রেইমন্ড কারভার'এর গল্প : প্রতিবেশী

অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা 

খুব সুখী দম্পতি বলতে যা বোঝায়, বিল এবং আরলিন মিলার সেরকমটাই। তবে তারা কখনও কখনও মনে করে, তাদের সমাজে কেবল তারাই খুব আটপৌরে জীবনযাপন করে। বিল করে হিসাবরক্ষকের কাজ, এবং আরলিন ব্যস্ত থাকে টুকিটাকি সাচিবিক কাজ নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে মাঝেমধ্যে তাদের যে আলাপ হয় না, তা নয়; বিশেষ করে যখন তারা তাদের প্রতিবেশী দম্পতি হ্যারিয়েট এবং জিম স্টোনের সঙ্গে নিজেদের অবস্থার তুলনা করে। তাদের কাছে মনে হয়, স্টোনদের জীবন তাদের থেকে অনেক বেশি পূর্ণ এবং জমকালো। স্টোনরা প্রায়ই রাতের খাবার খায় বাইরে গিয়ে, কিংবা বাসায় করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা অথবা জিমের কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন স্থানে।

মিলারদের বাসা থেকে স্টোনদের বাসা এক করিডোরের এপার ওপার। জিম মেশিনপার্টস্ প্রতিষ্ঠানের সেলসম্যানের চাকরি করার সুবাদে প্রায়ই ব্যবসায়িক সফরকে প্রমোদভ্রমণ বানিয়ে ফেলে। এবারকার যাত্রায় তারা কাটাবে দশ দিন, প্রথমে শ্যায়ানে তারপর, আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে সেন্ট লুইসে। স্টোনদের অনুপস্থিতিতে মিলাররা তাদের অ্যাপার্টমেন্টের দেখাশোনা করবে। তাদের বেড়াল কিটিকে খাওয়াবে। গাছগুলোয় জল দেবে। 

রওনা হওয়ার সময় গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বিল এবং জিম হাত মেলাল। হ্যারিয়েট আর আরলিন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আলতো চুমু খেল ঠোঁটে। 

“মজা করো,” হ্যারিয়েটকে লক্ষ করে বলল বিল। 

“তা নাহয় করব,” বলল হ্যারিয়েট। “তোমরা খোকা—খুকিরাও ফুর্তি করো দিলখুলে।” 

আরলিন মাথা নাড়ে। 

জিম মজার ছলে চোখ টিপে বলল, “বিদায়, আরলিন। বুড়োটার খেয়াল রেখো ঠিকমত।” 

“তা আর বলতে,” আরলিন বলল। 

“ফুর্তি করো,” বিল ফের বলল। 

“নিশ্চিন্তে থাকো,” বিলের বাহুতে আলতো চাপড় দিয়ে জিম বলে। “তোমাদের আবারও ধন্যবাদ।” 

স্টোনরা গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে হাত নেড়ে বিদায় জানায়, মিলাররাও হাত নাড়ে। 

“আমরা যদি ওদের জায়গাটা নিতে পারতাম,” বিল বলে উঠল। 

“সত্যি, আমাদের জন্য একটা ছুটি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে,” আরলিন বলল। সিঁড়ি ভেঙে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার সময় সে বিলের বাহু তার কোমরে জড়িয়ে নেয়। 

রাতের খাবারের পর আরলিন বলল,“ভুলে যেও না, বেড়ালটিকে প্রথমরাতে কলজের স্বাদঅলা খাবার দিতে হবে।’’ সে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, হ্যারিয়েট গতবছর স্যান্টা ফে থেকে হাতে বানানো যে টেবিলক্লথটা কিনেছিল সেটাকে ভাঁজ করতে লাগল। 

স্টোনদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে বিল বুক ভরে শ্বাস নেয়। ঘরের বাতাস কেমন যেন থমথমে, কেমন যেন মিষ্টি। টেলিভিশনের ওপরে রাখা সূর্যসদৃশ ঘড়িটা (সানবার্স্ট ক্লক) জানান দিচ্ছে, এখন রাত সাড়ে আটটা। তার মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যে দিন হ্যারিয়েট ঘড়িটা নিয়ে বাড়ি এসেছিল, আরলিনকে সেটা দেখানোর জন্য কীভাবে সে করিডোর পার হয়েছিল; নবজাতকের মত পেতলের বাকশোতে রাখা ঘড়িটাকে কীভাবে সে দুলিয়েছিল দুহাতে, কথা বলেছিল আদুরে গলায়। 

কিটি তার চপ্পলে মুখ ঘষে, তারপর পাশ ফিরে বসে, কিন্তু হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে যখন বিল রান্নাঘেরে ঢুকে ঝকঝকে ড্রেইনবোর্ড থেকে একটা কৌটা বেছে নেয়। বিড়ালটাকে তার খাবারের কাছে রেখে সে গোসলখানার দিকে যায়। সে আয়নায় নিজেকে দেখে, ক্ষণকালের জন্য চোখ বন্ধ করে, আবার দেখে। ওষুধের দেরাজটা খোলে। ভেতরে একটা বড়ির কৌটা, গায়ের লেখা, হ্যারিয়েট স্টোন। প্রতিদিন একটি করে──নির্দেশ অনুযায়ী। সেটাকে সে পকেটে চালান করে দেয়। আবার সে রান্নাঘরে ফিরে যায় এবং এক পাত্র জল নিয়ে বসবার ঘরে আসে। গাছগুলোতে জল দেওয়ার পর জলের পাত্রটা কার্পেটের ওপর রাখে। এবার সে মদের কেবিনেট খোলে। শিভাস রিগ্যালের বোতল থেকে দুই ঢোক মদ খেয়ে আস্তিনে ঠোঁট মোছে। তারপর বোতলটি পুনরায় জায়গামত রেখে দেয়। 

কিটি দিব্যি ঘুমাচ্ছে সোফার ওপর। আস্তেধীরে দেখেশুনে বাতিগুলো নিভিয়ে দেবার পর সে দরজা লাগিয়ে দেয়। তার কেন জানি মনে হয়, কিছু একটা ফেলে এসেছে সে। 

“কী করছিলে এতক্ষণ?” আরলিন জিজ্ঞেস করে। সে তার পা দুটোকে ভাজ করে বসে টেলিভিশন দেখছে। 

“কিছু না। বেড়ালটার সঙ্গে খেলা করছিলাম,’’ আরলিনের কাছে গিয়ে বিল আলতোভাবে তার স্তনযুগল স্পর্শ করে। 

“চল ঘুমাতে যাই, সোনামণি...,” সে বলে। 


পরের দিন বিল তার বিকালের বিরতির বিশ মিনিটের মাত্র দশ মিনিট ব্যয় করে, এবং পাঁচটা বাজার পনেরো মিনিট আগেই অফিস ছেড়ে চলে আসে। বাড়ি ফিরে বিল যখন গাড়ি পার্ক করছে, আরলিনও তখন কেবল বাস থেকে নামছে। আরলিন ভবনটিতে না—ঢোকা পর্যন্ত বিল অপেক্ষা করে, তারপর দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায় যাতে আরলিন লিফ্ট থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরতে পারে। 

“বিল! হা ঈশ্বর! তুমি আমাকে যা ভড়কে দিয়েছ! এত জলদি যে!” সে বলে। 

বিল কাঁধ ঝাঁকায়। “আজ আর কাজ নেই,” সে বলে। 

দরজা খুলবার জন্য আরলিন তাকে তার চাবি দেয়। আরলিনের পিছু পিছু ঘরে ঢোকার আগে বিল করিডোরের ওপারের দরজার দিকে তাকায়। 

“চল শুতে যাই,” সে বলে। 

“এখন?” আরলিন হেসে ওঠে। “তোমার কী হয়েছে গো?” 

“কিচ্ছু না। জামাটা খোল তো,” সে তাকে অদ্ভুতভাবে জাপটে ধরে। আরলিন একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলে, “হা ঈশ্বর, এ কী হচ্ছে বিল!” 

বিল তার বেল্টের বাঁধন আলগা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

কিছু সময় পর তারা চাইনিজ খাবারের অর্ডার দেয়। খাবার এলে কথাবার্তা না—বলে রেকর্ডে গান শুনতে শুনতে হাপুসহুপুস খেতে থাকে দুজনেই। 

“কিটিকে খাওয়াতে যেন আবার ভুলে যেও না,” আরলিন বলে। 

“আমিও ওটাই ভাবছিলাম,” বিল উত্তর দেয়। “এখনই যাচ্ছি।” 

বিল একটি মাছের গন্ধ—মেশানো কৌটা বেড়ালটির জন্য বেছে নেয়। তারপর গাছগুলোতে পানি দেয়। যখন সে রান্নাঘরে ফেরত আসে, দেখে, বেড়ালটি তার বাক্সের ভেতর আঁচড় কাটছে। বিলের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে মনোযোগ সরিয়ে নেয় তার খাবারের দিকে। বিল সবগুলো ক্যাবার্ড খোলে এবং কৌটাজাত খাদ্য, শস্যদানা, প্যাকেটকৃত খাদ্য, ককটেল ও সুরাপানের গ্লাশ, চিনামাটির বাসনকোসন, পাত্র ও তাওয়া পরীক্ষা করে। সে রেফ্রিজারেটর খুলে সেলারিগুলো (বিশেষ ধরনের শাক) একটু শোকে, চেডার পনিরে দু-কামড় দেয়, একটা আপেল চিবাতে চিবাতে শোবার ঘরে ঢোকে। মেঝে পর্যন্ত ঝুলে—পড়া তুলতুলে সাদা বেডকভার আচ্ছাদিত বিছানাটাকে তার কাছে বিশাল বলে মনে হয়। সে শয্যার পাশের ড্রয়ারটা টেনে খোলে, অর্ধেক খালি এক প্যাকেট সিগারেট পায় এবং ওটা পকেটে পোরে। তারপর সে আলমারির দিকে গিয়ে দরজা খুলতে নিতেই সদর দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পায়। 

দরজার দিকে যাওয়ার সময় সে টয়লেটটা ফ্লাশ করে দেয়। 

“কী কাজে আটকে ছিলে এতক্ষণ?” আরলিনের প্রশ্ন,“তুমি এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এখানে।” 

“সত্যি তাই?” বিল বলে। 

“হ্যাঁ তাই,” সে বলে। 

“আমাকে টয়লেটে যেতে হয়েছিল,” বিল বলে। 

“তোমার কি নিজের টয়লেট নেই?” আরলেন বলে। 

“আমি অপেক্ষা করতে পারছিলাম না,” বিল বলে। 

সে রাতে তারা আবার শারীরিকভাবে মিলিত হয়। 


সকালে বিল আরলিনকে দিয়ে অফিসে না—যাওয়ার বার্তা পৌঁছে দেয়। সে গোসল সারে, পোশাক পরে এবং হালকা নাশতা খায়। নতুন একটা বই শুরু করতে চেষ্টা করে। সে হাঁটতে বেরোয় এবং বেশ ভালো বোধ করে। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে, পকেটে তখনও হাত ঢোকানো, সে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে। বেড়ালটির শব্দ শুনতে পায় কিনা তা দেখার জন্য সে স্টোনদের দরজা কাছে দাঁড়ায়। তারপর সে তার নিজের বাসায় গিয়ে চাবির খোঁজে রান্নাঘরে ঢোকে । 

স্টোনদের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরটা তাদের অ্যাপার্টমেন্টের চেয়ে বেশি শীতল, বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে মনে হয়। বাতাসের তাপমাত্রার সঙ্গে ঘরের গাছগুলোর ভালোমন্দ কিছু যায় আসে কিনা, তার মনে এ প্রশ্নও দেখা দেয়। সে জানালার বাইরে তাকায়, তারপর সবগুলো কামরার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়, একটা একটা করে সবকিছুকে গুরুত্ব দিয়ে, যাকিছু তার নজরে আসে। ছাইদানি, বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, রান্নাঘরের বাসন—কোসন, ঘড়ি। সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে সবকিছু। সবশেষে যখন সে শোবার ঘরে প্রবেশ করে, বেড়ালটি তার পায়ের কাছে এসে দেখা দেয়। সে ওটার গায়ে একবার হাত বোলায়, তারপর বাথরুমে নিয়ে গিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। 

সে বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য চোখ মুদে সে শুয়ে থাকে। তারপর সে নিজের হাত বেল্টের নিচ দিয়ে চালিয়ে দেয়। কী বার আজ, মনে করতে চেষ্টা করে। মনে করতে চেষ্টা করে কখন স্টোনদের ফিরে আসবার নির্ধারিত সময়, এবং তখন সে ভাবে, আদৌ তারা কখনও ফিরবে তো! সে তাদের চেহারা মনে করতে পারে না, পারে না মনে করতে কীভাবে তারা কথা বলত ও কী পোশাক তারা পরত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেশ চেষ্টা করে বিছানা থেকে গড়িয়ে টেবিলের ওপর ঠেস দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে সে। 

সে আলমারি খুলে একটা হাওয়াই শার্ট বেছে নেয়। সুন্দরভাবে ইস্ত্রি করা এবং টুইল কাপড়ের একজোড়া বাদামি ঢোলা পাজামার ওপর ঝোলানো একটা বারমুডা শর্টস্ সে দেখতে পায়। সে নিজের কাপড় ছেড়ে শর্টস্ ও শার্ট পরে নেয়। সে আবার আয়নার দিকে তাকায়। বসবার ঘরে গিয়ে নিজের জন্য মদ নেয় এবং বেডরুমে ফিরে যেতে যেতে তাতে চুমুক দিতে থাকে। এবার সে নীল শার্ট, কালো স্যুট, নীল—সাদা টাই, উয়িংটিপ কালো জুতা পরে নেয়। গ্লাশ ফাঁকা, সে আরেক প্রস্থ মদ আনতে যায়। 
আবার সে বেডরুমে গিয়ে চেয়ারে বসে। পা দুটোকে আড়াআড়ি রেখে স্মিত হেসে সে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে। টেলিফোন বাজে দুবার, তারপর থেমে যায়। মদ খাওয়া শেষ হলে সে স্যুট খুলে ফেলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না একজোড়া প্যান্টি ও ব্রেসিয়ার পাওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত সে উপরের ড্র্রয়ার তন্নতন্ন করে খুঁজে চলে। সে প্যান্টি পরে এবং ব্রেসিয়ার বাঁধে বুকে, তারপর আলমারিতে পোশাকের খোঁজ করতে থাকে। সে একটা সাদা ও কালো ছককাটা স্কার্ট পরে, ওটার জিপ লাগানোর চেষ্টা করে। সে সম্মুখে বোতাম লাগানো একটি বারগান্ডি ব্লাউজ পরে। হ্যারিয়েটের জুতার কথাও ভাবে, কিন্তু নাহ্, ওগুলো পায়ে লাগবে না, সে তা বুঝতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে সে পর্দার পেছন থেকে বসবার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে শোবার ঘরে যায় এবং সবকিছু খুলে ফেলে। 

সে ক্ষুধার্ত নয়। আরলিনও বেশি খায় না। তারা কেমন লাজুক দৃষ্টি নিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি হাসে। আরলিন উঠে পড়ে এবং শেল্ফের ওপর চাবি আছে কিনা তা পরখ করে দেখে। তারপর সে দ্রুত বাসনগুলো পরিষ্কারে হাত লাগায়। 

বিল রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায় ও আরলিনের চাবি তুলে নেওয়া দেখে। 

“আমি ওদের বাসা থেকে ঘুরে আসি, তুমি আরাম কর।” আরলিন বলে। “পত্রিকা—টত্রিকা কিছু একটা পড়।” চাবির ওপর—রাখা আঙ্গুলগুলো সে মুঠো করে। সে বিলকে বলে যে, তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। 

বিল খবরের ওপর তার মনোযোগ নিবদ্ধ করতে চেষ্টা করে। সে পত্রিকায় চোখ বোলায় এবং টেলিভিশন চালু করে। শেষে সে করিডোর পেরিয়ে অপর প্রান্তে যায়। বাসার দরজায় তালা লাগানো। 

“এই যে আমি, তুমি কি এখনও রয়েছো, সোনামণি?” 

কিছুক্ষণ বাদে তালা খুলে যায়, আরলিন বাইরে আসে এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। “আমি কি অনেকক্ষণ হল গেছি?” সে বলে। 

“হ্যাঁ, তা তো হবেই,” বিল বলে। 

“তাই,” সে বলে, “মনে হয়, আমি কিটির সঙ্গে খেলা করছিলাম।” 

বিল তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখে। আরলিন অন্যদিকে চেয়ে থাকে, তার হাত তখনও দরজার নবের ওপর রাখা। 

“আজব তো!” আরলিন বলে। “তুমি জানো, ওভাবে কারও ঘরে যাওয়া─” 

বিল ঘাড় নাড়ে। দরজার নব থেকে আরলিনের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে তাকে নিজেদের দরজার দিকে নিয়ে যায়। সে তাকে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর নিয়ে যায়। 

“এটা সত্যি অদ্ভুত,” সে বলে। 

সে লক্ষ করে, আরলিনের সোয়েটারের পেছনে সাদা কাপড়ের সুতো লেগে রয়েছে, এবং তার কপোলে গাঢ় অনুরাগের ছোঁয়া। সে তার গলায়, চুলে চুমু খেতে থাকে, আরলিন ঘুরে তাকায় এবং বিলকে পাল্টা চুমু খায়। 

“ধুর ছাই,” আরলিন বলে ওঠে। “ধুর ছাই... ধুর ছাই,” হাততালি দিয়ে ছোট্ট খুকির মত সে গেয়ে চলে। “আমার এইমাত্র মনে পড়ছে। যা করতে আমি ওখানে গিয়েছিলাম তা করতে ভুলে গিয়েছি। আমি কিটিকে খাওয়াইনি, গাছেও পানি দেইনি।”সে বিলের দিকে তাকায়, “কী বোকামি, তাই না?” 

“আমি তেমন মনে করি না,” সে বলে। “এক মিনিট। আমি সিগারেটা নেই, তারপর তোমার সঙ্গে আসছি।” 

যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাদের দরজা বন্ধ করে এবং তালা লাগায়, আরলিন তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর সে তার বাহুর পেশীতে হাত রেখে বলে, “আমার মনে হয় তোমাকে বলা দরকার, আমি কিছু ছবি পেয়েছি।” 

বিল করিডোরের মাঝামাঝি স্থানে থেমে যায়। “কী ধরনের ছবি?” 

“তুমি নিজেই দেখ না কেন,” বলে তার দিকে মনোযোগী দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আরলিন। 

“দুষ্টুমি করো না,” বাঁকা হাসি হেসে বলে বিল, “কোথায়?” 

“একটা ড্রয়ারের ভেতর,” আরলিন জানায়। 

“কোনও দুষ্টুমি নয়।”সে বলে। 

তখন আরলিন বলে,“হয়ত তারা আর ফিরে আসবে না।”এবং হঠাৎ নিজের কথায় সে নিজেই বিস্ময় বোধ করে। 

“এটা হতে পারে।” বিল বলে, “যেকোনও কিছু হতে পারে।” 

“অথবা তারা ফিরে আসবে...” কিন্তু আরলিন কথা শেষ করে না। 

সামান্য হেঁটে করিডোরের অপর প্রান্তে যাওয়ার সময় তারা পরষ্পরের হাত ধরে থাকে। কিন্তু বিল যখন কথা বলে, আরলিন তা প্রায় শুনতেই পায় না। 

“চাবি,” বিল বলে। “ওটা আমাকে দাও।” 

“মানে?” আরলিন বলে। সে দরজার দিকে তাকায়। 

“চাবি,” বিল বলে। “তোমার কাছেই তো চাবি।” 

“হা ঈশ্বর,” আরলিন বলে,”আমি চাবিটা ঘরের ভেতরে ফেলে এসেছি।” 

বিল দরজার নব ঘোরাবার চেষ্টা করে। ওটা বন্ধ। তারপর আরলিন চেষ্টা করে। ওটা ঘোরে না একটুও। আরলিনের ঠোঁট ইষৎ ফাঁক হয়ে যায়, শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার। বিল তার দু’বাহু সামনে মেলে ধরে, আরলিন নিজেকে তাতে সমর্পণ করে। 

“দুশ্চিন্তা করো না,” বিল তার কানেকানে বলে। “ঈশ্বরের দোহাই, দুশ্চিন্তা করো না।” 

তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থাকে। দরজায় এমনভাবে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়, যেন তারা প্রবল বাতাসকে ঠেকিয়ে রেখেছে। 







লেখক পরিচিতি: 
রেইমন্ড কারভার 

রেইমন্ড ক্লেভি কারভার জুনিয়র একজন অ্যামেরিকান ছোটগল্পকার ও কবি। তিনি অ্যামেরিকান ছোটগল্পে প্রাণসঞ্চারের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। সেইসঙ্গে ছোটগল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেন। বিষয়বৈচিত্র্য ও বাক—সংযমের জন্য তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। মাত্র ৫০ বছর বয়সে (জন্ম: ২৫ মে ১৯৩৮ মৃত্যু: ২ আগস্ট ১৯৮৮) তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 

তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘ক্যাথিড্রাল’ ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ও পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তিনি ছোটগল্পের জন্য পাঁচবার ও’হেনরি পুরস্কার লাভ করেন। 
তাঁর অনেকগুলি গল্প চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। 

আধুনিক কথাসাহিত্যে রেইমন্ড কারভার একজন অতি আলোচিত ব্যক্তিত্ব। 
এই গল্পটি তাঁর Neighbors গল্পের অনুবাদ। 









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ