সাল্‌ওয়া বক্‌র'এর গল্প : উত্তরাধিকারিণী


ভাষান্তর – উৎপল দাশগুপ্ত

মাঝে মাঝে ওঁকে আমার জটিবুড়ির মত লাগত। মিনারের চূড়ায় আমাকে ওঠাবার জন্য যেন ওপর থেকে বিনুনি ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ওঁর গোলকধাঁধার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মনে হয় অদৃশ্য এক মাকড়সার জাল আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর তাই যদি না হবে, তাহলে এই ষাট বছরের বুড়ি – যাঁর আর মাত্র ছ’টি দাঁত পড়তে বাকি আছে – তাঁর সঙ্গে শুধু শুধু পড়ে আছি কেন? খবরের কাগজটাও আর পড়ে উঠতে পারেন না, চলাফেরাও করেন একেবারে শম্বুকগতিতে! দোষটা প্রায়ই আমি সময়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই। ওই হতভাগা সময় আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলো চুরি করে নেয় আর নির্মমভাবে নিজেদের বা অন্যদের নিয়ে ভাবাভাবি করার সুযোগটুকুও ছিনিয়ে নেয়! আবার কখনও দোষারোপ করি এই বুড়িয়ে যাওয়া শহরটাকে, ভাগ্যের ফেরে আমরা যেখানে ফেঁসে আছি। এই শহরের বেড়ে চলা ব্যাধির সঙ্গে ছত্রাকের মত যেন লেপটে রয়েছি।

আমাদের একসঙ্গে বাঁধা পড়ে যাওয়ার কারণটা, আমার মনে হয়েছে, কতকটা এই রকম। আমি একজন বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা, আর আমার চব্বিশ বছরের ছেলে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত। ওর শরীরটা প্রকাণ্ড হলেও মনটা ন’বছরের বালকের মত নিরীহ। ওর দেখাশোনা করতে গিয়ে আমাকে সামাজিক জীবনে ইতি টেনে দিতে হয়েছে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির দূরদর্শিতাও প্রখর হয়েছে। ওঁর দুই ছেলে, বেশ কিছুদিন হল, নতুন দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। ছেলেদের কথা মেনে উনিও ওদের সঙ্গেই থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ প্রিয় কায়রো শহরের মায়া কাটিয়ে উঠতে না পেরে আবার পরিচিত দুনিয়াতেই ফিরে এসেছেন।

ফাঁকা সন্ধ্যেগুলো ওঁর সঙ্গেই কাটে আমার। সকালটাও শুরু হয় আমার ঘর থেকে দশ পা দূরে ওঁর ঘরে উঁকি মেরে ওঁর খোঁজ নিয়ে। বেরিয়ে যাবার আগে প্রতিদিন জিগ্যেস করি, “কাজে বেরচ্ছি। কিছু লাগবে তোমার?”

নাকি ওই হুঁকোটাই আমাকে আসলে ওঁর সঙ্গে বেঁধে ফেলল? ওঁর সঙ্গে বসে ধূমপান করা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছিল আমার। সত্যি বলতে কী, আগে ধূমপান করার, এমনকি সিগারেট খাওয়ার অভ্যেসও আমার ছিল না। সূর্যাস্তের সময় ব্যালকনিতে হুঁকোটা দুজনের মাঝখানে রেখে বসতাম। মানুষপ্রমাণ শিশু আমাদের সামনে বসে থাকত। আমরা পালা করে হুঁকোতে টান লাগাতাম। জলের বুড়বুড়ির আওয়াজ মাঝে মাঝে আমাদের আলোচনায় ছেদ টেনে দিত। প্রত্যাশা বা আগামীর ভাবনা মাথায় না রেখেই, অনেক কথাই মাঝপথে শেষ হয়ে যেত। আমরা যে বেঁচে আছি, এটুকুই কেবল যাচাই করে নেওয়া।

“বড়ই গুমোট একটি ভাব, গত দু’দিন ধরে।”

“উম্‌ খলিল, কেয়ারটেকার, কাল রাতে বাড়ির ঘুলঘুলিগুলো সাফ করে দিয়েছে।”

“খুব সাবধান, মামদুহ্‌ বাছা, কয়লায় তোমার হাত পুড়ে যেতে পারে।”

তবুও আমি মনে মনে হিসেব করতাম, একটি হুঁকোই কেবল আমাকে ওঁর সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে না। হয়ত আমার মনে কিছু হতাশা ছিল। কিংবা নিজেকে হয়ত পঞ্চাশোর্ধ একজন বিধবা বলে মনে হত। ভাববার যথেষ্ট কারণ ছিল, আমার বয়স যদিও এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। পুত্রের জন্য আমি বাঁধা পড়ে গেছি। আমি হয়ে গেছি ডানাছাঁটা একটি পাখি, যে না পারে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, না পারে উড়ে যেতে। পুত্রের সঙ্গে কোনওভাবে এই জীবনটা টেনে নিয়ে যাওয়া কি আমার কর্তব্য নয়? মাঝে মাঝে মনে হয়, যে পুরুষটি আমার কাঁধে এই বোঝা চাপিয়ে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে চলে গেছে, সে না হয়ে অন্য কোনও পুরুষ যদি আমার জীবনে আসত! সেই অন্য মেয়েটি ওকে পুত্র ও কন্যা উপহার দিয়েছে, স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি নিয়েই পৃথিবীর আলো দেখেছে ওরা, সময়ের সাথে সাথে বড় হচ্ছে, সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে, আল্লাহ্‌র অন্যান্য সৃষ্টির মতই।

কাঁধে আমার এমন বিশাল এক বোঝা, পায়ে বেড়ি পরানো, মানুষের থেকে, জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি – এই আমাকে - কোন পুরুষই বা গ্রহণ করবে? কাজে যাওয়া ছাড়া বাড়ির বাইরে যাইই না। পৃথিবী থেকে পালিয়ে বেড়ানোর একমাত্র আশ্রয় আমার বাড়ি। এই একটিই মাত্র আশ্রয় আমার, যেখানে আমি বুড়ির সঙ্গে বসে হুঁকো টানতে করতে পারি। আর ছেলে আমাদের সামনে বসে সার্কাসের সঙের মত লোক হাসানো উদাস চোখে চেয়ে থাকে।

অনেকদিন পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও, আমাদের পরস্পরকে জানার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু দীর্ঘায়িত কাহিনী এবং অনেক অমীমাংসেয় রহস্য। প্রথম যখন আমাদের দেখা হয় – নিজের জীবন বৃত্তান্ত শোনান – নেহাতই মামুলি সে বৃত্তান্ত, তেমন মনোযোগ দিয়ে শোনাও হয়নি, আপনাআপনিই হয়ত এক সময় বলা থেমে গেছে। ওঁর মুখের দিকে তাকালে মনে হয় ওঁর জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে ওঁর চেহারাটা বেশ খাপ খেয়ে যায়। একবারমাত্র কেউ ওঁর দিকে তাকিয়ে চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক মত নজর করতে পারবে না। খুবই সহজবোধ্য কারণ। বৈশিষ্ট্যগুলো মনে গেঁথে রাখার জন্য কেউ আর ফিরে তাকানোর কথা ভাববে না।

তারপর হঠাতই একটি দিন থেকে ওঁকে একটু অন্যভাবে দেখতে আরম্ভ করলাম। এক ছুটির দিনের সকালে – আমার ছেলে গভীর ঘুমে মগ্ন – আমাকে ওঁর কাছে যেতে হল, কিছু সুতো ধার চাইতে।

“অল্প একটু সবুজ সুতো হবে আপনার কাছে? জলপাই রঙের স্কার্টটা সেলাই করার জন্য লাগবে। পাশ থেকে ছিঁড়ে গেছে। এই সামান্য কারণে, দোকানে গিয়ে একেবারে নতুন একটি স্কার্ট কিনে ফেলতে একদম ইচ্ছে করছে না!”

মনে হল নিবিষ্ট মনে কোনো কিছু নিয়ে ভাবছেন। বললেন, “আরে ভেতরে এসো না। আমার সেলাইয়ের বাক্সে একবার দেখে নাও।”

আমি বললান, “আরে না, না … ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খুলে এসেছি। মামদুহ্‌ ঘুমোচ্ছে। আপনি সময় করে খুঁজে দিলেই চলবে।”

“আরে, একটু ভেতরে এসো না!” হেসে বললেন কথাটা। তারপর ইশারায় আমাকে ওঁর পেছন পেছন আসতে বললেন। তারপর বললেন, “এসো, বাক্সটা নিয়ে যাও। তোমার সময় মত সুতোটা খুঁজে নিও।”

পেছন পেছন গিয়ে ওঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটের একমাত্র শোবার ঘরে গেলাম। নিঃসঙ্গ একজন বৃদ্ধার জন্য ঘরটা বেশ বড়ই। সেলাইয়ের বাক্সটা আমাকে দেওয়ার জন্য ওয়ার্ডরোব খুললেন। বেতের তৈরি বাক্স। বিছানার সাদা চাদরে চুলের বিশাল একটি স্তুপ দেখে আমার চোখ যে কপালে উঠে গেছে, সেটা উনি লক্ষ্য করলেন। সূর্যের আলো পড়ে, কালো, বেগুনি আর রুপোলি রঙের আভা ঝলমল করছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অবাক হলে তো” দরজা খুলতে যাবার আগে বালিশটা খুলেছিলাম। ভেবেছিলাম ভেতরের জিনিসটা একবার রোদ আর বাতাস লাগিয়ে রাখব। বালিশের ওয়াড়টা ফেটে গেছে, জীর্ণও হয়ে গেছে। নতুন ওয়াড় লাগাবো ভাবছি।”

আমি পিঠের ওপর ফেলা আলগা করে বাঁধা লম্বা বিনুনির দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললাম, “ও আচ্ছা … বালিশের পুরোটাই চুল দিয়ে ঠাসা?”

“হ্যাঁ, আমার মায়ের চুল। এটা ওঁরই বালিশ। স্নান করার পর, হাতির দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালে যে চুলগুলো উঠে আসত, উনি সেগুলো একটি কাপড়ের ঝোলাতে পুরে রাখতেন, যতক্ষণ না সেটা একটি বালিশের মত হয়ে যায়। এই দেখ, এই কালো চুলগুলো হল, যখন ওঁর বয়স কম ছিল। তারপর যখন চুলে পাক ধরল, উনি মেহেন্দি লাগানো শুরু করলেন। এই লাল চুলগুলো হল সেই মেহেন্দি লাগানো চুল। আরও যখন বয়স বেড়ে গেল, তখন চুলের স্বাভাবিক রঙটাই রাখতেন।

“ওঁর বেণী দেখে মনে হত যেন রুপোর সুতো দিয়ে তৈরি। দুঃখের কথা হল, ওঁর মৃত্যুর সময় আমি হাসপাতালে ভর্তি। ওরা আমাকে মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যেতে দিল না। সবে আমার বাচ্চা হয়েছে। বলল যাওয়াটা নাকি অশুভ, বুকের দুধ শুকিয়ে যেতে পারে। মৃত্যুশয্যায় ওঁর কাছে থাকতে পারলে আমি ওঁর বেণীটা কেটে নিতাম। হে আল্লাহ্‌, ওঁর আত্মাকে রহমতে রাখুন। আল্লাহ্‌র অসীম মেহেরবানি, ওঁর চুলের গোছা বালিশের মধ্যে থেকে গেছিল। ওঁর কসের দুটি দাঁত আর সামনের একটি দাঁত একটি সাটিনের থলিতে রেখে দিয়েছি। মৃত্যুর আগে উনি এগুলো তুলে ফেলেছিলেন।

“ওহ্‌ … দুটি কসের দাঁত আর সামনের দাঁত একটি। কী আশ্চর্য!” অবাক বিস্ময়ে কথাটা বলেই, সেলাইয়ের বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম।

এই ঘটনার পর থেকেই কি মূনিরা ফত্‌হিকে আমি একটু অন্য চোখে দেখতে লাগলাম? কে জানে? কেবল খেয়াল করলাম, আমি সর্বক্ষণ ওঁর কথাই চিন্তা করি। বিছানার চাদরের ওপর রাখা কেশরাশির ছবি আমার মনে গেঁথে গেল। ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম, ছুঁচে সবুজ সুতো পরানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি ওঁর মায়ের লাল, কালো আর সাদা চুলের ওপর আলো পড়ে চকচক করছে।

সেদিনের পর থেকে ওঁর প্রতি আমি এক মিশ্র অনুভূতি বোধ করতে লাগলাম। উনি একজন অতি সাধারণ মহিলা, যাঁকে লক্ষ্য না করলেও চলে, এই রকম একটি অনুভূতি আমার মধ্যে আর রইল না। কিছু একটি ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে যাতে আমার মনে হল, উনি যেন রহস্যময়ী একজন নারী, যাঁর নিজস্ব কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে। সেদিন থেকে আমি ওঁর মনোজগত নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে আরম্ভ করলাম। আগে এরকম কিছু করবার কথা মনেও আসেনি। এর পর থেকে যখনই আমি ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়েছি, হুঁকো টানতেই হোক বা কফি পান করতে, আমি ওঁর ফ্ল্যাটের চার দেওয়াল জুড়ে লাগানো অজস্র ছবিগুলো দেখতাম। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, উনি যে কেবল দেওয়াল জুড়ে ওঁর আর ওঁর পরিবারের ছবিই টাঙিয়ে রেখেছেন তাই নয়, ফ্ল্যাটের আনাচকানাচ জুড়ে ছড়িয়ে আছে ওঁর পারিবারিক ইতিহাসও।

ছবিগুলো যে সবই ওঁর তা মোটেও নয়। প্রতিটি ছবিতে এই মহিলা এক সময় কী ধরণের জীবন কাটিয়ে এসেছেন, তারই ইতিহাস। এমনকি ওঁর রান্নাঘরে, মার্বেল দেওয়া গোল পুরনো টেবিলের ওপরের দেওয়ালের কোণের দিকেও ওঁর মা আর মাসির ছবি ঝোলানো আছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ওঁর মা প্রকাণ্ড একটি মাছ কাটছেন, আর ওঁর মাসি প্রবল উৎসাহে মাছের ল্যাজটা ধরে রেখেছেন।

চারদিকে ওঁর জ্যাঠা-কাকাদের ছবি, ওঁর ছেলেদের ছবি, ওঁর প্রয়াত স্বামীর ছবি, পরিবারের সকলের ছবি লাগানো – সমুদ্রের ধারে, চিড়িয়াখানায়, স্কুলে, পিরামিডে। একটিই মাত্র ব্যক্তিগত ছবি আছে, কনে হিসেবে, মানে আমার তাই মনে হয়েছে। সুন্দরী এক তরুণীর উদ্ভাসিত মুখ, পরনে সাদা রেশমের পোশাক, পোশাকের ভেতর থেকে দৃষ্টিগোচর, আঁটোসাঁটো আবরণে বক্ষের ঊর্ধ্বভাগে হাতে ধরা উটপাখির পালকের পাখা আলতোভাবে স্পর্শ করে আছে।

ছোট ছোট বাক্যে ওঁর বলা সংক্ষিপ্ত কথাগুলো আমার কাছে আর সাধারণ লাগে না। বরং, ছবিতে যা ব্যক্ত হয়নি, সেই শূন্যস্থানগুলি ভরিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে।

“আমার বাবা, তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করুক, দিবানিদ্রার পরে এই হুঁকো থেকে ধূমপান করতেন। বিশ্বাস করতে পার? প্রথম যেবার ধূমপান করলাম, সেটা ওঁর সাথেই! প্রথম প্রথম একবার কী দু’বার টান লাগাতাম। বুঝে নিতাম ঠিক আছি কিনা। তখন আমরা শুকনো তামাক কিনে জলে ভিজিয়ে নিতাম। কাজটা করতেন আমার মা, তারপর বাবার ব্যবহারের জন্য ছোট ছোট টুকরো করে দিতেন।”

পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গ উঠলে তবেই মা-বাবার কথা তুলতেন। পুরনো স্মৃতিই ওঁর সারা জীবনের একমাত্র সঞ্চয়। আমি নিজের সঞ্চয়ের কথা ভাবতে বসি। সেখানে দুঃখ আর কষ্টের স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই পাই না।

“একদিন ডাকপিওন আমার জন্য একটি চিঠি নিয়ে এল। আস্‌র্‌-এর নমাজের ঠিক আগে। সামি লিখেছে, আমার বড় ছেলে। সেই সময় আমি রুপোর তৈরি কেকের ট্রে থেকে ধুলো ঝাড়ছিলাম। আমার চাচির দেওয়া, আল্লাহ্‌ তাঁর আত্মাকে রহমত প্রদান করুন। বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন।

“গতকাল রাতে আমার ছেলে ফুয়াদ ফোন করেছিল, আমেরিকা থেকে। ওর বড় মেয়ে মিশরে আসতে চায়। ও একটু শামলা, আসলে ওর মা ইতালির মেয়ে। কিন্তু ওর গায়ের রঙ আমার হুসেন চাচার মতই চাপা। হুসেন চাচার আত্মাকে আল্লা রহমত প্রদান করুন।”

“কিসমতের কী জোর ওঁর!” মাঝে মাঝে আমি মনে মনে আওড়াতে থাকি। দুনিয়ার তামাম ব্যাপারেই উনি খুশি। আর আমি? দিনের মধ্যে হাজারবার আমি ভয়েই মরে থাকি। এমন ভয়ে ভয়ে থাকি যে মাঝে মধ্যে চেঁচিয়ে উঠতেও ইচ্ছে করে। ভয় পাই যে আমার চাকরি চলে যাবে, আমার রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে (তাহলে ছেলের আর আমার খাওয়াপরার কী হবে?)। পুরনো যে বাড়িতে থাকি, মনে হয় সেটা হঠাৎ ভেঙে পড়বে, আজকাল হামেশাই যা হচ্ছে (তাহলে আমরা মাথা গুঁজব কোথায়?)। ভয় হয় যে আমাকে এভাবেই জীবনটা টেনে নিয়ে যেতে হবে, এমন কোনও পুরুষের দেখা মিলবে না যে আমার দিনগত পাপক্ষয়ের সঙ্গী হতে পারবে, বা কখনো কখনো আমার মুখে হাসি এনে দিতে পারবে।

তবে আমার সবচেয়ে বড় আর সবেচেয়ে গভীর যে আতঙ্ক, যে আতঙ্ক দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, সেটা হল এই যে একদিন সকালে উঠে দেখব, আমার দুনিয়ার একমাত্র নিশ্চিত আশ্রয়, আমার অশান্ত জীবনের একমাত্র শান্তির প্রতীক, আমার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা – আমার বৃদ্ধা প্রতিবেশি মুনিরা ফাত্‌হি – তাঁকে আর খুঁজে পাচ্ছি না! ভয় হয় উনি সহসা একদিন মরে যাবেন। যে মানুষটি প্রতিদিন আমাকে পরের দিনের বেঁচে থাকার জন্য নিত্য ভরসা যুগিয়ে চলেন, তাঁকে আর পাব না।

মৃত্যু বলতে কী বোঝায়? রাত্রে যখন খুব নিঃসঙ্গ লাগে, আমার ঘুমন্ত তিমির নাসিকা গর্জনের ছন্দময় উত্থান পতন শুনতে শুনতে এই কথাটা খুবই ভাবায়। নিজেই নিজেকে জিগ্যেস করি, “মৃত্যু মানে কি শুধুই গরহাজিরি?” তাই যদি হবে তবে সেটা কিসের? কেবলই শারীরিক অনুপস্থিতি, না অন্তরাত্মার, নাকি ভাগ করে নেওয়া মুহূর্তের? মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা খুঁজতে লাগলাম। এই খোঁজাখুঁজির খেলা আমাকে বহুদিন আবিষ্ট করে রাখল। হাতে কাজ না থাকলেই আমি কমপিউটারে বসে খেলতে লেগে যেতাম।

এইরকমই একদিন, কমপিউটারকে কিছু তথ্য দিয়ে আমি মৃত্যু সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম। অতি সরল কিছু জবাব পেলাম – মৃত্যু মানে একটি শরীরে পচন ধরা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া, একজন ব্যক্তির অন্তর্ধান, হৃদয়ের গতি বন্ধ হওয়া, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি।

তবে কি মৃত্যুর দুটি দিক নেই? একটি হল, একজন মানুষের মৃত্যু, আর অপরটি হল কারও মৃত্যুতে অন্য একজন ব্যক্তির আঘাত পাওয়া। কেমন করে আমরা মৃত্যুকে একজনের দৃষ্টিকোণ থেকেই শুধু দেখব, আরেকজনের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়? তাহলে অন্য জনের অবস্থান থেকে মৃত্যুকে কী ভাবে পরিমাপ করা হবে?

প্রশ্নটা আবার কমপিউটারে রাখলাম। আবারও কিছ আশ্চর্যজনক উত্তর –

“চোখ দেখতে পায় না। কান শুনতে পায় না। মুখ চুম্বন করে না। হাত স্পর্শ করে না … ”

আমার প্রিয় প্রতিবেশির দেওয়া জবাবটি কমপিউটারের দেওয়া জবাবের থেকে অনেক বেশি নির্ভুল। আর জবাবটি এত তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলেন, যেটা আমি আশা করতেই পারিনি। একদিন, মধ্যরাতের পরে, উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার দরজায় অবিরত ধাক্কা দিচ্ছিলেন। ঘুম ভেঙে চোখ খোলার পরেই মনে হল হয়ত আমার সন্তানের ওপর কোনও একটি বিপর্যয় নেমে এসেছে। দেখলাম উনি দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হল উনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। বললেন, শরীর খুব খারাপ লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি ওঁকে ফ্ল্যাটের ভেতরে নিয়ে এসে আমার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। ওঁর জন্য জল আনতে রান্নাঘরে ছুটলাম। বারবার বলছিলেন ওঁর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তার ঠিক পরেই সব থেকে কাছের হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করে একজন ডাক্তার ডাকলাম। আবার ছুটে ওঁর কাছে গেলাম। নিষ্পন্দ হয়ে শুয়ে আছেন। মাথাটা আমার বালিশের কোণে ঢলে পড়েছে। ওঁর বিনুনি ঝুলে মেঝেতে লুটোচ্ছে। রুপোলি বিনুনি, বিছানার পাশে ঝোলানো ল্যাম্পের ম্লান আলো পড়ে চকচক করছে।

আমি স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পরম শান্তিময় স্বস্তিদায়ক একটি অনুভূতি আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আগে কখনও এরকম অনুভূতি আমার হয়নি।

এতদিন ধরে যে আশঙ্কা করছিলাম, সেটাই হয়েছে, অথচ আমি শান্ত, সমাহিত। জীবনটা যে সম্ভাবনাময়, সেটা উপলব্ধি করতে পারছি। প্রতিবেশিনীর সঙ্গে শেষের মুহূর্তগুলোতে আমাদের দুজনের মাঝখানে হুঁকোর ব্যবধান ছিল না, ছিল না সামনে বসে থাকা আমার মানুষপ্রমাণ শিশু।

“মৃত্যু আমার সমুখে এখন একটি অনুভবনীয় অভিব্যক্তি, স্পর্শনযোগ্য বস্তু। অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়ার আক্ষেপ,” নিজের মনে মনেই বললাম। ওঁর বিশীর্ণ মুখের দিকে তাকালাম। মৃত্যুর শাশ্বত প্রশান্তি সেখানে বিরাজমান।

তবুও আমার খুব অনুশোচনা হল। ওঁর মৃত্যু আমাকে দুর্বহ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে, আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। মৃত্যু সম্বন্ধে আমার সমস্ত ধারণা, আমার সমস্ত যুক্তিবোধকে পরাস্ত করেছে। মনে হচ্ছে আমার কাছ থেকে কিছু একটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আমার অত্যন্ত প্রিয়, অত্যন্ত মূল্যবান কিছু জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

আচ্ছন্নের মত আমি ওয়ার্ডরোবের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাঁচিটা বের করে নিলাম। তারপর আবার ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আরও একবার ওঁকে দেখলাম। তারপর হাত দিয়ে ওঁর মোটা লম্বা বেণীটা মুঠোয়ে ধরলাম, তারপর দৃঢ় হাতে বেণীটা কেটে নিলাম। এখনও দুয়েক গাছি কালো চুল, সময়ের আঘাত সহ্য করে থেকে গেছে।

আয়নার কাছে গিয়ে বেণীটা মালার মত করে মাথায় জড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। অপূর্ব এক প্রশান্তিতে মন ভরে গেল। বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের বাঁশির তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে এল।



লেখিকা পরিচিতিঃ
সালওয়া বক্‌র-এর জন্ম ১৯৪৯ সালে মিশরে হয়। উনি একজন প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখিকা, নাট্যকার এবং চিত্র সমালোচক। ১৯৮৫ সালে ওঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয় – জ়িনাত অ্যাট প্রেসিডেন্ট’স ফিউনারাল। এরপরে ওঁর ছোটগল্পের অনেকগুলি সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে ওঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় – ওয়াস্‌ফ আল-বুলবুল (দ্য ডেস্ক্রিপশন অফ অ্যা বুলবুল)। ওঁর লেখালেখিতে সঙ্গরক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে ওঁর অনেক লেখাতেই, মিশরের বিভিন্ন স্তর থেকে আসা নারীদের সমস্যার কথা উঠে এসেছে। ওঁর দ্য গোল্ডেন চ্যারিয়ট উপন্যাসে একটি জেলখানার বিভিন্ন মহিলাবন্দীর জবানবন্দী এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ