কামাল রাহমান
বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সমস্যাটা প্রজন্মান্তরে গড়িয়ে এসেছে ইঁদুরদের ভেতর, বিভিন্ন প্রজন্ম ভিন্ন ভিন্নভাবে সমাধান করেছে এটার। বর্তমান প্রজন্মে এসে আরেকটু গভীর হয় সমস্যাটা। ইঁদুরদের এ প্রজন্মের রাজা একজন অতিপ্রাজ্ঞ, অতিবক্তা, অতিবুদ্ধিমান,,, অতি অপিনিহিতিটা তাঁর সবকিছুর আগেই ব্যবহার করা যায়। এমনকি ইঁদুরবিশ্বের অনেক জ্ঞানীগুণীরা তাঁকে সম্মান করে বেশ কিছু খেতাব ও পদক উপহার দিয়েছে, যদিও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এসবের নিন্দায় মুখর।
বাহ্যিকভাবে মহাপরাক্রমশালী এই ইঁদুররাজা ধ্যান-ধারণার দিক থেকে এখনো এক হাজার বছর পেছনে বাস করে। এমনিতেই রাজ্যটা একটা সমস্যার অরণ্য, তায় আবার রাজত্ব রক্ষার জন্য একটা নতুন ঘণ্টা বানানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। নিজেদের আয়ত্বে যথেষ্ট আকরিক না থাকায় এদিক-সেদিক করে যদিও প্রয়োজন-পরিমান লোহা সংগ্রহ করা গেছে, কিন্তু ঘণ্টা তৈরি নিয়ে একটার পর একটা সমস্যা দেখা দিতে থাকে।
কারিগর থেকে একটা কর্মী ইঁদুর পর্যন্ত সবাই কিছুটা উপরি আদায় করে নিতে চায় বিশাল এই কর্মযজ্ঞ থেকে। শেষ পর্যন্ত ঐ ঘণ্টাটা তৈরি হয়। বিশাল এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজাসাহেব গোত্রের সকল ইঁদুরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পুরোহিত মহাশয়কে ঘণ্টা বাঁধার দায়িত্ব দেন। সেই পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করে এক রাতে ঘণ্টা বাঁধা হয়। ইঁদুরের জন্য রাতের বেড়াল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, আর কিছু দেখা না গেলেও অন্ধকারে ওদের চোখদুটো কখনোই দৃষ্টি এড়ায় না।
বাহ্যিকভাবে মহাপরাক্রমশালী এই ইঁদুররাজা ধ্যান-ধারণার দিক থেকে এখনো এক হাজার বছর পেছনে বাস করে। এমনিতেই রাজ্যটা একটা সমস্যার অরণ্য, তায় আবার রাজত্ব রক্ষার জন্য একটা নতুন ঘণ্টা বানানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। নিজেদের আয়ত্বে যথেষ্ট আকরিক না থাকায় এদিক-সেদিক করে যদিও প্রয়োজন-পরিমান লোহা সংগ্রহ করা গেছে, কিন্তু ঘণ্টা তৈরি নিয়ে একটার পর একটা সমস্যা দেখা দিতে থাকে।
কারিগর থেকে একটা কর্মী ইঁদুর পর্যন্ত সবাই কিছুটা উপরি আদায় করে নিতে চায় বিশাল এই কর্মযজ্ঞ থেকে। শেষ পর্যন্ত ঐ ঘণ্টাটা তৈরি হয়। বিশাল এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজাসাহেব গোত্রের সকল ইঁদুরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পুরোহিত মহাশয়কে ঘণ্টা বাঁধার দায়িত্ব দেন। সেই পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করে এক রাতে ঘণ্টা বাঁধা হয়। ইঁদুরের জন্য রাতের বেড়াল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, আর কিছু দেখা না গেলেও অন্ধকারে ওদের চোখদুটো কখনোই দৃষ্টি এড়ায় না।
কিন্তু একেবারে আচানক এমন এক সমস্যা দেখা দেয় ইঁদুরকূলের ভেতর যে ওদের সব বুদ্ধিজীবী একত্রিত হয়েও কূলকিনারা করতে পারে না। নতুন ঐ ঘণ্টাটা যখন বাজতে শুরু করে তার আগেই এক দুটা ইঁদুর বেড়ালের হাতে মারা যেতে থাকে। ঘণ্টাটার এই দেরিতে বাজার কারণ কোনোভাবেই বের করতে না পেরে এক মহা-সমাবেশ ডাকে রাজাসাহেব।
‘প্রিয় ইঁদুরেরা আমার’ আকুল কণ্ঠে আহ্বান জানায় রাজা, ‘অভাবিত এক জাতীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে আমাদের ভেতর...’
জনতার ভেতর থেকে রব ওঠে, ‘আমরা সবাই রয়েছি আপনার সঙ্গে, বলুন কি করতে হবে রাজাসাহেব।’
‘অনেক কৃতজ্ঞতা আপনাদের কাছে, একটা ফলপ্রসু পরামর্শ করার জন্য একত্রিত হয়েছি আমরা আজ, সমস্যাটা সমাধানের জন্য সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাই।’
তোপধ্বনির মতো গর্জে ওঠে ইঁদুর-জনতা, ‘জয় হোক, আমাদের ইঁদুর রাজার, জয় হোক।’ অসংখ্য চিকচিক ধ্বনি একত্রিত হয়ে পুরোনোদিনের কয়লার ইঞ্জিনের সিটি দেয়ার মতো তীব্র শব্দ-তরঙ্গ সৃষ্টি করে।
‘আমাদের গোত্রের অনেকের জীবনমরণের সঙ্গে জড়িত যে ঘণ্টা তা সফলভাবে তৈরি হয়েছে।’
‘জয় হোক রাজার, জয় হোক আমাদের মহান রাজার।’
হাত তোলেন রাজা, ‘কিন্তু...’
নিস্তব্ধতা নেমে আসে জনতার ভেতর।
‘কিন্তু, আমাদের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে দেখা গেছে যে ঘণ্টাটা একটু দেরিতে বাজে, ততক্ষণে বেড়ালটা দু একটা ইঁদুর নিধন করে ফেলে। আমাদের ইঁদুর জাতির সংখ্যাও এতো বেড়ে গেছে যে এখন আমাদের পেছনে বেড়ালের দৌড়াতে হয় না, পা বাড়ালেই সামনে পড়ে যায় অনেক কটা, যখন তখন।’
ফুঁসে ওঠে জনতা।
‘তাহলে এটা প্রকৌশলীর দোষ, এ রকম একটা অকেজো ঘণ্টা কি করে বানালো সে?’
‘হ্যাঁ, এটা প্রকৌশলীদের দোষ।’ শত শত কণ্ঠ একসঙ্গে গর্জে ওঠে।
‘ওরা জাতচোর।’
‘পড়াশোনার সময়ই ওরা বলে যে পাশ করে ঘুষ খাবে।’
‘শূলে চড়ানো হোক ওদের।’
‘ফাঁসিতে ঝোলানো হোক ওদের।’
‘ন্যাংটো করে রাস্তায় ঘোরানো হোক।’
‘কানে ধরে উঠ-বস করানো হোক।’
‘পাছায় ছ্যাঁকা দেয়া হোক।’
‘মাছুল্টানি দিয়ে।’
‘কি?’
‘খুন্তি দিয়ে।’
এ রকম অনেক কঠিন ও বিচিত্র সাজা দেয়ার প্রস্তাব উঠতে থাকে জনতার মধ্য থেকে। ওদের রায়, অথবা সুপারিশমালা যখন ফুরিয়ে আসতে থাকে আবার হাত তোলে রাজা।
‘দোষটা যে প্রকৌশলীদেরই এটা এখনো জানি না আমরা। এমন একটা ঘণ্টা বানানোই তো আমাদের জন্য এক বিশাল সাফল্য। ঘণ্টাটা তো কাজ করে ঠিকই, কিন্তু...’
আবার চিৎকার করে ওঠে জনতার মধ্যে কেউ কেউ--
‘একটু দেরিতে।’
সায় দেয় রাজা।
‘হ্যাঁ, একটু দেরিতে।’
‘তাহলে আমাদের লাভটা হলো কি?’
‘এই সমস্যাটা সমাধানের জন্যই তো আজকের সমাবেশ। অধৈর্য হলে হবে না আমাদের। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।’
‘ঠিক আছে। বলুন রাজাসাহেব, আমাদের কর্তব্য কি?’
প্রধানমন্ত্রী তখন রাজাকে পরামর্শ দেয় প্রধান প্রকৌশলীকে তলব দেয়ার জন্য।
জনতা সায় দেয় এ প্রস্তাবে। এক ত্যাঁদোর চেঁচিয়ে ওঠে--
‘ডাক শালারে।’
এটা সহ্য হয় না শৃঙ্খলামন্ত্রীর, প্রধান প্রকৌশলী আবার ওর ভায়রাভাই। কষে এক ঘা লাগায় ওর পিঠে, শৃঙ্খলা আরো বিনষ্ট হয় এই অযথা উপদ্রবে, উত্তেজনা দেখা দেয় জনতার ভেতর। শেষ পর্যন্ত আবার রাজার হস্তক্ষেপ করতে হয় জনতাকে শান্ত করার জন্য। ইতোমধ্যে প্রধান প্রকৌশলী এসে হাজির। হাতজোড় করে বলে--
‘রাজাসাহেব, সাধ্যের কোনো কসুর করি নি, আমার জানা মতে কোনো ত্র“টি নেই এটায়। বেড়ালের গলায় ঝোলানোর আগে অনেক অনেকবার পরীক্ষা করা হয়েছে ওটা, প্রতিবারই উতরে গেছে।’
‘তবে?’
‘তাহলে?’
‘অতএব?’
সভা নিশ্চুপ হয়ে যায়। এ সুযোগে প্রধান প্রকৌশলীর তাবেদার ও ভাগের বখরা পাওয়া দলের মানুষেরা একটু একটু করে সোচ্চার হয়।
‘এমন একটা অসাধ্য সাধন করার জন্য বরং প্রধান প্রকৌশলীকে পুরস্কৃত করা হোক।’
‘ওকে পদোন্নতি দেয়া হোক।’
‘ও তো সবার উপরেই আছে, আর কোথায় ওঠানো যাবে ওকে!’
‘তাহলে মন্ত্রী বানানো হোক।’
‘ওকে একটা প্রাসাদ বানিয়ে দেয়া হোক।’
‘অনেক কটা প্রাসাদ আছে ওর।’
‘আরেকটা বিয়ে করানো হোক।
‘হ্যাঁটাম নাই ওর।’
এসব কথার ফাঁকে বিপক্ষের ওরা তেঁতে ওঠে আবার।
‘পোঁদে বাঁশ দেয়া হোক ওর।’
আবার হাতাহাতি লেগে যায়। এবার একটু উষ্মা প্রকাশ করে রাজাসাহেব।
‘আপনারা যদি এ রকম গ্যাঞ্জামই করবেন, তাহলে সমাবেশ স্থগিত করাই ভালো।’
টনক নড়ে সবার। সমস্বরে বলে--
‘ঠিক আছে, বলুন রাজাসাহেব, কি করতে হবে আমাদের।’
‘কিছুই করতে হবে না আপনাদের, ধৈর্য ধরে অন্যের কথা শুনুন, বিবেচনা করুন, সুপরামর্শগুলো নিন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করুন আমাদের।’
একটু নড়েচড়ে বসে এক উপমন্ত্রী।
‘এই ঘণ্টাটার ত্র“টি সারানোর ক্ষমতা যদি আমাদের না থাকে তাহলে আরেকটা...’
ওর কথা শেষ করতে দেয় না জনতা।
‘একটা বানাতে যেয়েই আমাদের হোগার চামড়া নাই, আবার আরেকটা।’
‘ভালোভাষা, ভালোভাষা।’ চেঁচিয়ে ওঠে শৃঙ্খলামন্ত্রী।
আরো জোড়ে চেঁচায় জনতা।
‘হ্যাঁ, ভালোবাসা, ভালোবাসা। তুমি তো আবার বিশ্বপ্রেমিক। তোমার থানায় কখনো কোনো নারী ইঁদুর যেতে পারে না অভিযোগ জানানোর জন্য, সবার ভালোবাসায় পড়ে যাও তুমি। চুপ করো আহাম্মক।’
আবার হাত ওঠাতে হয় রাজার। প্রধানমন্ত্রী বলে, ‘বরং এটা সারানোর চেষ্টা করবো আমরা।’
বিদেশমন্ত্রী বলে--
‘রাজাসাহেব সম্মতি দিলে প্রতিবেশী গোত্রদের মধ্যে ঘুরে দেখতে পারি ওরা ঠিক করে দিতে পারে কি না।’
এখানেও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় আমজনতা।
‘না, আমাদের কোনো সৎ প্রতিবেশী নেই।’
‘ওরা সব সময় প্রস্তুত থাকে আমাদের উল্টো করে ঠাপাতে।’
‘আমাদের কিছু উপকারও করেছিল ওরা।’
‘ওসব ওদের স্বার্থে।’
‘আমরা বরং আরো দূরের প্রতিবেশী খোঁজ করি।’
‘মুস্কিল হচ্ছে আমাদের বন্ধুরা সব দূরে দূরে।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী বলে--
‘আমরা তো বিনে পয়সায় প্রতিবেশীকে ডাকবো না।’
প্রতিবাদ করে ওঠে অর্থমন্ত্রী--
‘আমার হাতে কোনো অর্থ নেই।’
‘ওটা কখনোই আপনার হাতে থাকে না। জাহাজ ভরে যখন এখানে সেখানে যান তখন ভিক্ষে করে যোগাড় করেন ওটা।’
প্রধানমন্ত্রী বলে--
‘আমাদের বড় প্রতিবেশীদের ডেকে দেখা যেতে পারে। ওরা হয়তো বাকিতে কাজ করে দিতে পারে।’
‘হ্যাঁ, ওদের আবার পয়সার লালোচটা একটু বেশি।’
এসব বাকবিতণ্ডার পর সিদ্ধান্ত হয় যে প্রতিবেশীদের পরামর্শ নেয়া হবে। খুব শীঘ্র প্রতিবেশী বিশেষজ্ঞ দল এসে হাজির হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ঘি-গু-চিনি খেয়ে, সাড়ে বারো হাজার পৃষ্ঠার একটা প্রতিবেদন দিয়ে বিশাল অঙ্কের দক্ষিণা নিয়ে বিদেয় হয়। ঐ প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য দেড় লাইন: ঘণ্টাতে ব্যবহৃত ধাতু অতিমাত্রায় সম্প্রসারণশীল, বেড়ালটা ঘুমানোর সময় শরীরের উষ্ণতায় ওটা বড় হয়ে যায়, ফলে হাতুরিটা ওটার শরীর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
এটার সমাধান বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছুই বলা হয় নি। পরে জানা যায়, এটা ওদের দোষ নয়, আমরা শুধু কারণটাই জানতে চেয়েছিলাম। যাহোক, সমস্যাটা যখন ধরা গেছে সমাধান একটা হবেই। আবার অধিবেশন আহ্বান করে রাজাসাহেব। প্রকৌশলীর কোনো দোষ ধরতে না পারায় এবার বুক ফুলিয়ে হাঁটে সে। তাঁবেদাররা ওকে পুরস্কৃত করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। ঘণ্টাটা কাজ করে কিনা ওটা বড় কথা না, ঘণ্টাটা বানানো গেছে তো!
বিজ্ঞ রাজা সবার আগে জিজ্ঞেস করে প্রধান প্রকৌশলীকে--
‘ত্র“টি যখন ধরা গেছে এটা সারাতে পারবেন তো?’
ভাবনার মেঘ দেখা দেয় ওর কপালে। উপ-প্রকৌশলী বলে--
‘ঘণ্টাটার হাতুরিটা বদলে বড় করে বানিয়ে দেয়া যেতে পারে।’
প্রতিবাদ করে প্রধান প্রকৌশলী--
‘না, ওটা প্রকৌশল বিদ্যেয় নেই। সব কিছুই নিয়ম মেনে করতে হয় আমাদের। যেটা বরং করা যায়, অন্য ধাতু দিয়ে আরেকটা ঘণ্টা তৈরি করা।’
‘এটার কি হবে?’
‘এটা গলিয়ে অস্ত্র-সস্ত্র তৈরি করা যেতে পারে।’
‘নৌকো বা জাহাজ।’
‘তা-ও হতে পারে।’
‘আরেকটা নতুন ঘণ্টা যদি বানাতেই হয়, সেক্ষেত্রে অন্য কি ধাতু ব্যবহার করা হবে?’
প্রধানমন্ত্রী বলে--
‘অনেক মানুষকে দেখেছি গহনা পরতে, হাতে ও আঙ্গুলে, ওগুলো নাকি সোনার, সারাক্ষণ শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে, বেড়ে যায় না কখনো।’
‘হ্যাঁ, সোনার ঘণ্টা বানানো যেতে পারে।’
ফুঁসে ওঠে অর্থমন্ত্রী--
‘যেখানে আরেকটা ঘণ্টা বানানোর টাকাই হাতে নেই আমার, আবার সোনার ঘণ্টা, রাজাসাহেব, অনুমতি দিন তো আমি অধিবেশন ত্যাগ করি।’
পিঠে হাত দিয়ে বসিয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রী--
‘আরে ভাই, এতো সহজে খেপে উঠলে হবে কেমন করে, কোনো সিদ্ধান্তই তো হয় নি এখনো।’
‘জ্বী, বুঝতেন আপনি, যদি টাকার যোগানটা দিতে হতো আপনাকে।’
‘কেন, আপনি তো একসময় ঐ দলেই ছিলেন, যে দলের প্রধান সব সময় বলতো মানি ইজ নো প্রোবে¬¬ম!’
তেড়ে ওঠে অর্থমন্ত্রী--
‘খোঁচা দিয়ে কথা বলা আপনার স্বভাব, এই দল ঐ দল করছেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে পার্থক্যটা কি এই দু দলের! আমি অর্থমন্ত্রী, সবকিছু অর্থ দিয়ে বিচার করি আমি। রাজাসাহেব, এখানে আর থাকতে চাই না আমি, আমাকে অব্যাহতি দিন, নইলে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।’
‘খামোকা খ্যাঁচখ্যাঁচ করবেন না তো, পদত্যাগের নজির আমাদের নেই। আমাদের রাজাদেরই আসন থেকে সরাতে হয় একেবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে, আর আপনি তো এক পুঁচকে মন্ত্রী। আপনাদের সময় এক প্রাক্তন রাজাকে রাস্তায় জুতো-পেটা করা হয় নি? কই, তিনি তো আবার রাজাসনের জন্য লালা ঝরাচ্ছেন। দয়া করে ওসব বাখোয়াজ করবেন না এখানে।’
হিস্টিরিয়া রোগির মতো কাঁপতে থাকে অর্থমন্ত্রী। বিষয়টা থিতিয়ে দেয়ার জন্য মুখ খোলে বিদেশমন্ত্রী, ওর জন্মের পর পায়ের তলায় ভগবান নাকি নিজ হাতে আদি ও খাঁটি শর্ষের তেল মাখিয়ে দিয়েছিলেন।
‘আমি কি দূরের কোনো প্রতিবেশীদের একটু খোঁজ-খবর নেবো?’
প্রস্তাবটা মনে হয় মনোপুত হয় রাজার। এ সুযোগে হয়তো আরো দু একটা মানপত্র যোগাড় করা যেতে পারে নিজের জন্য।
‘চিঠি পাঠিয়ে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না?’
‘এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনাসামনি আলোচনা করতে হয় রাজাসাহেব।’
‘যাও তাহলে।’
সেদিনের মতো অধিবেশন মুলতবী করা হয়।
এর মধ্যে বেশ কিছু দুর্যোগ এসে হানা দেয় ইঁদুর রাজ্যে। ফসল ভালো না হওয়ায় খাদ্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবে, ইঁদুরে ইঁদুরে হানাহানি বেড়ে গেছে। গুমখুন থেকে শুরু করে প্রকাশ্য খুন, নেশা ভাং, রাহাজানি, সব যেনো একবারে এসে ভর করেছে। অবশ্য এ সবই একই সুতোয় গাঁথা, এই ডামাডোলের ভেতর ইঁদুরের সংখ্যা এতো বেড়ে গেছে যে কোথাও চলাফেরা করাই মুস্কিল হয়ে পড়ে। আগে তো তবু প¬্যাগ-ফ্ল্যাগ জাতীয় মারীটারী ছিল, মরেবেঁচে সংখ্যাটা খুব বেড়ে যেতো না, ওসব না থাকায় সংখ্যায় শুধু বেড়েই চলেছে ওরা।
বিদেশমন্ত্রীর কূটচালের সাফল্য হিসেবে অনেক দূরদেশ থেকে সাদা ইঁদুরের একটা দল এসে উপস্থিত হয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন ডাকা হয়। আমজনতাকে ডাকা হয় না এবার, শুধু গণ্যমান্য ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে নিয়ে বসে অধিবেশন। উপস্থিত অনেকে এই প্রথম সাদা ইঁদুর দেখেছে, ওদের বিস্ময় ও আগ্রহটাও অনেক বেশি। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরো অনেক খুঁচরো বিষয়ে এলোমেলো কথাবার্তা হয়। শেষ পর্যন্ত ঘণ্টার কথা উঠলে ওদের একজন বলে--
‘দেখুন, আমরা খুব সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব দেই, এবং আমাদের প্রস্তাবে বিকল্পও কিছু থাকে, যেন আপনারা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
‘খুব ভালো কথা, খুব ভালো।’
‘হ্যাঁ, আপনাদের বানানো ঐ ঘণ্টাটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। নতুন একটা ঘণ্টা বানিয়ে দেবো আমরা।’
‘কত দামে?’
‘ওটা বলেছি আপনাদের বিদেশমন্ত্রীর কাছে।’
‘ঐ দামে এটা কেনার ক্ষমতা আমাদের নেই।’
‘আমরা তো ঋণ দিচ্ছি আপনাদের।’
‘ওটা তো জীবনেও শোধ করতে পারবো না।’
‘আমরাও তা চাই না।’
‘আমাদের সাত পুরুষ, চৌদ্দ পুরুষেও পারবে না।’
‘দরকার কি? ঋণের সামান্য সুদটা দিয়ে গেলেই হলো।’
‘সামান্য?’
‘আপনাদের কাছে হয়তো বেশি মনে হতে পারে, দুঃখিত।’
‘মনে হয় না এমন একটা চুক্তিতে যেতে পারি আমরা।’
‘তাহলে বেড়ালের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
বেড়ালের কথা মনে করিয়ে দেয়ায় সবার গায়ে কাঁটা দেয় আবার। গুঞ্জন ওঠে সভার মধ্যে। রাজাসাহেব ও বিদেশমন্ত্রী ঐ সাদা ইঁদুরদের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে। সভার ভেতর গুঞ্জন বেড়ে যেতে থাকে। এক সাদা ইঁদুর গলাখাকারি দিয়ে বলে--
‘আমাদের মহান গোত্রের পক্ষ থেকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে একটা উপহার দিতে চাই আপনাদের। প্রস্তাবিত চুক্তিতে যদিও ঘণ্টাটা বেড়ালের গলায় বেঁধে দেয়ার কোনো শর্ত নেই, আমরা বিনি পয়সায় ওটা করে দেবো।’
একটা মহৎ প্রস্তাব হিসেবে এটাকে সাধুবাদ জানায় অনেকে, কারণ ওটাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাণসংহারী কাজ। চাটুকার ঐ দলের বিষয়টা আগেই ঠিক করে রেখেছিল সাদা ইঁদুরেরা। কিন্তু সব সময়ই কিছু বিরুদ্ধবাদী থাকে যাদের সংশয় সবকিছুতে। ওরা বলে--
‘বিকল্পের কথা কি যেনো বলেছিলেন।’
‘হ্যাঁ, বিকল্প আছে আপাতত দুটো। প্রথমটা হচ্ছে, কোনো ঘণ্টাই লাগবে না। আমাদের একটা ছোট্ট দলকে থাকার ব্যবস্থা করে দিন আপনাদের এখানে, ওরাই সব সামলাবে, বেড়াল কেন একটা বাঘও আপনাদের সীমানায় ঘেঁষতে পারবে না।’
ধূসর ইঁদুরদের অনেকেই আঁতকে ওঠে। এই সাদা ইঁদুরেরা এখন যেখানে আছে ওটা ছিল লাল ইঁদুরদের দেশ। মেরে-কেটে ওদের শেষ করে এখন ওরা ওখানের হর্তাকর্তা। কোনো পরামর্শ না করেই এ প্রস্তাবটা বাতিল করে দেয় ওরা।
‘দ্বিতীয়টা বলুন।’
‘আপনাদের কাছাকাছি কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিন আমাদের। নিজেদের ঘরবাড়িতেই থাকবো আমরা, আমাদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে না, আমাদের উপস্থিতিতেই কোনো বেড়াল আপনাদের ধারে কাছে ঘেঁষতে সাহস পাবে না।’
‘বলেন কি! বেড়ালেরা ভয় পায় আপনাদের?’
‘আগে পেতো না। আপনাদের মতোই নিরীহ ছিলাম আমরা।’
‘আকর্ষণীয় তো! বলুন দেখি কীভাবে এই অসাধ্যটা সাধন করেছেন?’
‘ইতিহাসটা একটু বড়, ধৈর্য থাকবে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।’
‘বেড়ালের অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে আমাদের মধ্যেও বিদ্রোহী মনোভাব দেখা দেয়। একটা প্রজন্মে এটা চরম রূপ নেয়, তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, হয় বীরের মতো বেঁচে থাকা, নয়তো জীবন বিসর্জণ, এভাবে বেড়ালের হাতে মরে লাভ কি? তখন ঠিক করা হয় আর পালিয়ে যাওয়া নয়, একযোগে আক্রমণ করে বেড়ালটাকে মেরে ফেলা হবে। এ প্রচেষ্টায় আমাদের অনেকে আত্মাহুতি দেয়, শেষ পর্যন্ত কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়, টার্গেট ঠিক করা হয়। আঁচড়ে কামড়ে একটা বেড়াল মেরে ফেলা ইঁদুরের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমে অন্ধ করে ফেলতে হবে ওটাকে, তারপর একটু একটু করে আক্রমণ করে শেষ করে ফেলতে হবে। প্রথম প্রচেষ্টায় অনেকের জীবনের বিনিময়ে একটা চোখ নষ্ট করে ফেলা সম্ভব হয়, এরপর দ্বিতীয়টা, ওতেও বেড়ালের অত্যাচার পুরোপুরি না কমায় ও যখন ঘুমিয়ে থাকে ওর দু পায়ের ফাঁকে স্পর্শকাতর জায়গায় কামড়ে কাবু বানিয়ে ফেলা হয়, জানেনই তো আমাদের দাঁতে বিষও থাকে। ধীরে ধীরে ওটা মারা যায়। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতে দ্বিতীয় আরেকটা বেড়ালের উপদ্রব দেখা দেয়। কিন্তু একবার যখন জেগে ওঠেছে গোত্রটা তখন আর ঠেকায় কে, একের পর এক, এভাবে অনেক কটা বেড়াল মেরে ফেলার পর এখন ওরাই আমাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়।’
‘বাহ্, সুন্দর একটা উদাহরণ তো! আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসছে।’
বিরুদ্ধবাদীদের একজন চিৎকার করে ওঠে--
‘হ্যাঁ, তা তো হবেই তোমার, ওদের দালালী তো অনেক আগেই জুটিয়েছো।’
আবার ঝগড়া লেগে যায়। সবাইকে শান্ত হতে বলে প্রধানমন্ত্রী। সাদা দলকে জিজ্ঞেস করে--
‘আর কোনো বিকল্প আছে আপনাদের প্রস্তাবে?’
‘আপাতত নেই, তবে আপনাদের মধ্যে কে যেনো ডুবে মরাটরার কথা কি বলছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ওটা তো আছেই। নতুন কিছু না। তবে এখন আপনারা গে¬াবাল ওয়ার্মিং না কি যেনো বলেন, ওটার প্রভাবে আমরা তো মরতেই বসেছি। ছোটোখাটো নর্দমাগুলো আগে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে পারতাম আমরা, একটু বড় হলে সাঁতরেও পার হয়ে যেতে পারতাম। কোনো কোনোটা আবার ভেলাটেলায় ভেসে পেরিয়ে যেতাম। আমাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় খাবার-দাবার যোগাড় করতে, অথবা জীবন ধারণের অন্যান্য কাজে অনেক বড় নর্দমাও পেরোনোর দরকার হয় মাঝে মাঝে, এ রকম একটা নর্দমায় একটা সেতু বানাতে পারলে খুব ভালো হতো আমাদের।’
‘হ্যাঁ, ও বিষয়েই কে যেনো কথা বলছিল। তা নর্দমাটা কত বড় আপনাদের?’
‘কত বড় তো আন্দাজ করতে পারবো না, তা বড় তো হবেই, কারণ ওপাড়টা আমাদের চোখে ধরা দেয় না।’
‘যাহোক, ওসব কোনো বিষয়ই না, আপনাদের নর্দমা আর কতই বা বড় হবে। ঠিক আছে, আমাদের দ্বিতীয় প্রস্তাবটা নিলে সেতুটা না হয় উপহার হিসেবে গড়ে দেবো আমরা।’
অধিবেশনের অনেকে চিৎকার করে ওঠে, ‘না, কোনোভাবেই ওটা মেনে নেবো না আমরা, সেতু চাই না আমাদের, দরকার হলে নিজেরাই বানিয়ে নেবো ওটা।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে তৃতীয়টা?’
বিরুদ্ধবাদীদের চিৎকারটা যেনো একটু ছোটো হয়ে এসেছে এবার। কিন্তু কেউ কেউ তখনো মারমুখী। যোগাযোগমন্ত্রী বলে--
‘শুরুতেই না বলে না দিয়ে ভেবে দেখতে ক্ষতি কি?’
সভার অনেকে গালাগাল দেয়া শুরু করলে দু ভাগ হয়ে যায় উপস্থিত ভদ্রজনেরা, বিতণ্ডা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেলে প্রাজ্ঞ রাজাসাহেব অধিবেশন আবার মুলতবী ঘোষণা করে। পরের হপ্তায়ই আবার জরুরী অধিবেশন ডাকে রাজাসাহেব। এ বিষয়ে যত শীঘ্র সম্ভব একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। চুলচেরা বিশে¬ষণ করে শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তের কাছাকাছি পৌঁছা যায় যে বিকল্প প্রস্তাব দুটো না নিয়ে বরং মূল প্রস্তাবটা নেয়া যেতে পারে যদি ফাও হিসেবে সেতুটা বানিয়ে দেয় ওরা। বিদেশমন্ত্রী আবার করিৎকর্মা হয়ে ওঠে। কিছুদিন পর চূড়ান্ত কথা বলার জন্য ওরা এসে উপস্থিত হলে বড় ধরনের আরেকটা জমায়েতের ব্যবস্থা করে রাজাসাহেব। এবারের সাদা দলটা একটু কাঠখোট্টা ধরনের, কথাও বলে চাঁছাছোলা।
‘দেখুন আপনাদের প্রস্তাবটাই মেনে নিয়েছি আমরা, আমাদের দিকটাও দেখবেন আপনারা, বোঝেনই তো বাধ্য হয়েই মোড়লগিরিটা করতে হচ্ছে, আর এ জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-টাওয়ার দরকার হয় আমাদের। এই যেমন আপনারা ডেকেছেন, উড়ে এসেছি।’
‘সেই তো, কীভাবে এলেন, আমাদের দশ বছরের পথ দু ঘণ্টায় পৌঁছে যান কেমন করে!’
‘সবই হচ্ছে গতি।’
‘গতি?’
‘হ্যাঁ, গতিই শক্তি, স্থবিরতা হচ্ছে দুর্বলতার অপর নাম। এই দেখুন না কেন, বেড়ালের গতি, যে গতিতে ওরা দৌড়ে ধরে ফেলে আপনাদের, তার চেয়ে বেশি গতি যদি অর্জন করতে পারতেন, তাহলে ওরা কি ধরতে পারতো আপনাদের?’
‘তাই তো!’
‘শুধু গতিই না, আরো আছে, কৌশল।’
‘কৌশল?’
‘হ্যাঁ, এই যে ঘণ্টাটা বানিয়েছে আপনাদের প্রকৌশলীরা, এটাও তো একটা কৌশল।’
নড়েচড়ে বসে প্রধান প্রকৌশলী। জনতার অনেকে আবেগমথিত হয়ে ওঠে--
‘আমাদের প্রধান প্রকৌশলীকে পুরস্কৃত করা হোক।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি সাদাদের দেশে সাইকেল আছে, একটা সাইকেল কিনে উপহার দেয়া হোক ওকে, যেনো আরো গতি পায় সে।’
‘এক জোড়া চশমা কিনে দেয়া হোক, যেনো আরো দূরে দেখতে পারে ও আরো কৌশলী হয়ে উঠতে পারে।’
‘আসুন সবাই মিলে ওর জন্য প্রার্থনা করি।’
‘এই, প্রার্থনা করি ক্যান্, ও কি মারা গেছে?’
আবার শুরু হয়ে ধুন্ধুমার। হাত তোলে রাজাসাহেব। ‘আমাদের অতিথিদের কথা শেষ করতে দিন।’
অতিথি বলা শুরু করে--
‘না, সাইকেল চালানোর মতো জায়গা আপনাদের এখানে নেই, ওটার গতি সামলাতে পারবেন না আপনারা, তা ছাড়া বেড়াল যখন তাড়া করবে ওটা নিয়ে আপনাদের লুকোনোর জায়গাগুলোয় ঢুকতে পারবেন না। আপনাদের প্রকৌশলীদের সম্মান রক্ষা করার ব্যবস্থা করবো আমরা। আর চশমা চোখে দিলে আপনাদের মাথা ঘুরবে। তবে আপনাদের কে যেনো প্রার্থনা করার কথা বললেন, ওটা খুব মনে ধরেছে আমাদের। একসময় ঐ আফিং খাইয়ে অনেক যুদ্ধটুদ্ধ করানো হয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েও। ওটার জন্য আমাদের অনেকে প্রাণ দিয়েছে। এখন আমরা বুঝতে পারি ওটা কি। তবে আপনাদের জন্য ওটা ভালো। বরং ওটা খেয়ে শান্ত থাকুন, আপনাদের জন্য সবকিছু আমরাই করে দেবো। শুধু আমাদের দিকটা একটু মনে রাখবেন। বোঝেনই তো দায়িত্বের কতো হ্যাঁপা, কতো ঝুট-ঝামেলা। শত্রুরও তো শেষ নেই আমাদের। তাই আপনাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বটা যেনো দৃঢ় থাকে, সেটা দেখবেন বিশেষভাবে। আমাদের শত্র“দের মুখে ছাই দেয়ার জন্য কোথাও একটু দাঁড়ানো-টাড়ানোর জায়গা দরকার হলে মনে রাখবেন আমাদের, এই এতটুকুই। আপনাদের প্রয়োজনে যখনই ডাকবেন হাজির থাকবো আমরা।’
‘শুনেছি আপনাদের প্রয়োজনে অন্যদের ডাকার পরোয়া করেন না আপনারা, নিজেরাই যেয়ে হাজির হন।’
‘ওরকম একটা রটনা অবশ্য আছে, বুঝেনই তো মোড়লগিরির কত সমস্যা।’
আর এক ত্যাঁদোড় চেঁচিয়ে ওঠে আবার--
‘না, আমাদের মাটিতে অন্য কাউকে চাই না আমরা, এমনিতেই পা ফেলার যোগাড় নেই।’
‘জান দেবো তবু মাটি দেবো না।’
‘বিদেশী শক্তি’
‘রুখে দাঁড়াও’
ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় জনতা, শে¬াগান দিতে থাকে, এভাবে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে অতিথিদের সরিয়ে নেয় রাজাসাহেব। সভা কিছুটা শান্ত হলে বিচক্ষণ রাজাসাহেব জনতাকে জিজ্ঞেস করে--
‘বলুন দেখি আসলে কি চান আপনারা?’
প্রত্যেকটা অধিবেশনের শুরু থেকে মন দিয়ে শুধুই শুনছিল এক শ্রোতা, কোনো কিছুতেই অংশ গ্রহণ করে নি এ পর্যন্ত। সুযোগ পেয়ে বলে--
‘অনুমতি দিন তো সামান্য একটা প্রস্তাব রাখতে পারি রাজাসাহেব।’
‘কি ওটা?’
‘এতো কিছুতে না যেয়ে হাড় দিয়ে একটা ঘণ্টা বানানোর চেষ্টা করতে পারি আমরা।’
‘হাড় দিয়ে?’
‘হ্যাঁ, দেখুন শরীরের ভেতর থাকে হাড়, উষ্ণতায় এটা বাড়েও না, কমেও না।’
‘চমৎকার ধারণা, অভিনবত্ব আছে।’
‘কিন্তু এতো হাড় পাবো কোথায়?’
‘একটা বেড়াল বধ করি আমরা, তারপর ওটার হাড় দিয়েই ঘণ্টা বানানো যেতে পারে।’
‘কিন্তু বেড়ালটা মারবে কে?’
‘আমরা সবাই মিলে।’
‘এটা যে আমাদের পক্ষে সম্ভব না, আগেই প্রমাণ করে রেখেছি।’
‘আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যাক না। আমরা যদি এককাট্টা থাকি তাহলে অবশ্যই সম্ভব।’
‘ওটাই তো হয় না, কারণ আমাদের ভেতর একটা জাজির গোষ্ঠিও আছে যে!’
সবাই চুপ করে থাকে। হতাশ হয়ে বসে পড়ে সে। বিড়বিড়িয়ে বলে--
‘তাহলে আমাদের হাড় দিয়েই বানানো হোক ঘণ্টাটা।’
‘এতো হাড় কোথায় আমাদের শরীরে?’
ফোঁড়ন কেটে বলে একজন--
‘একটা দাঙ্গা লাগিয়ে দেন না।’
আরেকজন বলে--
‘আরো ভালো হয় একটা জঙ্গি দল উসকে দিলে। তলোয়ার দিয়ে মৃতের পাহাড় গড়ে তুলবে দু দিনে। ওসব হাড় দিয়ে একটা কেন, দশটা ঘণ্টা বানানো যাবে।’
বিষয়টা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে আবার অধিবেশন মুলতবী ঘোষণা করেন রাজাসাহেব।*
লেখক পরিচিতি
কামাল রাহমান
আট দশকের গোড়া থেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। তার ক্ষেত্র মূলত কথাশিল্প। কবিতা অনুবাদও করছেন। ছোটকাগজ সম্পাদনার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বাস্তবকে একেবারে কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চান। তার লেখায় রাজ্যনীতি, রাজনীতি, সমকালীন বাস্তবতা উঠে আসে। তার দুটি গল্পগ্রন্থ আর তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
উপন্যাস :
১. তাজতন্দুরি, বইমেলা ২০১১, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা;
২. ঝুমপাহাড়, বইমেলা ২০১২, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা
৩. অন্য আলো, বইমেলা ২০১৩, প্রকৃতি প্রকাশনী, ঢাকা
গল্পগ্রন্থ :
১. শীতের আপেল ও কমলা, বইমেলা ২০১২, ধ্র“বপদ প্রকাশনী, ঢাকা
২. স্টোনহেঞ্জ, বইমেলা ২০১৩, ধ্র“বপদ প্রকাশনী, ঢাকা
সম্পাদক : ১৪০০
সম্পাদক (২টি সংখ্যার) : কালধারা
0 মন্তব্যসমূহ