সুমন রহমান
এই বর্ষাবিধৌত
সন্ধ্যাগুলোতে আমার টবচর্চা, আমার
উদার পানিসিঞ্চন, বারান্দায়
টবের ফুলগাছগুলো হাঁসফাঁস করে ওঠে। তাদের দিকে না তাকিয়ে আমি অবিরাম পানি ঢেলে
যাই। এভাবে বদনার নল ও ফুলগাছের শেকড়ের মধ্যে এক পানীয় রাস্তা স্থাপিত হয়, অব্যাহত পানির স্রোত প্রথমে
তাদের বিস্ময়, পরে
বিরক্তি, তারোপরে
বিবমিষা, তস্যপরে
খিস্তিখেউড়সমেত ডুবিয়ে একটা ছোট্ট কিন্তু তীব্র জলাবদ্ধতা তৈরি করে। সেখানে
খেলতে আসে বর্ষাশেষের বাতাস, তাদের
শিস খুব হালকা আর নরম উস্কানিতে ভরা, যেন সামনে, গাছপালা
কেটেছেঁটে ঐ যে নাকবরাবর দূরে একটা নকল বনানীমত বানানো হয়েছে, তার আড়াল দিয়ে আমার
মুক্তিদশার নদী কলকল করে বইছে।
তখন কেমন একটা দার্শনিকতাও
পেয়ে বসে। প্রাচীন ঋষিরা বলেন পানিই নাকি জগতের মর্ম, আমার কাছে মনে হচ্ছে, পানি নয়, জগতের মর্ম হল পানিসিঞ্চন।
মানুষ ও প্রকৃতি আসলে পানিসিঞ্চনই করে, পৃথিবীর ভূত-অভূত নানান শিকড়ে। এটাই জগতে একমাত্র কাজ। হে মনুষ্য!
পরিণাম চিন্তা না করিয়া তোমার আরাধ্য শিকড়গুলাতে পানি ঢালিয়া যাও....পৃথিবীর
কোনো একটা ধর্মগ্রন্থে এরকম একটা বাক্য থাকতেই পারে। ফলে বদনার নল দিয়ে পানি
অবিরাম পড়ে, টব
উপচিয়ে কখন যে বারান্দা টপকে নিচের ফাটের বারান্দায় পড়তে শুরু করে আমার খেয়াল
থাকে না। বা থাকলেও কিছু করনীয় থাকে বলেও মনে হয় না। কানের পাশে অফিসফের্তা
সাবরিনার নিচু গলার হিসহিস চাবুক আছড়াতে থাকে।
: তুহিনদের ফ্যাটে পানি পড়তেছে, শুনতে পাও না?
আমি হিসহিস শব্দ শুনি।
: ডেইলি সন্ধ্যায় একই কান্ড, এখন ন্যাকড়া-ত্যানা নিয়া যাও, ওদের বারান্দা মুইছা দিয়া আসো।
হিস হিস হিস।
: একদিন দেখা যাবে তুহিনের বাবা আইসা কান ধইরা বারান্দা মুছাইতে
নিতেছে...
হিসহিসহিস। স্বীয় স্বামীর
কর্ণযুগল অপর একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ কর্তৃক আকর্ষণের কল্পনা, যৌন উত্তেজক নিশ্চয়ই! ততণে
আমার কাজ শেষ। ঘরে এসে শুয়ে পড়ি মশারি টাঙিয়ে।
শুয়ে শুয়ে ভাবি। কতকিছু!
আমার শৈশব, সাইকেল
শেখা, নদী
সাঁতরানো। প্রথম চুম্বন, যৌন
অসততার দগদগে স্মৃতিগুলো, বের করে
করে চিবাই। টবের পানিতে আজ একটা লেয়ার পড়বে, ভোরের নরম আলোয় সেটা আকর্ষণ করবে কোনও পথহারা এডিসকে, এডিস তুমি কি পথ হারাইয়াছ, ডিম্বভারে তুমি কি স্লথগতি, আশ্রয় খুঁজিতেছ? দেখ আমার পরাগধানী, আর নিচে কী সুন্দর স্বচ্ছ
টলমল জল, ঘণ্টাদুই
তুমি আমার পরাগধানীতে বিশ্রাম কর বাপ, দেখবে তোমার ছেড়ে দেয়া ডিম থেকে লার্ভা বের হয়ে টলমল পানির ভেতর
মৃদু মৃদু ঘুরছে.....! এরকম একটি মহৎ সম্ভাবনা আমার মশারির উপরে ঘুরপাক খায়। একটা
ধারাবহির্ভূত অফৌজদারি মরণদশা বানায়। সেই দশার ভেতর আমি সাবরিনার মুখখানি বসিয়ে
দিয়ে পরম আরামে ঘুমাই।
সাবরিনাকে আমি মনে মনে ডাকি, আমার র্যাডিক্যাল
রজনীগন্ধা। রজনীগন্ধার মত ঋজুতা আছে ওর, ফলে আমি রজনীগন্ধাকেও ঘৃণা করি। শুয়ে শুয়ে ওর কথা ভাবি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে
নিশ্চয়ই ওর ডিপার্টমেন্টাল কলিগের বোনের বিয়েতে যেতে না পারার বছরপূর্ব
বেদনাটিকে শিক দিয়ে খোঁচাচ্ছে। এরকম দুয়েকটি বেদনা আছে ওর, সংবৎসর গণগণে থাকে, একটু টোকা পড়লেই
কন্টেম্পরারি হয়ে যায়। এরাই আমার আমোদের উৎস, হৃদয়ে শান্তি আনে। শান্তি আসে আমার আলাদা ঘরে আলাদা বিছানায় টানানো
মশারির বড় বড় দুটো ছিদ্র দিয়ে। এই ছিদ্রদুটো সেলাই করে দেয়ার কথা প্রতিদিনই
বলে সাবরিনা, আর
প্রতিদিনই ‘ভুলে’ যায়। সকালবেলা ওর অফিসের
গাড়ি যখন নিচে ঘন ঘন হর্ণ বাজায়, ঘড়ি পরতে পরতে আমার ঘরে উঁকি দেয় সে।
: মশারিটা আনুমানিক কত বছর পরপর একবার খোলা যাইতে পারে বইলা তোমার
ধারণা?
: বলা খুব মুশকিল। আপাতত এইটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
: ওহহো...ছিদ্র দুইটা সেলাই করা হইল না। দেখি, আজকা আইসা কইরা দিমু।
দেয়া হবে না কোনদিন, জানি আমি, এরাই যে ওর মুক্তির দরজা।
হাসি নিজের মনে। সে যদি প্রতিদিন মশারি সেলাইয়ের কথা নাও বলত, আমি কোনদিনই নতুন মশারি
কিনে আনতাম না।
বস্তুত, এটা এমন একটা ডুয়েল যেখানে
আমি সুঁইসূতা হাতে নিই না, যেমন সেও
ফেলে দেয় না টবে জমে-থাকা বাড়তি পানিটুকু। এটা হচ্ছে এমন একটা নৈতিক পরিস্থিতি
যাকে আমি অনেকদিন ধরে ভেবে ভেবে বানিয়েছি, এবং আমার অসহ্য লাগে যখন দেখি সাবরিনার চোখেও একই কৃতিত্বের আভা।
এভাবেই আমরা দুটি ডুবন্ত
পিঁপড়ের মত জড়াজড়ি করে উপরনিচ করতে করতে আসন্ন ডেঙ্গু মহামারীর দিকে আগাই।
আমাদের কোন যৌথতা নাই, কেবলমাত্র
টেলিভিশনের সংবাদ দেখা ছাড়া। সংবাদ শুনতে শুনতে আমার চোখ চকচক করে ওঠে, ওরও মুড়ি-চিবানো বন্ধ হয়ে
যায়। স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী স্বয়ং এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। অর্থাৎ
মিন্টো রোড পর্যন্ত এসে গেছে? পরম
বন্ধুর মত আমরা চকিত তাকাই একে অপরের দিকে। আহাহা...আর মাত্র পরীবাগের ঢাউস কয়টা
এপার্টমেন্ট আর ইস্টার্ণ প্লাজা নামক জঙ্গলটা....তারপরই তো ভুতের গলি! এত খুশি
লাগছিল, মনে হল
তুণি একটা মেঘদূত লিখতে বসি। হঠাৎ ’কালিদাস’ ‘কালিদাস’ বলে আমি চিৎকার করে উঠি।
: কালিদাস মানে?
: কবি কালিদাস...স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার। চিলেকোঠায়
থাকে।
: তারে ডাকতেছ ক্যান?
: কারণ অইই মশা নামাইছিল। উইড়া আসা এক দঙ্গল মশারে মেঘ মনে কইরা
মেঘদূত লেইখা ফালাইছিল....আর যায় কই!
: এডিস ছিল ঐগুলা?
: নাহ্...এডিসের জ্ঞাতিগোষ্ঠী। আসল এডিস ভিতরেই ছিল।....
আমরা এই হেঁয়ালিটাকে টানতে
টানতে অনেকদূর নিয়ে যাই। দু’জনেরই
উদ্দেশ্য, অন্যজন
যাতে মূল প্রসঙ্গটি এইসব ডালপালার মধ্যে খোয়ায়। কিন্তু নিখিল আলস্যস্রোতে ভবি
ভুলবার নয়। ওর সোজা হয়ে-থাকা মেরুদন্ড খেয়াল করে আমি বেশ বুঝতে পারি, কী ভাবছে সে, যেমন সেও তাকিয়ে আছে আমার
হঠাৎ লাফানো-শুরু-করা কপালের শিরার দিকে। পুরোপুরি পেশাদার প্রস্তুতি, যেন ইতালিয়ান ফুটবল লীগের
ফাইনাল।
পরের দিন সকাল। ওয়ার্মআপ।
আমি।
: নাহ...অফিসে যাব না আজ। কেমন জ্বর জ্বর লাগতেছে।
: সত্যি....যাঃ কিচ্ছু না, অফিস কামাই কৈর নাতো, যাও, ঠিক
হৈয়া যাবে।
কয়েক ঘণ্টা পর। ওয়ার্মআপ
ব্যাক। সাবরিনার ফোন।
: হ্যালো, গায়ে
কেন জানি ব্যথা করতেছে খুব। মনে হয় জ্বর আসবে। রান্না করতে পারব না, তুমি বাইরে খায়া আইস। আমি
অফিস থেকে ফেরার পথে ডাক্তার দেখায়া আসব।
: ডাক্তার দেখায়া লাভ কি। ঐগুলা তোমার পুরান বাতের ব্যথা। বাসায় আইসা
গরম পানির সেঁক নাও, ভাল
হৈয়া যাইব।
একদিন সন্ধ্যায় আমাদের
ফ্যাটের নিচে এম্বুলেন্সের সাইরেন থামে। কিছু জটলা হয়। দু-একটা উঁচুগলার
কথাবার্তা ভেসে আসে। সাবরিনার ভাষায়, নিষ্ঠুরতাহেতু আমি এসব দৃশ্যের দর্শক হই না, স্নায়বিক দুর্বলতার কথা
বলে পাশ কাটাই। সাবরিনা কিন্তু দেখে, আমি জানি যে সে এই দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, অম্লান একটুকরা সহমর্মিতা
মুখে ঝুলিয়ে।
: শুনছ...তিনতলার ভাবী মনে হয়, ধরাধরি করে এম্বুলেন্সে উঠাইতেছে। কালকা শুনছিলাম ভাবীর জ্বর। তিনদিন
ধৈরা।
: ডেঙ্গু নাকি?
: তাইতো বলাবলি করতেছে নিচে।
সাবরিনার গলায় স্পষ্ট
ঠাট্টা। আমি বেদনায় বিমূঢ় হয়ে যাই। এটা কী রকম রসিকতা? এ যেন বত্রিশ নাম্বার পেয়ে
ফেল করা, নিরানব্বই
রানে আউট হয়ে যাওয়া, লটারিতে
শেষ ডিজিট না মেলায় পাক্কা ত্রিশ লাখ টাকা হাতছাড়া হওয়া। উদভ্রান্তের মত
বারান্দায় ছুটে যাই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ইঞ্জিনিয়ার শাহাবউদ্দিন সাহেবকে।
লুঙ্গি পরা, উস্কোখুস্কো, বউয়ের স্ট্রেচার ঠেলে
এম্বুলেন্সে উঠাচ্ছেন। অথচ ভেতরে ভেতরে কী নির্ভার আর সপ্রতিভ লাগছে তাকে।
ওয়েলডান শাহাবউদ্দিন, বিড়বিড়
করে বলি, আর ভেতরে
ভেতরে ঈর্ষায় ছারখার হয়ে যাই।
তবে নিশ্চয়ই সময় এখনও শেষ
হয়ে যায় নাই Ñ রাতে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি। দূর থেকে মিউনিসিপ্যালিটির মশানিধন যন্ত্রের বিকট
আওয়াজ ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে আমার স্নায়ু কাটে। খুব ত্রস্ত লাগে, জীবনকে সাংঘাতিক ছোট মনে
হয়। ভেঙ্গে পড়া যাবে না, বিড়বিড়
করে নিজেকে বলি, কে না
জানে যে মিউনিসিপ্যালিটির ওষুধে মশার কিচ্ছু হয় না। হতে পারে, খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
ডেঙ্গু হওয়ায় পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে গেছে, তাতে কিছু অন্তত খাঁটি ওষুধ মশাদের পেটে যাওয়ার সম্ভাবনা। এমন
অবস্থায়, ধরা যাক, এমনওতো হতে পারে, ওষুধ ছিটানোর ফলে মিন্টো রোডের
মশা সব আমাদের ভুতের গলির দিকে পালাচ্ছে। বাহ্ এই তো, চমৎকার একটা পরিস্থিতির কথা
ভাবা যাচ্ছে! পানি ঢালার শিফট আরেকটা বাড়াব ঠিক করি, প্রয়োজনে কাল আরো কয়েকটা
ফুলের টব কিনে নিয়ে আসব, কারণ, আমার মশারিতে আজ তৃতীয় যে
ছিদ্রটি দেখছি ওটা নতুন, এবং ওটা
দিয়ে শুধু মশাই নয়, আস্ত
একটি মুরগিই ঢুকে পড়তে পারবে।
0 মন্তব্যসমূহ