তুহিন দাস
লেখক পরিচিতি
তুহিন দাস
জন্ম : ১১ জানুয়ারী ১৯৮৩। বরিশাল।
কবি।
গল্পকার।
লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক।
আমার নাম পুজা। পুজা সন্ধ্যাতারা মিত্র। আমার বাবা ছিলো বাঁশিওয়ালা। তার
সুরে-সুরে সন্ধ্যাবেলায় কেমন একটা বিষণ্ন আলো ফুটে উঠতো আমাদের বাড়ির উঠোনে। আমি
ঠিক দেখতাম একটা নীল আলো কোথা থেকে এসে হু-হু বাতাসের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে। তখন
জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই আলোর উৎসরেখার খোঁজে। এসব কোনো কল্পনা নয়। এ
রকমটি ঠিক ঘটতো। আরেকটি ঘটনা বাবা প্রায়ই বলতো, বাবা নাকি স্বপ্নে প্রায়ই দেখতো একটি
কালো ঘোড়া উড়ে যাচ্ছে। আমার জীবন শুরু হয়েছিলো এ রকম দু’টি অদ্ভুত ঘটনার মধ্য
দিয়ে, বাবার বাঁশির সুরে
আমাদের বাড়িটিকে নীল আলো ঘিরে ধরা আর ওই কালো ঘোড়ার উড়ে যাওয়া।
বাবাকে হঠাৎ-হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যেতো না। দশ-বারো দিনের জন্যে বাঁশি
বাজাতে-বাজাতে হারিয়ে যেতো। সঙ্গে থাকতো কালো একটা ঝুলি, যার মধ্যে থাকা
বাঁশিগুলো বিক্রি করতো গ্রামে-গঞ্জে-হাটে, রাত কাটানোর জায়গাটুকু ঠিক জুটিয়ে নিতো
কোথাও বাঁশি শোনাতে-শোনাতে আর শোনাতো সেই নীল আলো আর কালো ঘোড়ার কথা। আমি জানতাম, বাবার ঝুলিতে আরো কিছু
গল্প ছিলো মৃত্যু নিয়ে, নদী নিয়ে, আমাদের উঠোনের অসুখী
পেঁপেগাছ আর এক পরীর গল্প। সেইসব গল্প বাবা কখনোই আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলতে চাইতো
না।
মা কখনো এসবের ধারে-কাছে ঘেঁষতো না। বলতো : ‘এ তোমাদের ব্যাপার। সারাক্ষণ শুধু বাঁশি, নীল আলো আর ঘোড়ার
গল্প। মানুষ নিয়ে তো কিছু হয় নাকি!’ আমি হাসতাম, আমার বেশ ভালো লাগতো এসব গল্প, বাবা বাড়ি ফিরলে
জড়িয়ে ধরে বলতাম,এবার নতুন কি ঘটেছে
বলো। বাবা মৃদু হাসতো। জানতো, আমি অপেক্ষা করে আছি তার গল্পের জন্যে। বাবা অনেকদিন পর
ফিরে আসতো শেষ বিকেলের দিকে। বাবা সব সময়ই ফিরতো শেষ বিকেলে, যখন সন্ধ্যা হয়-হয়, ফিরেই তার প্রিয়
বাঁশিটি ঝুলি থেকে বের করে বাজাতে শুরু করতো। অমনি নীল আলো জুড়ে বসতো একদম শহর
শেষের আমাদের চৌচালা টিনের বাড়িটির উঠোন জুড়ে। আর আমি জানালা খুলে আকাশের দিকে
তাকিয়ে দেখতাম বাবার বলা সেই পরীটি ফিরে আসছে কিনা! সেই পরী আর আসতো না। যখন বাবা
থাকতো না, আমার একা লাগতো। আমি
বাঁশি বাজাতে পারতাম। কিন্তু চাইতাম এ বাড়িতে বাঁশি শুধু বাবা-ই বাজাক। মা খেপে
উঠতো আমাকে বাঁশি বাজাতে দেখলে। মায়ের ভয় লাগতো, আমারও না বাবার মতো মাথা খারাপ হয়ে যায়!
আমি নিয়মিত ডায়েরী লিখতে শুরু করলাম। আমার প্রতিদিনকার ঘটনা, অনুভূতি, বাবার গল্প, বাবাকে ঘিরে গল্প,মায়ের জেদ, উঠোনভরতি নীল আলো আর
চাঁদনীপসর রাতের পরীদের কথা। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলো বাবা কিন্তু জানতো না আমার
ডায়েরীগুলোর কথা, মা জানতো।
বাবার প্রায়ই জ্বর হতো। প্রলাপ বকতো। কিন্তু বাবা যে ঘোরের মধ্যে ওইসব কথা
বলতো তা নয়, বাবা জ্বরের সময় একদম
চুপ হয়ে যেতো। বাবা বলতো, বাঁশি না বাজালে আমার
জ্বর হয়। আমি তখন বাবার কাছে ঘুমোতাম আর ভাবতাম : বাবার জ্বর হতে পারবে না - এটা ঠিক নয়; জ্বর আমার হোক।
এক-একবার জ্বর থেকে সেরে উঠেই বাবা আমাকে নতুন গল্প শোনাতো। যেদিন খুব ভোরবেলায়
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তো বাবা আমায় আলতো করে ডাকতো : ‘সন্ধ্যাতারা শোন্।’ আমি বুঝতাম বাবার জ্বর আর নেই। বাবা সেদিন
কোথাও বের হতো না। ঠিক সন্ধ্যার আগে তার হারাধন বাঁশিটি নিয়ে উঠোনের পাশে জামরুল
গাছের নিচে বসতো, তুলতো নতুন কোনো সুর আর
নীল আলোরা এসে খেলা করতো। চাঁদ আকাশে না ওঠা পর্যন্ত বাবা ওভাবে বসেই থাকতো। আমি
সেই হালকা কুয়াশার মধ্যে নেমে যেতাম, আমার পা দেখা যেতো না। উঠোনে নীল আলো কমে
আসতো। মাদুর বিছিয়ে বাবার হাত ধরে এনে বসাতাম।
পাশে আমি। মা জানালার কাছে বসতো। বাবা শুরু করতো গল্প। পাশেই থাকতো তার বাঁশি, যার নাম ছিলো হারাধন।
বাবা প্রতিটি বাঁশিরই নাম দিয়েছিলো এভাবে। বাবা যেদিন মারা গেলো সেদিন তার হারাধন
বাঁশিটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো, আমরা অনেক খুঁজেও বাঁশিটি পাইনি আর সারাদিন ধরে বৃষ্টি
হচ্ছিলো। তার মধ্যেও বাবার বাজানো সুরগুলো যেন সেদিন এক এক করে আমাদের বাড়ির দিকে
ফিরে আসছিলো।
আমার মা অসাধারণ কেউ ছিলো না। বাবা একটা গল্প বলেছিলো : এক লোক
বেশ্যাপাড়ার এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলো,তাকে নতুন নাম দিয়েছিলো, নতুন পরিচয় দিয়ে অনেক
দূরের বেশ্যালয় থেকে নিয়ে এসেছিলো। এক অমাবস্যার রাতে সে বধূ গায়ে আগুন লাগিয়ে
মারা যায়। কেন তা স্বামীটি জানে না। আমি পরে জেনেছি : ওই নারীটি আমার মা, যাকে বাবা বিয়ে
করেছিলো। অথচ আমার মা কিন্তু মারা যায়নি। তবুও বাবা অমন একটা গল্প বলতো, আমার কাছে অদ্ভুত লাগতো
না যদিও। মা খুব সুন্দর গান গাইতো। ছোটবেলায় অনেক শুনেছি। আমি একটু বড় হবার পর
মা আর গান গায় না। কেন তা আমি জানি না। এমন নয় যে মা বাবাকে যৌবনের শেষ দিকে
বিয়ে করেছিলো। তারা একে অপরকে ভালোবেসেছিলো। মা ভালোবেসেছিলো বাবার বাঁশি, নীল আলো আর অনাগত
দেবদূতদের কথা - যারা নাকি আসবে। বাবার
মধ্যে যে মন্ত্রমুগ্ধতা-ইন্দ্রজাল ছিলো তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না এই
চেতনা-অচেতনার পৃথিবীতে।
মা ভালোবাসতো গাছ। নানা রকমের গাছ আমাদের বাড়িতে ছিলো। শিউলীগাছের সঙ্গে
মা কথা বলতো। সবাই বলতো পরিবারটাই যেন কেমন! বাবা বাঁশিওয়ালা, মা গাছের সঙ্গে কথা বলে, মেয়ে সেসব কথা লিখে
রাখে দিনভর। সেসব নাকি একদিন আমার ডায়েরী থেকে-আমার খাতা থেকে বেরিয়ে আসবে - এমন নাকি আমি বলতাম!
আসলে কয়েকটা মাত্র গল্পের সঙ্গে এ কথাও রটেছিলো, আমি এমন কখনোই বলিনি। আর তারা কয়টিই বা
গল্প শুনেছে!
আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলো আমার পুতুল খেলার সাথীরা এই খেলনাপৃথিবী
ছেড়ে। ফুরিয়ে এলো আমার মেয়েবেলা, বইল রক্তেভরা একটি ব্যক্তিগত নদী।
দুপুরবেলায় মৌটুসী পাখিরা ডাকতে শুরু করলো। আমার ব্যক্তিগত জানালার দিকে উড়ে আসা
হাওয়ার কাছে পাঠাতে শুরু করলাম আমার মনের খবর আর সন্ধ্যায় কোথাও আনমনে জ্বলে
উঠতো নিভৃত-নিজস্ব জলপিদিমেরা। আবার একটা সুরে ভাসতে থাকলো আমার
পাঠ্যপুস্তক-খাতাকলম, গণিতের বইয়ের ভেতর
জমলো অসংখ্য জলময়ূরীর পালক আর সে পালকের জন্যে অপেক্ষা করতে শুরু করলো দারুণ সব
নাচিয়ে পুরুষময়ূরেরা।
ততদিনে আমার বাঁশিওয়ালা বাবা সশরীরে চাঁদের দিকে উড়ে গেলো, তার ঘরে শুধু পড়ে
থাকলো তার খোলস তার দেহ, মায়াবী একটা মেঘের
শরীর। হারাধন বাঁশিটি আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। মাও বললো : ‘ওই বাঁশিতে চড়েই তোর বাবা পাড়ি জমিয়েছে
না ফেরার দেশে।’ হয়তো। হয়তো না। বাবা
আমাকে এসব বিষয়ে কিছু বলে যায়নি। সেদিন সারাদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো -ঝমঝম করে, অপ্সরাদের নৃত্য হয়ে
উঠেছিলো যেন বৃষ্টিরা। আর হিম হাওয়া। বাবার বাঁশি বাজানো শেষ হলে সেই নীল আলো
ক্রমে মিলিয়ে যেতে-যেতে যে রকম ঠাণ্ডা হাওয়া হুমড়ি খেয়ে পড়তো, সে রকম। এরপর আর কখনো
আমাদের বাড়িতে নীল আলো আসেনি। ওই আলো যেন যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা, মাটি ছুঁতো না।
আমার প্রজাপতি ওড়া ব্রিজ থেকে প্রজাপতিরা হারিয়ে গেলো, ওরা কি মরে গেলো সব? বা, কোনো বিস্ময়কর রোগে এই
ব্রীজে আসা প্রজাপতির পুরো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলো? এই কথা ভাবতে-ভাবতে আমি
এখন হাঁটি, এমন বিকেলে হাওয়ায়
পুরুষপাখিরা পাঁজরের হাড় ফেলে যায়, একটি কাঠের চাকা গড়াতে শুরু করে, সে শব্দ শোনা যায়
ক্ষীণ, কিন্তু চাকাটিকে দেখা
যায় না।
-
‘তুই এখনো আগের মতোই
আছিস!’
এই কথাটা শুনলে অদ্ভুত লাগে আমার। আমি? আমি কে? আমি তো একটা চুল্লী। ও ঠিক আমার মগ্নতার
কথা বলবে, বলবে অন্যমনস্কতার কথা, চারপাশ কাগজের নৌকোয়
ভরে উঠবার কথা; তার মধ্য থেকে একা-একা
দাঁড় বেয়ে যাবো আমি চিরকাল। হয়তো কখনো আর এভাবে সূর্য উঠবে না, একটা আলো ফুটে থাকবে
শুধু সারা আকাশ জুড়ে!
শ্যামলীর কথায় আমি হেসে বলি :‘আগের মতোই আছি? আমি তো ভাটির দিকে
সাঁতরে যেতে চেয়েছি আমার বাহুর নিচ থেকে বয়ে চলা নদীতে। অথচ সে নদী-সে নদীর স্রোত আমার সঙ্গে কথা
বলতে চায়, আমার হারানো নাকফুল
খুঁজে এনে দিতে চায়।’
-
‘অদ্ভুত! সাধারণ একটা
কথার এই মানে করলি! বাব্বা! তোর তো নীল জলের নদী...।’
-
‘কাকুর খবর কি?’
-
‘সে তো আছে সেই
টেলিস্কোপ নিয়ে। দিনের পর দিন ধরে চাঁদ দেখে মাতালের মতো করে।’
-
‘ভালো তো।’ আমি বলি।
-
‘হ্যাঁ, আর কি? তোর যেমন শব্দের ঘরে
বসবাস, ব্যথাভস্ম নিয়ে সময় কাটানো!’ বলে কপট দীর্ঘশ্বাস
ছাড়লো শ্যামলী।
আমি মজা পেয়ে বললাম :‘দীর্ঘশ্বাস ছাড়িস না, বেশি কার্বন নির্গত হচ্ছে, অন্যের জন্যে মৃত্যু
ডেকে আনছিস!’ একটা চোখ টিপে দিলাম।
-
‘মনে হলো একটা পাখি উড়ে
গেলো, হুঁশ করে...।’
আমি এবার সত্যি অবাক :‘কোথায়?’ এদিক-ওদিক তাকাই।
-
‘তোর চোখে...।’
মৃদু হাসলাম। গালের তিলটা বুঝি ঘেমে উঠলো! আমি নিঃশ্চুপ, কথাদের মৌনতা হয়ে।
আবার শ্যামলীই জানতে চাইলো :‘নতুন কি লিখছিস? কথা ও কাহিনী...’
-
‘কিছু না, পাথর হয়ে যাচ্ছি ক্রমে, নির্লিপ্তি কাজ করছে, মৌন...। আমি যাবো রে, বৃষ্টি আসবে বুঝি!
বৃষ্টি হলেই কেন জানি আমার মনখারাপ হয়!’
-
‘আয়।’
বেরিয়ে এলাম শ্যামলীদের বাড়ি থেকে। বৃষ্টি হলেই আমার ইদানীং মনখারাপ হয়, কান্না আসে। কেন? আমি জানি না... না, না -আমি মনে-মনে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলি, এমন বৃষ্টির একটা দিনে
একজন আমায় কিছু বলেছিলো, তাই সারাদিন ধরে কালো
মেঘ আমার ভালো লাগে না, কান্নায় উপচে পড়া
আকাশ আমার ভালো লাগে না। মনে হয় কোথাও কেউ একজন কেবলি জলের হারমোনিয়াম বাজিয়ে
চলেছে একা-একা, ঘুরে-ঘুরে। আমার মাথার
মধ্যে কেবলি অমন একটা বৃষ্টির শহর ঘুরপাক খায়, বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে-আলোয় ভিজে যাচ্ছে।
জলে-হাওয়ায়-বর্জ্যে-মগ্নতায়, তারপর রোদ উঠলে হাজার ফড়িঙেরা মাথায় একটা সুবিশাল
ক্ষেতে উড়ে আসে-নামে - ঝিকঝিক করে। আমি ওসব
দেখি আর লিখি। আর ভাবি : জীবন তো খুব ছোট, সব কথা লিখতে পারবো কি?
বাবাও কি যেন লিখতে চাইতো। ঘুম থেকে উঠে মা মাঝে-মধ্যে ডেকে তুলে বলতো
সকালে,
‘দেখ্ সন্ধ্যাতারা, তোর বাবা সারারাত কি
করেছে?’ দেখতাম : বাবা দেয়ালে
কী সব লিখে রেখেছে? সেগুলো কি কথা বা কোনো
গান? কোনো সুর?হারমোনিয়ামের সা চেপে
ধরা? বাবার এতো কাছে-কাছে
থেকেও তা জানতে পারিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাবা কিছুই বলতো না। কেমন একটা
লুকোচুরি করতো!
এসব
ভাবতে-ভাবতে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখলাম। আমাদের বাড়িতে ঢুকতে, বাগান পাশে রেখে যে এক
চিলতে রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয়, ওখানে ইয়া বড় ডানা মেলে একটা বড় প্রজাপতি উড়ে আসছে, পাখা এতো বড় যে পাখির
মতো মনে হচ্ছে। চোখাচোখি হয়ে গেলো আমার ও প্রজাপতিটার। আশ্চর্য! চোখটা যে বড়
চেনা! কে? বাবা?
তুহিন দাস
জন্ম : ১১ জানুয়ারী ১৯৮৩। বরিশাল।
কবি।
গল্পকার।
লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক।
0 মন্তব্যসমূহ