অনুবাদ : লুতফুন নাহার লতা
যুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু চারিদিকে তখনও যুদ্ধ পরবর্তী অস্থিরতা। ধ্বংসস্তূপের ভেতরেও অপেক্ষাকৃত ভালো একটি বাড়ীতে ওরা আমার কাছে জড়ো করেছে যুদ্ধ শিশুদের। ওদের কেউ নেই, বাবা মা আত্মীয় স্বজন সব হারিয়েছে ওরা। শিক্ষক হিসেবে আমার কাছেই ওদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
যুদ্ধের বিভীষিকা কাটিয়ে কোনকিছু আত্মস্থ করার মতন মানসিক অবস্থায় নেই ওরা। তাই আমি ওদের ছবি আঁকায় আগ্রহী করে তুলতে চাইলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা তাতে রাজী হল। সব হারানোর হাহাকার ভুলে মুক্তমনে দীর্ঘ সময় ধরে ওরা ছবি আঁকায় ডুবে থাকল, তীব্র শোক থেকে পালিয়ে অফুরান রঙে ডুবে অদ্ভূত সব রহস্যময় আকার,আকৃতি,পশু,পাখী,ষাঁড়, বা এসবের মিশেল নতুন কোন জীবজন্তু বা আকৃতি আঁকল,যা মূলত তাদের ভেতরের ধামাচাপা দেয়া অনিশ্চিত অবস্থারই প্রতিবিম্ব।
আমি অবশ্য ছবি আঁকার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোতেও যেমন ইতিহাস,ভূগোল, বা গণিতে ওদের উৎসাহিত করে তুলতে চাইছি, যদিও ওসব বিষয়ে খুব এলোমেলো ও অমনযোগী ওরা । ওদের কাছে ছবি আঁকাই সবকিছু, একমাত্র ভুবন।
বেশ কিছুদিন পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচিত একটি টিম এলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে। তারা যুদ্ধশিশুদের ব্যপারে আগ্রহ নিয়ে তাদের বর্তমান অবস্থা জানার জন্যে উৎসাহী হল। সাধারণ বিষয়গুলোতে শিশুদের অগ্রগতি তাদেরকে তেমন একটা আশান্বিত করল না। কিন্তু আমি যখন ওদের আঁকা নানারকম ছবি দেখালাম, পরিদর্শকেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে যেন চমকে উঠল। ছবিগুলো দেখে ওরা স্তম্ভিত হয়ে রইল, লাল আর হলুদে আঁকা ঢাউস সব বুনো ষাঁড়। বিশাল বিশাল ক্যানভাসে ছবিগুলো যেন সীমাহীন প্রাণশক্তি এবং ক্রোধ প্রকাশ করে বন্যসৌন্দর্য্য তুলে ধরেছে। এমন একটিও ছবি নেই যেটা কিনা অসাধারণ বা আতঙ্কজনক নয়। যেন হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া অজানা সব গুহাচিত্র। পৃথিবীর সেরা পোষ্ট-ইম্প্রেশানিষ্টদের সুদক্ষ হাতে আঁকা এক বিষ্ময়। অথবা ইম্প্রেশনিস্টদের গুরু। এটা ভয়ংকর এবং ভুতুড়ে! এই দেবশিশুরা কারা! কোন স্বর্গ থেকে এঁদের আগমন! যুদ্ধের বিভীষিকা কি ওদের এতটাই বিপর্যস্ত ও দিব্যজ্ঞানী করে তুলেছে এভাবে!
রাতের খাবারের পর আমরা সবাই একটি গোল টেবিল ঘিরে বসেছি। আমাদের অধিকাংশই লেখক। এদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় নারী লেখক প্রস্তাব দিলেন- যত বেশি ভাষায় সম্ভব আমরা সবাই যেন ‘ধন্যবাদ'শব্দটি তাঁদের বলি। আমি আমার কন্ঠের সকল কারুকাজ দিয়ে প্রিয় ভাষায় শুরু করি প্রথমে, তারপর কেউ জার্মান, কেউ জাপানিজ, কেউ রাশান, কেউ বা সোয়াহেলি ভাষায়...
আমাদের মধ্যে উল্লাস ছিল খুব। ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি নানা ভাষায়,নানা ছন্দে উচ্চারণ করতে করতে কিছুক্ষণের জন্যে আমরা সবাই হেসে উঠি। যুদ্ধ শেষে চারপাশের অন্তহীন কষ্টের ভেতরে সেটি যেন একটু প্রাণের আরাম দেয়।
বাইরে তখন শিশুরা বোমার আঘাতে ভেঙ্গে পড়া বাড়ি গুলোর বিধ্বস্ত আঙিনায় এবং উঁচু টাওয়ারগুলো গর্তের ভেতরে ওদের মায়েদের খুঁজছে।
অবশেষে রাতে,যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্ধকার নগরীটিতে শিশুরা তাঁদের বাড়িগুলোর ভগ্নস্তুপের উপর ঘুমিয়ে পড়ল এবং মৃত বাবা-মা’র ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলো।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু চারিদিকে তখনও যুদ্ধ পরবর্তী অস্থিরতা। ধ্বংসস্তূপের ভেতরেও অপেক্ষাকৃত ভালো একটি বাড়ীতে ওরা আমার কাছে জড়ো করেছে যুদ্ধ শিশুদের। ওদের কেউ নেই, বাবা মা আত্মীয় স্বজন সব হারিয়েছে ওরা। শিক্ষক হিসেবে আমার কাছেই ওদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
যুদ্ধের বিভীষিকা কাটিয়ে কোনকিছু আত্মস্থ করার মতন মানসিক অবস্থায় নেই ওরা। তাই আমি ওদের ছবি আঁকায় আগ্রহী করে তুলতে চাইলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা তাতে রাজী হল। সব হারানোর হাহাকার ভুলে মুক্তমনে দীর্ঘ সময় ধরে ওরা ছবি আঁকায় ডুবে থাকল, তীব্র শোক থেকে পালিয়ে অফুরান রঙে ডুবে অদ্ভূত সব রহস্যময় আকার,আকৃতি,পশু,পাখী,ষাঁড়, বা এসবের মিশেল নতুন কোন জীবজন্তু বা আকৃতি আঁকল,যা মূলত তাদের ভেতরের ধামাচাপা দেয়া অনিশ্চিত অবস্থারই প্রতিবিম্ব।
আমি অবশ্য ছবি আঁকার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোতেও যেমন ইতিহাস,ভূগোল, বা গণিতে ওদের উৎসাহিত করে তুলতে চাইছি, যদিও ওসব বিষয়ে খুব এলোমেলো ও অমনযোগী ওরা । ওদের কাছে ছবি আঁকাই সবকিছু, একমাত্র ভুবন।
বেশ কিছুদিন পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচিত একটি টিম এলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে। তারা যুদ্ধশিশুদের ব্যপারে আগ্রহ নিয়ে তাদের বর্তমান অবস্থা জানার জন্যে উৎসাহী হল। সাধারণ বিষয়গুলোতে শিশুদের অগ্রগতি তাদেরকে তেমন একটা আশান্বিত করল না। কিন্তু আমি যখন ওদের আঁকা নানারকম ছবি দেখালাম, পরিদর্শকেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে যেন চমকে উঠল। ছবিগুলো দেখে ওরা স্তম্ভিত হয়ে রইল, লাল আর হলুদে আঁকা ঢাউস সব বুনো ষাঁড়। বিশাল বিশাল ক্যানভাসে ছবিগুলো যেন সীমাহীন প্রাণশক্তি এবং ক্রোধ প্রকাশ করে বন্যসৌন্দর্য্য তুলে ধরেছে। এমন একটিও ছবি নেই যেটা কিনা অসাধারণ বা আতঙ্কজনক নয়। যেন হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া অজানা সব গুহাচিত্র। পৃথিবীর সেরা পোষ্ট-ইম্প্রেশানিষ্টদের সুদক্ষ হাতে আঁকা এক বিষ্ময়। অথবা ইম্প্রেশনিস্টদের গুরু। এটা ভয়ংকর এবং ভুতুড়ে! এই দেবশিশুরা কারা! কোন স্বর্গ থেকে এঁদের আগমন! যুদ্ধের বিভীষিকা কি ওদের এতটাই বিপর্যস্ত ও দিব্যজ্ঞানী করে তুলেছে এভাবে!
রাতের খাবারের পর আমরা সবাই একটি গোল টেবিল ঘিরে বসেছি। আমাদের অধিকাংশই লেখক। এদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় নারী লেখক প্রস্তাব দিলেন- যত বেশি ভাষায় সম্ভব আমরা সবাই যেন ‘ধন্যবাদ'শব্দটি তাঁদের বলি। আমি আমার কন্ঠের সকল কারুকাজ দিয়ে প্রিয় ভাষায় শুরু করি প্রথমে, তারপর কেউ জার্মান, কেউ জাপানিজ, কেউ রাশান, কেউ বা সোয়াহেলি ভাষায়...
আমাদের মধ্যে উল্লাস ছিল খুব। ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি নানা ভাষায়,নানা ছন্দে উচ্চারণ করতে করতে কিছুক্ষণের জন্যে আমরা সবাই হেসে উঠি। যুদ্ধ শেষে চারপাশের অন্তহীন কষ্টের ভেতরে সেটি যেন একটু প্রাণের আরাম দেয়।
বাইরে তখন শিশুরা বোমার আঘাতে ভেঙ্গে পড়া বাড়ি গুলোর বিধ্বস্ত আঙিনায় এবং উঁচু টাওয়ারগুলো গর্তের ভেতরে ওদের মায়েদের খুঁজছে।
অবশেষে রাতে,যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্ধকার নগরীটিতে শিশুরা তাঁদের বাড়িগুলোর ভগ্নস্তুপের উপর ঘুমিয়ে পড়ল এবং মৃত বাবা-মা’র ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলো।
অনুবাদক
লুতফুন নাহার লতা
লুতফুন নাহার লতা
গল্পকার। কবি। আবৃত্তিকার। অভিনেত্রী।
নিউ ইয়র্কে থাকেন।
নিউ ইয়র্কে থাকেন।
2 মন্তব্যসমূহ
বাহ! এই গল্পটাও বেশ ভালো লাগলো। তবে বেন ওকরির গল্পে যুদ্ধ, মৃত্যু এসব উঠে এসেছে বেশি।
উত্তরমুছুনগল্পটি প্রাণময়। অনুবাদ ভালো।
উত্তরমুছুন