাই তার অকল্পনীয় এক অর্জন হয়ে উঠেছিল। কেননা সমবেত সবার কাছে মনে হয়েছিল বলটি উপরে নীচে সকল বাঁধা পেরিয়ে যেনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় গর্তের দিকে ছুটে চলে। এ যেন এক পৈশাচিক শিল্প যা মায়ার বন্ধনে বেড়ে উঠেছে.....সম্ভবত গুজব আর বাস্তবতা সমান্তরাল।




অনুবাদক
রুমা মোদক
গল্পকার। নাট্যকার। শিক্ষক।
বাংলাদেশের হবিগঞ্জে থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ