লুসিয়া বার্লিনের গল্প : বাঘের কামড়

অনুবাদ : রোখসানা চৌধুরী

(০১)
ট্রেনটা এল পাসোর বাইরে দেখা যাচ্ছিল। আমি আমার ছেলে বেনকে জাগাইনি। কিন্তু তাকে সাথে নিয়েই বের হয়ে ছিলাম যাতে তাকে নজরে রাখতে পারি। বিভিন্ন মশলাযুক্ত খাবারের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। রিও গ্র্যান্ডে অবস্থিত মেক্সিকান পানশালাটি খাবারের জন্য বিখ্যাত ছিল।

আমি যখন প্রথম সেই পবিত্র ভূমিতে যাই মা আর দাদার সঙ্গে, সেই প্রথম আমি মেরি জেসাস, পাপ-পূণ্য সম্পর্কে জানতে পাই। এসব উপাখ্যান জেরুজালেমের এল পাসোতে পর্বত আর মরুভূমির ভাঁজে ভাঁজে মিশে আছে, নদীর জলে ভিড় করেছে। রাতের তারাগুলো ছিল অনেক বড় আর উজ্জ্বল। এরা মহৎ মানুষগুলোর মত অদৃশ্যে থেকেও পথ দেখিয়ে যায়।

আমার চাচা টাইলর ক্রিসমাসের পুনর্মিলনীর জন্য ভোজের আয়োজন করছিলেন, আমরা যাচ্ছিলাম সেখানে। তিনি আমার আত্মীয় স্বজনের দেখা পাওয়ার আশা রেখেছিলেন। আর আমি আসল ব্যাপারগুলো আড়াল করে রেখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে বাবা-মাকে নিয়ে আমি আতঙ্কগ্রস্তই হয়ে পড়েছিলাম। আমার স্বামী জো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এইই কারণে তারাও আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।

আমি মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিয়ে করেছিলাম, সর্বশেষ খড়কুটো আকঁড়ে ধরতে গিয়ে বিচ্ছেদও ঘটে গিয়েছিল। আর এসব নিয়ে তারা প্রায় মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন ।

কিন্তু আমি আমার চাচা জন আর চাচাতো বোন বেলা লীনকে না দেখে কিছুতেই থাকতে পারছিলাম না। তারা এসেছিলেন লস এ্যাঞ্জেলস থেকে। আর সেখানে ছিলও বেলা লীন, আহা! কিভাবে বর্ণনা করব তাকে? ট্রেন ডিপোর পার্কিং লটের কাছাকাছি একটা নীল রঙের ক্যাডিলাক গাড়ির ভেতর থেকে সে হাত নাড়ছিল। পরনে ছিল জমকালো কারুকাজ করা পাড়অলা নরম চামড়ার পোশাক। সে সম্ভবত পশ্চিম টেক্সাসের সবচেয়ে রূপসী নারী। অবশ্যই তার সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল।

বেলার চোখ ছিল হলদে বাদামী আর দীর্ঘ সোনালী চুল। আর তার হাসি, বরং বলা ভালো ঝর্ণার মতো সুরেলা ধ্বনি যেন সকল দুঃখবোধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাত। বেনের ছোট বিছানাসমেত আমাদের ব্যাগগুলো সে গাড়ির পেছনে ছুঁড়ে দিল। সে আমাদের বার বার আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে চুমু দিচ্ছিল। আমরা গাড়িতে উঠে শহরের দিকে রওনা দিলাম।

আবহাওয়া ঠান্ডা হলেও বাতাস ছিল বিশুদ্ধ আর কুয়াশামুক্ত। সে ড্রাইভ করতে করতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। আর আমরা সেই কথার স্রোতে গাড়ির গতির সাথে ভেসে যাচ্ছিলাম।

‘শোনো, প্রথমেই বলে নেই আমাদের বাড়িতে ক্রিসমাস উৎসবের আয়োজন চলছিল। জন চাচা এখানে এসেছেন গত পরশু ক্রিসমাস ইভের দিন। ও গড, ও মেরি আমাকে রক্ষা করো। তোমার মা আর আমার মা মদ পান করতে করতে শুরু করল ব্যাট দিয়ে মারামারি। মা উঠে গেলো গ্যারেজের ছাদে, কিছুতেই নামানো যাচ্ছিল না। এদিকে তোমার মা আবার তার হাতে দিল থু থু ছিটিয়ে।’
‘ও মাই গড!’
‘আরে বোলো না, এটা তো তবুও কিছুই না। কে জানে কেনো খালা আত্মহত্যার জন্য সুইসাইড নোট লিখতে শুরু করল। তুমি নাকি তার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছো। তাকে সেন্ট জোসেফের মানসিক রোগ ওয়ার্ডে বাহাত্তর ঘন্টা রাখা হয়েছিল। আর তোমার বাবা তো আসেইনি। সে তোমার ‘ডিভোর্স’ বিষয়টা নিয়ে চরম আতঙ্কিত ছিল। আমার পাগল দাদীমাও সেখানে ছিল। হা হতোস্মি! সেকেলে ভয়ংকর সেই সব আত্মীয় এসেছিল লুবক থেকে। বাবা তাদের গাড়িতে করে মোটেলে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল। তারা সারাদিন শুধু খায় আর টিভি দেখে। তারা আবার জন্ম নেবে এসব বলার সুখ নেয়ার জন্য যে, তুমি আর আমি পুরাই আবর্জনার ভাগাড়ে চলে গেছি। রেক্স কিপ এখানেই ছিল। সে আর বাবা মিলে সারাদিন ধরে গরিব মানুষদের জন্য উপহার কিনেছে আর বাবার আউটহাউস ভরে সেগুলো সাজিয়েছে’।
যাত্রা বিরতিতে সবার জন্য বার্গার মল্ট ড্রিংক আর ফ্রাইয়ের অর্ডার দেয়া হলো। সব সময়ের মতো আমি তাকে বেনের জন্য আলাদা কিছু বলতে বললাম। সে মাত্র দশ মাসের। কিন্তু সে বেনের জন্যও বার্গার আর ফ্রাই বলল। আমাদের পুরো পরিবারটিই ছিল ভোজনরসিক। আমার বাবা অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিল। সে এসেছিল নিউ ইংল্যান্ড থেকে। তার চরিত্রে দায়িত্বশীলতা আর মিতব্যয়িতার অদ্ভুত মিশেল ঘটেছিল।
এইসব প্রথমিক কুশলাদির পর বেলা আমাকে জানিয়েছিল তার বিয়ে আর তার বর ক্লেটিস সম্বন্ধে। তাদের বিয়ে হয়েছিল মাত্র দু মাস হল। বিয়ের সময় তার আত্মীয় স্বজনরাও তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে যেমনটা ঘটেছিল আমার বেলা। ক্লেটিস মূলত ছিল নির্মাণ কর্মী, রোডি রাইডার। বিয়ের গল্পটা বলতে বলতে বেলার চকচকে গাল ভিজে যাচ্ছিল অবিরত কান্নায়।
যাকগে সেসব, তোমাকে দেখে আমি কি খুশি যে হয়েছি তা বোঝাতে পারবনা লৌ।’

‘লৌ, তোমাকে বলি, আমরা সুখী ছিলাম ঝিনুকের মত। আমি বলছি--এরকম প্রেম জীবনে কেউ কখনো দেখে নাই। কেন স্বর্গের মতো সুখ পায় ঝিনুকেরা? দক্ষিণ উপত্যকায় আমাদের স্বর্গের মতো একটুকরো জীবন ছিল-- প্রিয় নদীর ধারে। আমাদের ছোট্ট নীল স্বর্গ। আমি ঘর পরিষ্কার করি, থালা বাসন মাজি, রান্না করি। আনারসের কেক, ম্যাকরোনি- এইসব। প্রথম যে বাজে ঘটনাটা ঘটে তা হলো--বাবা আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। ঐ যে, রীম রোডের বাড়িটা তোমার মনে পড়ে? একটা বিশাল প্রাসাদ যেন, কলামগুলো স্তম্ভের মতো পোর্চের উপর দাঁড়ানো। হলো কি, সেখানে গিযে বাবার সাথে ক্লেটিসের একটা বাজে ঝগড়া হয়ে গেলো। আমি চেষ্টা করলাম, বাবাকে বোঝাতে চাইলাম। চাইনা আমাদের ওরকম প্রাসাদ, তার চাইতে আমার স্বামীর চালাঘর ভালো। আমি ক্লেটিসকেও বারংবার বুঝিয়েছি। এমনকি তার গোমড়া হয়ে যাওয়া মুখকে উপেক্ষা করেই। তারপর একদিন শিং মলে গেলাম কিছু কাপড় চোপড় কিনতে। আমার পুরোনো অল্প কিছু স য় যা ছিল। ক্লেটিসের একটা অভিযোগ ছিল সে যা ছয় মাসে রোজগার করে আমি নাকি তা দুই ঘন্টায় উড়িয়ে দিতে পারি। তাই আমি এইসব জিনিসপত্র বাইরে জড়ো করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলাম। তারপর আমরা পরস্পর চুম্বন করে মিলিত হলাম। ওই, প্রিয় লৌ, আমি তাকে ভয়ংকর রকম ভালোবাসি।

এরপর আমি যে বোকার মত কাজটি করেছি সেটা শোনো। মা আমাকে ডাকতে এলো। আমি একদম পুরা বিবাহিত গৃহিনীর মতো তাকে কফি দিয়ে আপ্যায়িত করলাম। পিরিচে বিস্কুট ঢেলে দিলাম। আমি তো সরাসরি সেক্স বিষয়ে বকবক করতে শুরু করে দিলাম। কারণ আমার ধারণা আমি যথেষ্ট আর উপযুক্ত হয়েছি এসব বিষয় আলাপের জন্য। আরে বাপরে বাপ, তুমি বিশ্বাস করবে না কী ঘটলো, শুধু জানতে গিয়েছিলাম আমি যদি হঠাৎই প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ি তাহলে মোটা অবস্থায় কি ক্লেটিসের ঘরেই ঐ সময়টা কাটাবো কিনা? সে সোজা বাড়িতে দৌড়ে ফিরে গিয়ে এই কাহিনী জানিয়ে দিল। সমস্ত কিছু যেন তাদের মাথায় ভেঙেচুড়ে পড়ল। সেই রাতেই বাবা আর রেক্স আমার বাড়িতে এলো। ক্লেটিসকে দিনে দুপুরে পিটিয়ে মেরে হাড্ডি ভেঙ্গে দিয়েছে দুটো পাঁজরের হাড় সহ। তাকে নাকি তারা যৌন নিপীড়ক সমকামী হিসেবে জেলে দেবে। সাথে বিবাহ বিষয়ক চুক্তিভঙ্গ। চিন্তা করতে পারো, আইনানুগভাবে বিবাহিত স্বামীর বিরুদ্ধে বেআইনী সম্পর্কের অপবাদ।

যাই হোক আমি বাবার সাথে বাড়ি ফিরে যাবনা, যতদিন লাগে আমি ক্লেটিসের পাশে আছি তাকে রক্ষা করতে আর বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। আর আমরা ভালো আছি। আবার আমরা ঝিনুকের খোলসে মুক্তোর মতো হয়ে সুখী হবো। যদিও ক্লেটিস অতিরিক্ত পান করে, এতটাই যে সে কাজেই ফিরতে পারে না। গত সপ্তাহে আমি আমাদের গ্যারেজের বাইরে এই ক্যাডিলাকটা দেখতে পেলাম। এটার চারপাশে রঙিন রিবন আর সান্টার পুতুল সাজানো ছিল। আমি হাসছিলাম, জানোইতো এটা বাচ্চাদের মতো শিশুতোষ ব্যাপার ছিল যদিও, তবুও খুশি লাগছিল। ক্লেটিস বলছিল, কি খুশি তো? আমি তো তোমার বাবার মতো করে তোমাকে খুশি করতে পারব না কখনো। এটা বলে সে চলে গিয়েছিল। আমি অনুভব করলাম সে কান্না লুকাতে আড়ালে চলে গিয়েছিল আর সামলে নিতে ফিরেও এসেছিল। হায়! এবার সে চলে গেছে আর ফিরবেনা।

সে লুজিয়ানাতে একটা তেলের পাম্পে কাজ করতে গিয়েছিল। এমনকি সে ফোনও করতনা। তার বিরক্তিকর মা কাপড় চোপড় আর ঘোড়ার জিন নিতে এসে বলেছিল সে কথা।’

আমার ছোট্ট বেন বাবুসোনাটি এদিকে সব বার্গার আর বেশিরভাগ কলার কেক খেয়ে নিয়েছিল এর ভেতর। সে নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণটাই বেলা লীনসের জ্যাকেটের উপর ছুঁড়ে দিয়েছিল। জ্যাকেটটা বেলা পেছনের সীটে রেখেছিল। আমরা বেনকে পরিষ্কার করে নতুন ডায়াপার পরালাম। জামা কাপড় বদলে দিলাম। সে একেবারেই কান্নাকাটি করছিল না। গাড়িতে বাজতে থাকা রকএন-রোল মিউজিক তার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তাছাড়া বেলার কথার আওয়াজ আর চুলের উপর থেকে তার নজরই সরছিল না।
আমি বেলা আর ক্লেটিসের ভালোবাসার গল্প শুনতে শুনতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি জোকে সম্মান করতাম। কিন্তু সবসময় ভয়ে থাকতাম তাকে খুশি করা গেলো কিনা এটা ভেবে কারণ কখনোই সে আমাকে পুরোপুরি ভালোবাসতে পারেনি। আমি দুর্দশাগ্রস্ত হলেও তা ততটা অনুভব করতাম না কারণ আমার মনে হত সমস্ত ভুল আমারই।

আমিও বেলাকে আমার ছোট বিষাদগ্রস্ত দুখী কাহিনীটা বললাম। জো কেমন চমৎকার ভাষ্কর্য গড়ত। সে যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল, সাথে একটা বিশাল বাড়ি আর ঢালাই কারখানা। কিন্তু এসব ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল। কারণ শিল্পই ছিল তার জীবন। হ্যাঁ, এ কথাটা তার মতো নাটকীয়ভাবেই সবার কাছে বলার চেষ্টা করি আমি।
কিন্তু, না কোন সাহায্য চাই না, এমনকি তার শিশুর জন্যও কোনো কিছু চাইনা। আমি তার ঠিকানা পর্যন্ত জানিনা।

আমরা পরস্পর জড়িয়ে ধরলাম, কাঁদলাম, তারপর হঠাৎই বেলা বলে উঠল, অন্তত তুমি তো একটা বাচ্চা পেয়েছ তার কাছ থেকে।
‘বাচ্চাগুলো বলো।’
‘কি?’
‘আমি চার মাসের অন্ত:সত্ত্বা। এটা ছিল শেষ খড়কুটো জো কে ফিরে পাবার।’
‘এটা শেষ খড়কুটো? কি বলছ তুমি? কি করতে যাচ্ছ তা খেয়াল আছে? কোনো আত্মীয় স্বজন এ বিষয়ে তোমার পাশে থাকবে না। তোমার মা আত্মহত্যা করবে এটা শুনলে।’
‘আমি আসলে বুঝতেই পারছিনা কি করব? আরো একটা উৎকট ঝামেলা আমার ঘাড়ে। আমি আরো আগেই আসতাম। কিন্তু আমার কোম্পানী ছুটি দেয়নি। আমিও সাথে সাথেই দিলাম চাকরি ছেড়ে। আর চলে এলাম এখানে। এখন এই অন্ত:সত্ত্বাকালীন অবস্থায় চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
‘ও গড! তোমার যা প্রয়োজন তা হলো গর্ভপাত, লৌ, যথেষ্ট হয়েছে।’
‘কোত্থেকে করব? আমি কিছু চিনিওনা... এটাই যদিও সহজ দুটো বাচ্চা একা পালার চাইতে।’ ‘যতটা শুনেছি, এটা পুরোপুরি সত্য না। বেনের মত মিষ্টি বাচ্চা এখানে আছে বলেই সবকিছু সুন্দর লাগছে। সে এখন কারো কাছে রেখে চাকরিতে যাবার মত বড় হয়েছে যদিও তাকে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়াটা দুঃখের আর লজ্জার। কিন্তু তবুও তুমি নিশ্চয়ই একটা নবজাতক শিশুকে এভাবে ফেলে যেতে পারবেনা।’
‘হ্যাঁ, এটাই আসলে বর্তমান পরিস্থিতি।’
‘তুমি একদম তোমার বাবার মত করে কথা বলো। আসল পরিস্থিতি হলো তোমার মাত্র ঊনিশ বছর আর খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে। তোমার উচিত এখন ব্যক্তিত্ববান, আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর কোন মানুষকে খুঁজে নেয়া যে তোমাকে ভালোবেসে বেনকে আপন করে নেবে। অথচ তুমি খুঁজছ এমন এক মানুষকে যে তোমার দুই শিশু পুত্রের দায়িত্ব নেবে। এজন্য প্রয়োজন অতি দয়ালু আর প্রায় ঋষি-সন্ন্যাসী টাইপের কেউ যাকে বিয়ে করে তুমি ধন্য হবে। অথচ আমি জানি তুমি কদিন বাদেই অনুতপ্ত বোধ করবে আর তাকে ঘৃণা করতেও শুরু করবে, কারণ তাকে তুমি পাগলের মতো ভালোবাসতে। সেই ভাড়াখাটা এক স্যাক্সোফোন বাদককে। ওহ, ট্র্যাজিক, ট্র্যাজিক, ভীষণ দুঃখজনক, লৌ। আমি ভাবতে পারছিনা, প্লিজ ভেবে দেখো। এটা সিরিয়াস ব্যাপার। তুমি আমার কথা শোনো আর নিজের ব্যাপারে ভাবো। আমি কি সব সময় তোমার ভালোটা চেয়ে আসিনি।’
আসলে এসব বিষয়ে আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না বা চাইছিলামও না। আমি এখানে এসেছিলাম সবকিছু ভুলে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে আর আনন্দ-ফূর্তি করতে। আমি অবশ্য তাকে এসব কিছুই বললাম না। অবস্থা অবশ্য তার চাইতে খারাপই ছিল। মা আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন আমার জন্য আর বাবা তো দেখাই করতে আসেননি।
‘তুমি এখানে থাকো। আমাদের জন্য কফি বলো। আমি কিছু ফোনকল সেরে আসি।’ এ কথা বলে পুরুষকুলের প্রতি হাসির ঢেউ তুলে সে চলে গেলো, যে হাসি দিয়ে প্রতি গাড়ি থেকেই তাদের ইশারা করেছিল ফোন বুথের দিকে যাবার জন্য। সে সেখানে দীর্ঘ সময় কাটলো। মাঝখানে দু’বার এলো। একবার গরম কাপড় আর কফির জন্য, আরেকবার আরো কিছু পয়সা নিতে। বেন গাড়ির ভেতর রেডিও নব আর উইন্ডশীল্ড ওয়াইপার নাড়াচাড়া করে খেলছিল। এক বোতল গরম দুধ পান করে আমার কোলেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
বেলা যখন ফিরে এল তখন আনন্দে তার মুখ ঝলমল করছিল। আমাকে এক টুকরো স্মিত হাসি ছুঁড়ে দিয়ে সে গান ধরল।
‘লৌ, সব কিছু ঠিকঠাক করলাম। আমিও এর ভিতর দিয়ে গেছি। ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু তবুও জায়গাটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য সম্মত আর নিরাপদ তো বটেই। তুমি আজই বিকেল চারটায় যাবে আর সকাল দশটা নাগাদ মুক্ত হয়ে যাবে। তারা তোমাকে এ্যান্টিবায়োটিক আর ব্যথানাশক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। এটা তোমাকে একটা পিরিয়ডের চাইতে বেশি যন্ত্রণা দেবে না। আমি বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি আমরা শপিং এর জন্য এখানে রাতটা থেকে যাব। আসলে যেখানে আমি আর বেন থাকব, পরস্পরকে আরো ভালোভাবে জানার জন্য। আর তুমি কয়েক লহমায় এসব সমস্যা উৎরে ফিরে আসবে।
‘এক মিনিট বেলা, আমি আসলে এভাবে ভাবিইনি কখনো।’
‘আমি জানি ভাবতে পারার কথা নয় তোমার। তাই আমিই ভেবেছি পুরোটা।’
‘আমরা কোনো ভুল করতে যাচিছ না তো।’
‘তোমাকে তো একজন ডাক্তারই তো তত্ত্বাবধান করবে। টেক্সাসের ডাক্তার তাদের যথাসাধ্য করবে।’
‘যদি আমি মারা যাই তবে বেনের কি হবে ওকে কে দেখবে? ’
‘আমিই করবো। আশা করি একজন ভালো মায়ের ভূমিকাও পালন করতে পারব আমি।’
আমি শুনে হাসলাম। সে এটা গুরুত্ব নিয়েই বলছে। আসলেই তো একটা গুরুদায়িত্বের বোঝা আমার মাথা থেকে নেমে যাচ্ছিল। বেনের আরো একটা সংস্করণের জন্য একবারও ভাবছিলাম না।
ঈশ্বর, এ যে মুক্তি! সে ঠিকই বলেছিল। গর্ভপাতই যথার্থ সিদ্ধান্ত। আমি আমার চোখ বন্ধ করে একটা লম্বাশ্বাস নিয়ে পিছনের সীটে হেলান দিলাম।
‘আচ্ছা, আমার কাছে তো যথেষ্ট টাকা-পয়সাও নেই। এটা করতে কত পড়বে?:’
‘নগদে পাঁচশ। এটা আমার নরম ছোট্ট সুন্দর হাতটি সম্ভবপর করে দেবে। লৌ, এমন কি পুড়িয়ে দেওয়ার মতোও আমার যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রয়েছে। আমি প্রায়ই বাবা মার কাছে যাই। যদি শুধু বলি ক্লেটিসের জন্য মন কেমন করছে অথবা আমি একটা সেক্রেটারিয়াল কোর্স করতে যাচ্ছি অমনি তারা আমার হাসিমুখ দেখতে তড়িঘড়ি করে ব্যবস্থা করে দেন।’
‘আমি জানি।’ আমি আসলেই জানতাম আমার আত্মীয় স্বজনের অবজ্ঞা- উপেক্ষার পাশাপাশি তারা সত্যিই অনেক বড় মনের ছিল।
আমি এমনকি এরকমটা ভাবতাম যে, অনেক বড় একটা বাঘ আমাকে কামড়ে দিয়েছে, আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেছি। আর মা কিছু টাকা ফেলে দিয়ে মজা উড়াবেন এই বলে যে, ‘এক হাতে তো আর তালি বাজে না।’
আমরা ব্রিজের কাছে চলে এসেছিলাম প্রায়, যেখান থেকে মেক্সিকোর সুগন্ধ ভেসে আসছিল পোড়া মাংসের ধোঁয়া, ঝাঁঝালো মরিচ আর বিয়ার, আরো ছিল কারনেশন ফুল, মোম, কমলা লেবুর ঘ্রাণ। আমি উত্তেজিত ভাবে গাড়ির জানালা নামিয়ে দিলাম যাতে আমার বাড়ির পথ নজরে আসে। রাস্তা জুড়ে উৎসবের কোলাহল, বাঁশি, ভেঁপুর ক্রমাগত আওয়াজে চারদিক সরগরম। আমেরিকান মদ্যপ সৈনিকরা হল্লা করছিল। উপস্থিত ছিল এল পাসোর অভ্যাগতবৃন্দ। গম্ভীরমুখ দোকানীরা জগভর্তি রাম নিয়ে ছুটোছুটি করছিল।

আমরা একটা দামী সুসজ্জিত হোটেলে উপস্থিত হলাম, সেখানে একজন চটপটে সুদর্শন যুবক গাড়ি সরিয়ে নিল। আরেকজন নিল আমাদের ব্যাগগুলো, আর বেনকে বিনা দ্বিধায় এক বাহুতে নিয়ে রওনা দিল সে। আমাদের রুমটা ছিল অভিজাত আর বিলাসবহুল। চিত্রকলা, এ্যান্টিক আর চমৎকার কার্পোটে সুসজ্জিত। একটা জানালার শার্সি উঁচু করতেই বাইরে মনোরম বাগান, চোখ ধাঁধানো কৃত্রিম ঝরনা আর বিশাল সুইমিং পুল দেখা গেল। বেলা রুম সার্ভিসকে আসতে খবর দিল, জগভর্তি কফি, রাম, কোক, পেস্ট্রি, ফলমূলের অর্ডার দেবার জন্য। আমি তাকে বেনের সিরিয়াল কীভাবে বানাতে হয় তা শেখাচ্ছিলাম আর বারংবার নিষেধ করছিলাম যাতে তাকে চকলেট বা আইসক্রীম না দেয়া হয়।
‘ফ্ল্যান চলবে? আমি সায় জানাতে সে ফোনে ফ্ল্যান কেকের অর্ডার দিল। বেলা আবারো ফোন করল একটা গিফট শপে। গোসলের জন্য টুকিটাকি, প্রচুর খেলনা আর নিজের সময় কাটাতে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের অর্ডার করতে।
‘আমাদের হয়তো এখানে ক্রিসমাসের পুরো সময়টাই কাটাতে হতে পারে। ভুলে যাও ক্রিসমাসের উৎসব।’-- বেলা হাসতে হাসতে বলল।


(২)
আমি বেনকে নিয়ে চত্ত্বরের চারপাশে হেঁটে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। আমি খুব নিশ্চিন্ত আর সুখী বোধ করছিলাম, তাই বেলা যখন হঠাৎই জানালো আমার যাবার সময় হয়ে গেছে তখন আমি চমকে উঠলাম কেন জানি। সে আমাকে পাঁচশ ডলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল ট্যাক্সি আমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। গাড়ির বিল পেমেন্ট করা হয়েছে আগেই। যদি আমার আরো কিছু অর্থের প্রয়োজন হয় তাহলে ওর নাম আর নির্দিষ্ট একটা নাম্বারও দিয়ে দিলো যেগুলো দেখালে আমি অর্থ সাহায্য পেতে পারি। আমি বেলা আর বেনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। 

ট্যাক্সি আমাকে নুয়েভা পাবলানা রেস্টুরেন্টের পেছনের প্রবেশ দরোজায় নিয়ে গেল। যেখানে আরো দুজন কালো পোশাক আর সানগ্লাস পরা যুবক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি যেখানে মিনিট দুয়েকের বেশি দাঁড়াতে পারিনি। দ্রুততার সাথে তারা আমাকে একটা সেডান গাড়িতে তুলে নিল। একজন দরজা খুলে দিল, অন্যজন আরেক দিক দিয়ে ঘুরে এল। ড্রাইভারটা একদমই অল্প বয়সী ছিল। সে চারপাশে ভালো করে দেখে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ির পেছনে আমি যেখানে বসেছিলাম সেখানকার সীটগুলো ছিল একদম নিচু আর জানালাগুলো পর্দা দিয়ে ঢাকা। তাই ভেতর থেকে বাইরের কোনো কিছুই নজরে আসছিল না। শুধু অনুভব করলাম যেন গাড়িটা বৃত্তাকারে ঘুরে এলো। তারপর ক্রমাগত স্পিড ব্রেকারের ভাঙা ভাঙা ঝাঁকুনি, আরো আরো বৃত্তাকার দুলুনি, তারপর একসময় গাড়ি থামল কোথাও। বিশাল কাঠের ফটক ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আমরা ঢুকতেই পেছনে গেট বন্ধের শব্দ হলো। 

আমি দুর থেকেই এক নজরে চত্বরে এক কালো পোশাক পরা মহিলাকে দেখতে পেয়েছিলাম। অথচ সে আমাকে যেন ঠিকভাবে দেখতেই পাচ্ছিল না। আমার দিকে সরাসরি না তাকানো, ভালোভাবে সম্ভাষণ না করা বা কথা না বলা এগুলো মেক্সিকান উষ্ণ অতিথিপরায়ণতা বা উদারচিত্ততার সাথে একেবারেই যাচ্ছিল না। উল্টো চরম অপমান বোধ করছিলাম। হাসপাতাল বিল্ডিংটা ছিল হলুদ ইটের, সম্ভবত পুরোনো কোনো কারখানা ভবন ছিল। পুরো চত্ত্বরটি সিমেন্টে পাকা বাঁধাই করা, কিন্তু সেখানে এখন কিছু ক্যানারী পাখির খাঁচা, ফুলের টব শোভা পাচ্ছে। বোলেরো সঙ্গীতের ধ্বনি, হাসি, থালা বাসনের পরস্পর ঠৌকাঠুকির টুংটাং আওয়াজ আর সাথে পেঁয়াজে-রসুনে ঝাঁঝালো মুরগি রান্নার সুগন্ধও ভেসে আসছিল।
একটি কর্পোরেট চেহরার মেয়ে অভ্যর্থনার চেয়ার থেকে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে বসতে বলল। সে করমর্দন করল কিন্তু নিজের নাম বলল না। উল্টো আমার নাম জানতে চাইল। পাঁচশ ডলার নিয়ে নিল। জেনে নিল জরুরি প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় ব্যাক্তির নাম ও ফোন নম্বর। এই সবকিছু একাই প্রশ্ন করে জেনে নিল। কিন্তু কোথাও আমার স্বাক্ষর নেয়া হলো না। আমি তাদের সাথে স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহার করিনি। কারণ তারা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলছিল। স্প্যানিশ ভাষার ব্যবহার আমার কাছে নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার মনে হল সেখানে।

‘পাঁচটার সময় ডাক্তার আসবেন। তিনি তোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। জরায়ুতে ক্যাথেটার লাগাবেন। রাতে ব্যথা উঠতে পারে তাতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। তোমাকে ঘুমের ঔষুধ দেওয়া হবে। রাতে ডিনারের পর কোনো খাবার-পানি গ্রহণ করা যাবে না। সাধারণত খুব সকালে গর্ভপাতের কাজগুলো করা হয়ে থাকে। ছয়টায় তুমি অপারেশন কক্ষে যাবে। তোমার ঘুমের ভেতর কাজ শুরু হবে। ঘুম ভাঙলে তোমাকে এল পাসো এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবে।’ যান্ত্রিকভাবে মহিলাটি কথাগুলো বলে গেল। 

কালো পোশাক পরা মহিলাটি আমাাকে আমার নির্ধারিত শয্যার কাছ নিয়ে গেলো। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে একই রকম আরো ছয়টি বিছানা ছিল। সে ঘড়ি দেখল, তখন বিকাল পাঁচটা বেজেছিল। এরপর মহিলাটি ইঙ্গিতে বোঝালো সে বাইরের হল রুমের ওপাশে অবস্থান করবে। ভালোভাবে চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে আমি বুঝতে পারলাম ঐ ঘরে আরো জনাবিশেক নারীর অস্তিত্ব রয়েছে। সবাই আমেরিকান। তিনজন তাদের ভেতর একেবারেই নাবালিকা। তারা তাদের মায়েদের সাথে এসেছিল। বাকিরা সুনিশ্চিতভাবেই একা। তারা বসে ম্যাগাজিন ট্যাগাজিন পড়ছিল। তার মধ্যে চারজন মধ্য চল্লিশ এমনকি পঞ্চাশও হতে পারে। তারা হয়তো তাদের জীবনে পরিবর্তন আশা করেছিল। আমি যেভাবে ভাবছিলাম আর কি, আসলেই পরিবর্তন ঘটেছে, যা তারা হয়তো আশাও করেনি। অবশিষ্ট যারা ছিল তারা সদ্য তারুণ্য প্রাপ্ত, বিশ পার করেছে কি করেনি এদের প্রত্যেককেই ভীত-সন্ত্রস্ত আর বিব্রত দেখাচ্ছিল। আর প্রতিটি মুখের ভেতর ফুটে উঠেছিল কুন্ঠামিশ্রিত লজ্জা। যেন তারা কোনো অসম্ভব রকমের নৃশংস আর ভীতিকর কাজ করতে যাচ্ছে। অথচ কী লজ্জা। কারো জন্য কারো সেখানে কোনো সহানুভূতির বন্ধন তৈরি হয়নি। আমার এ ঘরে অনুপ্রবেশকে তারা কেউ লক্ষ্যই করল না।
একজন মেক্সিকান ঝাড়ুদার মহিলা একটা নোংরা ভেজা ঝাড়ু উচিঁয়ে সবার সামনে ঘোরাচিছল আর স্থির দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে তার নগ্ন কৌতুহল ঘৃণা সহযোগে প্রকাশ করেছিল। আমি এক ধরনের অজানা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম তাকে দেখে। 

‘তুই তোর যাজকের কাছে কি প্রতিজ্ঞা করেছিলি কুত্তী? তোর কোনো স্বামী নেই কিন্তু সাতটা সন্তান আছে। তোর এই নরকেই কাজ করতে হবে নইলে না খাইয়া মরতি হবে।’
হায়, ঈশ্বর, কথাগুলো হয়তো সত্যিই তার। আমি ক্লান্ত বোধ করছিলাম। সাথে ঐ ঝাড়ুদার মহিলাটির জন্য অদ্ভুত এক দুঃখ বোধও পেয়ে বসছিল আমার এবং আসলে দু:খ বোধ হচ্ছিল ঐ ঘরের সবগুলো নারীর জন্যই।
আমরা, আমাদের প্রত্যেকেই ছিলাম সত্যিকার অর্থে একা, নিঃসঙ্গ। নাবালিকা মেয়েগুলো প্রত্যেকেই, বিশেষত দুটি মেয়ে নিচুস্বরে কেঁদেই যাচ্ছিল। তাদের মায়েরাও তাদের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ঘরের এক পাশে নির্বাক দৃষ্টিতে বসেছিল। যার যার ক্রোধ, ক্ষোভ আর লজ্জা নিয়ে যার যার মত বিচ্ছিন্ন হয়ে বসেছিল। আমার চোখেও কান্না আসছিল, কারণ জো চলে গিয়েছিল, আর আমার মা-ও এখানে ছিল না, কখনো থাকবেও না। 

আমিতো এই গর্ভপাত চাইনি। আমার এই গর্ভপাতের কোনো কারণ ছিল না। কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি ধারণা করতে পারি এই ঘরটিতে অবস্থানরত সবগুলো নারীরই মানসিক পীড়াদায়ক, মৃত্যুযন্ত্রণাদায়ী পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ধর্ষণ, বলপ্রয়োগের মতো মনুষ্যেতের ঘটনাবলী। আমি যদি এই বাচ্চাটিকে বাঁচাতে পারতাম তাহলে তো একটা সত্যিকার পরিবার হতো। আমি সে আর বেন- একটা সত্যিকার পরিবার। আমি বোধহয় পাগল-টাগলই হবো। তবে এই সিদ্ধান্তটা আমার ছিল না। বেলা লীনই বলে দিয়েছে আমার কী করা উচিত। একথা ভাবতে ভাবতে আমি হল ঘরে চলে গেলাম। চলে গেলাম সেখান থেকে বেলা লীনকে ফোন করে বলতে যে, আমি চলে যেতে চাই। কিন্তু রান্নাঘরের দিকে যাবার দরোজা ছাড়া অন্য সব দরোজা ছিল বন্ধ। ফিরে এলাম সেই ঘরে। 

দরোজা খুলে ডাক্তার এলেন সময়মতো। কোনো সন্দেহ ছিল না তিনিই ডাক্তার। যদিও তাকে আর্জেন্টাইন সিনেমার নায়ক কিংবা লাসভেগাসের নৈশ গায়কদের মতো দেখাচ্ছিল। সেই বৃদ্ধা মহিলাটি তার গা থেকে ওভার কোট আর স্কার্ফ খুলে রাখতে সাহায্য করল। তার পরনে ছিল অত্যন্ত দামী সিল্ক স্যুট আর হাতে রোলেক্স ঘড়ি। এটা তার আভিজাত্যকে প্রকাশ করে দিচ্ছিল আর বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে, তিনি সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, একজন ডাক্তার। তিনি দেখতে ছিলেন শ্যামলা, সুদর্শন, রমনীমোহন পুরুষ। তিনি হাঁটছিলেন পা টিপে টিপে, প্রায় চোরের মত। তিনি আমার বাহু আলতোভাবে ধরে বললেন ‘চলো’ এবার তোমার পালা।’
‘কিন্তু আমি আমার মত বদলিয়েছি, আমি চলে যেতে চাই।’
‘তুমি তোমার ঘরে যাও, মেয়ে। এক ঘণ্টায় তোমার মনের মধ্যে হাজারো বার পরিবর্তন আসতে পারে। আমরা পরে কথা বলব। এসো তাহলে।’ 

আমি আমার বিছানায় ফিরে এলাম। অন্য মহিলারা যার যার জায়গা মতো বসেছিল। দুজন নাবালিকাও। বৃদ্ধা মহিলাটি আমাদের জন্য গাউন নিয়ে এলো। কাপড় বদলিয়ে পরিয়ে দেয়ার সময় বাচ্চা মেয়েগুলো ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছিল। তাদের আচরণ প্রায় মৃগীরোগীদের খিঁচুনি পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু যথেষ্ট ধৈর্য ধারণ করেও মেয়েটিকে তারা সামলাতে পারছিলেন না। মেয়েটি তাদের হাতের ভিতর থেকে পিছলে গিয়ে পায়ের কাছে বসে থাকা মাকে লাথি মারল। অবশেষে ডাক্তার তাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে একটা কম্বল দিয়ে তাকে ঢেকে দিলেন। মেয়েটির মাকে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি আবার আসছি।’ অন্য বালিকাটিকেও ঘুমের ঔষধ দেয়া হলো, যাবতীয় গঁৎবাধা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে। তিনি রোগের ইতিহাস শুনলেন, হৃৎস্পন্দন মাপলেন, রক্তচাপ আর তাপমাত্রা দেখলেন। কোনো রকম রক্ত বা প্রস্রাবের নমুনা আমাদের কাছ থেকে নেয়া হলো না। তিনি দ্রুতই প্রতিটি মহিলার পেলভিক পরীক্ষার জন্য বললেন। বৃদ্ধা মহিলাটি দশ ফুট লম্বা চিকন টিউব দিয়ে আমাদের জরায়ু বাঁধতে শুরু করল। ঠিক যেন হাসঁকে বাঁধা হচ্ছে রোস্ট বানানোর উদ্দেশ্য। তার হাতে কোন গ্লাভস ছিল না। সে একের পর এক রোগীকে বাঁধতে শুরু করেছিল। কেউ কেউ কেঁদে উঠেছিল কারণ ভয়ংকর ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল। 

‘এটা কিছুটা অস্বস্তিকর হবে।’ ডাক্তার বলছিল আমাদের উদ্দেশ্যে- কিন্তু একই সাথে এটা স্বাস্থ্যকর ও স্বাভাবিকভাবে ভ্রণকে বের করে দেবার জন্য ব্যথা সৃষ্টি করবে।’ তারপর ডাক্তার আমাকে বাদ দিয়ে পরবর্তী একজন অপেক্ষাকৃত বয়সী মহিলাকে দেখতে শুরু করলেন। যখন তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, তার সর্বশেষ পিরিয়ড কবে হয়েছিল, মহিলাটি তা বলতে পারলো না। সে ভুলে গিয়েছিল। একথা শুনে ডাক্তার দীর্ঘক্ষণ তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমি দুঃখিত, এটা পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। আমি ঝুঁকি নিতে পারব না। তারপর তাকেও ঘুমের ঔষধ দিল। মহিলাটি নির্বাক ভঙ্গিতে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে ছিল, কী শোচনীয় সেই দৃষ্টি, কী ভয়ানক। ওহ ঈশ্বর, ওহ ক্রাইস্ট!’
‘দেখো এখানে কে, আমাদের ছোট্ট পলাতক মেয়েটি।’ তিনি থার্মোমিটারটি আমার মুখে দিয়ে হার্টবিট মাপতে শুরু করলেন। আমি থার্মোমিটার মুখ থেকে বের করে বলে উঠলাম। ‘আমি মন বদলেছি। আমি চলে যেতে চাই’। 

তিনি শুনলেন না। তার কাজ তিনি করে যেতে লাগলেন। খুব নিস্পাপভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসলেন। তিনি ফুসফুসের গতি প্রকৃতি পরীক্ষা করছিলেন, বুকের উপর স্টেথোস্কোপ রেখে। আর এদিকে আমি ঘৃণায় ফুঁসছিলাম। ক্ষুব্ধ হচ্ছিলাম। যখন ডাক্তার বৃদ্ধা সহকারী মহিলাটিকে স্প্যানিশে বলে উঠলেন, ছোট্ট মেয়েটি এমন ভাব করছে যেন তাকে কেউ কখনো স্পর্শই করে নাই।’
আমি সুতীব্র ক্রোধে ভেঙে পড়ে স্প্যানিশেই বলে বসলাম, ‘তুই আমাকে ছুঁয়ে ও দেখবিনা, শুয়োরের বাচ্চা, আবর্জনা। 

সে হাসল। বলল, ‘কত অমার্জিত আর অভদ্র তুমি। তুমি কি আমাকে কিছু বলার জন্য অনুমতি দেবে।’ এরপর সে ক্ষমা চেয়ে বলতে শুরু করল যে কতটা তিক্ত অভিজ্ঞতা ঘটে প্রতিটা দিন এরকম পনেরো/বিশটা কেস সমাধান করতে গিয়ে। দুঃখজনক কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তাই গুরুত্বপূর্ণ সেখানে। ইত্যাদি। এসব কথার মধ্যে দিয়ে আমি তার জন্যও দুঃখিত বোধ করছিলাম ভীষণভাবে, আর তাছাড়া ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি তার বিশাল এক জোড়া বাদামী স্বচ্ছ চোখে ডুবে গেঁথে যাচ্ছিলাম যেন, যখন তিনি আমার বাহুতে টোকা দিয়ে স্মিত হাসি দিচ্ছিলেন।
আমি কাজের কথায় ফিরে এলাম। বললাম, দেখুন ডক্টর, আমি সত্যি সত্যি গর্ভপাতটা চাচ্ছিনা।’
‘ঠিক আছে, কিন্তু তুমি এটা জানো তো যে টাকাটা তুমি পেমেন্ট করেছ সেটা আর ফেরত পাবে না।’
‘হ্যাঁ জানি। তবুও চাই না।’
‘তবু যে তোমাকে রাতটা এখানে কাটাতেই হবে সেটা ভেবে আমি শঙ্কিত না হয়ে পারছি না। আমরা শহর থেকে অনেকটা দূরে, আর ড্রাইভাররাও সকালের আগে কেউ আসবেনা। আমি তোমাকে ঘুমের ঔষুধ দিয়ে যাচ্ছি। তুমি কাল সকালেই ফিরে যেতে পারবে। তুমি নিশ্চিত তো, যা করতে যাচছ, ভেবে চিন্তে করছ। এটাই শেষ সুযোগ। তোমাকে ভাবতে সময় দিচ্ছি।’ আমি সায় জানালাম। সে আমার হাতটা ধরল। আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করলাম। কান্নায় ভেঙে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। সামান্য আরামের জন্য কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম আমি। 

‘তুমিই পারো আমাকে সাহায্য করতে। কোণায় বসে থাকা মেয়েটা ভীষণভাবে ট্রমাটিক হয়ে পড়েছে। তার মা একটা উত্তরণের অযোগ্য পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে। সন্দেহ করি তার বাবাকে, নিশ্চয়ই কোন বাজে পরিস্থিতির ভেতর পড়তে হয়েছে তাকে। তার অবশ্যই এই গর্ভপাতটি প্রয়োজন ছিল। তুমি কি আমাকে তার ব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারো, তাকে আজকের রাতটা একটু সহজ স্বাভাবিক হতে দিয়ে? সে যেন সামনের জটিল-কঠিন বিপদগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে।’ আমি ডাক্তারের সঙ্গে সেই মেয়েটির বিছানার কাছে গেলাম। ডাক্তার আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমাকে দিয়ে মেয়েটাকে বোঝানো হল, তারা তাকে নিয়ে কী করতে যাচ্ছিল, কী আশা করছিল তারা তাকে নিয়ে। আমি আরো বললাম এটা কতটা নিরাপদ আর সব দিক দিয়েই প্রয়োজনীয়। এরপর ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিলেন। ফুসফুস অথবা হৃৎপিন্ডের চাপ মাপামাপি ইত্যাদি। এরপর ডাক্তার প্রস্তুত হলেন তার জরায়ুর ভিতরটা ভরে দিতে। যদিও তিনি মেয়েটিকে বলেছিলেন এতে সে কোনো কষ্ট পাবে না। কিন্তু আমি বলে দিয়েছিলাম সে ব্যথা পাবে। ডাক্তার বারবার নিশ্চিত করছিলেন যে, সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে শেষ হবে। কিন্তু মেয়েটি তখনো বাধা দিয়েই যাচিছল। বৃদ্ধা মহিলাটি সহ আমরা তিনজন মিলে তাকে শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমি আর ডাক্তার তার সাথে কথা বলে তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বৃদ্ধা যখন প্লাষ্টিকের চিকন টিউব দিয়ে তার পেটে বেঁধে দিচিছল তখন সে ভয়ে আতঙ্কে আমাকে জড়িয়ে লেপটে ধরে বসেছিল আর তার মা প্রস্তর মুখে বিছানায় পা তুলে বসেছিল।
‘সে কি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে?’
‘না, সে মদ্যাসক্ত। লাইনে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আমরা তার মেয়ের পাশে এনে শুইয়ে দিয়েছি।’ ডাক্তার ও তার সহযোগী মহিলাটি পাশের রুমে চলে গেলো অন্য সব রোগীকে দেখতে। ভারতীয় বালিকা দুটি খাবারের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। 

‘তুমি কি চাও আমি আমার খাবারটা তোমার সাথে বসে খাই।’ সে মাথা নাড়ালো। বালিকাটির নাম স্যালি। সে মিসৌরি থেকে এসেছে। সে গোগ্রাসে খাচ্ছিল। টরটিলা এর আগে কখনো খায়নি সে। এ্যাভোকাডো তার মাংস দিয়ে মুচমুচে রুটিটি মুড়িয়ে খেতে হয়।
‘তোমার মা এখন ঠিক আছেন?
‘সে সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।’

স্যালি মাদুর তুলে আধা পাইন্ট জিম বিমের বোতল দেখালো। ‘আমরা দুজন এখানে না থাকলে এতক্ষণে এটা তার পেটে চলে যেতো। এটা এখনো তার প্রয়োজন, তার মানে সে সুস্থই আছে।’
‘আমার মাও অতিরিক্ত মদপান করেন।’ বৃদ্ধা মহিলাটি ট্রে নিতে ফিরে এসে জানালো, বালিকাদের এখন ইনজেকশন দেয়া হবে। কিন্তু সে স্যালির মাকে নিয়ে ভয় পাচিছল। তাকে আরো কড়া ডোজের ঔষুধ দেয়া হল। আমি বিছানায় শুয়েছিলাম। শোবার জন্য তোষকটা ছিল খসখসে। রোদে শুকানোর তীব্র গন্ধ নাকে আসছিল, এমনকি গায়ে দেবার কম্বলটাও ছিল খসখসে আর কাঁচা উলের সোঁদা গন্ধে ভরপুর। আমার গ্রীস্মের খরতাপের দিনগুলো মনে আসছিল। 

ডাক্তার আমাদের কাছ থেকে কোনো বিদায় না নিয়েই চলে গিয়েছিল। জো হয়তো বাড়ি ফিরেছে। আমার মাথা একদমই কাজ করছিল না। আমার হয়তো গর্ভপাতটা করানোই প্রয়োজন ছিল। একটা বাচ্চা পালতেই তো আমি দিশেহারা তা আবার দুইজন! হায় ঈশ্বর... কী করলাম আমি। ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচিছলাম ঔষুধের প্রভাবে। 

কোথাও থেকে ভয়ংকরভাবে আর্তনাদের শব্দ আসছিল। ঘরটা ছিল অন্ধকার, কিন্তু হলঘরের মৃদু আলোতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম স্যালির শূন্য বিছানাটা। আমি দৌড়ে হলঘরে গেলাম। প্রথমেই আমি বাথরুমের দরজাটা ঠেলে দেখতে গেলাম। কিন্তু স্যালি পড়েছিল ঠিক উল্টোদিকে, অসেচতন আর জ্ঞানশূন্য অবস্থায়। সর্বত্র রক্তে থৈ থৈ করছিল। জমাট বাঁধা, চাকা-চাকা, দলা-দলা রক্ত। তার নাড়ি চলছিল, কিন্তু জ্ঞান ছিলনা। 

স্যালির প্রবল রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেই রক্তের ভেতর গর্ভনিরোধী কয়েল রক্তে মাথামাখি হয়ে বাঁকা চোরা হয়ে পড়েছিল আর পড়েছিল স্যালি, জটপাকানো একটা কুণ্ডলী যেন কয়েলটার মতোই। 

আমি দৌড়ে গিয়ে হলের দরোজায় জোরে জোরে নক করলাম। বৃদ্ধ মহিলাটি তার সাদা ইউনিফর্মেই ছিল তখনো। জেগে উঠে দৌড়ে বাথরুমে দিয়ে এক পলক দেখে অফিসে গিয়ে ফোন করল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম সবটা বোঝার জন্য। সে আমার সামনে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি স্যালির কাছে ফিরে গিয়ে তার হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলাম। ‘ডক্তার আসছেন, তুমি তোমার রুমে ফিরে যাও।’ ভারতীয় বালিকাটি তার পেছন দাঁড়ানো ছিল। দুজন মিলে আমাকে ধরে আমার বিছানায় নিয়ে গেল। মহিলাটি আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। আমি বিছানায় জেগে উঠলাম সূর্যের তীব্র আলো চোখে নিয়ে। সেখানে ছয়টি শূন্য বিছানা ছিল, সুসজ্জিত নতুন ঝকঝকে চাদর পরিপাটি করে বিছানো। খোলা জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে বোগেনভেলিয়া ফুলের সুবাস আর ক্যানারি পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছিল। আমার কাপড় চোপড় পায়ের কাছে পড়েছিল। সদ্য পরিষ্কৃত বাথরুমে ঢুকলাম। গোসল টোসল সেরে কাপড় পড়লাম, চুল আঁচড়ালাম। আমার মাথা ঢুলছিল, তখনো ঔষুধের প্রভাব কাটেনি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম অন্য মহিলারা ফিরতে শুরু করেছে হুইল চেয়ারে। যে মহিলাটির গর্ভপাত অসম্ভব ছিল সে বিষন্ন দৃষ্টিতে জানালার ধারে বসে ছিল, একা। ভারতীয় বালিকাটি প্রচুর নাস্তা ভর্তি ট্রে হাতে এগিয়ে এল। কিছু মহিলারা তাদের নাস্তা সেরে নিয়েছিল। বাকিরা ছিল, শোকগ্রস্ত, স্তম্ভিত, নিস্তব্ধ। তারা সবাই চলছিল যন্ত্রের মত।
দূর থেকে ডাক্তারকে দেখা যাচিছল দীর্ঘ সবুজ গাউনে, মুখের মাস্কটি থুতনিতে নামানো ছিল। লম্বা কালো আকর্ষণীয় চুল বাঁধা ছিল। আমার দিকে হেসে বলল, আশা করি রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। তুমি কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে উঠতে পারবে। 

‘স্যালি কোথায়? আর তার মা?’- আমার জিভ তখনো ভারি, শব্দ উচ্চারণে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।
‘স্যালির রক্ত বদলানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।’
‘সে কি এখানে আছে আসলে? জীবিত?’

শব্দটা উচ্চারণ করতে পারছিলাম না আমি। ডাক্তার আমার কব্জি ধরে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘স্যালি ভালো আছে। তোমার সবকিছু নিয়েছ তো? গাড়ি কিন্তু এখনই ছেড়ে দেবে।’

আমাদের মধ্যে পাঁচজনকে তাড়াহুড়ো করে হলে নামতে হলো। এরপর বাইরে, গাড়ির ভেতর। আমরা গাড়িতে উঠতেই পেছনে বিশাল গেটটি বন্ধ করার শব্দ পেলাম।
‘এল পাসো এয়ারপোর্টে কে যাবেন?’ আমাদের সবাই এয়ারপোর্টের যাত্রী ছিলাম। 

‘আমাকে ব্রিজের কাছে নামিয়ে দিয়েন।’ আমরা কেউ কথা বলছিলাম না। আমার মন থেকে খুব ইচছা করছিল বালতে ‘দেখো কি সুন্দর আজকের দিনটা।’ যদিও সেটা ছিল নিতান্তই বেআক্কেলে ধরনের কথা, ঐ মুহুর্তে। কিন্তু যে যাই বলুক দিনটি ছিল সত্যি চমৎকার। আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিস্কার, মেক্সিকান উৎসবের মত অতিরিক্ত জমকালো নীল। অথচ গাড়ির ভেতরকার নীরবতা ছিল দুর্ভেদ্য, লজ্জায় ভারি, বেদনাভারাক্রান্ত, অসহনীয় রকম শুনশান। শুধু ভয় চলে গিয়েছিল। আমার বেড়ে ওঠা মফস্বল এলাকা আগের মতোই আছে। তেমনি কোলাহল আর ঘ্রাণ। সেই কিশোর বেলার মতই নিজেকে নিস্পাপ মনে হচ্ছিল আমার, আমি চাইছিলাম যেন সেইসব আনন্দ-বিস্ময় ভরা দিনগুলো আবার ফিরে আসুক। কিন্তু না। গাড়ির ঝাঁকুনি আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। হোটেলটি মাত্র কয়েক ব্লক দূরে ছিল। হোটেলের দারোয়ান গাড়ির ড্রাইভারকে পাওনা মিটিয়ে দিল। 

বেলা লীন সব বিষয়েই সজাগ ছিল। দারোয়ান জানলো তারা রুমেই আছে। ঢুকে দেখলাম পুরো ঘর তছনছ আর এলোমেলো হয়ে আছে। বেন আর বেলা বিছানার মাঝখানে খেলা করছে। তারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল, ম্যাগাজিনগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে উপরে ছুঁড়ে দিচ্ছিল আবার ছোঁ মেরে ধরছিল। ‘এটা আমাদের প্রিয় খেলা, লৌ। তোমার ছেলে ভালো শিল্প সমালোচক হবে। নিশ্চিতভাবেই সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ‘জুডাস প্রিস্ট! তুমি এটা করতে পারোনি দেখা যাচ্ছে। নির্বোধ! অতি নির্বোধ তুমি।’
‘না। আমি পারিনি।’ বেনকে আমি কোলে তুলে নিয়েছিলাম। কি মিষ্টি গন্ধ তার শরীরে। সে মুখ দিয়ে বুড়বুড় তুলছিল। আমি নিশ্চিত তারা দুজন দারুণ সময় কাটিয়েছে।
‘আমি পারিনি, বেলা- যদিও তোমার দেয়া টাকার পুরোটাই জলে গেছে। আমি তোমাকে অবশ্যই শোধ করে দেব। তুমি চিন্তা করোনা। তুমি খালি এই বিষয়ে কোনো বক্তৃতা দিওনা। সেখানে একটা মেয়ে ছিল জানো, নাম স্যালি...’

মানুষ বলত স্যালি নাকি উচ্ছন্নে যাওয়া বড় লোকের বখে যাওয়া মেয়ে। দুনিয়ার কোনো কিছুকে যে পাত্তা দেয় না। কিন্তু আসলে কেউই তাকে বুঝতে পারত না। সে ছিল সত্যিকার অর্থেই অনুভূতিসম্পন্ন একটি মেয়ে। আমি না বলতেই সে আমার সবকিছুই বুঝে নিয়েছিল। সে আর বেন ছিল বলেই কান্নায় ভেঙে পড়তে গিয়েও আমি সামলে নিতে পেরেছিলাম। 

‘দেখো লৌ, আমি অবশ্যই কোনো বক্তৃতা দেব না। তুমি যাই করেছ আমি তাতে বাধা দেব না। আমি শুধু জানতে চাই এখন তুমি কি ভাবছ, আমাদের কী করণীয় এই মুহূর্তে? টাকিলা সানরাইজ? লা নাকি শপিং? আমি না খেয়ে আছি এখনো।’
‘আমিও। চলো খেতে যাই। আমি দাদীমা আর রেক্স কিপর জন্য কিছু উপহার নিতে চাই।’
‘হুম, বেন, আসো আমরা ঠিক করি কী করা যায়? শপিং বিষয়ে। তুমি ‘শপিং’ উচ্চারণ করতে পারো বেন? আমরা এই পিচ্চিটাকে শপিং বিষয়ক কায়দা কানুন শেখাতে পারি।’ রুম সার্ভিসের ছেলেটি তার জমকালো জ্যাকেটটি পৌঁছে দিয়ে গেল। আমরা দুজনই রেডি হয়ে বেনকেও প্রস্তুত করলাম। আমি চিন্তিত ছিলাম বেনকে নিয়ে, তার চামড়ায় র‌্যাশ ওঠে কিনা ভেবে। কারণ বেনের পুরো মুখে লিপস্টিকে চুম্বনের দাগে ভরে ছিল। চমৎকার দেখতে ডাইনিং রুমে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। আমরা ছিলাম সমধর্মী, পৃথিবীকে পাত্তা দেবার কোনো দরকার ছিলনা। তরুণ প্রাণ, সুন্দরী, আর স্বাধীন। সামনের দিনগুলোর দুশ্চিন্তা আমরা পেছনে ফেলে এসেছিলাম যেন। আমরা ডাইনিং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর এই রুমটার আত্মজীবনী নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম। ‘আসলে আমরা এভাবে মিলিত হতে পারি কখনো কখনো। বাড়ির চাইতে ভালো।- 

তৃতীয় বারের মতা কফির অর্ডার দেয়ার পর আমি বললাম। আমরা হোটেল কক্ষ থেকে বেনের খেলনাসহ, উপহার ইত্যাদি সব কিছু বাস্কেটে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। বেলা লীন যাবার সময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সবসময়ই হোটেল রুম ছেড়ে যাবার মুহূর্তে আমার মন ভেঙে যায়। হোটলগুলো আমার ঘর হয়ে ওঠে তাই।
টাইলর চাচার মফস্বলের বাড়িটির বিশাল ফটকের ভেতরটা দেখা যাচিছল দূর থেকে, যেখানে রয় রজার্স আর ডেল ইভানস ক্রিসমাস ক্যরলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিল। একটা বুদবুদ বানানোর মেশিন থেকে ক্রমাগত বুদবুদ উড়ছিল। তাই দরোজার ভেতর নজর পড়তেই প্রথমে সেই সাবানগন্ধী চকচকে বর্ণিল বুদবুদের ভেতর দিয়ে ক্রিসমাস ট্রির চেহারাটা দেখতে হলো। 

‘জুডাস প্রিস্ট! এটা তো মনে হচ্ছে গাড়ি ধোয়াধুয়ি চলছে। আর গালিচাটার অবস্থা দেখ।’ বলতে বলতেই বেলা বাবল মেশিনের প্লাগ খুলে ফেলল। মিউজিক বন্ধ করে দিল। 

আমরা সবাই বসার জন্য বিশাল ড্রইংরুমে ঢুকলাম। লগ কেক, ক্রিসমাস ট্রি, জলন্ত ফায়ার প্লেস- সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। টিনি খালার আত্মীয় স্বজন সোফা আর ডিভানে আয়েশ করে বসেছিল। কেউ কেউ টিভিতে ফুটবল খেলা উপভোগ করছিল। বেন আমার পাশে বসেছিল। সে এর আগে কখনো টেলিভিশন দেখেনি, অথচ সে সব রকম অবস্থার সাথে চমৎকারভাবে মানিয়ে নিচ্ছিল। বেলা লীন আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। খুব কমই তাদের মধ্যে আমাকে লক্ষ্য করে দেখল। তাদের চোখ খাবারের প্লেট আর ফুটবল ম্যাচের দিকে সেঁটে ছিল। তারা সবাই এতটা সাজপোশাক করেছিল যেন তারা বিবাহ অনুষ্ঠান কিংবা মৃত্যুজনিত শোকসভায় এসেছে। যদিও তাদের তখনো আমার চোখে বড়জোর বর্গাচাষী কংবা ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত শরণার্থীদের মতো দেখাচ্ছিল।

আমরা সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। বেলা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আমি বাবার দেয়া কালকের পার্টির জন্য আর ধৈর্য্য ধরতে পারছিনা। সকালেই আমরা জন চাচাকে তুলে নিয়ে চলে যাব আর তোমার মাকে চমকে দেব হঠাৎ হাজির হয়ে। সেখানে বিশাল খোলামেলা একটা বাড়ি আছে। পার্টিতে অবশ্য বেশিরভাগই অবিবাহিত যুবক থাকবে। কাজেই আমরা তাদের বদলে আমাদের পুরনো বন্ধুদের স্বাগত জানাতে পারি, তারা নিশ্চয়ই তোমার আর তোমার বাচ্চার প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারে। জেসাস! এযে দেখি ব্লেসিট রিডিমার।’ টিনি খালার মাকে দেখে বেলা বলে উঠল। 

সে এসেই ছোঁ মেরে বেনকে তুলে নিল হাতের জিনিসপত্র রেখে। তারপর পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে বেনের পিছু পিছু হাঁটলেন। বেন টলমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে ঘুরছিল। এটাকে মজার কোনো খেলা মনে করে হাসছিল সে। তারা কাঁচের জিনিস রাখার আলমারিটার পাশ দিয়ে যাবার সময় ক্রিস্টালের জিনিসগুলো ঝনঝন করে বেজে উঠছিল। যেন যে কোনো মুহূর্তেই সেগুলো ভেঙে পড়বে। মা যেমন বলত- ‘জীবনটা পরিপূর্ণ ঝুঁকি আর বিপদে।’ মিসেস ভিডার তার সাথে তার মতো করেই টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্য ঘরে চলে গেলেন। সেখানে আরো একটা টেলিভিশন ছিল যেটাতে অপেরা শো চলছিল। আর বিছানাটা বেনকে অন্তত মাসখানেক আমোদ রাখার মত জিনিসে ভরা ছিল। বাইরের আউট হাউসে খাবারের প্যাকেট, টিস্যু পেপারের ঢাকনা, স্যাশে ব্যাগ, হারিয়ে যাওয়া ব্রেসলেট ইত্যাদি আবর্জনার পাহাড় যেন ক্রিসমাস উপহারেরই অংশবিশেষ ছিল। বেনকে নিয়ে মিসেস ভিডার সেখানে অনেকটা সময় কাটালেন। বেনও খুব সহজেই সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। সে যিশুর মূর্তি চিবোচ্ছিল যেটা অন্ধকারে জ্বলজ¦ল করত, র‌্যাপিং কাগজে মোড়ানো চকচকে উপহারগুলো তছনছ করছিল। কোথাও গান বাজছিল- ‘জেসাস লাভস মি! ইয়েস আই নো, কজ দ্য বাইবেল টেলস মি সো।’ খাবার টেবিলটা দেখে মনে হচ্ছিল প্রমোদ জাহাজের উৎসব রাতে স্তুুপিকৃত আড়ম্বরের চিত্র বিশেষ। মাংসের প্লেট, সালাদ, বারবিকিউ, চিংড়ি, মাংসের জেলি, পনির, পিঠা ভর্তি ডিশগুলো আমার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল টিনি খালার সেই সব আত্মীয় স্বজনদের কাছে যারা নিজেদের অজান্তেই আমাকে তাচ্ছিল্য করে যাচ্ছিল। 

এসথার রান্নাঘরে বিশাল বিশাল ডেকচিতে মেক্সিকান ডিশ সামলাচ্ছিল। মাংসের পিঠা ওভেন থেকে সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। বেলা লীন এমনভাবে এসথারকে জড়িয়ে ধরে অভিবাদন করল যেন কতকাল পর তাদের দেখা হলো। 

‘সে ফোন করেছিল? ’
‘আরে না, সে করবে ফোন।’ এসথার তাকে ধরে রেখেই দোলাচ্ছিল। সে বেলাকে পিচ্চিকাল থেকে দেখাশোনা করে আসছে। অন্যদের মতো সেও বেলাকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছে। তবে নষ্ট করে দেবার জন্য নয়। আমি তাকে সংকীর্ণমনা ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সে আমাকেও সম্ভাষণ করল- ‘এই যে দেখো, এ দেখি আরো একটা মাথা ছাড়া নির্বোধ মেয়ে।’ সে আমাকেও জড়িয়ে ধরল। 

‘কোথায় তোমার সেই মিষ্টি বাচ্চাটা? ’ সে বেনকে দেখতে ছুটল। ফিরে এসে আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আর্শীবাদ করছি তোমাকে, তোমার বাচ্চাটা ভারি মিষ্টি, ঈশ্বর তার মঙ্গল করুন। তুমি নিশ্চয় কৃতজ্ঞ তাকে পেয়ে, তাই না?- আমি সায় জানিয়ে হাসলাম।
‘আমরা কি তোমাকে রান্নায় সাহায্য করব? আমি একটু টাইলর আর রেক্সকে শুভেচ্ছা জানাতে যেতে চাই। আর টিনি খালা, তিনি আছেন?’
‘তিনি এখনো নিচে নামেননি। তার আছে আরামদায়ক বিছানা, রেডিও আর কড়া সুস্বাদু মদ। তিনি সহজে নামছেন বলে মনে হয় না।’
‘ঈশ্বর সহায়।’ - বেলা নির্দেশ দিতে লাগল। সকল অভ্যাগত অতিথি আর শিশুদের জন্য খাবারের আর রেক্সের জন্য প্রচুর চিংড়ি মাছের ব্যবস্থা করতে। যারা ‘দোকানে’র বাইরে অবস্থান করছিল। টাইলর চাচার ‘দোকান’ বলতে সত্যিকার অর্থে এটা ছিল একটা আড্ডা দেবার ঘর, সাথে অতিথি কক্ষ। আরেকটা বড় ঘর ভর্তি বন্দুক ছিল, কিছু নতুন, কিছু আবার একদমই প্রাচীন সংগ্রহ। আড্ডাস্থলে বিরাট অগ্নিকুন্ড, দেয়াল জোড়া বিভিন্ন শিকার করা পশু পাখির চিহ্ন ঝোলানো, মেঝেতে টাইলস ফ্লোরে শুকরের চামড়ার মাদুর। স্থানাগারে নরম প্লাষ্টিকের কার্পেট। সব রকম রঙ আর আকারে। একটা কার্পেট তিনি জারি গেল্ডিওয়াটারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদপ্রার্থী ছিলেন। রাত নামছিল। অন্ধকার শীতল আর পরিষ্কার আবহাওয়া। আমি বেলাকে অনুসরণ করে এগোচ্ছিলাম। 

‘হুররে! এটা কি!’
আমিও অবাক বিস্ময়ে হাঁপাচ্ছিলাম। বেলা হাসছিল। ছাদের উপর মাকে দেখা যাচ্ছিল। রেক্স আর টাইলর চাচা আমাকে দেখে খুশি হলেন। তারা বলল যখন তারা জানল জো আমাকে ছেড়ে আমেরিকা চলে গেছে তখন তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা দুজন মদ্যপান করতে করতে উপহারের তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। ঘরটি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল উপহারের ব্যাগে। প্রতি বছর তারা দরিদ্র আত্মীয়স্বজন, এতিমখানা আর হাসপাতালের জন্য সুপ্রচুর উপহার আর খাবার দাবার নিয়ে যেত। এবার তারা নতুন বুদ্ধি বের করেছিল। যেহেতু রেক্স তখন একটা এরোপ্লেনের অধিকারী হয়েছে। তারা সেই প্লেন থেকে টাইলর চাচার বাড়ীর দক্ষিণে একটা বাঁশি বাজানো ব্যাঘ্রশাবকের মুর্তি নামিয়ে দেবে। ক্রিসমাস ইভে প্রতি বাড়িতে সেভাবেই তারা বায়ুরোধী ব্যাগে খেলনা আর খাবার ভর্তি করে নামিয়ে দেবে। মানুষ দুজন তাদের পরিকল্পনা নিয়ে দারুণ উত্তেজিত ছিল আর হাসাহাসি করছিল।
‘কিন্তু বাবা, আমাদের কী হবে? মা আর মেরি খালার ব্যাপারে কি ভাবছ? আমি আর লৌ? বাঘেরা চলে গেছে, তাকে ফেলে রেখে আর আমার স্বামী পালিয়েছে।’
‘আশা করছি তোমরাও কালকের পার্টির জন্য উপযুক্ত পোশাক পেয়ে যাবে। বাবুর্চির সহকারী লোকজন চলে এসেছে, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে এসথারের আরো কিছু সাহায্যকারীর প্রয়োজন রয়ে গেছে। রেক্স, কী পরিমান মিষ্টি লজেন্স তুমি পথ শিশুদের জন্য সংগ্রহ করতে পেরেছ?’ টাইলর চাচা বলে যাচ্ছিল রেক্সকে। আর আমি দেখছিলাম বেলা লীনকে।


-------------------
লেখক পরিচিতি
লুসিয়া বারলিন
তিনি কখনোই জনপ্রিয় ছিলেন না। তবে বোদ্ধ পাঠকদের কাছে তিনি ছিলেন এলিস মুনরো, গ্রেস পালে ও টিলি ওলসেনের মতোই গুরুত্বপূূূূর্ণ। পরিবার, প্রেম, কাজ কর্ম নিয়ে গল্প লিখেছেন বুদ্ধিদীপ্ত একাগ্রতা নিয়ে। তাঁর লেখন ভঙ্গিমা সহজ, অকপট, সরস, স্পষ্ট, ননজাজমেন্টাল। যা বলতে চেয়েছেন ঋজু ভঙ্গিতেই বলেছেন। তার চরিত্রগুলো অচেনা নয়--তাদের শ্বাসটুকুও পাঠকের কানে লাগে। তার মৃত্যুর পরে তিনি বেস্ট সেলার লেখকে পরিণত হন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোটগল্প লেখক লুসিয়া বার্লিনের জন্ম আলাস্কায়, ১৯৩৬ সালের ১২ নভেম্বর। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি কবি এড ডর্নের অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৮১ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে তাঁর গল্প গ্রন্থ (‘এঞ্জেলস্ লন্ড্রোম্যাট’) প্রকাশিত হয়। তাঁর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয় ‘দ্য আটলান্টিক’ এবং সল বেলোর ‘দ্য নোবেল স্যাভেজ’ ম্যাগাজিনে। যদিও তিনি ছয়টি গল্প সংকলনের রচয়িতা, কিন্তু তাঁর সব গল্প তিনটি ছোটগল্প সংকলনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এগুলো হলো: হোমসিক: নিউ অ্যান্ড সিলেক্টেড স্টোরিজ’ (১৯৯০), ‘সো লঙ: স্টোরিজ ১৯৮৭-৯২ (১৯৯৩) এবং ‘হোয়্যার আই লিভ নাউ: স্টোরিজ ১৯৯৩-৯৮ (১৯৯০) ।



অনুবাদক
রোখসানা চৌধুরী
অধ্যাপক
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ