ভাষান্তর : কুলদা রায়
একজন কোমল মানুষের সঙ্গে আমার চিন পরিচয় ছিল। তার এক ভাই এক খুব ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে সমতলভূমিতে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে মারা যায়। জীবিত ভাইটি-- কোমল ভাইটিও খুব দ্রুত মদে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। সে রাগী এবং অপদার্থ, মদ্যপ, এবং ভদ্র, প্রায় বালিকাদের মতো-- কোমল। সে সব ধরনের স্বাদ ও রঙের স্নাপ্স নামের মদ পান করে।
আমার কাজ ছিল মদের পাত্র পূর্ণ করা আর তার হিসেব রাখা। এছাড়া যখন নিরবতা অসহনীয় হয়ে উঠত তখন জুকবক্সে পয়সা ভরে দিতাম। মারলে হ্যাগার্ড, গার্থ ব্রুকস, এমিলউ গেয়ে উঠত-- ‘ আমি খুব নিচু পাড়া থেকে বন্ধু পেতাম’--। ঐ শহর ও সময়ের মধ্যে যে ভিন্নতা ছিল তাদেরকে এক সূতোয় বেঁধে রাখত বধির করে দেওয়ার মতো এই গানটি।
লোকটি, লোকদুটি--কোমল লোকটি, মরা লোকটির একটি বোন ছিল। সে ছিল দুর্বোধ্য একটি কাছিমের মতো। প্রতি রাতেই সে আসত। তার জীবিত ভাইকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিত। কয়েক মাস ধরে সে ফুল আঁকা পোষাক পরল। তারপর আর পরল না। সে হতাশা হয়ে পড়ল। অথবা অন্য কোথাও চলে গেল। সে কারণে কোমল ভাইটি বুনোভাবে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরত। সে সময়ে সে মাতাল হয়ে লম্বা রাস্তা ধরত। যেসব রাস্তায় বাঁক নেওয়ার রীতি নেই সেখানেই সে বাঁক নিত।
এর কয়েক মাস পরে এক রাতে তার বাড়িতে গেলাম। রাস্তার যে বাঁকটিতে তার ভাইটি মরে গিয়েছিল সেইখানে আমি তাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলাম। আকাশের তারা দেখার জন্য আমরা ঘাসের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। আমার বেশ করুণা হতে লাগল। হ্যা, বেশ আকর্ষকও মনে হল। শোকের মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ পুলকিত হয়-- আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম ছিল না। অন্ধকারের মধ্যে আমরা একটি পাখির সাড়াশব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু পাখিটিকে দেখতে পেলাম না। আমরা মনে করতে লাগলাম-- পড়ন্ত উল্কা, পুড়ন্ত উল্কা, খণ্ডিত উল্কা। স্তরীভূত, আগ্নেয়, রূপান্তরিত।
কিছু সময় পরে আমরা উঠে পড়লাম। সে আমাকে চুমু খেলো। তার চুলের মধ্যে বেশ কিছু বাদাম বীজের খোসা দেখা গেল। ছায়াপথের থুতুর মতো পশমী রুপোলী কিছু জিনিস বাদামের খোসা নিজের মধ্যে ধরে ধরে পুরে নিচ্ছিল। এই জিনিসগুলো আসলে মহাকাশের আবর্জনা টাবর্জনা। তাকে পেয়ে তারা হৈ হুল্লোড় করছিল।
তার জায়গাটি ছিল ছোটো। বাথটাবটি রান্নাঘরের ভেতরেই ছিল। সবচেয়ে লম্বা নখযুক্ত পা এর আগে আমি দেখিনি। এই বাথটাবটিতে হাটু না মুড়েই তুমি শুয়ে থাকতে পারো। উজ্জ্বল মাখনের মতো ফেনার নিচে তলিয়ে যেতে পারো। হয়ে যেতে পারো পুরোপুরি অদৃশ্য। সে নিচে চলে গেল। কতো সময়ের জন্য সে অদৃশ্য হয়ে থাকল তুমি সেটা বিশ্বাস করতে পারবে না। আমি তার মুখ দেখতে পারিনি। কিন্তু তার চোখ দেখা যাচ্ছিল। চোখ ছিল ভয়ঙ্কর, কালো, বিস্তৃতভাবে খোলা। একটি চোখ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। আবার দৃশ্যমান হচ্ছিল। খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে পলক ফেলছিল। এক মিনিট সময় নিয়ে পলকটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
বিছানায় সে অন্ধের মতো হাতড়ে করে যাচ্ছিল। সে ছিল অবিচল ও পাগলের মতো ধীরস্থির। কুকুরের দিকে ইঙ্গিত করার মতো শিস দিয়ে উঠল একবার সে।
শরীর খুলে যায়, খুলে যেতে পারে অদ্ভুতভাবে এবং তখনো আমরা বেঁচে আছি।
যখন তার কাজ হয়ে গেল, সে তখন আবার বাথটাবটি ভরল। কোনো কথা না বলে আমাকে বাথটাবে বয়ে নিয়ে গেল। । আবার সাবানের ফেনা উঠল, বড় বড় ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠল। জাম ফলের ঘ্রাণ ছড়াল। আমার যোনির মধ্যে একটি জ্বলন্ত বেলুন ঢুকে গেল।
জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। বাথটাবে জল জমতে লাগল। আমাদের কারণেই এটা ঘটল বলে আমাদের মনে হলো। আমরা তার মাতাল ভাইয়ের ছাইয়ের উপরে শুয়ে আছি। শুয়ে আছি ঘাসের উপর। এখান দিয়েই সামনের দিকে চলে গেছে সেই ভাইটি। এটা আমার কোনো শোক নয়-- কিন্তু শোক বলেই দাবী করেছি। পাহাড়গুলো কেঁপে কেঁপে উঠল। ভূপৃষ্ঠ প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করল। সে বেঁকে গেল--পাথরগুলো ছড়িয়ে গেল। ঘাসগুলো, অসমানভাবে, হিমবাহের গতির পরিবর্তন হলো। এটা কোনো রূপক নয়। এটা ছিল একটা ভূমিকম্পন, এটা ছিল চলমান তরঙ্গ-- আমার মনে হলো ভূৃপৃষ্ঠ যেন কঠিন পদার্থের মতো মুচড়ে গেছে। এবং তা আবার যেন তরলে রূপান্তরিত হয়েছে।
গল্পকার পরিচিতি
একজন কোমল মানুষের সঙ্গে আমার চিন পরিচয় ছিল। তার এক ভাই এক খুব ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে সমতলভূমিতে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে মারা যায়। জীবিত ভাইটি-- কোমল ভাইটিও খুব দ্রুত মদে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। সে রাগী এবং অপদার্থ, মদ্যপ, এবং ভদ্র, প্রায় বালিকাদের মতো-- কোমল। সে সব ধরনের স্বাদ ও রঙের স্নাপ্স নামের মদ পান করে।
আমার কাজ ছিল মদের পাত্র পূর্ণ করা আর তার হিসেব রাখা। এছাড়া যখন নিরবতা অসহনীয় হয়ে উঠত তখন জুকবক্সে পয়সা ভরে দিতাম। মারলে হ্যাগার্ড, গার্থ ব্রুকস, এমিলউ গেয়ে উঠত-- ‘ আমি খুব নিচু পাড়া থেকে বন্ধু পেতাম’--। ঐ শহর ও সময়ের মধ্যে যে ভিন্নতা ছিল তাদেরকে এক সূতোয় বেঁধে রাখত বধির করে দেওয়ার মতো এই গানটি।
লোকটি, লোকদুটি--কোমল লোকটি, মরা লোকটির একটি বোন ছিল। সে ছিল দুর্বোধ্য একটি কাছিমের মতো। প্রতি রাতেই সে আসত। তার জীবিত ভাইকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিত। কয়েক মাস ধরে সে ফুল আঁকা পোষাক পরল। তারপর আর পরল না। সে হতাশা হয়ে পড়ল। অথবা অন্য কোথাও চলে গেল। সে কারণে কোমল ভাইটি বুনোভাবে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরত। সে সময়ে সে মাতাল হয়ে লম্বা রাস্তা ধরত। যেসব রাস্তায় বাঁক নেওয়ার রীতি নেই সেখানেই সে বাঁক নিত।
এর কয়েক মাস পরে এক রাতে তার বাড়িতে গেলাম। রাস্তার যে বাঁকটিতে তার ভাইটি মরে গিয়েছিল সেইখানে আমি তাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলাম। আকাশের তারা দেখার জন্য আমরা ঘাসের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। আমার বেশ করুণা হতে লাগল। হ্যা, বেশ আকর্ষকও মনে হল। শোকের মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ পুলকিত হয়-- আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম ছিল না। অন্ধকারের মধ্যে আমরা একটি পাখির সাড়াশব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু পাখিটিকে দেখতে পেলাম না। আমরা মনে করতে লাগলাম-- পড়ন্ত উল্কা, পুড়ন্ত উল্কা, খণ্ডিত উল্কা। স্তরীভূত, আগ্নেয়, রূপান্তরিত।
কিছু সময় পরে আমরা উঠে পড়লাম। সে আমাকে চুমু খেলো। তার চুলের মধ্যে বেশ কিছু বাদাম বীজের খোসা দেখা গেল। ছায়াপথের থুতুর মতো পশমী রুপোলী কিছু জিনিস বাদামের খোসা নিজের মধ্যে ধরে ধরে পুরে নিচ্ছিল। এই জিনিসগুলো আসলে মহাকাশের আবর্জনা টাবর্জনা। তাকে পেয়ে তারা হৈ হুল্লোড় করছিল।
তার জায়গাটি ছিল ছোটো। বাথটাবটি রান্নাঘরের ভেতরেই ছিল। সবচেয়ে লম্বা নখযুক্ত পা এর আগে আমি দেখিনি। এই বাথটাবটিতে হাটু না মুড়েই তুমি শুয়ে থাকতে পারো। উজ্জ্বল মাখনের মতো ফেনার নিচে তলিয়ে যেতে পারো। হয়ে যেতে পারো পুরোপুরি অদৃশ্য। সে নিচে চলে গেল। কতো সময়ের জন্য সে অদৃশ্য হয়ে থাকল তুমি সেটা বিশ্বাস করতে পারবে না। আমি তার মুখ দেখতে পারিনি। কিন্তু তার চোখ দেখা যাচ্ছিল। চোখ ছিল ভয়ঙ্কর, কালো, বিস্তৃতভাবে খোলা। একটি চোখ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। আবার দৃশ্যমান হচ্ছিল। খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে পলক ফেলছিল। এক মিনিট সময় নিয়ে পলকটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
বিছানায় সে অন্ধের মতো হাতড়ে করে যাচ্ছিল। সে ছিল অবিচল ও পাগলের মতো ধীরস্থির। কুকুরের দিকে ইঙ্গিত করার মতো শিস দিয়ে উঠল একবার সে।
শরীর খুলে যায়, খুলে যেতে পারে অদ্ভুতভাবে এবং তখনো আমরা বেঁচে আছি।
যখন তার কাজ হয়ে গেল, সে তখন আবার বাথটাবটি ভরল। কোনো কথা না বলে আমাকে বাথটাবে বয়ে নিয়ে গেল। । আবার সাবানের ফেনা উঠল, বড় বড় ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠল। জাম ফলের ঘ্রাণ ছড়াল। আমার যোনির মধ্যে একটি জ্বলন্ত বেলুন ঢুকে গেল।
জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। বাথটাবে জল জমতে লাগল। আমাদের কারণেই এটা ঘটল বলে আমাদের মনে হলো। আমরা তার মাতাল ভাইয়ের ছাইয়ের উপরে শুয়ে আছি। শুয়ে আছি ঘাসের উপর। এখান দিয়েই সামনের দিকে চলে গেছে সেই ভাইটি। এটা আমার কোনো শোক নয়-- কিন্তু শোক বলেই দাবী করেছি। পাহাড়গুলো কেঁপে কেঁপে উঠল। ভূপৃষ্ঠ প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করল। সে বেঁকে গেল--পাথরগুলো ছড়িয়ে গেল। ঘাসগুলো, অসমানভাবে, হিমবাহের গতির পরিবর্তন হলো। এটা কোনো রূপক নয়। এটা ছিল একটা ভূমিকম্পন, এটা ছিল চলমান তরঙ্গ-- আমার মনে হলো ভূৃপৃষ্ঠ যেন কঠিন পদার্থের মতো মুচড়ে গেছে। এবং তা আবার যেন তরলে রূপান্তরিত হয়েছে।
গল্পকার পরিচিতি
আমেরিকান গল্পকার নয় হোল্যান্ডের জন্ম ১৯৬০ সালের ৩ ডিসেম্বর। লেখক সাম মিশেল তার স্বামী। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি ও লেখক বিভাগের প্রফেসর। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালিয় থেকে ফাইন আর্টসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস বার্ড প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। এই উপন্যাসেই তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার গল্পগ্রন্থ-- I was trying to describe what it feels like (2017), The spectacle of the body (1994), উপন্যাস--what begins with bird (2005).
হোল্যান্ড টালি গল্পটির প্রথম বাক্যটি লেখেন তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে সেপ্টেম্বরের একটি দিনে। এই বাক্যটি আর তার ঘোর নিয়ে গল্পটি লিখেন ফেলেন। সে সময় তারা মাঝে মাঝে যে বিষয়টিকে বেশি ভয় করতেন তারা সেই ভয়ের মুখেই চলে যেতেন। মনটানা শহরের একটি বার, কাউবয় বার, হোরফ্রস্টে যেতেন। শুনতেন জুকবক্সে গান। সে সময়ে তার ছিল পাখিদের রক্ষা করার কুকুর আর একটি সস্তা এপার্টমেন্ট।
টালি গল্পটি মাত্র ৫০০ শব্দের একটি খুদে গল্প। অসামান্য শক্তিশালী এই গল্পটি গল্প ও কবিতার যুগলমিলন। প্রথম বাক্যটিতেই তিনি ব্যবহার করেছেন বিপরীতার্থক শব্দযুগল-- মাতাল ও কোমল। তৃতীয় বাক্যটির শব্দগুলো খাপছাড়া। সহজে বোঝা যায় না। জয়সি ক্যারি যেমন বলেছেন, প্রত্যেক শিল্পীকে একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়-- জটিল করে ছবিটি এঁকেছ কেনো?
হোল্যান্ড টালি গল্পটির প্রথম বাক্যটি লেখেন তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে সেপ্টেম্বরের একটি দিনে। এই বাক্যটি আর তার ঘোর নিয়ে গল্পটি লিখেন ফেলেন। সে সময় তারা মাঝে মাঝে যে বিষয়টিকে বেশি ভয় করতেন তারা সেই ভয়ের মুখেই চলে যেতেন। মনটানা শহরের একটি বার, কাউবয় বার, হোরফ্রস্টে যেতেন। শুনতেন জুকবক্সে গান। সে সময়ে তার ছিল পাখিদের রক্ষা করার কুকুর আর একটি সস্তা এপার্টমেন্ট।
টালি গল্পটি মাত্র ৫০০ শব্দের একটি খুদে গল্প। অসামান্য শক্তিশালী এই গল্পটি গল্প ও কবিতার যুগলমিলন। প্রথম বাক্যটিতেই তিনি ব্যবহার করেছেন বিপরীতার্থক শব্দযুগল-- মাতাল ও কোমল। তৃতীয় বাক্যটির শব্দগুলো খাপছাড়া। সহজে বোঝা যায় না। জয়সি ক্যারি যেমন বলেছেন, প্রত্যেক শিল্পীকে একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়-- জটিল করে ছবিটি এঁকেছ কেনো?
1 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভাল অনুবাদ
উত্তরমুছুন