ইভান বুনিনের গল্প : দাঁড়কাক

অনুবাদ : সমর সেন

বাবা দেখতে ছিলেন দাঁড়কাকের মতো। কথাটা মনে হয়েছিল ছেলেবেলায়। একদিন ‘নিভা*’য় একটা ছবি দেখেছিলাম নেপোলিয়নের -- শৈলশিরার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, সাদা ভুঁড়িপেট, গায়ে হরিণের চামড়ার কোট, পায়ে ছোট কালো বুট, আর হঠাৎ বগদানভে*র) ‘মেরু ভ্রমণ’--এর একটা ছবি মনে পড়ে যাওয়াতে খুশিতে হেসে উঠলাম – নেপোলিয়নকে দেখাচ্ছে ঠিক পেঙ্গুইনের মতো -- তারপর বিষণ্ণভাবে মনে হল: আর বাবা দাঁডকাকের মতো।...

আমাদের মফস্বল শহরে বাবা বেশ উঁচু পদের একটা চাকরী করতেন, সেটা আরো বেশী করে তাঁর ক্ষতি করে। সরকারী চাকুরেদের যে গোত্রের লোক তিনি, মনে হয় না এমনকি তাঁদের কেউ ধীরসুস্থ বচনে ও কাজে তাঁর চেয়ে বেশী উদ্ধত, বেজার, স্বল্পভাষী ও নিস্পৃহ নিষ্ঠুর 

ছিলেন। সত্যি তাঁকে দেখাত দাঁড়কাকের মতো – বেঁটে, গাঁট্টাগোঁট্টা, অল্প কুঁজো, খড়খড়ে কালো চুল, বড়ো নাক, লম্বা মুখ, দাড়ি-গোঁফ কামানো, শ্যামল বর্ণ – আরো বেশী দেখাত সেরকম যখন জনহিতার্থে প্রদেশপালের স্ত্রীর দেওয়া কোনো বল-নাচে গিয়ে তিনি রুশী কুঁড়েঘরের মতো সাজানো কোনো স্টলের কাছাকাছি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন কুঁজো হয়ে, দাঁড়কাকসুলভ বড়ো মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়কাকের মতো চকচকে চোখে তেরছাভাবে তাকিয়ে দেখতেন নৃত্যরত যুগলদের, স্টলের কাছে আসা লোকজন আর সেই ভদ্রমহিলাটির দিকে, যিনি মধুর হাসি হেসে, বড়ো হাতে হীরের আংটি ঝকঝকিয়ে সরু গেলাসে সস্তা হলদে শ্যাম্পেন দিতেন – দীর্ঘাঙ্গী ভদ্রমহিলাটি পরতেন সাবেকী মস্তকাবরণ, পরনে জরির গাউন, নাকটি পাউডারে এত সাদাটে গোলাপী যে নকল মনে হত। বাবা বহুদিন বিপত্নীক, ছেলেপিলে বলতে দু'জন – আমার আট বছরের বোন লিলিয়া আর আমি – আর সরকারী একটি বাড়ির দোতলায় আমাদের সরকারী ফ্ল্যাটের প্রকাণ্ড, চকচকে পালিশ করা ঘরগুলো জ্বলত কেউ-না-থাকার নিরাসক্ত জাঁকজমকে। বাড়িগুলোর মুখ ক্যাথিড্রাল ও শহরের প্রধান রাস্তার মাঝখানে পপ্‌লার ছাওয়া এ্যাভেনিউর দিকে। কপাল ভালো, বছরের বেশীর ভাগ আমার কাটত মস্কোয়। সেখানে কাৎকভ লাইসিতে*) পড়তাম, বাড়িতে আসতাম শুধু, বড়দিন ও গরমের ছুটির সময়ে। সে বছর বসন্তে স্কুলের পড়া শেষ করে যখন বাড়িতে এলাম, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার। 

মস্কো থেকে এসে একেবারে হতবুদ্ধি লাগল: কবরখানার মতো নিরানন্দ আমাদের ফ্ল্যাটে যেন হঠাৎ সর্যের আলো ফেটে পড়েছে -- হাসিখুশি কমবয়সী একটি মেয়ের উজ্জল উপস্থিতিতে ঘরদোর আলোকিত। লিলিয়ার বুড়ী আয়ার বদলে তাকে সবে নেওয়া হয়েছে; লম্বা, শুকনো সে বুড়ীটা দেখতে ছিল মধ্যযুগীয় কোনো পুণ্যবতী কাষ্ঠমূর্তির মতো। মেয়েটি গরীব, আমার বাবার অধীনস্থ একজন কর্মচারীর কন্যা, স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন ভালো একটা কাজ জুটিয়েছে আর আমি এসে পড়াতে সমবয়সী সঙ্গী একজন পাবে বলে তার আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু, মা গো, কী ভীরু মেয়েটি। পোশাকি ডিনারের সময় বাবার সামনে কী তার ভয়। কালো-চোখ লিলিয়াকে নিয়ে কী তার উৎকণ্ঠা। লিলিয়াও চাপা, কিন্তু তার এই চাপা ভাবেও কী তীব্রতা, যেমন তীব্রতা তার প্রত্যেকটি নড়াচড়ায় -- সর্বদা যেন কিছুর প্রতীক্ষায় আছে এমন ভাবে কালো-চুল মাথা বেপরোয়াভাবে এদিক-ওদিক ঘোরাত শুধু! ডিনারের সময় বাবাকে আজকাল আর চেনা যায় না: সাদা বোনা দস্তানাপরা বুড়ো গুরিই যখন খাবার দেয় তখন তার দিকে আর বেজার দৃষ্টি হানেন না; মাঝে মাঝে কথা বলেন -- একটু কষ্ট করে টেনে টেনে, তবু, সেটা তো কথা বলা — আর অবশ্য সবসময় বলেন মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে, অতি ভদ্রতা করে ডাকেন তার পিতৃনাম ধরে – “প্রিয় ইয়েলেনা নিকলায়েভনা’ বলে – এমনকি ইয়ার্কি বা হাসির চেষ্টা পর্যন্ত চলে। তাতে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে মেয়েটি শুধু হাসত ক্লিষ্টভাবে, পেলব পাতলা মুখে দেখা দিত টকটকে লাল ছোপ-- সে মুখটা রোগাসোগা, সোনালি-চুল একটি মেয়ে, সাদা ব্লাউজ বগলের নীচে কমবয়সের গরম ঘামে কালচে, সে ব্লাউজের নিচে বুকজোড়া ছোট, প্রায় দেখা যায় না। ডিনারের সময় আমার দিকে মুখ তুলে তাকাবার সাহস ছিল না তার, সে সময় ওর কাছে আমি এমনকি বাবার চেয়েও ভীতিকর। কিন্তু আমার দিকে না তাকাবার যতই চেষ্টা সে করুক, আমার দিকে বাবার তির্যক দৃষ্টিপাত ক্রমশ কঠিন হয়ে যেত: শুধু, তিনি নন, আমিও অনুভব করতাম যে আমার দিকে দৃষ্টিপাত না করে বাবারই কথা শোনায় তার কষ্টকৃত চেষ্টা এবং বদস্বভাব, চুপচাপ অথচ ছটফটে লিলিয়াকে দেখাশোনা করার আড়ালে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি ভয় চাপা আছে -- একসঙ্গে থাকলে আমরা দু'জনে যে আনন্দ বোধ করি, তারই থরোথরো ভয়। সন্ধ্যেবেলায় স্টাডিতে কাজ করার সময় বাবাকে সর্বদাই চা দেওয়া হত সোনালি কিনারের বড়ো একটি কাপে, তাঁর কাজের টেবিলে। কিন্তু এখন তিনি চা খান আমাদের সঙ্গে ডাইনিংরুমে; সামোভারে চা বানানোর ভার মেয়েটির হাতে, সে-ই ঢেলে দিত -- লিলিয়া ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। লাল-পাড় দেওয়া ঢিলে লম্বা একটি জ্যাকেট পরে বাবা পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের আরামকেদারায় বসে কাপটা এগিয়ে দিতেন তাকে। কানায় কানায় ভরে – বাবার পছন্দ সেটা – কম্পিত হাতে কাপটা তাঁকে দিয়ে আমার ও নিজের জন্য চা ঢালত, তারপর চোখ নামিয়ে সেলাইয়ের কাজ নিয়ে পড়ত। এদিকে বাবা, অভ্যাসমতো ধীরেসুস্থে যা বলতেন তা ভারি অদ্ভুত: 

‘ইয়েলেনা নিকলায়েভনা, যাদের সোনালি চুল, তাদের সবচেয়ে ভালো দেখায় হয় কালো, নয় টকটকে লাল পোশাকে।... এই ধরো, খুব উঁচু আর খাড়া কলার দেওয়া, ছোট ছোট হীরে বসানো, ‘মেরি স্টুয়ার্ট*) ধাঁচের কালো সাটিনের গাউনে তোমাকে চমৎকার মানাবে।... কিম্বা চুনির ছোট কুশের সঙ্গে সামান্য বুক-খোলা টকটকে লাল মখমলের মধ্যযুগীয় কোনো গাউন।... ফার-দেওয়া লিওনের নীল মখমলের ওভারকোট আর ভেনিসের টুপিও তোমাকে মানাবে।... এসব অবশ্য শুধু, আকাশকুসুম’, মৃদু হেসে তিনি বলতেন, “তোমার বাবাকে আমরা মাইনে দিই মাসে মাত্র পচাত্তর রুবল, তুমি ছাড়া আরো পাঁচটি ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ তাকে করতে হয়, সবকটাই ছোট - তাই খুব সম্ভব তোমাকে সারা জীবন কাটাতে হবে দারিদ্র্যে। কিন্তু তবু, আমি হামেশা বলি – আকাশকুসুম ভাবলে ক্ষতিটা কি? তাতে মনটা ভালো হয়, শক্তি ও আশা পাওয়া যায়। তাছাড়া, মাঝে মাঝে এমনটি তো হয় যে স্বপ্ন হঠাৎ সত্যি হয়ে গেল - তাই না? কচিৎ কখনো অবশ্য, কদাচিৎ বলতে হবে, তবু হয় তো।... এই ধরো, কুর্স্ক স্টেশনের সেই রাঁধুনেটা দু'লক্ষ রুবলের লটারির টিকিট টেনে বসল - সাধারণ রাঁধুনে তাও !’ 

এসব শুধু সহৃদয় ঠাট্টাতামাসা হিসেবে নিচ্ছে, ভান করত মেয়েটি। জোর করে মুখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসত, এদিকে যেন কোনো কথা কানে আসছে না এমন ভাব করে আমি পেসেন্স খেলে যেতাম। আর বাবা, একবার তিনি তো আরো দুরে এগোলেন। আমার দিকে মাথা নাড়িয়ে হঠাৎ বলে বসলেন: 

‘এই যে ছোকরা, এ-ও হয়ত নানা স্বপ্ন দেখে। ভাবছে পেয়ারের বাপ একদিন তো মারা যাবে, তখন এত সোনার মোহর পাবে যে গোনা ভার! সত্যি বটে, সে গুড়ে বালি, গোনার মতো কিছুই থাকবে না! বলা বাহুল্য অবশ্য যে, ওর বাপের কিছু কিছু সম্পত্তি আছে – যেমন সামারা প্রদেশে আড়াই শ' একর কালো মাটির সেই ছোট জমিদারিটা – কিন্তু আমার ঘোরতর সন্দেহ বাছাধন সেটা পাবে কিনা। বাপের প্রতি ওর অনুরাগ তো বিশেষ নেই, আর যতদুর বুদ্ধি- - ও একেবারে পয়লা নম্বরের নিষ্কর্মা হয়ে দাঁড়াবে।...' 

শেষ কথাবার্তা হয় সেন্ট পিটার দিবসের আগের সন্ধ্যায়, যে দিবসটি আমার পক্ষে অত্যন্ত স্মরণীয়। পরের দিন ভোরবেলায় বাবা বেরিয়ে গেলেন, প্রথমে -- ক্যাথিড্রালের উপাসনায়, তারপর প্রদেশপালের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে – সেদিন তাঁর জন্মদিন। কিন্তু এমনিতে রবিবার বাদে বাবা কখনো বাড়িতে লাঞ্চ খেতেন না, সেজন্য বরাবরকার মতো আমরা তিন জনে ছিলাম শুধু। খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে, তার প্রিয় নিমকির বদলে লিলিয়াকে চেরির জেলি দেওয়াতে সে গুরিইকে উদ্দেশ্য করে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে, টেবিলে ঘুষি মেরে প্লেটটা মাটিতে ছড়ে ফেলে দিল, মাথা ঝটকে কাঁপিয়ে রাগে ফুঁপিয়ে কঁকিয়ে উঠল। আমরা কোননাক্রমে তাকে তার ঘরে নিয়ে গেলাম, খালি আমাদের হাত কামড়াচ্ছিল আর পা ছুঁড়ছিল, সাধ্যসাধনা করলাম ঠাণ্ডা হতে, বললাম রাঁধুনেকে এর জন্য কঠিন সাজা দেওয়া হবে, অবশেষে স্তোক দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম কোনো রকমে। আর লিলিয়াকে ঘরে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের শুধু এই একত্র প্রচেষ্টায়, মাঝে মাঝে দু'জনের হাতে হাত লেগে যাওয়াতে কী থরোথরো সোহাগেই না আমাদের মন ভরে গেল! বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি, অন্ধকার ঘরে বারবার বিদ্যুতের ঝিলিক, বাজের শব্দে জানলার শার্সির খটখটানি। 

‘ঝড় বিদ্যুতের জন্য ও এত অস্থির হয়ে পড়েছে’, বারান্দায় বেরিয়ে আসার পর খুশিতে ফিসফিসিয়ে ও বলল, তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে কান পেতে শুনতে লাগল। 

‘ওরে বাবা, কোথায় আগুন লেগেছে!' বলে উঠল। 

ডাইনিং-রুমে ছুটে গিয়ে জানলা ঘটাং করে খুলে দেখলাম এ্যাভেনিউতে গড়গড় শব্দে দমকল ছুটে চলে গেল আমাদের বাড়ি পেরিয়ে। পপলারগুলোর ওপর খর বষ্টিধারা – ঝড় বিদ্যুৎ আর নেই, যেন বৃষ্টিতে নিভে গেছে -- হোজপাইপ আর মই বোঝাই লম্বা লম্বা গাড়ি ছুটোছুটি করছে। এগুলোর হৈচৈ-এর মধ্যে দুষ্টুছেলের খেলার মতো নরম হুঁশিয়ারির সুরে দমকলের বাঁশী বেজে উঠল, গাড়িতে কালো কালো ঘোড়ার কেশরের ওপরে ডাণ্ডায় লাগানো ঘণ্টার বাজনার মাঝে পেতলের শিরস্ত্রাণ পরা দমকালের লোকে দাঁড়িয়ে; কানে এল পাথরের রাস্তায় ঘোড়ায় দ্রুত টানা গাড়িগুলোর ধাতব মুখর ধ্বনি।... তারপর যোদ্ধা সেন্ট জন গির্জার* ঘণ্টাঘরে বিপদসূচক ঘণ্টার দ্রুত, অতি দ্রুত টঙ্কার।... দু'জনে কাছাকাছি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে, জানলা দিয়ে আসছে জল, বৃষ্টিধোওয়া রাস্তা আর ধুলোর গন্ধ, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়বৃত্তি শুধু দেখা ও শোনার জন্য চরম উত্তেজনায় জ্যাবদ্ধ। তারপর প্রকাণ্ড লাল একটা জলের ট্যাঙ্কসুদ্ধ শেষ গাড়িটা এসে ঘড় ঘড় করে চলে গেল, হৃৎস্পন্দন আমার দ্রুততর, কপালের চামড়াটা যেন শক্ত করে বসেছে – নেতিয়ে পড়া ওর হাত হাতে নিয়ে মুখের পাশে তাকালাম মিনতির ভঙ্গিতে আর – ও ফ্যাকাসে হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে, গভীর নিঃশ্বাস নেওয়াতে বুক উচু হয়ে উঠল। যে নির্মল চোখ আমার দিকে ফেরাল তাতে অশ্রু, ও আবেদন একটা। ওর কাঁধ ধরে জীবনে এই প্রথম মেয়ের ঠোঁটের অপরূপ স্নিগ্ধতায় আপনহারা হয়ে গেলাম।... এর পর থেকে এমন কোনো দিনের এমন কোনো ঘণ্টা যায় নি যে ওর সঙ্গে দেখা হয় নি, হঠাৎ যেন, হল ড্রয়িংরুমে, নয় বল্রুমে, বারান্দায় -- কিম্বা বাবার পড়ার ঘরে -- বাবার ফিরতে দেরী হত সর্বদা। সংক্ষিপ্ত দেখা সেগুলো, মরিয়ার মতো দীর্ঘ অতৃপ্ত চুম্বন, সে চুম্বন সমাধানহীনতায় তখনি সহ্যের বাইরে। আর বাবা, একটা কিছু আঁচ করে তিনি আবার ড্রয়িংরুমে সন্ধ্যেবেলায় আমাদের সঙ্গে চা খাওয়া ছেড়ে দিলেন, আবার মনমরা ও স্বল্পভাষী তাঁর ভাবখানা। কিন্তু তাঁকে আমাদের আর ভ্রুক্ষেপ নেই, ডিনারের সময় মেয়েটির হাবভাবে এল আরো শান্তি ও স্থৈর্য। 

জুলাই মাসের গোড়ায় অতিরিক্ত রাস্পবেরি খাওয়ার ফলে লিলিয়া অসুখে পড়ল; বিছানায় শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে সেরে উঠছে, সারা দিন একটা ছোট ডেকে লাগানো বড়ো বড়ো কাগজে রঙীন পেন্সিল দিয়ে উপকথার শহরের ছবি সে আঁকে; তাই লিলিয়ার পাশে সময় কাটানো ছাড়া তার গত্যন্তর রইল না। বসে বসে নিজের জন্য একটা ইউক্রেনীয় ব্লাউজে সূচীর কাজ করত – জায়গাটা ছেড়ে যাওয়া সম্ভবপর নয়, কেননা লিলিয়া সবসময় কিছু-না কিছু চাইত। আর ফাঁকা নিঃশব্দ বাড়িতে আমি একেলা থেকে তাকে দেখার, চুমু খাবার ও ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনের অবিরত বাসনায় দগ্ধে মরতাম। বাবার পড়ার ঘরে গিয়ে বসতাম। আলমারি থেকে এলোপাথারি বই টেনে নিয়ে পড়ার জোর চেষ্টা করতাম। সেদিনও ঠিক তাই করছি। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ কানে এল তার লঘু, দ্রুত পদধ্বনি। বই ছুড়ে ফেলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। 

‘ও ঘুমিয়ে পড়েছে?’ 

অসহায় ভঙ্গি একটা সে করল। 

‘ঘুমোবে আবার! ওকে তুমি চেনো না -- পাগলের মতো দু'রাত্তির না ঘুমিয়ে কাটালেও ওর কিছু এসে যায় না! আমাকে বাবার ডেস্ক থেকে হলদে আর কমলা রঙের গোটা কতক পেন্সিল খুঁজে পেতে বের করে নিতে পাঠিয়েছে।...' 

কেঁদে ফেলে কাছে সরে এসে আমার বুকে মুখ রাখল : ‘হে ভগবান, কখন এসবের শেষ হবে? ওঁকে বলো না কেন যে আমাকে ভালোবাসো, আমাদের আলাদা রাখতে পারে দুনিয়ায় এমন কিছু নেই।‘ 

অশ্রুসিক্ত মুখ তুলে গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে রুদ্ধশ্বাস চুম্বনে আঁকড়ে রইল। ওর সমস্ত শরীর আমার দেহে চেপে সোফার দিকে নিয়ে গেলাম – সে মুহূর্তে অন্য কিছু মনে করার বা ভাবার সাধ্য কি আমার? কিন্তু কানে এল দোরগোড়ায় কার মৃদু গলা খাঁকারি; ওর কাঁধের ওপর থেকে চেয়ে দেখলাম- - বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছেন। তারপর ঘরে, কুঁজো হয়ে তিনি চলে গেলেন। 

সে রাত্রে ডিনারের সময় দু'জনের কেউই দেখা দিল না। পরে গুরিই আমার দরজায় টোকা দিয়ে বলল: 

‘বাবা আপনাকে বলছেন ওনার ঘরে যেতে। পড়ার ঘরে গেলাম।’ ডেস্কের সামনে আরামচেয়ারে তিনি বসে ফিরে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন : 

‘কাল তুমি সামারার জমিদারিতে রওনা দেবে, বাকি গ্রীষ্মটা সেখানে থাকতে হবে। শরতে হয় মস্কো নয় পিতার্সবুর্গে গিয়ে একটা চাকরীর চেষ্টা করবে। যদি আমার কথা না শোনার মতো স্পর্ধা হয়, তাহলে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেব। কিন্তু এই সব নয়: কাল প্রদেশপালকে বলব যেন তোমাকে দেশে নির্বাসিত করে রক্ষীর সঙ্গে সেখানে পাঠিয়ে দেন। যাও এখন, আর কখনো যেন তোমাকে না দেখি। কাল সকালে ট্রেনের ভাড়া আর কিছু পকেট খরচা লোক মারফত পাবে। মস্কো বা পিতার্সবুর্গে প্রথম কয়েকটা দিনের খরচা বাবদ টাকা দেবার জন্যে কাছারিবাড়িতে শরৎ নাগাদ লিখব। যাবার আগে ওর সঙ্গে দেখা করার কোনো আশা রেখো না। ব্যস। যাও।’ 

সেই দিন রাত্রেই আমি ইয়ারস্লাভল প্রদেশে রওনা হয়ে গেলাম, সেখানে স্কুলের একটি বন্ধুর সঙ্গে সারা গ্রীষ্ম গ্রামে কাটল। শরতে তার বাবার সাহায্যে পিতার্সবুর্গে পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি চাকরী পেয়ে বাবাকে লিখলাম তাঁর সম্পত্তিতে আমার অধিকার চিরকালের জন্য ত্যাগ যে করছি শুধু, তা নয়, তাঁর কাছ থেকে কোনো সাহায্যেরও প্রয়োজন আমার নেই। শীতকালে শুনলাম চাকরীতে অবসর গ্রহণ করে তিনিও পিতার্সবর্গে চলে এসেছেন, সঙ্গে আছে ‘তাঁর লাবণ্যময়ী নবীনা বধু'। একদিন রাত্রে যবনিকা ওঠার কয়েক মিনিট আগে মারিইনকি থিয়েটারের স্টলসে যেতে যেতে হঠাৎ দেখলাম দু’জনকে। স্টেজের কাছে একটা বক্সে তারা, ঝিনুকের অপেরাগ্লাস কার্নিসে রেখে বসে আছে সামনের সীটে। ড্রেসকোটে দাঁড়কাকের মতো দেখতে তিনি কুঁজো হয়ে একটা চোখ কুঁচকে অনুষ্ঠান-লিপি পড়ছেন একাগ্র মনে। আর সে – সোনালি চুল চুড়ো করে বাঁধা, লাবণ্যভরে বসে ব্যগ্র চোখে দেখছে উষ্ণ, উজ্জ্বল আলোকিত, মৃদু গুঞ্জরিত নীচের প্রেক্ষাগহ, বক্সে বসা লোকেদের সান্ধ্য গাউন, ড্রেসকোট ও ইউনিফর্ম। বুকের ওপর চুণির একটা ছোট ক্রুশের অন্ধকার রক্তাভা, সরু কিন্তু এর মধ্যেই নিটোল হয়ে ওঠা হাত নগ্ন, আর টকটকে লাল মখমলের ওড়নার মতো কী একটা চুণিবসানো ব্রোচ দিয়ে কাঁধে আটকানো।... 


১৮. ০৫. ১৯৪৪ 




অনুবাদক
সমর সেন
প্রখ্যাত কবি, সম্পাদক, অনুবাদক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ