ডিনারের পর ডাইনিং-রুমের গরম উজ্জ্বল আলো থেকে চলে এসে তারা দাঁড়াল ডেকে, রেলিং-এর কাছ ঘেষে। চোখ বুজে মেয়েটি হাতের উল্টো দিক গালে চেপে হেসে উঠল সহজ, মধুর সুরে – ছোটখাটো মেয়েটির সব কিছুই মধুর — তারপর বলল:
‘মনে হচ্ছে নেশা হয়েছে আমার।... কোত্থেকে এসেছেন আপনি? তিন ঘণ্টা আগে এমনকি অপনার অস্তিত্ব পর্যন্ত জানা ছিল না। কোথায় যে স্টীমারে উঠলেন তাও জানি না। সামারায় ? যা হোক, সব সমান।... আমার মাথা ঘুরছে, না স্টীমারটা মোড় নিচ্ছে?
সামনে অন্ধকার আর আলো। একটানা মৃদুমন্দ হাওয়া অন্ধকার থেকে বইছে তাদের মুখে, সামনে থেকে আলোগুলো ছুটে পালাচ্ছে এক পাশে: ভোলগা জলযানের সচরাচর ক্ষিপ্রগতিতে স্টীমারটা বড়ো একটা পাক দিয়ে চলেছে ছোট জেটির দিকে।
মেয়েটির হাত ধরে লেফটেনান্ট ঠোঁটে ছোঁয়াল। ছোট্ট বলিষ্ঠ হাতে রোদেপোড়া গন্ধ। আর তার বুক স্বর্গসুখে আর ভয়ে থমকে দাঁড়াল এই ভেবে যে, দক্ষিণী আকাশের নীচে তপ্ত বালুতে (মেয়েটি বলেছিল আনাপা থেকে ফিরছে) পুরো এক মাস সূর্যস্নানের পর লিনেনের পাতলা ফ্রকের নীচে ওর সারা শরীর কী শক্ত আর তামাটে।
‘চলুন নামা যাক...’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল লেফটেনান্ট।
‘কোথায়?’ অবাক হয়ে মেয়েটি শুধাল।
‘এখানে নেমে পড়ি।’
“কেন?”
কিছু বলল না লেফটেনান্ট। মেয়েটি আবার হাতের উল্টো দিক চাপাল তপ্ত গালে।
‘পাগলামি...’
‘চলুন নামি’, ভারি গলায় সে আবার বলল, “দোহাই আপনার...'
‘বেশ, আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন’, মুখ ফিরিয়ে মেয়েটি বলল।
যতদূর সম্ভব বেগে এসে স্বল্পালোকিত জেটিতে স্টীমারটা লাগল আস্তে ধপ করে। দু’জনে আর একটু হলে এ-ওর গায়ের ওপর পড়ত। মাথার ওপর দিয়ে ছুটে এল একটা দড়ি, স্টীমারটাকে টেনে নেওয়া হতে লাগল, শুরু হল জলের তোলপাড়, নামবার তক্তার গড়গড় শব্দ।... মালপত্র আনতে ছটল লেফটেনান্ট। মিনিটখানেক পরে ঘুমে জড়ানো ছোট আপিসটা পেরিয়ে বালুতীরে এসে পড়ল দু'জন। বালিতে পায়ের গাঁট অবধি বসে যাচ্ছে, নীরবে উঠল একটি ধুলোভরা গাড়িতে। বিরল বাঁকা বাঁকা লণ্ঠনে আলোকিত পাহাড়ের ঢালর মধ্যে ধুলোয় নরম পথের শেষ হবার নামগন্ধ নেই মনে হল তাদের। কিন্তু এবার ঢালুর শেষ, শুরু হল পাথুরে রাস্তায় চাকার খটখট আওয়াজ। এই তো কোন চক, নানাবিধ দফতর ও অফিস, দমকল বাহিনীর মিনার, গ্রীষ্মের রাতে মফস্বল শহরের উষ্ণতা ও গন্ধ।... একটি আলোকিত ফটকের সামনে গাড়োয়ান গাড়ি থামালে খোলা দরজার ফাঁকে চোখে পড়ল খাড়া পুরনো কাঠের সিঁড়ি এবং গোলাপী শার্ট ও কোট পরা দাড়িগোঁফ না কামানো বুড়ো একটি দারোয়ান। বেজার মুখে সে নেংচাতে নেংচাতে তাদের সুটকেস নিয়ে পথ দেখিয়ে চলল ওপরে। বড়ো কিন্তু সারা দিনের তাপে বেজায় গুমোট একটা ঘরে নিয়ে গেল তাদের। জানলায় সাদা পর্দা, ড্রেসিং-টেবিলে গোটা দুয়েক নতুন মোমবাতি। ঘরে ঢুকতেই দারোয়ান দরজা বন্ধ করে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই লেফটেনান্ট এত অধীর আবেগে ছুটে গেল মেয়েটির কাছে, চুম্বন করার সময়টায় এত তীব্র বাসনায় দু'জনের হাঁফ ধরে গেল যে পরে অনেক বছর তাদের মনে জেগে ছিল মুহূর্তটির স্মৃতি: সারা জীবনে দু'জনের কারোর এরকম অভিজ্ঞতা আর কখনো হয় নি।
সকাল দশটার সময় চলে গেল সেই ছোটখাটো অনামী মেয়েটি, শেষ পর্যন্ত যে নাম জানায় নি লেফটেনান্টকে, হেসে হেসে নিজের শুধু পরিচয় দিয়েছে অচেনা সুন্দরী বলে। তপ্ত রৌদ্রোজ্জ্বল, আনন্দভরা সেই সকালটায় গির্জার ঘণ্টাধনি, হোটেলের সামনে হাটের হৈচৈ, খড়ের, আলকাতরার আর রুশী মফস্বল শহরের নানা উগ্র মিশ্র গন্ধ। রাত্রে বিশেষ ঘুমোয় নি তারা কিন্তু সকালে বিছানা ছেড়ে পর্দার আড়ালে গিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মুখহাত ধুয়ে জামাকাপড় পরে নেবার পর তাকে দেখাল সপ্তদশীর মতো নবীনা। অস্বস্তি লাগছিল কি তার? না, খুবই সামান্য একটু শুধু। আগের মতো তার সহজ হাসিখুশি ভাব, আর তার বিচক্ষণ বুদ্ধির পরিচয় পেতে দেরী হল না।
‘‘না, না, মণি’, একসঙ্গে আবার যাত্রার প্রস্তাবের উত্তরে সে বলল, “না, পরের স্টীমার না আসা পর্যন্ত আপনাকে থেকে যেতে হবে। দুজনে একসঙ্গে গেলে সব কিছু পণ্ড হবে। আমার বেজায় খারাপ লাগবে। গা ছুঁয়ে বলছি, আমাকে হয়ত যা ভেবেছেন মোটেই আমি তা নই। এটা তো দুরের কথা, এর ঘেঁষা কিছু আমার জীবনে ঘটে নি কখনো, আর ঘটবেও না। আমার বুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছিল নির্ঘাত।... কিংবা হয়ত আমাদের দুজনের সদিগর্মি গোছের কিছু একটা হয়েছিল।...'
আর কেমন যেন হালকা মনেই তার কথা মেনে নিল লেফটেনান্ট। স্টীমার-ঘাটে হালকা খুশি মনে গেল তার সঙ্গে -- গোলাপী রঙের ‘সামোলিওৎ’*) ছেড়ে দেবার উপক্রম করেছে তখন – ডেকের সবার সামনে তাকে চুমু খেয়ে নামবার তক্তা সরিয়ে নেবার সময় কোনক্রমে লাফিয়ে পড়ল তা থেকে।
আগেকার মতো নিশ্চিন্ত হালকা মনে সে ফিরল হোটেলে। কিন্তু মনে হল এরই মধ্যে সেখানটা কিছু বদলেছে। ও নেই, ঘরটার চেহারা তাই কেন যেন একেবারে আলাদা। এখনো সেটা তার উপস্থিতিতে ভরাট, কিন্তু ফাঁকা! কী আশ্চর্য ঘরে তখনো তার বিলিতী ওডিকলোনের খাসা গন্ধ, ট্রেতে শেষ-না-করা তার চায়ের কাপ, কিন্তু তবু সে নেই।... আর কোমল অনুরাগে লেফটেনাণ্টের বুকটা এমন মুচড়ে উঠল যে, তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট ধরিয়ে সবেগে পায়চারি করতে লাগল ঘরে।
“কী অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা!” হেসে বলে উঠল জোরে, অথচ টের পেল চোখ ফেটে কিন্তু জল আসছে তার। -
‘গা ছুঁয়ে বলছি, আমাকে হয়ত যা ভেবেছেন মোটেই আমি তা নই...' আর চলে গেছে...'
পর্দাটা সরানো, বিছানা তখনো ঠিক করা হয় নি। ওর মনে হল বিছানার দিকে তাকানো এখন অসহ্য। পর্দা টেনে আড়াল করল বিছানাটা, হাটের হৈচৈ, গাড়ির চাকার আর্তনাদ ঢাকার জন্য জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে সাদা ফোলা পর্দাগুলো নামিয়ে বসে পড়ল সোফায়।... তাহলে ‘জাহাজী কাণ্ডকারখানার’ সমাপ্তি হল! ও তো চলে গেছে, এতক্ষণে অনেক দুরে, হয়ত বসে আছে কাঁচের সাদা লাউঞ্জে, নয়ত ডেকচেয়ারে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে রোদে চিকচিকে বিরাট নদীর দিকে, ভাটির দিকে কাঠের ভেলা চলেছে, হলদে বালুর চর, জল আর আকাশের উজ্জল দশ্যপট, ভোলগার অনন্ত বিস্তার... আর বিদায়, চিরবিদায়... আবার কোথাও দেখা হওয়া কি সম্ভব? –
‘সত্যি তো’, সে ভাবল, ‘আমি বিনা কারণে কী করে হাজির হই সে শহরে যেখানে থাকে ওর স্বামী, ওর তিন বছরের মেয়ে, আর মোটের ওপর যেখানে ওর গোটা সংসার, রোজকার জীবন’। -- শহরটা তার কাছে মনে হল অন্য ধরনের, পূত সে শহর, সেখানে মেয়েটি কাটাবে তার নিঃসঙ্গ জীবন, হয়ত প্রায় মনে পড়বে তার কথা, মনে পড়বে হঠাৎ দেখার কথা, নশ্বর মুহূর্তগুলির কথা। আর সে কখনো চোখে দেখতে পাবে না তাকে – চিন্তা করে হতবুদ্ধি লাগল লেফটেনাণ্টের। না, তা হতে পারে না! পাগলের মতো ব্যাপার হবে, অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এত তীব্র ব্যথা বোধ করল সে, ওর সঙ্গহীন সামনে প্রসারিত দীর্ঘ জীবনকে এত অর্থহীন মনে হল যে, আতঙ্কে আর হতাশায় হৃদয় ভরে গেল।
‘ছাইপাঁশ কী ভাবছি!’ ভেবে উঠে পড়ে আবার শুরু করল পায়চারি, চেষ্টা করল পর্দার আড়ালে বিছানাটায় চোখ যাতে না পড়ে। ‘কী হয়েছেআমার? আর ওর মধ্যে আহামরি কী দেখেছি, ঘটেছে কী শুনি? সত্যি সদিগর্মির মতো ব্যাপারটা! কিন্তু আসল কথা হল, এই হতচ্ছাড়া শহরটায় ওকে ছাড়া বাকি দিনটা কাটাই কী করে?”
মেয়েটির সমস্ত কিছু, এখনো মনে আছে তার, ওর সামান্যতম সব স্বকীয়তা, মনে আছে ওর রোদে পোড়া চামড়া, লিনেনের পোশাক আর বলিষ্ঠ দেহের গন্ধ, ওর মধুর, সহজ, হাসিখুশি গলার স্বর।... ওর স্ত্রীলোকসুলভ সমস্ত মোহিনী মায়ায় নিজের তীব্র উচ্ছাসের অনুভূতি এখনো আছে অসাধারণ স্পষ্টভাবে; তবু অন্য, একেবারে অভিনব এই অনুভূতিটা আরো গুরুত্বপূর্ণ এখন - যে বিচিত্র অদ্ভুত অনুভূতিটা ওর সঙ্গে থাকার সময় একবারও অনুভব করে নি। আগের রাত্রে মজার অভিজ্ঞতা হিসেবে ব্যাপারটা শুরু করার সময় কখনো মনে হয় নি এ ধরনের অনুভূতি তার হতে পারে। এই অনুভূতির কথা ওকে আর বলা যায় না এখন! -- ‘আর সবচেয়ে খারাপ হল, ওকে বলতে আর পারব না কখনো!’ ভাবল লেফটেনান্ট। “কী করি? এই সব স্মৃতি আর অশান্ত যন্ত্রণার চাপে কী করে অন্তহীন দিনটা কাটাই চিকচিকে ভোলগাপারের পাণ্ডববর্জিত এই শহরটায়, ভোলগা বেয়ে তাকে নিয়ে গেছে গোলাপী জাহাজটা!’
মুক্তির সন্ধান করা দরকার, অন্যমনস্ক হবার জন্য কিছু, করা চাই, যেতে হবে কোথাও একটা। মন ঠিক করে মাথায় টুপি চাপিয়ে, ছড়িটা তুলে নিয়ে ফাঁকা বারান্দায় টপবুটেরর লোহার কাঁটা খটখটিয়ে সে ক্ষিপ্র পায়ে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ছুটল সদর দরজায়।... বেশ, কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় ? বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে, ফিটফাট পোশাকে কমবয়সী একটি গাড়োয়ান কার প্রতীক্ষায় যেন ধীরভাবে সিগারেট টেনে চলেছে। বিব্রত অবাকভাবে লেফটেনান্ট তাকাল তার দিকে; কোচবাক্সে এমন ধীরস্থিরভাবে বসে সিগারেট টানছে, সব মিলিয়ে এমন একটা সাধারণ, বেপরোয়া আর উদাসীন ভাব লোকটার আসে কী করে? - ‘গোটা এই শহরে বোধহয় আমিই একমাত্র লোক যে ভয়ঙ্কর অসুখী,' – ভেবে বাজারের দিকে চলল লেফটেনান্ট।
বাজারে এরই মধ্যে ভিড় কমে আসছে। শসাবোঝাই গাড়ির মাঝখান হয়ে, তাজা গোবরে পা দিয়ে নিরুদ্দেশভাবে সে চলল। চারিধারে নতুন হাঁড়ি-কুঁড়ি আর ঘটিবাটি। মাটিতে বসে থাকা মেয়েরা এ-ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিনিস বেচতে চাইছে তাকে। বাটিগুলো তুলে আঙুলের টোকায় আওয়াজ তুলে দেখাতে চাইল কত খাসা জিনিস। এদিকে লোকেদের চিৎকারে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়: এই যে হুজুর, এমন খাসা শসা আর কোথাও পাবেন না, হুজুর! -- সমস্ত ব্যাপারটা এত অবান্তর আর বিশ্রী যে, বাজার ছেড়ে পালাল লেফটেনান্ট। গির্জায় গিয়ে পড়ল যখন, তখন প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে জোর গলায়, আনন্দ ও সিদ্ধকর্তব্যের অনুভূতিতে; তারপর নদীর ইস্পাত -ধূসর সীমাহীন প্রসারের পাড়ে পাহাড়টায় ছোট পরিত্যক্ত উত্তপ্ত বাগানে ঘোরাফেরা করল অনেকক্ষণ।... টিউনিকের ব্যাজ আর বোতামগুলো এত তেতে উঠেছে যে ছোঁয়া যায় না। টুপির ভেতরকার ফিতেটা ঘামে চটচটে, মুখটা জ্বলছে।... হোটেলে ফিরে বেশ ভালো আর আরাম লাগল একতলার বড়ো ফাঁকা ঠাণ্ডা ডাইনিংরুমে গিয়ে টুপি খুলে খোলা জানলার কাছে একটা টেবিলে বসতে। জানলা দিয়ে বইছে উত্তপ্ত হাওয়া, তবুও হাওয়া তো বটে। বরফ-দেওয়া বীট পালঙের সুপ ফরমাশ করল।... সব কিছু বেশ ভালো, সমস্ত কিছুতে অতল সুখ, বিপুল আনন্দ; আনন্দ রয়েছে এমনকি এই গরমে, হাটের গন্ধে, অদ্ভুত, শ্রীহীন অচেনা ছোট শহরে, মফস্বলের পুরনো হোটেলটায়, তবু সেই সাথে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। কয়েক গেলাস ভোদকা শেষ হল, নুন-দেওয়া শসা খেতে খেতে ভাবল, যদি কোনো জাদুমন্ত্রে ওকে ফিরিয়ে আনা যায়, শুধু যদি আর একটি দিন কাটাতে পারে ওর সঙ্গে, তাহলে কোনো দ্বিধা না করে আগামীকাল মরে যেতে প্রস্তুত সে--দিনটা কাটাতে চায় শুধুওকে বলার, বোঝানোর জন্য, ওর কাছে প্রমাণ করার জন্য যে ওকে ভালোবাসে কী জ্বালায়,তীব্র অনুরাগে।... কিন্তু কেন প্রমাণ করা? কেন বোঝানো ? সে জানে না কেন, কিন্তু তা বেঁচে থাকার চেয়েও বেশী দরকার।
‘স্নায়ুগুলোর বারোটা বেজে গেছে!’ অনুচ্চকণ্ঠে বলে ভোদকা ঢালল পঞ্চম বারের মতো।
সূপ সরিয়ে দিয়ে, কালো কফি আনতে বলে, সিগারেট খেতে খেতে একাগ্রভাবে ভাবতে লাগল: কী করা যায় এখন, কী করে রেহাই পাওয়া যায় এই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা থেকে? তা তো অসম্ভব, কথাটা অনুভব করল তীব্রভাবে। হঠাৎ চটপটে উঠে পড়ল, টুপি আর ছড়ি হাতে ডাকঘরের হদিস নিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটল সেখানে, টেলিগ্রামে কী লিখবে মনে মনে তার খসড়া প্রস্তুত : ‘আজ থেকে চিরদিন, আমরণ আমার গোটা জীবন আপনার হাতে।’ কিন্তু মোটা দেয়ালের পুরনো তার ও ডাকঘরে পৌঁছিয়ে হতবুদ্ধির মতো থমকে দাঁড়াল; কোন শহরে ও থাকে সে জানে, জানে ওর স্বামী ও একটি তিনবছরের মেয়ে আছে, কিন্তু ওর নাম ও পদবীটি তো জানা নেই! আগের রাত্রে খাবার আগে আর পরে হোটেলে বারবার জানতে চেয়েছে তার নাম, কিন্তু সে শুধু হেসে বলেছে:
‘কিন্তু আমি কে, আমার নাম কী, কেন জানতে চান?”
ডাকঘরের পাশে রাস্তার কোণে একটি ফটোগ্রাফারের দোকান। অনেকক্ষণ সে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল একটি অফিসারের বড়ো ফটোর দিকে - পুরু পাড় দেওয়া কাঁধপট্টিদুটো, বেরিয়ে আসা চোখ, নীচু কপাল, অদ্ভুত চমৎকার জুলফি। বিরাট চওড়া বুক ঢাকা নানা সম্মান চিহ্নে।... কী পাগলের মতো, কী বিদঘুটে আর ভয়ঙ্কর লাগে সাধারণ, তুচ্ছ সব জিনিসকে যখন হৃদয় আহত হয় -- হ্যাঁ, এখন সে জানে তার হৃদয় আহত হয়েছে, ভয়ঙ্কর সেই ‘সদিগর্মিতে’, সহ্যাতীত প্রখর প্রেমে, সহ্যাতীত সুখে! নবদম্পতীর একটি ছবির দিকে সে তাকাল – অল্প বয়সী বরের গায়ে লম্বা ফ্রককোট, গলায় সাদা টাই, চুল ছোট করে ছাঁটা, বিয়ের ওড়না পরা একটি মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে টান হয়ে – চোখ পড়ল একটি বাচাল চেহারার মিষ্টি মেয়ের দিকে, মাথার এক পাশে হেলে আছে ছাত্রীর টুপি।... তারপর তার অজানা, যন্ত্রণার বালাইহীন এইসব লোকের প্রতি ক্লিষ্ট ঈর্ষায় কাতর হয়ে সে সক্লেশে তাকাল রাস্তার ওদিকে।
‘কোথায় যাই? কী করি?”
রাস্তায় লোক নেই। বাড়িগুলোর চেহারা সবই এক রকম, সাদা, দোতলা। বণিকদের সব বাড়ি, সঙ্গে বড়ো বাগান, মনে হয় জনপ্রাণী থাকে না একটায়ও; রাস্তায় পুরু সাদা ধুলোর আবরণ; চোখে ধাঁধা লেগে যায়, সব কিছু তীব্র লেলিহান, আনন্দময় সুর্যের আলোয় প্লাবিত, কিন্তু এখানে কেমন যেন লক্ষ্যহীন। দুরে রাস্তাটা কূঁজো হয়ে ওপরে উঠে মেঘহীন, ছাই-রঙা চিকচিকে দিগন্তে গিয়ে পড়েছে। দক্ষিণের একটা রেশ এখানে, তাতে মনে পড়ে সেভাস্তোপোল, কের্চ... আনাপার কথা। এসবই বিশেষ করে অসহ্য লাগে। মাথা নীচু করে, প্রখর আলোয় চোখ কুঁচকিয়ে, মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে টলতে টলতে টপবুটের লোহার কাটায় হোঁচট খেতে খেতে ফিরে চলল লেফটেনান্ট।
হোটেলে যখন পৌঁছল, তখন শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে, সাহারা বা তুর্কিস্তানের*) কোথায় যেন দুস্তর পথ পার হয়ে এসেছে। শরীরের শেষ শক্তিটুকু খাটিয়ে ঢুকল নিজের বড়ো ফাঁকা ঘরে। ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়ে গেছে ততক্ষণে, মেয়েটির রেশমাত্র আর নেই, শুধু ফেলে যাওয়া একটি চুলের কাঁটা বিছানার ধারের টেবিলের ওপর! টিউনিক খুলে লেফটেনান্ট তাকাল আয়নায় : মামুলি অফিসারের রোদে পড়ে তামাটে মুখ, বিবর্ণ গোঁফ; তামাটে রঙের জন্য আরো সাদা দেখাচ্ছে নীলচে চোখের তারা - সে চোখে এখন উন্মত্ত উত্তেজনার একটা ছাপ, আর মাড় দেওয়া খাড়া কলারের পাতলা সাদা শার্টটায় অত্যন্ত যৌবনসুলভ, অত্যন্ত বিষণ্ণ কী একটা যেন ভাব। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে, ধুলোমাখা টপবুট পাশে রেখে। পর্দা নামানো, খোলা জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া এসে থেকে থেকে ফুলিয়ে দিচ্ছে পর্দাগুলোকে, ঘরে আনছে তপ্ত লোহার ছাদের আর সেই উজ্জ্বল, এখন একেবারে শূন্য ও শব্দহীন পৃথিবীর উত্তাপ। মাথার নীচে হাত রেখে, এক দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে শুয়ে রইল সে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজল, অনুভব করল গাল বয়ে ধীরে ধীরে নামছে চোখের জল; অবশেষে ঘুম এল। চোখ যখন খুলল তখন পর্দার ওদিকে লালচে-পীতাভ আভায় সূর্য অস্তগামী। হাওয়া পড়ে গেছে, ঘরে গুমোট গরম।... কালকের দিন আর আজকের সকালের কথা মনে পড়ল -- ঠিক যেন বছর দশেকের আগেকার ঘটনা।
ধীরেসুস্থে উঠে জামাকাপড় পরে নিল আস্তে আস্তে, পর্দা তুলে ঘণ্টা বাজিয়ে আনতে বলল সামোভার আর বিল, তারপর ধীরেসুস্থে খেল লেবু-চা। তারপর গাড়ি আনতে বলে স্যুটকেস অন্যদের দিয়ে নামিয়ে গাড়িতে ঢুকে বিবর্ণ, মরচে তামাটে সীটে বসে দারোয়ানকে বখশিস দিল পাঁচ রুবেলের একটা নোট।
‘মনে হচ্ছে, হুজুর, কালকে আমিই আপনাকে এখানে এনেছিলাম’, লাগামটা তুলে নিতে গিয়ে ফুর্তিতে বলল গাড়োয়ান।
স্টীমার-ঘাটে যখন পৌঁছল, তখন ভোলগার ওপরে নেমে এসেছে গ্রীষ্মের নীল রাত্রি। নানা রঙের ছোট ছোট আলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নদীতে, ঘাটের দিকে আসছে জাহাজ, মাস্তুলে ঝুলছে লণ্ঠন।
‘ঠিক সময়ে এনে ফেলেছি, হুজুর!’ তোয়াজ করে বলল গাড়োয়ান।
তাকেও পাঁচ রুবল দিয়ে লেফটেনান্ট টিকিট কেটে নেমে গেল স্টীমার-ঘাটে।... ঠিক আগের রাত্রের মতো জাহাজ ভিড়ানোর জায়গায় অল্প একটি শব্দ, দোলন্ত মেঝের দরুন একটু মাথা ঘোরা, ছুড়ে ফেলা দড়াদড়ি, অল্প কিছু পেছিয়ে আসা স্টীমারের নীচে জলের দ্রুত স্রোতের তোলপাড় আর শব্দ।... আর ভিড় বোঝাই, আলোয় আলো, রান্নাঘরের গন্ধে ভরপুর জাহাজটায় তার মনে এল অসাধারণ একটা হৃদ্যতা ও পরিতৃপ্তির ভাব।
এক মিনিট পর নদীর উজানে শুরু হল যাত্রা সেই পথে, যে পথে আজ সকালে চলে গেছে মেয়েটি।
বিরস, অলস, রঙীন নানা ছায়া জলে ফেলে সামনে অনেক দূরে মিলিয়ে গেল গ্রীম গোধুলির ঘোর আভা, তার অনেক নীচে জলে তখনো ছোট ছোট ঢেউয়ের স্পন্দন আর ঝিকিমিকি এখানে-সেখানে, চারিদিকের অন্ধকারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আলো ভেসে গেল দূরে, বহ, দূরে...
শামিয়ানার নীচে ডেক-চেয়ারে বসে বসে লেফটেনাণ্টের মনে হল বয়স বেড়ে গেছে দশ বছর।
-------
মারিটাইম আলপস, ১৯২৫
0 মন্তব্যসমূহ