হাড়ের চেয়ার

মুক্তি মণ্ডল

 হাড়ের চেয়ারে বসে আছে কাক। পাশেই কাঠচেরাইয়ের শব্দ। আগুনের লেলিহান শিখা; হাড়ের চেয়ারের পায়ায় পায়ায়। কাক বসে আছে স্থির পাথর। বোবাদৃষ্টি। নিঃশব্দ রাত্রির মাতাল সানাইয়ে চেয়ার দুলছে। হঠাৎ সাপ। নিঃশ্বাস সমুদ্র-নীল। মাটি ফুঁড়ে বের হয়। আগুনের শিখাগুলো গিলে ফেলে। চেয়ারের কাঁপন থামে।


কাক তবুও বসে। একাকী। ভাবনাহীন। সাপটা উঠে আসে চেয়ারে। কাক ও সাপ পাশাপাশি বসে। চেয়ারটা কাঁপনহীন, নিঃশব্দ পড়ে থাকে। চেয়ারে সাপটা নৃত্য করে। কাক নৃত্য দেখে। সাপের নৃত্যের তালে তালে কাকও একসময় নৃত্য শুরু করে। কাক ও সাপের নৃত্যে চেয়ারটাও আগের মত দুলতে থাকে। কাক নৃত্য, সাপ নৃত্য এবং চেয়ার নৃত্য রহমতের বউ ফুলির হাতের আঙুলে খেলা করে। ফুলি কুলোর উপর আতপচাল ঝাড়ে। কুচি কুচি ঢিল, পাথর ও মাটি বেছে বেছে ফেলে দেয়। ফুলির সংসারও তো ঢিল পাথরের মতই-! ফুলি রাগে ফোঁস ফোঁস করে সাপের মত।

এখন আষাঢ় মাস, কাজ কাম নাই। রহমত দোচালা ঘরে বসে বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টির শব্দে রহমত জীবনের হিসেব মেলাতে চায়। হিসেব মেলে না। জীবনের শূন্য খাতায় সবই শূন্য। এবড়ো থেবড়ো কাদামাটির পথের মত রহমত বৃষ্টি দেখে আর ভাবে।

আজ তিনদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আবার শুরু করছে। রহমত এসব দৃশ্য বসে বসে দেখছে। বৃষ্টি তো নয় যেন রহমতের চোখের নোনা জল-
অনার্য ভোরের শিশিরের লাগামহীন পাগলা ঘোড়া।

ফুলির চাল ঝাড়া শেষ। কুলোর চালগুলো ফ্যাকাশে রোগীর মত। রক্ত শূন্য। রোদে পোড়া চাষার হাসির মত; কৃষাণীর ঠোঁটের ভাঙা চাঁদ-। ফুলির রান্না করতে ইচ্ছে করে না। কুলোসুদ্ধ চাল হেঁসেলে রেখে রহমতের পাশে এসে বসে। রহমত খেয়াল করে না। ফুলি বৃষ্টি দেখে না। বৃষ্টির শব্দও শোনে না। পিছন দিক থেকে রহমতের ঘাড়ের গর্দান দেখে। কোঁকড়ানো চুলের এলোমেলো বিন্যাসের রেখায় রেখায় ছুটন্ত ষাড়ের পায়ের ছাপ। ফুলির চোখ এঁটে যায়। কোন কথা বলে না। একহাত দূরে বসে ফুলি অন্যমনা হয়ে যায়।

রহমত বৃষ্টি ধোয়া আকাশে সবুজ শাড়ীর আঁচল খোঁজে। যে শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে যমুনার দস্যি মেয়ে, মেঘনার রাখাল ছেলে লাটাইবিহীন ঘুড়ি উড়ায়, বাঁশি বাজায়, ডাংগুলি খেলে, সাঁতার কাটে - রহমত এসব দেখতে দেখতে বৃক্ষের ডাল-পালায় মিশে যেয়ে বৃক্ষ; মৃত্তিকার রস শোষণে শিশুর স্তন চোষার ভঙ্গিমায় দোল খায়।

ফুলি আস্তে করে ঘাড়ের উপর হাত রাখে। দোল থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ফুলিকে দেখে। আকাশের মত ফুলির দু'ঠোঁটে এখন কোন মেঘ নেই; চাঁদ লুকোচুরি খেলে। রহমত ফুলির হাত ধরে দোচালা ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। ফুলি বলে, "এডা কি করো?" রহমত কোন কথা বলে না। হঠাৎ ফুলির দু'গাল দু'হাতে ধরে একভাবে তাকিয়ে থাকে। ফুলির গা শির শির করে। পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি। এই আশংকায় ফুলি রহমতের চুলে পাগল বশের মন্ত্র দেয়ার মত হাত বুলায় - রহমত এতে আরো বেশি পাগলামি শুরু করে। ফুলিকে শরীরে মিশিয়ে ফেলে।

হাড়ের চেয়ারে কাঠচেরাইয়ের শব্দ। হাড়ের চেয়ারের পায়ায় পায়ায় আগুনের লেলিহান শিখা। চেয়ারে কাক। পাশাপাশি সাপ। কাক ও সাপ নৃত্য করে ...............।

বাইরে তখনও বৃষ্টি; বৃষ্টি থামে না। 







লেখক পরিচিতি
মুক্তি মণ্ডল


কবিতা লিখছেন বহুদিন ধরে মুক্তি মণ্ডল। তিনি লেখেন নিজের অনুভব প্রকাশের জন্য। এক্ষেত্রে তিনি নিজের। তিনি লিখেছিলেন-- অন্যকোনো মাধ্যম জানা না থাকার কারণে তিনি কবিতা মাধ্যমটি বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি আবিস্কার করেছেন--তার কবিতায় এক ধরনের গল্পই থাকে। সেই গল্পের বিস্তারের জন্য কবিতার পাশাপাশি এখন গল্প লিখছেন।
তাঁর জন্ম চুয়াডাঙ্গায়, ১৯৭৬ সালে। একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। প্রকাশিত কবিতার বই : ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো (২০০৮), পুষ্পপটে ব্রাত্যমিনতি (২০০৯), উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি (২০১১)। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ